অনুভবে ২ পর্ব-৩৭+৩৮

0
822

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৩৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

পরেরদিন অফিসের অল্প কিছু ফাইল সাইন করে সভ্য রহমানের সাথে এলো ইনারার শ্যুটিং এর জায়গায়৷ সে ঢুকে জানতে পারে ইনারার সিন শ্যুট হচ্ছে। সে চুপচাপ যায় সে রুমে। যেয়ে দেখে ইনারা গোলাপি রঙের একটি সাধারণ গাউন পরে আছে। চারপাশে গোলাপি রঙের ফুল। পিছনে একটি দোলনা। সে কতগুলো ফুলের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। তলোয়ার নিয়ে ক্যামেরার সামনে শট দিচ্ছে। সভ্য তার দিকে তাকিয়ে রইলো মুগ্ধ দৃষ্টিতে। তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল এই পোশাকে, তোলায়ার চর্চায়, অভিনয়ে। মুখটায় যেমন মিষ্টি ভাব তেমনি কঠিন।

দৃশ্যট শ্যুট শেষ হওয়ায় সকলে হাত তালি দেয়। আজমল সাহেব বলে, “ভেরি গুড ইনারা। পার্ফেক্ট সট ছিলো।”
এর মধ্যেই সকলের নজর যায় সভ্যের উপর। মুহূর্তে হৈচৈ -এ মেতে উঠে জায়গাটা। আজমল সাহেব এসে হাত মেলায় সভ্যের সাথে, “কেমন আছো?”
দুইজনে একে অপরকে আগের থেকেই চেনে। বিভিন্ন পার্টিতে দেখা হতো তাদের। আজমল সাহেবের বেশিরভাগ ছবির জন্যও সভ্য গান গেয়েছিল।
“ভালো, আপনি?” সভ্য জিজ্ঞেস করে।
“ভালোই। এতবছর পর তোমাকে দেখে ভালো লাগল। আমি তো আগে জানতামই না ইনারা তোমার ওয়াইফ। ও কখনো বলে নি। কিন্তু সেদিন নিউজ দেখে তোমাদের জন্য খুশি হয়েছি। আজ হঠাৎ করে এখানে?”
“শুটিং দেখতে এসেছিলাম। আপনি অনুমতি দিলে থাকব।”
“আরে এখানে অনুমতির কী আছে? অবশ্যই আসো। আমার পাশে বসে দেখো।”
সভ্য ইনারার দিকে তাকাল। তাকে দেখে জোরপূর্বক হাসে ইনারা। সভ্য অবাক হলো। কারণটা বুঝল না। ইনারা কী তাকে দেখে খুশি না?

নতুন দৃশ্য স্যুট শুরু হবে। গ্রিন স্ক্রিনের সামনের দোলনায় ইনারা বসল। সে সভ্যের দিকে তাকিয়ে আজব মুখের ভাব করছে। সভ্য কিছুই বুঝতে পারছে না। পরিচালক আজমল তার পাশে বসতে বললেও সে পাশে বসে না। তারা নিজেদের মতো কাজ করুক। সে এককোণে চেয়ার নিয়ে বসে যেখান থেকেই ইনারার মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। রহমান তার পাশে দাঁড়ানো।

সিন শ্যুট কিছু মুহূর্ত পূর্বেই সেখানে উপস্থিত হলেন ওয়াসিন খান। তাকে দেখিয়ে মুখ বানায় সভ্য। রহমানকে জিজ্ঞেস করে, “উনি এখানে কি করছে?”
“স্যার উনি তো সিনেমার নায়ক উনি তো থাকবেই।”
সভ্য আরও বেশি করে মুখ বানায়।

ওয়াসিন যেয়ে বসে ইনারার পাশে। হেসে কিছু একটা বলে। সে কথা শুনে ইনারাও হাসে। সভ্য রহমানকে আবারও জিজ্ঞেস করে, “ওরা কী এমন কথা বলছে যে এমন খি খি করে হাসতে হচ্ছিল।”
“স্যার আমি তো আপনার পাশেই দাঁড়ানো। আমি কীভাবে জানবো।”
“কোনো কাজেরই না তুমি।” সে আবার তাকাল ইনারার দিক্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।
তাদের শুটিং শুরু হয়েছে। ওয়াসিন খান ইনারার হাত নিজের হাতে নিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “জ্যোৎস্না, তুমি চিন্তা করো না। আমি নিজের পিতাকে আমাদের সম্পর্কের জন্য রাজি করিয়েই ছাড়ব। আর সে তো রাজি হচ্ছে না। কিন্তু তোমার জন্য আমি আমার সব ছেড়ে দিতে পারব। নিজের সব।”

“এহ আসছে নিজের সব ছাড়তে। দেখতে যে গর্দভ লাগছেতে মনে হয় না বাবার সামনে মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হয়।” সভ্য রাগে কটমট করতে করতে বলে। রহমান তাঁর পাশ থেকে হেসে বলল, “যেমন আপনি দাদাজানের সামনে কিছু বলতে পারেন না।”
সভ্য সরু চোখে তাকায় তার দিকে। রহমান আমতা-আমতা করে বলে, “মানে আপনার মতো সাহসী কী সব প্রেমিকরা হয়? আপনি যা বলেন, যা করেন তা তো একেবারে ঠিক হয়। এসব গর্দভরা তা কী বুঝবে?”
সভ্য ভাব নিয়ে নিজের চুলে হাত আঁচড়ায়। রহমান বলে, “স্যার আপনি তো জানেন এটা কেবল শুটিং তাই না?”
“হ্যাঁ জানবো না কেন?”

ওয়াসিন উঠে একটি ফুল নিয়ে ইনারার চুলে গুঁজে দেয় তার কপালে থাকা চুল আলতো করে সরিয়ে নেয়৷ আর তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
“এই লোক আমার বউয়ের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?” বলে সে উঠে তাদের দিকে এগিয়ে যেতে নিলি রহমান তাকে ধরে নেয়। আর বলে, “স্যার উনারা কেবল অভিনয় করছে। এটা আসল কিছু না।”
সে বসায় সভ্যকে। তবুও সভ্য রাগে ফোঁপাচ্ছিল। ইনারাকে ওয়াসিনের কাঁধে মাথা রাখতে দেখে যেন তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে ধরে রাখা রহমানের হাত মোচড়াতে থাকে। রহমান বলে, “স্যার এটা আমার হাত ওয়াসিন খানের গলা না যে এভাবে মোড়াচ্ছেন।”

তখনই সিন কাট হয় এবং সভ্য রহানের হাত ছেড়ে উঠে যায় ইনারার কাছে। রহমান নিজের হাত দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
সভ্য ইনারার কাছে যেয়ে সাথে সাথে তাকে দোলনা থেকে উঠায়। ইনারা হতবাক। হঠাৎ করে সভ্যের এমনটা করায়। সে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে আপনার?”
সভ্য সরু চোখে তাকায়। তার তাকানো দেখে ইনারার গলার পানি শুকিয়ে গেছে। সাথে সাথে সে জোরপূর্বক হেসে চোখ সরিয়ে নেয়। তখনই ওয়াসিন খান উঠে সভ্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “ওহ মাই গড সভ্য! আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান ছিলাম। আপনার জন্য কতগুলো কনসার্টেও গিয়েছি। কিন্তু আমার ফিল্মে আসতে আসতে আপনি ব্যান্ড ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তাই কখনো সামনা-সামনি দেখা হয়নি। নাইস টু মিট ইউ।”
সভ্য হাত মেলায় ওয়াসিনের সাথে। তার হাত এত জোরে ধরে যে ব্যাথায় সে শব্দ করে উঠে। ইনারা তার হাতটা ছাড়ায়। ওয়াসিন খান হেসে বলে, “আপনার হাতটা একটু বেশিই শক্ত মনে হচ্ছে।”
ইনারা তাকে আগের জায়গায় নিয়ে গেল। রহমানকে বলল, “রহমান ভাই উনাকে বাহিরে নিয়ে যান। আমার আধাঘন্টায় শুটিং শেষ হয়ে যাবে। আজকে আর আমার সিডিউল নেই। আমি কাজ শেষ করে আসছি। ভুলেও উনাকে এখানে ঢুকতে দিবেন না।”
“যো হুকুম ম্যাম।”
“যো হুকুম মানে? আমি কোথাও যাব না।”
“দাদাজানকে কল দিব?”
দাদাজানের নাম শুনে দেবে যায় সভ্য, “কিছুক্ষণ পরপর তুমি দাদাজানের হুমকি আমাকে দিতে পারো না।”
“অবশ্যই আমি পারি। এই মুহূর্তে আপনি বের না হলে আমি দাদাজানকে কল দিব।”
সভ্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে। তার দিকে ঝুঁকে বলে, “এখন দাদাজানের হুমকি দিচ্ছ না? বাসায় আসো বোঝাব।”
“রহমান ভাই উনাকে নিয়ে যান তো, নাহলে নিশ্চিত উনি ওয়াসিনের হাত ভেঙে দিবে আজ।” ইনারা বলে।
রহমান টেনেটুনে সভ্যকে নিয়ে যায়।

শুটিং শেষে ইনারা বের হয়। সে বেত দেখে এখনও সভ্য গাড়িতে বসে আছে। বাহিরের বড় প্রবেশদ্বারটা বন্ধ। প্রেবশদ্বারের ওপারে ভিড়। মিডিয়াও এসেছে। ইনারা সবটাকে এড়িয়ে যেয়ে বসল গাড়িতে। বসেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আর সভ্যের বকার ভয়ে বলল, “দেখেন প্লিজ রাগ করবেন না। আজ আমাদের প্রথম ও শেষ রোমেন্টিক সিন ছিলো। আর এত আহামরি কিছুও ছিলো না। আপনি যা দেখেছেন ওতটুকুই। এটা তার অতীতের স্মৃতি হিসেবে রাণী মনে করে। এই সিন না দিলে সম্পূর্ণ গল্পের মাধুর্যই শেষ হয়ে যাবে। কেন সে খারাপ পথে গেল তা না দেখালে গল্পটাই যে বৃথা। আপনি আমার কথা শুনছেন? সভ্য আপনি কি শুনছেন?”
সব ধ্যান তখনও তার মোবাইলে ছিলো। সে ইনারার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলো, “আমি জোহান ও আইজার কাজ ইন্ডাস্ট্রিতে আটকে দিয়েছিলাম। দেখো আইজা এরপর কি করেছে! তার বাবার বয়সী এক প্রডিউসারের সাথে সম্পর্কে আছে। জলদি নাকি বিয়েও করবে। যার দুইটা ডিভোর্স হয়েছে এবং একটা সতেরো বছরের মেয়ে আছে। অথচ সাইদ মেয়েটাকে কত ভালোবাসতো! মানুষ লোভে এত নিচে নামতে পারে জানতাম না।”
ইনারা মোবাইলটা হাতে নিলো। সে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো সংবাদটার দিকে। আইজার এতকিছু করার পর এই খবরে তার অবাক হবার কথা না। কিন্তু সে হচ্ছে। সে যত ভাবে আইজা তার নিজের ক্ষতির সীমা পাড় করে দিয়েছে, ততই আইজা আবারও নিজের ক্ষতি করে ইনারাকে অবাক করতে পিছ’পা হয় না।

ইনারা নিজেকে সামলে নেয়। ফোনটা পাশে রেখে এমন ভাব করে যেন কিছুই হয় নি। সভ্যকে তার জন্য আর চিন্তিত করতে চায় না । তাই সে হেসে বলে, “এখন আর আমার এসব কিছু আসে যায় না। এই টপিক বাদ দিয়ে অন্য টপিক এ যাই।”
“অন্য টপিকে যেতে চাও?” সভ্য ইনারার দিকে তাকিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসে। তার দিকে ঝুঁকে জানালায় হাত রাখে। জানালা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে বলো তো ওয়াসিন খানের কাঁধে মাথা রাখার কী দরকার ছিলো?”
সভ্যকে এত কাছে দেখে ইনারা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সে চোখ নামিয়ে নেয়, “ক্রিপ্টে লেখা ছিলো।”
“স্ক্রিপ্টে যদি তাকে ভালোবাসি বলা থাকে তাও বলবে?”
ইনারা অবাক হয়ে সভ্যের দিকে তাকায়। তারপর জোরপূর্বক হাসে। আমতা-আমতা করে, “আপনার আসার পর ওই সিনটাই শুট হয়েছে।”
“ওহ গ্রেট। আর কিছু বাকি আছে?”
রহমান সামনে থেকে কাশে। মনে করায় গাড়িতে তারাও আছে। সভ্য সরে যায়।
ইনারা আরও লজ্জিত হয়। লজ্জায় লাল হয়ে যায় সে। লজ্জায় নিজের মুখ ব্যাগ দিয়ে ঢাকে।

গাড়ি চালু হয়। সভ্য কঠিন মুখে সামনেই তাকিয়ে ছিলো। কিছুক্ষণ পর ইনারা তার কাঁধে মাথা রেখে তার হাতটা ধরে। সভ্য তার দিকে তাকায় না। ভাব দেখায় একটুখানি। কিন্তু অন্যদিকে তাকিয়ে নিজেও হাসে।
.
.
বাড়িতে এসে দেখে বাহিরে কতগুলো বডিগার্ড দাঁড়ানো। দুই-তিনটা গাড়িসহ। ইনারা দৃশ্যটা দেখে অবাক হয়। আগে বাড়িতে কাউকে আসতে দেখেনি। সে সভ্যকে জিজ্ঞেস করে, “কে এসেছে জানেন?”
“আমার জানা মতে কারো আসার কথা তো ছিলো না। চলো ভিতরে যেয়ে দেখি।”
দুজনে গাড়ি থেকে নামার পর সভ্য দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে, “কে এসেছে?”
“স্যার আপনার বড় ভাই। অভ্র সাহেব।”
অভ্রের কথা শুনে সভ্য যতটা অবাক হয় ইনারা ততই খুশি হয়। সে অভ্রকে আগে কখনো দেখেনি। আজ প্রথম দেখবে।
সভ্য বিস্মিত সুরে বলে, “অভ্র ভাইয়া? উনার তো এখানে আসার কথা না।”

দু’জনে যেয়ে ভেতরে যেয়ে দেখে একটি লোক ড্রইং রুমে বসা। তাদের দিকে পিঠ করে। তার পাশে দাঁড়ানো আরেকটি লোক ইনারা ও সভ্যকে দেখে প্রথম লোকটার কানে কিছু একটা বলল। আর সে উঠে দাঁড়াল। পিছনে ফিরে তাকাল। তাকে দেখেই ইনারার চোখ কপালে উঠে যায়৷ সে লোকটাকে আগে কোথাও দেখেছে। অনেকবারই দেখেছে। মনে পড়ায় সে চোখ দুটো বড় বড় করে সভ্য কে জিজ্ঞেস করল, “উনি কী নেতা অভ্র আহমেদ?”
সভ্য বলে, “হ্যাঁ।”
“আমি উনাকে আগে দেখেছি। উনি যখন প্রথম ইলেকশনে স্পিচ দেয় আমাদের কলেজের সবার ক্রাশ হয়ে গিয়েছিল। সাথে আমারও। উফফ কি হট মামা।” ইনারা খুশিতে সভ্যের বাহুতে মেরে বলে দেয়।
সভ্য কথাটা শুনে তাকায় ইনারার দিকে। চোখ দুটো বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে জিজ্ঞেস করে, “আমার থেকেও বেশি?”
“আবার জিগায়। অনেক বেশি।”
কথাটা বলেই ইনারা নিজের দাঁত দিয়েই জিহ্বা কাটে। সভ্যের দিকে তাকিয়ে দেখে নিজেই ভয় পেয়ে বলে, “না মানে আপনার থেকে একটু কম।”
এরপরও সভ্যের কঠিন মুখ স্বাভাবিক হয় না। ইনারা আবার বলে, “আচ্ছা যান অনেক কম খুশি?”

অভ্র তাদের আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে, “কী ব্যাপার আমাকে কি এখানে দেখে পছন্দ হয় নি?”
তার কথায় দুইজন এগিয়ে যায়। সভ্য বলে, “এমন কিছু না ভাইয়া। তুমি আসবে জানতাম না তাই একটু অবাক হয়েছি।”
“স্যারপ্রাইজ তো না বলেই দেয়।”
সভ্য অভ্রের সাথে জড়িয়ে ধরে ছাড়ার পর ইনারা দেখিয়ে বলে, “ভাইয়া ওই ইনারা।”
“ওকে চিনব না তা কি হয়? আজকাল নিউজে এবং মা’য়ের কথায় আমাদের থেকে বেশি ও থাকে। কেমন আছো ইনারা।”
“অনেক ভালো। আপনি? আপনার সাথে দেখা করার অনেক ইচ্ছা ছিলো। অভ্র নাম পরিচিত হলেও আপনার সম্পূর্ণ নাম শুনে কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। আপনাদের ফ্যামিলির সবার নাম ইসমাত আপনার না কেন? আর আপনি…..” সভ্য তাকে থামিয়ে বলে, “এই প্রশ্ন এক্সপ্রেস থামো। ভাইয়া আসছে একটু আগে হালচাল জিজ্ঞেস করে তো প্রশ্ন করবে। না ডিরেক্ট প্রশ্ন শুরু করেছ।”
ইনারা জোরপূর্বক হাসে, “ও হ্যাঁ, সরি ভাইয়া। আপনাকে দেখে একটু এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম।”
“অসুবিধা নেই। আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।”
“আমার সাথে?”
“হ্যাঁ, বসে কথা বলি?”
তিনজনে সোফায় বসে। অভ্র ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলার মানুষ নয়। তাই সরাসরি বলে, “আমি দেশের বাহিরে যাচ্ছি কিছুদিনের মধ্যে। তোমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে সম্ভবত থাকতে পারবো না। তাই ভাবলাম যাওয়ার পূর্বে তোমার জন্য একটা উপহার দিয়ে যাই। সে উপহারের জন্য তোমার অনুমতি লাগতো।”
“অনুমতি?” ইনারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“তোমার খেলার বাজিমাতটা আমি দিতে চাই। অনুমতি।”
“সরি ভাইয়া আমি আপনার কথাটা বুঝতে পারছি না।”
অভ্র বাঁকা হেসে সোফায় হেলান দিয়ে পা’য়ের উপর পা রাখে। বলে, “তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু হলো মোশতাক। তাকে তুমি সোজা রাস্তায় শাস্তি দিতে চেয়েছিলে? লাভ হয়েছে? হয় নি। সে ঠিকই বের হয়ে এসেছে। তাই এই ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দেও। তাকে আজীবন জেলের খাটনি কীভাবে খাটাতে হয় তা আমি ভালো করে জানি।”
মাঝখানে সভ্য বাঁধা দেয়, “ভাইয়া তুমি অন্যায়ভাবে কাজটা করতে চাইলে আমি এর অনুমতি কখনো দিব না। তুমি কতজনকে ভুল কেস-এ ফাঁসিয়েছ তার হিসাব আমার কাছে আছে। আমি জানি তুমি এখানে ইনারারর সাহায্য করতে আসো নি এমন ট্রিকস-এ তোমার মজা লাগে তাই এসেছ অথবা তোমার নিজের কোনো স্বার্থ আছে। স্বার্থ ছাড়া তুমি কিছু করো না।কিন্তু আমি অন্যায়ভাবে কিছু করতে চাই না।”
অভ্র হাসে। তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটি চাবির রিং বের করে আঙুলে ঘুরায় ও বলে, “ন্যায় অন্যায় ভালোমানুষদের জন্য করা হয়েছে। মুশতাকের মতো মানুষদের মতো না। যে নিজে সারাজীবন অন্যায় করে এসেছে তার জন্য আবার কীসের ন্যায় অন্যায়? আর আমি তোর অনুমতি নিতে আসি নি,” অভ্র তাকায় ইনারার দিকে, “তোমার অনুমতি নিতে এসেছি। কারণ এটা তোমার মেটার। তুমি কী চাও? এমন একটা মানুষের সাথে ন্যায়বিচার করতে চাও যে তোমার সাথে কেবল অন্যায় করেছে। মনে রেখো, তোমরা দুইবছরেও তার শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারবে বলে সন্দেহ। কারণ তার হাতের মুঠোয় অনেক পরিচিত লোক আছে। কিন্তু আমি সে শাস্তি তাকে দুইদিন দেবার ব্যবস্থা করতে পারব।”

এবার ইনারা দ্বিধায় পড়ে গেল। সে সভ্যের দিকে তাকাল। আবার ভাবল অভ্রর কথাগুলো। সে ভুল কিছু তো বলছে না। মুশতাকের মতো মানুষ জানোয়ার থেকে অধম। তার জন্য আর কীসের ন্যায় অন্যায়? কিন্তু অভ্রকে হ্যাঁ বললে যদি সভ্য নারাজ হয়? কী করবে সে?

চলবে…

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৩৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

এবার ইনারা দ্বিধায় পড়ে গেল। সে সভ্যের দিকে তাকাল। আবার ভাবল অভ্রর কথাগুলো। সে ভুল কিছু তো বলছে না। মুশতাকের মতো মানুষ জানোয়ার থেকে অধম। তার জন্য আর কীসের ন্যায় অন্যায়? কিন্তু অভ্রকে হ্যাঁ বললে যদি সভ্য নারাজ হয়? কী করবে সে?

ইনারা চোখ বন্ধ করল। কিছু মুহূর্তের জন্য ভাবলো, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্দ্বিধায় বলল, “আমি রাজি।”
সভ্য অবাক হয়, “ইনারা তুমি কীভাবে… ” সেখানেই তাকে থামায় ইনারা, “আমি ভেবেই বলছি সভ্য। এসব আমার আর ভালো লাগে না। আমি আমার অতীত পিছনে ফেলে আপনার সাথে ভবিষ্যতে ধ্যান দিতে চাই। আমার অতীত নিয়ে পড়ে থাকতে চাই না। এছাড়া অভ্র ভাইয়া ভুল কী বলল? উনি সারাজীবন অসাধু কাজই করেছে। উনার কর্মের ফল তো উনাকে পেতেই হবে। সোজা আঙুলে না হলে আঙুল ব্যাঁকা করতেই হয়। আমার মা’কে মেরেছে উনি অথচ কত সুন্দর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সম্ভবত আমার বাবাকেও তিনি মেরেছিল। আমি জানি না। কেউ জানে না। কোনো প্রমাণ নেই। উনার কর্ম তো ভালো ছিলো না তাহলে আমি কেন ঠিক ভুল ভেবে উনাকে ছেড়ে দিব। আমি কেবল এতটুকু জানি সত্য হোক, কিংবা সাজানো মিথ্যা উনার কর্মের ফল উনাকে পেতে হবে।”

সভ্য ইনারাকে এই বিষয়ে কিছু বলতে পারছে না৷ কিছুক্ষণ ভাবল প্রথমে তারপর বলল, “উনি তোমার সাথে অন্যায় করেছে তাই এই ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। তুমি হয়তো নিজের দিক থেকে ভুল না। আচ্ছা তোমরা বসো আমি ভাইয়ার জন্য চা বানিয়ে আনছি।”
ইনারা গম্ভীর পরিবেশটা সাধারণ করতে বলল, “আয়হায় ভাইয়া আপনি চা খান? যাক কাউকে তো পেলাম। আপনার ভাই ব্লাককফি খায়। তাও লেবু দিয়ে। ছিঃ!” মুখ বানায় ইনারা। আবার বলে, “মাঝেমধ্যে ভাবি কোন এলিয়েনের দেশ থেকে উনাকে সহ্য করে না পেরে টুপ করে ফেলে গেছে কে জানে?”
সভ্য বিরক্ত হয়ে তাকায় ইনারার দিকে, “এলিয়েনমার্কা কথা কার তা বুঝাই যাচ্ছে। আমি চা আনছি।”
সভ্য সেখান থেকে যাবার পর অভ্র ইনারাকে বলে, “খুব বদলে গেছে।”
“কে ভাইয়া?”
“সভ্য। ওকে আগে এমন হাসতে, কথা বলতে দেখি নি অনেক বছর। দাদাজান ওকে রোবট বানিয়ে দিয়েছিল। তুমি ওকে আবারও নতুন করে গড়লে, ভালো লাগল।”
“দাদাজান? কিন্তু দাদাজান তো অনেক কিউট। উনার ব্যাপারে এমন বলছেন কেন?”
এখন প্রথমবার অভ্রর পাশের লোকটি তার টুপি ঠিক করে টেনে টেনে বলল, “আমার নাম ফজলু, মিথ্যা কই না এই রাইখেন ভরসা আইজ। দাদাজানে লোক ভালা মানি, কিন্তু ভাইসাবরে জ্বালাইসে বহুত এই কথাও জানি।”
অভ্র গম্ভীর গলায় বললেন, “ফজলু চুপ।”
“ভাইয়ের আদেশ মানতে হইব, ফজলুর হইল মাথা নত।”

অভ্র ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে, “ওর কথায় ধ্যান দিও না। আসলে দাদাজান তোমার কাছে অনেক নরম হতে পারে কিন্তু আমাদের সময় এমন ছিলো না।”
“হ্যাঁ, সভ্য আমাকে বলেছিল।”
“তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে না? আমি কেন আমার নাম ইসমাতের পরিবর্তে আহমেদ বলেছি সবাইকে? দাদাজানের কারণেই। উনার পছন্দ ছিলো না যে, আমি পলিটিক্স জয়েন করছি। আমার কখনোই তার কোম্পানিতে কোনো ইন্টারেস্ট ছিলো না। অনেক যুদ্ধের পর নিজের স্বপ্নের দিকে এগিয়েছিলাম কিন্তু দাদাজান বলল এর জন্য আমার নিজের পরিচয় লুকাতে হবে। নাহলে তাদের ক্ষতি হতে পারে। যত্তসব ফালতু চিন্তা উনার। উনি আর উনার এই নিয়ন্ত্রণ করার স্বভাবটাই আমার বিরক্তিকর লাগে।”
“দাদাজানের উপর রাগ রেখেন না ভাইয়া। এটা তো উনি নিজের আপনজনদের সুরক্ষার জন্যই করেছে।”
অভ্র ভ্রু কপালে তুলে। বাঁকা হেসে বলে, “ওই নায়িকার নাম কি যেন? আইজা, হ্যাঁ আইজা। সে তোমার সাথে অনেক খারাপ কিছু করেছিল তাই না? ওর উপর রাগ রেখো না, ও যা করেছে নিজের ক্যারিয়ারের জন্যই তো করেছিলো। তেমনি মিঃ হক নিজের ছেলের জন্য খারাপ পথ বেছে নিয়েছে। সবাই নিজের আর নিজের আপনজনদের জন্যই সব করে। তাহলে তাদের উপর রাগ রেখে নিজের এবং আমাদের সবার এভাবে সময় নষ্ট করছ কেন?”
অভ্রর কথা শুনে ইনারা চমকিত হয়। সে কি বলবে খুঁজে পায় না। এমন সময় সভ্য আসে। তার সাথে হাসনা আসে নাস্তা নিয়ে। সভ্য বলে, “চা চুলায় দিয়েছি। ততক্ষণ নাস্তা খাও ভাইয়া।”
সে ইনারার দিকে তাকায়। তাকে এভাবে চুপ দেখে অবাকই হয়, “তুমি চুপ করে আছো যে? কিছু হয়েছে?”
ফজলু বলে, “ফজলু মিয়া কয় না কথা মিছা, ভাবিরে এক মিনিটে চুপ করায় দিসে আমগো অভ্র ভাই-ই সেরা।”
সভ্য তার কথায় পাত্তা না দিয়ে অভ্রকে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে ভাইয়া?”
“বিশেষ কিছু না। শুন আমি উঠি। আমার পার্টি মিটিং আছে। যেতে হবে। চা আরেকদিন খাব।”
“আজ থেকে যাও।”
“না, আমার এত সময় নেই। যেতে হবে।” আবার ইনারার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার উপহারটা জলদি পেয়ে যাবে। চললাম।”
.
.
ইনারার গাড়ি এসে থামে তার বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে তার সে পুরনো ঘর দেখে আবেগী হয়ে যায় তার মন। গাড়ি করে এদিকে অনেকবার এসেছে সে। কিন্তু গাড়ি থেকে নামার সাহস করে নি। আজ গাড়ি থেকে নেমেছে। সাথে উকিল এনেছে। যেখানে লেখা এই বাড়িটি সাইয়ারার একমাত্র মেয়ের অর্থাৎ তার। আজ এই বাড়িটি সে নিজের কাছে ফিরিয়ে নিবে। সাথে কিছু পুলিশ আনার কথা ছিলো। মুশতাক সাহেব তো বললেই চলে যাবার মানুষ না। কিন্তু সে আনল না। কারণ আগের থেকেই এই বাড়িতে পুলিশ ও রিপোর্টার ভরা। সে এগিয়ে ভেতরে ঢুকলে মিডিয়া তাকে দেখে ঘিরে ফেলে। তাকে দেখে পুলিশের এক উচ্চ কর্মকর্তা বলেন, “আপনি এই মুহূর্তে এখানে কি করছেন?”
ইনারা উকিল থেকে একটি ফাইল নিয়ে পুলিশের হাতে দিলো, “এই বাড়িটা আমার মা’য়ের। কিন্তু আমাকে এখান থেকে বের করে এই বাড়িটা দখল করা হয়েছিল। আজ সকল কাগজপত্র নিয়ে কথা বলতে এসেছি। আপনারা এখানে কী করছেন?”
“মোশতাক আহমেদের অফিসে ড্রাগের ব্যাগ পাওয়া গেছে। ড্রাগ সেলের মধ্যে তার হাত আছে বলে জানা গেছে। তাকে ধরে নিয়ে তদন্ত করার জন্য এসেছি। এখন আরেকটি কেস যুক্ত হলো তার বিরুদ্ধে। ভেতরে চলুন। এই ব্যাপারে কথা হবে।”
ইনারা ভেতরে গেল। তার পিছনে গেল মিডিয়ারাও। কিন্তু দরজাতেই রিপোর্টারদের পুলিশরা আটকায়। কিন্তু তারা থামার পাত্র না, সে দরজাতেই ইনারার জন্য চিৎকার করতে থাকে। পুলিশদের যেন ঠেলে ফেলে দিবে।

পুলিশ এরেস্ট করছিল মোশতাক সাহেবকে। তিনি নিজের পক্ষ রেখে বলছিলেন, “আপনি এমন করতে পারেন না। আমি কোনো ড্রাগস ডিলিং এর সাথে জড়িত না। কেউ ষড়যন্ত্র করেছে আমার বিরুদ্ধে। বিশ্বাস করুন।”
পাশে তার বোনও কান্নাকাটি করে আবদার করছিলেন।

হঠাৎ ইনারার নাম শুনে চমকে উঠে মুশতাক সাহেব। সে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে আসলে সেখানে ইনারা দাঁড়ানো। মুশতাক সাহেবের সাথে কথা বলা পুলিশের কর্মী জিজ্ঞেস করল, “আপনি এখানে?”
এবার ইনারার উওর দেওয়া লাগলো না। তার পাশে থাকা পুলিশটি বলল, “ম্যামের কাছে কাগজপত্র আছে এই বাড়িটি উনার মা’য়ের ছিলো এবং এখন এই বাড়ি উনার নামে। মুশতাক সাহেব এই বাড়ি দখল করে বসে আছেন। উনার উপর আরেকটি কেস হয়।”
মুশতাক সাহেব এগিয়ে যেয়ে তার সামনে দাঁড়ায়, “এটা মিথ্যা কথা। এটা আমার মৃত স্ত্রীর বাড়ি।”
“যে আমার মা।” ইনারা কথাটি বলল। সে আরও যোগ করে, “ইন্সপেক্টর উনি আমাকে মারধর করে কিছু বছর পূর্বে এই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলো। তারপর কিছুমাস আগেই জানতে পারি বাড়িটি আমার নামে লেখা। আমার সাথে সব কাগজপত্র এবং উকিলও আছে। এছাড়া উনি কয়েকবছর পূর্বে কাউকে দিয়ে আমাকে ধর্ষণ করাতে চেয়েছিলেন। সে ব্যক্তি কনফেশ করেছিলো এটা এক ভিডিওতে। আমি তা পুলিশকে দেখিয়ে মামলাও করেছি। তবুও তিনি ছাড়া পেয়ে গেলেন।”
“তাই না’কি?” তিনি তাকালেন মুশতাক সাহেবের দিকে, “এখন আমি এই কেসটা নিজের হাতে নিচ্ছি। আর যে পুলিশ অফিসার তাকে ছেড়ে দিয়েছে তাকেও আমি নিজে শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করব।”
“এসব ভুল। এসব মিথ্যা। এই মেয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমার উপর মিথ্যা আরোপ লাগাচ্ছে।”
ইনারা হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে, “আর আমি এমনটা কেন করব?”
মুশতাক সাহেব এই প্রশ্নে দেবে যায়। সে চুপ করে যায়। পুলিশ তাকে এরেস্ট করে টেনে নিয়ে যাবার সময়ও সে অনেক অনুরোধ করে। অনেক সাফাই দেয় নিজের প্রতি। লাভ হয় না। তার যোগাযোগে থাকা সব লোকেরাও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ড্রাগসের কেসে কেউ নিজেকে ফাঁসাতে চায় না। মুশতাক সাহেব এখন এইখান থেকে না বাঁচতে পারলে সে নিশ্চয়ই ফেঁসে যাবে কয়েক বছরের জন্য।

অবশেষে যখন সে দেখল তার এত বলারও কোনো লাভ হচ্ছে না তখন সে রাগে মাতাল হয়ে ছুটে এলো ইনারার কাছে। তার হাত শক্ত করে ধরে বলল, “বল…বল তুই সবাইকে যে তুই আমাকে ফাঁসিয়েছিস। প্রতিশোধ নিচ্ছিস তুই আমার কাছে।”
“আজব আমি আপনার থেকে প্রতিশোধ নেবার জন্য এতকিছু করব কেন?”
“কারণ আমি তোর মা বাবাকে মেরেছি তাই।” আর ইনারার গলা চেপে ধরে তিনি। আবারও রাগে হুঁশ হারিয়ে বলে, “আর তোকে মারতেও আমার এক মুহূর্ত লাগবে না। সবাইকে বল যে তুই এসব করেছিস।”
ইনারা ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে। তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
পুলিশ এসে ছাড়ায় মুশতাককে। কিন্তু সে আবারও এসে ইনারাকে ধরতে নিলেই, ইনারা নিজেই তার হাত ধরে নেয়। হাতটা মুচড়ে প্রথম হাঁটু দিয়ে তার পেটে লাথি দেয়, তারপর পা’য়ে। সাথে সাথে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মুশতাক।
ইনারা কাঁপা গলায় বলে, “এখন আর না, আর না। আমি সেই দুর্বল মেয়ে না যাকে সবাই মিলে শরীর ও হৃদয়ে আঘাত করে বের করে দিয়েছিলেন। আরে তখনও তো এতটুকু মেয়ের সাথে লড়াই করার জন্য ছলনার প্রয়োজন হয়েছিলো আপনাদের। আর এখন আমি একজন সাহসী নারীর রূপে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে হারানো এত সহজ না। এমনকি অসম্ভব। আপনি আমাকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি করিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন তাই না। দেখুন আপনি নিজেই সারা পৃথিবীর সামনে নিজের গুনাহ কবুল করেছেন।”
ইনারা দরজায় দাঁড়ানো কতগুলো ক্যামেরার দিকে ইশারা করলেন। মুশতাক সাহেব চমকে উঠলেন। সে নিজের মুখে এ কী বললেন? সারাজীবন বুদ্ধি দিয়ে খেলে এসেছেন তিনি অথচ আজ বোকার মতো এত বড় এক কাজ করে ফেলে সে? এই অবাক কান্ডে সে যেন পাথর হয়ে গেলেন। নড়তেও ভুলে গেলেন।
পুলিশ তাকে ইনারার পা’য়ের কাছ থেকে ধরে নিয়ে গেল।

তাকে নিয়ে যেতেই তার বোন ছুটে যায় তার পিছনে। কান্নাকাটি করতে করতে। তার দৌড়ে আসে ইনারার কাছে, “তুমি আমাকে মাফ করে দেও। ছোট বেলা থেকে তোমাকে দেখে আসতেছি। কত আদর করছি তোমাকে। আমার সাথে কিছু কইরো না তুমি। দোহাই লাগে।”
“আদর? জীবনে আমার সাথে স্বার্থ ছাড়া ভালো ভাবে কথাও বলেন নি আপনি। যে নিজের স্বার্থের জন্য আপন মেয়ের জীবন শেষ করে দিতে পারে সে কারো আপন হতেই পারে না। ইন্সপেক্টর, উনাকেও সাথে নিয়ে যাবার আবদার করছি। উনার উপরও তদন্ত করুন।”
“উনার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই আমাদের কাছে।”
“উনি সবসময় মুশতাক আহমেদের সাথে ছিলেন। যেহেতু মুশতাক এখানে আমার মা বাবাকে মারার কথা কনফেশ করে তাহলে আমি নিশ্চিত এই মহিলাও তার সাথে ছিলো। আর আমি তাদের উপর মামলা করব।”
“ঠিকাছে উনাকেও আমরা এরেস্ট করছি।”
একজন মহিলা পুলিশ অফিসার আইজার মা’কেও নিয়ে গেলেন।

নিজের চোখের সামনে থেকে তাদের এভাবে যেতে দেখে প্রশান্তির নিশ্বাস ফেরে ইনারার। কিন্তু পুলিশ অফিসার বলে, “ম্যাম আপনাকেও এখান থেকে যেতে হবে। আমরা এই ঘরটায় খোঁজ করব।”
“এই বাড়ি যেহেতু আমার তাহলে আমি এখানে থাকতে পারব না?”
“আপনার কাগজপত্র আমরা যাচাই করে দেখব। আর ড্রাগের বিষয়টা অনেক বড়। আপনি বড় তারকা আপনার এখানে না থাকাটাই ভালো মনে হয় আমার কাছে।”
“আমি কি এই বাড়ি একবার ঘুরে দেখতে পারি?”
“আপাতত না, আমরা একটু তদন্ত করে কিছুদিনের মধ্যে বাড়িটা আবার আপনার হাতে তুলে দিব। আপনি এখন আমাদের নিজেদের কাজ করতে দিন। আর আপনারও পুলিশথানায় আসতে হবে মুশতাক সাহেবের মামলায় সাক্ষী দেবার জন্য। আর আপনি যা মামলা করতে চান তার জন্যও।”
“জ্বি আচ্ছা।”
ইনারা যাবার সময়। একবার ফিরে তাকাল পিছনে বাড়িটা দেখে মুচকি হাসলো। কিছুদিন পর আবার সে ফিরে আসবে এই বাড়িতে। সে মনে মনে বলল, “মা, আরেকটু অপেক্ষা করো।”

এই দৃশ্যটা ফোনে দেখছিল ফজলু মিয়া। সে ফোনটা অভ্রর দিকে ঘুরিয়ে বলে, “আমি ফজলু মিয়া, আর ভাই আপনে সেরা। কিন্তু এই মাইয়া গেল এক কদম এগিয়ে। আপনার অন্যায় খেলার মাঝে চলল নিজের ন্যায় চাল, এক চালে সবাই হইল বাজিমাত।”
অভ্র চেয়ারে হেলান দিয়ে শব্দ করে হেসে বলে, “এতে আমাদের কী? আমাদের কাজ হয়ে গেছে তাই প্রধান বিষয়। মুশতাক সাহেব আমাদের বিরোধী পার্টিতে ফান্ডিং দিতো। এখন আমার বিরোধী দল শক্তিশালী হবে তা কী আমার সহ্য হতে পারে?”
“এক তীরে দুই নিশানা মারা আপনার থেকে শেখা উচিত ভাই, একদিকে করলেন বিরোধী দলকে দুর্বল ড্রাগের মিথ্যা কেসে ফাঁসিয়ে আর অন্যদিকে ছোট ভাইয়ের বৌয়ের সাহায্য করে হয়ে গেলেন আপনার পরিবারের কাছে শ্রেয়। কী বুদ্ধি ভাই!”
অভ্র বাঁকা হেসে মাথা নাড়ায়। আবার তার কাজে ধ্যান দেয়।
.
.
বন্ধ দরজাটা খুলে ইনারা। তার পুরনো ঘরে প্রবেশ করে। তার ঘরটা ফিরে পেতে প্রায় একমাস লাগলো। নিজের ঘরে ফিরে এসে যেন পুরনো সে দিনগুলোতে হারিয়ে যেতে চাইলে ইনারার মন। সে ঘরের ভেতর ঢুকে গোল গোল ঘুরে সম্পন্ন ঘর দেখতে থাকল। মুহূর্তের জন্য যেন বাচ্চা হয়ে গেল সে। গাড়ি থেকে নেমেই দৌড় দিয়ে বাসায় এসে পরল বাড়ির ভেতর। তার সাথে যে সভ্য ছিল তাও ধ্যান দিলো না।

সভ্য দরজার ভেতর ঢুকে ইনারার এমন কান্ড দেখে সেখানেই থেমে যায়। দেখতে থাকে ইনারার বাচ্চামো। তার ভালো লাগে। যখনই ইনারার নজর পড়ে তার উপর তখনই সে দৌড়ে এসে সভ্যের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে আসে তার সাথে। তাকে সোফার কাছে নিয়ে উৎসুক গলায় বলে, “জানেন এই সোফায় বসে আমি আর ফুফা একসাথে টিভি দেখতাম। রাত রাত ভরে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতাম আর চিপ্স খেতাম। অনেক মজা হতো।”
তারপর ইনারা তাকে নিয়ে যায় তাদের বাড়ির পিছনের বাগানে, “এখানে আমি আর আইজা আপু সবসময় খেলাধুলা করতাম। আমার না পড়তে ভালো লাগতো না। আপু টিচার টিচার খেলে আমাকে পড়াতো। আমার সাথে কানামাছি, লুকোচুরিও খেলতো।”
সভ্যকে কিছু বলার সুযোগ দেয় না সে। তার ভেতর যেন আজ সম্পূর্ণ পৃথিবীর খুশি ভরে গেছে। তবুও গলায় কান্না কান্না ভাব। সে তাকে আবার ডাইনিংরুমে নিয়ে যেয়ে বলল, “এই টেবিলে বসে খালাজান সবসময়ই আমাকে খাইয়ে দিতো। আমার নিজের হাতে খাবার খেতে ভালোই লাগত না।”
এবার সে সভ্যকে নিয়ে যায় দোতলায়। তার রুমে নিয়ে বিছানায় বসে বলল, “এটা আমার রুম ছিলো। আমার সব পাগলামোর জায়গা। খালাজান আমাকে সবসময় বকা দিতো রুম অগুছালো রাখার জন্য। কতদিন পর এলাম এ রুমে। কিন্তু আমার রুমটা পরিবর্তন করে ফেলল। আমার আর কিছু নেই এখানে।”
হঠাৎ তার কিছু একটা মনে পড়ল। সে ছুটে গেলে আলমিরার কাছে। অস্থির হয়ে আলমিরার সব জিনিসপত্র বের করে কিছু খুঁজতে শুরু করে।
সভ্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী খুঁজছ?”
ইনারা বলেই না। সে সবকিছু বের করে কিছু একটা খুঁজতেই থাকে। অবশেষে একটা ছবি পেয়ে তার নিশ্বাস ফেরে। সে ছবিটা দেখায় সভ্যকে। তার মা’য়ের ছবি। ছবিটা হাত দিয়েই মুছে সে। কিন্তু সাথে সাথে একফোঁটা নোনাপানি পড়ে সে ছবির উপর। সে সাথে সাথে তা মুছে ফেলে। আর সভ্যকে দেখিয়ে বলে, “দেখেন আমার ও আমার মা’য়ের ছবি একসাথে। কত সুন্দর তাই না?”
সভ্য তাকায় ইনারার দিকে। তার ঠোঁটে এতবড় হাসি সে এই জন্মে দেখে নি অথচ চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়েই যাচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি আজ অনেক খুশি তাই না?”
“অনেক। এটা কেবল একটা ঘর না। আমার স্মৃতির বাক্স। এই ঘরে থাকলে আমি আমার মা’কে অনুভব করি। তার স্মৃতিকে অনুভব করি।”

সভ্য কিছু একটা ভেবে ফোনটা বের করল। ইনারাকে বলল, “আমি ফোনটা করে আসছি।”
“কাকে ফোন করছেন?”
“দাদাজানকে।”
“কেন?”
“আমাদের বিয়েটা এই বাড়িতে হবে তোমার স্মৃতির মাঝে। তোমার মা’য়ের স্মৃতির সাথে। যেন তুমি তোমার বিয়ের সময় তোমার মা’কে তোমার সাথে অনুভব করতে পারো। আমি আসছি।”
সভ্য বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ইনারার চোখ সরালো না সভ্য থেকে। তার বুকের ভেতর মিষ্টি ব্যাথা হলো। হঠাৎ যেন তার হৃদয়ে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। ভালোবাসার অনুভবে ভরে গেল তার মন। সে আবারও প্রেমে পড়লো? আবারও প্রেমে পড়ল সভ্যের?

সে মুহূর্তখানিক অপেক্ষা করল না। দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরল সভ্যকে। বলল, “একটুখানি। কোথাও যাবেন না। এভাবেই থাকুন।”
“হঠাৎ কী হলো তোমার?”
“এই মুহূর্তে কেবল আমি এই হৃদয়ের সুখ অনুভব করতে চাই। এইটা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তে। আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় স্থানে, প্রিয় মানুষের স্মৃতির সাথে ও প্রিয় মানুষের সাথে আছি। প্লিজ এই মুহূর্তে কোথাও যাবেন না। এই মুহূর্তটা আমি আমার অনুভবে বন্দী রাখতে চাই।”
সভ্য অবাক হলো কিন্তু কিছু বলল না। সে কেবল হাত রাখলো ইনারার পিঠে।
.
.
চারদিকে হৈ-হুল্লোড়। বাবাগানে একটি ছোট হলুদের স্টেজ সাজানো হচ্ছিল ফুল দিয়ে। সে স্টেজে ফুল লাগাচ্ছে সামি এবং বকা দিচ্ছে তার পাশে দাঁড়ানো ঐশিকে, “একটা কাজ দিছি তাও ঠিক মত করতে পারিস না। অকাইম্মা সবগুলো। আবার নিজেই লাফিয়ে লাফিয়ে বলছিল যে ‘সভ্য তুই লোক ডাকবি না, আমাদের বন্ধুর হলুদের আয়োজন কেবল আমরা করব। বাহিরের লোক করবে কেন? অকাইম্মার ঢেকি।”
“দেখ সামি আমি চেষ্টা করেছি। খবরদার বকবি না।”
“একশোবার বকব, তুই কি করবি শুনি?”
“আমি… আমি সভ্যকে বিচার দিব।”
“এহ যেন আমি কত ভয় পাই সভ্যকে। বিচার দে, কে মানা করছে? ওই নিজেই তো ইনারার ভয়ে কাঁপে আমাকে আর কী করবে?”
“তাই? তাহলে আমি ইনারার ভয়ে কাঁপি?”
“তো আর কি….” বলতে বলতে থেমে যায় সামি। হঠাৎ তার কন্ঠটা চেনা চেনা লাগে। ভয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে তার সামনে দাঁড়ানো সভ্য। সাদা পাঞ্জাবির উপর বেগুনি রঙের জ্যাকেট পরে। তাকে দেখেই থতমত খেয়ে গেল সামি। সে আমতা-আমতা করে বলল, “দোস্ত দেখ আজ তোর এবং ইনারার হলুদের অনুষ্ঠান। তুই আজ আমাকে কিছু করতে পারবি না?”
ঐশি সভ্যের পাশে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে বলে, “এখন ভয় পাচ্ছিস কেন? খুব না বলেছিলি সভ্য তোর আর কী করতে পারবে?” সে আবার সভ্যকে বলে, “জানিস এতো কিছু না, সারাদিন ছেলেটা এটাই বলতে থাকে তুই ইনারাকে অনেক ভয় পাস। চিন্তা কর দ্যা গ্রেট সভ্য কাওকে ভয় পায় এমন হতে পারে।”
“ওই পেত্নী তুই চুপ কর। আগুনে ঘি ঢালার কাজ করবি না খবরদার।” সামি চেঁচিয়ে বলল। তারপর সে তাকাল সভ্যের দিকে, “ভাই বিশ্বাস কর আমি কিছু বলিনি।”
সভ্যের মুখ দেখে মনে হলো না সে বিশ্বাস করেছে। সে সামির দিকে আসতেই, সামি দিলো এক দৌড়। পিছনে গেল সভ্যও।

খালাজান ফুলের থালা নিয়ে আসছিলেন তাদের দৌড়াদৌড়িতে থালা পরে গেল।
ঘরের ভেতর হলুদ বাটছিলেন দাদীজান। সেখানে বসেছিলো সভ্যের মা ও ফুপিও। সামি বাঁচতে তাদের পিছনেও যেয়ে লুকায়। লাভ হয় না। অবশেষে উপায় না পেয়ে সে পাটা থেকে হলুদ নিয়ে সভ্যের গালে লাগিয়ে ভাগে সেখান থেকে। মা উঁচু স্বরে বলে, “এই বিয়েবাড়িতে এত কাজের মাঝে কী শুরু করলি তোরা?”
“আন্টি এখন জানের ভয় নিয়ে পালাচ্ছি। বাঁচলে আবার দেখা হবে।” সামি বলল।
সভ্যও উঁচু স্বরে বলল, “এখন তো ওর খুন করেই ছাড়ব আমি।”

তারা দৌড়ে উঠলো দোতলায়। রুমের ভেতরে তৈরি হচ্ছিল ইনারা ও সুরভী। এমন চিৎকার চেঁচামেচি শুনে তারা বের হয়। দুইজনকে এভাবে দৌড়াতে দেখে অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকায়। ইনারা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, “এভাবে ছুটাছুটি কেন করছ তোমরা।”
সামি উওর দেয় না। সে বাঁচার জন্য ইনারার হাত ধরে তাকে সভ্যের দিকে ঠেলে দেয়। সে পড়ে সভ্যের বুকেতে।

সভ্যও তাকে ধরে নেয়। তারপর চেঁচিয়ে বলে, “পাগল তুই?”
সামি আর থামে না। কেবল পিছনে ফিরে চোখ টিপ মেরে বলে, “পরে ধন্যবাদ জানিয়ে দিস।”
সভ্য বিরক্ত হয়ে তাকায় ইনারার দিকে। মুহূর্তে তার সকল রাগ, বিরক্তি হাওয়ায় মিশে যায়। ইনারা আজ বেগুনি লেহেঙ্গার সাথে ফুল দিয়ে সেজেছে। এখনো বোধহয় তার সাজগোজ শুরু হয় নি। তবুও সভ্যের হৃদয়ের স্পন্দন থেমে গেল কিছু মুহূর্তের জন্য।

ইনারা এখনো সভ্যের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে। হয়তো কি হলো সে বুঝতেই পারছে না। সভ্য মৃদু হেসে বলল, “আমার নামের হলুদ আমিই তোমাকে সর্বপ্রথম লাগাচ্ছি।” বলে সে নিজের হলুদমাখা গাল ছোঁয়াল ইনারার গালে।

চলবে…

[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে