অনুভবে ২ পর্ব-৪০+৪১

0
779

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৪০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

নিচের অংশটুকু পড়ার পূর্বে সভ্য থেমে গেল। সে কী ঠিক পড়ছে। ইনারা তাকে ভালোবাসতো? তার বিদেশ যাবার পূর্ব হতে? উওরের জন্য সভ্য আবারও পড়তে শুরু করল চিঠিটা,

“আমি জানি আপনি কী ভাবছেন? আপনাকে ভালোবাসলে আমি জোহানকে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বললাম কেন? আমি তখন ওকে হ্যাঁ বলি নি। জোহান মিথ্যা বলেছিল আপনাকে। আপনি আমার সাথে কথা না বলে কেন ওকে বিশ্বাস করলেন তা আমার অজানা। তখন জোহান কেবল আমার ভালো বন্ধু ছিলো। ওর সাথে সময় কাটানোর কারণ ছিলো ওর কোম্পানি থেকে আমি অভিনেত্রী হিসেবে জয়েন করেছিলাম এবং ও আমাকে অভিনেত্রী হিসেবে পরিচালকের সাথে দেখা করতে সাহায্য করতো। এতটুকুই। এমনকি জোহান নিজেও জানতো আমি আপনাকে ভালোবাসি। কেবল আপনাকে। ওর প্রতি যা ছিলো তা ভুল বয়সের আবেগ। যা সময়ের সাথে সাথে জীবন থেকে মুছে গেছে। আপনি কিন্তু কখনো আমার জীবন থেকে মুছেন নি। একারণেই হয়তো বিয়ের পর আপনাকে এতটা ঘৃণা করতাম। ভাবতাম আপনি আমাকে ভালোবাসার আভাস দিয়ে দূর কোথাও উড়ে গেছেন। অথচ আপনি আমার জন্যই নিজের স্বপ্ন ছেড়ে দিয়েছিলেন। অথচ আমি অজান্তেই আপনাকে কত কষ্ট দিয়েছি, কতবার দূরে সরিয়েছি, কতকিছু না বলেছি। পারলে ক্ষমা করে দিয়েন।
পাঁচ বছর পূর্বে আপনি আমার জন্মদিন পালন করতে চেয়েছিলেন নিজের মনের অনুভূতি বলে। আজ পাঁচ বছর পর আমি আপনাকে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করছি। ভালোবাসি সভ্য, আপনাকে খুব ভালোবাসি। আপনি কী আমার ভালোবাসাটা গ্রহণ করবেন?”
~আপনার মহারাণী

সভ্য চিঠিটা পড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। আর বাঁকা হাসল।
.
.
ইনারার মেকাপ করা শেষে তাকে গাউন পরানো হচ্ছিল। সাদা গাউন। হাতে সাদা গ্লাভস পরা এবং চুলে ফুল পরানো হচ্ছে। সবটা খুব জলদি করা হচ্ছে। একসাথে দুই তিনজন তাকে সাজাতে ব্যস্ত। কেননা একঘন্টায় রাত বারোটা বাজবে। তার দ্রুতই বাহিরে যাওয়া উচিত। এমন সময় তার ফোন বাজল। একটি মেয়ে তার ফোনটা এনে দিয়ে বলল, “আপু আপনার মেসেজ আসছে।”

ইনারা হাতে ফোনটা নিয়ে দেখে সভ্যর মেসেজ, “নিচে যাবার পূর্বে আমার রুমে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।”
ইনারার মলিন মুখেতে হাসি ফুটে। সম্ভবত সভ্য তার চিঠিটা পড়েছে। ইনারা সভ্যকে কথাগুলো সামনা-সামনি বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল সে পারবে না। তাই চিঠিতে সব লিখে দিলো। কিন্তু আগামীকাল সভ্যর জন্য একটা স্যারপ্রাইজ আছে তার কাছে। কিন্তু সভ্য এই মুহূর্তে কীজন্য তার রুমে ডেকেছে? চিঠি নিয়ে কিছু বলতে না’কি তার হৃদয়ের অবস্থা ইনারার সামনে খুলে রাখতে?

তাড়াহুড়োর মধ্যে তৈরি হলো ইনারা। সুরভি তাকে নিতে এসেছিলো। কিন্তু তাকে ভুলভাল বুঝিয়ে দিয়ে চুপিচুপি গেল সভ্যর রুমে। দরজায় টোকা দিলো। দরজা খুলল সভ্য। তার পরনে সাদা শার্ট এবং কালো রঙের স্যুট। ইনারার চুলে দেওয়া সাদা ফুল আছে সভ্যর পকেটেও। তাকে দেখে কিছু মুহূর্তের জন্য ইনারা কথা বলতে ভুলে গেল। পুরুষ মানুষের এতটা সুদর্শন হতে নেই। এই মুহূর্তে আশেপাশে কোনো মেয়ে না থাকা সত্ত্বেও ইনারার ঈর্ষা হচ্ছে। যদি কেউ সভ্যকে এভাবে দেখে তার প্রেমে পড়ে যায়?

সভ্যও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইনারার দিকে। তাকে বাস্তব মনে করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল সভ্যর পক্ষে। এত সৌন্দর্য প্রকৃতি কীভাবে সয়? সাদাতে তাকে পবিত্র ও নিষ্পাপ দেখাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল মেঘের কোল থেকে এই মাত্র কোনো রাজকন্যা নেমে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে মোহে ডুবে তাকিয়ে রইলো ইনারার দিকে। যতক্ষণ পর্যন্ত সে সভ্যর ঘোর না ভাঙলো,”সভ্য ডেকেছিলেন?”
“হঁ?”
“ডেকেছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
ইনারা ভাবে হয়তো চিঠি সম্পর্কে কথা বলার জন্যই ডেকেছে সভ্য তাকে। সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী চিঠিটা নিয়ে….” সে থেমে যায়। রুমে আজমল সাহেবকে দেখে অবাক হয়, “আপনি এখানে?”
সভ্য ইনারাকে ভেতরে যাবার রাস্তা করে দেয়, “আমি আজমল সাহেবকে ডেকেছিলাম।”
ইনারা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্য বলে, “আমি তৈরি হয়ে বের হচ্ছিলাম তখন ক’দিন আগের একটা রিউমারের কথা মনে পড়ল, যে আজমল সাহেব তোমার আত্নীয় হয় তাই তোমাকে এত জলদি তার সিনেমার জন্য নিয়েছে।”
“হ্যাঁ, আর এই গুজব কে ছড়িয়েছে তাও আমি জানি। এ নিয়ে কি আবার কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“আমার তখন মনে পড়ে আজমল সাহেব অনেক বছর পূর্বে আমাকে জানিয়েছিলেন তার ভাই নায়ক ছিলো আর তার ভাইয়ের নাম হলো ইমতিয়াজ চৌধুরী। সে তোমার আপন চাচা হন।”
কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। নিজের কানকে বিশ্বাস করাটা একটু কঠিন হয়ে পরছিল তার জন্য। এক বছর যার সাথে সে কাজ করেছে সে তার পরিবার। অথচ সে জানতোই না?

আজমল সাহেবের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কান্না করে দিবে, অথবা করেছে। সে কাঁপানো গলায় বলল, “আ-আমার প্রতি মুহূর্ত এমন মনে হতো তুমি আমার আপন কেউ। তোমার চোখের দিকে তাকালেই আমার ভাইয়ের কথা মনে পড়তো।”
ইনারা তাও নড়ে না। সে কতকিছু ভেবে রেখেছিল এই মুহূর্তের জন্য। যখন সে তার পরিবারের সন্ধান পাবে তখন সে খুশিতে আত্নহারা হবে, লাফালাফি করবে, সবাইকে যেয়ে জড়িয়ে ধরবে। অথচ আজ এই মুহূর্ত আসার পর তার জন্য নড়াটাও যেন কঠিন হয়ে গেছে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে সে।
সভ্য ইনারাকে দেখে কিছু মুহূর্ত। তাকে এভাবে একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে নিজেই তার হাত ধরে আজমল সাহেবের সামনে দাঁড় করায়। ও বলে, “আমি উনাকে সব জানিয়েছি।”
আজমল সাহেব এগিয়ে আসেন। কাঁপা-কাঁপা হাতে ইনারার মাথায় হাত রেখে বলে, “আমাকে ক্ষমা করে দেও, তুমি এতকিছু সহ্য করলে অথচ আমি তোমার পাশেই ছিলাম না। ভাইয়ার পর আমার উচিত ছিলো তোমাকে দেখাশোনা করা, তোমাকে রক্ষা করা, তোমার যেন বাবার কমতি অনুভূতি না হয় তার খেয়াল রাখা কিন্তু আমি তা করতে ব্যর্থ।”
অনেকক্ষণ ইনারা তাকায় আজমল সাহেবের দিকে। ছলছলে তার নয়ন দুটো। সে ভেজা কন্ঠে বলে, “এভাবে বলবেন না। আপনি কিছু জানতেন না আমার ব্যাপারে।”
“হয়তো শুরুতেই নিজের সকল দায়িত্ব থেকে মুখ না ফেরালে জানতে পারতাম। এত আমি এটা বলতে পারতাম আমার কাছে তোমার মতো একটা লক্ষ্মী মেয়ে আছে।”
কথাটা শুনে আর ইনারা নীজেকে আটকে রাখতে পারে না। দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে শব্দ করে কান্না করে দেয়। আজমল সাহেব তার মাথায় হাত রেখে নিজেও কান্না করে দেন, “তোমাকে বলেছিলাম না তোমার চোখ দুটো দেখে খুব কাছের কারো কথা মনে পড়ে যায়? আমার ভাইয়ের কথা বলেছিলাম। তোমার বাবার কথা। আমার কাছে তার চোখগুলো সবচেয়ে সুন্দর লাগতো। তুমি তার চোখ পেয়েছ।”
ইনারার কান্না কমে না, আরও বাড়ে।
“বাবাও আজ এখানে থাকলে কত খুশি হতেন তাই না? আমি কখনো তাকে দেখি নি। একটিবার তাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আজ আর তা সম্ভব না। তাকে আমি কখনো চেয়েও একটিবার ছুঁতে পারব না।” বলে কান্না করে দেয় ইনারা।
তার কান্না দেখে যেন আজমল সাহেবের বুক কেঁপে উঠে তারও আজ নিজের ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে। সে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ইনারাকে, “আমি আছি তো। তোমার চাচ্চু। তোমার বাবার সব দায়িত্ব আজ থেকে আমি পালন করব।”
.
.

সুরভী ইনারার রুমে খুঁজে তাকে। পায় না। রাত বারোটা হতে চলল। তার জন্য বিশেষ আয়োজন করেছিল সে এবং সভ্যর বন্ধুরা। কিন্তু মনে হচ্ছে তাদের কোনো পরিকল্পনাই ঠিক হবে না। কিছুক্ষণ পর সে তাকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে দেখে। তার সাথে সভ্য ছিলো। কিন্তু সে এটা দেখে অবাক হলো যে তার সাথে আজমল সাহেবও আছেন।

এই মুহূর্তে বাগান ছেড়ে সকলে দাঁড়ানো ড্রইংরুমে। বাহিরের সকলে চলে গেছে। আছে কেবল সভ্য ও ইনারার কাছের মানুষেরা। তবে রাত গভীর হওয়ায় দাদাজান এবং দাদীজান ঘুমিয়ে পরেছেন। ভেতরেও কিছুটা ডেকোরেশন করা হয়েছে। হাল্কা রঙের। রুমের মাঝখানে, ঠিক ঝাড়বাতির নিচের এক টেবিলে রাখা হয়েছে একটি সাদা রঙের কেক। যার ডিজাইন ইনারার চুলে লাগানো ফুলের মতো।

সিঁড়ি দিয়ে নামছিল ইনারা। সে আজমল সাহেবের বাহু ধরে নিচে নামছিল। সভ্য ছিলো আজমল সাহেবের অপরপাশে দাঁড়ানো। সবাই তাদের সাথে আজমল সাহেবকে দেখে খানিকটা অবাক হয়। সামি তো সরাসরি জিজ্ঞেসই করে নেয়, “সভ্য আর ইনারার তো একসাথে আসা বুঝলাম। আজমল সাহেব তোমাদের সাথে কেন? ইনারা তুমি কি বিয়ের মধ্যে তোমার নেক্সট স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করতে শুরু করে দিলে?”
ঐশি পাশ থেকে তার পেটে ঘুষি মেরে বলে, “চুপ কর।”

সুরভি দৌড়ে আসে ইনারার কাছে। এসেই ইনারার হাত ধরে অস্থির গলায় বলে, “এতক্ষণে এলি? তোকে খুঁজে আসলাম মাত্র। আচ্ছা শুন আমরা সবাই মিলে একটা জিনিস প্লান করেছি…” সেখানেই সুরভিকে থামিয়ে দেয় সভ্য, “সুরভি একটু সময় দেও।”
সুরভি থেমে যায়। সভ্যর হঠাৎ করে এভাবে বলাটা খটকা লাগে সুরভীর। ইনারাকে এই মুহূর্তে একটু অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে তার কাছে। ভয় পেতে শুরু করে সুরভি। সভ্যকে চিঠি দিয়েছিল ইনারা। সে চিঠি নিয়ে তো দুইজনের মাঝে কোনো সমস্যা হয় নি?

সভ্য একটু এগিয়ে যেয়ে দাঁড়ায় কক্ষের মাঝখানে। পকেটে হাত রেখে সকলের সামনে উচ্চস্বরে বলে, “আপনাদের মাঝে অনেকেই ইনারাকে ভালো করে চিনে, আবার অনেকে ইনারার অতীত সম্পর্কে কিছুটা জানেন। কিন্তু এতটুকু জানতেন ইনারার আপন পরিবার ছিলো না।”
এই কথা শুনেই ক্ষেপে যায় সভ্যের মা, “পরিবার ছিলো না মানে? তাহলে আমরা কী?”
“আহা মা হাইপার হবার প্রয়োজন নেই। সম্পূর্ণ কথা তো শুনো। ওর অতীতের কথা বলছি। কিছু কারণের জন্য ইনারা কখনো তার আসল বাবার পরিচয় জানতে পারে নি। কিন্তু আজ ওর বাবা এবং বাবার পরিবারকে পেয়েছি। আজমল সাহেব ইনারার আপন চাচা হন।”
“বলিস কী?” সভ্যর মা এগিয়ে যায় ইনারার দিকে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “সত্যি।”
ইনারা খুশিতে বাচ্চাদের মতো হেসে মাথা নাড়ায়। মা অনেক খুশি হয়। মা আজমল সাহেবকে বলেন, “তবে আপনি আমার বেয়াই হলেন। আপনি ওর চাচা হতে পারেন কিন্তু আমি আগে দিয়ে বলে দিচ্ছি ও সবার পূর্বে আমার মেয়ে। তাই ওর উপর আমার অধিকার বেশি কিন্তু।”
আজমল সাহেব হাসেন, “আসলে এখন আমার কি বলা বা করা উচিত আমি জানি না। তবে একটা কথা বলবো, এখানে এসে আমি দেখেছি আপনারা ওকে কত ভালোবাসেন। আমার ওর জন্য এক মুহূর্ত চিন্তা করারও প্রয়োজন নেই। কারণ আমি জানি যাই হোক না কেন, আপনারা সবসময়ই ওর পাশে থাকবেন। ও অনেক ভাগ্যবান আপনাদের মতো পরিবার পেয়ে।”
মা হাসলেন।

সভ্যর বাবা জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু আমরা তো ইনারার বাবার নামটা জানলামই না।”
“ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ চৌধুরী। আপনাদের সময়ের অনেক বড় নায়ক ছিলেন।” আজমল সাহেব জানালেন। ইনারা সাথে যোগ করে, “আব্বু আপনি আমাকে যে বলেছিলেন আমার চোখ একজন নায়কের সাথে মিলে। আপনি কি…”
“হ্যাঁ আমি ইমতিয়াজ চৌধুরীর কথাই বলছিলাম। কী আশ্চর্যজনক ঘটনা! আমি তো সাধারণভাবেই বলেছিলাম আর তা সত্যি হয়ে গেল। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমাদের যুগের জনপ্রিয় নায়ক নায়িকা আমার আত্নীয় লাগে। বাহ!”
ইরফানও বলে, “এজন্যই তো বলি ইনারা এত সুন্দর হয়েছে কোথা থেকে। সাইয়ারা ম্যাম এবং ইমতিয়াজ স্যারের মেয়ে তো সবচেয়ে সুন্দর হবেই।”
ঐশি ইরফানের দিকে তাকায় চোখ রাঙিয়ে। সাথে সাথে ইরফান বলে উঠে, “ভাই…ভাবি…ইনারা ভাবি।”
“গুড।”
আজমল সাহেব সভ্যের মা’কে জিজ্ঞেস করেন, “আপা কিছু মনে না করলে আমি কী আগামীকাল সভ্য এবং ইনারাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি? আসলে আমাদের আর কেউ তো নেই। মা খুব অসুস্থ থাকে। ভাইয়ার মৃত্যুর পর থেকেই তার অসুস্থতা। ইনারাকে এক মুহূর্তের জন্য দেখলেও শান্তি পাবে। আমিব্জানি আগামীকাল বিয়ের অনুষ্ঠান আছে। জলদিই এসে পরবে।”
“আপনি অনুমতি কেন নিচ্ছেন? আপনার মেয়ে আর ঘরের জামাই। যখন, যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যান।”

সুরভি ইনারাকে একপাশ জড়িয়ে ধরে বলে, “আমি তোর জন্য অনেক হ্যাপি জানু।” আবার মুহূর্তখানিক পর তাকে ছেড়ে বলে, “কিন্তু এখন কি আমরা আমাদের প্রোগ্রাম শুরু করতে পারি? আর কিছুক্ষণ বাকি আছে। কেক কাটা শেষে আমরা সকলে আবার ইমোশনাল গল্প করব, ওকে?”
সুরভির কথা শুনে হেসে দেয় সকলে।
সভ্যের মা জিজ্ঞেস করেন, “তো তোমাদের প্রোগ্রাম কীভাবে শুরু হবে?”
“দুলাভাই ইনারার হাত ধরে এদিকে আসুন।”
সভ্য অবাক হয়, “কেন?”
“আহা এত প্রশ্ন না জিজ্ঞেস করে আসুন তো।”

আজমল সাহেব ইনারার হাত সভ্যর হাতে তুলে দিলেন, “যাও বাবা।”
সভ্য ইনারার হাত ধরে এগোতেই আশেপাশে লাইটগুলো বন্ধ হয়ে গেল। মাঝখানে একটি গোলাকৃতির বাতি জ্বলল। ইনারা ও সভ্য অবাক হয়। তাদের আশে পাশে তাকাতেই গান শুরু হয়,

“তুমি না ডাকলে আসব না, কাছে না এসে ভালোবাসব না
দুরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
না কি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়?
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল, গল্পটা পুরনো
ডুবে ডুবে ভালোবাসি, তুমি না বাসলেও আমি বাসি…”

গানটা শুনতে অবাক হয়ে দুইজন। তাদের প্রথম গানে নাচা, কাছে আসা, হৃদয়ের স্পন্দন দিশেহারা হওয়া। কয়েক বছর আগে এভাবেই দুজনে এই গানে তালে তাল মিলিয়ে নেচেছিল। হারিয়ে গিয়েছিল একে অপরের মাঝে।

পিছন থেকে উচ্চ শব্দ এলো। সভ্য ইনারার বন্ধুবান্ধবরা তাদের নাচার জন্য শব্দ করছে। হৈ হুল্লোড় শুরু করে দিয়েছে। শব্দ শুনে ঘোর ভাঙে দুইজনের। ইনারা সামনা-সামনি দাঁড়াল সভ্যর। তার হাত সভ্যর কাঁধে রাখল। সভ্যও আলতো করে হাত রাখে তার কোমরে। গানের সুরে হাল্কা দুলতে থাকল তারা। চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয় ইনারা। তার হৃদয়ের অবস্থা করুণ। তার হৃদয়ের স্পন্দন দিশেহারা হয়ে আছে। আবারও।

ইনারা সভ্যকে মৃদুস্বরে বলে, “ধন্যবাদ। আপনার জন্য না হলে, আজ আমি হয়তো এখানেই উপস্থিত থাকতাম না। আর না আজ এতকিছু পেতাম আমার জীবনে।”
সভ্য চুপ থাকলো। কিছু বলল না।
ইনারা আবার আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “চিঠিটা কী পেয়েছেন?”
সভ্য এবারও উওর দেয় না। ইনারা আবারও জিজ্ঞেস করে, “আমি ওখানে যা লিখেছি তা নিয়ে কিছু বলবেন না?”
“হাতের লেখা দেখে মনে হয়েছে কাক কাগজের উপর হেঁটে গেছে আর তুমি তা আমাকে ধরিয়ে দিসো।”
কথাটা শুনে ইনারা হা হয়ে যায়। সে নাচ ছেড়ে পিছিয়ে যায়। উচ্চ স্বরেই বলে কী বললেন আপনি? আমার হাতের লেখা কাকের ঠ্যাংয়ের মতো?”
“ঠ্যাং আবার কী?”
“ঠ্যাং মানে পা। কিন্তু কথা তো ওটা না, কথা হচ্ছে আপনি এটা বললেন কীভাবে? সাহস কত বড় আপনার?”
“সত্যি বলায় সাহস আসে কোথা থেকে?”
“ওহ প্লিজ এক মহান মানুষ বলেছে ট্যালেল্টেড মানুষদের হাতের লেখা একটু এমনই হয়।”
“আর সে মহান মানুষ কে শুনি?”
“আমি, আর কে?”
“এটা কী জোক ছিলো?”
ইনারা রাগে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলে, “আমার হাতের লেখা কাকের ঠ্যাংয়ের মতো হলে আপনার…আপনার মুখ ব্যাঙের ঠ্যাংয়ের মতো।”
“এই মেয়ে এই ঠ্যাংঠ্যুং এর মতো শব্দ আমার সামনে ব্যবহার করবে না।”
“একশোবার করব।”
সুরভি পাশ থেকে বলে, “আরে এত রোমেন্টিক মোমেন্ট ছেড়ে কেউ এভাবে ঝগড়া করে? এট লিস্ট এই বিয়েতে ঝগড়াটা না করলেন।”
ইনারা বলে উঠে, “ধ্যুর বিয়েই করব না এই ছাগলের সাথে।”
সভ্য চোখ বড় করে নেয়, “তুমি আমাকে সবার সামনে এসব ফালতু কথা বলবে আর আমি চুপ থাকব না’কি? আমারও তোমাকে বিয়ে করার কোনো শখ নেই।”
“আমি যেন বিয়ের জন্য মরে যাচ্ছি।
“ওহ প্লিজ, তোমার কথাতেই এই বিয়েটা হচ্ছে।”
“ওটাই তো সব আমারই করতে হয়। আপনি তো এই এত বড় নাকটায় শুধু এক ডজন রাগ নিয়ে ঘুরতে পারেন।”
“তোমাকে আমি…”
সুরভি দুইজনের মাঝে এসে দাঁড়ায়, “হয়েছে হয়েছে, অনেক ঝগড়া হয়েছে। বারোটা বাজতে এলো। আমরা কেক কাটি এখন?”
সুরভি দুইজনের হাত ধরে কেকের সামনে নিয়ে যায়। ছুড়িটা ইনারার হাতে দিয়ে বলে, “চুপ করে কেক কাট। একটা কথাও বলবি না আর। সবাই বার্থডের গান গাই, আসুন।”

সকলে বার্থডের গান গায়। ইনারার কেক কাটতেই হাততালি দেয় সবাই। ইনারা কেক কেটে সবার আগে সভ্যর মা, বাবা ও নিজের চাচাকে খাওয়ায়। সুরভি তাকে বলে,”ভাইয়াকে কেক খাওয়া।”
“ওই শয়তানের হাড্ডি কি করেছে দেখিস নি? খাওয়াব না।”
“তুইও কম করিস নি।”
“আগে ও শুরু কর…”
“চুপচাপ যেয়ে খাওয়া।” ধমক দিয়ে বলে সুরভি।

ইনারা না চাওয়া সত্ত্বেও যায় সভ্যের কাছে। মুখ বানিয়ে কেকটা সভ্যের দিকে এগিয়ে বলে, “খেয়ে নিন।”
সভ্য বিরক্তির সুরে বল, “এভাবে পেঁচার মতো মুখ করে বললে কার খেতে মন চাইবে?”
“আমি পেঁচার মতো মুখ করে বলেছি?” ইনারা এক দুই না ভেবে সম্পূর্ণ কেক মাখিয়ে দিলো সভ্যর মুখে। আর রেগে বলল, “এবার ভালো মতো খান।”
বলে সে রাগে উপরে চলে যায়।

সকলে কান্ডটা দেখে হতবাক হয়ে গেল। বিশেষ করে সভ্যর মা বাবা। এর মধ্যে আজমল সাহেব বললেন, “রাগও একবারে ভাইসাবের মতো। ভয়ংকর।”
সভ্যর মা বাবা তাকায় তার দিকে। তাদের দেখে আজমল সাহেব জোরপূর্বক হাসেন।

সামি দৌড়ে আসে সভ্যর কাছে, “তো তোকে ডিট্টো ভূতের কপি লাগছে।”
সভ্য রাগে কটমট করে তাকায়। সাথে সাথে সে টিস্যু দিয়ে বলে, “এভাবে রাগে তাকাইস না। বুকের ভেতর ভয়ে কাঁপে। আর রাগ বাদ দিয়ে যেয়ে ভাবিকে মানা। সেই রাগ করে গেছে।”
সভ্য তার মুখ মুছতে মুছতে বলে, “যেন ওর রাগে আমার কিছু আসে যায়। ওকে আমি দেখছি।”

সভ্যও দৌড়ে উপরে যায়। ইনারার কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী সমস্যা তোমার?”
“আপনার কী সমস্যা? আমি আপনাকে নিজের মনের সব কথা চিঠিতে লিখে দিলাম কিন্তু আপনি এমন ব্যবহার করছেন যেন আপনার উপর তার কোনো প্রভাবই পড়ে নি?” ইনারাও রেগে বলে।
“তাহলে আমার কীভাবে রিয়েক্ট করা উচিত শুনি?”
“অন্তত এভাবে না। প্লিজ আপনি যান। অলরেডি আমার মুড নষ্ট করে যেয়েছেন। আমার বিশেষ দিনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।” অন্যদিকে তাকিয়ে বলে ইনারা।
“তুমি আগে আমার সাথে কথা বলো।”
“বলবো না, যান তো।”
“বলবে না?”
সভ্য ইনারার হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়৷ ইনারা ঠেলে দূরে সরাতে চাইলে সভ্য তার কোমরে হাত রেখে নিজের কাছে টেনে আনে এবং হঠাৎ করেই তার ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে বসে। আবার তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “কথা বলবে না?”
আকস্মিকভাবে সভ্যের এমন কান্ডে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ইনারা। সে গোল চোখ করে তাকিয়ে রইল সভ্যর দিকে। সভ্যকে এত কাছে দেখে তার যেন নিশ্বাস আটকে আসছে। সে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। সে কাচুমাচু করতে শুরু করলেই সভ্য তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। ইনারা সভ্যর ব্যবহারে ভীষণ অবাক হয়। প্রথমে তার চিঠির ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া, তার পর তার সাথে এভাবে ঝগড়া করা, এখন তার এত কাছে আসা। চলছেটা কি সভ্যর মাথায়?

চলবে…

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৪১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারা সভ্যর ব্যবহারে ভীষণ অবাক হয়। প্রথমে তার চিঠির ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া, তার পর তার সাথে এভাবে ঝগড়া করা, এখন তার এত কাছে আসা। চলছেটা কি সভ্যর মাথায়?

ইনারা বলতে নেয়, “আপনি ঝগড়ার মাঝে হঠাৎ এমন… ” সম্পূর্ণটা বলার পূর্বেই সভ্য তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। স্তব্ধ হয়ে গেল ইনারা। শিউরে উঠলো। এর থেকেও বেশি চমকিত হলো। হঠাৎ কেউ এমন করে? তাও গম্ভীর ঝগড়ার মাঝে? তবুও সে সরাল না সভ্যকে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করল তার স্পর্শ। যখন সে হাত এগিয়ে ধরল সভ্যর কোর্টটা, তখনই সভ্য তাকে ছেড়ে দেয়৷ ইনারা চমকে তাকিয়ে রয় সভ্যর দিকে। সভ্য তাকে আর একটা কথাও বলে না, সেখান থেকে চলে যায়। ইনারা কেবল হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সভ্যর যাওয়া দেখে।
.
.
সকাল সকাল রওনা হবার জন্য বের হলো ইনারা। আজমল সাহেবের ঠিকানা অনুযায়ী যাবার কথা তাদের। ইনারা জলদি করে তৈরি হয়ে নিচে নামলো। গাড়ির দরজা খুলে সভ্যকে দেখে খানিকটা স্তব্ধ হয়ে গেল। ভাবল গতকালের কথা। তারপর ভেতরে ঢুকে বসলো। সভ্যর দিকে তাকায় সে, কিন্তু সভ্য একপলকও তার দিকে তাকায় না। এবার ইনারারও জেদ উঠে। ভেংচি কেটে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

সারা রাস্তা চুপচাপ কাটে দুইজনের। তাদের প্রায় তিন ঘন্টা লাগে গন্তব্যে পৌঁছাতে। ইনারা দেখতে পায় আজমল সাহেব তাদের বরণ করার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন মুখ্য দরজায়। তাদের দেখে একগাল হেসে এগিয়ে আসে। তাদের খুশিমনে নিয়ে যায় বাড়ির ভিতর। বাড়ির কাঠামো একটু পুরনো দিনের মতো। কিন্তু আসবাবপত্র সব নতুন। ইনারা এই কথা চিন্তা করতে করতেই আজমল সাহেব বলেন, “এটা আমাদের দাদার কালের বাড়ি। খুব পুরনো। আমার আরেক বাড়ি ফিল্মসিটির পাশে আছে। কিন্তু মা এই বাড়ি ছেড়ে যেতে চান না। বলেন, মরলে এই বাড়িতেই মরবো, তাও বাড়ি ছেড়ে যাব না। একারণে ফিল্মের শুটিং থাকলে আমি ওই বাড়িতে থাকি এবং না হলে এই বাড়িতে।”
“আপনাদের পরিবারের আর কেউ থাকে না?”
“পরিবারে তো আর কেউ নেই। বাবা একা সন্তান ছিলেন আর আমরা দুই ভাই। ভাইয়া কতবছর পূর্বে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আর আমার কখনো পরিবার হয় নি তাই আমাদের আর কেউ নেই। কিন্তু এখন তোমরা আছো।”
আজমল সাহেব হেসে ইনারা ও সভ্যর দিকে তাকিয়ে বললেন। কথা বলতে বলতে রুমে এসে পড়লেন তিনজন। দরজায় দাঁড়িয়েই দেখতে পায় বিছানায় শুয়ে আছে একজন বৃদ্ধ মহিলা। তার পা টিপে দিচ্ছে আরেকটি মাঝারি বয়সের মেয়ে। তাদের তিনজনকে দরজায় দেখতেই মেয়েটি মাথায় কাপড় দিয়ে নিলো। আজমল সাহেব পরিচয় করাল তাদের, “ও হলো মিতু। এই বাড়িতেই থাকে এবং মা’য়ের দেখাশোনা করে।”
মেয়েটি সালাম দিলো সবাইকে।

“কে রে? আজু তুই আসছিস?” বৃদ্ধ মহিলাটা উঠে বসার চেষ্টা করে। না পারায় মিতুই তাকে ধরে বসায়। আজমল সাহেব এগিয়ে যেয়ে তার বিছানার পাশে দাঁড়ায়। তার হাত ধরে বলে, “মা তোমাকে বলেছিলাম না আজ এক বিশেষ অতিথি আসবে। দেখ নিয়ে এসেছি। ইনারা এদিকে আসো।”
ইনারা সামনে এগোল। আজমল সাহেব তাকে বললেন বিছানায় বসতে। সে বসলোও। কিন্তু চোখ নিচু করে রাখল। কেমন জানি অনুভূতি হচ্ছে। অদ্ভুত। তার সামনে বসা বৃদ্ধ মহিলাটা তার দাদী হয়। সে কখনো তার মা’কে মেনে নেয় নি। মা’য়ের জন্য তার আপন ছেলেকে এতবছর দূরে রেখেছে। একবার খোঁজও নেয় নি। তাহলে তাকে কী মেনে নিবে?

“কে ওরা? তোর সঙ্গে কাম করে?” দাদী বললেন। আজমল সাহেব ইনারাকে জানালেন তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকেই দাদী খুব জলদি সবাইকে ভুলে যান। কিছু মনে রাখতে পারেন না। কাউকে মনে রাখতে পারেন না। আজমল সাহেব দাদীকে আবার জানান, “মা ওর নাম ইনারা। তোমাকে আজ সকালে বলেছিলাম না ওর কথা? ও তোমার নাতনি হয়। ইমতিয়াজ ভাইয়ের মেয়ে।”
“ইমতিয়াজের মাইয়া? আমার নাতনি?”
মহিলাটা খপ করে ইনারার হাত ধরে। হাত ধরতেই ইনারা মুখ তুলে তাকায় তার দিকে। খুশিতে মহিলাটার চোখ জ্বলজ্বল করছে। সে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আমার নাতনি? আমার ইমতিয়াজের মাইয়া?”
ইনারা প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না। তারপর মাথা নাড়ালো।
দাদী ইনারাকে খুব ভালো করে কয়েক মুহূর্ত দেখলো। তারপর নিজেই বলল, “হো ওই আমার ইমতিয়াজের মাইয়া। সেই চোখ, সেই নাক। আমার ইমতিয়াজের মাইয়া ওই।” বলে ইনারার গাল ধরে তার সারামুখে চুমু খেল। তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে শুরু করলেন সে। তার কান্নায় হাহাকার করে উঠে ঘরের চার দেয়াল।

ইনারা সেই মুহূর্তেও বুঝতে পারছিল না কি করা উচিত তার। অজান্তেই তার চোখ ভিজে গেল। দাদী তাকে ছেড়ে যখন বললেন, “তোমার রঙরূপ একবারে তোমার মা এর মতো হইসে। কী সুন্দর! তোমার মা আইসে?”
“আমার মা?” ইনারা তাকাল আজমল সাহেবের দিকে। সে বললেন, “মা প্রায়শ্চিত্ত করছে তোমার মা’য়ের সাথে তার ব্যবহার করার জন্য। একবার কেবল তার সাথে দেখা করে চেয়েছিল কিন্তু এর আগেই উনি…” বলতে বলতে চুপ হয়ে গেলেন তিনি। ইনারা তার কথাটা বুঝতে পারল। সে দাদীর হাত ধরে বলল, “উনি আসেন নি।”
“আর আমার ইমতিয়াজ ওই আসছে?”
ইনারা মাথা নাড়াল। আসে নি। সে বলল, “পরে আসবে দাদী।”
“দাদী! আজমল শুন ওই আমারে কী কইসে? দাদী। আমারে দাদী কইসে। আমার কলিজার ভেতরটা ঠান্ডা হইয়া গেল। আমার নাতনি আমারে দাদী কইয়া ডাকছে। আমার পোলার কোনো সন্তান দেখার লাইগা আমার কলিজা পুইড়া যাইতাছিল। আর আজ আমার ইমতিয়াজের মাইয়া আমার কাছে আছে। বু তুই আমার কাছ থেকে দূরে যাইস না।”
বলে আবার জড়িয়ে ধরলেন তাকে।

ইনারাও কান্না করে দিলো। খুশির কান্না। এই জীবন আস্তে আস্তে তার সব ছিনিয়ে নিয়েছিল। রেখে গিয়েছিল কেবল দুঃখ কিন্তু আজ এতো বছর পর মনে হচ্ছে এই জীবন তাকে জীবনের সকল শান্তি একসাথে ফিরিয়ে দিচ্ছে।
ইনারাও জড়িয়ে ধরল দাদীকে। কিন্তু হঠাৎ দাদী তাকে সরিয়ে দিলেন। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কে? তুই এখানে কী করছিস?আজমল এই মাইয়া কে?”
“আমার অতিথি মা। পরে আবার পরিচয় করিয়ে দিব। তুমি এখন আরাম করো।”

আজমল সাহেব ইনারাকে বললেন, “উনি তোমার সব ভুলে গেছেন। চিন্তা করো না তোমাকে দেখতে দেখতে একসময় মনে রাখবে। মন খারাপ করো না।”
ইনারা মাথা নাড়ে, “যে মেয়ে অর্ধেক জীবন তার পরিবারকে কাছে পায় নি তার জন্য এতটুকু মুহূর্তও অনেক।”

আজমল সাহেব ঘর ঘুরিয়ে দেখাতে থাকেন দুজনকে। একসময় তার রুমেও নিয়ে গেলন। সেখানে দেখলেন একটি দেয়ালে বড় ফ্রেমে লাগানো ছবি। ছবিটায় আজমল সাহেব সহ তার বাবা, মা এবং সৌমিতা আন্টি দাঁড়ানো। ছবিটা দেখে সে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। সভ্যও এসে দাঁড়ালো ইনারার পিছনে। ছবিটা দেখে জিজ্ঞেস করল, “সৌমিতা আন্টি এই ছবিতে?”
আজমল সাহেব হাসলেন, “আগে আমরা চারজন একসাথেই থাকতাম অনেক সময়। ভাইয়া, ভাবির জন্য দেখা হতো। অনেক মজা করতাম সবাই একসাথে। এরপর হঠাৎ সব শেষ হয়ে গেল। আমি ভারতে পড়তে চলে গেলাম। আর ভাইয়া ভাবি বিয়ে করার পর মা’য়ের কসমের জন্য কখনো তাদের সাথে কথাও বলিনি। দেশে ফিরে এসেও ভাইয়াকে প্রথম দেখি মৃত অবস্থায়।” দীর্ঘশ্বাস ফেলল আজমল সাহেব। আবার বললেন, “হয়তো আমাদের সবার জীবন আজ অনেক আলাদা হতো। ভাইয়া, ভাবি আমাদের সাথে থাকতো যদি মা বাবা এত কঠিন মন না রেখে ভাবিকে মেনে নিতেন। আমরা ইনারাকে ছোট থেকে বড় হতে দেখতে পারতাম, আদর করতে পারতাম। তাদের এক সিদ্ধান্ত সব শেষ করে দিলো।”
ইনারা এখনো তাকিয়ে থাকে ছবিটির দিকে, “মা বাবাকে একসাথে কত সুন্দর দেখাচ্ছে। যেন একে অপরের জন্যই তৈরি হয়েছিল।”
ইনারা পিছনে ফিরে তাকায় আজমল সাহেবের দিকে, “আপনি আমাকে যে মেয়েটার কথা বলেছিলেন সে কী সৌমিতা আন্টি? যাকে আপনি ভালোবাসতেন?”
কথাটা শুনে সভ্য ও আজমল সাহেব দুইজনই চমকে উঠে। তারপর আজমল সাহেব মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ, কিন্তু কখনো ওকে বলা হয় নি। সৌমিতাও হয়তো বাসতো। ভাবির কারণে প্রায় দেখা হতো আমাদের। চিঠি লেনদেনও হতো, বন্ধু হিসেবে। কিন্তু হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে গেল। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। আমার সামনেই ওর বিয়ে হয়েছিল। ওকে বধূ বেশে ভীষণ সুন্দর লাগছিলো। ওকে দেখার পর অন্যকাউকে এই পরাণ চায় নি। সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এই জন্মে আর কাওকে ভালোবাসবো না। বাসি নি।”
সভ্য জিজ্ঞেস করে, “আপনার খারাপ লাগে না?”
“লাগলে ওর দেওয়া চিঠিগুলো পড়ে নেই। চিঠিগুলো আজও সযত্নে আমার কাছে আছে। এছাড়া ওকে নিজের পরিবারে সুখী দেখেই আমার শান্তি।”
ইনারার মনে পড়ে কীভাবে মিঃ হক সৌমিতা আন্টিকে কষ্ট দিচ্ছিল। কিন্তু সে কিছু বলল না। কেবল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক চিরে।

তারা বিকালেই রওনা দেয়। রাতে আবার মেহেদীর অনুষ্ঠান আছে। ইনারার পার্লারে যেতে হবে। তৈরি হতে হবে। সারা রাস্তা কথা না বললেও হঠাৎ সভ্য বলে, “আমি অন্যগাড়ি আনতে বলছি। তুমি এ গাড়ি নিয়ে যাও।”
“কেন? কেন? কেন?”
ইনারা আতঙ্কিত কন্ঠে এমন প্রশ্ন শুনে অবাক হয় সভ্য, “এমন রিয়েক্ট করছ কেন? আমার এক মিটিং আছে। ওখানে যেতে হবে।”
“বিয়ের সময় আপনার কীসের মিটিং হ্যাঁ?”
“তুমি তো পার্লারে যেয়ে আধাদিন বসে থেকে টাইমপাস করতে পারবে আমি তো আর পারব না। আমার তো সময় কাটাতে হবে।”
ইনারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “কখন মিটিং আপনার?”
“কিছুক্ষণ পরই।”
“আপনি কোথাও যাবেন না।”
“তাহলে কি তোমার সাথে পার্লারে বসে থাকবো?”
“তাই থাকবেন।”
“ইনারা জেদ করো না।”
ইনারা তাকে আর পাত্তা দিলো না। সে ড্রাইভারকে বলল, “ড্রাইভার আংকেল যদি আপনি উনার কথায় গাড়ি থামিয়েছেন তাহলে উনার সাথে আপনাকে রকেটে বেঁধে উড়ায় দিব৷ যেখানে বলেছি ওখানে গাড়ি নিন।”

ইনারা সভ্যকে নিয়ে এলো তার আগের ফ্ল্যাটে। যেখানে পঞ্চসুরের সময় থাকত সভ্য। সভ্য জিজ্ঞেস করে, “গাড়ি এখানে এনে কেন থামালে?”
“সামি এখানে আসতে বলেছিল।” গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলে ইনারা।
সভ্যর চলে যাবার কয়েকবছর পরই তার ফ্ল্যাট কিনে নেয় সামি। সেখানে থাকে। আজ অনেক বছর পর এই বিল্ডিং দেখে সভ্যর তার পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। স্মৃতিগুলো চোখে ভাসে তার।

ফ্লাটের সামনে যেয়ে ইনারা দরজা খুলে। ভেতরে ঢুকতেই চমকে উঠে সভ্য। চারপাশে ফুল ও মোমবাতি দিয়ে সাজানো। আর মাঝখানে টেবিলের উপর একটি কেক রাখা। সে পাঁচ বছর পূর্বে যেভাবে সাজিয়েছিল সম্পূর্ণ ডেকোরেশন ঠিক তেমন। এই দৃশ্যটা দেখতেই পাঁচ বছর পূর্বের কথা মনে পড়ে গেল তার। এখানে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করছিল সে ইনারার। আর মুহূর্তে সব শেষ হয়ে গেল।

ইনারা সামনে এসে দাঁড়ায়। একগাল হাসি নিয়ে। তার হাত ধরে কক্ষের মাঝখানে এসে দাঁড় করায়, “এই দৃশ্যটা মনে আছে আপনার? এভাবেই আপনি আমার জন্য সব তৈরি করেছিলেন তাই না?'”
সভ্য চুপ থাকে। উওর দেয় না।
ইনারা নিজে ঘুরে ঘুরে সব দেখায় ও বলে, “সামির কাছ থেকে ছবি নিয়ে আমি সব সেরকম করেছি। এই’যে এই ফুল, সাদা মোমবাতি, এই সেইম কেক। সব। যেন সেদিন আমাদের জীবনে যা অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল তা আজ সম্পূর্ণ করতে পারি। কেবল শেষ একটা জিনিস বাকি।”
ইনারা উত্তেজিত হয়ে একটানা কথা বলে হয়রান হয়ে গিয়েছিলো। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার ব্যাগ থেকে একটি রিং বের করে হাঁটু গেড়ে নিচে বসলো, “আপনি আমায় ঠিক কীভাবে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতেন আমি জানি না। তবে আমি নিজের মতো করে বলি, আপনি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ। আপনি আমার জীবনে সে ব্যক্তি যার নামে আমি নিমিষে আমার সম্পূর্ণ জীবন লিখে দিতে পারি। আমার দুঃখভরা আকাশে সুখের মেঘ আপনিই এনেছেন। আপনি কাছে থাকলে আমি এই পৃথিবীতে নিজেকে সবচেয়ে ভাগ্যবতী বলে মনে করতে পারি। আপনার সাথে যেমন ঝগড়া করতে আমার ভালোলাগে, তেমনি আপনার বাহুডোরে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে আমি ভালোবাসি। আপনিই এই হৃদয়ের স্পন্দনে লেখা। আপনাকে কখনো বলা হয় নি। আজ বলছি, ভালোবাসি….”

সভ্য এখনো চুপ। ইনারা অবাক হয়। এই মুহূর্তে সভ্যর কিছু তো বলা উচিত। সে মশকরা করে বলল, “জলদি বলুন আপনিও আমাকে ভালোবাসেন, নাহয় এভাবে বসে থাকতে থাকতে আমার পা যাবে।”
সভ্য তখনো কিছু বলে না। এবার ইনারার একটু খটকা লাগে। সে উঠে দাঁড়ায়, সভ্যকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কিছু বলছেন না কেন?”
“কী বলবো?”
“কী বলবো মানে? আপনার কী চিঠি পড়ার পর অথবা আজ আমার কনফেশন শোনার পর কিছু অনুভূতি হয় নি?”
“অনুভূতি? আমার তো সকল অনুভূতি তখনই হারিয়ে গিয়েছিল যখন তুমি আমাকে বলেছিলে আমি কেবল তোমার দেহ পাবার জন্য তোমার কাছে আসি।”
ইনারা চমকে উঠে, “কী বলছেন আপনি? এটা তো কত আগের কথা। আমি ভেবেছি আপনি কথাগুলো ভুলে গেছেন?”
“এত সহজে ভুলে যাব? এত সহজ মনে হয় তোমার কাছে? তুমি যা বলেছিলে তা আজ পর্যন্ত আমার কানে বাজে। আমি এসব ভুলতে পারব না। তোমার সিদ্ধান্ত ছিলো এই সম্পর্কটা রাখা, এই বিয়ে করা। এসব যাস্ট ফর্মালিটি আর কিছু না। তোমার জন্য আমার মনে আর কিছু নেই। আর কিছু আসবেও না। এই বিয়েটা এখন নামমাত্র।”
ইনারা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সভ্যের দিকে। তার চোখে বিস্ময়। এই মুহূর্তটা তার কল্পনা মনে হচ্ছে। কিন্তু এটা কল্পনা না। বাস্তব।

সভ্য আবার তার ঘড়ি দেখে বলল, “আমার মিটিং আছে। দেরি হয়ে যাবে। আমি যাই।”
সে ফিরে যেতে নিলেই ইনারা জিজ্ঞেস করে বসলো, “তাহলে গতরাতের আপনি আমাকে এভাবে হলুদ লাগিয়ে দিলেন কেন, আমার কাছে আসলেন কেন, এভাবে তাকালেন কেন যেন আমি আপনার সম্পূর্ণ পৃথিবী।”
সভ্য দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু ইনারার দিকে তাকায় না, “হঠাৎ করে পুরনো অনুভূতি মনের ফাঁকে উঁকি দেয়। এরপর থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখবো। চিন্তা করো না।”
“আপনি ভুল করেন নি? আপনি অন্য একজনের কথা শুনে আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। কিছু জিজ্ঞেস করেন নি, কিছু বলেন নি। হঠাৎ চলে গেলেন। আপনি না গেলে কি আমাদের জীবনের এতগুলো বছর আলাদা থাকতে হতো?”
সভ্য উওর দিলো না। কিছু বললও না। কেবল বের হয়ে গেল।

ইনারা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। নিস্তব্ধ, নিথর। সেখানেই বসে পড়লো ইনারা। তার এই এক ভুলের মাশুল কতদিন দিতে হবে কে জানে? সভ্য কী আদৌও সব ভুলে তাকে মেনে নিতে পারবে। হঠাৎ ইনারার নিজেকে খুব দুর্বল মনে হচ্ছিল। সে থপ করে নিচে বসে পড়লো।
.
.
সুরভি জলদি করে গাড়ি থেকে নামে। তার লেহেঙ্গাটা উঁচু করে দৌড়ে আসে ভেতরে। সভ্যর বাড়িতে এসেছে সে। সে সামিকে পেয়ে যায় দরজাতেই। অস্থির হয়ে সামিকে জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া এসেছে?”
সামি তার এমন হাঁপানি দেখে বলে, “রিলেক্স হও। এত হাইপার হবার কিছু নেই। সভ্য অনেক আগেই এসে পড়েছে।”
“ভাইয়ার না কাজ ছিলো?”
“যায় নি। সম্ভবত ক্যান্সেল হয়ে গেছে।”
“ওহ।”
“পার্টনার কোথায়?”
“ওঁকে বলেছি মাঝরাস্তা থেকে আমার ফেরত যেতে হচ্ছে। মা’য়ের জরুরি ফোন এলো বলে। বিয়ের ড্রেসটা ওরই এখান থেকে এসে নিতে হবে। আমার ওর মুখ দেখে যা খারাপ লাগছিলো। তুমি কল দেবার পর আমি ওকে তোমার বাসা থেকে জোর করে নিয়ে পার্লারে গেলাম। ও আমায় কিছু বলে নি। কিন্তু মেকাপ করার সময়ও বারবার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো।”
“আরে কিছু মুহূর্তই তো। তারপর ওর মুখে কেবল হাসির ঝলক দেখবে। তো ভাবি কখন আসবে।”
“এইত্তো এসে পড়বে। আমি পার্লার থেকে বের হওয়ার দশ মিনিট পরই ওকে আসতে বলেছিলাম। এখনই এসে পরবে।”
“আর তুমি এখন বলছ?”
সামি দৌড়ে যায় বাগানের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঐশি ও ইরফানকে বলে, “জলদি সব ঠিক করে ভেতরে চল। জলদি। ইনারা আসছে। জলদি।”

ইনারা গাড়ি থেকে নামলো। তার পরনে হলুদ ও লাল রঙের সারারা। তার সোনালি উজ্জ্বল চুল হলুদ রঙের ফুল দিয়ে বাঁধা। সাজগোজে তাকে রূপসী দেখাচ্ছে। আজ তার জন্য এত বড় দিন বলে কথা। কিন্তু তার ঠোঁটের হাসিটা আজ নেই। মলিন তার মুখ। বিয়ের খুশিটা যেন আর তার মাঝে নেই। সভ্যর মতো তার জন্যও এসব কেবল ফর্মালিটি। এই বাড়িটা দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ইনারার বুক চিরে। দুই বছর পূর্বে এই বাড়িতেই সভ্যের বধূ সেজে পা রেখেছিল সে। তখন তার কোনো স্বপ্ন ছিলো না সভ্যকে নিয়ে। আজ হাজারো স্বপ্ন তার বুকে গাঁথা অথচ তার কাছে সভ্য নেই। এই বাড়িটা দেখতেই কেবল নিশ্বাস আটকে আসছে তার। বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে তার ও সভ্যর স্মৃতিতে ভরা। জলদি করে তার লেহেঙ্গা নিয়ে এখান থেকে বের হলেই হয়। আজ সভ্যর কথাগুলো শোনার পর আর সে এখানে থাকতে পারছে না।

ইনারা ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে নিলেই কিছু শব্দ শুনে বাগান থেকে। গুণগুণ শব্দ। সে বাগানের দিকে যায়। চারদিকে অন্ধকার। তবুও শব্দটার দিকে সে এগোয়। সে জিজ্ঞেস করে, “কে?”
চারদিকে বাতি জ্বলে উঠে। ইনারার সামনে একটি গোল মঞ্চ সাজানো। সাদা ও হলুদ ফুল দিয়ে। সে মঞ্চের ঠিক অপরদিকে বসে আছে সভ্য। কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। তার হাতে একটা গিটার। ইনারা কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই চোখ টিপ দিয়ে গিটার বাজাতে শুরু করে এবং গান ধরে তার জন্য,

“বৃষ্টি নেমেছে আজ আকাশ ভেঙে
হাঁটছি আমি মেঠো পথে
মনের ক্যানভাসে ভাসছে তোমার ছবি
বহুদিন তোমায় দেখিনা যে।

তোমায় নিয়ে কত স্বপ্ন, আজ কোথায় হারাই
পুরানো গানটার সুর, আজ মোরে কাঁদায়।

তুমি তো দিয়েছিলে মোরে কৃষ্ণচূড়া ফুল
আমি তো বসে ছিলাম নিয়ে সেই গানের সুর
তুমি তো দিয়েছিলে মোরে কৃষ্ণচূড়া ফুল
আর কোথাও ফেলে যেও না আমায় বহু দূর…”

ইনারা তাকিয়ে রইলো সভ্যর দিকে। এক দৃষ্টিতে। সভ্য গান গাইতে গাইতেই এগিয়ে এলো তার কাছে। তার গায়ের গিটার রেখে এলো মাঝপথে। টেবিল থেকে তুলে নিলো এক মুঠো কৃষ্ণচূড়া। ইনারার চারপাশে ঘুরে গান গাইতে গাইতে তার উপর বর্ষণ করল কৃষ্ণচূড়া। সে মুহূর্তে ইনারার গালে হাসি ফুটে ওঠে। তার মনে খুশির জোয়ার ভাসে। সে দুই হাত ছড়িয়ে উপভোগ করে কৃষ্ণচূড়ার বর্ষণ। আর তাকায় সভ্যর দিকে। অবশেষে সভ্য থামে। সে ইনারার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার হাত ধরে কাছে টানে। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, এখনও। সভ্য তার দিকে ঝুঁকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলে, “ভালোবাসি, আমার মহারাণী।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে