অন্ধকারে এক চিলতে আলো পর্ব-০৭

0
1330

#অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৭

সে কিছুটা অনিশ্চয়তা নিয়ে তার পাশের রুমটায় দরজা খোলা পেয়ে হালকা উঁকি দিয়ে কিছুটা বিস্মিত হলো।কারণ পুরো রুমটায় পেইন্টিং দিয়ে সাজানো। রুমটা বেশ ফাঁকা আর পরিপাটি । আলো দিশা না পেয়ে রুমটায় প্রবেশ করলো। একে একে সবগুলো পেইন্টিং দেখতে লাগলো। প্রতিটা পেইন্টিং এ কোনো নারী রুপের অবয়ব লুকিয়ে আছে মনে হচ্ছিল। বিস্ময়ের সাথে প্রতিটা পেইন্টিং সে দেখতে লাগল। কী অপরুপ হাতের নিপুণে আঁকা ছবি গুলো। ঘরের এক কোণে একটা গিটার রাখা। বিছানার পাশে ল্যাম্প টা আধু আধু করে এ দিনের বেলাতেও জ্বলছে। ল্যাম্পটার ঠিক পাশে তাজা ফুলগুলো ফুলদানিতে রাখা যা সুভাস ছড়াচ্ছে। ঘরটা বেশ সযত্নে সাজানো বুঝায় যাচ্ছিল। আলো ভাবতে লাগল এটা কী তানভীরের রুম? কিন্তু তানভীরের রুম হলে তানভীর কোথায়? রাবু নানু বলেছিল তানভীর রুমে ঘাপটি মেরে আছে। তাহলে হয়তো এটা তানভীরের রুম না। কিন্তু কার রুম? ভাবতে ভাবতেই আনমনে গিটারটা হাতে নিয়ে তারগুলো টেনে ধরল। তারগুলো টান দিতেই একটা বেসুরা আওয়াজ গিটার থেকে বের হয়ে আসলো। গিটারের আওয়াজটা পেয়েই তানভীর কোথায় থেকে যেন হাজির হয়ে রুমে প্রবেশ করলো। আর আলোর দিকে রুষানলে তাকিয়ে বলল

– এই মেয়ে হুট করে এ রুমে ঢুকেছেন কেন? মা জানলে আপনাকে আস্ত রাখবে না। এক তো এ রুমে ঢুকেছেন তার উপর অনুমতি ছাড়া জিনিসপত্র ধরতেছেন। বাসা থেকে কী কোনো ভদ্রতা শেখায় নি আপনাকে?

তানভীরের কথা শুনে যেন আলোর টনক নড়ল। সত্যিই তো কারও অনুমতি ব্যতীত রুমে প্রবেশ করা অন্যায় তার উপর জিনিস পত্র ধরা তো নেহাত অন্যায়। আলোর মুখটা চুপসে শুকনো হয়ে গেল। আধু আধু কন্ঠে ঢুক গিলতে গিলতে বলল

– দুঃখিত বুঝতে পারে নি। আপনাকে খুঁজতে বের হয়েছিলাম হঠাৎ করে এ রুমে চোখ গেল আর দেখে বেশ অন্যরকম লাগল তাই ঢুকার লোভ জাগল আর ঢুকে পড়লাম। সরি কিছু মনে করবেন না দয়াকরে। এটা সত্যিই ভুল হয়েছে। আচ্ছা এটা কী আপনার রুম?

তানভীর ভ্রুটা কুচকে কর্কশ গলায় বলল

– এত কিছু জেনে আপনার কী হবে? সবকিছুতে শুধু প্রশ্ন করেন। এটা যার ইচ্ছা তার রুম হোক। আপনাকে যে রুম দিয়েছি সে রুমে থাকুন। আর থাকতে চেয়েছেন সেটার ব্যবস্থাও করছি। এত লাফালাফি করলে এ বাসায় থাকা মুশকিল হয়ে পড়বে আপনার জন্য। আপনি বেশ ছটফটে স্বভাবের। ভাগ্য ভালো যার সাথে বিয়ে হয়েছে তাকে আপনি বিয়ে করেন নি। না হয় বেচারার কপালে একটা পাগল জুটত। বের হন রুম থেকে।

আলো তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু তানভীরের কথাগুলো শুনছিল। আর ঢুক গিলতে লাগল। তানভীরের কপালে বিন্দু বিন্দু ইষৎ লোনা ঘাম জমে আছে বৃষ্টি ফোটা কণার মতো। মুখটা বেশ রাগান্বিত হয়ে আছে। আলোর ভয়টা বাড়তে লাগল। তবুও এ ভয় প্রকাশ করে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা যাবে না। কারণ

“দুর্বলতা এমন একটা জিনিস যেটা একবার প্রকাশ পেলে সেটা কাটিয়ে উঠা বেশ কঠিন। কারণ আঘাতের মুখ্যম জায়গা হিসেবে মানুষ তখন সেটাকেই ব্যবহার করে”

তাই আলো নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের কপালেও রাগ এনে জবাব দিল

– এই যে থাকতে দিচ্ছেন তার মানে মাথা কিনে নেন নি? আমার উনি আসলেই চলে যাব। আর আমি ভুল করেছি ক্ষমাও তো চেয়েছি তাহলে এমন কেন করছেন? এত চেঁচিয়ে উঠার কী আছে? আমি কী এ রুমে থাকতে এসেছি নাকি।

বলতে বলতেই আলোর গাল গড়িয়ে চোখের জল বৃষ্টি হয়ে নামতে শুরু করল। এ বিষয়টা বেশ অসচেতন হয়েই হয়েছে। আলো জানে না হুট করে তার চোখ দিয়ে এত অভিমানের জল কেন নেমে আসলো। সে তাড়াহুড়ো করে চোখের জলটা মুছে রুম ত্যাগ করল। তানভীর আলোর কথা শুনে চুপ হয়ে গেল। এতটা বকা দেওয়াও তার উচিত হয়নি। কিন্তু কেন জানি না অতীত মনে হয়ে তানভীরের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। সে চাইলেও নিজেকে সামলে নিতে পারছে না।

“অতীত বেশ ভয়ানক জিনিস। অতীতকে কাটিয়ে নিয়ে সামনে এগুনো গেলেও সেটা ভুলে যাওয়া বেশ দুঃসাধ্য ব্যাপার”

নিজের অজান্তেই সে রেগে যাচ্ছে যেটা একদম অনুচিত। তানভীরের মনে হলো আলোর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। এতটা কঠিন হওয়া তার উচিত হয়নি।

আর এদিকে আলো রুমে এসে ঘাপটি মেরে বসে আছে। নিজের জীবনের কালো অতীত গুলো তাকে যেন আরও তাড়া করছে। যত ভাবেই সে এটা কাটিয়ে উঠতে চাচ্ছে ঠিক ততটাই যেন সব তাকে ঘিরে ধরছে। আলোর কী তানভীরকে মিথ্যা বলাটা আদৌ উচিত হয়েছে। তানভীরকে তো বেশ মননশীলেই মনে হয় আলোর। তাহলে কী সে তানভীরকে সবটা বলে দেবে। এসব ভাবনা মনের মধ্যে আওরাতে লাগল সে। চুপ হয়ে বসে আছে। আনমনে কত চিন্তা আলোকে গ্রাস করছে সে নিজেও জানে না। আলোর বয়স সবে ১৪। এ বয়সের একটা মেয়ের উচিত হেসে খেলে বড় হওয়া। অথচ আলোকে সম্মুখীন হতে হচ্ছে চরম বাস্তবতায়।এ পথের শেষ কী? এর গন্তব্য কী সে জানে না। আচ্ছা নীলা কী গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছে? নীলার ভাবনাটা আবার ঝেঁকে বসলো আলোর মনে। নীলার চোখ গুলো বারবার তার চোখে ভেসে আসছিল। আলো জানে না নীলা কোথায়? এ অন্ধকার গলিতে হারিয়ে গেল নাকি আলোর নিশানায় ছুটে গেল। ইশ নীলার খুঁজ যদি মিলত কত ভালোই না হত। কতশত চিন্তা তার মনে বাসা বাঁধছে। সে সাথে চিন্তা করছে ঐ লোকটা কী মরে গেছে নাকি বেঁচে আছে। কত নির্মম এ দুনিয়া নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে কত হিংস্র হতে হয়। যে আলো মানুষের রক্ত দেখলে ভয় পেত সে আলোই একটা লোককে রক্তাক্ত করে পালিয়েছে। আলো সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে এসবেই ভাবছিল। এমন সময় তানভীর হালকা কাশি দিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। আলোর ভাবনায় ছেদ পড়ল সে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল তানভীর দাঁড়িয়ে আছে। তানভীরকে দেখে আলো মুখটা বাকিয়ে অভিমানের রেখা মুখে ফুটিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। তানভীর আলোর ঠিক কাছে বসে বলল

– শুনুন এভাবে আপনাকে বলা ঠিক হয়নি। সত্যি বলতে রুমটা আমার বড় ভাইয়ের। মা বেশ যত্ন করে রেখেছে। ভাইয়া কিছুটা মায়ের উপর অভিমান করেই বিদেশ চলে গিয়েছিল। এখন পর্যন্ত আসেনি। আর কবে আসবে বলেও না। রুমের যা পেইন্টিং গুলো দেখেছেন সেটাও আমার বড় ভাই করেছে। মা সে রুমটাকে বেশ পরিপাটি করে সবসময় সাজিয়ে রাখে। মায়ের একটা দুর্বল জায়গা ঐটা বলা যায়। আপনাকে যদি আমার জায়গায় মা ঐখানে দেখত বেশ রেগে বসত। আমি আপনাকে ওভাবে বকতে চাইনি তবে রাগের মাথায় বলে ফেলেছি।

আলো তানভীরের কথায় ওপাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল

– আপনার ভাই রাগ করে চলে গেল কেন? আর ফোনে কী কথাও বলে না?

– রাগের কারণ বলতে পারব না।সেটা একান্তই ব্যক্তিগত।বাইরের মানুষকে বলা উচিত হবে না। ভাইয়া সবার সাথেই কথা বলে। তবে দেশে আসতে চায় না। ভাইয়ার অভিমানটা জমিয়ে রেখেছে সেটা বুঝতে না দিলেও আমরা বুঝতে পারি।আপনি আর ঐ রুমে যাবেন না।

তানভীরের কথা শুনে আলো যেন এক রহস্যের জগতে পড়ে গেল।তানভীরের ব্যপারটাও আলোর কাছে এতক্ষণ রহস্যজনক মনে হয়েছিল এখন তার বড় ভাইয়ের বিষয়টাতে বেশ রহস্য পরিলক্ষিত করল। সবকিছু তার জানতে ইচ্ছা করছে। তবে জানতে চাওয়াটা উচিত হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ এতে তানভীর আবার রেগে যেতে পারে। আর আলোর কোনোভাবেই উচিত না তানভীরকে রাগানো। কারণ তাকে এ বাসায় থাকতে হবে নাহয় বাইরে বের হলে আবার কোনো হায়েনার কবলে পড়বে। অনেক কৌতুহল থাকা সত্ত্বেও আলো তানভীরের কথার তেমন কোনো প্রতিউত্তর না দিয়ে শুধু হালকা গলায় বলল

– আমি আর যাব না। তখন আমাকে এভাবে বললেও যেতাম না। তবে হুট করে ধমক দিয়েছেন তো তাই মন খারাপ হয়ে গেছিল।

– হুম বুঝতে পরেছি। নাস্তা করেছেন? রাবু খালা কী নাস্তা দিয়েছেন?

– হ্যাঁ দিয়েছেন।আচ্ছা আপনি রাবু নানুকে খালা কেন ডাকেন? শুনেছি আপনার মাকে উনি খালা ডাকে তার মানে আপনার মায়ের খালা উনি। তাহলে রাবু নানু আপনার খালা হয় কী করে। সম্পর্কটা গরমিল করে ফেললেন না?

তানভীর নিজের জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল

– সত্যিই তো ঠিক বলেছেন। এখন থেকে তাহলে আমিও নানু ডাকব।এ বিষয়টা আমার নজরে আসে নি। যাক বিষয়টা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। তার জন্য আপনাকে একটা গিফট দেই কী বলেন?

আলো ছটফট গলায় জবাব দিল

– কী গিফট দিবেন? আর আমার কিছু লাগবে না।

– এমন কিছু দিব না যেটা আপনি নিজের কাছে রাখতে পারেন। গিফট হিসেবে আমি আপনাকে আমাদের ছাদে নিয়ে যাব।

– আপনার সাথে ছাদে যাব না। দেখা গেল ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে রাগের মাথায় ফেলে দিবেন তারপর আবার সরি বলবেন।

আলোর এমন কথায় তানভীর জোরে হেসে দিয়ে বলল

– বেশ মজার কথা বলেন আপনি। আপনার প্রেমিক আপনাকে সামলায় কী করে কে জানে। যাইহোক ধাক্কা দিয়ে আপনাকে মেরে জেলের ভাত খাব না। এমনিতে একবার জেলে গিয়ে শিক্ষা হয়ছে।

শেষের কথাটা শুনে আলো অবাক হয়ে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে বলল

– আপনি কী এর আগে খুন করেছেন?

– মানে?

– এই যে বললেন জেলে গিয়েছিলেন। তাই জিজ্ঞেস করলাম।

– আরে আপনি তো বেশ বোকা। খুন করলে কেউ ছাড়া পায় নাকি। জেলে গিয়েছি অন্য কারণে। কোনো একদিন বলব। এখন আপনি কী যাবেন আমার সাথে নাকি রুমেই থাকবেন।

তানভীরের কথা শুনে আলো যেন রহস্যের বেড়াজালে আটকে যাচ্ছিল। তবে এ মুহূর্তে সে ছাদে যাওয়ার লোভটাও সামলাতে পারছে না। লাজুক সুরে জাবাব দিল

– এত করে যখন বলছেন তাহলে তো যাওয়ায় যায়।

এরপর বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। ছাদের দিকে যাওয়ার জন্য রওনা দিল সে। ছাদের ঠিক কাছে গিয়ে গেটটার সামনে দাঁড়াল দুজন।গেটটা তালা দেওয়া। গেটের চাবি তানভীরের কাছে। তানভীর চাবিটা বের করে গেটটা খুলল। গেটটা খোলার সাথে সাথে এক ঝলক আলোক রশ্নি এসে আলোর মুখের থুবরে পড়ল। সে সাথে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে