অন্তরালের সত্যি পর্ব – ০৭ (শেষ পর্ব)

0
1978

#অন্তরালের সত্যি
#নুরুন্নাহার তিথি
#পর্ব-৭

এরিমধ্যে সানজি কাকির ব্রেস্ট টিউমার থেকে ক্যান্সার হয় তা আমাদের জানিয়েছেন যখন লাস্টের দুইটা কেমোথেরাপি বাকি তখন। আমাদের থেকে চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছেন। দাদা, বাবা ও ছোটকাকা দুইটা কেমো দেয়ার জন্য অর্ধলাখ টাকা পাঠায়। এরপর আর যোগাযোগ করেননা তারা। চিকিৎসার জন্য টাকা চেয়েও যোগাযোগ করেন প্রায় দুই বছর পর। আমাদের বাড়িতে কখনো এমনিতেও বেড়াতে আসতেননা বলতে গেলে। আসলেও আমরা যদি থাকতে বলি তো থাকতেননা। এরজন্য দাদা-দাদী ও আমাদের সানজি কাকি ও তার ছেলেদের প্রতি টান হারিয়ে গেছে বলতে গেলে। শুনেছি ফুফির কাছ থেকেও আর্থিক সহোযোগিতা নিয়েছেন চিকিৎসার জন্য। সানজি কাকির ভাই ও বাবার ভাষ্যমতে,

“চিকিৎসার খরচ তোর শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও দিবে। আমরা একা কেনো দিবো?”

সানজি কাকি সুস্থ হয়েছেন কিনা তা জানার জন্য দাদী ও মা তাদের এক-দুইবার ফোন করেছিলেন কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করেননি আর না কল ব্যাক করেছেন!

এরপর ২০১৭ সালের রোজার ঈদের পর আমার দাদীরও ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পরে। দাদীকে কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছিল। দুই-তিনটা দেয়ার পরেও দাদী সুস্থই ছিলেন। দাদীর মনের জোর ছিল। শুধু মাথার চুল, নখ কালো হওয়া ও খাওয়াতে অরুচি এগুলোই সাইড এফেক্ট ছিল।
মনের জোর সবচেয়ে বড় জোর। মনের জোর না থাকলে সামান্য জ্বরও মানুষকে কাবু করে ফেলতে পারে।

_______
২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাস। আমাদের স্কুলের ৫০ বছরের মিলনায়তনে আমার দাদা, বাবা, ফুফি, ছোটকাকা, আমার বোন, আমি সহ আমার ফুফাতো ভাইয়েরা ফুফির সাথে আসে। ফুফাতো ভাইয়েরা এই স্কুলে না পড়লেও মায়ের সুবাদে ওরা আসে।
সেদিন নাকি আমার ফুফাতো ভাইদের ও আমার বোন তারিনের সাথে বড়কাকার দেখা হয়। তাদের সাথে কথাও বলেন বড়কাকা। আমার ছোটকাকা অর্পার সাথে বড়কাকার ছাড়াছাড়ি হবার পর আর আমাদের বাঁধা দেননি আর বড়কাকার সাথে কথা বলতে। আমার সাথেও দেখা হয়েছিল এরপর তিনি কেমন আছেন সেগুলো জিজ্ঞাসা করি আর দাদীর ক্যান্সারের কথা জানেন তিনি সেদিন।

ছোটকাকার ভয় ছিল যে, অর্পা বড়কাকাকে কোনো ক্ষতি করতে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। তাই ছোটকাকা শাহিন আমাদের আড়ালে রাখতে চাইতেন। ছোটকাকা তার জায়গায় সঠিক ছিলেন একদিক দিয়ে কারন অর্পা ও অর্পার পরিবার কতোটা নিচু মানসিকতার তা সকলেই জানতেন।

বড়কাকার সাথে আমার মিলনায়তনে দেখা হয়নি। মিলনায়তনের ৬ দিন পর সন্ধ্যার মাগরিবের নামাজের সময় দাদীর ফোনে কল আসে। দাদী ফরজ তিন রাকাআত নামাজ পড়ে কল রিসিভ করলেন। দাদীর ফোনে কথা কিছুটা লাউডে শোনা যেতো কারন ফোনটা বাটন ফোন ছিল। দাদী ফোন রিসিভ করার পর অপরপাশ থেকে কান্নার শব্দ আসছিল। ততোক্ষণে আমার নামাজ শেষ। আমি জায়নামাজে বসে দাদীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ফোনের কথাগুলো খুব হালকা আমি শুনছিলাম তাও পুরোপুরি বুঝতে পারিনি।
দাদী কয়েকমিনিট পর কোনো কথা না বলে ফোন রেখে দিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে যে ঢেকে নামাজ পড়তেন সেটা দিয়ে চোখ মুছে আবারো নামাজ পড়তে থাকেন। আমি কিছু বুঝতে না পেরে দাদীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দাদী নামাজ পড়ছেন আর তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমি এমতাবস্থায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম দাদীর মনে হয় ব্যাথা হচ্ছে।

জায়নামাজ ছেড়ে দৌড়ে মাকে ডাক দেই। মায়েরো তখন নামাজ শেষ। মা দাদীর কথা শুনে দাদীর কাছে এসে দেখেন, দাদী কাঁদছেন আর নামাজ পড়ছেন। এদিকে ফোনও বাজছে। এবার আমি ফোন রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দেই। নাম্বারটা অচেনা নাম্বার ছিল। অপরপাশ থেকে কান্নার শব্দ আসাতে আমি ও মা বুঝতে না পেরে চুপ করেই থাকি। তখন সানজি কাকি ফোনের অপরপাশ থেকে বললেন,

–মা আপনার ছেলে আর নাই। নাই মা। আপনার ছেলে ম*রে গেছে।

আমি ও মা একে অপরের দিকে তাকিয়েছিলাম। আমার মা সানজি কাকির ভয়েস চিনতে পারেন তখন। তারপর মা বলেন,

–সানজি বলছো? কি হয়েছে?

সানজি কাকি তখন কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
–ওহ ভাবী! আপনার দেবর আর নাই। সে এখন আইসিউতে আছে। যেকোনো সময় ম*রে যাবে। ভাবী আমি বিধবা হয়ে গেলাম। শাহিনকে জানাইছি। শাহিন হাসপাতালে আসতেছে।

সানজি কাকি এটা বলার পর আমি দাদীর দিকে চেয়ে দেখি দাদী মোনাজাতে কাঁদছেন। উনি এমনিতে ক্যান্সারের রোগী। এটা সানজি কাকি জানতেন কারন কাকি কোন ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন তা জানতে আমার মা সানজি কাকিকে ঈদের পর ফোন করেছিলেন। তখন সানজি কাকি জানেন দাদীর ক্যান্সারের কথা।
আমার মা ফোন কেটে তৎক্ষণাৎ ছোটকাকাকে ফোন করেন। আমার বাবাকে মা জানাননি তখনো। আমার মা দাদীর রুম থেকে নিজের রুমে চলে যান কারন দাদা মসজিদ থেকে এসেছিলেন।

ছোটকাকাকে ফোন করলে ছোটকাকা বলেন,
–মেঝোভাইকে আইসিউতে রাখা হয়েছে। এখনো ডাক্তার জানায়নি কিছু। আমি গাজিপুর থেকে আসতেছি। আম্মাকে জানাইয়েন না। আম্মা অসুস্থ আরো অসুস্থ হয়ে যাবেন।

আমার মা বলেন,
–সানজি সবার আগে আম্মাকেই জানাইছে। আম্মা নামাজের মধ্যে কাঁদছেন এখন।

ছোটকাকা রাগে বলেন,
–এর থেকে আর কি আশা করা যায়! বড় ভাইয়েরে আমি বলতেছি বাসায় যেতে। আম্মার কাছে যেতে।

ফোন রেখে দিলেন ছোটকাকা। আমার বাবা তার পাঁচমিনিট পর ফোন করেন মাকে। তারপর বলেন,
–আমি বাসায় আসতেছি। তুমি আম্মার কাছে যাও আর তিহাকে বলো ওর ছোটমামাকে বাসায় আসতে বলতে। আমার পরশু মার্কশিট জমা দিতে হবে। আমি তিহার ছোটমামাকে কাজ বুঝিয়ে ঢাকা যাবো। আসতেছি আমি।

মা দাদীর কাছে গিয়ে দেখেন দাদী কোরআন পড়তেছেন। দাদীকে মা পাশ থেকে জড়ায় ধরলে দাদী বললেন,

–তুই চিন্তা করিস না তিহার মা। আমি ঠিক আছি। আমারে নিয়া তোরা চিন্তা করিস না। আল্লাহ্ তো আমারে নিবেন না!

আমি ও তারিন গিয়ে দাদীর পাশে বসে দাদীর সাথে তবজি পড়ছিলাম আর মা দাদীকে আগলে বসে ছিলেন।

এরপর ছোটমামা আসার পর বাবা আমাকে ও ছোটমামাকে রেজাল্টশিটের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে দাদীর সাথে অনেকক্ষন বসে থেকে মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। তখনো খবর আসেনি বড়কাকার কি অবস্থা। সানজি কাকি আগেই না হওয়ার আগেই সবাইকে মা*রা যাবার খবর দিয়ে দিয়েছিলেন। তারিন দাদীর কাছে বসে ছিল আর আমি ও মামা বাবার কাজ করছিলাম।
এরপর কিছু রাস্তা যাবার পর বাবা ও মা ফিরে আসেন। বাবা তখন কাঁদছিলেন। মা বাবাকে ধরে এনে ফ্যানের নিচে বসিয়ে পানি খাওয়ান। তারা কিছু রাস্তা যাবার পর খবর পান বড়কাকা মারা গেছেন আর সবাই লাশ নিয়ে আসছেন। দাদাকে তখনো কেউ কিছু জানায়নি। দাদা নিজের মতো নামাজ পড়ে কোরআন পড়ছিলেন। দাদীও দাদাকে এখনি জানাতে মানা করাতে আমরা কিছু বলিনি তখন।

আমি বেশি ভয়ে ছিলাম দাদী ও বাবাকে নিয়ে। বাবা বাসায় এসে নিজেও রেজাল্টশিটের কাজ করা শুরু করেছিলেন আর তার হাত কাঁপছিল। আমার মনে তখন আরো প্রিয়জন হারানোর ভয়।

রাত ৯.৩০ টার পর বড়কাকার লা*শ নিয়ে এম্বুলেন্সে করে আসলেন। ছোটকাকা সবার আগে বাসায় এসে দাদীকে ধরলেন। দাদী তখন আরো নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। দাদা তখন উনাদের দিকে তাকিয়ে বলেন,

–কি হয়েছে?

ছোটকাকা তখন দাদাকে ধরে নিয়ে যান নিচে। দাদা বারবার জিজ্ঞাসা করছিলেন কি হয়েছে কিন্তু ছোটকাকা ও বাবা কোনো জবাব না দিয়ে বড়কাকার কফিনের কাছে নিয়ে যান। বড়কাকার কফিনের চাদর সরানোর পর দাদা তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে যান ও “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিওন” পড়তে থাকেন।

সানজি কাকি তখন দাদার কাছে কাঁদতে কাঁদতে এসে বলেন,
–বাবা আপনার ছেলে আর নাই। আমি বিধবা হয়ে গেলাম। আমার ছেলেরা এতিম হয়ে গেল।

দাদা তখন সানজি কাকির মাথায় হাত রেখে উপরে উঠে চলে যান নিজে একাই। দাদারো কস্ট হচ্ছিলো কিন্তু তিনি শক্ত ছিলেন। আমাদের সকলের আফসোস আর দোয়া করা ছাড়া কিছুই করার ছিলনা।

★বড়কাকা হার্ট এ্যাটাক করে মারা গেছিলেন। তার হার্টে ব্লক ধরা পরেছিল যা সানজি কাকিরা জানতো কিন্তু আমাদের জানায়নি। তারা না জানালে আমরা জানতেও পারতাম না কারন বড়কাকার মোবাইল নাম্বার আমাদের কাছে ছিল না। আর যেদিন মারা গেলেন সেদিন দুপুরে বড়কাকা সানজি কাকিদের বাড়ির নিচে গিয়েছিলেন তখন রনিকে একটু আদর করে পানি খেতে চেয়েছিলেন। রনি তার মাকে গিয়ে বলার পর সানজি কাকি বড়কাকাকে ভেতরে আসতে বলেন আর পানি দেন। এক ঢোক পানি খাবার পর আর পানি খেতে পারেননি বড়কাকা। তখন বমি করে দিয়েছিলেন।★

বড়কাকাকে তারা হাসপাতালে নেওয়ার পরে বড়কাকার সেন্স ফিরলে বড়কাকা শুধু এটুকু বলেছিলেন,

–তোমাদের সাথে অনিচ্ছাবশত অন্যায় করে ফেলিছি। মাফ করে দিও। সাথি(সানজি কাকির ছোট বোন) আমার মনে হচ্ছে বার্থরুম হবে। তোমরা একটু এখান থেকে বাহিরে যাও।

এরপর একঘন্টা ভালো ছিলেন। তারপর আসরের নামাজের অনেকক্ষন পর ডাক্তার আইসিউতে নেন তাকে। এরপর মাগরিবের সময় ডাক্তার যখন জানান, অবস্থা খারাপ। তখন সানজি কাকি ছোটকাকাকে ও দাদীকে জানান।

পরেরদিন বড়কাকাকে দাফন করার পর বড়কাকার বড় ছেলে শাহাদাতের জেএসসির রেজাল্ট দেয়। সানজি কাকির পুরো পরিবার শাহাদাতের রেজাল্টে মহাখুশি। বাসায় মিষ্টিও নিয়ে আসেন সানজি কাকির বাবা। এরপর শাহাদাত ও রনি বিকেলে তার নানার সাথে ফিরে যাবে। আসলে শাহাদাত তার বন্ধুদের ট্রিট দেয়ার জন্য তার নানাকে একপ্রকার পা*গল বানিয়ে রেখেছিল। শাহাদাত যাওয়ার সময় আমার বাবার এন্ড্রোয়েড ফোনটা চু*রি করে নিয়ে যায়।

প্রথমে সেটা আমার দাদাই দেখেন কারন দাদা সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন আর শাহাদাত নামছিল তখন দাদা শাহাদাতের হাতে দুইটা ফোন দেখেন যা শাহাদাত দাদাকে দেখে ফোন দুইটা লুকিয়ে ফেলে। দাদা তখন বাসায় আসেন। শাহাদাতরা চলে যাবার পর বাবা যখন তার ফোন খুঁজে পাচ্ছিলেন না তখন দাদা শাহাদাতের কথাটা বলার পর সানজি কাকি কান্না শুরু করেন যে তার ছেলে এমন করতেই পারেনা।

তারপর বড়কাকার চারদিনের খাওয়ানোর দিন শাহাদাত আসেনা। তখন সবার সন্দেহ সত্য হয় আর ফোনের লোকেশন ১৪ দিন পর ট্র্যাক করে জানা যায় ফোনটা ১৪ দিন পর মিরপুরের দিকে একবার ৫ মিনিটের জন্য ওপেন করা হয়েছিল। সানজি কাকি আমাদের বাসায় ২৭ দিন ছিলেন তারপর তার বাবা এসে তাকে নিয়ে যান। বলেছিলেন আবার আসবেন কয়েকদিন পর কিন্তু আসেননি।

পরাশিষ্টঃ
আমার দাদীর ক্যান্সারের সব চিকিৎসা শেষ হয়ে গিয়েছিল। দাদী অনেকটা সুস্থও হয়ে গেছিলেন। তারপর বড়কাকার মৃত্যুর সাড়ে ৮ মাস পর দাদী মা*রা যান। দাদীর মৃত্যুর দুই মাস আগে থেকে দাদীর রক্তস্বল্পতার সমস্যা ও একমাস আগে তিনি নিজের সব সেন্স হারিয়ে ফেলেছিলেন। টানা একমাস আমার মা দাদীকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলেন।
সানজি কাকি যে বড়কাকা মারা যাবার ২৭ দিন পর আমাদের বাড়ি থেকে যাবার পর দাদীর অসুস্থতার খবরে আসেননি। মুত্যুর খবরে আসেন তবে সেটা দাদীর মুত্যুর চারদিনের অনুষ্ঠানে তার দুই ছেলে ও তার বাবাকে নিয়ে।
সেদিন দাদার কাছে সম্পত্তি চাইলে দাদা বলেছিলেন,

–আমি ওদের সম্পত্তি দিবো তবে এখন না। আর শাহাদাত তো চোর হয়ে গিয়েছে। আমরা প্রমান পেয়েছি সেটার। এখান থেকে তো ভালো মানুষ করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। যাইহোক, আমি একটা জমি নিয়ে ঝামেলা চলছে যা জলদি ঠিক হবে সেটা ওদের দিবো। আর কিছু বলবেন না দয়া করে।

এরপর বর্তমানে সানজি কাকি বছরে একবার করে আসেন আমাদের বাড়িতে আর দাদা এখনো জীবিত আছেন।
অর্পার বাবা মারা যাবার পর ওদের পরিবার কোথায় গেছে সব বেচে তা জানা যায়নি তবে অর্পার একটা প্রতিবন্ধী বাচ্চা হয়েছে তার দ্বিতীয় বিয়েতে এটা অর্পাদের প্রতিবেশিরা জানিয়েছিলেন।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে