অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৩১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
নড়াচড়ায় ঘুম ভেঙে গেল ইনারার। ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখে সভ্যর বাহুডোরে সে। তাকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে সভ্য। সবে লিফট থেকে নামল তারা। তাদের পিছনে একজন বডিগার্ড উপস্থিত ছিলো। ইনারা আধো খোলা চোখে তাকিয়ে ছিলো সভ্যর দিকে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে। হঠাৎ সভ্য তার দিকে তাকায়। সাথে সাথে সে চোখ বন্ধ করে নেয়। ঘুমানোর ভান করে।
সভ্য ইনারার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সে সবে চোখ বন্ধ করেছে। সে বিরক্ত হয়। মেয়েটার সম্ভবত তাকে জ্বালাতে একটু বেশিই ভালো লাগে। একজন গাড়ির দরজা খুলে দেয় তাদের জন্য। গাড়িতে বসে দেখে ইনারা এখনো নড়ছে না। উলটো নড়েচড়ে তার গলা জড়িয়ে ধরল। সে বিরক্তির ভাব নিয়ে বলল, “নাটক শেষ হলে এবার আমাকে ছাড়ো। গাড়িতে এসে বসেছি।”
ইনারা নড়ে না।
সভ্য আবার বলে, “তুমি ঘুমাচ্ছ না আমি জানি। এবার সরো, নাহলে যখন গাড়ি স্টার্ট হবে তখন ব্যাথা পেলে আমার দোষ নেই।”
ইনারা নাছোড়বান্দা। সে নড়ে না। সেভাবেই বসে থাকে সভ্যকে ধরে। কিন্তু সভ্য তাকে ধরে না।
গাড়ি চালু হয়। ইনারাও সভ্যর গলা ছেড়ে দেয়। সে পড়ে মাথা জানালায় লাগতে নিলেই সভ্য তাকে ধরে নেয়। তার মাথায় হাত রেখে নিজের বুকের মাঝে শক্ত করে ধরে। আতঙ্কিত কন্ঠে বলে, “পাগল হয়ে গেছ তুমি? এখনই তো মাথায় ব্যাথা পেতে।”
ইনারা কিছু বলে না। সভ্যের বুকে মুখ লুকিয়ে মৃদু হাসে। বিজয়ের হাসি। আর চোখ বন্ধ করে শুনতে থাকে সভ্যের হৃদয়ের স্পন্দনের সুর।
সারারাস্তা ইনারাকে এভাবে আগলে নিয়ে আসে সভ্য। কোলে করে বাসায় এনে তার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে নিলেই ইনারা তার গলা জড়িয়ে রেখে চোখ খুলে, “কি মিস্টার এত রেগে থাকা সত্ত্বেও আমাকে এত যত্নে আনলেন যে?”
সভ্য রাগ করে খুব, “আমি জানতাম তুমি জেগে ছিলে৷ এখন এসব নাটক করে কী প্রমাণ করতে চাও তুমি?”
“যে আপনি হাজার রেগে থাকলেও আমার কথা প্রতিমুহূর্ত ভাবেন।”
সভ্য তার হাত ছাড়িয়ে বলে, “ইনাফ ইনারা। অনেক হয়েছে। তোমার এসব করার প্রয়োজন নেই৷ আমার এসব নাটক একটুও পছন্দ না।” কথা বলে সে চলে যেতে নিলেই ইনারা বলে উঠে, “একটা ব্যাপার নিয়ে এতরাগ করার মানে হয়। আমি তো মানছি ভুল করেছি আমি তাই বলে এত…”
সভ্য পিছনে ফিরে ইনারার দিকে তাকায়, “এই ভুলটা আমি করলে তুমি কী করতে? যদি আমি তোমার চরিত্রের উপর প্রশ্ন তুলতাম তখন কী করতে? আমি উওরটা দেই তুমি আমার চেহেরাটাও দেখতে না। কারণ তোমার চরিত্র, তোমার সম্মানের উপর প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু তুমি মনে করো তোমার এক সরিতে আমি তোমার সব আঘাত ভুলে যাব? কেন তুমি মেয়ে আর আমি ছেলে বলে? তুমি তো নিজের এক ছেলে বন্ধুর সম্মানের জন্য এত কিছু করেছিল। নিজের চোখে দেখেছিলে তার উপর মিথ্যা অপবাদের পরিণাম কি হয়েছিল। তুমি যেমন আমার ও ঐশিকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলে তেমন আমিও তোমার সাথে প্রিয়র সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারতাম। আমি এমন করলে তুমি কী করতে?”
ইনারা সভ্যের কোনো প্রশ্নের উওর দিতে পারে না। সভ্য যেতে নেয়। এর পূর্বে কেবল ইনারাকে বলে, “এখন তোমাকে বলা এবং না বলাটা একই। তবুও বলছি, ঐশি আমার বোনের মতো। আমি সবসময় ওকে নিজের ছোট বোন মনে করে এসেছি। আর সেদিন এতবছর পর ও আমাকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরে সে কথাগুলো বলেছিল। যেমন সুরভি তোমাকে এতবছর পর দেখে জড়িয়ে বলেছিল। কিন্তু আমি নিজের সীমা জানি৷ প্রথমবার হয়তো হঠাৎ দেখা ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছে যা আমার কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিলো কিন্তু তা দ্বিতীয়বারের জন্য আমি মানা করে দিতাম।”
সভ্য চলে যায়। শব্দ করে দরজা বন্ধ করে।
এত জোরে দরজা আটকানোর শব্দে কেঁপে উঠে ইনারা।
.
.
পরেরদিন সকালেই দেখা যায় ইনারার পোস্ট করা ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে। চারদিকে ভিডিওটা ছড়িয়ে যায়। ইনারার পুলিশের কাছে একটা মামলা করার দেরি ছিলো। তা করতেই মুশতাককে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। ইনারার দৃশ্যটা নিজের চোখে দেখার ভীষণ ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু তা হলো না।
একদিন পর,
অপ্রত্যাশিতভাবে শুটিং এ আসে ঐশি। ঐশি তাকে দেখেই দৌড়ে এসে তার হাত ধরে নেয়, “কতবছর পর দেখা হলো তোমার সাথে!” আর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
ইনারা প্রথমে দ্বিধাবোধ করছিলো। লজ্জা লাগছিলো তার। ক’দিন পূর্বে কত কি না বলেছিল সে সভ্য এবং তার সম্পর্ক নিয়ে। কিন্তু পরে সেও ঐশিকে জড়িয়ে ধরে। ঠোঁটের কোণে হাসি আঁকে, “আপনাকে দেখেও খুব ভালো লাগলো।”
ঐশি তাকে ছেড়ে জিজ্ঞেস করে, “সেদিন না’কি তুমি সভ্যের অফিসে এসেছিলে? আমার সাথে দেখা না করে চলে গেলে কেন?”
“একটু কাজ ছিলো আপু তাই। এসব বাদ দিন আপনার খবর বলুন।”
“আমার খবর তো ভালোই। সভ্য তোমাকে নিশ্চয়ই বলেছে আমার এবং ইরফানের বিয়ের কথা। তোমাদের কিন্তু আসতে হবে। সভ্য আসতে চাইবে না, ওকে আনার দায়িত্বটা কিন্তু তোমার।”
“কিন্তু আপু…”
“কোনো কিন্তু না। সভ্য আমার জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। ও আমার জন্য অনেক করেছে। যে সময় আমার ভাইকে হারিয়ে ফেলছিলাম তখন ও এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমার জন্য স্ট্যান্ড নিয়েছে। সবসময় আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলো ঢাল হয়ে। আমি চাই সামি এবং জোহান ভাইয়ের সাথে ও আমার বিয়েতে উপস্থিত থাকুক। প্লিজ।”
ঐশির কথা শুনে তার মুখের উপর মানা করতে পারে না ইনারা, “চেষ্টা করব আপু। সৌমিতা আন্টি কেমন আছেন?”
“একটু অসুস্থ। এখন বিদেশে গেছে চিকিৎসা করাতে। এনগেজমেন্টের আগে এসে পড়বে।”
“তাকে অনেক মনে পড়ে।”
ঐশি হাসে। ইনারার হাত ধরে রেখেই তাকে নিয়ে বসলো সোফাতে। বলল, ” সভ্যর উপর কিন্তু আমার অনেক রাগ আছে। একতো হঠাৎ গায়েব হয়ে গেল। এর উপর ও আমাকে কখনো তোমার কথা বললই না। কি সুন্দর মতো বিয়ে করে বসে আছে।” সে এক মুহূর্ত বিরতি নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “সরি ইনারা।”
“সরি!” অবাক হয় ইনারা, “সরি কেন?”
“আমি একসময় তোমার সাথে অনেক বাজে ব্যবহার করেছি। আসলে ইরফানকে আমি অনেক আগের থেকে ভালোবাসতাম। একদিন ওর লেখা ডাইরিতে তোমার নাম দেখি। সে মুহূর্তে ঈর্ষা আমাকে এমন কাবু করে যে মাথা ঠিক ছিলো না।”
“সরি বলবেন না আপু। ভালোবাসার মানুষের কাছে কাওকে দেখলে প্রায়ই এমন হয়। আমি বুঝি।”
“এরপর যখন জোহান ভাই তোমার বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যায় তখন আবার তোমাকে পছন্দ হলেও হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ায় রাগও হয়। ভেবেছিলাম তুমি জোহান ভাইকে কীভাবে ছেড়ে চলে যেতে পারো। তাও ঠিক এনগেজমেন্ট এর পূর্বে। একারণেই যখন তোমায় মুভিতে দেখলাম রাগেই দেখা করতে আসি নি। কিন্তু কয়েকমাস আগে জানলাম তুমি ভাইকে না, ভাই তোমাকে ছেড়ে আইজার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল। তাদের সম্পর্কটা প্রথমদিকে কেবল গুজব মানতাম আমি। কিন্তু আসলে সে সময়ে এমনটা হয়েছে জেনে তোমার জন্য খারাপ লাগছিলো। কিন্তু যখন শুনলাম সভ্যর সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে সব খারাপ লাগা উধাও হয়ে গেল। তুমি অনেক লাকি সভ্যকে জীবনসাথী হিসেবে পেয়ে। আমি তো অনেক অবাক হয়েছিলাম যখন সামি বলল সভ্য তোমাকে প্রথমে ভালোবেসেছে। কারণ আজ পর্যন্ত সভ্যকে কোনো মেয়েকে পাত্তাই দিতে দেখি নি।” বিরতি নিয়ে হাসে ঐশি। আবার বলে, “আর বিশ্বাস করো এর থেকে বেশি আমি খুশি তোমাকে সাফল্য দেখে। তুমি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছ। তোমার সাফল্য দিকে খে আমারই কেন যেন গর্ব অনুভব হচ্ছে।”
“কিন্তু আপনি গান ছেড়ে দিলেন কেন আপু?”
ইনারার প্রশ্নে ঐশির মুখটা মলিন হয়ে আসে, “আসলে বাবা ছেলেদের সাফল্যটা প্রধান মনে করেছে। মেয়েরা ঘরে থাকবে এটাই তার চিন্তা। আগে সভ্যই কোনো একভাবে বাবাকে বাধ্য করতো আমাকে ব্যান্ডে থাকার জন্য। ও যাবার পর সব শেষ হয়ে গেছে। জোহান ভাই চেষ্টা করেছিল, বাবার সাথে কথা বলেছিল কিন্তু বিশেষ লাভ হয় নি।” ঐশি হাসার চেষ্টা করে বলে, “কিন্তু জোহান ভাই কোনো একভাবে ইরফানের সাথে আমার বিয়ের জন্য বাবাকে রাজি করিয়েছে। যেহেতু আমি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয় সেহেতু বিশেষ সমস্যা হয় নি। ইরফান বলেছে বিয়ের আমি আবার গান শুরু করতে পারব। আমিও না এসে বকবকানি শুরু করে দিলাম। শুনো আগামীকাল আমার এনগেজমেন্ট আর পরের সাপ্তাহে বিয়ে। তোমাকে সব অনুষ্ঠানে আসতে হবে সভ্যকে নিয়ে। বুঝেছ?”
ইনারা হেসে মাথা নাড়ে।
.
.
ইনারা আজও সভ্যের অফিসে এসেছে। এই নিয়ে টানা তিনদিন সে কাজ করে অফিসে আসছে এবং সভ্য তাকে বসিয়ে রেখে আনিকার সাথে প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলছে। ইনারা জানে তাকে ইচ্ছা করে জ্বালানোর জন্য এত কিছু করা হচ্ছে। প্রতিদিন এত কীসের কাজ তাদের? আগে তো এমন ছিলো না। আজ ইনারা খুব জলদি শুটিং শেষ করে এসেছিল, সভ্যের সাথে ডিনার করবে বলে। কিন্তু সভ্য তাকে এড়িয়ে যেয়ে আনিকাকে ডেকে নেয় কাজ করার জন্য।
রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ইনারা। তার আসার দুইঘন্টা হয়ে গেছে। এখন খুব বিরক্ত লাগছে তার। ধৈর্য্যের সীমা পেরিয়ে যাবার পর সে উঠে সভ্যকে জিজ্ঞেসই করে নেয়, “আপনি কী আসবেন না’কি আমি একাই চলে যাব?”
সভ্য তার দিকে তাকায় না, “তোমাকে আমি আটকে রাখি নি। যেতে হলে যাও, নাহয় চুপচাপ বসে থাকো। আমার দেরি হবে, কাজ করছি।”
“আচ্ছা, ঠিকাছে।”
ইনারা যেয়ে বসল সোফাতে। সে বুঝতে পারে সভ্যকে এভাবে মানাতে গেলে মানুষটা উল্টো তাকে জ্বালাবে। বিগত তিন চারদিন ধরে এটাই হচ্ছে। তাই সে এবার ব্যাপারটা নিজের মতো করে সমাধান করার সিদ্ধান্ত নেয়।
সে তার ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কানে নেয়, “হ্যালো ওয়াসিন….”
ওয়াসিনের নাম শুনতেই সভ্য চকিতে তাকায় ইনারার দিকে। অবাক হয়ে।
ইনারা আসলে তাকে কল করেনি। তবুও নাটক করে। বলে, “তুমি না আজ ডিনারে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলে আমাকে? হ্যাঁ, আগে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এখন আমি একেবারে ফ্রী। কোথায় আসতে হবে বলে দেও। ওহ তুমি আসবে? সো সুইট। আচ্ছা আমি তোমাকে এড্রেস দিচ্ছি। আমি সেখানে তোমার অপেক্ষা করবো।”
রাগে সভ্য জোরে ফাইল অফফ করে দেয়। আনিকা ভয় পেয়ে গেল, “স্যার আপনি কী করছেন? ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
“সরি। তুমি এখন যেতে পারো।”
“স্যার কিন্তু কনসার্টের আয়োজনের ব্যাপারটা নিয়ে কথা তো সম্পূর্ণ হয় নি।”
“কাল বলবো। আজ যাও।”
“আচ্ছা স্যার।”
আনিকা যাবার সময় ইনারার কাছ থেকেও বিদায় নিয়ে গেল।
ইনারাও গুনগুন গান করে তার পিছনে উঠে যেতে নেয়।
সভ্য প্রায় দৌড়ে এসে তার হাত ধরে নেয়, “কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
ইনারা বহু কষ্টে নিজের হাসি আটকায়,
“ওই ওয়াসিন খান আছে না? সে ডিনারে ডেকেছিল।আমি ভেবেছিলাম আপনার সাথে যাবো কিন্তু আপনি দেখি ব্যস্ত তাই ভাবলাম তার সাথেই যাই।”
সভ্য বিচলিত হয়। কিন্তু তা প্রকাশ করে না। অপ্রভিত ভাব নিয়ে তার দুইহাত পকেটে ভরে এবং গলা পরিষ্কার করে বলে, “আমার কাজ শেষ। বাসায় চলো।”
“কিন্তু আমি তো তাকে বলে বলে দিয়েছি। এক কাজ করুন, আপনি বাসায় যান। আমি ওর সাথে দেখা করে আসি।”
সভ্য চোখ রাঙিয়ে তাকায় তার দিকে, “একবার দরজা বন্ধ করলে আর খুলব না আমি। আসলে আসো, নাহয় আজ বাসার বাহিরে থাকতে হবে।”
“আমি হোটেলে রুম বুক করে নিব। নো টেনশন।”
সভ্য এবার রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে, “চুপচাপ বাসায় চলো। কোনো ওয়াসিনের সাথে দেখা করছ না তুমি।”
বলে সে ইনারার হাত ধরে তাকে নিয়ে যায়।
ইনারা মিটিমিটি হাসে। সে তো এটাই চাইতো। তবুও সে বায়না ধরে, “এখন ওখানে না গেলে যে আমার পেটে ইঁদুররা কুস্তি খেলছে তার কী হবে? আপনার কিন্তু আমাকে রান্না করে খাওয়াতে হবে। আমি পাস্তা, পিজ্জা এবং চকোলেট ব্রাউনি খাব।”
“রেস্টুরেন্ট পেয়েছ না’কি যে আবদার করবে আর পূরণ হবে?”
“তাহলে আমি ওয়াসিনের কাছেই যাচ্ছি।”
“কেবল পাস্তা আর ব্রাউনি করতে পারব।”
ইনারা মিটিমিটি হাসে। সভ্য রেগে থাকা সত্ত্বেও গাড়ি পর্যন্ত তার হাত ধরেই রাখে। গাড়িতে উঠার পর ইনারা সভ্যের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে, “আপনাকে জেলাস হলে অনেক কিউট লাগে।”
সভ্য কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে। তার হাসি দেখে বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এরপর নিজেই লজ্জিত হয়। ইনারার সাথে ঝগড়া থাকা সত্ত্বেও সে কেন এমন ঈর্ষান্বিত ব্যবহার করতে গেল?
.
.
বাসায় এসে ইনারা প্রথমে লম্বা এক শাওয়ার নিলো। যেখানে সভ্য রান্না করতে জুড়ে গেল। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নিজের ফোন দেখেই মাথা গরম হয়ে গেল। মুশতাক সাহেবকে দুইদিনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। খবরটা দেখে মাথা গরম হয়ে যায় ইনারার। সে এতকিছু করল, প্রমাণ পর্যন্ত দিলো কিন্তু লাভ কী হলো? কীভাবে এত জলদি করে ছাড়তে পারে আইন এক অপরাধীকে? নিশ্চয়ই মুশতাক সাহেব খুব রেগে আছেন। ছাড় পেয়ে বড় এক ঝামেলা করবেন এই বিশ্বাস আছে ইনারার।
বিরক্তি নিয়ে ফোনটা বিছানার উপর রেখে বের হয় রুম থেকে ইনারা। রান্নাঘরে যায়। সভ্য তার জন্য রান্না করছিলো। তাকে দেখে নিজের মুখের সকল চিন্তার রেখা মুছে ফেলে ইনারা। ঠোঁটে হাসি আঁকে। খবরটা সভ্যকে দেওয়া যাবে না, নাহয় অকারণেই চিন্তা করবে।
সে দৌড়ে যেয়ে সভ্যকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, “রান্না করার সময় আপনাকে সেই লেভেলের হ্যান্ডসাম লাগে। জানেন?”
হঠাৎ এভাবে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরায় চমকে উঠে সভ্য। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে, “এখন হঠাৎ আমাকে তোমার কাছে কিউট, হ্যান্ডসাম লাগছে। আগে তো এতকিছু লাগতো না।”
“আগেও লাগতো কিন্তু তখন ভাব নিতাম। এখন আপনি ভাবে আছেন তাই আমার ভাবটা সাইডে রাখলাম।”
সভ্য কঠিন মুখ নিয়ে আবার রান্না করতে শুরু করে। ইনারা কাউন্টারে বসে প্রশ্ন করে, “আগামীকাল ঐশি আপুর এনগেজমেন্ট। যাবেন তো?”
“না।”
“আপনি যাবেন।”
“আমি না করেছি।”
“আমি তো প্রশ্ন করি নি। বলেছি। ঐশি আপু আজ শুটিং এ এসেছিল। আমাকে অনুরোধ করেছে যেন আপনাকে নিয়ে যাই। তাই আপনি যাবেন।”
সভ্য এবার রেগে ইনারার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। তার পাশের কাউন্টারে জোরে হাত মেরে তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে কঠিন গলায় বলে, “আমার জীবনে দখল দেওয়া বন্ধ করো। সেই অধিকার আর তোমার নেই।”
ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, ইনারা উল্টো দুই হাত সভ্যের গলায় আবদ্ধ করে তার কাছে যেয়ে বলে, “হায় এভাবে রাগলে কি কিউট লাগে আপনাকে। এজন্যই তো আমি বারবার আপনার উপর ফিদা হয়ে যাই।”
চলবে…
অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৩২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কানেরদুল পরছে ইনারা। সে প্রায় তৈরি। এখন গয়না পরছে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। আর উঁচু স্বরে বলছে, “সভ্য আপনি ভালোয় ভালোয় তৈরি হয়ে নিন। আমি কিন্তু রেডি হয়ে গেছি। আমার অপেক্ষা করতে হলে আপনার জন্য সমস্যা হবে কিন্তু।”
ইনারা তৈরি হচ্ছে ঐশির এনগেজমেন্ট পার্টিতে যাবার জন্য। সে একটি মেরুন রঙের শাড়ি পরেছে। সাথে স্টোনের গয়না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে তার। শুটিং এর কারণে বাসায় আসতেই দেরি হলো। ভাগ্যিস সেখান থেকে মেকাপ করে এসেছিলো নাহলে আজ যাওয়াই হতো না।সে দ্রুত ড্রাইভারকে গাড়ি বের করার জন্য কল করে বাহিরে গেল সভ্যকে দেখার জন্য। সভ্যর রুমে যেয়ে দেখে সে বসে বসে কাজ করছে। খুব বিরক্ত হলো ইনারা। আসার পর থেকেই সে সভ্যকে তৈরি হতে বলছে।
সে সভ্যের সামনে যেয়ে বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি এখনো তৈরি হন নি কেন?”
“আমি তো আগেই বলেছিলাম যাব না।”
সভ্য মুখ না তুলেই উওর দিলো।
ইনারার বিরক্তি আরও বাড়ে। সে সভ্যের সামনে যেয়ে তার ফাইল হাত থেকে কেড়ে নেয়। ধমকের সুরে বলে, “আমি বলেছি না আপনি যাবেন। এখনই রেডি হয়ে আসুন যান।”
সভ্য বিরক্ত হয়ে ইনারার দিকে তাকায়। পরক্ষণেই তাকে শাড়িতে দেখতেই তার চোখদুটো বড় হয়ে যায়। হৃদয়ের স্পন্দন যেন দ্রুত হয়ে যায়। ইনারা তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঝুঁকে মুখোমুখি হয় সভ্যের। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমাকে দেখে হার্টের বিট বেড়ে গেল না’কি জনাব?”
সভ্য সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়। সেখান থেকে উঠে যায় এবং বলে, “আমার সেখানে যাওয়া সম্ভব না। আমার মানা আছে।”
“দেখেন কিন্তু সেখানে কিন্তু অনেক পুরুষ থাকবে। এখন আপনার এত সুন্দরী বউকে সেখানে একা পাঠালে চিন্তা হবে না আপনার?”
“হবে তো। সে পুরুষদের চিন্তা তো হবেই। তুমি না কখন তোমার আসল জংলী রূপ দেখিয়ে বসো।”
ইনারা এবার আসলে রেগে যায়, “ফাজলামো বন্ধ করে রেডি হয়ে আসুন, নাহলে আপনার জন্য ভালো হবে না। আমি দাদাজানকে কল দিব কিন্তু।”
সভ্য ইনারার দিকে তাকায়। হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে পিছনের আলমিরাতে হেলান দেয়। অশঙ্কিতভাবে বলল, “দেও।”
ইনারা বিস্মিত হয়ে উওরটা শুনে।
সভ্য আবারও বলে, “দাদাজানও তোমাকে একই উওর দিবে। আমাদের পরিবারের সুরক্ষার জন্য সকলের সামনে যাওয়াটা মানা। বিশেষ করে আমার। কারণ আমি একাধিক বছরের জন্য জনগণের নজরে ছিলাম। এতে হয়তো আমাদের কোম্পানির লাভ হতে পারে, নয়তো হিতে বিপরীত আমার সাথে আমাদের কোম্পানি এবং আমার পরিবারের সুরক্ষায় সমস্যা হতে পারে।
আমি কোম্পানি জয়েন করার পূর্বে দাদাজানকে ওয়াদা করেছিলাম। তোমার কি মনে হয় আমার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে, তাদের ফাংশনে অংশগ্রহণ করতে মন চায় না? মন চায় কিন্তু আমার পক্ষে তা আর সম্ভব না। আমি আমার ওয়াদা কারো জন্য ভাঙতে পারবো না। নিজের জন্যও না।”
ইনারা সভ্যের শেষ কথাগুলো শুনে তার পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করে। সে মাথা নাড়িয়ে বলে, “এখন বুঝতে পারছি। আচ্ছা আমি ঐশি আপুকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব। আর আপনার জন্য এত্তগুলা ভিডিও করে আনব যেন আপনি ফাংশন একটুও মিস না করেন।”
সভ্য মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে সে ইনারার উপর নারাজ। সাথে সাথে সে মুখটা গম্ভীর করে অন্যদিকে চলে যায়।যাবার সময় বলে, “আমি রহমানক তোমার সাথে পাঠাচ্ছি এবং সামিও তোমার আশেপাশে থাকবে। যেখানে যাচ্ছ সেখানে তোমার শত্রুদের অভাব নেই।”
.
.
চারদিকে হৈ-হুল্লোড়। গান বাজনা চলছে। নাচ গান হচ্ছে। সামি এবং জোহান আজ মন খুলে নাচছে। তাদের বোনের বিয়ে বলে কথা। তাও তাদের এত কাছের বন্ধুর সাথে। জোহান স্টেজ থেকে ঐশি এবং ইরফানের হাত ধরে তাদের নামিয়ে আনে। তাদের নিয়ে নাচতে শুরু করে। এমতো সময় কারও সাথে ধাক্কা খায় সে।
“সরি…” বলে পিছনে তাকিয়ে দেখতে পায় ইনারাকে। তাকে এখানে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়ে সে। নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না তার। ইনারা এখানে কী করছে?
ইনারা তাকে দেখে মুখ বানায়। সম্ভবত তাকে দেখার মোটেও ইচ্ছে ছিলো না। বিরক্তি নিয়ে মুখ ফিরিয়ে তার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ঐশির কাছে যেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানায়। ঐশি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে কি যেন জিজ্ঞেস করে। ইনারার উওর শোনার পর তার চোখেমুখে উদাসীন ভাব ছড়িয়ে যায়। হতাশ দেখা যায় তাকে। জোহান ঐশি থেকে ধ্যান সরিয়ে তাকাল ইনারার দিকে। তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করল। সে বুঝে উঠতে পারছে না এই মেয়ে দিনের পর দিন এত সুন্দর হয় কীভাবে?
ঐশি ইনারাকে ছেড়েই ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, “সভ্য কোথায়? ও এসেছে?” এটাই তার প্রথম প্রশ্ন।
ইনারার খানিকটা দ্বিধাবোধ হয়। সে জানে সভ্যর এখানে উপস্থিত হওয়াটা কতটা জরুরী ছিলো ঐশির জন্য। সে নিরাশাজনকভাবে উওর দেয়, “সরি আপু আমি চেষ্টা করেছি। উনার নিজেরও আপনাদের খুশিতে উপস্থিত হবার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু উনি বাধ্য। কিছু করার নেই।”
“ওহ।” আশাহত সুরে বলল ঐশি। পরক্ষণে হাসার চেষ্টা করল, “ওর জন্যই এখনও আংটি বদল করি নি। যাই হোক, তুমি এসেছ এতেই আমি অনেক খুশি।”
“সৌমিতা আন্টিকে দেখছি না?”
“মা’য়ের ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়ে গেছে তাই আসতে পারে নি। আগামী ফাংশনগুলোতে থাকবে। আসো তাহলে এবার আংটি বদলের অনুষ্ঠান শুরু করি।”
গান বাজনা থামে। স্টেজে উঠে ঐশি এবং ইরফান। তাদের আংটি বদলের সময় হয়েছে। ইরফানের সাথে তার পরিবার দাঁড়ায় এবং ঐশির পাশে মিঃ হক ও জোহান। তখনও অনুষ্ঠান শুরু হয় না। মিঃ হক হাতের ইশারায় কাওকে ডাকে। স্টেজে উঠে আসে মুশতাক সাহেব। মুশতাক সাহেবকে এত বছর পর প্রথম দেখে ইনারা। তাকে দেখতে কেমন শিউরে উঠে সে। তার মনে পড়ে সে রাতটির কথা যখন তাকে নির্মম ভাবে মেরেছিল লোকটি। ভয়ে বুক কেঁপে উঠল তার।
মুশতাক সাহেব স্টেজে উঠার সময় ইনারার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলেন। হাসিটি বিজয়ের মনে হলো। বিজয়ের হাসি তো হবেই একদিনেই তার করা ফাঁদ থেকে এত সহজে বেরিয়ে এলো মুশতাক। লোকটির দিকে তাকালে এখনো ভয় লাগে তার। ভয়ানক মনে হয়। যে মানুষের জন্য অন্যের প্রাণ তুচ্ছ তাকে ভয় হওয়াটাই স্বাভাবিক।
হঠাৎ তার কাঁধে কেউ হাত রাখতেই ভয়ে লাফিয়ে উঠে ইনারা। পাশে তাকিয়ে সামিকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, “ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।”
সামি তাকে জানাল, “ঐশি মুশতাক আহমেদকে আমন্ত্রণ না করার জন্য অনেক অনুরোধ করেছিল মামাকে। কিন্তু মামা তো কারো কথাই শুনে না। তার প্রিয় বন্ধু বলে কথা।”
“কয়েকবছর আগে তো একে অপরকে এত ভালো করে চিনতো না। তাহলে হঠাৎ কীভাবে এত ভালো বন্ধু হলো যে নিজের পরিবারের সাথে তাকে দাঁড় করাচ্ছে?”
“আগের থেকে পরিচয় ছিলো কিন্তু তেমন কথা হতো না। চার বছর পূর্বে মুশতাক আহমেদ মামাকে কক্সবাজারে একটা রিসোর্ট উপহার দিয়েছিলন। সাথে কোম্পানির অনেক বড় অংশ শেয়ারও কিনে নিয়েছে। এরপরই তাদের বন্ধুত্ব ভালো হয়।”
ইনারা হাসে, “এটাকে বন্ধুত্ব না ব্যবসা বলে। এবার বুঝতে পারছি মিঃহক কেন তখন এতকিছুর জন্য সাহায্য করেছিল তার সো কল্ড বন্ধুকে। বাপ ছেলে দুইজন একরকম। ছেলে রূপের পাগল আর বাপ টাকার। সবাইকে তাদের যোগ্য স্থান তো একদিন দেখাবোই।”
কথাটা শুনে সামি একবার ইনারার দিকে তাকিয়ে আবার তাকায় স্টেজের দিকে।
ইনারা মুশতাক সাহেবের দিকে তাকায়। সে এখনো ইনারার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোণে সে ভয়ানক হাসি।
ইনারা নিজেকে সংযত করে। সে-ও অসংশয় নিয়ে তাকায় তার দিকে। নিজের ঠোঁটের কোণে আত্ন-বিশ্বাসের হাসি আঁকে। মুশতাক সাহেবের ঠোঁটের হাসি মিশে যেয়ে চোখে রাগের উৎপত্তি হয়। পরবর্তীতে সে রাগ রূপান্তর হয় বিস্ময়ে। ইনারা ততক্ষণ পর্যন্ত চোখ সরায় না, যতক্ষণ মুশতাক সাহেব অন্যদিকে না তাকায়।
সামি ইনারাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এতকিছু করার পরও মুশতাক আহমেদ ছুটে গেল। ব্যাপারটা দুঃখজনক! তুমি ঠিক আছো তো?”
“অবশ্যই। তাদের সকলের কর্মের ফল তো আমি দিয়েই ছাড়বো। আজ না হয় কাল। সময় আসুক সবাই সবার কর্মের পরিণতি পাবে।”
আংটি বদল হওয়া শেষে সকলে একে অপরকে মিষ্টি খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। এর ফাঁকে হঠাৎ করেই জোহান ইনারার বাহু ধরে টেনে আনলো একপাশে। আঁতকে উঠল ইনারা, “এটা কোন ধরনের বেয়াদবি।”
“বেয়াদবি তো আমি এখনো করিই নি। তুমি আইজা বা ওর মামার সাথে যা ইচ্ছা তা করো, আই ডোন্ট ইভেন কেয়ার। কিন্তু তুমি আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি করবার চেষ্টা করবে না, নাহলে কতটা খারাপ হবে তুমি ভাবতেও পারবে না।”
ইনারা তাচ্ছিল্য হাসে, “কেন আইজা না আপনার গার্লফ্রেন্ড? তাহলে তার কষ্টে আপনার তো চিন্তা হওয়া উচিত। লেট মি গেস কারণ আপনি জীবনে কারও হতে পারেন না। না নিজের মা’য়ের, না বন্ধুর আর না নিজের ভালোবাসার মানুষের। আপনার চিন্তা কেবল নিজেকে নিয়ে। কারণ আপনি স্বার্থপর।”
জোহান হাসে। সে ইনারার কাছে এসে আলতো আঙ্গুলে ইনারা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বলল, “ভুল বলো নি। কিন্তু আজ তোমার স্বার্থের জন্য কথাটা বললাম। আসলে এত সুন্দর মেয়ের জন্য কোনো সমস্যা তৈরি করতে বুক কাঁপে। বাই দ্যা ওয়ে দিন দিন এত সুন্দর হয়ে যাচ্ছ, রহস্যটা কী?”
ইনারা বিরক্ত হয়ে তার হাত এক ঝাটকায় সরিয়ে দেয়, “নিজের হাত নিজের কাছে রাখেন, নাহয় হাত ভেঙে দিব। আর আমাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে? আপনি নিজে ভয়ে আছেন যে আমি আপনার এবং আপনার বাবার কুকর্মের ফল আপনাকে দিব। এই কারণেই তো এসব বলছেন।”
“উফফ সুন্দরী মেয়েদের রাগ এত মানায় না। কতবার বলেছি তোমায় মেয়েদের নম্র এবং চুপচাপ থাকা উচিত। কিন্তু তুমি তো শুনো না। তোমাদের মতো মেয়েদের একটা শিক্ষা না দিলেই নয়। কাল দেখে নিবে আমি কেবল হুমকি দেই না। কাজও করে দেখাই।”
বলে জোহান চোখ টিপ দিয়ে চলে গেল সেখান থেকে।
ইনারা বিরক্ত হয় প্রচুর। রাগে তার শরীর জ্বলে উঠে। কেবল ঐশির জন্য আজ বিশেষ দিন বলে বেঁচে গেল জোহান, নাহলে তার সাথে কি করতো সে নিজেও জানে না।
.
.
সত্যি সত্যি পরেরদিন খবর আসে ইনারা নতুন নায়িকা হওয়া সত্ত্বেও আজমল সাহেবের সিনেমায় একারণেই সুযোগ পেয়েছে কারণ সে আজমল সাহেবের আত্নীয়। খবরটা ভিত্তিহীন। কোনো প্রমাণ নেই এই খবরের। সাথে আরেকটি খবর হলো সে এক বড় অভিনেত্রীর মেয়ে বলেই এই ইন্ডাস্ট্রিতে সুযোগ পেয়েছে। যা সে লুকিয়েছে।
ইনারা নিশ্চিত খবরটা ছড়িয়েছে জোহান। গতকাল সে-ই তাকে হুমকি দিয়েছিল। একদিনেই খবরটা ছড়িয়ে যায়।এতে জনগণের মিশ্রিত ভাবপ্রকাশ পায়। এক ভাগ জনগণ এই কথাটা মানতেই রাজি নয়, তারা মানে ইনারা নিজের অভিনয়ের জন্য এত বড় সুযোগ পেয়েছে। অন্য দল এই কথা মেনে ইনারাকে ঘৃণা দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। এতে তাদের শুটিং এ কিছু প্রভাব পড়ে। কেউ সরাসরি না বললেও আভাস পায় ইনারা। সে আজমল সাহেবের সাথে এই বিষয়ে কথা বলে। আজমল সাহেব তার সাথে রাগ করেন না, উল্টো শান্ত গলায় বলে, “মিডিয়া জগতে এসব স্বাভাবিক। এই বিষয়ে চিন্তা করো না। কয়েকদিনেই জনগণ শান্ত হয়ে যাবে।”
এতটুকু বোধহয় কম পড়ে গেল। একদিন বাদেই সন্ধ্যায় কোনো এক ইন্টারভিউতে মিঃ হককে প্রতিবারের মতো সভ্যের কথা জিজ্ঞেস করা হলো। সকলের মনে আজও সভ্যকে নিয়ে আগের মতোই ভালোবাসা এবং কৌতুহলে ভরা। প্রতিবার কিছু না বললেই এই ইন্টারভিউতে সে সরাসরি বলে দিলেন যে ইনারাই সভ্যের ব্যান্ড ছেড়ে যাবার কারণ। তাদের সম্পর্ক ছিলো এবং ইনারা সভ্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সম্পূর্ণ বানানো গল্প। অথচ প্রমাণস্বরূপ সে সভ্যের সাথে তার একাধিক ছবিও দেখালেন। কিছু তাদের দুইজনের আর কিছু পঞ্চসুরের সাথে। মুহূর্তে যেন চারদিকে কেবল ইনারাকে নিয়েই কথা হতে থাকল। মুহূর্তে সকলের ঘৃণার পাত্র হয়ে গেল সে। এই ঘটনা তার জানা ছিলো না। শুটিং করার সময় বাহিরে থেকে অনেক শব্দ শুনতে পায় ইনারা। বেরিয়ে দেখে ভিড় জমে আছে তার শুটিং প্লেসের সামনে। সকলে তার নামে ধিক্কার জানাচ্ছিল। ইনারা তো কিছুই বুঝতে পারছিল না। পরে সে জানতে পারে ঘটনার কথা। এমন করুণ অবস্থা দেখে আজমল সাহেব তাকে আজ জলদি ছুটি দেয়।
খবর দেওয়ার পর রহমান কিছু বডিগার্ডসহ পূর্ব থেকেই তার শুটিং প্লেসের থাকে। ইনারা পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়। তার সুরক্ষার জন্য বডিগার্ডরাও থাকে। তবুও আক্রমণের স্বীকার হতে হয় তাকে। ভিড়ের থেকে একটি পাথর এসে লাগে তার কপালে। মুহূর্তে কপাল থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করে। রহমান তড়িঘড়ি করে তার রুমাল বের করে ইনারার কপালে চেপে ধরে। তাকে যেমন তেমন করে বাহিরে নিয়ে আসে। আসার সময় ইনারা কেবল ভীড়ে তার জন্য গালি, মন্দ কথা এবং অভিশাপই শুনতে পেয়েছে। এমন না যে সে আগে মানুষের ঘৃণার স্বীকার হয় নি। সে ইন্ডাস্ট্রিতে আসার শুরু থেকে অনেকবার ঘৃণার স্বীকার হয়েছে। কিন্তু এমন জঘন্য পরিস্থিতিতে আর সে কখনো পড়ে নি।
রহমান গাড়িতে উঠে। গাড়ি চালু হবার পর বলে, “ম্যাম এই মুহূর্তে হাস্পাতালে যাওয়াটা আরও রিক্স হয়ে যাবে। অনেকে পিছু করবে মনে হয়। আমি বাড়ির দিকে গাড়ি নেই। সে এলাকায় তো অনুমতি ছাড়া ঢোকা যাবে না। আমি ডাক্তার বাসায় নিয়ে আসব।”
ইনারাও কথায় সম্মতি দেয় এবং জিজ্ঞেস করে, “সভ্য কি এই ব্যাপারে কিছু জানে?”
“স্যার মিটিং এ ছিলো। ফোন অফফ।”
“তাকে জানানোর প্রয়োজন নেই। অকারণে উনি চিন্তা করবে।”
“অকারণে? ম্যাম বাহিরে অবস্থাটা দেখেছেন?”
“ব্যাপার না। উনাকে জানানোর প্রয়োজন নেই। আমি সব দেখে নিব। আগামীকাল আমার এক বিউটি প্রডাক্টের লঞ্চ-এ যাবার কথা। তা ক্যান্সেল করে দিন। এই অবস্থায় কোথাও যাওয়াটা ঝুঁকির হয়ে যাবে। আমি শুটিং থেকেও দুইদিনের ছুটি নিয়ে নিব।”
“জ্বি ম্যাম। এটাই ঠিক হবে।”
.
.
সভ্যের বাসায় আসতে আসতে রাত হলো। মিটিং এ অনেক সময় লাগলো তার। আসার পর সে ইনারাকে আশেপাশে কোথাও খুঁজে পায় না। সম্ভবত সে নিজের রুমে। যে মেয়েটা সারাক্ষণ বানরের মতো লাফালাফি করে সে আজ রুমে চুপচাপ বসে আছে, ব্যাপারটা কী?
যেহেতু সে এমনিতেই ইনারার উপর অভিমান করে আছে সেহেতু সে কিছুতেই তার রুমে যেতে পারে না। তাই পোশাক পরিবর্তন করেই সে এসে বসলো সোফায়। ইনারা রাতে একবার হলেও যদি রুম থেকে বের হয়।
ইনারা রুমে পায়চারি করতে শুরু করে। ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে তার। কিন্তুর সভ্যকে আসতে দেখে রুমে লুকিয়ে আছে সে। তার কপালে দাগ দেখলে নিশ্চয়ই চিন্তায় পড়ে যাবে সে। আর এই ব্যাথা নিয়ে কী উওর দিবে সে সভ্যকে?
অনেক সময় হয়েছে। নিশ্চয়ই সভ্য ঘুমিয়ে পড়েছে। তার ঘুমানোর সময় তো হয়েছে। সে চুপিচুপি যায় রান্নাঘরে পানি আনতে। মাঝপথেই সে দেখতে পায় সভ্যকে। সে সোফায় বসে আছে। সাথে সাথে সে পিছনে ফিরে উল্টোপথে হাঁটতে নেয়। তখনই সভ্যের কন্ঠ ভেসে উঠে, “দাঁড়াও।”
ইনারা থেমে যায়। চোখ বন্ধ করে নিজেকে নিজেই বকে, “কেন যে এখন বের হতে গেলাম? একটু পিপাসা সহ্য করলে কী হতো?” মনে মনে বলে।
সভ্য তার ল্যাপটপ রেখে উঠে আসে। ইনারার পিছনে দাঁড়ায়, “তুমি এত রাতে এখানে কী করছ?”
“ওই…ওই পানি নিতে এসেছিলাম।”
“তাহলে এভাবে চলে যাচ্ছ কেন?”
“তৃষ্ণা শেষ হয়ে গেছে। আর পানি লাগবে না।”
সভ্যর এবার সন্দেহ হয় ইনারার কথার ধরণে। ইনারা তো এত সুন্দর করে কথার উওর দেবার মেয়ে নয়। সে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছ না কেন?”
“আপনাকে তো প্রতিদিনই দেখি। ব্যাঙের ছাতার মাথাই তো। তাকিয়ে আর নতুন কী দেখব?”
সভ্য এবার হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে। আদেশের সুরে বলে, “ইনারা এদিকে তাকাও।”
ইনারা তাকায় না। সভ্য আবারও বলে, “ইনারা আমার দিকে তাকাও।”
ইনারা এবার দৌড়ে নিজের রুমে যেতে নিলেই সভ্য তার হাত ধরে নেয়। তাকে ফিরিয়ে নিজের দিকে ঘোরাতেই সর্বুপ্রথম তার চোখে পড়ে ইনারার কপালের সেলাইয়ে। সে আঁতকে উঠল, “তোমার কী হয়েছে? কপালে কী হয়েছে তোমার? ব্যাথা পেলে কীভাবে?”
চলবে…
[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]