অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ২৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“তুমি এটাই চাও তাই না?” সভ্য কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে। কিন্তু কাঁপা গলায় বলে, “তাই হবে। আমার থেকে যত দূরে পারো ততদূরে চলে যাও। আমি আর তোমাকে আটকাব না।”
কথা শেষেই সে মুখ ফিরিয়ে নেই। তার ভেজা চোখের জল গালে গড়িয়ে পড়ে।
ইনারা এক মুহূর্তের জন্য অবাক দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। তার রাগ বাড়ে। বুকের ভেতর অভিমান গড়ে উঠে। সে রাগে তার লাগেজ নিয়ে সভ্যের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সভ্য কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। সে চিন্তাও করতে পারছে না ইনারা তাকে নিয়ে এত নিচু চিন্তাও করতে পারে। তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে। সে কি এতটা বাজে? এত বছরেও কি ইনারা তাকে চিনতে পারে নি? তার ভালোবাসা অনুভব করতে পারে নি? ইনারার জন্য সে নিজের সবটা দায়ে লাগিয়ে দিয়েছে। তার জন্য নিজের স্বপ্নের ত্যাগ করে এই কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে। যেন নিজের সব ক্ষমতা দিয়ে ইনারাকে রক্ষা করতে পারে, তার সাহায্য করতে পারে। অথচ আজ মেয়েটা কত সহজে বলে দিলো এই সম্পর্কটা কেবল তার মতলবের জন্য ছিলো।
সে গভীর নিশ্বাস ফেলল। তার ফোনটা বেজে ওঠে। ফোন বের করে সে। সামির কল আসছে। আজ ঐশিকে তার ঠিকানা সামিই দিয়েছিলো। না সামি ঐশিকে তার ঠিকানা দিতো, না ঐশি তার কাছে এসে আবেগে তাকে জড়িয়ে ধরতো আর না ইনারা তাদের এই অবস্থায় দেখতো। সামির উপর প্রচন্ড রাগ উঠছিল সভ্যের। রাগে সে কাঁপছে। মুহূর্তে সে মোবাইলটা ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। সাথে তার পাশে থাকা টেবিলের কাঁচের জিনিসপত্রও মেঝেতে ছুঁড়ে মারল। মুহূর্তে তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সে কাঁপানো গলায় বলে, “তুমি আমার কখনো ছিলেই না ইনারা। কখনো না। তুমি কখনো না তোমার উপর আমাকে অধিকার দিয়েছ আর না তোমার ভালোবাসার উপর। অকারণে বারবার আমার জীবনে এলে, আর প্রতিবার আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়ে গেলে। কিন্তু আর না। এই শেষ। তুমি কেবল আমাকে না, আমার ভালোবাসার অনুভূতিকেও অপমান করেছ। তোমার জন্য আমার জীবনে আর জায়গা নেই। আমার মন থেকে তোমাকে মুছতে না পারলেও আমার জীবনে তোমার অস্তিত্ব আর রাখব না আমি।”
.
.
“ইনু তুই পাগল হয়ে গেছিস? রাগের মাথায় কেউ এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়?” সুরভি চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে।
সে এই মুহূর্তে ইনারার সাথে একটি হোটেলে আছে। বাসাতে বসে পড়ছিলো সে। হঠাৎ ইনারার কল আসে। বুঝাই যাচ্ছিল সে রাগে আছে। সে জানতে পারে সভ্যর সাথে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে হোটেলে এসে থাকছে ইনারা। ব্যাপারটা জানতেই সে হোটেলে এসে পড়ে। এসে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে।
এই মুহূর্তেও ইনারার মাথায় রাগ চেপে আছে। সে রাগান্বিত সুরে বলে, “তোর কথার মানে ও যা ইচ্ছা তা করবে, অন্য মেয়েদের জড়িয়ে ধরবে কিন্তু আমি রাগ দেখাব না? বাহ!”
“আমার কথার অর্থ এটা ছিলো না। তুই দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলে দেখ। শান্ত মাথায় কথা বললে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আর ও সত্যি কথা বলছে এর প্রমাণ কোথায়?”
“সম্পর্কে বিশ্বাস থাকতে হয়।”
“বিশ্বাস থাকতে হয়। অন্ধবিশ্বাস না। এই অন্ধবিশ্বাসে আমি আমার সব হারিয়েছি। নিজের চোখে যা দেখেছি তাকে তো আমি অস্বীকার করতে পারি না।”
“ইনু তারা দুইজন বন্ধু হয়।”
“তো আমার ছেলে ফ্রেন্ড ছিলো না? আমি তো কখনো কাওকে এইভাবে জড়িয়ে লাভ ইউ বলি নাই। সে আজ পর্যন্ত আমাকে একবার ভালোবাসি বলল না আর সে অন্য মেয়েকে…” ইনারা রাগে ফোঁপাতে লাগল। সে উঠে যায় বিছানা থেকে, “আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। যে মানুষ একবার মিথ্যা কথা বলতে পারে। সে বারবার মিথ্যা বলতে পারে। তার উপর আমার আর বিশ্বাস হবে না। আর বিশ্বাস ছাড়া সম্পর্ক অর্থহীন।”
“ইনু আমি এখনো বলছি তুই ভাইয়ার সাথে শান্ত মাথায় কথা বলে দেখ। তুই কখনো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কাছ থেকে দেখিস নি। আমি দেখেছি। সংসারে এমন টুকটাক ঝামেলা হয়েই থাকে। সে ঝামেলা কথা বলে সামলে নিলে তা টিকে যায় নাহলে শেষ হয়ে যায়।”
“হোক।”
সুরভি এবার আসলে বিরক্ত হয়, “ইনু তোর এখন মনে হচ্ছে এই সম্পর্ক শেষ হলে তোর কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু যখন বুঝবি তুই নিজের হাতে নিজের এত সুন্দর সংসার নষ্ট করে দিয়েছিস তখন আফসোস করবি।”
“উফফ সুরভি এমনিতেই বিরক্ত লাগছে। আজ জ্বালাস না। কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়তো।”
“ভালো কথা শুনতে বিরক্ত তো লাগবেই। ইনু আমি তোর কাছে প্রার্থনা করছি নিজের ইগো একপাশে রেখে চিন্তা কর। আর পারলে দয়া করে শান্ত মাথায় দুলাভাইয়ের সাথে কথা বল। নিয়তি তোকে নিজের ভালোবাসা পাবার দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে। এই সুযোগ এত সহজে হারালে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবি না।”
বলে সুরভি শুয়ে পড়ে। ইনারা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই। তারপর সুরভীর পাশে এসে বসে। অনেকক্ষণ সেভাবেই পাথরের মতো বসে থাকে। ফোনটা হাতে নেয়। সময় দেখে রাতের একটার বেশি বাজে। সভ্যর নাম্বার ডায়েল করেও কেটে দেয় সে। ফোনটা পাশে রাখে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে যায় কিন্তু ঘুম নেই তার চোখে। সে রাতে কিছুতেই তার ঘুম আসে না।
.
.
প্রায় তিনদিন পর ইনারা শুটিং এ আসে। এ কয়দিন সে নিজের হোটেল রুম থেকেই বের হয় নি। ঠিক মতো খাবার না খাওয়া এবং না ঘুমানোর কারণে তার শরীরের অবস্থাও ভালো নেই। এসে শুনতে পায় সামি এবং ইরফান তার সাথে দেখা করতে এসেছিল গত দুইদিন। তাকে না পেয়ে চলে গেছে। নিশ্চয়ই সভ্যর জন্য এসেছে।
তার সুপারিশ করতে। কিন্তু এবার ইনারা গলবে না। নিজেকে এত সহজে নরম হতে দিবে না সে।
সারাদিনের শুটিং এর পর সন্ধ্যায় ইনারা তার ভ্যানিটি ভ্যানে এসে দেখে সামি এবং ইরফান আগের থেকেই সেখানে বসে আছে। সে তাদের দেখে বিরক্তির সুরে জিজ্ঞেস করে, “সভ্য তোমাদের এখানে পাঠিয়েছে?”
সামি অবাক হয়ে বলে, “সভ্য? ওর ফোন তো গত তিন চারদিন ধরেই অফফ। ওকে পেলে কি আমরা দুইদিন এসে ঘুরে যাই? আজ তুমি এসেছ কনফার্ম হয়েই এলাম।”
“মানে সভ্য আপনাদের পাঠায় নি? তাহলে হঠাৎ করে এখানে এলে যে?”
ইরফান উঠে দাঁড়ায়। ইনারার দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলে, “এত বছর পর দেখা করে ভালো লাগলো। তোমার গত ফিল্ম দেখেছি এবং সব এড, ম্যাগাজিন কভারও দেখেছি। অনেক বড় নায়িকা হতে চলেছ।”
ইনারা জোরপূর্বক হাসল। সে এখনো বুঝতে পারছে না তারা এখানে কি করছে। সামি বলল, “তুমি তো জানো ইরফান আগে রাইটিং এ কাজ করতো। ও কয়টা ফিল্ম রাইটিং এর সাথে বইও লিখেছিল। এর মধ্যে একটা হলো ‘রূপকথা’। যা সবচেয়ে বেশি নাম করেছিলো। এখন সে বইয়ের মুভি বের হবার কথা হচ্ছে।”
“তাই নাকি? কনগ্রেটস ইরফান।” ইনারা বলল।
ইরফান তার মনের কথাটা জানায়, “আমি চাই সে ছবির নায়িকা তুমি হও।”
“আমি? কিন্তু আপাতত তো আমি এই ফিল্ম করছি। তাহলে কীভাবে?”
“তোমার এই ফিল্মের শুটিং শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব। প্রডাকশনও বড়। নিরাশ হবে না।”
সামি মজার সুরে বলে, “আসলে হয়েছে কি জনাব যখন তোমাকে প্রথম এক ফাংশনে গাউনে দেখেছিল তখন মন দিয়ে দিয়েছিল তোমাকে। তোমাকে কল্পনা করেই ওর এই বই লেখা। তাই ও চায় তুমিই এই চরিত্রে অভিনয় করো।”
সামির এভাবে কথাটা বলায় দুইজনের মধ্যে অস্বস্তিবোধ ছড়িয়ে যায়। সামি ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বলে, “আরে এখানে এমন অকোয়ার্ড ফিল করার কি আছে। আমরা সবাই-ই তো কোনো এক সময় কাওকে পছন্দ করিই। এটা তো নরমাল।” সামি আবারও ইরফানকে বলে, “আর তুই বিয়ের আগে পুরনো ক্রাশকে দেখে লজ্জা পাস? ঐশীকে জানাতে হবে দাঁড়া।”
ইনারা ঐশির কথা শুনে অবাক হয়, “ঐশি…ঐশির কথা কেন বললে?”
“আরে ঐশি আর ইরফানের কয়দিন পরই তো বিয়ে। তাহলে ঐশির কথা না বললে কার কথা বলব?”
ইনারার চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। সে বিস্মিত গলায় বলল “ঐশি আর ইরফানের বিয়ে?”
“এত অবাক হচ্ছো কেন? ঐশি তো ওদিন সভ্যকে কার্ড দিতে গেল। সভ্য বলে নি তোমাকে?”
ইনারা হতভম্ব। মুহূর্তে তার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। ঐশির বিয়ে ইরফানের সাথে হলে তার সেদিন দেখা দৃশ্যটার মানে কি ছিলো?”
এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে ওয়াসিন খান। সে রুমে ঢুকে সামি ও ইরফানকে দেখে ইনারাকে বলে, “ওহ তোমার সাথে দেখা করার জন্য মেহমান এসেছে? আমি তোমার জন্য চিকেন স্যালেড অর্ডার দিয়েছিলাম। তোমার মুখ দেখে ভালো মনে হচ্ছিল না তাই নিয়ে এলাম। নায়িকাদের ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করা উচিত। তাদের সৌন্দর্যই ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকার বড় এক হাতিয়ার।”
ইনারা বিরক্ত হয়। সে উওর না দিয়েই তার চেয়ারে বসে। ওয়াসিনকে সে যত এড়িয়ে যায় লোকটা ততই তার আশেপাশে ঘুরে। ব্যাপারটা দিনদিন বিরক্তিকর হয়ে যাচ্ছে তার কাছে।
ইরফান ওয়াসিন খানের কাছে যেয়ে নিজের পরিচয় দেয় এবং বলে, “আসলে আমার এক বইয়ের মুভি করার জন্যই আমি ইনারার সাথে কথা বলতে এসেছিলাম। আপনাকে প্রধান চরিত্রের জন্য এপ্রোচ করতে চেয়েছিল ডিরেক্টর। আমরা কি একটু কথা বলতে পারি এই বিষয়ে।”
ওয়াসিন খান একটু ডানদিকে ঝুঁকে ইনারার দিকে তাকায়। ও জিজ্ঞেস করে, “মিস ইনারাও এই ছবিতে থাকবে?”
“জ্বি।”
“ঠিকাছে তাহলে আমিও এই ব্যাপারে বিবেচনা করতে পারি। আমার টাচ আপ করা পর্যন্ত সময় আছে। ততক্ষণ ছবিটাকে নিয়ে আপনার কাছ থেকে প্লট শুনে তারপর সিদ্ধান্ত নিব। আপনি আমার সাথে আসুন।”
সে যাবার আগে আবার ইনারাকে বলে যায়, “মিস ইনারা খেয়ে নিবেন কিন্তু। চাঁদের উপর তাও দাগ সুন্দর লাগে। আপনার সৌন্দর্যের উপর নয়।”
ইনারা বিরক্ত হয় প্রচুর। তার ভীষণ মাথা ব্যাথা করছিল বিধায় সে মাথায় হাত রেখে বসে আছে।
দুইজনে যাবার পর সামি হেসে বলে, “ওয়াসিন খানও তোমার পিছনে লাড্ডু হয়ে ঘুরছে? ব্যাপারটা আসলে অবাক করার মতো না। আজকাল তোমাকে এই ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে সুন্দর নায়িকাদের হিসেবে ধরা হচ্ছে। তোমার পিছনে লাইন তো লাগবেই। বেচারা আমার বন্ধু। তোমাকে প্রথম গাউনে পার্টিতে দেখে আমিও বেশ অবাক হয়েছিলাম। সেদিনই তো জোহান ও ইরফানের সাথে কতজনে তোমায় দেখে নিজের মন হারিয়েছে। আর এখন তো আরও সুন্দর হয়ে গেছ তুমি।”
ইনারা বিরক্তির সুরে বলে, “সৌন্দর্যের পিছনে সবাই পাগল থাকে। এখন সাজুগুজু করে চলাফেরা করি বলে সবাই পিছনে পড়ে আছে। এই’যে মানুষ মনকে ভালোবাসাটার কথা বলে বেড়ায়। এটা একদম মিথ্যা কথা। কেউ মনকে ভালোবাসে না। দিনশেষে সবার কাছে সে সৌন্দর্যই বড়।”
সামি আনমনে বলে ফেলে, “আমার বন্ধুর কাছে না। সভ্য তো তোমাকে পার্টিতে দেখার অনেক আগের থেকেই ভালোবাসে। আমি তো ওর পছন্দে তখন এত অবাক….”
সে থেমে যায়। তার এই কথাটা বলার ছিলো না। সভ্যকে ওয়াদা করেছিলো সে। কিন্তু কথার তালে তালে কিভাবে এই কথাও তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল সে বুঝতে পারল না।
ইনারা সামির মুখ থেকে এমন কথা শুনে চমকে উঠে। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় সে সামির দিকে, “কী বললে তুমি?”
“আ..আমি? কোথায়? কিছু না তো।”
ইনারা উঠে দাঁড়ায় সামির সামনে, “সভ্য আমাকে আগের থেকে ভালোবাসতো?”
“ইরফান মনে হয় আমার জন্য অপেক্ষা করছে৷ আমার যাওয়া উচিত।”
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি।”
“সরি পার্টনার ভুলে কথাটা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। বেশি কিছু বললে সভ্য আমাকে খুন করে ফেলবে। আমাকে যেতে দেও প্লিজ।”
সামি যেতে নেবার পূর্বেই ইনারা টেবিল থেকে একটি কাটা চামচ নিয়ে সামির গলার কাছে রেখে হুমকি দিলো, “বলো, নাহয় সভ্যের কাছে খবর যাবার আগেই তুমি উপরে পৌঁছে যাবে। কি বলেছিলে আবার বলো। সভ্য আমাকে ভালোবাসে?”
সামি ভয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।
“কবের থেকে?” আবারও প্রশ্ন করে ইনারা।
“তুমি জয়েন করার কয়েকমাস পরই জানলাম। তখন পার্টির প্রিপারেশনের জন্য তুমি সভ্যের সাথে ডান্স করছিলে৷ প্রথমে ও তোমাকে পছন্দ করতে শুরু করে। যা ধীরে ধীরে ভালোবাসার রূপ নেয়।”
ইনারা তার চামচটা সরিয়ে নেয়। সে দূরে সরে অন্যদিকে ফিরে তাকায়। কিন্তু সামি তার কথা থামায় না, “আমি তো প্রথমে অবাকই হয়েছিলাম। তোমাকে দেখে কখনো মেয়ে মনেই হয় নি। যেভাবে আগে থাকতে। কীভাবে ও তোমার প্রেমে পড়তে পারে? কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যত তোমার প্রতি ওর ভালোবাসা দেখলাম ততই আমার মনে সম্মান বেড়ে গেল। ও তো তোমার খুশির জন্য নিজের গানও ত্যাগ করেছিলো। ইনফ্যাক্ট ওর কোম্পানিতে যোগ দেবার কেবল একটিই কারণ। কেবল তুমি। তোমায় সব সমস্যা থেকে রক্ষা করতে পারে, তোমার স্বপ্ন পূরণ সহজ করতে পারে এবং তোমার যাত্রা সহজ করতে পারে।”
কথাগুলো শুনে ইনারা কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল। সে এতকিছু একসাথে নিতে পারছে না। সামির মুখে কথাগুলো শুনে সে যেন এক ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। সে জিজ্ঞেস করল, “সভ্য আমাকে এত আগে থেকে ভালোবাসলে কখনো বলে নি কেন?”
এই প্রশ্নটার উওর সামি দেয় না।
ইনারা তার দিকে ফিরে তাকায়। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস, “সামি আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি।”
সামি তখনও চুপ।
এবার ইনারা রাগে চেঁচিয়ে উঠে, “আমি জিজ্ঞেস করছি সভ্য আমাকে কথাটা বলে নি কেন? উওর দেও।”
সামি সাথে সাথে বলে উঠে, “ও বলতে চেয়েছিলো। চার বছর পূর্বে। সব কিছু তৈরি করে রেখেছিল সভ্য। চারদিকে ফুল, মোমবাতি দিয়ে সাজিয়েছিল। কেক আনিয়েছিল। একটা আংটি কিনেছিল তোমায় প্রাপোজ করবে বলে।”
“তাহলে করে নি কেন?”
“আসলে… জোহান ওকে এসে বলেছিলো তোমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে। সেদিন তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল ও। আর তোমাদের বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে জানায়। জোহান তখন সভ্যকে কি বলেছি আমি ঠিক জানি না। কিন্তু এরপর সভ্য ব্যান্ড এবং এই দেশ দুটোই ছেড়ে দেয়।”
ইনারার রাগে গা জ্বলে উঠে। সে রাগে কটমট করতে করতে বলে, “ওই জোহানকে তো আমি দেখে নিব। ওর জীবনটা তছনছ না করে দিলে আমার নামও ইনারা না। কত বড় মিথ্যুক! আমি সভ্যকে ভালোবাসতাম ও জানতো, তবুও ও আমাদের দুইজনের জীবন নিয়ে খেলা করল!”
সামি অনেকক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা চিন্তা করে। তারপর মিনমিনে গলায় বলে, “শান্ত হও পার্টনার। মানুষ জীবনে কতগুলো ভুল করে, মানুষ মানেই তো ভুল।”
“এটা ভুল না অপরাধ। ও কতগুলো জীবন নষ্ট করেছে তুমি বুঝতে পারছ? পঞ্চসুর ভেঙে তোমার ক্যারিয়ার নিয়েও যে খেলা করেছে তা নিয়ে কখনো ভেবেছ?”
সামি চুপ করে থাকে।
ইনারা বলে, “ওর শাস্তি তো আমি ওকে দিব।” আবার সে মনে মনে ভাবল, “কিন্তু এর পূর্বে আমার ভুলটা শোধরাতে হবে। সভ্যকে মানাতে হবে। ওদিন যে তেজ দেখিয়ে এসেছি সভ্য ঘরে ঢুকতে দিবে না’কি সন্দেহ। ইনুর বাচ্চা তুই কেন সভ্যর কথা শান্ত মাথায় শুনলি না। এবার বাঁশ খা। শেষে যে অভিমান নিয়ে বলল, ‘আমার থেকে যত দূরে পারো ততদূরে চলে যাও।’ তাকে মানাতে মানাতে আমার তেল বের হয়ে যাবে। ইনু লেগে পড় কাজে। এবার তোর পালা সভ্যর আগে পিছে ঘুরার।”
চলবে…
অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৩০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
দরজা খুলতেই ইনারা বামদিকে ঝুঁকে একগাল হেসে বলে, “আপনি কি আমাকে মিস করেছেন?”
ইনারাকে দেখে সভ্য অবাক হওয়ার থেকে বেশি বিরক্ত হয়। সে কঠিন মুখের ভঙিতেই তাকায় ইনারার দিকে।
ইনারা জোরপূর্বক হাসে, “আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন যে? বেশি রেগে আছেন?”
সভ্য উওর দেয় না। সে বিরক্তির ভঙ্গিতে ফিরে যায় ভেতরে। বেড রুমে যেয়ে আবারও ল্যাপটপে নিজের কাজ করতে বসে।
ইনারাও তার পিছু পিছু যায়। তার সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টি গলায় বলে, “আমি আপনার ফেভারিট রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার এনেছি। আজ আমরা একসাথে খাই?”
সভ্য তার দিকে তাকায় না। কেবল উঠে আলমিরা থেকে একটি খাম বের করে ইনারাকে দেয়।
ইনারা খামটা উল্টেপাল্টে দেখে জিজ্ঞেস করে, “এটা কী?”
“ডিভোর্স পেপার।”
ইনারা চকিতে তাকায় সভ্যের দিকে, “কী!”
“এত অবাক হওয়ার কী আছে? তুমিই তো বলেছিলে তুমি এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাও। তো তোমার মুক্তির কাগজ এখানে।”
“আমি তো রাগের মাথায় বলে ফেলেছিলাম তাই বলে আপনি সিরিয়াসলি ডিভোর্স পেপার তৈরি করাবেন? দেখুন আই এম সরি। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি হঠাৎ ঐশির সাথে দেখে ভেবেছিলাম আপনাদের মধ্যে কিছু… দেখুন আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে। সামি আমায় সব বলেছে। ঐশি আপনাকে বিয়ের কার্ড দিতে এসেছিল।”
“ও তাহলে এ কারণেই ফিরে আসা হয়েছে তোমার। ডিভোর্স পেপারে সাইন করো আর যাও।”
ইনারা সাথে সাথে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে, “আমি কোথাও যাব না। এখানেই থাকব। এই রুমেই থাকব। এটা আমার বাড়ি।”
সভ্য বিরক্ত হয়ে তার ল্যাপটপ নিয়ে অন্যরুমে যাবার পূর্বেই ইনারা তার সামনে এসে দাঁড়ায়। কান ধরে বলে, “সরি তো। ভুল হয়ে গেছে। আর হবে না।”
সভ্য তাকে উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে সে আবারও সামনে এসে দাঁড়ায়, “এমন করছেন কেন আপনি? ভুল তো মানুষেরই হয় তাই না? আপনার বুঝি কখনো ভুল হয় না?”
“হয়। আমারও ভুল হয়। তাই বলে আমি অপরপক্ষের কথা না শুনে কারও চরিত্রহীন হবার সার্টিফিকেট দেই না। সিদ্ধান্ত নেবার আগে অপর পক্ষের কথাও শোনা উচিত।”
“তাহলে আপনি যখন চারবছর পূর্বে জোহানের কথা শুনে এই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তখন আমার কথা শুনেন নি কেন?”
সভ্য কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “কোন বিষয়ে কথা বলছ?”
“সামি আমাকে সব বলেছে। আপনি আমাকে প্রাপোজ করতেন কিন্তু জোহানের কথায় আপনি মেনে নিয়েছিলেন আমাদের দুইজনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এই নিয়ে আমার সাথে কথা বলার প্রয়োজনবোধ করেছেন আপনি?”
কথাটা শুনে সভ্য রেগে যায়, “সামিকে আমি মানা করেছিলাম কথাটা বলতে কিন্তু ও…” সে গভীর নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে ইনারাকে বলে, “ও যা বলেছে সব ভুলে যাও।”
“ভুলে যাব যে আপনি আমাকে ভালোবাসতেন?”
“হ্যাঁ, ভুলে যাও। আর আমার রাস্তা ছাড়ো।” কঠিন ভাষায় বলল সভ্য। সে ইনারাকে সরিয়ে অন্যরুমে চলে যায়।
ইনারা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে বুঝতেই পারে না কি করবে। চিন্তিত হয়ে পায়চারি করতে শুরু করে সারা রুমে। চিন্তা করে কোনো উপায় না পেয়ে অবশেষে কল দেয় সুরভিকে। প্রথমে ব্যস্ত পাওয়ায় আবারও চেষ্টা করে। কল ধরতেই সে ঝারি দেয় সুরভিকে, “এখানে আমি চিন্তায় মরতেছি তুই কার সাথে এত গল্প করিস?”
“আহনাফের সাথে কথা বলছিলাম।”
“আমি এখানে বাঁশ খাচ্ছি আর তুই সেখানে প্রেম করতেছিস? লজ্জা লাগে না?”
“তো দোষ করছ তুমি বাঁশটা খাবে কে? এই তিনদিন কত করে বললাম যেয়ে দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলতে। শুনেছিলি?”
ইনারা বিছানায় বসে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলে, “এবার কি করব তা তো বল। আমার তো কিছুই মাথায় আসছে না। এসব ব্যাপারে আমি একটু কমই বুঝি জানিস তো। কারও ব্যান্ড বাজাতে হলে এতক্ষণে হাজারটা বুদ্ধি একসাথে এসে পড়তো কিন্তু এখানে তো আমারই ব্যান্ড বেজে আছে।”
“আরও কর ঝগড়া। কতবার বলছি রাগ হলে চুপ থাকবি। কিন্তু কে শুনে কার কথা। আমার কথার তো পাত্তাই নেই।”
“আরে মা হইসে তো, এবার বল তো কি করব। কি করে জনাবের অভিমান ভাঙাবো।”
“এক কাজ কর, ভাইয়ার পছন্দের রঙের ড্রেস পর, দুই মগ কফি বানিয়ে ভাইয়ার কাছে যা। আর তোর রেডিও স্টার্ট কর। তোর থেকে বিরক্ত হয়ে ভাইয়া তোকে মাফ করেই দিবে।”
“তুই আমাকে রেডিও বলসোস কেন? আমি কী বেশি কথা বলি?”
“ভাই তুই দুলাভাইয়ের রাগ ভাঙাতে চাস না?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে যা। কেন এখানে বসে আমার মাথা খাইতেছিস?”
“আচ্ছা একটা লাস্ট হেল্প কর।”
“বল।”
“কফি কীভাবে বানায়?”
সুরভি তার কপালে মেরে বলল, “তোকে আমি ব্লাকহোলে
পাঠায় দিব একদিন দেখিস। আমার তেরো বছরের কাজিনও কফি বানাতে জানে। আর তুই বিবাহিত মাইয়া কফি বানাতে পারিস না।”
“আরে মজারটা তো বানাতে পারি। কিন্তু উনি তো খায় কড়াটা। যেটা খেলে বমি আসে ওটা।”
“আচ্ছা তুই রান্নাঘরে যেয়ে আমাকে কল দিস মা।”
.
.
ইনারা গুটিগুটি পায়ে রুমে ঢুকল দুইকাপ কফির মগ নিয়ে। তার অস্থির লাগছে খুব। ভয় করছে। সে সভ্যের দিকে তাকাল। সভ্য ফাইলে কিছু কাজ করছে। ইনারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার সামনে যেয়ে দাঁড়াল, “দেখুন আমি কি এনেছি।”
সভ্য তার দিকে তাকাল না। সে বসে কফির মগগুলো পাশের সাইড বক্সের উপর রেখে বলে, “আপনি কি সত্যি আমার সাথে কথা বলবেন না? আমি জানি আমার ভুল হয়েছে। প্রয়োজনে শাস্তি দিন তবুও এভাবে অবহেলা করবেন না প্লিজ।”
সভ্য অপ্রভিত হয়। সে বিরক্ত হয়ে উঠে সেখান থেকে যেতে নিলেই ইনারা তার কাঁধের দুইপাশে হাত রেখে রাস্তা আটকায়। মুখ ফুলিয়ে বলে, “আমি কিছু বলছি।”
সভ্য সরু দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “দেখো ইনারা তুমি এখানে থাকলে থাকো। কিন্তু আমার সাথে কথা বলার বা আমার কাছে আসার কোনো প্রয়োজন নেই। পরে আবার বলবে আমি তোমার কাছে আসার জন্য তোমাকে ঘরে রেখেছি।”
“আপনি এভাবে বলবেন না প্লিজ। আমার কষ্ট লাগছে। আপনি আমার উপর রেগে থাকলে বকা দিন, থাপ্পড় দিন তবুও মাফ করে দিন।” ইনারা সভ্যের হাত ধরে নিজের গালে মারতে নিতে চায়। কিন্তু সভ্য বিরক্ত নিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। উঠে যায় সেখান থেকে। বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে বেরোতে নেবার সময় এক মুহূর্তের জন্য থেমে যাগ। পিছনে তাকিয়ে দেখে ইনারা তার গালে হাত মুছছে। কাঁদছে মেয়েটা? তার বুকের ভেতর কেঁপে উঠে। প্রচন্ড রকমের ব্যাথার অনুভূতি হয়।
কিন্তু সে ফিরে যায় না। শব্দ করে দরজা লাগিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। দরজার ওপাড়ে দাঁড়ায়। চোখ বন্ধ করে নিজের বুকের বা পাশে হাত রাখে। মেয়েটার চোখের পানিতে কখনো তার বুক কাঁপছে।
.
.
“ইনারা আগামীকালও তোমার এক্সট্রা সিফট আছে। তোমার এবং ওয়াসিনের গানের সিনও স্যুট বাকি আছে।” আজমল সাহেব বললেন। তারা এখন শুটিং এর কাজে ব্যস্ত। ইনারা যে তিনদিন ছুটিতে ছিলো সেদিনের সিনগুলো আবার স্যুট করা হচ্ছে।
“ঠিকাছে স্যার। আপনার শুটিং এর ভিশনটা অনেক সুন্দর। বিশেষ করে কাপল সিনগুলো। আচ্ছা স্যার আপনার কাছে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? ভালোবাসার মানুষ আপনার উপর রেগে থাকলে বা অভিমান করলে তাকে কীভাবে মানাতে হয়?”
আজমল সাহেব হাসেন, “এমন কাওকে জিজ্ঞেস করছ যে কখনো বিয়েই করে নি?”
“আপনি তো এত আইকোনিক রোমেন্টিক মুভি বানিয়েছেন তাহলে আপনি কেন বিয়ে করেন নি? কখনো কাওকে ভালোবাসেন নি?”
তিনি গভীর নিশ্বাস ফেললেন, “জানো যারা ভালোবাসে তারা ভালোবাসার গল্প সুন্দর করে বানাতে পারে। কিন্তু যাদের গল্পটা বিচ্ছেদের তারা আরও সুন্দর ভালোবাসার গল্প বানাতে পারে। কারণ তারা সে গল্পগুলোতে নিজেকে এবং নিজের ভালোবাসার মানুষকে দেখতে পায়।”
“আপনি নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে পান নি?”
আজমল সাহেব মাথা নাড়ায়, “উঁহু, তার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে গেছে। আমার চোখের সামনেই।”
“আর কখনো কাওকে ভালোবাসার চেষ্টা করেন নি?”
“ভালোবাসা জিনিসটা যত দেখায় ততটা সুন্দর না বুঝলে?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে আজমল সাহেব। পা’য়ের উপর পা তুলে বলেন, “এই ভালোবাসা জিনিসটা আমায় ভেঙে দিয়েছে ভেতর থেকে। নিজেকে, নিজের ক্যারিয়ারকে প্রায় শেষ করে ফেলেছিলাম এই ভালোবাসাকে হারিয়ে। কিন্তু যা হারিয়েছি তা তো আর পাবার নয়। যেদিন এই জ্ঞান এলো সেদিন প্রতিজ্ঞা করলাম আর কখনো কাওকে ভালোবাসবো না। আর কেবল আমার কথা নয়। আমার খুব কাছের একজনকে শেষ হতে দেখেছি এই ভালোবাসার জন্য। এরপর থেকে আর ভালোবাসার ইচ্ছা নেই। এই ভালোবাসা মানুষকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট।”
ইনারা আজমল সাহেবকে প্রথম এত উদাস দেখে। তার কথা শুনে ইনারার মনে পড়ে যায় সভ্যের কথা। সে বলে, “সকলের ভালোবাসা তো এক হয় না স্যার। অনেকে তাদের সব হারায় তার ভালোবাসার মানুষের স্বপ্ন পূরণের জন্য।”
“তাই?” আজমল সাহেব হাসলেন, “তাহলে বলব তারা ভাগ্য নিয়ে এসেছে।”
তাদের কথোপকথনের মাঝেই ইনারার ফোনে একটি মেসেজ আসে। যে লোকটাকে সে আইজার পিছনে লাগিয়েছিল তার মেসেজ। একটি উকিলের অফিসের ঠিকানা দেওয়া। এরপর আরেকটি সিন স্যুট হয় তার। স্যুট শেষ হবার পর সে এসে দেখে তার ফোনে কয়েকটা মিসকল এসেছে। আইজার কল। দেখার পরপরই সে দেখতে পায় আইজা আবারও তাকে কল দিচ্ছে। সে কলটা ধরল, “কী চাই?” সরাসরি প্রশ্ন ইনারার।
ফোনের ওপাশ থেকে আইজা বলে, “আমার আর তিনদিন সময় লাগবে। তারপর বাড়িটা তুই পেয়ে যাবি। কিন্তু এতে তোমার এমন দেখাতে হবে যে বাড়িটা তুমিই নিয়েছ। আমার নাম যেন না আসে এতে। মামা যেন কিছুতেই না জানে বাড়িটা আমি তোমাকে দিয়েছি।”
“কেন?”
“কেন মানে কি? তুই তর কাজে মতলব রাখো।”
“আওয়াজ নিচে। আমার সাথে এভাবে কথা বললে কিন্তু ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে আপনার।”
“সরি।” নরম কন্ঠে বলল আইজা, “তোমার কাজ হয়ে যাবে। কেবল তুমি নিজের কথা মনে রেখো।”
“একদম চিন্তা করবেন না। আমার নিজের দেওয়া কথা ভালো করে মনে আছে।”
“আচ্ছা তাহলে ফোন রাখি।”
আইজা কল কেটে দেয়। ইনারা কান থেকে ফোন নামিয়ে হাসে। সে ভিডিওতে যেয়ে তা আপলোড দিয়ে দেয়। এবং বলে, “আমি বলেছিলাম এক সাপ্তাহ পরে কিছু করব না। তাই আগে করে ফেললাম। প্যাক আপ হয়ে গেল। একটু নিজের স্বামীর অফিসে যেয়ে দেখা করে আসি। তার রাগও তো ভাঙাতে হবে।”
.
.
ইনারা শুটিং শেষে আবার যায় অফিসে। দরজা খুলে ভেতরে যাবার পূর্বে একটি বডিগার্ড আটকায় তাকে। ইনারা জিজ্ঞেস করে, “আপনি তো আমাকে আগে কখনো আটকান নি।”
“বাট ম্যাম গতবার যা হয়েছে…”
ইনারা তার কথা সম্পন্ন হবার আগেই বলে, “তা এবার হবে না। চিন্তা করেন না। যেতে দিন।”
যেহেতু ইনারার অনুমতি নেবার প্রয়োজন নেই বলাই হয়েছে তাই বডিগার্ড তাকে যেতে দেয়।
ইনারা ভিতরে যেয়ে দেখে সভ্য একটি মেয়ের সাথে একটি ফাইল নিয়ে আলোচনা করছে। মেয়েটি আনিকা। সেলস ডিপার্টমেন্টের হেড।
দরজা খোলার শব্দ শুনে দুইজনে চোখ তুলে তাকাল। মেয়েটিকে সভ্যের এত কাছে বসা দেখে ইনারা মাথায় রক্ত উঠে গেল। কিন্তু সে গতবারের কথা মাথায় রেখে নিজেকে সামলে নেয় এবং জোরপূর্বক হেসে আনিকাকে জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছেন আপনি?”
“ভালো। আপনি?” অপ্রভিত ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে আনিকা।
“ভালো।” ইনারা এসে বসে সামনের সোফায়।
তখনই সভ্য বিরক্তির সুরে বলে, “আমার দেরি হবে। তুমি যেতে পারো।”
সভ্যের এমন করে বলায় আনিকার সামনে খুবই অপমানবোধ করে সে। অন্যসময় হলে নিজের ইগোতে কথাটা নিয়ে তুমুল ঝগড়া বাঁধাত ইনারা। কিন্তু এইবার তো তারই ভুল। তাই বেহায়ার মতো বলল, “আমি অপেক্ষা করব।”
সভ্য তাকায় ইনারার দিকে। তাচ্ছিল্য হেসে আবার তার কাজে মনোযোগ দেয়।
সে হাসিটা যেন তাকে এতটুকুই মনে করার জন্য ছিলো যে গতবার এই কক্ষেই একটা মেয়ের সাথে তাকে দেখে সে বড় একটা ঝগড়া বাঁধিয়েছিল। অথচ আজ একটি মেয়ের সাথে তাকে দেখে চুপ করে বসে দেখতে হচ্ছে তার। বাধ্য হয়ে।
ইনারা আসলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে। সভ্য মেয়েটির খুব কাছে বসেছিলো। দুইজনে কেবল কাজের কথা বলছিলো। অথচ ইনারার এতেও অশান্তি লাগছিলো। সে সহ্য করতে পারছিল না। তার ভালোবাসার মানুষটিকে অন্যকারো কাছে কীভাবে সহ্য করে সে?
মনে হলো কাজটা আরও আগে শেষ হতো। কিন্তু সভ্য তাকে জ্বালানোর জন্য কাজটা লম্বা টানলো। কিন্তু ইনারা উঠলো না। সেখানেই বসে রইলো। কোন সময় তার চোখ লেগে এলো তাও বুঝল না।
কাজ শেষ করে সভ্য উঠে দেখে ইনারা সোফাতেই হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল তার উঠার। কিন্তু ইনারা উঠে না। সভ্যতার কাছে যায়। পাশে বসে। সে দেখে ইনারা চোখের নিচে দাগ পরে গেছে। মেয়েটা কী আজকাল ঠিকভাবে ঘুমায় না? তার মুখটা শুকিয়ে গেছে। নিজের খেয়াল রাখে না?
চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের উপর ছড়িয়ে আছে। সভ্য আলতো আঙুল তার কপালে ছড়িয়ে থাকা অবাধ্য চুল সরিয়ে দেয়। সাথে সাথে তার বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। সে বিষণ্ণ সুরে বলে, “তোমার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা বুকের বাঁ পাশে জমিয়েছিলাম। কিন্তু আমারও তো মন ভাঙে, কষ্ট হয়, সে ভালোবাসা ঢেকে যায় অভিমানের পর্দায়। তোমায় কষ্ট দিয়ে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছি। তোমাকে ভালোবাসার শাস্তি।”
চলবে…
[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]