#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
চত্বারিংশ পর্ব (৪০ পর্ব)
শাফিনের ফাঁ°সির রা°য় কার্যকর হয়েছে। চিন্তিত মানুষগুলো স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে। শাফিনের উপর অত°র্কি°ত হা°ম°লার জন্য মৃত্তিকাকে এসপির অফিসে রাখা হয়েছে৷ খবর পেয়ে ইমতিয়াজ ছুটে এসে অফিসারকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মৃত্তিকাকে নিয়ে আসে।
আহনাফের ফোনে একের পর এক কল করে যাচ্ছে সারাহ্। মধ্যরাত্রী চলছে অথচ আহনাফ বাসায় ফেরেনি, চিন্তা হওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। অনেক লোকের ভীড়ে থাকায় ফোনের শব্দ আহনাফ শুনছে না।
ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে নিয়ে বাইরে আসে। আহনাফ ওকে দেখে হাত নাড়ে। ইমতিয়াজ এসে বলল,
“লা°শ বের করেছে?”
“উহু, সেই অপেক্ষাই করছি।”
মৃত্তিকা মাঝ থেকে বলে,
“ব°ডি তো ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাবে। এসপি তো তাই বলছিলো।”
“তবে আমিও সেখানে যাবো।”
ইমতিয়াজের কথায় আহনাফ মাথা নাড়ে। অবশেষে এ°ম্বু°লে°ন্সে করে শাফিনের দেহ বের করে আনা হয়। সুরভি বা দেলোয়ারা কেউই নেই। বাড়ির লোক বলতেই কেউ এখানে নেই। বাড়ির লোকের পরিচয় দিয়ে ইমতিয়াজ-মৃত্তিকা এ°ম্বু°লে°ন্সে উঠে যায়৷ আহনাফ অন্য পথে ঢামেকে পৌঁছায়। সেখানে দেহ গোসল করিয়ে, ক°ফি°নবন্ধী করা হয়। অনেকক্ষণ পর তানজিমের সাথে মমতাজ বেগম আসে আর তারপর লুৎফর রহমান সুরভি ও দেলোয়ারাকে নিয়ে আসে।
ইমতিয়াজের কানের কাছে ফিসফিস করে মৃত্তিকা বলে,
“ফাঁ°সির আ°সা°মীকে এতো সেবা করে বিডিতে?”
উত্তর জানা না থাকলেও ইমতিয়াজ একটা উত্তর দেয়,
“স্পেশাল কতগুলাকে করে বোধহয়।”
শাফিনের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী দা°ফ°ন হবে খুলনায়৷ তার পিতৃ নিবাসে, পিতার কবরের পাশে। ব্যবস্থা করা হলো।
আহনাফ এসে কথাটা শুনে ইমতিয়াজকে বলে,
“আপনি কি যাবেন ভাইয়া?”
“হ্যাঁ।”
আহনাফ ঘড়িতে সময় দেখে বলল,
“আমি তো যেতে পারবো না, আপনি কি আমাকে আপডেটটা জানিয়ে দিতে পারবেন?”
“ওকে, নো প্রবলেম।”
“থ্যাংকস, তবে আমি বাসায় চলে যাই।”
“ওকে।”
দুজনে হ্যান্ডশেক করে। আহনাফ বেরিয়ে পড়ে বাসার উদ্দেশ্যে। মৃত্তিকা মিনমিনে স্বরে ইমতিয়াজকে বলে,
“আমিও (একটু থেমে) কি যেতে পারি?”
“না, যা করেছো তুমি তাই যথেষ্ট।”
মৃত্তিকা ওর হাত জড়িয়ে ধরে বাহুতে পরপর কয়েকটা চুম্বন করে৷ ইমতিয়াজ চমকে আশেপাশে তাকিয়ে হাত সরাতে চাইলে মৃত্তিকা বলে,
“ইজ্জত বাঁচাতে চাইলে সাথে নিয়ে চলেন।”
“আচ্ছা, আচ্ছা, যাবে। এখন ছাড়ো।”
মৃত্তিকা হাত ছেড়ে দেয়। ইমতিয়াজ অন্যদিকে তাকালে মৃত্তিকার চেহারা গম্ভীর হয়ে যায়। মৃত্তিকার মনে পড়ে শাফিনের বলা কথা,
“এখানে আরো অনেক কিছু আছে।”
______________________________________
রাত প্রায় দুইটায় আহনাফ বাসায় ফিরে আসে। শশুড়বাড়ির লোকজন কি ভাববে তার চেয়ে বড় চিন্তা সারাহ্ কেমন আছে। লোকজনের শোরগোল থাকায় জেল থেকে সে কোনো কল দেয়নি বা ফোন ধরে দেখেনি কোনো কল এসেছে কিনা। এখন যখন দেখছে সারাহ্ এতোবার কল দিয়েছে তার মানে মেয়েটা প্রচন্ড রেগে আছে।
বেল না বাজিয়ে সারাহ্-র নাম্বারে কল দেয় আহনাফ। সারাহ্ নামাজ পড়ছিল, সালাম ফিরিয়ে ফোন হাতে নিয়ে আহনাফের নাম্বার দেখে কল কে°টে দেয়। আহনাফ আবারো কল দেয়, সারাহ্ রিসিভ করে না। পরে ম্যাসেজ দেয়,
“ঐশী গো, দরজা খুলো।”
সারাহ্ রুম থেকে বের হয়। এখনো কেউ উঠেনি৷ নার্গিস পারভিন রান্নাঘরে আছেন, হয়তো উনি সেহরি প্রস্তুত করছেন।
সারাহ্ একটু জোরে বলে,
“আম্মু, দরজা খুলে দাও।”
“কেন?”
নার্গিস পারভিন বের হয়ে আসেন।
সারাহ্ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“তোমার গুণধর জামাই এসেছে।”
নার্গিস পারভিন কপাল কুঁচকে গিয়ে দরজা খুলে। আহনাফ দরজা খোলার শব্দে যতটা স্বাভাবিক হয়েছিল, নার্গিস পারভিনকে দেখে ততটাই অ°প্রস্তুত হয়ে যায়।
গলা ঝেড়ে বলল,
“মা?”
“আসো।”
আহনাফ বাসায় প্রবেশ করে। কেউ যাতে টের না পায় সেজন্য ও সারাহ্-কে ম্যাসেজ করে দরজা খুলতে বলেছিল আর সারাহ্ মাকে জানিয়েই দিয়েছে৷
আহনাফ একটু ইতস্তত করেই বলল,
“মা, আসলে একটা কাজ ছিল তাই দেরি হয়েছে। কিছু মনে করবেন না।”
“না না, সমস্যা নেই। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।”
আহনাফ রুমে এসেই সারাহ্-কে বলল,
“মাকে জানানোর খুব প্রয়োজন ছিল?”
সারাহ্ একমনে জিকির করছে, এমন এক ভাব যেন আহনাফের কথা সে শুনতেই পাচ্ছে না। আহনাফ বিছানায় বসে বলল,
“মা কি জানলো? আমি রাতে দেরি করে বাসায় ফিরি, উনি ভাবছে প্রতিদিন আমি এমনই করি।”
সারাহ্ জিকির থামায়। শান্তভাবে জবাব দেয়,
“বাসায় না আসতেন, তবেই হতো।”
আহনাফ ওর থুতনিতে হাত দিয়ে বলল,
“রাগ করেছো?”
“না।”
বলেই সারাহ্ মুখ ফিরিয়ে নেয়।
আহনাফ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে৷ অবশেষে সারাহ্ তাকায় ওর দিকে। বলে,
“কোথায় গিয়েছিলেন?”
আহনাফ এই জবাবটাই দিতে চাচ্ছে না। চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই দুজনে ওষ্ঠোধর জোড়া এক করে দিলো। সারাহ্-র বাধা তো সে সবসময়ই উপেক্ষা করে। সারাহ্ একহাতে আহনাফের চুল খা°ম°চে ধরে, অন্যহাতে আহনাফের হাতের মুঠোয় পড়ে রইলো।
______________________________________
সেহরিটা বাইরেই করেছে ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা। ফজরের নামাজটাও রাস্তায় পড়ে নিতে হয়েছে৷ ভোরের আলো ফুটে উঠছে একটু একটু করে। পুব আকাশে লাল সূর্য দেখা যাচ্ছে।
লা°শের গাড়িতে যাচ্ছে ওরা। পেছনে একটা গাড়িতে মমতাজ বেগম, লুৎফর রহমান, তানজিম, সুরভি আর দেলোয়ারা আছে।
মৃত্তিকা বারবার ক°ফি°নটা দিকে তাকাচ্ছে। ফ্রিজিং গাড়ি নয়, সাধারণ একটা এ°ম্বু°লে°ন্স দিয়ে পাঠানো হচ্ছে৷ মৃত্তিকার মনে হচ্ছে লা°শটা উঠে যাবে, শাফিন উঠে দাঁড়াবে আর ওকেও ওর মামের মতোই মে°রে ফেলবে।
সিটে হেলান দিয়ে ইমতিয়াজ ঘুমিয়ে গেছে৷ নিস্তব্ধ পরিবেশ, একটা গু°মোট ভাব। মৃত্তিকা ঢোক গিলে পিছনে ফিরে তাকালো। না, ক°ফি°ন বন্ধই আছে।
“ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ।”
দুবারের ডাকেই ইমতিয়াজ চোখ খুলে। মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কি?”
“রাস্তা ফুরোয় না কেন?”
ইমতিয়াজ একটু হেসে ওকে একহাতে আগলে নিয়ে বলে,
“ঘুমাও, ফুরিয়ে যাবে।”
“তবে আপনি জেগে থাকুন।”
“হুম, জেগে আছি।”
মৃত্তিকা ওর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে। ইমতিয়াজ মৃত্তিকার হিজাবটা ঠিকঠাক করে দিয়ে বলল,
“ওই দুইটা হিজাবই ঘুরে ফিরে পড়তেছো। আলমারিতে তো আরো আছে, পড়তে পারো ওইগুলা।”
মৃত্তিকা ওর দিকে না তাকিয়ে বলে,
“এই দুইটা তাহমিনার তাই পড়ছি।”
“ওইগুলাই তাহমিনারই।”
“আমাকে নিউ কিনে দিয়েন, আর এই দুইটা পড়বো।”
ইমতিয়াজ একটু জোরপূর্বক হাসে৷ মৃত্তিকা বলে,
“আমি যখন তাহমিনার মতো চলে যাবো, তখন এই দুইটা হিজাব একবারে হাতে নিলেই দুজনের স্মৃ°তি পেয়ে যাবেন।”
মৃত্তিকার যুক্তির বহরও আছে। মৃত্তিকা বামহাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে ইমতিয়াজের বুকে হাবিজাবি করে ঘুরাতে থাকে। ইমতিয়াজ ওর হাতে ধরে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“ঘুমাও।”
______________________________________
ফজরের পর সারাহ্ ছাদে গিয়ে বসে৷ সারারাত নির্ঘুম মেয়েটার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা। মায়ের বলা সেদিনের কথাগুলো নিয়ে ভাবছে সে৷ ও জানে না শাফিন কে? কোথায় আছে? তবে মায়ের একজন পূর্ব শত্রু আছে, যে এখন তাকেও মা°রতে পারে।
আহনাফ এসে ওকে ডাকে,
“ঐশী?”
সারাহ্ ফিরে তাকায় না। কোনো উত্তরও দেয় না। আহনাফ এসে ওর সামনে দাঁড়ায়।
“আজকে বাসায় ফিরে যাবো, এখন তবে একটু ঘুমিয়ে নাও।”
“আমি যাবো না আহনাফ, আপনি চলে যান।”
আহনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“যেসব চিন্তা থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছি সেসব চিন্তাই তোমার আশেপাশে আসছে বারবার।”
সারাহ্ ফ্লোরে বসে পড়ে। আহনাফ পাশে বসে৷ সারাহ্ বলে,
“সবকিছু থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছেন? কিন্তু জানেন তো অনেক ঘটনা আমার আশেপাশে হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। আমি দেখি কিন্তু কথা বলি না।”
“কি হয়েছে?”
সারাহ্ লাল হয়ে থাকা আকাশের দিকে তাকায়। কয়েক মুঠো মেঘে ভেসে বেড়াচ্ছে সেখানে। মেঘেদের সাথে দীর্ঘশ্বাসগুলো উড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তার।
বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে সারাহ্ মায়ের বলা সমস্ত কথা আহনাফকে বলে দেয়। আহনাফ নিরব মনোযোগী শ্রোতার মতো সবকিছু শ্রবণ করে বলে,
“শাফিনের ফাঁ°সি হয়েছে মধ্যরাতে, আমি সেখানেই ছিলাম।”
একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সারাহ্। যেন বিশাল চাপমুক্ত হলো সে।
______________________________________
সকাল নয়টায় খুলনায় নিজের নানাবাড়িতে পৌঁছায় মৃত্তিকা। প্রথমবার এখানে এসেছে সে৷ পুরাতন জমিদার বাড়ি আর গো°র°স্থানের কিছু জায়গা ছাড়া আর কিছুই এখানে অবশিষ্ট নেই।
কবর খোঁড়া হয়েছে। ইমতিয়াজ কবরের কাছে ভিতরে দেখে, একটু গভীর করে কবরটা খোঁড়া হয়েছে৷ আশেপাশের দেয়ালগুলো একদম সোজা। ইমতিয়াজ নামতে নিলে মৃত্তিকা দূর থেকে ডেকে বলে,
“এই নামবেন না।”
মৃত্তিকা দৌড়ে ওর কাছে এসে বলল,
“একদম না। এমন একজন মানুষের কবরে আপনি কেন নামবেন?”
মৃত্তিকার বাধা ইমতিয়াজ মেনে নেয়। সময় গড়ায়, শাফিনের জা°নাযা হলো তারপর দা°ফন। এবারে ফিরে যাওয়ার পালা। মমতাজ বেগমের এক বি°লাপ,
“আমার ভাই নির্দোষ, নিষ্পাপ।”
পুরোনো জমিদার বাড়ির বারান্দায় যোহরের নামাজ পড়ে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে একটু আগেই এসেছে।
পাশের বাড়ি থেকে দিয়ে যাওয়া প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ইমতিয়াজ আশেপাশে চোখ বুলায়। লতাপাতা জন্মে গেছে বাড়ির দেয়ালে৷ বহুবছর এখানে কেউ আসেনা, থাকেনা। ময়লা, ধুলাবালি আর শুকনা পাতায় ভরে গেছে জায়গাটা।
মৃত্তিকা নামাজ শেষে বলল,
“কখন রওনা দিবো আমরা?”
“একটু পর, মা শান্ত হোক একটু।”
মৃত্তিকা উঠে নিজের হিজাব ঠিক করে। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে সে, মনে হলো কোনো বড় কিছু নাড়াচাড়া করা হচ্ছে। তবে শব্দটা খুব মৃদু হওয়ায় সে ভালোমতো কিসের শব্দ বুঝতে পারলো না।
“ইমতিয়াজ, আপনি কোনো শব্দ পেয়েছেন?”
ইমতিয়াজ আশপাশটা দেখতে ব্যস্ত৷ মৃত্তিকার কথায় মাথা নেড়ে বলল,
“না তো।”
“কিন্তু আমি তো কিছু শুনলাম।”
ইমতিয়াজ ভালো করে শুনতে চেষ্টা করে, তবুও কিছুই শুনে না।
“তোমার মনের ভুল, মৃত্তিকা।”
“হতে পারে।”
মৃত্তিকা মাথা নাড়ে৷
তানজিম ওদেরকে ডেকে বলল,
“ভাইয়া, আসো।”
ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“চলো।”
দুজনে বেরিয়ে আসে৷ ইমতিয়াজ একটু আগে আগে চলে যায়৷ মৃত্তিকা সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ওর মনে হলো কেউ বাড়ির ভিতরে আছে। মৃত্তিকা ফিরে তাকায়। কোথাও কেউ নেই, কিন্তু ওর মনে হচ্ছে কেউ আছে৷ আবারো সেই শব্দ, কিছু একটা টে°নে নেয়ার শব্দ৷
“ইমতিয়াজ?”
ইমতিয়াজ ফিরে আসে। বলে,
“কি?”
“কেউ আছে ওখানে?”
ইমতিয়াজ তাকায় ভালো করে৷ বলে,
“তুমিই দেখো না কেউ আছে কিনা?”
ইমতিয়াজ ওর হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মৃত্তিকা ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে, আবারো পিছনে ফিরে চায়। কেউ নেই, কিন্তু বারবার শোনা সেই শব্দ কি সত্যি?
অপরূপা বাড়ির ভিতর থেকে ওদেরকে দেখে৷ তারপর পিছনে ফিরে ওর লোকদের বলে,
“শাফিনকে দ্রুত আনো।”
“আনছি তো।”
অপরূপা নিজের গোলাপী ঠোঁটগুলো বাঁকিয়ে হেসে আবারো জানলার ফাঁক দিয়ে তাকায়। বলে,
“তোমরা ভেবেছো শাফিন ম°রে গেছে? শাফিন কিভাবে ফিরে আসবে তা তোমরা টেরও পাবে না। হ্যাপি জার্নি।”
চলবে….
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
একচত্বারিংশ পর্ব (৪১ পর্ব)
“আহনাফ, দা°ফ°নের কাজ শেষ হয়েছে। আমি তো ভ°য়ে ছিলাম, কোনো ঝা°মেলা না হয়।”
“যাক, তাও আলহামদুলিল্লাহ।”
“হুম, ক°ফি°নে শাফিনই ছিল। চেহারা আমি নিজে দেখেছি৷ কবরে যখন নামিয়েছে তখনও ছিলাম, কবর দেয়ার পর সরেছি ওখান থেকে।”
“আজকে ফিরে আসবেন?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, এইতো গাড়িতে উঠে যাবো।”
“আচ্ছা, সাবধানে আসেন।”
আহনাফের সাথে ফোনযোগে কথা বলছে ইমতিয়াজ। এখানের সকল ঘটনাই তাকে জানানো হয়েছে। এখনি বের হবে ওরা।
হঠাৎ সুরভি চিৎকার করে উঠে। মৃত্তিকা দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরে। মমতাজ বেগম ওর অবস্থা দেখে বলেন,
“লেবার°পে°ইন।”
“সর্ব°না°শ, এখানে কিভাবে কি?”
মৃত্তিকার কথায় তানজিম বলল,
“বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাই?”
“হ্যাঁ, তাই করো।”
মমতাজ বেগমের অনুমতি পেয়ে ইমতিয়াজ ও তানজিম মিলে ওকে ভিতরে নিয়ে যায়। গ্রামের একজনকে দিয়ে দাঈ ডেকে আনা হলো আর তারই পরিচিত একজন নার্সকেও আনলো।
মৃত্তিকা জমিদার বাড়ির দরজা খুলে। ভেতরে গন্ধ কম। মৃত্তিকার কপাল কুঁচকে গেল। এতোবছরের পুরোনো বাড়ির ভেতর গন্ধ নেই কেন? এখানে তো গন্ধ, ধুলা সবই থাকার কথা। সুরভির এ অবস্থায় কেউই কথা বলার মতো নেই।
মহিলাদের ভীড় বাড়ে। ইমতিয়াজ, তানজিম, লুৎফর রহমান বাইরে যায়। মৃত্তিকা বাইরে না গেলেও এখানে থাকে না। সে জমিদার বাড়ির ভিতরের রুমগুলো দেখতে বেরিয়ে পড়ে।
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে সে। একটা রুমের সামনে গিয়ে কাঠের খোদাইকৃত ডিজাইনের চকচকে দরজা দেখে দাঁড়িয়ে যায়। সব দরজা পুরোনো হলেও এটা নতুন কেন? প্রশ্ন জাগে ওর মনে। ক্রমাগত দরজা খোলার চেষ্টা করতে থাকে। ভিতরে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে, কিন্তু ভিতর থেকে কোনো শব্দই আসে না। জোরে জোরে দরজায় ধা°ক্কা দেয় সে। দরজা খুলতে ব্য°র্থ হয়।
অনেকটা সময় পার হয়। একসময় মৃত্তিকাকে ডাকে মমতাজ বেগম। মৃত্তিকা যাওয়ার সময় আবারো দরজার দিকে তাকায়। এখনই কাউকে এর কথা বলা যাবে না, আগে দেখতে হবে এর পেছনে কি আছে।
মৃত্তিকা নিচে যায়, সুরভির বাবুর কান্না শোনা যাচ্ছে। মৃত্তিকা একটা রুমে যায়, সুরভিকে সেখানেই রেখেছে। ছেলেবাবু হয়েছে, সুরভি বাচ্চাকে এখনো দেখেনি। সে দেখবে না, অজানা কারণে নিজের ছেলের উপর রেগে আছে সে। মৃত্তিকা বাবুকে কোলে নেয়। সদ্য জন্ম নেয়া বাবুটা কাঁদছে, তার লাল লাল মুখের দিকে তাকিয়ে আছে মৃত্তিকা।
সুরভির কাছে নিয়ে গিয়ে বলল,
“নিজের ছেলেকে আদর করবে না আপু?”
“আগে ওর কানে আযান দিতে বলো, ভালো করে বুঝিয়ে দাও নানার মতো যেন না হয়।”
মৃত্তিকা ওকে কোলে নিয়ে বাইরে আসে। লুৎফর রহমান এখানে নেই, উনিই তো আযান দিতে পারতো। ইমতিয়াজকে একটু দূরে দেখে ডাকে,
“শুনুন, ইমতিয়াজ।”
ইমতিয়াজ এগিয়ে আসে। বাবুর দিকে তাকালে মৃত্তিকা বলে,
“ওর কানে আযান দেন, নইলে আপু ওকে দেখবেও না।”
“এ কেমন কথা?”
“নিন।”
বাবুকে কোলে নিয়ে তার কানে খুব আস্তেধীরে আযান দেয় ইমতিয়াজ। ওর কানে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, এক আল্লাহ্ মহান, তুমি তারই সৃষ্টি। সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্-র।
আযান দেয়া হলে মৃত্তিকা বাবুকে কোলে নিয়ে বলে,
“নানার মতো হইয়ো না, তোমার মা তবে তোমার সাথে এই আযান দাতাকেও ঝে°রে ফেলবে।”
মৃত্তিকা ভিতরে চলে যায়। ইমতিয়াজ হেসে দেয়। বাচ্চার সাথে এ কেমন বাচ্চামো।
______________________________________
“জামিল ফুপা কি আপনার বন্ধু হয়?”
আহনাফের প্রশ্নে জাহাঙ্গীর সাহেব না বোধক মাথা নেড়ে বলল,
“না।”
“কিন্তু আমাকে তাই বলা হয়েছিল, ফুপার বন্ধু। পরে জানতে পারি এই বিয়ে পরিকল্পিত এবং শাফিন জড়িত ছিল এতে।”
নার্গিস পারভিন ভয় পান। কেউ জেনেশুনে তার মেয়েকে তার থেকে দূরে নিয়ে গেছে। আহনাফ আবারো বলে,
“শাফিনের ফাঁ°সি হয়েছে, দা°ফ°নও শেষ। তবে জামিল ফুপা এখনো বাইরেই ঘুরাঘুরি করছে।”
“তাকে তলব করো।”
জাহাঙ্গীর সাহেবের কথায় আব্বাস ফয়েজ সম্মত হলেন। বলেন,
“হ্যাঁ, তাকে আমাদের বাসায় আসতে বলি আর আপনারাও আসেন। ঘটনা বিস্তারিত জানা যাবে।”
আহনাফ ঠোঁট বাঁ°কিয়ে বলল,
“আপনাদের মনে হয় সে এতো সহজে মুখ খুলবে?”
“কখনোই না।”
আহনাফের প্রশ্নের সাথে সাথেই উত্তর দেয় নার্গিস পারভিন।
আহনাফ উনার দিকে তাকালে বলল,
“তুমি বের করো। আলোচনা আর যার সাথেই হোক তার সাথে নয়।”
আহনাফ মাথা নেড়ে উঠে যায়। নার্গিস পারভিন সবদিক থেকে সঠিক, জামিলের সাথে আলোচনা করে বা কথা বলে লাভ নেই। তাকে বুঝিয়ে কাজ নেই। তার থেকে জোর করে কথা বের করতে হবে।
রুমে বসে সারাহ্ সকল কথাই শুনেছে। নিজের স্বামীর সাথে পরিকল্পিত বিয়ের কথাটা শুধু সারাহ্ কেন যেকোনো মেয়ের জন্যই খুবই অপমানের আর লজ্জার হবে।
“ঐশী?”
আহনাফের ডাকে সারাহ্ একটু চমকে তাকায়। অন্যমনস্ক হয়ে ছিল সে। ওর চোখে পানি দেখে আহনাফ কপাল কুঁচকে বলল,
“কান্না করছো কেন?”
সারাহ্ ছলছল চোখে তাকায়৷ আহনাফ ওর চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলে,
“জানার ছিল এসব, লুকানো যাবে না।”
“আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?”
নিষ্প্রাণ প্রশ্ন করে বসে সারাহ্৷ আহনাফ ওর কপালে চুম্বন করে বলল,
“এতোটা সন্দেহ করো না।”
সারাহ্ হয়তো সম্পূর্ণ আশ্বস্থ হয় না। তবুও মাথা ঝাঁ°কিয়ে সম্মতি দেয়।
______________________________________
আজকের মতো ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা বন্ধ করে সবাই। সুরভির এই অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়৷ জমিদার বাড়ির চারটা রুম পরিষ্কার করে কোনোমতে থাকার উপযোগী করা হলো। ইফতার বাইরে থেকে কিনে এনে খাওয়া হলো।
ইফতার শেষে মৃত্তিকা সুরভির সাথে বসে আছে৷ মৃত্তিকা বাবুকে কোলে নিয়ে বসে আছে, সুরভি ঘুমিয়ে পড়েছে। মমতাজ বেগম আসলে মৃত্তিকা বাবুকে উনার কাছে রেখে দোতলায় চলে যায়।
সেই দরজার কাছে যেতেই দেখে ইমতিয়াজ সেখানে দাঁড়ানো। ওকে আঙ্গুলের ইশারায় চুপ থাকতে বলে হাত ধরে নিচে নিয়ে আসে। নিজেদের রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে বলে,
“মা, ওই রুমে ছিল। আমাকে দেখে দরজা লাগিয়ে চলে এসেছে। নতুন দরজা কোথা থেকে এলো ওখানে?”
মৃত্তিকার কাছে উত্তর নেই। তবে মমতাজ বেগমকে সন্দেহ করে যাচ্ছে সে। তবে কি এতোগুলো মানুষের মৃ°ত্যুর পিছনে শাফিনের সাথে মমতাজ বেগমও জড়িত?
রাত বাড়ে, পাশের বাড়ির চুলা থেকে সেহরি রান্না করে আনে মৃত্তিকা। এরমধ্যে মমতাজ বেগম আর রুম থেকে বের হননি। সবকিছু সামলে রেখে রুমে আসে। ইমতিয়াজ নামাজ পড়ে এসেই শুয়ে আছে, দুইদিনের ধ°ক°ল গেছে শরীরের উপর দিয়ে।
মৃত্তিকা এসে বালিশ ঝে°ড়ে শুতে নিয়ে বুঝে বালিশ অনেক শক্ত। এগুলোও তো নিজেদের নয়। আশেপাশের পরিচিত কিছু মানুষ দিয়ে গেছে। এরচেয়ে বেশি আর কিই বা আশা করা যায়।
ইমতিয়াজ নিজের একহাত এগিয়ে দিয়ে বলে,
“শুয়ে পড়ো।”
মৃত্তিকা একটু তাকিয়ে থেকে ইমতিয়াজের হাতের উপর শুয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ ওকে কাছে নিয়ে আসে। মৃত্তিকা ওর বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
“ইমতিয়াজ, আমার অদ্ভুত ফিল হচ্ছে৷ সবকিছু অদ্ভুত লাগছে৷ ওই শব্দটা কিসের ছিল?”
ইমতিয়াজ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“বেশি চিন্তা করছো, তাই এমন হচ্ছে।”
“একবার শাফিনের কবরটা চেক করবেন প্লিজ?”
“সকালে।”
“ঠিক আছে।”
মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে ভালো করে জড়িয়ে ধরে। ইমতিয়াজও তাকে আগলে নেয়, মিশিয়ে নেয় নিজের বুকে।
রাত পেরিয়ে সকাল হলো, দুজন লোককে সাথে নিয়ে শাফিনের কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় ইমতিয়াজ। কবরের আশেপাশে অস্বাভাবিক কিছু নেই। তবুও মন চাইলো তার, শুরু হলো কবর খোঁ°ড়া।
কবর খুঁ°ড়েই অবাক হলো সে। ক°ফি°নের মুখটা খোলা, ভিতরে শাফিনের দেহ নেই। লোক দুজনও ভ°য় পায়। একজন চেঁচিয়ে উঠে৷ চিৎকার শুনে মৃত্তিকা, তানজিম ছুটে আসে। মৃত্তিকা অবস্থা দেখে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
ইমতিয়াজ কবরের ভিতরে নামে। কবরের একপাশের দেয়াল ভা°ঙা, সেখানে একটা সুরঙ্গ। মৃত্তিকাও ভিতরে নামে। দুজনে সুরঙ্গে প্রবেশ করে। সুরঙ্গটা বেশ বড়, অনেকদূর পর্যন্ত প্রসারিত।
সুরঙ্গের মাথায় মাটির সিঁড়ি কাটা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে জমিদার বাড়ির একটা রুমে এসে পৌঁছায় ওরা। কারুকার্যে শোভিত বড় একটা কাঠের পালঙ্ক আছে এখানে, বড় বড় দুটো আরাম কেদারাও আছে, বিশাল একটা আয়না আর তারপাশে কিছু তাক। দুজনে ঘুরেফিরে রুমটা দেখে।
ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“নতুন কাঠের দরজা, এটাই কি সেই রুম?”
মৃত্তিকা এবারে নিজের সন্দেহ প্রকাশ করে বলে,
“তবে কি বড়মণি এসবে যুক্ত?”
ইমতিয়াজ চোখ বড় করে তাকায়। মমতাজ বেগম নিজের মেয়েদের খু°নের জন্য দায়ী? ভ°য়ং°কর ব্যাপার এটা।
ইমতিয়াজ কিছু বলার আগেই মৃত্তিকা বলে,
“উনাকে আমার সন্দেহ হচ্ছিল অনেকদিন থেকেই, তবে এখন এটাও শিউর যে শাফিন বেঁচে আছে।”
“নিচ চোখে দেখা মৃত মানুষ জীবিত কিভাবে হয়?”
মৃত্তিকা চিন্তায় পড়ে। আলাদা কোন জিনিসটা সে ভুলে যাচ্ছে? স্মৃ°তির পাতার পৃষ্ঠাগুলো উল্টেপাল্টে দেখে বুঝে শাফিন বলেছিল, ওর অনেককিছু জানার আছে। অবশ্যই জানার আছে, কিন্তু এ জানার অ°ন্ত কোথায়?
রুমে ইমতিয়াজ একটা চিঠি পায়,
“আমি চললাম আমার পথে,
যেখানে জোসনা থাকে অনেক
একটা বেশি দামি।
অনেক অনেক তারার মাঝে
সবচেয়ে উজ্জ্বল আমি।”
ইমতিয়াজ একটু ভেবে বলল,
“ধাঁধা রেখে গেছে। এটা নিশ্চয়ই কোনো ক্লু।”
মৃত্তিকা কাগজটা দেখে। ইমতিয়াজ এটি ভাঁজ করে পকেটে ঢুকায়। কবর থেকে লা°শ উধাও, নাকি লা°শের ভাণ ধরা জীবিত কেউ উধাও? প্রশ্নের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে ওরা, উত্তরের জন্য অতল গভীরে ডু°ব দিতে হবে।
চলবে….
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
দ্বিচত্বারিংশ পর্ব (৪২ পর্ব)
মৃত্তিকার কাজটুকু ঠিকমতোই করছে সে৷ কাজই হলো মমতাজ বেগমের উপর নজর রাখা৷ সে রাখছে, উনার সব আচরণই স্বাভাবিক। এরমধ্যে শাফিনের কোনো খোঁজ পায়নি ওরা। সবই কেমন যেন শান্ত।
দিন পেরিয়ে যায়, সময়ের নিয়মে রমজানও চলে গেছে৷ শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেছে, কাল ইদ।
মৃত্তিকা পায়েস বানাচ্ছে, ইমতিয়াজ এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ায়। সুরভি আর দেলোয়ারা বাসায় থাকলেও মৃত্তিকা তাদেরকে রান্না করতে দিচ্ছে না, দিবে না৷ সে নিজে নিজে একা কাজ করবে।
ইমতিয়াজকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি ভাবছেন আমি এসব বানাতে পারি না?”
ইমতিয়াজ হাসলো। বলে,
“তা কখন বললাম?”
“না, তাকানোটা অদ্ভুত।”
ইমতিয়াজ এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার চোখ তো সহজে ফসকায় না। তাই তাকানোর স্টাইলটাও দেখেছো।”
মৃত্তিকা একচামচ পায়েস তুলে ফুঁ দিয়ে ইমতিয়াজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“মিষ্টি ঠিক আছে কিনা দেখেন।”
ইমতিয়াজ একটু খেয়ে বলে,
“একটু কম, বাট চলবে।”
ইমতিয়াজের ঠোঁটের কোণায় একটু পায়েস লেগে আছে৷ মৃত্তিকা আঙ্গুল দিয়ে সেটুকু নিয়ে এসে নিজের খেয়ে ফেলে। ইমতিয়াজ একটু তাকিয়ে থেকে রুমে চলে যায়। এখন মৃত্তিকার মনে হয় সে কি করেছে। লজ্জা পায়, মুখখানা লাল হয়ে গেছে তার। আবারো বুকের বামপাশে তীব্র ধু°কপু°ক।
______________________________________
সারাহ্ আজ খুব ব্যস্ত৷ আহনাফের সাথে তার প্রথম ইদ, অবশ্যই বিশেষ কিছু করা চাই৷ তাজা ফুল এনে পুরোনো ফুলের স্থানে রাখা হয়েছে। বিছানার চাদর, সোফার কভার সব পালটে ফেলেছে। পুরো বাসা ঝকঝকে। নিজের জানা ভালো ভালো রেসিপি করার জন্য সব গোছগাছও চলছে একই তালে।
আহনাফ ইফতার করেই বেরিয়ে গিয়েছিল। এখন বাসায় এসেই ড্রইংরুমে বসে কাউকে ফোন করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আব্বাস সাহেব নিজ রুম থেকে বেরিয়ে আহনাফকে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলে আহনাফ?”
আহনাফ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,
“ছোট ফুপ্পির বাসায়৷ ফুপা বাসায় নেই। আজ নিয়ে সাতদিন গেলাম আর আসলাম।”
“জামিল বুঝতে পেরেছে তুমি ওর পিছু করছো, এজন্যই গা ঢাকা দিয়েছে।”
“কয়দিন দেয় আমিও দেখবো।”
সারাহ্ রান্নাঘরে পেঁয়াজ কা°টছিল, দুজনের কথা শুনে ছু°ড়ি চালানো থামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এতোসব সাজ ওর এলোমেলো করতে ইচ্ছা করছে। সব এলোমেলো হয়ে যাক, সব ধ্বং°স হোক।
এতো আয়োজনের মাঝেই আহনাফ ওকে মনে করিয়ে দিয়েছে বিয়েটাই পরিকল্পিত। এ পরিকল্পনা ওরা নয়, একজন লুকায়িত শ°ত্রু করেছে। এই কথা ও বারবার ভুলে যাচ্ছে। একটা বাটারফ্লাই ইফেক্ট হলে সারাহ্ আর আহনাফের হতো না।
ভুলবশত ছু°ড়িটা ও নিজের হাতেই চালিয়ে দেয়৷ কে°টে র°ক্ত পড়ায় টের পায়। “আহ” বলে অস্ফুট স্বরে চেঁচিয়ে উঠে।
আহনাফ ড্রইংরুম থেকে ছুটে এসে ওর হাত ধরে ধ°মক দিয়ে বলে,
“কাজ গুছিয়ে করতে না পারলে করবে না।”
সারাহ্-র কাছে এই ধ°মকটাও খারাপ লাগলো। আহনাফের প্রতি ভুল ভাবনা আসছে তার৷ আহনাফ ওকে ডাইনিং এ এনে বসিয়ে কাটাস্থানে স্যাভলন লাগিয়ে একটা এককালীন ব্যা°ন্ডে°জ দিয়ে দেয়।
আব্বাস সাহেব পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
“একা এতোকিছু কেন করছো, মা?”
“পারবো আমি।”
ছোট করে জবাব দিয়ে সারাহ্ আবারো রান্নাঘরে চলে যায়। আহনাফ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। সারাহ্-র এমন পরিবর্তন কি শুধুই প্রেগন্যান্সির সময়ের মুড সুইং? সন্দেহ হয় আহনাফের৷ অবশ্যই সারাহ্ বিয়ের বিষয়টা নিয়ে ভাবছে৷
______________________________________
পায়েসটুকু বানিয়ে এসেই মেহেদী দিতে বসে মৃত্তিকা। অনেকদিন পর মেহেদী ধরেছে, তাই হাত কাঁপছে। ইমতিয়াজ বিছানার একপাশে বসে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে, অফিসের কোনো একটা কাজে সে ব্যস্ত।
“শরীফ সাহেব অস্ট্রেলিয়া যাবে।”
ইমতিয়াজের কথায় মৃত্তিকা মুখ ভেংচিয়ে বলে,
“সাহেব? উনাকে এতো ভদ্র করে ডাকার কি দরকার?”
“আমার শশুর তো।”
মৃত্তিকা উঠে এসে একটুখানি মেহেদী লাগানো হাতটা ওর সামনে ধরে বলল,
“কিসের শশুর? আমি যাকে বাবা মানি না আপনি তাকে শশুর ভাবেন কেন?”
ইমতিয়াজ ওকে টে°নে নিজের কোলে বসিয়ে একহাতে কোমড় জড়িয়ে বলল,
“তোমার বাবা, আমার শশুর। তোমার মানা কিংবা না মানার উপর আমার কিচ্ছু আসে যায় না।”
ইমতিয়াজের হাতের বাঁধন হালকা হলে মৃত্তিকা উঠে যায়৷ ঘটনাক্রমে হওয়া নিজের অস্বাভাবিক ভাব মুখে না এনে বলে,
“সুরভি আপুকেও আমার সন্দেহ হয়েছিল, বেশ অনেকদিন তাই নজরব°ন্দি রেখেছি। কিন্তু সব তো স্বাভাবিকই দেখলাম।”
ইমতিয়াজ ল্যাপটপ বন্ধ করে বলে,
“সব আমাদের ভাবনার কয়েক ধাপ উপর দিয়ে হচ্ছে৷ ধাঁধার সমাধান হয়নি। শাফিন নারী পাচারে যুক্ত ছিল, কোথায় সেই স্থান তাও খুঁজে পাইনি। বুঝতে পারছো আমরা পিছিয়ে আছি?”
কথা সত্য, শ°য়°তান এমন সব বুদ্ধি খাটায় যা আমরা ভাবতেও পারি না। ভদ্র সুরতে ক্ষতি করে আমাদের। মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“তা তো বুঝেছি, তবে শাফিন জীবিত থেকে কবর পর্যন্ত গেলে এখানে বড় বড় লোকের আনাগোনা আছে।”
“প্রথম কথা হলো জে°লারের হাত আছে।”
মৃত্তিকা ওর পাশে এসে বসে বলে,
“হ্যাঁ, তবে জে°লারের থেকে আগে শাফিনকে বের করে আনতে হবে। নিখুঁতভাবে গা ঢাকা দিয়ে আছে সে। ঝ°ড়ের আগে আকাশ এভাবেই শান্ত থাকে।”
“তোমার কি মনে হয় ধাঁধার সমাধানে শাফিনকে পাওয়া যাবে? ওকে খুঁজে পাওয়ার জন্য ধাঁধা দেয়নি।”
মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলল,
“তা আমি জানি, এরচেয়ে শর্টকাট পদ্ধতি আছে।”
“কি?”
মৃত্তিকা মুখে হাসি বজায় রেখে মেহেদীর প্যাকেট হাতে নিয়ে উঠে যায়৷ ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে বলল,
“পদ্ধতিটা কি?”
মৃত্তিকা ফিরে তাকিয়ে আবারো হাসলো। ইমতিয়াজ বোকাসোকা চেহারা করে তাকিয়ে থাকে৷ সুরভির রুমে গিয়ে মৃত্তিকা ওর হাতে মেহেদী ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“সুন্দর করে দিয়ে দাও তো।”
______________________________________
গরম গরম স্যুপ খাচ্ছে শাফিন, পাশে অপরূপা আছে। তার গায়ে আকর্ষণীয় পোশাক, আবেদনময়ী হয়ে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে শাফিনের কাছে ধরা দেয় সে। প্রতিদিন এই একই কাজ তার।
সেদিন ফাঁ°সি না দিয়ে ঘুমের ই°ঞ্জে°কশন প্রয়োগ করে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল শাফিনকে। তারপর নিজেদের লোক দিয়ে গোসল ও ক°ফি°নব°ন্দি করা হয়। ক°ফি°নে বেশ অনেকগুলো ফুটো ছিল হাওয়া চলাচলের জন্য। কবরের নকশা তো আগেই অপরূপাকে দেয়া হয়েছিল আর এতো পরিকল্পনায় আজ সে মুক্ত বাতাসে বিচরণ করছে।
“ওই নোটটা কেন ছেড়েছিল?”
অপরূপার প্রশ্নে শাফিন হেসে বলে,
“মৃত্তিকা খুঁজবে তার উত্তর, আর খুঁজে জানতে পারবে আমার মায়ের নাম ছিল জোসনা৷ তখন নিজের নানীর নাম তা°লা°শ করবে।”
“ওর নানী?”
“মেহরিবা সুলতানা, আমার চাচী।”
“তাতে আমাদের লাভ?”
শাফিন অপরূপার কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলল,
“এতে আমরা পাকাপোক্ত কিছু ভাবতে সময় পাবো, এখন যেমন পাচ্ছি।”
অপরূপা একটু করে মাথা ঝাঁকায়। একজন মানুষ কতটা নি°কৃ°ষ্ট হতে পারে তার উদাহরণ বোধহয় শাফিন। অপরূপা জানে এই লোকটা একটা সা°ই°কো, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কখনোই এমন আচরণ করবে না। ডা. আরিফা ওকে একবার বলেছিল, এই মানুষকে হাজার চিকিৎসা করেও সুস্থ করা যাবে না, কারণ সে তো সুস্থ হতেই চায় না।
“মমতাজ জানে আমি এখানে?”
অপরূপা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে৷ শাফিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
“একমাত্র ওকেই কেউ সন্দেহ করে না, ওকে এমনভাবে থাকতে বলো যাতে কেউ টের না পায়৷ আমি সময় করে কথা বলবো।”
“ঠিক আছে।”
______________________________________
আফরোজা বাসার সবার সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে। সারাহ্-র সাথে কথা বলার সময় বলে,
“ওমা সারাহ্, মেহেদী দাওনি?”
“না আপু, হাত কে°টে গেছে৷”
“তো কি হয়েছে? বিয়ের পরে প্রথম ইদ, হাত ভরে মেহেদী দিবে। (একটু থেমে) আহনাফকে দাও।”
সারাহ্ আহনাফের দিকে ফোন এগিয়ে দেয়৷ আহনাফ ফোন নিলে আফরোজা বলে,
“কিরে, সারাহ্-র হাত খালি কেন? মেহেদী দিয়ে দিবি।”
“আমি দিতে পারি না।”
“যা পারিস তাই দিবি।”
“আচ্ছা আচ্ছা।”
আহনাফ আব্বাস সাহেবকে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে রুমে আসে। সারাহ্ টেবিলের উপরে থাকা বইগুলো গোছাতে ব্যস্ত।
আহনাফ এসে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আপু বলেছে তোমাকে মেহেদী দিয়ে দিতে।”
“দিবো না আমি।”
সারাহ্-কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”
সারাহ্ মাথা নেড়ে না বোঝায়। আহনাফ একটু হেসে গিয়ে আলমারি খুলে। একটা শাড়ি বের করে সারাহ্-র হাতে গিয়ে বলল,
“এটা পড়ো, তারপর মেহেদী দেয়ার ব্যবস্থা আমি করছি।”
সারাহ্ শাড়িটা হাতে নেয়। আহনাফ শান্ত কন্ঠে বলে,
“পড়ে নাও, আমি অপেক্ষা করছি।”
আহনাফ বাইরে চলে যায়। কি করবে, পড়বে কি পড়বে না ভেবে ভেবে অবশেষে শাড়িটা পড়েই নেয় সারাহ্। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে আঁচড়ানোর সময়ই আহনাফ বাইরে থেকে ডেকে বলল,
“ঐশী, আসবো আমি?”
“আসেন।”
মিনমিনে করে জবাব দিলো সারাহ্।
আহনাফ ভিতরে আসে। হঠাৎ সারাহ্-র দিকে তাকাতেই সে থমকে যায়। ছোটবেলায় খেলার ছলে যেমন দাঁড়িয়ে থাকতো বা স্কু°ই°ড গেমে যেমন হঠাৎ থামতে হয়, ঠিক তেমনি আছে আহনাফ।
সারাহ্ একটু লজ্জা পায়। আহনাফ কাছে আসার সাথে সাথে তার লজ্জার পরিসর বাড়ে৷ সারাহ্ চঞ্চল দৃষ্টির চোখদুটো নামিয়ে নেয়। আহনাফ ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে ওর দিকে৷ নিজের ঐশীর রূপের প্রশংসা সে করে না, অন্যদিনের মতো আজ লজ্জাও দিচ্ছে না কিন্তু সারাহ্ অনবরত লজ্জা পাচ্ছে।
আহনাফ ওর হাতদুটো একহাতে ধরে, অন্যহাতে ওর মুখটা তুলে। দুজনের চোখ দুজনকে দেখে। ঘনঘন ফেলতে থাকা সারাহ্-র চোখের পাপড়ির ছন্দে কোনো এক নৃত্য দেখছে আহনাফ।
আহনাফের কৌতুহলী দৃষ্টি, বড়বড় চোখ, মোটা ঠোঁটজোড়া দেখে দেখে লজ্জা বাড়ে সারাহ্-র৷ কন্ঠ তো সেই কবেই থেমে গেছে, আহনাফ ওর বাধা মানে না।
আহনাফ ওর হাত ধরে এনে বিছনায় বসায়, নিজে বসে মুখোমুখি। ওর হাত টে°নে তালুতে চুম্বন করে, তারপর টেবিল থেকে মেহেদী নিয়ে এসে ডিজাইন করা শুরু করে। ঠিকমতো তো বহু দূর, কোনোমতে মেহেদী লেগেছে। এলোমেলো আর এবড়ো থেবড়ো ডিজাইনে সারাহ্-র হাত লেপ্টে গেছে।
তবে এতে সারাহ্-র সংশয় দূর হয়েছে। আহনাফকে নিয়ে ভুল চিন্তার জন্য নিজেই অনুতপ্ত সে। ভালোবাসি না বললেও এ ভালোবাসা এভাবেই বাড়তে থাকুক।
চলবে…..