অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৩৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
ইনারা এখনো সভ্যের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে। হয়তো কি হলো সে বুঝতেই পারছে না। সভ্য মৃদু হেসে বলল, “আমার নামের হলুদ আমিই তোমাকে সর্বপ্রথম লাগাচ্ছি।” বলে সে নিজের হলুদমাখা গাল ছোঁয়াল ইনারার গালে।
ইনারা কিছুটা চমকিত হয়ে তাকিয়ে থাকে সভ্যের দিকে। এরপর লজ্জায় লাল হয়ে যায় । সভ্য হাসে তাকে দেখে। দু’জনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সুরভি এসে দুইজনের পাশে দাঁড়ায়। একবার সভ্যের দিকে তাকায়, আবার ইনারার দিকে। তারপর কেশে বলে, “রোমেন্স কি শেষ হতে সময় লাগবে? লাগলে আমি পার্লারের আপুকে বলি একটু রেস্ট নিতে।”
সভ্য ও ইনারা দুইজনই লজ্জা পায়। একে অপর থেকে দূরে সরে যায়। লজ্জিত হয়ে আশেপাশে তাকাতে থাকে। সভ্য আমতা-আমতা করে বলে, “আমি…আমি সামির খবর নিয়ে আসি।” বলে সে চলে যায়।
সুরভি ইনারার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “জানু তুমি এমনভাবে ব্লাশ করছ যেন নতুন নতুন বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের তো সে দুই বছর হয়ে এলো। এখনো এভাবে লজ্জা পেলে হয়?”
“ধ্যুর বিরক্ত করিস না-তো।”
“ইশশ আবারও লজ্জা পেয়ে গেলি? বিশ্বাস কর অতীতে আমি কখনো ভাবি নি তুই এভাবে লজ্জা পেতে পারিস। কী সুন্দর দেখায় তোকে! এখন মুখ ধুয়ে আয়, এখন সাজতে না বসলে দেরি হয়ে যাবে।”
ইনারা তার গালে হাত দিয়ে, নিজের গালে মাখা হলুদটা ছোঁয়। হলুদটা দেখ মুচকি হাসে, “আজ আর সাজবো না।”
“তোর হঠাৎ কী হলো?”
“সভ্যর লাগানো হলুদ এভাবে ধুঁয়ে ফেলতে পারি? আমি কাজল লাগিয়ে নিব। আর সভ্যও তো আমাকে যখন পছন্দ করেছে তখন আমি সাজগোজ মোটেও করতাম না।তাই আজ পুরোনোভাবেই ওর সামনে যাব। কিন্তু তুই, মিনু ও রিধু ভাবি সেজে নেয়।”
“জান তুমি তো প্রেমে পুরো দিওয়ানা হয়ে গেছো দেখছি। আমরা তোর পাগলামি দেখে ভাবতাম জীবনে তোর জীবনে প্রেম আসবে না-কি। অথচ আজ তোর প্রেম কাহিনীটাই সবচেয়ে সুন্দর। আজ তোর হলুদ হচ্ছে। আগামীকাল রাতে তোর মেহেদীর অনুষ্ঠান। পুরশু তোর বিয়ে, সাথে জন্মদিনও। তুই আগামীকাল তোর জন্মদিনের আগে ভাইয়াকে তোর মনের কথা জানাবি। কত আগে থেকে তাকে ভালবাসিস তাও জানাবি। যে গল্প তোর জন্মদিনেই কয়েকবছর পূর্বে অপূর্ণ রয়ে গিয়েছিল তা পূর্ণ করবি। আমি তোর জন্য কত হ্যাপি তোকে বুঝাতে পারছি না।”
“আমাকে তোর জন্য হ্যাপি হওয়ার সুযোগ কবে দিবি শুনি?”
“মানে?”
“মানে তোর আর আহনাফের খবর কী?”
কথাটা শুনে সুরভি একটু দেবে যায়। তার হাসি মুখটায় বিরক্তি প্রকাশ পায়। সে বলে, “ওর কথা বাদ দে। ভেতরে চল।”
সুরভী এগিয়ে যেতে নিলেই ইনারা তার হাত ধরে নেয়। তাকে নিয়ে যায় শেষ প্রান্তের বারান্দায়। এখানে তেমন কেউ আসেনা। শান্তি মত কথা বলা যাবে। এখানে এসে সুরভিকে জিজ্ঞেস করে, “এবার বল। কি হয়েছে সব বলবি।”
সুরভি ভাবল, ইনারার মন মেজাজ আজ অনেক ভালো। তাকে শুরু থেকে সব বললে হয়তো তাকে আর বকবে না। তাও সে ওয়াদা নিলো, “আগে ওয়াদা কর বকবি না, বা মাইর দিবি না।”
ইনারা কপাল কুঁচকে নিল, “এমন কি করেছিস তুই?”
“ওয়াদা কর তো।”
“আচ্ছা করলাম।”
“হয়েছে কি আহনাফের সাথে যেদিন প্রথম দেখা সেদিন ওর ফোনে একটি মেয়ের ছবি দেখেছিলাম। মেয়েটি না’কি তার এক্স গার্লফ্রেন্ড।”
“এক্স-গার্লফ্রেন্ডের ছবি ফোনে? এটাতো ভালো লক্ষণ নয়। বিয়ের জন্য হ্যাঁ কেন বললি তাহলে?”
“সম্পূর্ণ কথাটি শোন, আমি তো মানাই করেছিলাম। কিন্তু মা, বাবা, ভাইয়া অনেক জোর করতে শুরু করে। কথা বলে দেখতেই হবে এমন অবস্থা। ওর ক্ষেত্রেও তাই। তাই দুইজনে বন্ধুত্ব করলাম। কথা হতো। আর যাই হোক, ও অনেক কেয়ারিং ও ভালো। ওর পার্সোনালিটি দেখে আমারও ওকে পছন্দ হয়।”
“আর ওর?”
“জানি না বাপু। ওর মনে কি চলে তা খোদা জানে। এমন কনফিউজড মানুষ আমি এই জীবনে আর দেখিনি। আমার সাথে কথা না বলতে পারলে অস্থির হয়ে যায়, ফোন না ধরলে চিন্তায় আমাদের বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে…”
“মানে সে-ও তোকে পছন্দ করে?”
“জানি না। কিছু বুঝতে পারি না। আমাকে পছন্দ করলে তো বারবার নিজের এক্স -গার্লফ্রেন্ডের কাছে ছুটে যেত না সে। আমার এখন বিরক্ত লাগে।”
এমন সময় তাদের ডাক পড়ে। কণ্ঠটা রিধুর। রিধু হচ্ছে সুরভির ভাবি। অর্থাৎ সাইদের স্ত্রী। তাদের দুইজনের বিয়ে হয়েছে একমাস হবে। সুরভির কথামতে রিধু খুব নম্র স্বভাবের মেয়ে। ঘরের সবার খুব খেয়াল রাখে এবং সবাইকেই অনেক আদর করে। মেয়েটা লাজুক হলেও হাসি-খুশি থাকে সবসময়। এমনকি মাঝেমধ্যে সাইদ ভাইয়া তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলে, তবুও ঘরের সবার সামনে হাসিমুখেই প্রস্তুত হয় রিধু।
ইনারা সুরভির হাত ধরে বলে, ” তুই ওয়াদা নিয়েছিলি নাহলে তো এতকিছু লুকানোর জন্য এখন তোকে জ্যান্ত রাখতাম না।”
“আমি জানি এজন্য আগে দিয়ে নিজেকে সেফজোনে রেখে দিলাম।”
“চিন্তা করিস না, একবার বিয়ে হলে তোর সেটিংও ঠিক করে দিব। আমার জানু কাওকে পছন্দ করবে এবং তাকে পাবে না, ইনারা তা হতেই দিবে না।”
দুইজনে হাইফাই দিতে নেয় এবং আবারও রিধুর কন্ঠ ভেসে উঠে। সুরভি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “বাহিরে না যাওয়া পর্যন্ত রিধু ভাবি এভাবেই চিল্লাচিল্লি করতে থাকবে। ভাবি অনেক ভালো কিন্তু এই এক সমস্যা তাকে যে কাজ বলা হবে তা না করা পর্যন্ত যেন তার শান্তি নেই।”
“আংকেল আন্টি আসবে না?”
“আজ আসবে না। বিয়েতে আনার চেষ্টা করব। শেষবার তোকে বাসায় ঢুকতে না দেবার লজ্জাটা সে ভুলতে পারছে না। তাই ভাবির সাথে পাঠিয়ে দিলো।”
“আন্টি নিজের জায়গায় সম্পূর্ণ ভুল ছিলো না। মা’য়েদের জন্য নিজের ছেলে মেয়েরা সবার আগে আসে। আর আমার জন্য তোদের উপর প্রভাব পড়তো। তখন আমাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিল, সে অবস্থার পর এমনই বা কয়জন করে? আচ্ছা অতীতের কথা বাদ দে। আন্টি না আসলে তাকে জোর করে তুলে আনব। সাইদ ভাইয়া কি আসবে?”
“সাইদ ভাইয়া তো এখনো জোহানের এসিস্ট্যান্ট হয়ে বসে আছে। কবে যে তার জ্ঞান বুদ্ধি আসবে বুঝি না। সে আইজা তাকে ছেড়ে এক বুড়োকে টাকার জন্য ডেইট করে, আর সে ওই মেয়ের কথা ভেবে রিধু ভাবির সাথে খারাপ ব্যবহার করে।”
এমন সময় আবারও রিধুর কন্ঠ শুনে সুরভি বলে, “আয় তো। নাহলে ভাবি আমাদের ডাকতে ডাকতে নিজের গলা ব্যাথা করে ফেলবে।”
.
.
সভ্য আশেপাশে খুঁজে পেয়েই যায় সামিকে। সামি খালাজানের সাথে গল্প করছিল। সে সামিকে ডাক দেয়। কিন্তু সভ্যর কন্ঠ শুনে তাকে আর পায় কে? সে দিলো এক দৌড়। তখনই সভ্য দরজা দিয়ে ঢুকা মিনুকে শব্দ করে বলে, “মিনু ওকে ধর। একদম যেতে দিবি না।”
সভ্যর এমন কথা শুনে মিনু ভাবে লোকটি হয়তো কোনো চোর, নাহয় এভাবে সভ্য তাকে থামাতে বলল কেন। এক দুই না ভেবে সে পা এগিয়ে দিলো। আর পা’য়ে ঠোকর খেয়ে পড়ে যায় সে লোকটা। আর মিনু ভাব নিয়ে বলে, “আর এভাবেই জোর ব্যবহার না করে আমেনা মিনু চোর ধরতে সফল হন।”
“আমাকে কোন দিক থেকে তোমার চোর মনে হলো?” সামি কপাল কুঁচকে মুখ তুলে। মিনু তাকে দেখে নিজেই থতমত খেয়ে নিচে বসে যায়। চোখ দুটো এমনভাবে বড় করে তাকায় যেন এখনই কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না কিছু মুহূর্তের জন্য, “আপ…আপনি সামি? আপনি সত্যি সামি?”
এতক্ষণ মেয়েটার উপর বিরক্ত হলেও তার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে সামি নিজেকে সংযত করে জিজ্ঞেস করে, “তুমি আমাকে চেনো?”
“চিনি? কে না চেনে আপনাকে? আপনি এতো বড় একটা সেলিব্রিটি কে না আপনাকে চিনবে। উফফ আপনি ছবি থেকে সামনা-সামনি বেশি হ্যান্ডসাম।”
সুন্দরী মেয়েদের থেকে প্রশংসা শুনাটা সামির অনেক পছন্দ। আর সামনা-সামনি এত প্রশংসা শুনে সে তো হাওয়ায় উড়ছিলো। তবুও ভাব নিয়ে বলল, “তুমি বেশি প্রশংসা করছ। এমন কিছু না।”
“বলেন কি? আপনার প্রডিউস করা গান, আপনার ইন্সট্রুমেন্ট বাজানো, গানের কভার সব আমার অনেক পছন্দ। আপনার নামের ফ্যানপেইজও আছে আমার।”
“বলো বলো, আরও বলো। আমার শুনতে অনেক ভালো লাগছে।”
এতক্ষণে সভ্য এসে পড়ে। সে সামির পিছনে দাঁড়িয়ে বলে, “আমার কথাও তাহলে ভালো করে শুন.”
সামি উঠে যেতে নিলে এবার সভ্য তার কলার ধরে নেয়। মিনুকে বলে, “আসতে এত দেরি হলো কেন?”
“ভাইয়া আজ এক্সাম শেষ হলো। এক্সাম শেষে একটু ঘুরাফেরা করলাম, তারপর এলাম। কিন্তু তুমি বলো নি কেন তোমার সামির সাথে পরিচয় আছে।”
“পরিচয়? ওর সাথে পাঁচ বছরের বেশি কাজ করেছি আমি।”
“ওহ হ্যাঁ কথায় লজিক আছে।”
“এটা কমনসেন্স। আচ্ছা উপরে যেয়ে তৈরি হয়ে নে, ফাংশন শুরু হবে।”
“ইনারা ভাবি কোথায়? তার নামের ফ্যানপেইজে আমার দশ হাজার ফলোয়ার হয়েছে তা দেখাব ভাবিকে।”
সভ্য একজন লোককে ডেকে মিনুকে নিয়ে যেতে বলল। সে সামির কাছে বিদায় নিয়ে লাফাতে লাফাতে উপরে চলে গেল।
সামি বিড়বিড় করে বলে, “আমি তো ভেবেছিলাম কেবল আমারই ফ্যানপেইজ আছে। এখন দেখি ইনারারও।”
তার কথা শেষ না হতেই সভ্য বলে, “আমার সামনে এমন বিড়বিড় করে কথা বলবি না। বিরক্ত লাগে।”
“দেখ ভাই মারবি না। একটু আগে এত সুন্দর মতো ভাবির দর্শন করালাম তাই ছেড়ে দে।
“ছেড়ে তো দিব। কিন্তু আমার একটা কাজ করতে হবে।”
সামি আড়চোখে তাকায় সভ্যর দিকে, “আমাকে দিয়ে তোরা যে কাজ করাস, এই কাজের জন্য টাকা দিলে আমি আজ তোর থেকেও বেশি ধনী হতাম। শালা কিপটা।”
“কী বললি?” সভ্য রাগে বলে। সাথে সাথে সামি ছাড় পেয়ে দৌড়ে পালায়।
.
.
সভ্য স্টেজে বসে আছে। ইনারা আসলেই তাদের হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। মেহমান বলতে কেবল কাছের কিছু মানুষই এসেছে। তাদের পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং কাজ থেকে কিছু লোক। তবে বাহিরের সবাইকে ফোন নিয়ে না ঢোকার অনুরোধ করা হয়েছে। যেন তাদের পরিবার বা বন্ধুদের ছবি বাহিরে প্রকাশ না হয়। ইনারাকে আনা হলো। তার মাথার উপর হলুদ একটা ওড়না দিয়ে রেখেছে তার বন্ধুরা। সভ্য খেয়াল করল ইনারা আর সাজগোজ করে নি। এখনো তার গালে হলুদ মাখা। তাকে দেখে আপনা-আপনি হাসি ফুটে ওঠে সভ্যর ঠোঁটে।
ইনারা তার পাশে এসে বসে। আড়চোখে তাকায় সভ্যর দিকে। লুকিয়ে। তাদের একসাথে থাকতে থাকতে এতগুলো বছর কেটে গেল কিন্তু তবুও আজ কেন যেন ইনারার খুব অস্থিরতা লাগছে। লজ্জায় যেন সভ্যর দিকে তাকাতেও পারছে না সে। অদ্ভুত অনুভূতি। গতবার সে তাড়াহুড়োর বিয়েতে তার মর্জি ছিলো না। ছিলো কেবল রাগ ও অভিমান। কিন্তু আজ এই বিয়ের প্রতিটি মুহূর্ত তার জন্য অনুভূতিতে ভরা। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
ঘরের বড়রা সবার আগে এলো হলুদ লাগাতে। কিন্তু দাদীজান ইনারার গালে হলুদ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “ইনারা তুমি অনুষ্ঠানের পূর্বেই হলুদ লাগিয়ে বসে আছো কেন? কে লাগিয়েছে তোমায় হলুদ?”
ইনারা আড়চোখে তাকায় সভ্যর দিকে। লজ্জামাখা চোখদুটোয় আর কারও দিকে তাকাতেই পারে না। মিনমিনে গলায় বলে, “দাদীজান এমনি লেগে গেছে। হলুদই তো থাক।”
দাদীজান আবার তাকালেন সভ্যর দিকে। তার চশমা ঠিক করে ভালো করে দেখলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বুঝলাম। আজকালকার ছেলে মেয়েরা দেখি হলুদের অনুষ্ঠানেই পূর্বেই হলুদ লাগিয়ে বসে থাকে।”
শেষে তিনি হেসে দুইজনকে হলুদ লাগিয়ে উঠলেন। দাদাজান বসে ইনারাকে কানে কানে বলে, “তোমার দাদীজানকেও আমিই বিয়ের আগে হলুদ লাগিয়ে অনুষ্ঠান করেছিলাম। অনুষ্ঠান করার মতো কেউ তো আর ছিলো না। তাই আমিই শখ পূরণ করেছিলাম ওর।”
“বলেন কী দাদাজান? সত্যি?”
“হ্যাঁ, এই আজকালকার ছেলেপেলেরা তো প্রেম কীভাবে করে তাই জানে না। প্রেম তো ছিলো আমাদের জমানায়।”
পাশ থেকে সভ্য বলে, “দাদাজান আমি সব শুনছি কিন্তু।”
“তুই শুনলে কী হবে হ্যাঁ? আমি তোকে ভয় পাই?” ধমক দিয়ে বলে দাদাজান। এরপর সভ্য ডাক দেয় দাদীজানকে। সাথে সাথে দাদাজান উঠে দৌড় দেয়।
মা, বাবা ও খালাজান লাগানো শেষে সুরভি এসে হলুদ লাগায়। ইনারা পরিবর্তে হলুদ লাগিয়ে বলে, “এরপর যেন তোর বিয়ে হয়।”
কথাটা শুনে সামি এক লাফে এসে বসে বলে, “পার্টনার আমাকেও লাগিয়ে দেও যেন আমারও বিয়েটাও সেরে যায়।”
“না, দিব না।”
“কেন?”
“আমার ইচ্ছা।”
সামি জোর করে ইনারার হাত থেকে হলুদ লাগানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ। এরপর সে বাটি থেকে প্রায় সব হলুদই নিজে মেখে নেয়। আর ভেংচি কেটে বলে, “এবার আমার বিয়ে সবার আগে হবে।”
তার এই কান্ডে সবাই হাসিতে মেতে উঠে। গান বাজনা শুরু হয়। সভ্যর বন্ধুরা তাদের দুইজনকে নিয়ে নাচ গান শুরু করে। যার মধ্যে সভ্য না নাচলেও ইনারা তাদের থেকেও বেশি নাচা-নাচি শুরু করে দেয়। কিন্তু আরও মেহমান আসা বাকি ছিলো হলুদ লাগানোর তাই ইনারাকেও আসতে হলো। ইনারা দেখে তার নতুন ছবির কয়েকজন তার আমন্ত্রণ পেয়ে এসেছে। আজমল সাহেব ও ওয়াসিন খান সহ আরও কিছুজন এসেছেন। তারা এসে ইনারাকে শুভ কামনা জানাল। ওয়াসিন খানকে সামনা-সামনি দেখে তো মিনুর শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সে ওয়াসিন খানকে অস্থির হয়ে বলল, “আপনাকে আমি সামনা-সামনি দেখছি… আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। আপনার নামে আমার একটা ফ্যানপেইজ আছে। আমি আপনার সাথে ছবি তুলতে পারি? আমি অনেক বড় ফ্যান আপনার।”
সামি তাকে দেখে যেমন বিরক্ত হয় তার থেকে বেশি নিরাশ হয়। সে মুখ বানিয়ে বলে, “আমি ভেবেছিলাম সারা বিয়ের অনুষ্ঠানে একটা ভাব নিয়ে থাকব এখানে কেউ আমার এত বড় ফ্যান। কিন্তু এই মেয়ে দেখি সবার ফ্যান।”
ইনারা সবকিছু দেখে অনেক খুশি ছিলো। তবুও কিছু একটা শূন্যতা ছিলো এসবের মাঝেও। ইনারার দেখে সভ্য জিজ্ঞেস করে, “তুমি খুশি না?”
ইনারা চমকে উঠে তার এমন প্রশ্নে, “”হ্যাঁ, খুশি হব না কেন? সব তো আমার পছন্দেই হচ্ছে।”
“তবুও তুমি এতটা খুশি না, যতটা হবার কথা। হাজার খুশিতেও উদাসীনতা আছে তোমার মাঝে।”
“দেখুন সবাই কত খুশি! আজ আমার মা-বাবা থাকলে তারাও অনেক খুশি হতো তাইনা? পরিবারের কোন সদস্য। অন্তত যদি বিয়ের আগে আমার বাবার পরিবারের নাম জানতে পারতাম তাহলে… ”
সভ্য তাকে বাঁধা দেয়, “ওয়েট তোমার বাবার পরিবার মানে?”
“সৌমিতা আন্টি বলেছিল আমার বাবার পরিবার আমার কথা জানে না। তারা কখনো বাবার সাথে যোগাযোগ রাখেনি। মা’কে বিয়ে করার কারণে। আর আমাকে হারানোর ভয়ে মা’ও কখনো তাদের আমার কথা জানায় নি।”
“তুমি এই কথাটা আমাকে আগে জানাও নি কেন?” অনেকটা রেগে উঠে সভ্য।
ইনারা আমতা-আমতা করে বলে, “কারণ আমি সম্পূর্ণ কথাটা জানতে পারি নি।”
“আর কিছু তথ্য আছে? কোনো কাজের তথ্য পাওয়া গেল আমি রহমানকে বলে তাদের খোঁজার কাজে লাগিয়ে দিব।”
“না, ওই টাক্কু ব্যাটা আন্টিকে নিয়ে গেছে তাই সব কথা জানাতে পারে নি। কেবল বলেছে বাবা মা’য়ের দেখা এক ফিল্মে হয়েছিল। বাবার ব্যবহার দেখে মা তার প্রেমে পড়েছিল। আর বাবার এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়েছিল। বাবাও এক নায়ক ছিলেন। বিষয়টা অস্থির না।”
সভ্য সরু চোখে তাকিয়ে রয় তার দিকে। ইনারা অবাক হয়, “আপনি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
“একটা সত্যি কথা বলো তো তুমি কী আসলে বোকা হবার নাটক করো না’কি তোমার মাথায় আসলে গোবর ভরা।”
“এই কি বলছেন আপনি?”
“গুগলে সার্চ করলেই তো হয় তোমার মা’য়ের সাথে কারা কাজ করেছে এবং কাদের এক্সিডেন্ট হয়েছিল।”
ইনারা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে সভ্যর দিকে, “এই বুদ্ধি আমার মাথায় আসে নি কেন?”
“বুদ্ধি আসার জন্য মস্তিষ্কে বুদ্ধি থাকতেও হয়।”
ইনারা মুখ ফুলিয়ে তাকায় তার দিকে। রাগান্বিত স্বরে বলে, “এই ব্যাঙের মতো প্যাক প্যাক করা বন্ধ করেন তো।”
“ব্যাঙ প্যাক প্যাক করে না’কি? ওটা তো হাঁস করে।”
ইনারা বিরক্ত হয়। সে সভ্যের পকেট থেকে তার ফোন বের করে গুগলে সার্চ দেয়। এবার সভ্য হতবাক হয়, “তুমি শাশুড়ী মা’য়ের তৃতীয় সিনেমা কেন সার্চ করছ?”
ইনারা জোরপূর্বক হাসে। নিজের বোকামিটা লোকানোর হাসি এটা। সে বলে, “হয়েছে কি সৌমিতা আন্টি বলেছিল মা বাবার সাথে তার তৃতীয় ছবিটা করেছিলেন।”
কথাটা শুনে আজব ভঙ্গিতে তাকায় সভ্য ইনারার দিকে, “আসলে চেকআপ করানো উচিত তোমার মাথায় কি আছে।”
কিন্তু সার্চ করার পর একটা নায়ক আসে। যা তার পরিচিত। সে কিছু বুঝতে পারে না। হঠাৎ তার মনে পড়ে তার মা’য়ের দ্বিতীয় ছবি কখনো প্রকাশ পায় নি কিছু সমস্যার কারণে তাই সে আবার দ্বিতীয় সিনেমা দিয়ে আগের প্রশ্নটা সার্চ দিলো। ছবি এলো। তার মা’য়ের সাথে একটা পুরুষের ছবি। পুরুষটা ভীষণ সুদর্শন। সে ছবিটার দিকে তাকিয়েই রইলো৷ তার চোখে বিস্ময় ও নম্রতা। হঠাৎ সভ্যও বিস্মিত সুরে বলে উঠে, “উনার চোখে সম্পূর্ণ তোমার মতো। নীলচে গভীর। সমুদ্রের মতো।”
ইনারার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে। তার চোখটাও ভিজে যায় নিজ অজান্তেই। সভ্য ইনারার হাত থেকে তার ফোনটা নেয়। ও শব্দ করে নাম বলে, “ইমতিয়াজ চৌধুরী।”
“হতে পারে আমার বাবা উনি। হতে পারে তাই না?” ইনারা সভ্যের দিকে তাকায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। কিন্তু সভ্য উওর দেয় না। সে কিছু ভাবে গম্ভীর মনে। আর বলে, “ইমতিয়াজ চৌধুরী… ইমতিয়াজ চৌধুরী… তার নাম আমি শুনেছি। কয়েক বছর পূর্বে কারও মুখ থেকে শুনেছি? কিন্তু কার মনে পড়ছে না।”
“উনি তো নায়ক ছিলেন। তাহলে স্বাভাবিক তার নাম শুনবেনই।”
“না, আমি কারও মুখ থেকে শুনেছি। তার ভাই হয়। কিন্তু কার মনে পড়ছে না। নেটেও এ ব্যাপারে কিছু লেখা নেই।” সে তাকায় ইনারার দিকে। ইনারার চোখে উওরটা জানার আগ্রহ দেখে চুপ হয়ে যায় সভ্য। তাকে ভরসা দিয়ে বলে, “আমি রহমানকে দিয়ে খোঁজ নেওয়াব তুমি চিন্তা করো না।”
ইনারার মন আরও খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু সে কিছু বলে না। কেবল মুখে জোর করে হাসি এঁকে রাখে।
.
.
রাত বারোটায় ইনারার জন্মদিন পালন করা হবে। কেক কাটা হবে। সকলে এখনো সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত। কেবল ইনারা ও সভ্য পোশাক পরিবর্তন করতে গিয়েছে। তারা দুইজনই কেবল পোশাক পরিবর্তন করবে। এ ইচ্ছাটা ছিলো ইনারার। সে সাদা গাউন পরবে ও সভ্য কালো কোর্ট। এভাবেই তারা ইনারার জন্মদিনের কেক কাটবে। আর কেক কাটার পরই অনুষ্ঠান শেষ হবে।
সভ্য নিজের রুমে এসে পোশাক পরিবর্তন এর সময় তার পাঞ্জাবিতে একটি কাগজ উপায়। কাগজটি সে রাখে নি। তাহলে কীভাবে এলো তার পকেটে। সে অবাক হয়ে খুলে কাগজটি। বিছানায় যেয়ে বসে এবং পড়তে শুরু করে,
“প্রিয় সভ্য,
শুনুন আমি এই চিঠিটিঠি লিখতে পারি না। প্রেমপত্র লেখার অভ্যেস আমার নেই। আপনি গায়ক মানুষ, সুন্দর করে শব্দ সাজিয়ে লেখাটা আপনার কাজ। আমার নয়। আমি এসব বুঝি না। তবুও আজ প্রথম চিঠি লিখতে বসলাম। আপনার মনে আছে আমাদের প্রথম দেখা? চারপাশে শব্দ ছিলো। হৈ-হুল্লোড় ছিলো। কী নাটকীয় দেখা ছিলো। আর দেখা হতেই আপনি আমার সবচেয়ে অপছন্দের ব্যক্তি হয়ে গেলেন। ভাগ্যক্রমে আপনার কাছেই এই নিয়তি আবার পাঠায় আমায়। যখন আপনার অধীনে কাজ করা শুরু করি আপনার জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে যাই আমি। বিরক্ত হই। আপনি আরও অপছন্দের মানুষ হন আমার। কিন্তু পরে জানতে পারি আপনার মতো সে কঠিন, শক্ত মানুষটার ভেতর একটি নম্র মন আছে। যা সবার চিন্তা করে। আমারও। সভ্য জানেন, আপনি সেদিন যখন নাচতে যেয়ে আমার কাছে এসেছিলেন আমার হৃদয়ের স্পন্দন আর নিয়ন্ত্রণ মানছিল না। কীভাবে, কেমন করে, কবে আপনাকে পছন্দ করে ফেলি বুঝতে পারি না। আর কীভাবে সে পছন্দ ভালোবাসার রূপ নেয় তাও জানি না। যেদিন শুনি আপনি আমাকে না বলে বিদেশে চল গিয়েছিলেন খুব অভিমান হয়েছিল আমার। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। কান্না করেছিলাম। আফসোস করেছিলাম যে একবারও আপনাকে জানাতে পারি নি যে, আমি আপনাকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি।”
নিচের অংশটুকু পড়ার পূর্বে সভ্য থেমে গেল। সে কী ঠিক পড়ছে। ইনারা তাকে ভালোবাসতো? তার বিদেশ যাবার পূর্ব হতে?
চলবে…