অনুভূতি পর্ব ৫২ (শেষপর্ব)

1
2711

অনুভূতি
পর্ব ৫২ (শেষপর্ব)
মিশু মনি
.
৮৫.
ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। সেইসাথে ঠাণ্ডাও লাগছে বেশ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে,ঝরো বাতাস ও বইছে। লোডশেডিং চলছে বলে পুরো বাড়িতে যেন আজ খুব তাড়াতাড়ি ই রাত নেমেছে। রাতের খাবার শেষ করে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে সবাই যার যার ঘরে শুতে গেলো। পূর্ব,আরাফ ও সায়ান একসাথে রুমে টুকটাক ড্রিংস করছে। মেঘালয় অন্ধকারে নিজের রুমে শুয়ে আছে।

মিশু ওর মা ও ছোটবোনের সাথে বসে কথা বলছিলো। ওরা শুয়ে পড়ার পর রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে চুপিচুপি মেঘালয়ের রুমে আসলো। বিকেলে মেঘালয় ওর বন্ধুরা মিলে বাইরে গিয়েছিলো কি সব কেনাকাটা করতে। ফিরেছে রাত্রিবেলা। ওর ফোন মিশুর কাছে ছিলো বলে আর কোনোভাবে কথাও হয়নি। রাতে খাবার টেবিলে বসেও কথা বলতে পারেনি, সবাই ছিলো সেখানে। খাওয়াদাওয়ার পর সব ডেকোরেশন আর দাওয়াতের কার্ড সবখানে পৌছেছে কিনা এইসব নিয়ে কথাবার্তা চলেছে বাবা আর ওদের সবার মাঝে। মিশু একটু সুযোগ পায়নি মেঘালয়ের সাথে কথা বলার। এখন সবাই শুয়ে পড়েছে, এটাই মোক্ষম সুযোগ।

মিশু আস্তে আস্তে মেঘালয়ের দরজায় এসে ধাক্কা দিলো। দরজা খোলাই ছিলো। মেঘালয় পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলো মিশু ওর রুমে একবার আসবেই। তাই দরজা খোলা রেখেই শুয়ে পড়েছে। মিশু দরজায় ধাক্কা দিতেই ও মিশুর উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুমানোর ভান করে শুয়ে রইলো। মিশু দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আবার দরজা লাগিয়ে দিলো। ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে বিছানার কাছে এগিয়ে গেলো মিশু।

মেঘালয় খুব শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে মায়া হলো মিশুর। কত মায়াবী একটা মুখ! অথচ এই ছেলেটাকে কতদিন ধরে কষ্ট দিয়েই এসেছে ও। এসব ভেবে আবারো অনুতপ্ত হলো ও। মেঘালয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিলো একবার। তারপর নিচু হয়ে মেঘালয়ের কপালে আলতো চুমু এঁকে দিলো। মেঘালয় খুব গভীরভাবে অনুভব করলো মিশুর স্পর্শ। শরীর শিউরে উঠলো ওর। কিন্তু তবুও চুপ করে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলো। একটুও নড়লো না। ওকে ঘুমাতে দেখে আর জাগালো না মিশু। প্রায় বছর খানেক হয়ে গেলো কতবার এই ছেলেটার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে ও! অথচ মনেহচ্ছে কখনো বোধহয় কাছেই পায়নি ওকে। ভালোবাসার অনুভূতি গুলো এমন কেন? প্রতিটাদিন ই শুধু নতুন নতুন অনুভূতি কাজ করে ভেতরে।

মিশু অনেক্ষণ অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলো মেঘালয়ের দিকে। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ওর ঘুমন্ত দেহটাকে একবার ভালোকরে দেখে নিলো ও। চাদরটা গায়ে টেনে দিলো ভালোমতো। আরো একবার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে চেয়ে রইলো নিশ্চুপ হয়ে। মেঘালয়ের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো। ও হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো “চোর চোর” বলে। আচমকা ওর চিৎকার শুনে ভয়ে আঁৎকে উঠলো মিশু। ফোনটা পড়ে গেলো হাত থেকে। ও মেঘালয়ের মুখ চেপে ধরে বললো, “এই এই আমি আমি।”

মেঘালয় চুপ করে গেলো কথাটা শুনে। মুখ থেকে মিশুর হাতটা সরিয়ে বললো, “তুমি! এতরাতে? আমিতো ভেবেছিলাম চোর। কেমন হতো যদি সবাই এসে তোমাকে উরাধুরা মাইর শুরু করে দিতো?”

মোবাইল টা হাত থেকে মেঝের উপর পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। ফ্ল্যাশলাইট ও নিভে গেছে। অন্ধকারে কাছ ঘেষে বসে আছে দুজনে। মিশু আস্তে আস্তে বললো, “আমিতো ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে এসেছিলাম। লাইট হাত থেকে পড়ে নিভে গেছে।”
-“এতরাতে কেন? কেউ দেখলে কি ভাব্বে?”
-“যা খুশি ভাবুক।”
-“কি জন্য এসেছো সেটা বলো?”

মিশু আচমকা মেঘালয়কে জড়িয়ে কেঁদে ফেললো, “মেঘ আমায় মাফ করে দিবা না? আরো কতক্ষণ এভাবে থাকবা?”

মেঘালয় কর্কশ স্বরে বললো, “এসব কি হচ্ছে? মাঝরাতে এরকম ন্যাকামির কোনো মানে হয়? যাও গিয়ে ঘুমাও।”

মিশু হুট করেই মেঘালয়ের মুখটা ধরে ওর ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁটের ভেতর নিয়ে নিলো। মেঘালয় আচমকা আক্রমণে কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। মিশু বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর মুখটা ছেড়ে দিয়ে বললো, “আমায় ভালোবাসো মেঘ। প্লিজ, আগের মত হয়ে যাও।”
-“ভালো আবার কিভাবে বাসতে হয়?”
-“মেঘ,একটু আদর করবে আমায়?”
-“সেদিন রাতে বলেছি তো আর কক্ষনো ছুঁয়েও দেখবো না। মেঘালয় যা বলে সেটা করেই ছাড়ে। আজীবন এভাবেই সংসার করবা,কক্ষনো টাচ ও করবো না।”
-“কি বলো এসব? এত রাগ? প্লিজ এভাবে অভিমান করে থেকোনা। আমি তো তোমার ই মেঘালয়। শুধু তোমার। একটু ভূল না হয় করেই ফেলেছি, তাই বলে এভাবে আমায় কষ্ট দেবে?”
-“আমি কাউকে কষ্ট দিচ্ছি না। যার কর্মফল সে নিজেই ভোগ করছে। ভাগ্যিস ভূলটা তাড়াতাড়ি বুঝতে পেরেছে, দাগ যত গভীর হতো, তার কষ্টটাও তত বেশি হতো। মানুষের বিবেক তাকে ঠিকই একসময় দহন করে।”
-“মেঘ, সরি।”

মিশু মেঘালয়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে। কেঁদেই চলেছে মেয়েটা। তবুও মেঘালয় ওকে স্পর্শ করলো না। বরং খুব শান্ত গলায় আর ধীরেধীরে বুঝিয়ে বলতে লাগলো, “মিশু। আজকে দুটো কথা বলি তোমায়। মানুষের মন কখন কিভাবে বদলায় সেটা কেউই বলতে পারেনা। আজকে এখন আমরা যা দেখছি সকাল হতেই তার বিপরীত কিছুও দেখতে পারি। কার মাঝে কখন কি অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে যায় কেউই বুঝতে পারেনা। কিন্তু সবসময় একটা কথা মনে রাখবা, আমি যেটা করছি এটা কার মধ্যে কেমন প্রভাব ফেলবে? আমার আচরণটা কে কিভাবে নেবে? সহ্য হবেতো সবার?”

মিশু কিছু বললো না। ওর কান্না বেড়ে গেলো। ও শক্ত করে মেঘালয়ের হাত চেপে ধরে রেখেছে। মেঘালয় বললো, “যদি এটা চিন্তা করো তাহলে দেখবে কেউই কষ্ট পাবেনা তোমার থেকে। আর তুমি কোনো ভূল কাজও করতে পারবে না। আর যদি একান্তই নিজের দিকটা ভাবো তাহলে পারিপার্শ্বিক দিকগুলো অবশ্যই প্রভাবিত হবে তোমার দ্বারা। ব্যাপারটা এমন, তুমি শুধুমাত্র নিজের সুখের কথা ভেবে কিছু করতে গেলে তোমার আপনজন রা তোমার কাছ থেকে আঘাত পাবে।এটাই স্বাভাবিক।”

মিশুর চোখের জলে মেঘালয়ের কোল ভিজে যাচ্ছে। তবুও মেঘালয় ওর চোখ মুছে দিলো না। বললো, “আমরা কত অদ্ভুত প্রজাতি ভাবতে পারো? কেউ কাউকে কখনো পুরোপুরি জানতে পারিনা। যেমন আমি এখনো তোমাকে পুরোপুরি চিনতে পারিনি। অথচ তুমি আমাকে অনেকটাই চিনে গেছো কারণ আমি কেবলমাত্র তোমাকেই আমার সবকিছু উৎসর্গ করে দিয়েছি। তবুও আমি কি বদলাতে পারিনা? আমিও বদলাতে পারি।”

মিশু কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, “তুমিও বদলে যাবে?”

মেঘালয় উত্তর দিলো, “আমি তো শুধু নিজের কথা ভাবছি না। আশেপাশে সবকিছুতে প্রভাবটা কেমন পড়বে সেটা চিন্তা করছি। আর বদলানো টা স্বাভাবিক সবার পক্ষে। কারণ মানব মন বড় অদ্ভুত। আমার এক দূর সম্পর্কের মামার দশ বছরের সংসার। খুব সুখের সংসার, অথচ হুট করেই মামি আমার মামা আর বাচ্চাকাচ্চা সবাইকে ফেলে আরেকজনের হাত ধরে চলে গেলো। কত অদ্ভুত না? একটা কাজিনের প্রায় চার বছরের সংসার। ভালোই চলছিলো। কোনো কারণ ছাড়াই সেদিন নাকি ওর হ্যাজব্যান্ড ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে।”

মিশু অবাক হয়ে বললো, “এমন কেন হয়?”

মেঘালয় বললো, “ওইযে বললাম শুধুমাত্র নিজের সুখের কথা ভাবা। মামি যদি স্বামী, সন্তানদের উপর কেমন প্রভাব পড়বে সেটা ভাবতেন তাহলে কখনোই ওভাবে চলে যেতে পারতেন না। আর দুলাভাই যদি আপুর কথা চিন্তা করতো, আর যদি ভাবতো এই মহিলাকে এখন সবার কাছে কতটা লাঞ্চিত হয়ে সমাজে থাকতে হবে। এসব পারিপার্শ্বিক ব্যাপারগুলো কেমন প্রভাবিত হবে সেটা চিন্তা করলে দুলাভাই কখনো ডিভোর্স দিতোনা আপুকে। যে বদলায়,তার বিবেকবোধ কাজ করেনা ঠিকভাবে। সে ভাবে আমি যা করছি সেটাই ঠিক। অবশ্য প্রত্যেকেই যার যার কাজ ঠিক মনে করে। তোমার দিক থেকে তোমার কাজটাই ঠিক,আমার দিক থেকে আমার টা ঠিক।”

মিশুর কান্না থেমে গেলো। ও বললো, “হুম। শুধুমাত্র নিজের কথা ভাবলে এমনই হয়। কিন্তু যে সম্পর্কে দুজনই পারিপার্শ্বিক সবকিছুই চিন্তা করে,সবকিছুই বুঝে তবুও সেগুলো কেন আলাদা হয়। তারা কি জানেন না এরপর লোকজন কতটা সমালোচনা করবেন ওনাদের নিয়ে? সবকিছু জেনে বুঝেও কেন আলাদা হয় অনেকে?”

মেঘালয় হেসে বললো, “পরিবর্তনের সূচনা যেখান থেকে শুরু সেখানেই যাও। শুরুতে কেউ না কেউ কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে অপরজনের কথা না ভেবেই একটু একটু করে বদলে গেছে। অপরজন সহ্য করতে করতে আর পারছিলো না। এরপর শুরু হয় ঝগড়া, কথা কাটাকাটি, মতের অমিল,একে অপরের উপর বিরক্ত হয়ে যাওয়া তারপর বিচ্ছেদ। আজকাল মানুষ গুলো বড্ড বেশি স্বার্থপর।”

মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “সবাই যদি এভাবে ভাবতো। তুমি দূরে গিয়ে যেমন আমাকে উপলব্ধি করার সুযোগ দিয়েছো সবাই যদি এমন করতো।”
-“হা হা হা। সবার তো ভালোবাসা এক রকম না। তুমি আমাকে সত্যিই ভালোবাসতে বলে আমার শূন্যতা তোমাকে পুড়িয়েছে। যে আমাকে ভালোবাসবে না, আমি দূরে যাওয়া কেন আমি মরে গেলেও তার বিন্দুমাত্র খারাপ লাগবে না।”

মিশু মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমি কিন্তু তোমাকে না পেলে পাগল হয়ে যেতাম।”
-“আচ্ছা, যদি আমি দূরে গিয়ে কোনো এক্সিডেন্টে মরে যেতাম?”

মিশু মেঘালয়ের মুখের উপর হাত রেখে বলল, “ছি এসব কেন বলো? আর কক্ষনো বলবা না। তবে সত্যি সত্যিই তুমি যদি কোথাও হারিয়ে যেতে আমি পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম।”

মেঘালয় আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। জড়িয়ে ধরলো মিশুকে। কতদিন পর মেঘের স্পর্শ পেয়ে অন্যরকম এক সুখ এসে স্পর্শ করে গেলো মিশুকে। বাইরে বৃষ্টির তোড় বেড়েই চলেছে। অন্ধকারে অনেক্ষণ একে অপরকে জড়াজড়ি করে বসে রইলো। তারপর মেঘালয় বললো, “এবার রুমে যাও। অনেক রাত হয়েছে। আর তো মাত্র কটা দিন, তারপর আজীবন আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে।”
-“মেঘ,আমার মনেহচ্ছে আজকে সুখেই আমি মরে যাবো ”

মেঘালয় আরেকবার মিশুকে বুকে চেপে ধরে বললো, “আমাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার ক্ষমতা তোর নেই। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া।”

মিশুও স্বীকার করে সে কথা। ওর কান্নারা আজ বাধ ভেঙেছে যেন। কিছুতেই চোখের জল আটকাতে পারছে না। বুকটা ফেটে যেতে চাইছে। একদিকে মেঘালয়কে দূরে সরে যাওয়ার পর কাছে পাওয়ার আনন্দ,আরেকদিকে নিজের অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়া। আনন্দ ও বিষণ্ণতা একসাথে কাজ করছে ভেতরে। ও মেঘালয়ের বুকের ভেতর ঢুকে যেতে চাইছে, বুকে মুখটা গুঁজে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে ওকে। মেঘালয় ও মিশুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে রেখেছে। আজ বাইরেও বৃষ্টির জলে জগতের সব পাপ আর অনুশোচনা যেন নির্বাসিত হয়ে যাচ্ছে।

মিশু মাথা তুলে মেঘালয়ের মুখটা ধরে ওর নাকের সাথে নাক ঘষলো। মেঘালয় ও হুট করেই যেন ছোট্ট বাচ্চা হয়ে গেছে,মিশুর সমস্ত চুল এলোমেলো করে দিলো হাত দিয়ে। দুজনে পাগলামি ও খুনসুটি করতে করতেই রাত পেড়িয়ে ভোর হয়ে গেলো। সকাল হওয়ার আগে আগে মিশু নিজের রুমে শুতে গেলো। এত বেশি শান্তি লাগছে ভেতরে যা বলে বোঝানো সম্ভব না।

৮৬.
দুটো দিন কেটে গেলো ব্যস্ততায়। সব আত্মীয় স্বজন রা আসতে শুরু করেছেন। মেঘালয় সারাক্ষণ ব্যস্ত বিয়ের আয়োজনে সাহায্য করতে। অফিসেও গিয়ে বসতে হচ্ছে, এ কারণে মিশুর সাথে সারাদিন দেখাই হলোনা। রাত্রিবেলা অফিস থেকে বাসায় ফিরলো মেঘালয়। মিশুর সাথে চোখাচোখি হতেই দুজনে খুব সুন্দর করে হাসলো, কত প্রশান্তির ছাপ মিশে আছে সে হাসিতে। দুজনেই শুধু মনেমনে একটা কথাই ভাবলো, এত সুন্দর করে ও কেন হাসে!

এক টেবিলে বসে খাবার খেলেও দুজনাতে কথা হলো মাত্র দুবার। আর একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়েই সব কথা সেরে নিচ্ছে। খাওয়া শেষ হবার পর কিছুক্ষণ আড্ডা চললো সবার মধ্যে।মেঘালয় পূর্ব, সায়ান ও আরাফকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো আজকে। ওরা সবসময় সব ধরণের সহযোগিতা করেছে মেঘ মিশুকে। আর সব ট্যুরের সাথী হয়ে ট্যুর গুলোকেও দারুণ আনন্দদায়ক করে তুলেছিলো। ওদেরকে ছাড়া এই বিয়েটা যেন অপূর্ণই থেকে যেতো।

এদিকে নিখিল ও দুপুর খুব শান্ত অথচ সুখী এক দম্পতি হয়ে উঠেছে, যাদেরকে দেখলেই মনটা আনন্দে ভরে যায়। রৌদ্রময়ীর বিয়েটাও হয়ত আগামী মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে পূর্ব’র সাথে। আর সায়ান ও আরাফ? দুই অভাগার আর প্রেম করা হয়ে উঠলো না। ওরা এখনও মেঘালয়ের মিশুর মত একটা মিশু খুঁজে ফেরে। জগতে আরেকটা মিশু যদি পাওয়া যেতো! ওর বন্ধুরা সেই প্রথম থেকেই মিশুকে খুব বেশি আপন ভাবে। মিশু এমন একটা মেয়ে,যাকে আপন না ভেবে থাকাই যায়না।

আড্ডা শেষে যে যার রুমে শুতে গেলো। রিমিকার ব্যাপারটা শুনে মিশু প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে মেঘালয়ের সাথে। দুজনে পাশাপাশি দুই রুমে শুয়ে শুয়ে ফোনে মেসেজিং করতে লাগলো। রাত প্রায় একটা বেজে গেছে। খানিকক্ষণ মেসেজে ঝগড়া চালিয়ে মেঘালয় লিখলো, “আজ খুব সুন্দর জোৎস্না ছড়িয়েছে বাইরে। সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়েছিলো তো এখন আকাশ একদম ঝকঝকে। চাঁদের আলোয় গাছের পাতা চিকচিক করছে।”

মিশু রিপ্লাই দিলো, “জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে শুধু বিল্ডিং চোখে পড়ে। তোমার শহরে জোৎস্না দেখে একটুও মজা লাগেনা।”
-“আচ্ছা হানিমুনে কোথায় যাবা বলো? কোন পাহাড়ের চূড়ায় বসে জোৎস্না দেখতে চাও?”
-“পাহাড়ে না, গাজীপুরের কোনো এক জংগলে বসে দেখবো। ব্যবস্থা করা যায়?”
-“অবশ্যই যায়। মিশু, একটু সিঁড়ির কাছে আসবা? দেখবো তোমায়। বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে।”

মিশু হেসে “আচ্ছা” লিখে পাঠালো। একটু আগেই দেখা হলো তবুও নাকি দেখতে ইচ্ছে করছে! ও দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ির কাছে চলে আসলো। মেঘালয় ও এসে আচমকা ওকে কোলে তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে সোজা ছাদে চলে গেলো। মিশু ওর গলা জড়িয়ে ধরে বারবার বলছিলো, “আমি নাকি হাতির বাচ্চা? আলুর বস্তা?”
-“এই হাতির বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে। তুই আমার অভ্যেস না?”

মিশু ক্ষেপে গিয়ে দুটো কিল বসালো মেঘালয়ের বুকে। মেঘালয় ছাদে গিয়ে মিশুকে দোলনায় বসিয়ে দিলো। মিশু অবাক হয়ে বললো, “ছাদের উপর দোলনা আছে? আমি জানতাম ই না। এ বাড়ির ছাদে কক্ষনো উঠিনি আমি।”
-“হুম,সারপ্রাইজড?”
-“অবশ্যই। চাঁদের আলোয় ছাদটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে মেঘ।”
-“আকাশের দিকে তাকাও।”

মিশু আকাশের দিকে তাকানো মাত্রই দেখলো ঝিকঝিক করা আকাশে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা। সাদা সাদা মেঘ দারুণ লুকোচুরি খেলছে চাঁদের সাথে। এক্ষুনি ঢেকে দিচ্ছে চাঁদ কে,আবার এক্ষুনি মেঘের ফাঁক ফোঁকর দিয়েই উকি দিচ্ছে চাঁদ। ও মেঘালয়ের বুকপকেট খামচে ধরে বললো, “তুই আমার। আজীবন আমার থাকবি তো?”
মেঘালয় হেসে বললো, “হুম পাগলীটা।”

দোলনায় বসে মিশু মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রেখে জোৎস্না উপভোগ করলো। সুখে ভেসে যেতে ইচ্ছে করছে ওর। আগামীকাল ওদের গায়ে হলুদ,রাতে বিয়ে আর পরশু বৌভাত। ইস! এত সুখ সুখ লাগছে।

মেঘালয় বললো, “মিশু পাগলী, ‘জল জংগলের কাব্য’ নামে একটা জায়গা আছে। জোৎস্না উপভোগের জন্য দারুণ একটা জায়গা। বিলের উপর টংঘরে বসে বসে দুজনে আঙুলে আঙুল রেখে জোৎস্না দেখবো। চাঁদের আলোয় বিলের জল চিকচিক করবে। কেমন হবে বলোতো, মাঝরাতে বিলের মাঝখানে নৌকায় শুয়ে চাঁদ দেখতে? তুমি আমার বুকে পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে দুজনে একইসাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবো। শিরশিরে বাতাস লাগবে গায়ে, নৌকা থেকে যেদিকে তাকাবা শুধু জল আর জল। মাঝেমাঝে রাতের নির্জনতা গ্রাস করবে পুরো জংগলটাকে। আকাশে থাকবে পূর্ণিমার চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি। এদিকে নৌকায় তুমিও আমার বুকে মুখ গুঁজে লজ্জার লুকোচুরি খেলবা।”

মিশু উত্তেজনায় উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, “ইস! এমন ভাবে বললে সুখে পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে মেঘমনি। জল জংগলের কাব্য? উফফ কবে নিয়ে যাবা আমায়?”
-“কালকে রাতে আমাদের বাসর,পরশু বৌভাত। তার পরের দিন যেতে হবে।”
-“মেঘমনি, আমাদের কতবার বাসর আর হানিমুন হবে বলোতো?”

কথাটা বলতে বলতে মিশু মেঘালয়ের বুকে মুখ গুঁজে দিতে লাগলো লজ্জায়। মেঘালয় বললো, “আমাদের প্রত্যেকটা দিনই প্রেমের সূচনা, প্রত্যেকটা রাতই বাসর, প্রত্যেকটা পূর্ণিমাই মধুচন্দ্রিমা।”

মিশু হেসে বললো, “আর প্রত্যেকটা ট্যুরই হানিমুন এটা বাদ রাখলা কেন?”
-“হা হা হা। পাগলী, তুই বদলে গিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছিস জানিস?”
-“প্লিজ মেঘমনি,আর ওই কথা তুলো না। ওটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভূলে যাও। আমি তোমার মিশু পাগলী, শুধু তোমার তোমার তোমার।”
-“আর আমি বুঝি তোমার মেঘ পাগলা?”
-“উহুম, আমি মেঘালয়া আর তুমি মেঘালয়।”
-“ইস! বললেই হলো? তোমার যা হাইট, আমার পাশে দাড়ালে মনেহয় বিদ্যুতের খাম্বার পাশে বনমানুষ দাঁড়িয়ে আছো।”

মিশু ক্ষেপে গিয়ে বললো, “বারে এতদিন পর আমার হাইট নিয়ে কথা বললা? আমায় কে বিয়ে করতে বলছে শুনি? যাও সরো ওইদিকে ”

মেঘালয় উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার উপক্রম হতেই মিশু পিছন দিক থেকে ওর শার্ট খামচে ধরে বললো, “এখন থেকে প্রত্যেকটা সেকেন্ড আমার সাথে থাকতে হবে। এই বলে রাখলাম। একটু দূরে গেলেই ঠুস করে টেনে ধরে ঠাশ করে চড় মেড়ে ক্যাক করে গলাটা টিপে ধরে টুক করে মেরে ফেলবো।”

মেঘালয় হো হো করে হেসে উঠলো। হাসি যেন আর থামতেই চায়না। আকাশ, মেঘ, চন্দ্র সবাই যেন মেঘালয়ের সাথে হাসিতে যোগ দিয়েছে। ও হেসেই চলেছে। মিশু ওর বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে দুহাতে জাপটে ধরে রইলো।

৮৭.
মেঘালয় নিজের বিয়ে করা বউকে আরো একবার বিয়ে করলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে আজকের তারিখেই ওদের বিয়ে হয়েছিলো, শুধুমাত্র এক মাসের পার্থক্য। আগামী মাসের একইদিনে ওদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। ব্যাপারটা এমন যে, আগের মাসের এইদিনে প্রথম বিবাহবার্ষিকী আর পরের মাসের এইদিনে দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী। বিয়ে পড়ানোর পর সব বন্ধু বান্ধবী মিলে প্রচুর হাসাহাসি চলছিলো এসব নিয়ে। বিয়ের একমাস পরেই ওরা বিবাহবার্ষিকী পালন করবে, যদিও মেঘালয়ের বন্ধুরা ছাড়া আর কেউই সেটা বুঝবেও না।

মেঘালয় ‘জল জংগলের কাব্য’ জায়গাটায় যাবে শুনে ওর বন্ধুরাও জেদ ধরলো যাওয়ার জন্য। তবে এবার ওরাই সবাই মিলে মেঘালয় ও মিশুর সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করবে। বিলের ধারে টংঘরে বসে কয়েক প্রকার পিঠা আর দেশী খাবার খেতে চাইলে সেখানে তো যেতেই হবে। আর রাত্রিবেলা নৌকায় শুয়ে জোৎস্না বিলাস তো কোনোভাবে মিস করাই যাবেনা!

মেঘালয়কে বুকে জড়িয়ে ধরে ওরা আরেকবার শুভেচ্ছা জানালো বিয়ের। যদিও বিয়েটা অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে,তবুও আজকে সামাজিক ভাবে স্বীকৃতি পেলো। এতদিন বিয়েটা গোপন রাখার মত ক্ষমতা শুধুমাত্র মেঘালয়ের ই আছে। বন্ধুরা ওকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো।

মেঘালয় বিছানার কাছে আসতেই মিশু মাথার ঘোমটা টা এমন ভাবে খুলে ফেললো যে মেঘালয় ভয় পেয়ে গেলো। মিশু মুখটা বিকৃত করে বলল, আজকে যা গরম,যা দেখছি তাই হট লাগছে!”

মেঘালয় হাসিতে ফেটে পড়লো। ওর ডায়ালগ ওকে ই শোনানো হচ্ছে। মেঘালয় পা দুটো বিছানায় এলিয়ে দিয়ে বললো, “বউ,আমার পা টিইপ্পা দেও। এক বছর আমি তোমার সেবা করছি। আজ তুমি আমার সেবা করো।”

মিশু খিলখিল করে হাসতে হাসতে মেঘালয়ের পা টিপে দিতে শুরু করলো। মিনিট দুয়েক পরেই মেঘালয় মিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, “পাগলী বউ আমার। বুকে কান পেতে শোন তো।”

মিশু ওর বুকে কান পেতে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করলো। মেঘালয় বুকে চেপে ধরে রইলো ওর মাথাটা। বললো, “কিছু শুনতে পাও?”
-“হুম। প্রতিটা স্পন্দন বলছে, ভালোবাসি মিশু।”
-“আর আমি তোমাকে বুকে চেপে ধরে কি অনুভব করছি জানো?”
মিশু কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি?”
মেঘালয় বললো, “এক স্বর্গীয় সুখানুভূতি।”

মিশু হাতের বাঁধন আলগা করে দিয়ে মেঘের বুকে মুখ লুকিয়ে বললো, “নেশা ধরে যাচ্ছে। কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছে। সত্যিই এ যেন অন্যরকম অনুভূতি।”

দুজন সুখী মানুষ একে অপরকে জড়াজড়ি করে বসে রইলো চোখ বন্ধ করে। কিন্তু কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে। কেবলই মনেহচ্ছে দুজনে শুয়ে আছে নৌকায়। চারিদিকে জল আর জল,চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে জলের তরঙ্গ। শাপলা, পদ্ম রাও লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠছে এই জোৎস্না রাতে ওদের প্রেম দেখে। রাতের নির্জনতা ঘন হয়ে নেমে এসেছে চারিদিকে। দুজনে মুগ্ধ হয়ে আকাশ আর চাঁদ দেখতে দেখতে আবেশে চোখ বুজে এসেছে। একে অপরকে বুকে জড়িয়ে এখন শুধুই প্রশান্তি আর অনুভব করছে মায়াবী জোৎস্নায় এই স্বর্গীয় সুখের অনুভূতি!

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে