অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৬+৭

0
574

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ষষ্ঠ পর্ব

সামিহার ক্লাস শেষ হয়েছে বহু আগে। এখন সে শ°হী°দ মিনারের সামনের সিঁড়িতে বসে, এক সিঁড়ি উপরে বসে আছে তারই বেস্টফ্রেন্ড তানজিম। আজ দুজনের তুমুল ঝগড়া হয়েছে, সে রাগ ভা°ঙাতেই পিছুপিছু এসেছে তানজিম।

“সামি, দেখ এসব নরমাল। লামিনা তো..”

তানজিমের নরম কথায় সামিহা একটা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে,
“একদম ওই মেয়ের নাম মুখে আনবি না। গলা চি°পে ধরবো।”

দুহাত বাড়িয়ে বলা শেষের কথায় তানজিম একটু সরে যায়। বলল,
“দেখ, লামিনা আমার পাশে বসেছে, হাত ধরেছে। ওই ধরেছে, আমি তো কিছু করিনি।”

সামিহা ভেং°চি কেটে বলল,
“আহাগো, সাধু আমার, তুইও তো বারবার মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছিলি। আমি কি দেখিনি ভেবেছিস?”

ঘটনাটা হলো এই যে প্রতিদিনের মতো আজ ক্লাসে তানজিমের পাশে জায়গা পায়নি সামিহা। অন্য একটা মেয়ে, লামিনা ওর পাশে বসেছিলো আর ওর হাতও ধরেছিলো। ব্যস, এইটাকে পুঁজি করে ঝ°গড়া শুরু করে সামিহা। যদিও হাতটা ইচ্ছাকৃত ধরেনি, ক্লাস থেকে বের হওয়ার সময় পড়ে যেতে নিয়ে হঠাৎ ধরে ফেলে।

তানজিম এসে সামিহার পাশে বসে একহাত ধরে বলল,
“আমার বউ তো তোর জ্বা°লা°য় সংসারই করতে পারবে না।”
“থা°প্প°ড় দিবো। বাচ্চা ছেলে, সারাদিন বউ বউ করে শুধু।”
“কিসের বাচ্চা? পুরো ২২ বছর আমার।”

সামিহা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“এমন কি কিছু বেশি হয়েছে?”

তানজিম হেসে উঠে গেল। একটু দূরে বসে ফুল বিক্রি করতে থাকা ছোট মেয়েটার কাছ থেকে শিউলি ফুলের মালা নিয়ে আসে। সামিহার ডানহাতে মালা পেঁ°চি°য়ে দিতে থাকে সে। সামিহা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তানজিমের দিকে। ওর হাতের দিকে তাকিয়ে তানজিমের ঠোঁটের হাসিটা দেখে হঠাৎ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে।

তানজিম বলল,
“লামিনাকে মালা কিনে দিয়েছি? নিজে থেকে হাত ধরেছি? তবে রাগ করিস কেন?”

সামিহা কিছুক্ষণ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। তারপর বলে,
“অন্য কারো সাথে মিশলে বেস্টফ্রেন্ডের খারাপ লাগতেই পারে।”
“আচ্ছা, আর মিশবো না।”
“গুড বয়।”
তানজিমের গাল টে°নে দিলো সামিহা।

ভার্সিটির প্রথমদিনই দুজনের আলাপ হয়। মনস্তাত্ত্বিক মিল থাকায় ধীরে ধীরে তা বন্ধুত্বে পরিণত হয়। বন্ধু থেকে সেরা বন্ধু হয়ে উঠে দুজনে। একে অন্যকে চোখে হারায় অবস্থা। যদিও ওদের সম্পর্ককে অনেকে অন্য নামে ডাকে, তবে ওরা সম্পর্কের বিশেষ নাম দিতে নারাজ।
______________________________________

লাঞ্চ টাইমে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে ইমতিয়াজ। অর্ধদিবস ছুটি নিয়ে কাকরাইল গো°র°স্থানে এসেছে তাহমিনার কবর যিয়ারাত করতে। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করে দোয়া করলো। আজও তার চোখের কোণে জল জমে, কন্ঠ ভারী হয়, নিশ্বাস থেমে আসে। তার মিনা আর সন্তান কি করে আছে ওই অন্ধকারে।

কবর পরিচর্চার লোক থাকলেও তাহমিনার কবরটা নিজেই পরিষ্কার করলো। সাথে করে নিয়ে আসা বেলী আর গোলাপের চারা লাগিয়ে দিলো। বোতল থেকে পানি ঢেলে ভিজিয়ে দিলো গাছের গোড়া।

“মিনা, অন্ধকারে ভয় করে তোমার? আমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে না? আমার যে খুব করে ইচ্ছা করে তোমাকে দেখতে, তোমার কন্ঠ শুনতে, তোমার ব°কা শুনতে।”

কথাগুলো বলতে বলতে হুট করে কেঁদে দেয় ইমতিয়াজ। অনেকটা সময় বসে থাকে সে। উঠতে চেয়েও উঠতে পারে না। অদৃশ্য আকর্ষণে আটকে আছে সে।

“মিনা, ফিরে এসো।”

অসম্ভব এই কথা খানা বারবার বলতে থাকে ইমতিয়াজ। ভালোবাসায় পিপাসায় তৃষ্ণার্ত এই মানুষটা বারে বারে তার মিনাকে ফিরে পেতে চায়।

“তুমি আসবে না, মিনা। আমাকে তবে তোমার কাছে নিয়ে নাও।”
______________________________________

সন্ধ্যা ৭ টায় আফরোজাকে নিয়ে শপিং এ এসেছে আহনাফ। কলেজে একটা কাজে আটকে পড়ায় তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরা হয়নি তার। তাইতো সন্ধ্যা করে বের হওয়া হয়েছে।

আফরোজা শাড়ি দেখছে, আহনাফ পাশে বসে আছে। আফরোজা একটা শাড়ি দেখিয়ে বলল,
“এই শাড়িটা কেমন?”

আহনাফ একবার শাড়িটা দেখল। তারপর বলল,
“চলে।”

ওর কথায় বোঝা গেল এসবের ওর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আফরোজা ফের শাড়ি দেখায় মন দিলো। গাড় নীল ও সোনালী রঙের বেনারসি শাড়ি দেখিয়ে বলল,
“এটা?”

আহনাফের এবার বি°র°ক্ত লাগলো। বলল,
“যা নিবে নাও তো আপু।”

আফরোজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আর কিছুই বলে না। আহনাফ হালকা গোলাপী রঙের একটা শাড়ি দেখিয়ে বলে,
“এটাতে তোমাকে ভালো মানাবে।”

আহনাফ জানে ওর বিয়ের জন্যই শাড়ি কেনা হচ্ছে। তবুও এভাবে কথাটা বলে উঠে চলে যায়। আফরোজা আলতো হেসে বলল,
“এটা প্যাক করুন।”

শাড়ির পর কিছু কসমেটিকস কেনা হলো, সাথে একটা ফোনও কিনলো। আহনাফ বুঝে গেছে যেকোনো মূল্যে ওকে বিয়ে করাবে সবাই। ও রাজি না থাকলে জোর করবে, পাত্রী পছন্দ না হলেও বিয়ে করাবে।

ওরা এবারে ব্যাগের দোকানে এসেছে। ওরা বললে ভুল হবে কারণ স্বেচ্ছায় এসেছে আফরোজা আর একপ্রকার মনের বিরুদ্ধে জোর করে এসেছে আহনাফ। অকারণে মার্কেটে ঘুরে বেড়াতে ওর মোটেও ভালো লাগছে না।

আফরোজা বেশ মনোযোগ দিয়ে ব্যাগ দেখছে। আহনাফ বলল,
“আপু, মনে একটা প্রশ্ন ঘুরছে।”
“হ্যাঁ, বলে ফেল।”
“যদি পাত্রী পছন্দ না হয়?”
“তবে চলে আসব।”
ঝটপট জবাব দেয় আফরোজা।

আহনাফ অন্যদিকে তাকিয়ে আলতো হাসে। দোকানের আয়নায় ওর প্রতিবিম্ব টা দেখে আফরোজা। পাত্রী পছন্দ হলেও বিয়ে যে আহনাফ করতে চাইবে না তা আফরোজা অন্তত ভালো করে বুঝেছে।
______________________________________

ইতালির ঘড়িতে দুপুর আড়াইটা। অফিসের কাজে ব্যস্ত মৃত্তিকা। এমন সময় তানজিমের নাম্বার থেকে কল আসে। ফোনের ভাইব্রেশন চালু ছিল, অনবরত ফোন কাঁ°পছে। মৃত্তিকা ফোনের দিকে তাকিয়ে আবারো কম্পিউটারের স্ক্রিনে মনোযোগ দেয়।

বেশ কয়েকবার কল আসায় অবশেষে রিসিভ করে সে।
“আসসালামু আলাইকুম।”

মৃত্তিকার নরম কন্ঠের সালামের জবাব দেয় ইমতিয়াজ,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”

হুট করে এতদিন পর এই কণ্ঠ শুনে ফোনটা কান থেকে দূরে সরায় মৃত্তিকা। সেই পুরোনো অনুভূতিগুলো জেগে উঠার ভ°য়ে ভী°তু হয় সে।

খানিক বাদে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“কে বলছেন?”
“আমি ইমতিয়াজ। আসলে মা আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে, তাই..”

ইমতিয়াজ থেমে যেতেই মৃত্তিকা অস্থির হয়ে বলল,
“বড়মনিকে ফোন দিন।”

মমতাজ বেগমের হাতে ফোন দেয় ইমতিয়াজ। মুখে বলে,
“মা, মিউকো কলে আছে।”

ফোন নিয়ে মমতাজ বেগম বলে,
“মিউকো, কেমন আছো মা?”
“ভালো আছি বড়মনি। আপনারা কেমন আছেন?”
“আমরাও ভালো আছি। তা রিপার কি খবর?”

মৃত্তিকার কণ্ঠনালী পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। অনবরত কাঁপতে থাকা কন্ঠে বলে,
“মাম ভালো আছে।”
কথাটা বলে দু চোখের জলের ফোয়ারা ছেড়ে দেয়।

আর কথা বলতে পারে না মৃত্তিকা। কোনরকমে বলে,
“বড়মনি, আমি অফিসে আছি। বাসায় গিয়ে কথা হবে।”
“তখন রিপাকে দিও। রিপা তো নিশ্চয়ই আমার সাথে রাগ করে আছে।”
“মাম রেগে নেই বড়মনি। রাখছি।”

কল কা°টার আগেই ইমতিয়াজের কন্ঠ শুনে মৃত্তিকা। মমতাজ বেগমকে বলছে,
“মা, এখন আপনি রেস্ট নিন।”

মৃত্তিকা ফোন রেখে দিলো। যে অনুভূতিকে ও আরো আগেই ত্যাগ করেছে, তা নতুন করে জেগে উঠুক তা সে চায় না। যোজন যোজন দূরে সেই বাংলাদেশে ফেলে আসা ওই লোকটার সামনে আর যেতে চায় না। থাকুক সবাই নিজের মতো ভালো অথবা খারাপ।
______________________________________

পরদিন,
ফজরের পরই জাবেরকে নিয়ে দুষ্টুমিতে মজেছে আহনাফ। ছোট জাবের এখনো কথা বলা শিখেনি। হু, হা করে আর আধো আধো বুলিতে মা বলতে পারে। সেও আহনাফের সাথে খিলখিল হাসিতে মজেছে।

দুজনের একজনেরও ঘুম নেই। আফরোজা প্রচন্ড বি°র°ক্ত আহনাফের উপর আর ওকে ইচ্ছা করে আরো বি°র°ক্ত করাচ্ছে আহনাফ।

“আপু, কাল তো ঢাকায় যাবি?”
“হুম।”
আফরোজা গমগমে সুরে বলল।

“আপু, পাত্রীর কোনো ছবি নেই?”
“কেন?”
“মানে টাকা খরচ করে ঢাকা যাওয়ার থেকে এখানে দেখে নিলেই ভালো হতো না?”

আফরোজা তেতিয়ে উঠে,
“না, তুই কেন এমন করছিস আহনাফ?”

আফরোজা ড্রইংরুমে এসে আহনাফের সামনে বসে বলল,
“বিয়ে করা তো সুন্নত। তবে তোর এতো সমস্যা কেন?”
“আর স্ত্রীকে মর্যাদা দিতে হবে না? সম্মান দিতে হবে না? ভালোবাসতে হবে না? শুধু বিয়ে করলেই কি সব খতম?”

আহনাফের কথায় আফরোজা চুপ করে। আহনাফ আবারো বলল,
“একটা মেয়ে নিজের পরিবার, বাবা-মা সব ছেড়ে আমার কাছে আসবে আর আমি তাকে ভালোবাসতে পারবো না, এতে কি সে সুখী হবে আপু?”

ভাইয়ের দুইগালে হাত দেয় আফরোজা। শান্ত গলায় বলে,
“যে ছেলের এই বোধবুদ্ধি আছে সে সুখী রাখতে না পারলেও খারাপ রাখবে না। (একটু থেমে) বাসায় একজন নারীর পদচারণ দরকার। সংসার সাজানোর জন্য, আগলে রাখার জন্য কাউকে দরকার।”

আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো জাবেরের দিক মন দেয়। ওর গালে চুমো খায়। আফরোজা বলল,
“তোর সন্তান লাগবে না? তোর সন্তানের জন্য, এ বংশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তোর বিয়ে করা দরকার।”

আহনাফ হুট থেকে থমকে গেল। একটু অপ্রস্তুত সে। আফরোজা যেন আগে থেকেই সব যুক্তি সাজিয়ে রেখেছে।

আফরোজা উঠে জাবেরকে নিয়ে চলে গেল। আহনাফ সোফায় হেলান দিয়ে বসে ভাবতে লাগলো। আফরোজার কথাগুলো নিয়ে ও ভাবছে না, ও ভাবছে তাহসিনাকে নিয়ে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল আহনাফ।

আব্বাস সাহেবের ডাকে ঘুম ভা°ঙে৷
“আহনাফ, কলেজ যাবে না?”

চোখ কচলে উঠে বসে। অসময়ের ঘুম সহজে কা°টতে চায় না। আহনাফ উঠে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিলো।

তারপর এসে নাস্তার টেবিলে বসলো। জুহাইব বলল,
“এবারে কিন্তু ছুটি কম, শালাবাবু। মাত্র দুসপ্তাহ।”
“শালাবাবু বইলেন না তো ভাইয়া। অদ্ভুত শোনায়।”
“শুধু শালা বললে তো গা°লি গা°লি লাগে।”

জুহাইবের কথায় উপস্থিত সবাই হেসে দিলো। আহনাফ কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল,
“ভাইয়া, এই গা°লি কোথায় শুনেছেন?”
“আমার এক বাঙালি কলিগ যাকে তাকে রেগে গেলেই শালা ডাকতো। তার থেকেই একদিন জেনেছি এটা গা°লি।”

আহনাফ ঠোঁট টি°পে হেসে বলল,
“নির্ঘাত চাঁটগাইয়া।”

আবারো হাসির রোল পড়লো। সকলের হাসির মাঝে আফরোজার হাসিটা ফিকে লাগছে। আহনাফ দেখলো বোনের অবস্থা, বুঝতেও পারলো কিন্তু কিছু বলল না।

নাস্তা শেষে আহনাফ রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। পরপর দুটো ক্লাস থাকায় আজ বেশ ব্যস্ত সময় কাটবে তার।

কলেজের সামনে সারাহ্ রিকশা থেকে নেমে উপর পাশে আহনাফকে দেখলো। ওকে দেখেই মুচকি হাসলো সারাহ্। ভিতরে আসার সময় আবারো ফিরে তাকালো আহনাফের দিকে। হালকা নীল শার্ট আর ধূসর রঙের ফর্মাল প্যান্টে বেশ সুদর্শন লাগছে তাকে।

সারাহ্ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিজেকে বলে,
“এসব ঠিক হচ্ছে না, সারাহ্। এই লোকে আসক্ত হোস না।”

আহনাফ ক্লাসে গেল। সকাল নয়টা থেকে নয়টা পঞ্চাশ প্রথম ক্লাস এবং দশটা থেকে দশটা পঞ্চাশ দ্বিতীয় ক্লাস নিয়েছে সে। ক্লাস থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসতেই পেছন থেকে একজন মেয়ে ডাক দিলো,
“স্যার?”

আহনাফ ফিরে তাকালো।
“ইয়েস, এনি প্রবলেম?”

মেয়েটি এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“মেনি প্রবলেম স্যার।”
“কি হয়েছে?”
“আপনি সেই প্রবলেম স্যার।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকায়। বি°ভ্রা°ন্তি নিয়ে বলে,
“আমি.. কিভাবে?”

মেয়েটি আরেকটু কাছে আসতে নিলে আহনাফ বলল,
“কিপ ডিসটেন্স।”
“ওকে।”

মেয়েটি দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,
“স্যার, আমি ফিদা। (একটু থেমে) আপনার উপর ফিদা।”

আহনাফ রেগে গেছে। তবুও চুপ করে আছে। মেয়েটি দুহাত একবার উপরে একবার নিচে নিয়ে বলল,
“আপনার এটিটিউটে আমি পুরোই..”

কথা শেষ করার আগেই মেয়েটির গালে একটা চ°ড় পড়ে। আহনাফ নিজেও চমকে উঠে। চ°ড়টা তো আহনাফ দেয়নি, দিয়েছে পাশ দিয়ে যাওয়া সারাহ্।

ক্লাসে যাচ্ছিল সে, মেয়েটির কথা শুনে রেগে গিয়ে চ°ড় বসিয়ে দেয়।

“একজন স্যারের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না? বে°য়া°দ°ব।”
“সরি ম্যাম।”
“ক্লাসে যাও।”

সারাহ্-র ক°র্ক°শ কন্ঠের ঝা°রি খেয়ে মেয়েটি ক্লাসে চলে গেল। সারাহ্ আহনাফের দিকে ফিরে বলল,
“স্টুডেন্টদের মাথায় তুলবেন না। পরে আপনার মাথায়ই কাঁঠাল ভে°ঙে খাবে।”

আহনাফ বুকের হাত বেঁধে ভ্রূ উঁচিয়ে মাথা নাড়ালো। সারাহ্ হেলেদুলে ক্লাসে চলে গেল। এই মানুষটার উপর একটা অধিকার অনুভব করছে সে। খুব করে চাচ্ছে, এ অধিকার বৈ°ধ হয়ে আসুক ওর কাছে। ক্লাসে যাওয়ার আগে আবারো পিছনে ফিরে আহনাফের দিকে তাকায় সে। আহনাফ টিচার্স রুমের দিকে যাচ্ছে। সারাহ্ মাথানেড়ে হেসে ক্লাসে যায়।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

সপ্তম পর্ব

ঘড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা, ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে সারাহ্। শা°স°ন°গাছায় কোনো এসি বাস পায়নি, তাই স্টেশন রোড বিআরটিসি কাউন্টারে চলে এসেছে সে। টিকেট কিনে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে লাগলো।

ফোন বের করে কল করলো বাবাকে।
“আসসালামু আলাইকুম, বাবা।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। গাড়িতে উঠছো?”
“না, বাবা। টিকেট কিনেছি।”
“আচ্ছা, গাড়িতে উঠে জানিও। আমি বাজারে আছি, পরে কথা বলবো।”
“আচ্ছা বাবা।”

জাহাঙ্গীর সাহেব ফোন রাখলেন। কাল মেয়েকে দেখতে আসবে সেসবের জন্য বাজার আর সবকিছু গোছানো উনার একার জন্য একটু কষ্টসাধ্যই বটে। তবুও নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন উনি।

সারাহ্ জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো। উঁচুনিচু রাস্তার অপরপাশের দোকানগুলোতে হঠাৎ করে দেখলো এক লোককে। চেনা লাগলো সারাহ্-র, কিন্তু ঠিক চিনতে পারলো না। ভালো করে দেখার জন্য ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

এরমধ্যে বাস চলে আসায় লোকটাকে আর দেখা হলো না সারাহ্-র। বাসে উঠে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে লোকটাকে আর দেখলো না সারাহ্, লোকটা নেই ওখানে। কপাল কুঁচকে মস্তিষ্কের মধ্যে আ°তি°পা°তি করে খুঁজতে লাগলো সে, যদি মনে পড়ে লোকটাকে কোথায় দেখেছে।

“এক্সকিউজ মি, আপনার ব্যাগটা একটু সরান।”

পাশে দাঁড়ানো লোকটার কথায় চমকে উঠে সারাহ্ দ্রুত ব্যাগটা সরিয়ে ফেলে। তাকিয়ে দেখে এই তো সেই লোকটা। এবারে মনে পড়ে সারাহ্-র। এই মানুষটাই তো তাকে দু°র্ঘ°ট°নার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।

ইমতিয়াজ সিটে বসে ঘড়িতে সময় দেখলো। হঠাৎ সারাহ্-র দিকে চোখ পড়ায় দেখে সারাহ্ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ইমতিয়াজ কপাল কুঁ°চকে বলল,
“কিছু বলবেন?”
“আপনাকে আমি চিনি বোধহয়।”

ইমতিয়াজ একটু হাসলো। বলল,
“কি বলছেন আপনি এসব?”
“আপনি একবার রাস্তায় আমাকে সাক্ষাৎ মৃ°ত্যু থেকে বাঁচিয়েছিলেন। মনে আছে, ঢাবিতে? শ°হী°দ মিনারের সামনে?”

ইমতিয়াজ একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলে,
“যদি এভাবে তাকেও বাঁচাতে পারতাম।”
“কাকে?”

ইমতিয়াজ চুপ করে অন্যদিকে তাকালো। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল,
“আমার স্ত্রীকে।”

সারাহ্ বুঝতে পারছে ইমতিয়াজের স্ত্রী হয়তো এই পৃথিবীতে নেই আর থাকলেও হয়তো অসুস্থ হয়ে আছে। বিষয়টা নিয়ে জানার আগ্রহ থাকলেও কিছু জিজ্ঞাসা করে না সে।

ইমতিয়াজ সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। সারাহ্ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আপনার নামটা জানা হয়নি।”

ইমতিয়াজ চোখ খুলে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“সৈয়দ ইমতিয়াজ সৌরভ।”
“আমি সারাহ্ তাসনিম ঐশী।”

ইমতিয়াজ নিজে থেকেই বলল,
“কুমিল্লায় থাকেন?”
“হ্যাঁ, ভিক্টোরিয়া কলেজের কেমিস্ট্রি টিচার।”

ইমতিয়াজ ঠোঁট উলটে মাথা নাড়ায়। সারাহ্ বলল,
“আপনার বাসা কুমিল্লায় নাকি ঢাকায়?”
“ঢাকায় থাকি, এখানে গ্রামে এসেছিলাম।”
“ওহ, আন্টি-আংকেল গ্রামে থাকে?”
“আমার বাবা-মা কেউ নেই।”

ইমতিয়াজের কথায় থমকে যায় সারাহ্। এভাবে প্রশ্নটা করা যে ওর উচিত হয়নি তা ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। একটু অনুতপ্ততা নিয়ে বলল,
“সরি, আসলে..”

ওর কথার মাঝেই ইমতিয়াজ বলে,
“ইটস ওকে।”

ইমতিয়াজ আবারো চুপ করে। গ্রামে চাচার বাড়িতে গিয়েছিল সে। চাচা অসুস্থ, চাচী কল করে যেতে বলায় যেতেই হয়েছে ওকে। ওর বাবার মৃ°ত্যুর পর এই চাচাই ওর আর দেখাশোনা করেনি। ১৭ বছর, অনেক বেশি, নিজের পথ নিজে দেখ বলে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে। অর্থ না হোক, সাহস দেয়ার জন্যও কাউকে প্রয়োজন হয়। ইমতিয়াজ এমন কাউকেও পায়নি। অথচ আজ চাচার কথা শুনে না এসে পারেনি সে।
______________________________________

ব্যাগপত্র গোছাচ্ছে আফরোজা। আহনাফ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে। আফরোজা ওকে দেখে বলল,
“কিছু বলবি?”
“না, কিছু বললেও তো তুমি শুনবে না।”

আফরোজা ধুম করে ট্রলি ব্যাগটা বন্ধ করে বলল,
“কি শুনবো বল তো? বিয়ে করবি না, তাইতো?”

আহনাফ চুপ করে রইলো। আফরোজা নরম কন্ঠে বলল,
“আমি জানি তুই তাহসিনাকে ভুলতে পারিস নি, সহজে ভুলতে পারবিও না। কিন্তু একা কেউ বাঁচতে পারে না আহনাফ। সাথে কাউকে তো চাই।”

আহনাফ মাথানিচু করে চলে গেল। আফরোজার কোনো কথার জবাব দেয়ার ইচ্ছা ওর নেই।

রুমে এসে বিছানায় বসে পড়লো। এ কেমন পরীক্ষায় পড়লো সে? অন্য একজন নারীর বিচরণ হবে ওর জীবনে। কল্পনায় আনতেও কষ্ট হচ্ছে তার।
______________________________________

ইমতিয়াজ ঘুমিয়ে পড়েছিল, সারাহ্-র ডাকে ঘুম ভা°ঙলো। চমকে উঠে বলল,
“মিনা।”

সারাহ্-ও একটু ভ°য় পেয়ে গেল। ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকিয়ে থেমে গেল, মিনা যে আসেনি।

সারাহ্ নিচুস্বরে বলল,
“টিকেট চেক করতে এসেছিল, আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন।”
“ওহ।”

ইমতিয়াজ কন্ডাক্টরকে ডেকে টিকেট দেখালো। সারাহ্ বলে,
“মিনা কি আপনার স্ত্রীর নাম?”

ইমতিয়াজ নিজের হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, তাহমিনা রহমান।”
“ওহ, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
“জি, বলুন।”
“কি হয়েছিল উনার?”

ইমতিয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“রোড এ°ক্সি°ডে°ন্ট, মাঝ সড়কে আমার অনাগত সন্তানকে নিয়ে তার মা চলে গেল। একবার হাসপাতালে নেয়ার সময়টুকুও দেয়নি।”

সারাহ্ চেয়ে রইলো ইমতিয়াজের দিকে। বাইরের আলোকে দেখলো তার চোখদুটো চিকচিক করছে, নিশ্চয়ই পানি জমেছে। সারাহ্ বলল,
“সরি।”
“ব্যাপার না।”

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“ঢাকায় কি কোনো বিশেষ কাজে যাচ্ছেন? (একটু থেমে) মানে রাত করে যাচ্ছেন তাই জিজ্ঞাসা করলাম।”
“আসলে ক্লাস ছিলো বলে সকালে যাওয়া হয়নি।”
“ওহ।”

ইমতিয়াজের কল আসায় ফোন বের করে দ্রুত রিসিভ করে,
“হ্যাঁ, তানজিম।”
“ভাইয়া, আম্মু কেমন যেন করছে? আপুদেরকে খুঁজছে আর প্রচন্ড কান্নাকাটি করছে।”

ইমতিয়াজ ভ°য় পেয়ে যায়।
“কি বলছো তুমি? এখন কোথায় আছে?”
“বাসায়ই আছে, কিন্তু আমরা কেউ সামলাতে পারছি না। আপনি তাড়াতাড়ি আসেন।”
“আমি তো বাসে, কুমিল্লা থেকে আসছি। (একটু থেমে) আমি ডক্টর আরিফাকে জানাচ্ছি।”

ইমতিয়াজ কল কে°টে আরিফার নাম্বারে ডায়াল করে। কয়েকবার কল হলেও রিসিভ হয় না। চিন্তায় পড়ে যায় ইমতিয়াজ। গত দুইবছর ধরে আরিফার কাছের চিকিৎসারত আছেন মমতাজ বেগম। অবশেষে আরিফা রিসিভ করে আর ইমতিয়াজ উনাকে পুরো ঘটনা বুঝিয়ে বলে উনাকে তানজিমদের বাসায় যাওয়ার অনুরোধ করে।
______________________________________

পরদিন,
ভোর ভোর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আহনাফ ও তার পরিবারের সবাই। পরিবার বলতে তো আব্বাস সাহেব, আফরোজা, জুহাইব আর জাবের। মতিঝিলের কাছে সারাহ্দের বর্তমান বাসা। ওরা আগে মতিঝিলে ওর চাচার বাসায় যাবে, সেখান বিকালে থেকে সারাহ্-র বাসায় যাবে।

এদিকে সারাহ্-র বাসায় চলছে মহা আয়োজন। সামিহা ঘর গুছিয়ে রেখে তানজিমকে কল করে,
“তানজিম, আজকে আসবি না?”

তানজিম কান্না করছিল, নাক টে°নে বলল,
“আম্মু অসুস্থ সামি, আমরা হাসপাতালে।”

আচমকা উ°ত্তে°জ°নায় সামিহার ঠোঁটদ্বয় ফাঁক হয়ে গেল। সারাহ্-র দিকে একবার তাকিয়ে বারান্দায় চলে গেল। মমতাজ বেগমের অসুস্থতার ব্যাপারে সে জানে, যদিও পুরো কারণ জানে না।

“কোন হাসপাতালে আছিস? আমি আসবো।”
“না, আপুর আজ বিয়ে আর তুই আসবি।”
“বিয়ে না, দেখতে আসবে। পছন্দ হলে বিয়ে হবে। বাবা সামলে নিবে, আমি আসবো, আসবোই।”

তানজিমের নিষেধ শুনতে রাজি নয় সামিহা। তানজিম ওকে ঠিকানা বলতে বাধ্য হলো। আটটার দিকে জাহাঙ্গীর সাহেবের অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে গেল সামিহা।

এনআইএমএইচের কাছে এসে তানজিমকে কল করে। তানজিম এসে ওকে নিয়ে উপরে যায়। চারতলায় মমতাজ বেগমের সেশন চলছে। বাইরে অপেক্ষারত আছে তানজিম, ইমতিয়াজ ও লুৎফর রহমান। সামিহা উনাদেরকে সালাম দিয়ে তানজিমের কাছেই বসে রইলো।

“আন্টির এ অবস্থা কেন হয়েছে তানজিম?”

তানজিম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল,
“আপুদের কথা মনে করে কালকে অনেকক্ষণ চেঁচামেচি করেছে। তারপর হঠাৎ করেই জ্ঞান হারায়। (একটু থেমে) ডক্টর আরিফা বাসায় এসে মাকে দেখলেও সকালে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখানে নিয়ে আসা হয়। এখন সিনিয়র ডক্টর রিজভী উনার সেশন নিচ্ছে।”

সামিহা তানজিমের হাত ধরে বলল,
“চিন্তা করিস না সুস্থ হয়ে যাবে।”
“হুম।”
বলে তানজিম হালকা মাথা নাড়ালো।
______________________________________

দুপুরে আহনাফ কাকরাইল এসেছে। তাহসিনার কবরের কাছে কিছুক্ষণ কাটালো। তারপর তানজিমদের বাসায় গেল। বেল বাজাতেই ইমতিয়াজ এসে দরজা খুললো। মমতাজ বেগমকে নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই বাসায় এসেছে ওরা।

আহনাফকে দেখে ইমতিয়াজ একটু অবাক হলো। বলল,
“আরে আহনাফ, কেমন আছো?”
“এইতো মোটামুটি আছি। আন্টি কেমন আছেন?”
“ভিতরে এসো।”

আহনাফ ভিতরে গেল। সোফায় বসতেই তানজিম আসলো।
“আহনাফ ভাইয়া, ঢাকায় হঠাৎ?”

ইমতিয়াজ ভিতরে চলে গেল। আহনাফ একটু ইতস্ততভাবে বলল,
“চাচার বাসায় এসেছি।”

বিয়ের কথাটা বলা হলো না আহনাফের। তানজিম জানলে হয়তো কষ্ট পাবে। ওর নিজেরও খারাপ লাগবে এতে। এমনিতেও উনাদের মানসিক অবস্থা ভালো নেই।

“আম্মু ভিতরে আছে, চলেন দেখা করবেন।”

মমতাজ বেগমের সাথে দেখা করলো, কথা হলো না। উনি শান্ত হয়ে গেছেন। এতোদিন পর উনার মনে হচ্ছে উনার মেয়েরা নেই, চলে গেছে। উনি বুঝতে পেরেছেন উনার ছোটবোন নেই, যে বোনের সাথে সুন্দর সময়গুলো কাটানো হয়েছিল সেই বোন। থেমে থেমে ঠোঁট কেঁপে উঠে উনার, কাঁদতে থাকেন। আবারো থামেন, কিছু ভাবেন। জীবন চলছে না উনার, যেন মৃ°ত্যু°র দিনক্ষণ গুণছেন।
______________________________________

বিকালের আগেই সারাহ্-কে সাজানো হলো। রোজ গোল্ড রঙের জামদানি শাড়ির সাথে স্বর্ণের ছোট ছোট গহনাগুলো বেশ ভালো মানিয়ে নিলো। মুখের হালকা মেকাপ আর চোখের গাঢ় কাজল যেকারো নজর কাড়তে বাধ্য হবে৷ হালকা গোলাপী রঙের হিজাব পড়ে নিলো সে।

সামিহা ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“বাহ, কি সুন্দর লাগছে আমার আপুকে। এতোদিন এমন রা°ক্ষু°সির মতো লাগতো কেন?”
“কি?”

সারাহ্-র রাগ করা কথায় হেসে দিলো সামিহা। সারাহ্ আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে বলল,
“সকালে কোথায় গিয়েছিলি?”
“হাসপাতালে, তানজিমের মা অসুস্থ।”
“ওহ, কি হয়েছে আন্টির?”
“উনি মানসিকভাবে একটু অসুস্থ।”

সারাহ্ আয়না দিয়েই সামিহার চেহারার দিকে তাকালো। আশেপাশে এতো মানুষ আছে, অথচ একেকজনের একেক সমস্যা। না কেউ কারো সমস্যা বুঝে আর না কেউ কারো সমস্যার সমাধান করতে পারে।

সময় পেরিয়ে বিকাল সাড়ে চারটা বাজলো। আহনাফরা চলে এসেছে। ড্রইংরুমে কথা বলছেন সবাই। সারাহ্ রুমে বসে আ°ইঠা°ই করছে ওকে দেখার পর আহনাফের কি প্রতিক্রিয়া হয় তা দেখার জন্য।

অবশেষে সেই মহেন্দ্রক্ষণ আসলো। সারাহ্কে নিয়ে ড্রইংরুমে গেল জাহাঙ্গীর সাহেব। আহনাফ ওকে দেখে আবারো মাথানিচু করলো, তেমন বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না।

সারাহ্ আড়চোখে তাকালো ওর দিকে। সাদা শার্ট, কালো ফর্মাল প্যান্ট, বামহাতের ঘড়ি আর শার্টের গোটানো হাতার কাছে থাকা চকচকে কালো তিল। সবকিছু মিলিয়ে এই সুদর্শন পুরুষকে মিস্টার পারফেক্ট লাগছে। সারাহ্ লাজুক হেসে মাথানিচু করলো।

আফরোজা সারাহ্-র সাথে এটাসেটা নিয়ে কথা বলল। আহনাফ বলল,
“আংকেল, কিছু মনে না করলে আমি উনার সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চাই।”
“হ্যাঁ, অবশ্যই। (সারাহ্কে বলল) সামিহার রুমে যাও।”

সারাহ্ একটু মাথা নাড়লো। সামিহার রুমে দুজনের কথা বলার ব্যবস্থা হলো। চেয়ার টেনে বসলো আহনাফ আর সারাহ্ বসলো খাটের একপাশে। সারাহ্-র বুকের ভিতর ডিপডিপ করতে লাগলো। কঠিন এক অনুভূতিতে আছে সে।

“আপনাকে আমার ছবি দেখানো হয়েছিল?”

আহনাফের সরাসরি প্রশ্নে সারাহ্ মাথানেড়ে বলল,
“জি।”
“আপনি আমাকে চিনতে পেরেছিলেন, তবে বলেননি কেন?”

সারাহ্ আহনাফের দিকে তাকালো। এ কেমন প্রশ্ন? চিনলেও কি বলবে সে? এইযে শুনছেন আপনার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা। তবে বাসায় না গিয়ে এখানেই দেখে ফেলুন। এসব তো আর বলা যায় না, তবে?

সারাহ্-র নিরবতায় আহনাফ বি°র°ক্ত হয়ে বলে,
“আপনার ইচ্ছায় বিয়ে হচ্ছে নাকি অনিচ্ছায়? (একটু থেমে) মানে মত আছে?”
“মত না থাকলে কুমিল্লা থেকে ঢাকা আসতাম না।”
নিচুস্বরে জবাব দেয় সারাহ্।

আহনাফ জোরে নিশ্বাস নিয়ে বলল,
“আমার মা নেই, বাসায় কোনো মেয়েই থাকে না। সবটা সামলে নিতে পারবেন?”
“আশা করি পারবো।”
“বিয়ের পর যদি বলি চাকরি করতে পারবেন না?”

সারাহ্ চঞ্চল চোখে ফ্লোরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“ছেড়ে দিবো।”
“যদি বলি অন্য কাউকে ভালোবাসি। আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না। তবে?”

আহনাফের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“তবে তাকেই বিয়ে করুন।”

আহনাফ একবার ওর আপাত মস্তক দেখে উঠে বেরিয়ে গেল। ওর শেষের কথাটা নিয়ে ভাবছে সারাহ্। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। যদি সত্যি ও আহনাফের মনে জায়গা না পায়? আহনাফকে নিয়ে যে স্বপ্ন ও দেখতে শুরু করেছে তা কি সত্যি করতে পারবে না? হৃদয় গহীনে গড়ে তোলা ভালোবাসার তাজমহল কি শাহজাহান নিজ হাতে ভে°ঙে দিতে পারে?

প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে আটকে রেখে আবারো ড্রইংরুমে যায় সে, বাবা যে তাকে ডাকছে। আহনাফ ওর দিকে তাকায়, দুজনের দৃষ্টি এক হয়। কিন্তু সারাহ্-র ডাগর চোখের ভাবের খেলা আহনাফ বুঝে না বা বুঝতে চায় না।

চলবে…..

(আহনাফ-সারাহ্ চলবে?)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে