অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-১৯+২০+২১

0
562

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ঊনবিংশ পর্ব

রাত আটটা, শাফিন সাহেব মাত্রই বাসায় এসেছেন। একটা বিষয় নিয়ে উনি খুবই রেগে আছেন আর তা হলো কলরবের সাথে হওয়া উনার কথা কা°টা°কা°টি।

“মিউকো।”

শাফিন সাহেবের ডাকে মৃত্তিকার সাথে সুরভিও বেরিয়ে আসে। মৃত্তিকা একগ্লাস পানি এনে মামার সামনে রেখে বলল,
“জি, মামা।”
“কলরব কি বলেছে তোমাকে?”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে দাঁড়ায়। দেলোয়ারা বেরিয়ে আসে। বিচলিত হয়ে বলে,
“কি হয়েছে?”

শাফিন সাহেব মৃত্তিকাকে জিজ্ঞাসা করে,
“কলরবের সাথে তোমার কি কথা হয়েছে?”

মৃত্তিকা নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রাখলো। তারপর একে একে কলরবের সকল আচরণ খুলে বলল মামাকে। কলরবের সাথে যে ওর বাবাও ছিল তাও জানালো।

শাফিন সাহেবের রাগ বাড়লো। চিৎকার দিয়ে উঠলেন,
“সাহস কি করে হলো আমার বোনের নামে এধরনের কথা বলার? ওই ছেলেকে আমি..”

রাগে কি°ড়মি°ড় করছেন উনি। মৃত্তিকা উনাকে ধরে বলে,
“মামা, নিজের শরীর খারাপ করবেন না।”

দেলোয়ারা এসে শাফিন সাহেবকে সান্ত্বনা দিলেন,
“দেখো, যা হয়েছে তা হয়ে গেছে। পরিবর্তন সম্ভব নয়৷ তাও শুকরিয়া করো বিয়ের আগেই এসব হয়েছে না হলে মেয়েটার জীবনের বাকিটাও শেষ হয়ে যেত।”

শাফিন সাহেব সোফায় বসেন। সামনে থাকা গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি পান করে। তারপর বলেন,
“আমার দোকানে এসেছিল। যা নয় তাই ব্যবহার করেছে। মি°থ্যাবা°দী, প্র°তা°রক এমন কোনো কথা নেই যা বলেনি।”

শাফিন সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। মৃত্তিকা সুরভির পাশে গিয়ে বসে। সুরভি ওর হাত ধরে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলে।

“ইমতিয়াজ ঠিক বলেছিল মিথ্যা বলাটা ভালো নয় বরং আরো খারাপ হবে। জানাজানি হলে বিষয়টা খারাপের দিকেই এগোবে। এখন তাই হলো।”

শাফিন সাহেবের কথায় মৃত্তিকা বড়বড় চোখে তাকায়। হুট করে ইমতিয়াজের নাম শুনে তার মন আবারো ছটফটিয়ে উঠে।
______________________________________

সারাহ্ বারান্দায় বসে আছে। আহনাফ ওকে যতই বোঝাতে চায় সে বুঝতে চায় না। কিছুটা ইগো দেখিয়েই আছে সে।

টেবিলে বসে আহনাফ কিছু পড়ছে আর বারবার দেখছে বারান্দার দরজার দিকে। একপর্যায়ে ডাক দেয়,
“ঐশী।”

সারাহ্ জবাব দেয় না, উঠেও আসে না। আহনাফ আবারো ডাকে,
“ঐশী, এদিকে এসো।”

তবুও সারাহ্-র কোনো সারাশব্দ না পেয়ে আহনাফ দুষ্টুমি করে ডাকে,
“জান, কলিজা, গু°র্দা, পাকস্থলী এদিকে আসো।”

আহনাফের কথায় সারাহ্-র হাসি পায়। সে নিরবে হাসে, কিন্তু এবারেও জবাব দেয় না। আহনাফ ফোঁ°স করে একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে যায়। আহনাফের আসার শব্দে সারাহ্ মলিন মুখে বাইরে তাকিয়ে থাকে।

“ডাকছি যে শুনতে পাচ্ছো না?”
না শুনার ভান করে বসে আছে সারাহ্।

আহনাফ ওকে কোলে তুলে রুমে নিয়ে আসে। বিছানায় বসিয়ে নিজে পাশে বসে বলল,
“অবুঝ বাচ্চাদের মতো আচরণ করো না, ঐশী। তোমাকে মানায় না এসবে। (একটু থামে) তুমি জানো আমার অতীত সম্পর্কে। আমাকে একটু সময় দাও।”

এবারে সারাহ্ কান্না করে দিলো। বেশ কিছুক্ষণ একভাবে কাঁদলো সে, আহনাফ চেয়ে রইলো ওর দিকে।

“সময় লাগলে আগে বলতে পারতেন। কিন্তু না প্রথমদিন থেকে আমার সাথে অদ্ভুত আচরণ করে গেছেন। যেন আমি ঘুড়ি, হাওয়ার দোলায় সুতার সাথে ওড়ছি আর আপনি ইচ্ছামতো সুতা ছাড়ছেন।”

আহনাফ ওর গালে হাত দেয়। সারাহ্ মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আহনাফ জোর করে ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“আমি অপরাধ স্বীকার করছি। কিন্তু প্লিজ চুপ করে এরকম গু°ম°রে থেকো না।”

সারাহ্ ওর দিকে তাকায় না। চোখ নামিয়ে রেখেছে। কপালের দুপাশে কয়েকটা চুল এলোমেলো হয়ে এসে পড়েছে। আহনাফ চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলে,
“ম্যাডাম তো তোমাকে প্রেগন্যান্ট বলে বেড়াচ্ছে।”

সারাহ্ অ°গ্নিদৃষ্টি দেয় আহনাফের দিকে। আহনাফ দাঁত বের করে হেসে বলল,
“বাংলা সিনেমার মতো মাথা ঘুরে পড়লে আর প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে?”

কথা শেষ করে হো হো করে হেসে উঠে সে। সারাহ্ একটু সরে বসে বলল,
“আগের দুইদিন আমার ব°মি হয়েছিল, আবার পিঠার গন্ধে অস্বস্তি হচ্ছিল৷ আগের দিনও খাবারের গন্ধে গা গু°লি°য়েছে। তাই ম্যাডাম এসব ভেবেছে।”

আহনাফ ভ্রূ উঁচিয়ে তাকায়, মুখে দুষ্ট হাসি। সারাহ্ আড়চোখে ওকে দেখে বলে,
“কিন্তু প্রেগন্যান্সির জন্য না, আমার প্রেশার কম ছিল আর গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা ছিল।”

আহনাফ হেসে ওর কানের কাছে এসে বলল,
“আমি জানি তুমি প্রেগন্যান্ট নও।”

সারাহ্ গালে চুম্বন করে চলে যায় আহনাফ। সারাহ্ রাগে গাল মুছে। আহনাফের এসব আচরণ ওর একদমই সহ্য হয়না।

আহনাফ আবারো ফিরে এসে বলল,
“কাল বিকেলে ঢাকায় যাবো।”

সারাহ্ একইভাবে বসে থেকে বলল,
“কোথাও যাবো না আমি।”

আহনাফ এসে ওর পাশে বসলো। গালে বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে হালকা স্পর্শ করে বলে,
“যেতে তো হবেই তোমার। ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক।”

আহনাফ আবারো সারাহ্-র দিকে এগিয়ে আসলে সারাহ্ আহনাফকে ধা°ক্কা দিয়ে সরে যায়। একটা ঢোক গিলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে শান্তভাবে বলে,
“যতদিন মেনে নিতে না পারবেন, ততদিন দূরত্ব রেখে চলবেন। যদি তা রাখতে না পারেন, তবে আমি চিরদিনের দূরত্ব তৈরি করতে বাধ্য হবো।”

সারাহ্ একটু থামে। বড়বড় দুটো নিশ্বাস ফেলে বলে,
“বাইরের মেয়েদের সম্মান করতে পারেন, অথচ নিজের তিনকবুলের বিয়ে করা বউকে সম্মান করা যায় না। অধিকার জোর করে পাওয়া যায় না, সম্মান করলে অধিকার আপনা থেকেই আসে।”
______________________________________

রাত ৯ টা বেজে ৪২ মিনিট, মাত্রই অফিস থেকে বাসায় এসেছে ইমতিয়াজ। দরজা খুলতেই বিড়ালটা দৌড়ে ওর কাছে আসে। ইমতিয়াজ তাকে কোলে তুলে আদর করে বলে,
“মিউকো, মিস করছিলি আমাকে?”

অপরপাশের মিউ মিউ শব্দে ইমতিয়াজ হেসে রুমে যায়। শার্ট খুলে বিছানায় ফেলে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হাতঘড়ি খুলছে তখনই ফোন বাজে।

পকেট থেকে ফোন বের করে শাফিন সাহেবের নাম্বার দেখে রিসিভ করে।

“আসসালামু আলাইকুম, মামা। কেমন আছেন?”

কিছুক্ষণের নিরবতার পর অপরপাশ থেকে উত্তর আসে,
“মামা ভালো আছে, আমি ভালো নেই।”

মৃত্তিকার কন্ঠে চমকে উঠে ইমতিয়াজ। ফোন রেখে দিতে চেয়েও রাখে না। বলে,
“আপনার ভালো থাকার মেডিসিন আমার কাছে নেই।”
“এক কথায়ই কোনো ডাক্তার ওষুধ দেয় না। ভালো করে বলতে হয়। ডাক্তারেরও শুনতে হয়।”
“ভণিতা না করে কি বলতে চান তাই বলেন।”

মৃত্তিকা আবারো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“দেখা করতে চাই, কথা আছে। সময় হবে?”
“না, এখন লং টাইম ডিউটি।”

সরাসরি এভাবে না করায় মৃত্তিকার একটু খারাপ লাগলো। তাই সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর কল কে°টে দেয়।

ইমতিয়াজ আবারো কল করে। রিসিভ হলেও মৃত্তিকা কথা বলে না।

ইমতিয়াজ নিজে থেকেই বলে,
“কাল অফিস টাইমের পর দেখা করতে পারবো, ৭ টার পর। কোথায় থাকবেন?”

মৃত্তিকা একটু খুশি হলেও মুখে হাসলো না। বলল,
“কাল কাকরাইল বড়মণির বাসায় যাবো। তবে আশেপাশে যেকোনো জায়গায় দেখা করতে পারি।”
“ওকে, আমি বাসার কাছেই থাকবো। কল দিলে নিচে আসবেন।”
“ঠিক আছে।”
“নাম্বার কি আগেরটাই আছে?”
“হুম।”
“ওকে, বাই।”

মৃত্তিকা ফোন রেখে হেসে দেয়। এতোদিন পর ইমতিয়াজের সাথে দেখা হবে। হঠাৎ তানজিমের কথাগুলো মনে পড়ে। মুখটা মলিন হয় তার। সবাই শুধু তাদের কথা কেন ভাবে? মৃত্তিকার দিকটা কি কেউ বুঝে না?

মৃত্তিকার ঠোঁট কেঁপে উঠলো। ডানচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। চোখজোড়া বন্ধ করলো সে।
______________________________________

পরদিন সকালে,
তানজিম এখনো ভার্সিটিতে আসেনি। একের পর কল করছে সামিহা। রিসিভ করার নামগন্ধও নেই। কিছুক্ষণ পর ম্যাসেজ আসে,
“আমি আজ ক্লাস করবো না, নোট দিয়ে দিস।”

সামিহার মনটা একটু খারাপ হলো। কারণ জিজ্ঞাসা করে ম্যাসেজ করলে ফোন অফলাইন দেখালো। নিশ্চয়ই তানজিমের বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে।

এদিকে মৃত্তিকা, শাফিন সাহেব তানজিমের বাসায় এসেছে। লুৎফর রহমানও আজ দোকানে যাননি। ফরচুন শপিংমলে উনার দুটো কাপড়ের দোকান আছে। কর্মচারী থাকায় মাঝে মাঝে দোকানে না গেলেও কাজ চলে যায়।

মূলত বাবার কথায় ভার্সিটিতে যাওয়া বন্ধ করেছে তানজিম। মৃত্তিকার সাথে কথা বলার বা দেখা করার ন্যূনতম রুচি ওর নেই। খালাতো বোনের হাসবেন্ডকে পছন্দ করতে পারে, এরকম মেয়েকে তানজিম সহ্যই করতে পারে না।

লুৎফর সাহেব ইমতিয়াজকে কল করে অফিস ছুটির পর বাসায় আসতে বলেন, ইমতিয়াজও রাজি হয়। বাসার যেকোনো সমস্যা বা সিদ্ধান্তে ইমতিয়াজ উনাদের ভরসার জায়গা।

মৃত্তিকা মমতাজ বেগমের সাথে কথা বলছে। তানজিম এসে মাকে বলল,
“আম্মু, আমার তো এখানে থাকার কোনো দরকার নেই। আমি কি যেতে পারি?”
“না, থাকো। ইমতিয়াজ আসা পর্যন্ত থাকো।”

মৃত্তিকা তানজিমের দিকে একনজর তাকায়। তানজিম বিরক্তি নিয়ে বলে,
“ভাইয়াকে এখানে টা°নার কি দরকার ছিল? যার যার সমস্যা সে সে সমাধান করবে।”
“তানজিম, তোমার বাবা তোমার চেয়ে ভালো বুঝে।”

তানজিম রেগে চলে যায়। মৃত্তিকা বুঝে ওর রাগের কারণ, কিন্তু সে নিরব থাকে। এক্ষেত্রে কথা বলার অর্থ আ°গু°নে ঘি ঢালা।

দুপুরের পর কলরবের ফ্যামিলি বাসায় আসবে। সব বিষয় নিয়ে সরাসরি আলোচনা হবে আজকে।
______________________________________

আজ আহনাফের সাথেই কলেজে এসেছে সারাহ্। তবে একেবারেই চুপচাপ সে। যেন কথা বলাই ভুলে গেছে। আহনাফও আজ চুপ।

প্রথম পিরিয়ডে ক্লাস আছে আহনাফের। ক্লাসে মন বসাতে কষ্ট হলো তার। কারণটা বুঝতে পেরেছে, গতরাতের সারাহ্-র কথা আর ওদের মাঝে অদৃশ্য দেয়ালের যে বিভাজন তৈরি হয়েছে সেটা আহনাফ মানতে পারছে না।

কোনোমতে ক্লাস করে বেরিয়ে আসে। নিজেকে বারবার বোঝাতে থাকে, কিন্তু শান্ত করতে পারে না। অস্থিরতা বিরাজ করছে তার মনে। দুরন্ত ঘোড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ছোটাছুটি করছে বুকের বামপাশে থাকা সেই য°ন্ত্র।

রুমে এসে বসে মাথানিচু করে থাকে। বারবার নিজেকে একই কথা বোঝাচ্ছে,
“ঐশী কেউ না। ওর কথা ভেবো না, কষ্ট পাবে। সব অনুভূতি মি°থ্যা, এসবের কোনো মূল্য নেই। তাহসিনা ছাড়া আর কেউ তোমাকে ভালোবাসবে না, বুঝবে না। ঐশীর প্রতি থাকা সকল অনুভূতিকে ক°বর দাও, মূল্যহীন ওগুলো।”

নিজেকে বোঝাতে ব্যর্থ হয় আহনাফ৷ এই একটা মেয়ে ওকে সর্বোচ্চ এলোমেলো করেছে। ভদ্র আহনাফকে অভদ্র করেছে, শান্ত আহনাফকে অশান্ত করেছে। মেয়েটার শান্ত চাহনি, কথা কিংবা অনবরত কাঁপতে থাকা সেই ওষ্ঠোধর সবকিছু আহনাফকে পাগল করেছে।

আহনাফের এমন অস্থিরতার ঠিক উলটো চেহারা সারাহ্ ধারণ করেছে। শান্তভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করছে। ক্লাসে যাওয়ার সময় টিচার্স রুমে আহনাফকে দেখেছে। আহনাফ যে অন্যমনস্ক হয়ে আছে তা সে খেয়াল করেও নিশ্চুপ।

ওরা দুজন যেন দুটি দ্বীপের বাসিন্দা। একটি দ্বীপের ঢেউ শান্ত, আরেকটি দ্বীপে হচ্ছে সুনামি। আছড়ে পড়ছে বড় বড় ঢেউ আর ভেসে যাচ্ছে সে দ্বীপে থাকা আহনাফ।
______________________________________

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় মৃত্তিকার নাম্বারে ম্যাসেজ দেয় ইমতিয়াজ,
“আমি অফিস থেকে বেরিয়েছি, বাসার কাছে চলে এসেছি। আপনি রেডি থাকেন। – ইমতিয়াজ।”

ম্যাসেজটা দেখে মৃত্তিকা দ্রুত ডি°লিট করে দেয়। বাসার সবার সামনে বসে আছে সে। দ্রুত চোখে সকলের দিকে তাকায়। কিভাবে বের হবে সে তাই ভাবতে থাকে।

বিকালে কলরবের ফ্যামিলি এসেছিল। মৃত্তিকা নিজেই বিয়ে ভা°ঙার কথা বলেছে আর তা ইতোমধ্যে ভে°ঙেও গেছে। বাবাকে নিয়ে অনেক কথা হলেও মৃত্তিকা সেখানে ছিল না। এখন বাসার সবাই মোটামুটি স্বাভাবিক আছে।

মৃত্তিকা উঠে রুমে গিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে। সাদা সুতির থ্রিপিসের সাথে সোনালী রঙের স্কার্ফ মাথায় পেছিয়ে নেয়। বুকের ভেতর সাহস জুগিয়ে ড্রইংরুমে আসে সে।

শাফিন সাহেবকে বলল,
“মামা?”
“জি, মামা।”

মৃত্তিকা চঞ্চল চোখে এদিকওদিক তাকিয়ে বলে,
“আমি একটু বাইরে যেতে চাই। যেতে পারি?”

শাফিন সাহেব হেসে বলেন,
“সুরভি নেই বলে ভালো লাগছে না? আচ্ছা, যাও। বেশি দূরে যেও না।”
“থ্যাংক ইউ।”

মৃত্তিকা হাসি হাসি মুখে বেরিয়ে যায়। পড়ার টেবিলে বসে মৃত্তিকার কথা শুনেছে তানজিম। কিন্তু ওর আন্দাজে ইমতিয়াজের কথা আসে না।

বাসার বাইরে এসে ইমতিয়াজকে কল দেয়। ইমতিয়াজ রিসিভ না করে ওর দিকে এগিয়ে আসে।

“বাসার কাছে থাকবো বলেছিলাম, সামনে না।”

মৃত্তিকা একপ্রকার লাফিয়ে উঠে বামদিকে ইমতিয়াজকে দেখে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে। মৃত্তিকা পূর্ণদৃষ্টি দেয় ইমতিয়াজের দিকে। গাঢ় খয়েরী শার্ট, সাথে কালো প্যান্ট, শার্টের হাতা কনুই অব্ধি গুটিয়ে রাখা, প্যান্টের কোমড়ের দিকে অফিস আইডি কার্ড ঝুলানো।

ইমতিয়াজ হাত বাড়িয়ে হাঁটতে ইশারা করে। হাঁটতে হাঁটতে মৃত্তিকা আবারো ওর দিকে তাকায়। নিজেই নিজেকে ফিসফিস করে বলল,
“নজর খারাপ হয়ে গেছে, আর দেখিস না।”

একটা ক্যাফেটেরিয়া পর্যন্ত ওদের গন্তব্য হয়। কফি অর্ডার করে মুখোমুখি বসে দুজনে।

“বলুন, কি কথা বলতে চাচ্ছিলেন?”

মৃত্তিকা লজ্জার চাদর ফেলে স্বাভাবিক হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমার কথা আসলে শোনার মতো কেউ নেই। কারো ধৈর্য নেই, সময় নেই। (একটু থামে) নিজেকে কেমন যেন যাযাবরের মতো মনে হয়। হয় মামার বাসা আর না হয় বড়মণির বাসা। নিজের বলে কিছু নেই আমার এদেশে।”

ওদের কফি চলে আসে। ইমতিয়াজ ওকে খেতে ইশারা করে কাপে চুমুক দেয়।

মৃত্তিকা এক চুমুক কফি পান করে আবারো বলা শুরু করে,
“কলরবের সাথে অনেক ঝা°মেলা হয়েছে, বিয়েও ভে°ঙে দিয়েছি।”
“কিরকম ঝা°মেলা?”

ইমতিয়াজের কথায় কথা থামে মৃত্তিকার। ওর দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
“মামকে নিয়ে খারাপ কথা বলেছে। বলেছে আমি নাকি..”

মৃত্তিকা আর বলতে পারে না। ইমতিয়াজ জিজ্ঞাসা করে,
“আপনি কি?”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে ভারি কন্ঠে বলল,
“আমি মামের (একটু থামে) মামের না°জায়েজ সন্তান আর আমার (আবারো থামে) শরীরে নাকি অনেক পুরুষের..”

ইমতিয়াজ ওর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে থামিয়ে দেয়। মৃত্তিকা ছলছল চোখে ওর দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ হাত সরিয়ে নেয়। মৃত্তিকার নয়নের ধারা আবারো গড়িয়ে পড়ে।

ইমতিয়াজ টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলে,
“চোখ মুছে নেন।”

মৃত্তিকা চোখ মুছে নাক ঝে°ড়ে নেয়। ইমতিয়াজ বলে,
“এতো কথা বলে কেউ পার পেয়ে গেল?”
“থা°প্প°ড় মে°রেছি।”

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ইমতিয়াজ বলল,
“একটা মেয়ের থা°প্প°ড়ে কি এমন হয়েছে? প্রত্যেকটা শব্দের জবাব দেয়া উচিত ছিল।”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে রইলো। স্কার্ফ পেরিয়ে কপালের দুপাশে চুলগুলো এসে পড়েছে। মৃত্তিকা কানের পিছনে চুল গুজে বলে,
“বাবাকে কি করবো? সারাজীবন মামের নামে এসব বলেই গেল। উনিই তো কলরবকে এসব বলেছে।”

ইমতিয়াজ শান্তভাবে বলে,
“আপনার বাবা কি করে?”
“ডাক্তার।”

ইমতিয়াজ হেসে দেয়৷ বলে,
“ডাক্তার হয়ে মেয়ের পেছনে সারাদিন কিভাবে থাকে?”

মৃত্তিকা একটু ভেবেচিন্তে নিজের মনের সন্দেহের কথা বলেই দেয়।
“উনি সারাদিন থাকে না, মাঝেমধ্যে থাকে। আর (একটু থেমে আশেপাশে তাকায়) উনার স্পা°ই আমার আশেপাশে থাকে।”
“কি?”
মুখ বাকিয়ে কপাল কুঁচকায় ইমতিয়াজ।

মৃত্তিকা মাথা নাড়ে। মুখে বলে,
“এটা আমার সন্দেহ। নাহলে আমার প্রত্যেক পদক্ষেপের খবর উনার কাছে কিভাবে থাকে?”

মৃত্তিকা আবারো আড়চোখে এদিকওদিক তাকায়। বলল,
“বাবার কাছে একটা পি°স্ত°লও আছে। আমি নিজে দেখেছি ওটা। অ°বৈ°ধ নয়, বৈ°ধ।”

ইমতিয়াজ চোখ ছোট করে তাকায়। ওই লোকটা কি আসলেও একজন ডাক্তার নাকি এর আড়ালে অন্যকিছু? প্রশ্নটা মৃত্তিকাকে না করলেও জানার আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্র°তর হতে থাকে ইমতিয়াজের।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

বিংশ পর্ব

“তোমাদের দেখা হলো কোথায়?”

বাসায় মৃত্তিকা ও ইমতিয়াজ একত্রে আসায় কিছুটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করলেন শাফিন সাহেব।

ইমতিয়াজ স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলো,
“বাসার কাছেই উনাকে হাঁটতে দেখলাম। তারপর আসা আরকি।”

শাফিন সাহেব হাসলেন। বলেন,
“একা একা ভালো লাগে না ওর। (একটু থেমে) আচ্ছা, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।”
“জি।”

ইমতিয়াজ তানজিমের রুমে গেল। পকেট থেকে ফোন বের করে টেবিলের উপর রেখে তানজিমকে বলে,
“কেমন আছো?”
“ভালো।”

তানজিম খাটে বসে বই পড়ছিল। একটু আগে শাফিন সাহেব আর ইমতিয়াজের মধ্যে হওয়া কথাগুলো সে শুনেছে। উঠে এসে বলল,
“মিউকোপুর সাথে তোমার কোথায় দেখা হয়েছে ভাইয়া?”

ইমতিয়াজ চোখ কুঁচকে বলল,
“বাসার কাছে।”
“সত্যি বলছো?”

ইমতিয়াজ জবাব না দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। এখানে থাকলে তানজিম একের পর এক প্রশ্ন করেই যাবে।

কিছুক্ষণ পর শাফিন সাহেব আর লুৎফর রহমানের সাথে কথা বলতে বসে ইমতিয়াজ। এসব কথা বা কাজে তানজিম বেশ বি°র°ক্ত। বিয়ে ভে°ঙেছে এটা নিয়ে এতো আলোচনার কোনো দরকার নেই।

মৃত্তিকা মাথা নুইয়ে রুমে চলে যায়। প্রচন্ডভাবে মাথা য°ন্ত্র°ণা করছে, হয়তো মাই°গ্রে°নের সমস্যা। আপাতত সে নিরবতা চায়।

বারান্দায় গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। যতক্ষণ তুমি চিৎকার করে নিজের মনের কথা বলতে না পারো, ততক্ষণ এক আল্লাহ্ ছাড়া কেউ তোমার অবস্থা বুঝবে না। এটাই বাস্তবতা, যা মৃত্তিকার ক্ষেত্রে হচ্ছে।
______________________________________

রাত ১১ টা, আহনাফ ঢাকা যাবে বলেও যায়নি। এব্যাপারে সারাহ্-র সাথে কোনো কথাও হয়নি। যেহেতু কাল শুক্রবার তাই বেশ আঁট গাঁট বেঁধে সিরিজ দেখতে বসেছে সারাহ্। আজ ঘুমানোর তাড়া নেই।

আহনাফ ওকে এখানে দেখে গেলেও ডাকে না। কালকের কথায় আহনাফ যে বেশ চুপচাপ আছে।

আহনাফ কফি বানাচ্ছে। দুইটা কাপে কফি এনে একটা সারাহ্-র সামনে দিয়ে নিজে পাশে বসে পড়লো। ইউটিউবে কোনো একটা টার্কিশ সিরিজ দেখছে সে। আহনাফ এসব সহজে দেখে না, তবুও পাশে বসে আছে। সোফার সাথে হেলান দিয়ে দুজনেই ফ্লোরে বসেছে। রুমে একটা অল্প আলোর বাতি জ্ব°লজ্ব°ল করছে।

“ঐশী?”

আহনাফের নরম ডাকে সারাহ্ ওর দিকে তাকালো। আহনাফ বলল,
“এতো চুপচাপ আছো, আগের মতো কথা বলো।”

সারাহ্ আবারো টিভির দিকে তাকায়, সাথে কফির কাপে চুমুক দেয়। মুখে বলে,
“কফি ভালো হয়েছে।”

আহনাফ তাকিয়ে আছে ওর চেহারার দিকে। সারাহ্ খেয়াল করেও কিছু বলে না। আহনাফ সারাহ্-র কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলে,
“ঐশী, ঢাকায় যেতে চাচ্ছিলাম।”
“তো যেতে পারতেন। আমি তো নিষেধ করিনি।”
“তোমাকে একা রেখে যাবো?”
“আমি বাচ্চা নই।”

আহনাফ হেসে বলল,
“বাচ্চাদের মতোই রাগ করে বসে আছো।”
“অকারণে রাগ করিনি।”
“আমি জানি যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু…”

আহনাফের কথার মাঝেই সারাহ্ বলল,
“এসব নিয়ে আর কথা না বলি।”

আহনাফ কিছু বলে না। সারাহ্ টিভি বন্ধ করে আহনাফের দিকে ফিরে বলে,
“আপনার সময় লাগবে, সময় নিন। তবে অযথা আমাকে ব্যবহার করবেন না।”
“আমি তোমাকে ব্যবহার করিনি। কখনোই না।”

আহনাফের ফিসফিসানিতে সারাহ্ সরে যেতে নিলে আহনাফ ওকে বাহুডোরে আগলে নিলো। আহনাফের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে সারাহ্। দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আহনাফকে, কেন যেন এখন রাগ করতে ইচ্ছা করলো না। অদ্ভুত আকর্ষণ আর অ°ব্যক্ত অনুভূতি দুজনের মাঝেই কাজ করছে। দুটো দ্বীপ একই স্থানে চলে এসেছে। ভালোবাসা মিলেমিশে এক হয়ে গেছে।
______________________________________

ফজরের আযান দিচ্ছে। সারাহ্ চোখ খুলে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝলো সে শয়নকক্ষে বিছানার উপর আছে। ড্রইংরুম থেকে এখানে কখন এসেছে তা ওর মনে নেই। আহনাফ পাশেই ঘুমিয়ে আছে, তার একহাত সারাহ্-র উপর। সারাহ্ উঠে বসে ওর দিকে তাকায়।

আহনাফের হাতটা ধরে সে। ঘন লোমের বলিষ্ঠ পুরুষের হাত, বাবার পর প্রথম এই পুরুষের হাতের স্পর্শ পেয়েছিল। সারাহ্ ওর হাতের উলটো পিঠে চুম্বন করে উঠে যায়। যতই দায়িত্ব, কর্তব্য বলুক না কেন আহনাফ এখনো ওকে পুরোপুরি আপন করতে পারেনি।

ঘুমের ঘোরে আহনাফ বুঝতে পারে না কোনো এক রমনী তার শক্ত হাতে নরম ওষ্ঠোধর ছুয়ে গেছে।

ফ্রেশ হয়ে ওযু করে এসে সারাহ্ কর্কশ গলায় আহনাফকে ডাকে,
“প্রতিদিন ডাকাডাকি লাগে কেন? নিজে থেকে উঠতে পারেন না?”

আহনাফ চোখ খুলে কান চুলকে বলল,
“একটু মিষ্টি করেও তো ডাকতে পারো।”

সারাহ্ কিছু না বলে নামাজের হিজাবটা বাঁধতে লাগলো। আহনাফ উঠে বসে বলে,
“তোমাকে যে আমি ড্রইংরুম থেকে কোলে করে নিয়ে এলাম, তখন তো আমি ফেলে দিয়ে আসতে পারতাম।”

সারাহ্ ফিরে এসে বলল,
“আমি আনতে বলেছিলাম?”
“না আনলে বলতে আনিনি কেন?”

সারাহ্ কিছু না বলে হিজাবটা বাঁধতে থাকে। আহনাফ উঠে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলল,
“লোকে ঠিকই বলে মেয়েদের মন বোঝা সহজ নয় আর বউ হলে তো কথাই নেই।”
______________________________________

সকাল এগারোটা, বাসায় চলে এসেছে শাফিন ও মৃত্তিকা। মৃত্তিকাকে বাসায় রেখে বাইরে গেছেন শাফিন সাহেব। নিজের একটা বড় গ্রোসারি শপ আছে উনার। সেখানে এলেন এখন।

দোকানের প্রবেশের গেইট দুটির মধ্যে একটি বন্ধ থাকায় কর্মচারীকে বলেন,
“কি ব্যাপার গেইট বন্ধ কেন?”

কর্মচারী উমার কিছু জিনিসপত্র গোছাচ্ছিল। শাফিন সাহেব রেগে গিয়ে বলেন,
“কথা কি কানে যাচ্ছে না?”
“সব যাচ্ছে, এখন তুমি চুপ করো।”

উমার একটা ছু°ড়ি দিয়ে শাফিন সাহেবের বুকের ডানপাশে ঢু°কিয়ে দিলেন। পেছন থেকে কেউ একজন উনার পায়ে আর কাঁধে ছু°ড়ি চালালেন। শাফিন সাহেব প্র°তি°রো°ধ করতে গিয়েও ব্যর্থ হলেন। ফ্লোরে পড়ে গিয়ে চোখ বন্ধ হওয়ার আগে কেবল উমারের বুকে কাউকে ছু°ড়ি চালাতে দেখলেন।

বেশ খানিকক্ষণ পর সুরভির নাম্বারে কল এলো। কোনো এক ক্রেতা দোকানে এসে এসব দেখে পুলিশকে খবর দেয় আর উনারা সুরভিকে জানায়।

সুরভি বাবার এ অবস্থার কথা শুনে মৃত্তিকাকে নিয়ে ছুটে এলো দোকানে। শাফিন সাহেবকে ততক্ষণে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে।

ওরা আবারো গেল স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে শাফিন সাহেবের দেখা পেলেও এখানে উনাকে রাখা হলো না, অবস্থা খারাপ বলে পাঠানো হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

সুরভির মা দেলোয়ারা কান্না করতে করতে জ্ঞান হারিয়েছেন। শাফিনের মতো মানুষকে কেউ কেন মা°রার চেষ্টা করবে?

খবর পেয়ে লুৎফর রহমান আর ইমতিয়াজ হাসপাতালে ছুটে এসেছে। মমতাজ বেগমকে এখনো এ ব্যাপারে জানানো হয়নি। সুরভি নিজেও ক্রমাগত কান্না করে যাচ্ছে। শাফিন সাহেবকে কিছুক্ষণ আগেই আইসিইউতে পাঠানো হয়েছে।

মৃত্তিকার বারবার মনে হচ্ছে এসবের জন্যও ওর বাবা দায়ী। ওর বাবা বলেছিল ওকে একা করে দিবে। এভাবেই কি একা করবে উনি?

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো, তারপর হলো সন্ধ্যা। এই পরিবারটুকু সুখের মুখ আর দেখলো না। শাফিন সাহেবের অবস্থা অপরিবর্তিত। উমার মা°রা গেছে, কে বা কারা এ কাজ করেছে তা চেনা যায়নি। সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ ছিল আর উমার নিজেই তা বন্ধ করেছে।

মাগরিবের নামাজের পর মৃত্তিকা সুরভিকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে বের হয়। অসুস্থ সুরভি যেতে না চাইলেও একটু জোর করেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মৃত্তিকা।

সিএনজি নিয়ে চলে আসে বাসায়। সুরভি লিফটে করে আগে আগে উপরে চলে গেল। মৃত্তিকা ভাড়া মিটিয়ে বাসায় ঢুকার সময় শরীফ এসে পেছন থেকে ডাকলো,
“মিউকো, কোথায় গিয়েছিলে?”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে ফিরে তাকালো। রাগটা আবারো মাথাচা°ড়া দিয়ে উঠলো। শরীফের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“মামাকে আপনি মা°রার চেষ্টা করেছেন কেন? এভাবে একা করবেন আমাকে?”

শরীফ হাসলো। বলল,
“তোমার মামা এমনিতেও তোমাকে একা করতে চাচ্ছে। আমার তাকে মা°রার প্রয়োজন নেই।”

শরীফ চলে যাওয়ার সময় আবারো ফিরে এসে বলে,
“শাফিন কি বাঁচবে নাকি শেষ?”
বলেই বামহাত ডান থেকে বামদিকে নাড়লো।

মৃত্তিকা উত্তর না দিয়ে ভিতরে চলে গেল। ওর জন্যই যদি সবার এ অবস্থা হয় তবে ওর ইতালি গিয়ে একা থাকাই ভালো। যা যা হবে সব একা সহ্য করে নেয়া উচিত। আবেগ-অনুভূতিকে কবরস্থ করে দেয়া দরকার। শাফিন সাহেব সুস্থ হলেই ইতালি চলে যাবে সে, এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।
______________________________________

সারাহ্ রাতের রান্না করছে। আহনাফ সাহায্য করতে আসলেও সারাহ্ ওকে পাত্তা দেয়নি। পাত্তা না পেয়ে সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

“ঐশী, রাতে তোমাকে সুন্দর লাগছিল।”

সারাহ্ রাগি চোখ তাকালে আহনাফ ওকে আরো রাগানোর জন্য বলে,
“কিভাবে এসে বুকে পড়েছিলে? তারপর আবার আমাকে বলছিলে আদর করো না ফয়েজ।”

সারাহ্ জোরে খু°ন্তিটা ফেলে বলল,
“মোটেও না। এতোটা অ°সভ্য আমি নই।”
“আরে তারচেয়েও বেশি। ঘুমালে মনে হয় ম°রে পড়ে আছো। এতোগুলো কিস করলাম উঠলেই না।”

আহনাফ এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলে,
“দুই চারটা কা°ম°ড়ও দিয়েছি।”
“ছি, কি ভাষা?”

সারাহ্ নাক ছি°ট°কানি দেয়। আহনাফ হাসতে হাসতে চলে যায়। মাঝে মাঝে মিথ্যা বলে সারাহ্-কে রাগাতে ভালোই লাগে।

আহনাফ আবারো এসে বলে,
“তুমি মেবি নে°শাটে°শা করো, কি নে°শা°ক্ত একটা কন্ঠ ছিল।”
বলেই বামচোখ টিপে চলে যায়।

“ছি।”
সারাহ্ রাগে ধুপধাপ করে কাজ করছে।

আহনাফ তো হেসে কুটিকুটি। শান্ত মেয়েটা ওকে অভদ্র বানিয়েছে। এতোটা ঠোঁট°কা°টা কোনোকালেই সে ছিল না। অথচ এখন লাজ-লজ্জা সব গঙ্গায় ভা°সিয়েছে।

আহনাফ ডাইনিং থেকে চেঁচিয়ে বলল,
“ঐশী, তুমি কিন্তু…”

সারাহ্ ধ°ম°ক দিয়ে বলে,
“আর একটা কথা বললে একদম গরম পানি ঢেলে দিবো।”

আহনাফ হো হো করে হেসে উঠে। সারাহ্ কাজ করতে করতে ভাবে,
“আমি কি সত্যিই এসব করেছি? আমার তো ঘুম এতো গভীর না, তবে ড্রইংরুম থেকে বেডরুমে গেলাম কখন টের পাইনি কেন?”

সারাহ্ শান্তভাবে হেঁটে আসে। আহনাফকে বলে,
“শুনুন।”

আহনাফ ভ্রূ উঁচিয়ে বলে,
“অসমাপ্ত কথাটা শুনতে চাচ্ছো?”
“না।”
সারাহ্ ধ°মক দেয়।

ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি সত্যি এসব বলেছি?”

আহনাফের হাসির তো°প বাড়লো। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাউ।”
“মজা না সিরিয়াস।”

আহনাফ ওর কাছে যায়। সারাহ্ একটু নিচু হয়। আহনাফ বলল,
“কেমিস্ট্রি ম্যাডাম আমার সাথে উনিশ-বিশ কিছু করে নাই।”
বলে ঠোঁট বাঁ°কিয়ে উড়ন্ত চুম্বন দেখিয়ে রুমে চলে যায়।

সারাহ্ প্রতিদিন এই লোকের পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। প্রথমদিনের সাথে পার্থক্য আছে, দিন যত যাচ্ছে আহনাফের মনের কোণে ততবেশি স্থান পাচ্ছে সে।
______________________________________

একমাস পর,
কিছুটা সুস্থ অবস্থায় বাসায় আছেন শাফিন সাহেব। তবে এখনো একা একা ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। নিজের কাজগুলো করতেও যথেষ্ট সমস্যা হচ্ছে তার। মৃত্তিকা আর দেলোয়ারার সাহায্যে চলাচল করেন উনি।

আজ উনাকে দেখতে বাসায় এসেছে ইমতিয়াজ। উনি অসুস্থ হওয়ার পর প্রায়ই উনাকে দেখতে আসে ইমতিয়াজ।

মৃত্তিকা আর সুরভি দুপুরের রান্না করছে। দেলোয়ারা এসে বললেন,
“মিউকো, ইমতিয়াজকে নাস্তা দিয়ে আসো।”

মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“ঠিক আছে, মামানী।”

সুরভি ট্রেতে নাস্তা সাজিয়ে দিলো। মৃত্তিকা ট্রে নিয়ে ড্রইংরুমে ইমতিয়াজের সামনে রাখে। একটা চায়ের কাপ তুলে পাশে সোফায় বসা শাফিন সাহেবের হাতে দেয়।

ইমতিয়াজ ওকে জিজ্ঞাসা করে,
“কেমন আছেন মৃত্তিকা?”
“ভালো।”

ছোট করে উত্তর দিয়ে মৃত্তিকা ভিতরে চলে আসে, আড়চোখে একবার ইমতিয়াজকে দেখলেও পূর্ণদৃষ্টি দেয়া হয় না। আবারো গিয়ে রান্নার কাজে হাত লাগায়। দেলোয়ারা ড্রইংরুমে চলে যাওয়ার পর সুরভি বলে,
“ইমতিয়াজ ভাইয়াকে দেখলে তুমি এমন লজ্জা পাও কেন?”

মৃত্তিকা চমকে মাথানিচু করে। সুরভি ওর রকমবহর দুটোই দেখেছে। মৃত্তিকা বলে,
“কই? এমন কিছু না।”
“আমি অন্ধ বা বোকা নই।”

মৃত্তিকা সুরভির দিকে তাকায়। সুরভি বলে,
“ভালো টালো লাগে নাকি ভালোবাসা?”

মৃত্তিকার কাঁধে আলতো ধা°ক্কা দেয় সুরভি, মুখে থাকে মিষ্টি একটা হাসি। মৃত্তিকা হেসে বলে,
“আরে না, ওই এমনিই।”
“আমার সাথে কিসের শরম? বলো না।”
“না আপু, তেমন কিছু না।”

মৃত্তিকা কাজে মন দেয়। সুরভিও আর কথা বাড়ায় না। মৃত্তিকার নজর, ভাব বুঝতে পারে সুরভি।

চলবে……

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

একবিংশ পর্ব

ঢাকায় এসেছে আহনাফ-সারাহ্। বাসায় আসার পর থেকেই সামিহা সারাহ্-র সাথে গল্পে মজেছে। ক্লাসের এটা ওটা সেটা সবই সারাহ্-কে দেখাচ্ছে সে। কোন কোন জায়গায় ঘুরতে গিয়েছিল, কোথায় কি ছবি তুলেছে তাও দেখাচ্ছে।

সারাহ্ বালিশে মাথা রেখে শুয়ে বলে,
“এগুলো তো হোয়াটসঅ্যাপে বহুবার দেখিয়েছিস।”
“আরে এখন দেখো না, লাইভ।”

সারাহ্ ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে পাশে রেখে বলল,
“এক্সাম কবে?”
“উহু, উহু, রুটিন দেয় নাই।”
“পড়াশোনা চা°ঙ্গে তুলে বসে থাকো।”

সামিহা হাসতে হাসতে সারাহ্-র পাশে শুয়ে বলে,
“পরীক্ষার আগে নামাই নিবো। (একটু থেমে) আপু চলো না ঘুরতে যাই।”

সারাহ্ উঠে খোঁপা করতে করতে বলল,
“কাল কিন্তু আমরা চলে যাবো। আজ কোথাও যেতে পারবো না।”
“সে তো জানা কথা। শুক্র, শনি বন্ধ আবার রবিবার কিলাস।”
ব্য°ঙ্গ করে কথাটা বলল সামিহা।

আহনাফ এসে দরজায় নক করে।
“আসবো?”
“জি ভাইয়া, আসেন।”

আহনাফ রুমে আসলে সামিহা বেরিয়ে গেল। সারাহ্ ফোনে ক্লাসের নতুন রুটিন দেখে বলল,
“ফার্স্ট ইয়ারে শুধু আপনার ক্লাস কেন? সেকেন্ড ইয়ার কি করছে?

আহনাফ হেসে উঠে বলল,
“ওখানের মেয়েগুলো কিউট হয়। কারো চোখ সুন্দর, কারো ঠোঁট সুন্দর, কারো হাসি সুন্দর, কারো চুল সুন্দর।”

সারাহ্ চশমার উপর দিয়ে আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ বলে,
“বাট সমস্যা হলো কেমিস্ট্রির সারাহ্ ম্যাম অসম্ভব মায়াবী।”

সারাহ্-র কাছে এসে বলল,
“সরি, মায়ার খাজানা এখানে।”

সারাহ্ হেসে মুখ ঘুরায়। ওদের সম্পর্ক এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। আহনাফের এসব দুষ্টুমিতে সারাহ্ অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

এদিকে, সামিহার ফোনে কল দেয় তানজিম। সামিহা রিসিভ করতেই তানজিম বলে,
“তাড়াতাড়ি নিচে আয়, আমি অপেক্ষা করছি।”

সামিহা নিচে নেমে গেল। বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে তানজিম। সামিহা গিয়ে বলল,
“কিরে, এখন এখানে?”
“দুইদিন ভার্সিটিতে যাইনি, তোকে দেখিনি, তাই চলে আসলাম।”

সামিহা ভ্রূ উঁচিয়ে তাকায়। তানজিম হাঁটা শুরু করে, সামিহাও ওর পাশাপাশি হাঁটছে।

তানজিম বলে,
“পরশুদিন মামার বাসায় গিয়েছিলাম।”

শাফিন সাহেবের অবস্থার কথা সামিহা জানে। প্রশ্ন করে,
“কেমন আছেন উনি?”
“আগের চেয়ে ভালো। (একটু থেমে) দুই একদিন পর পর ইমতিয়াজ ভাইয়া ওখানে যান। সেদিন সন্ধ্যাও গিয়েছিলেন।”

সামিহা চুপ করে আছে। তানজিমের এসব কথা সে কেবল শুনে। ভালোমন্দ যাচাই করতে এখনো শেখেনি সে।

“মামাকে না ভাইয়া মিউকোপুর সাথে দেখা করতে যায়।”

তানজিম হাঁটা থামিয়ে বলে,
“আমি আগেও তোকে বলেছি না ভাইয়া আপুকে অন্য নজরে দেখে। আমার বোন বেঁচে থাকলে কি হতো?”

কি হতো তা সামিহা জানে না। কারো মনের খবর ও তো আর বলতে পারবে না। সামিহা এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু বি°ব্রতভাবেই বলে,
“তানজিম, তাহমিনা আপু যেহেতু নেই তাই উনাদেরকে উনাদের মতো থাকতে দিলে হয় না? (একটু থেমে) আমরা অন্য বিষয়েও তো কথা বলতে পারি।”

তানজিম একটু গরম সুরে বলে,
“হ্যাঁ, আমার বোন থাকলে এখানে একটা পর°কি°য়ার গল্প রচিত হতো।”

তানজিম হনহনিয়ে চলে যায়। সামিহা একটু হতভ°ম্ব, নিজের মতো একটা কাহিনী রচনা করেছে তানজিম। সবটাই ওর কল্পনা। এতো বড় হয়েও কি বাস্তবতার জ্ঞান হয়নি তার?

আজকাল তানজিমের সাথে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে ওর কথাই হয় না। সারাদিন সে তার বোনদের কথা আর মৃত্তিকা-ইমতিয়াজের বদনামে ব্যস্ত থাকে। সামিহা বি°র°ক্ত হয়ে যাচ্ছে ওর এসব আচরণে। তানজিমের এমন ব্যবহার ও আগে কখনোই দেখেনি।
______________________________________

সন্ধ্যা ৭ টা, শাফিন সাহেব নিজকক্ষে শুয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন। সুরভি দরজায় নক করে।

“বাবা।”

শাফিন সাহেব ফোন রেখে উঠে বসে বলেন,
“হ্যাঁ মা, আসো।”

সুরভি রুমে গিয়ে বসে। বাবার হাতে-পায়ে হাত বুলিয়ে দিলো। শাফিন সাহেব হাসলেন। নিজের সেদিনের ছোট্ট মেয়েটা এখন মা হতে চলেছে।

“মিউকো ইতালি চলে যেতে চায়।”
“ইতালি? কেন?”
শাফিন সাহেব অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন।

সুরভি সরাসরি বলে,
“ওর বাবার কারণে আর কেন। ওর নাকি মনে হয় এসবের জন্য ওর বাবা দায়ী।”

শাফিন সাহেবের হাসি উঠে। কিছুক্ষণ হেসে বলে,
“ওখানে একা একা কিভাবে থাকবে? ওর বাবা তো ওকে একাই করতে চায়।”

সুরভি কিছুক্ষণ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন কিছু বলতে চায়। শাফিন সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে,
“কি বলবে মা?”

সুরভি হাসে। বলে,
“মিউকো হয়তো কাউকে পছন্দ করে।”
“কাকে? ইতালিতে কেউ?”
“না এখানে। (একটু থেমে) ইমতিয়াজ ভাইয়া।”

শাফিন সাহেব চোখ বড় করে তাকালেন। সুরভি দরজার দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
“কিছু মনে করবেন না বাবা, মিউকো আমাকে এসব বলেনি, তবে আমার এটা মনে হয়।”

দেলোয়ারা দরজা ঠেলে রুমে আসেন।
“কি কথা হচ্ছে বাপ-বেটির?”

শাফিন সাহেব উনাকে বসতে ইশারা করে আবারো সুরভিকে বলেন,
“ইমতিয়াজের সাথে কথা বলবো নাকি আগে লুৎফরকে জানাবো?”
“আগে ফুপার সাথে কথা বলেন। ভাইয়াকে উনারা ছেলের মতো ভালোবাসেন।”

দেলোয়ারা মাঝ থেকে প্রশ্ন করেন,
“কি হয়েছে?”

শাফিন সাহেব চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলেন। সুরভি উঠে নিজের রুমে চলে যায়। মৃত্তিকা সেখানে কোনো একটা বই পড়ায় ব্যস্ত। সুরভি গিয়ে পাশে দাঁড়ায়।

মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি ঠিক বলেছিলে আপু, বাংলা সাহিত্য আসলেও অনেক আনন্দের।”

সুরভি হেসে বইটা নিয়ে শেলফে রেখে বলে,
“আমার প্রশ্নের উত্তর না দেয়া পর্যন্ত আর কোনো বই পাবা না।”

মৃত্তিকা একটু হকচকিয়ে যায়। তারপর হেসে উঠে বলে,
“বলো, কি প্রশ্ন?”
“ইমতিয়াজ ভাইয়াকে ভালোবাসো?”

কথাটা মৃত্তিকার কানে জোড়ে ধা°ক্কা খায়। কন্ঠনালি কেঁপে উঠলেও কথা বলা হয় না। সুরভি ওর সামনে এসে চেয়ার টেনে বসে বলল,
“বাবাকে বলবো বিয়ের কথা বলতে?”

মৃত্তিকা চমকে উঠে, কিছুই বলতে পারছে না। সব কথা ওর স্বরযন্ত্রের কাছে এসে গু°লিয়ে যাচ্ছে।

সুরভি ওর হাত ধরে বলে,
“অস্বস্তি হচ্ছে জানি, কিন্তু আমি সত্য বলতে বা শুনতে পিছুপা হইনা। এসব বোঝার ক্ষমতা আমার আছে।”

তানজিমের কথাগুলো মনে পড়ে মৃত্তিকার। একটা ঢোক গিলে বলল,
“যদি তাহমিনা আপু থাকতো, তবে?”
“তাহমিনা থাকলে কি হতো না হতো ওসব ভুলে যাও, তাহমিনা নেই। ইমতিয়াজ ভাইয়া একা, কোনো মানুষ একা বাঁচতে পারে না। (একটু থেমে) সঙ্গী হিসেবে তুমি খারাপ নও।”

মৃত্তিকার গাল টে°নে দেয় সুরভি। মৃত্তিকা মাথানিচু করে। সুরভি আলতো হেসে বলে,
“কি? বিয়ের কথা হবে নাকি? বউ সাজবে?”

মৃত্তিকা নিচুস্বরে বলল,
“ইমতিয়াজ যদি রাজি থাকে, তবে আমিও রাজি।”

সুরভি ওর গালে চুমো দেয়। বয়সে মৃত্তিকা ওর থেকে ২ বছরের ছোট। তাহমিনা, তাহসিনাও ওর থেকে ছোটই ছিল। বোন তো সবাই, আদরও সকলের জন্যই সমান। চলে যাওয়া মানুষদের স্মৃ°তি যেমন থাকবে, তেমনি যারা বেঁচে আছে তাদের সুখের কথাও চিন্তা করতে হবে। একপাক্ষিক হয়ে জীবন চলে না।
______________________________________

পরদিন অর্থাৎ শনিবার সকাল,
আব্বাস ফয়েজ, আহনাফের বাবা আজ ঢাকায় আসবেন। আহনাফ উনাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে এসেছে, সাথে সারাহ্ও আছে। উনাকে নিয়ে সরাসরি কুমিল্লা চলে যাবে ওরা।

দুজনে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে। সারাহ্ আপন মনে ফোন দেখছে।

“ঐশী।”

সারাহ্ আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ বলল,
“ভাবছি একটা কথা?”
“কি?”
“বাবা চলে আসলে আমাদের কি হবে?”

সারাহ্ ফোন রেখে ওর কাছাকাছি এসে বসে বলল,
“খুব ভালো হবে। আপনার মুখের যা অবস্থা হচ্ছে তাতে বাবা আসলেই ঠিক হবে।”

আহনাফ সারাহ্-কে একহাতে আগলে নিয়ে বলল,
“এটা নিয়ে আমিও চিন্তিত।”
“কেন?”
“তোমার সাথে জড়ানোর পরই আমার এ অবস্থা হইছে। (একটু থেমে) জাদু টো°না করছো নাকি?”

সারাহ্ ওর বুকে একটা থা°প্প°ড় দিয়ে বলে,
“ছি, না। আপনি আগে থেকেই এমন ছিলেন।”
“আরে না, তাহুর সাথে এমন কথা কখনোই বলি নাই।”

তাহু, মানে তাহসিনা, হঠাৎ সারাহ্-র সামনে এই নাম উচ্চারিত হওয়ায় সারাহ্ চমকে উঠে। আহনাফের থেকে একটু সরে যায়। আহনাফ অপ্রস্তুত, এ কি কথা বলে ফেলল?

গাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো আহনাফ। তাহসিনার কথা মনে পড়ার অর্থ সেই রিসোর্ট, সেই সাদা শাড়ি আর অসম্পূর্ণ সেই স্বপ্নগুলোর কথা মনে পড়া। অথচ এখন সে সারাহ্-র সাথে নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে।

সারাহ্ জানলা দিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন আর এই মানুষটাকে তার ভ°য় লাগে না, তবে এই মানুষটার মুখে তাহসিনার নাম শুনলেই ভ°য় পায় সে। এই বুঝি তাকে ছেড়ে চলে যাবে।

“হে আল্লাহ্, এই সম্পর্ককে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে দিও।”
সারাহ্-র এই একটা দোয়া মহান রব্বুল আলামীন কবুল করুক। তাহাজ্জুদে চাওয়া স্বামীর ভালোবাসা সে পেতে শুরু করেছে, এখন তো কেবলই শুরু।

কিছুক্ষণ পর দুটো আইসক্রিম কিনে নিয়ে আহনাফ এসে আবারো গাড়িতে উঠে বসলো। নভেম্বরের শেষ সময়, মোটামুটি শীত আছে, এসময় আইসক্রিম দেখে সারাহ্-র একটু রাগ হলো।

“কেন খাবেন এসব? ঠান্ডা লাগবে, জ্ব°র আসবে, আমি কারো সেবাযত্ন করতে পারবো না।”

সারাহ্-র কথায় আহনাফ হেসে একটা আইসক্রিম ওর হাতে দিয়ে বলে,
“আমি অসুস্থ হলে তুমি করবা স্বামীসেবা আর তুমি অসুস্থ হলে আমি করবো বউসেবা। ডিল ফাইনাল? এখন খাও।”

সারাহ্ আহনাফের মুখের দিকে তাকায়। একটু আগে অস্বস্তিকে দূরে সরিয়ে সে স্বাভাবিক হতে চাইছে। মনের অজান্তেই হাসে সে।

“এভাবে হাসলে তোমাকে কাঠবিড়ালির মতো লাগে।”
“কি?”
সারাহ্ কপাল কুঁচকায়। আহনাফ জোড়ে শোরে হেসে উঠে।

সারাহ্ আইসক্রিম খেতে খেতে ঘড়িতে দেখে সকাল ১১ টা। তারপর আহনাফকে বলে,
“একটু বাইরে হাঁটি? বসে থেকে থেকে কোমড়ে ব্য°থা করছে।”
“হ্যাঁ, যাও। আমি যাবো না, বাবা কিন্তু চলে আসবে এখুনি।”
“আচ্ছা, আমি আশেপাশেই আছি।”

সারাহ্ গাড়ির বাইরে হাঁটতে লাগলো। একটা গাড়ির সামনে গিয়ে চেনা একটা নাম শুনলো।

“নাম সামিহা, ডাকনাম এশা।”

সারাহ্-র ছোটবোন সামিহা, তারও তো ডাকনাম এশা। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে যায় সারাহ্।

এবারে অন্য কন্ঠ,
“এ আমাদের কোন কাজের?”

আবারো পুরোনো কন্ঠটা বলে,
“ওকে দিয়েই কাজ আছে, সেদিন ওখানে এই মেয়েটাই ছিল। (একটু থেমে) হয় মানবে আর না হয় ম°রবে।”

সারাহ্ ভয় পেয়ে যায়। সামিহাকে কেউ মারার প্ল্যান করছে। এরমধ্যে আহনাফের ডাক,
“ঐশী, এদিকে আসো।”

লোক দুজনেই সারাহ্-কে দেখে। সারাহ্ দ্রুত সরে পড়ে। হার্টটা প্রচন্ড গতিতে লাফাচ্ছে তার। আহনাফকে বুঝিয়ে বলার মতো অবস্থায় নেই। এমনকি আব্বাস সাহেবকে সালাম দিতেও বেমালুম ভুলে গেছে সে। গাড়িতে বসে জানলা দিয়ে সেই কালো চকচকে মাইক্রোর দিকে তাকায় সারাহ্। হয়তো এখনো ভেতর থেকে দুজোড়া চোখ ওকে দেখছে।

সারাহ্ চলে গেলে গাড়ির ভেতরের একজন বলে,
“সব ঠিকঠাক, সারাহ্ আমাদের কথা শুনে গেছে।”
______________________________________

লুৎফর রহমানকে বাসায় ডেকেছেন শাফিন সাহেব, দুপুরের খাবারের দাওয়াত। ঘটনা মূলত ইমতিয়াজ আর মৃত্তিকাকে নিয়ে কথা বলা।

জুম্মার নামাজের আগে আগেই লুৎফর রহমান, মমতাজ বেগম আর তানজিম তিনজনই এসেছে। নামাজের পর দুপুরের খাবার খেয়ে তারপর উনারা কথা বলতে বসেছেন।

সুরভি ফল কে°টে এনে উনাদের সামনে রাখলো। শাফিন সাহেব সুরভির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার মেয়ে ভাগ্যিস আমার মতো হয়নি, সব বুঝে সে।”

মমতাজ বেগম হাসলেন। সুরভিকে উনার পাশে বসিয়ে বলেন,
“ঠিকই বলছো।”

শাফিন সাহেব একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলেন,
“আসল কথায় আসি। আমি মিউকোর বিয়ে নিয়ে ভাবছিলাম।”

লুৎফর রহমান বলেন,
“একবার এতো ঘটনা হওয়ার পরও?”

শাফিন সাহেব মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“হ্যাঁ, মিউকোর জন্য উপযুক্ত একজনকে পাওয়া গেছে।”

মমতাজ বেগম খুশি হয়ে বলেন,
“এ তো ভালো কথা।”
“ইমতিয়াজের জন্য আমাদের মিউকো কেমন হবে?”

মৃত্তিকা রুম থেকে উনাদের কথা শুনছেন। সুরভি উঠে ভিতরে যায়।

লুৎফর রহমান একবার মমতাজ বেগমের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“ইমতিয়াজ রাজি হবে? আর মিউকো?”
“তোমরা রাজি কিনা তাই বলো।”
“রাজি না হওয়ার কারণ নেই।”

লুৎফর রহমানের কথায় সম্মত হলেন মমতাজ বেগম,
“ইমতিয়াজের অধিকার আছে নিজের জীবনকে সাজানোর। ওর কবরের কাছে ফাতিহা পড়ার মানুষও নেই। ওর পরিবারের দরকার, সন্তানের দরকার।”

শাফিন সাহেব লুৎফর রহমানকে বললেন,
“তুমি ইমতিয়াজের সাথে কথা বলো।”
“আর মিউকো?”
“সেটা আমি বুঝে নিবো।”

তানজিম সব শুনছে, রাগে তার ক°লজে ফেঁ°টে যাচ্ছে। এখন মৃত্তিকাকে খু°ন করতেও হয়তো সে পিছু হটবে না। কিন্তু বড়দের সামনে কিছু বলতেও পারছে না।

লুৎফর রহমান একটু জোর গলায় মৃত্তিকাকে ডাকেন।
“মিউকো?”

মৃত্তিকা বের হয়ে আসে।
“জি, আংকেল।”

মমতাজ বেগম বলেন,
“বসো, এখানে।”

মৃত্তিকা মমতাজ বেগমের পাশে বসে। মৃত্তিকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন উনি। তানজিম রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। মৃত্তিকা তানজিমকে দেখলেও তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। যা হওয়ার হবে, তানজিম বাধা দিলেও হবে আর না দিলেও হবে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে