অনুভবে ২ পর্ব-২৭+২৮

0
880

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ২৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারা বাঁকা হাসে, “ইনারার কথার দাম আছে। সে মানুষকে কথা দিলে তা রাখতে জানে। এখন তুমি সিদ্ধান্ত নেও। টাকা পেয়ে নিজের শাশুড়ীর কটু কথা বন্ধ করবে, না’কি তোমার স্বামীকে ব্যাপারটা জানানোর পর ঘর থেক বের হয়ে ব্যাপারটা নিয়ে ভাববে?”
অমৃতা উওর দিলো না। তাকে বেশ খানিক সময় ধরে চিন্তিত দেখা গেল।
ইনারা উঠে দাঁড়ায়। বলে, “ঠিকাছে তাহলে সামনে যা হতে যাচ্ছে তার অপেক্ষা করো। আমি আসলাম।”
ইনারা উঠে যেতে নিলেই অমৃতা তাকে থামায়, “আ..আমি চিন্তা করে দেখব।”
“তোমার চিন্তা করে দেখার সময় আছে কিন্তু আমার তো এত সময় নেই। হ্যাঁ কিংবা না, উওরটা এখনই লাগবে আমার।”
অমৃতা পড়ে গেল দ্বিধায়। সে এত বড় ঝুঁকি নিতে পারে না। কিন্তু আবার এমনও না যে খুব সুখে আছে। তার শাশুড়ী উঠতে বসতে তাকে খোঁটা শোনায়। টাকাটা তার মুখের উপর ছুঁড়ে মারলে একটু তার মুখ তো থামবে। এর উপর ইনারা যদি আসলেই তার স্বামীকে কথাটা জানায়? না, এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়াটা বোকামি হবে।

“আমি রাজি।” অমৃতা জানায়।
ইনারা তার হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে, “আর তোমার কাছে কোনো প্রমাণ আছে যে আইজা ও তার মামাই এসব করিয়েছে?”
“পুলিশের কাছে মামলা দেবার পরদিনই মুশতাক সাহেব আমার একাউন্টে সাত লক্ষ টাকা পাঠিয়েছিলেন। তার কাগজ আছে।”
“গ্রেট। তাহলে আমি মিডিয়াকে আনার ব্যবস্থা করে দিব। আর তুমি সত্যিটা বলার ব্যবস্থা করো। আর তোমার শাশুড়িকে বলো চা নাস্তা করার জন্য অন্যদিন আসব।”
বলে ইনারা চলে গেল।

“সভ্য…সভ্য…” ঘরে ফিরে এসেই সে খুঁজতে শুরু করে সভ্যকে। সে ভুলেই গিয়েছিলো সভ্য অফিসের কাজে বিদেশের জন্য রওনা দিয়েছে আজ সকালেই। মনে পড়তেই তার ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে গেল। এই খালি ঘরে তার যেন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ এ ঘরে কেবল তারা দুইজন থাকে।
ইনারা সভ্যকে কল দিয়ে পায় না। তারপর সে প্রতিদিনের কল দেয় খালাজানকে। কয়েকমাস আগে সে দেশে এসেছেন। এখন তার ছেলের সাথে থাকছেন গ্রামে। প্রতিদিন সে তার নাতিদের দুষ্টুমির খবর শোনায় ইনারাকে। আর ইনারা তাদের কথা শুনে হাসে। অথচ আজ তার মন খুলে হাসিও আসছে না। সুরভির সাথে কথা বলেও সে শান্তি পায় না। হঠাৎ কি হলো তার মনের?

সে লম্বা একটি শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে। সভ্যের আলমিরা থেকে একটি স্কাই-ব্লু শার্ট বের করে শার্টটার দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে, “বেয়াদব ছেলে আমি কল করি, ধরছেন না কেন? আমি আপনাকে কত মিস করছি বুঝতে পারেন না? আই হেইট ইউ?”
বলে ভেংচি কেটে আবার শার্টটা বুকে জড়িয়ে ধরে। তা আলমিরায় ঢোকাতে নিয়েও থেমে যায়। কিছু একটা ভেবে শার্টটা পরে নেয়। আর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। ঘুমে তার চোখ লেগে আসছে। তবুও সে বহুকষ্টে তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। সভ্যের ফোন আসবে বলে। কিন্তু সারাদিনের খাটুনির পর শরীরটা আর তার মনের কথা শুনল না। ক্লান্তিতে চোখ লেগে এলো তার।
তারপর হঠাৎ করে ফোনটা বেজে ওঠে। লাফিয়ে উঠে ইনারা। হড়বড়ে ফোনটা হাতে নিলো, “হ্যালো..হ্যালো সভ্য?”
মাতাল করা ঘুমঘুম কন্ঠ শুনে বুকের ভেতর নাড়া দিলো সভ্যের। সে চেয়ার থেকে উঠে যেয়ে দাঁড়াল এক কাঁচের দেয়ালের সামনে। যেখান থেকে নিচের সবকিছু খুবই ছোট দেখা যাচ্ছে এবং আকাশটা পরিষ্কার। সে গভীর এক নিশ্বাস ফেলে বলে, “মহারাণী ঘুমাচ্ছিলেন না’কি? আপনার ঘুমন্ত কন্ঠে আমার প্রাণ বেরিয়ে যাবার মতো অবস্থা।”
“আগে বলুন আপনি ছিলেন কোথায় এতক্ষণ? কতবার কল দিয়েছি জানেন আপনি?” ইনারার কন্ঠে রাগ রাগ ভাব।”
“কেন? আমাকে মিস করছিলে বুঝি?”
ভেংচি কাটে ইনারা, “আমি আপনাকে মিস করব? আর মানুষ পান নি? আমি তো এখানে সেই মজায় আছি। যা মন চায় তা করতে পারছি। আপনি বকার জন্য নেই।”
“তাই? ভেবেছিলাম চারদিনের মাথায় কাজ শেষ করেই আসবো। কিন্তু তুমি যেহেতু এত খুশি তাহলে আগামী সাপ্তাহে আসার ব্যবস্থা করছি।”
“না না, একদম না।” আঁতকে উঠল ইনারা, “আপনি যত দ্রুত সম্ভব এখানে আসুন।”
“কেন? তুমি তো ভীষণ খুশিতে আছো। তাই না?”
ইনারা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মিনমিনে গলায় বলল, “আপনাকে ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগছে না।।”
কথাটা শুনতেই সভ্যের ঠোঁটে গাঢ় এক হাসি এঁকে উঠে। গাল ভারী হয়ে আসে। মনের ভেতর প্রজাপতিরা নাচতে শুরু করে দেয়।

এই মুহূর্তে সে মিটিং এর ব্রেকে আছে। যে কোম্পানির সাথে মিটিং তার অফিসেই। সাধারণত এসব মিটিং তার অধীনে থাকা কর্মীরাই করে। কিন্তু এই মিটিং তার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকমাস পর দেশে একটা মিউজিক ফেস্টিভ্যাল করা হবে যেখানে দেশের গায়কদের সাথে ওয়েস্টার্ন মিউজিশিয়ানসরাও উপস্থিত হবে। এই আয়োজন করছে তার কোম্পানিই। তাই সে নিজেই এলো। নাহলে সে ইনারাকে রেখে আসে?

যদি এই মুহূর্তে সে হোটেল রুমে থাকতো তাহলে ঠিকই মনে হয় নাচতে শুরু করতো। ইনারার মুখের থেকে এই সামান্য কথাও তার বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করে দেয়। পুরুষ মানুষ অপক্ক থেকে পরিপক্ক হয়। অথচ তার ব্যাপারে উল্টো ঘটছে। তার মনে কিশোরদের মতো অনুভূতি হচ্ছে। কিশোরদের মতো প্রেমে পাগলামো করতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা প্রেমে পড়লে সবার অবস্থা কি এমনই হয়?

“এই’যে মহারাজ, এখন চুপ করে আছেন কেন শুনি?”
ইনারা অভিমানী গলায় বলল।
“ভাবছি।”
“কী ভাবছেন?”
“ভাবছি কথাটা তুমি আমার সামনে বললে জড়িয়ে ধরে গভীর একটা চুমু খেতাম।”
“সারাক্ষণ এসব মাথায় ঘুরে আপনার তাই না? নির্লজ্জ।”
সভ্য হাসে, “আচ্ছা ওখানে এখন অনেক রাত। যেয়ে ঘুমান মহারাণী। আমারও ব্রেক টাইম শেষ হয়ে আসছে।”
“আচ্ছা ফ্রী হলে কল দিবেন।”
“দিব। যদি আবার বলো আমায় মিস করছিলে।”
“কচু বলব। আপনাকে মিস করতে আমার বইয়েই গেছে।”
কল কাটার পর ইনারা ফোনের দিক তাকিয়ে আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছুসময়ের জন্য তার উড়ু উড়ু মনটা আবারও উদাসীনতায় ভরে যায়।

সভ্য কল রেখে মৃদু হাসে। আবার ফিরে যেতে নেয় মিটিং রুমে। দেখে সামি তার পিছনেই দাঁড়ানো। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি’রে তুই এখানে?”
“সামি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফসোসের সুরে বলে, “মানুষ ঠিকই বলে বন্ধু বিয়ে হলে আর আপন থাকে না। পর হয়ে যায়। জীবনে কোনো মেয়ের থেকে ছ্যাঁকা খেলাম না কিন্তু তোর থেকে ছ্যাঁকা খেলাম।”
“কী হয়েছে বলবি?”
“কী আর বলব? সেন্টি খেয়েছি। গত একমাস ধরে একবার খোঁজও নেস নাই। পনেরোদিন ধরে যে আমি এখানেই তাও জানিস না। রহমানকে কল দিয়ে শুনি তুই এখানে। তাই চলে এলাম।”
“বাট তুই এখানে কী করিস?”
“ওহ কিছু ওয়েস্টার্ন আর্টিস্টের সাথে কাজ করছি। তাই এখানে। আর তুই ইনারার সাথে কথা বলছিলি? তো জনাব এতমাস হয়ে গেল। তোদের মাঝে তো সব ঠিকই চলছে। ওকে বলে দিলেই পারিস যে ওকে কতটা ভালোবাসতি।”
“অতীতের কথা টানব না। কিন্তু ওকে বলব। পঞ্চাশ দিনের মাথায় ওর জন্মদিন। অতীতে ওকে যেদিন হারিয়েছিলাম সেদিনই ওর কাছে নিজের ভালোবাসার স্বীকারোক্তি করে নিব।”
“দেরি করার কী প্রয়োজন? কয়েকবছর আগেও এমন দেরি করেছিলি। তারপরের ঘটনা আমরা দুইজনই জানি।”
“কিন্তু এখন এমন হবে না। কারণ তখন আমাদের মাঝে কেউ ছিলো। কিন্তু এখন কেউ নেই। আর কোনো কিছু আমাদের মাঝে আসতে পারবে না। এখন ও আমার। তখন আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিলো না, কিন্তু আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে ওর উপর। এছাড়া… ”
“এছাড়া? ”
“এছাড়া আমার মনে হয় ইনারাও আমাকে ভালোবাসে।”
.
.
অমৃতা দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো মানুষের মাঝে। একটি ছোট রুমে কতগুলো ক্যামেরা তার মুখের সামনে ধরা। সে ব্যাপারটার জন্য গত দুইদিন ধরে প্রস্তুতি নিলেও ভাবে নি এতগুলো মানুষ ও ক্যামেরার সামনে তার বক্তব্য দিতে হবে। ইনারার পাঠানো একজন লোক তাকে ইশারা দিতেই অমৃতা তার কথা বলল। প্রিয়কে পছন্দ করা থেকে শুরু করে তাকে ফাঁসানোর প্রস্তাব স্বীকার করা, সবটা। আইজা যে তাকে এই কাজের প্রস্তাবটা দিয়েছে তাও বলল৷ সাথে মুশতাক সাহেবের একাউন্ট থেকে টাকা পাঠানোর রিসিট দেখাল। সবটা লাইভ হচ্ছিল টিভি চ্যানেলে। সে লাইভ টিভিতে শো দেখছিল ইনারাও। সে টিভিতে দেখল রুমটাতে প্রবেশ করছে পুলিশরা। অমৃতাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অমৃতা চিৎকার চেঁচামেচি করছে। তার কথা কেউ শুনছে না৷ তাকে টেনে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে টিভি অফফ করে দিলো ইনারা। অপেক্ষা করতে শুরু করল তার ফোনের দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ফোন বেজে উঠবে।

তাই হলো। ইনারার ফোন বাজল। ইনারা ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে অমৃতার আঁতকে থাকা কন্ঠ শোনা গেল, “ই-ইনারা মেডাম দেখেন পুলিশরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। আপনি দয়া করে তাদের সাথে কথা বলেন।”
“কথা বলব? আমিই তো তাদের পাঠালাম তোমাকে অতিথিসেবা করতে। কিন্তু আফসোস প্রিয়কে যেভাবে করল তোমাকে সেভাবে করতে দেখলাম না এটা তো অন্যায়।”
অমৃতা বিস্ময়ের জন্য কিছুসময় ধরে কোনো কথা বলতে পারল না। বহু কষ্ঠে বলল, “আপনি বলেছিলেন আমার কোনো ক্ষতি হবে না।”
“আমি তো এটাও বলেছিলাম তোমাকে পঁচিশ লক্ষ টাকা দিব৷ টাকা কি গাছে উঠে? আমি তোমার পিছনে ওয়েস্ট করব কেন?”
“আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন। আপনি যা বলেছেন আমি তা করেছি। আপনি বলেছিলেন আপনি একবার কথা দিলে সে কথা ফিরিয়ে নেন না। আপনি এখন নিজের কথা ফিরিয়ে নিতে পারেন না।”
“ভুল। আমি বলেছিলাম আমি মানুষকে কথা দিলে সে কথা ফিরিয়ে নেই না। তুমি কাওকে হত্যা করার পর নিজেকে মানুষ মনে করো? কীভাবে?”
“আ-আমি কাওকে হত্যা করিনি। আপনি আমার সাথে ছলনা করেছেন। আমি আপনার সত্যিটা সবাইকে বলে দিব।”
“আগে নিজের সত্যির ধাক্কা তো সামলাও। কয়েকবছর আগে যেমন তুমি লোভে পরে প্রিয়র জীবন নষ্ট করেছিলে আজ সে লোভই তোমায় ডুবাল। ওকে কি বলতে তুমি? তুমি ওকে ভালোবাসো? ভালোবাসার অপমান করেছ তুমি। কাওকে ভালোবাসলে তার সাথে এমন জঘন্য কাজ মানুষ কখনোই করতে পারে না। আর হত্যা করো নি? ওর জীবন শেষ করে তুমি বলছ ওর হত্যা করো নি? তোমার মতো কিছু মেয়েদের জন্য আজ সমাজের এই অবস্থা। কতগুলো মেয়ে আসলে ধর্ষণ হওয়া সত্ত্বেও ন্যায়বিচার পায় না। আর তোমার মতো মেয়েরা এই আইনের অপব্যবহার করে অন্যের জীবন নষ্ট করে। কেন? কিছু টাকার জন্য? এখন জেলে বসে বসে হিসাব করতে থেকো কত টাকার লোকসান হলো। আমি নিশ্চিত করব তোমার জেল যেন অনেক লম্বা কাটে।”
“না না আপিনি এমন করতে পারেন না। আমার একটা সংসার আছে। আমার পরিবার, স্বামী তাদের কী হবে? আপনি এভাবে আমার জীবন নষ্ট করতে পারেন না। আমি আপনার পা’য়ে পড়ি। হ্যালো…হ্যালো ইনারা…”

ইনারা ফোন কেটে দেয়। সে চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দেয়। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে জেলে থাকা প্রিয়’র করুণ চেহেরা। সত্য যাচাই করা ছাড়াই তার উপর অনেক অত্যাচার করা হয়েছিল। মুখের বিভিন্ন অংশে রক্ত জমে গিয়েছিলো। যখন সে প্রিয়কে নিয়ে থানা বেরোলো তখন অনেকে তাকে ঘৃণার নজরে দেখে কিছু বাজে কথা বললেন। তাকে ধিক্কার জানালেন। অথচ প্রিয়’র এই ঘৃণা পাওয়ার কথা ছিলো না। সে তো কিছুই করে নি। সততার সাথে কামাই করে এতটুকু বয়সে নিজের সংসার চালাতো। আর সেই সৎ মানুষেরই মৃত্যু হলো এত বড় এক মিথ্যা অপবাদে। আজ হয়তো সে নিজের বন্ধুকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কিন্তু অন্তত তার নামের উপর কলঙ্ক মোছার চেষ্টা তো করেছে।

“মেডাম আপনার গাড়ি রেডি আছে। আপনার শুটিং এ দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসুন।” ড্রাইভারের কন্ঠ ঘোর ভাঙলো ইনারার। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে হচ্ছে আজ তার বুকের থেকে অনেক বড় এক পাথর সরে গেছে। শান্তি লাগছে তার। সে উঠে নিজের শুটিং এর জন্য রওনা দিলো।

শুটিং -এ পৌঁছাতেই সে শুনে আইজা তার সাথে দেখা করতে এসেছে। এক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে তার জন্য। ইনারা ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আরেকটু অপেক্ষা করতে বলে নিজে তৈরি হতে যায়। তার তৈরি হতে সময় লাগে আরও এক ঘন্টা। তৈরি হয়ে সে রাজি হয় আইজার সাথে কথা বলার জন্য। আইজাকে ভেতরে পাঠানো হয়। ইনারা মেকাপ টাচ-আপ করছিল। সে আইজাকে দেখে বলে, “সরি আপনাকে অপেক্ষা করানোর উদ্দেশ্যটা আমার ছিলো না। আপনি আমাদের দেশের এত বড় এক নায়িকা, সরি ভুল হয়ে গেছে। এত বড় এক নায়িকা ছিলেন। যে এখন নাকি বড় কোনো মুভির অফার পাচ্ছেন না।”
আইজা ইনারার সামনের চেয়ারে বসে শান্ত গলায় বলে, “ইনারা দেখ আমি জানি আমাদের অনেক ঝামেলা হয়েছে অতীতে। কিন্তু এভাবে আর কয়দিন? তুই আমার ব্যাপারে সমস্যা তৈরি করার চেষ্টা করছিস আর আমি তোর। একে অপরকে আর কয়দিন এভাবে জ্বালাবো বল? তুই অমৃতাকে পুলিশ স্টেশনে দিয়েছিস, ওকে। এখানে আমার নাম আনলি তাও ঠিক আছে। আমার দোষ ছিলো, আমি মানছি। ওসব আমি সামলে নিব। কিন্তু এখন আমরা এসব বন্ধ করি প্লিজ। সামনে কি হবে? আমরা একে অপরের পিছনে এভাবে কয়দিন পরে থাকব? দেখ তুই মিডিয়ার সামনে যখন থেকে তোর আর জোহানের এনগেজমেন্টের সময় আমার ওর সাথে রিলেশন শুরু হবার কথা তুলেছিস তার পর থেকে অনেক হেইট পেয়েছি আমি। তুইও কষ্ট পেয়েছিস। আমিও পাচ্ছি। এখন থেকে একে অপরের পিছনে পড়া বন্ধ করে দেই?”
“ঠিকাছে করতে পারি। কিন্তু পরিবর্তে আমি কী পাব?”
আইজা অস্থির হয়ে বলে, “তুই… তুই চাইলে মামার সাথে কথা বলে আমি বড় একটা প্রজেক্ট দেওয়াতে পারি।”
ইনারা হাসে, “ফিল্মের কথা তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমার সাফল্যের জন্য কারও সাহায্যের দরকার নেই। অন্যকিছু বলো। বড় কোনো অফার দেও। এতকিছুর পর কেন আমি তোমাদের ছেড়ে দিব? এটা বলবে না যে তোমরা আমার কোনো ক্ষতি করবে না এজন্য। তোমরা যা ইচ্ছা করতে পারো। আই ডোন্ট ইভেন কেয়ার।”
আইজা কতক্ষণ চিন্তা করে বলল, “ঠিকাছে, তোর কি লাগবে তা বল।
ইনারা ভ্রু কপালে তুলে বলল, “আমার মা’য়ের বাড়ি যেখানে আপনারা সবাই বেহায়ার মতো থাকছেন? ওটা লাগবে। একসাপ্তাহ পর আমি আসবো। একসাপ্তাহে ঘর খালি করে দিবেন। এখন আসতে পারেন। আমারও শুটিং শুরু হয়ে গেছে। পরিচালক আজমল তো আর যেকোনো পরিচালক না যে তাকে অপেক্ষা করাব।”
শেষের দেওয়া খোঁটাটা আইজা ঠিকই ধরতে পারে কিন্তু এ ব্যাপারে কিছু বলে না। কিন্তু জিজ্ঞেস করে, “ঠিকাছে আমি মামার সাথে কথা বলব। কিন্তু এর কি গ্যারান্টি যে এরপর আমাদের কোনো ক্ষতি তুই করবি না।”
“আহা আপু, তুমি আমাকে চিনো না? আমি মানুষকে কথা দিলে সে কথা রাখি।”
.
.
শুটিং শেষে ইনারা বাসায় ফিরে। আজও সে শূন্য ঘরে তার বুকের ভেতরটা হাহাকার করবে। সে সভ্যতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। গত কয়েকমাস তাকে ছাড়া একদিনও থাকে নি। আর এই তিনদিনে তাকে একপলকও দেখে নি। বাহিরে কাজ করার সময় যেমন তেমন করে সময়টা পার হলেও বাড়িতে যেতেই তার বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যায়। কিছু ভালো লাগে না। কেবল ফোনটার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে সভ্যর ফোনের। আর একদিন, কালই সভ্য আসবে দেশে। আসলেই খুব করে মারবে তাকে। এত অপেক্ষা করায় কেউ? অসভ্য একটা।

বড় প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে ঢুকার পর গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে এগোয় ইনারা। স্বাভাবিকভাবেই বাগানের রাস্তা পেরিয়ে দরজা দিয়ে ঢুকতে নেয়। হঠাৎ তার চোখ পড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচের দোলনায়। সেখানে বসে আছে সভ্য। প্রথমে সে ভাবলো সে স্বপ্ন দেখছে। তাই নিজের চোখ ঢলে আবার তাকাল। সভ্য সেখানেই বসা। মুহূর্তে তার গালভর্তি হাসি এঁকে উঠে। সে তার হ্যান্ডব্যাগ সেখানেই ফেলে সভ্যের দিকে দৌড়ে যায়।

সভ্যও উঠে দাঁড়ায়। দুই হাত ছড়িয়ে অপেক্ষা করে তার মহারাণীর আসার। ইনারা ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়ে সভ্যের বাহুডোরে। সভ্যও তাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। গাছ থেকে ঝরতে থাকে কৃষ্ণচূড়া ফুল।
সভ্য ইনারাকে খানিকটা তুলে হাওয়াতে ঘুরায়।
ইনারা সভ্যর গলা জড়িয়ে ধরে তার দিকে তাকিয়ে হাসে।
কপালে কপাল ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” আপনার না আগামীকাল আসার কথা ছিলো?”
“সিউর ছিলাম না। তাই দুইদিনের টিকিট বুক করে রেখেছিলাম। সেখানে মন বসছিল না। তাই জলদি করে সব কাজ শেষ করে চলে আসলাম আমার মনের কাছে।”
ইনারা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সে সভ্যের কোল থেকে নেমে যায়। কিন্তু সভ্যের গলায় হাত আবদ্ধ করে রেখেই বলে, “তাই কে আপনার মন?”
“আছে একজন। তুমি তাকে চিনো। তবে তাকে ব্যাপারটা জানানো হয় নি।”
“না জানালে জানবো কি করে শুনি?”
সভ্য তার কোমরে আলতো করে হাত রাখে। তার চোখে চোখ রাখে, “মুখে সব বলতে হয়? চোখে চোখেও তো কত কথোপকথন হয়। তো মহারাণী আপনি আমাকে মিস করেছেন?”
“আমি আর আপনাকে মিস করব?” ইনারা সভ্যর বুকে হাত রেখে তাকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে বলল, “একদম না। উল্টো এ কয়দিন এত শান্তিতে ছিলাম। দিলেন তো সব শান্তি নষ্ট করে।”
ইনারা হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে ভেংচি কেটে অন্যদিকে তাকায়।
সভ্য ভ্রু কপালে তুলে নেয়, “তাই? ঠিকাছে তাহলে তো হলোই। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে পনেরোদিনের জন্য। ভেবেছিলাম যাব না। এখন যেহেতু তোমার শান্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তাহলে ভাবছি চলেই যাই।”
মুহূর্ত না গড়াতে ইনারা সভ্যের কলার চেপে ধরে, “খবরদার। আমাকে ছেড়ে যাবার কথা বললে খুন করে ফেলব একবারে।”
সভ্য হাসে, “কেন মহারাণী আপনি তো আমাকে মনেই করেন নি তাই না?”
সে ইনারাকে কাছে টেনে নেয়। দুই হৃদয়ে হয় উথাল-পাথাল। ইনারার কঠিন মুখ হয় নম্র। সে সভ্যর গাল ছুঁয়ে বলে, “খুব মনে করেছি। আপনাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগে না আমার। খুব খারাপ অভ্যাস করিয়েছেন আমার।”
“কিন্তু আমি তো অনেক সুন্দর এক আসক্তে জড়িয়েছে।”
“তাই? কোন আসক্তে?”
“তোমার আসক্তিতে।”

চলবে…

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ২৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“কিন্তু আমি তো অনেক সুন্দর এক আসক্তে জড়িয়েছি।”
“তাই? কোন আসক্তে?”
“তোমার আসক্তিতে।”

ইনারা লজ্জা পায়। সে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি করে বলেন তো কয়টা মেয়েকে এই ডায়লগ মেরেছেন?”
সভ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “অনেক প্রাক্টিস করতে হয়েছে।”
“কী বললেন? আপনার সাহস তো কম না।”
ইনারা সভ্যকে মারতে শুরু করে। সভ্য হেসে বলে, “মজা করছি মহারাণী। আমার কী জানের ভয় নেই? অন্যমেয়ের দিকে তাকালে যদি আপনি আমার চোখ তুলে নেন তাহলে আপনার জংলী মুখখানি দেখব কী করে?”
“তাই না?” ইনারা জোরে খামচি দিলো সভ্য কে।
“সাধে সাধে বলি তুমি জংলী?”
“আচ্ছা শুনেন, আজ আপনি আমার জন্য কিছু রান্না করবেন? হাসনা আপা বা বাকি কারও হাতের খাবার খেতে আমার ভাল্লাগে না।”
“এই কারণেই খুব মিস করা হচ্ছিল আমাকে তাই না?”
“একদম।”
ইনারা বলে দাঁত জিহ্বা দিয়ে কেটে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্য গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো।

দুইজনে বাড়িতে যাওয়ার পর ইনারা লম্বা একটি শাওয়ার নেয়। বের হয়েই দেখে সভ্য তার জন্য ক্রিমি পাস্তা রান্না করে রেখেছে। সভ্য তাকে সোজা নিয়ে যায় ছাদে।
সেখানে যেয়ে ইনারা দেখে মেঝেতে একটি চাদর। তার উপর রাখা দুই বাটি পাস্তা এবং দুইটা কোকের বোতল। আর একপাশে দুইটা নিভু মোমবাতি। সভ্য তার হাত এগিয়ে দিয়ে একটুখানি ঝুঁকে বলে, “আমাদের ফার্স্ট ক্যান্ডেললাইট ডিনারে আপনাকে স্বাগতম মহারাণী।”
“ক্যান্ডেল তো আছে। কিন্তু লাইট কই?”
“আকাশে এত বড় একটা চাঁদ তোমার চোখে পড়ে না? আর কত লাইট লাগবে তোমার? আমাকে দেখতে পারলেই তো হলো। বাতাসে যে আগুন নিভে যাচ্ছিল বারবার।”
ইনারা হাসে। সভ্যের হাত না ধরেই যেয়ে বসে চাদরের মাঝখানে। সভ্যও এসে ঠিক বসে তার পিছনে। তার পিঠটা নিজের বুকে ঠেকিয়ে, কাঁধে মাথা রেখে ভেজা চুলে মুখ ডুবায়।
“শুনলাম অমৃতাকে না’কি ভালো একটা শিক্ষা দিয়েছ?”
“দিয়েছি। নেক্সট আইজা আর মুশতাক সাহেবের পালা। আজ আইজা এসেছিল শুটিং এ।”
“তাই? কী বলল?”
“আমি আর তার পিছনে না লাগলে সেও আমার পিছনে লাগবে না।” হাসলো ইনারা, “যেন এতবছর পিছনে লেগে থেকে বড় কিছু করে ফেলছে। তবে আমি কথা বাড়াই নি। কেবল কথা দিয়েছি আমার এক সাপ্তাহে বাড়িটা ফিরিয়ে দিলে আমি তাদের পিছনে আর লাগব না।”
“বলো কি? কথা দিতে গেলে কেন?” আশ্চর্য হয়ে বলে সভ্য।
“এখন কথা দিয়েছি একসাপ্তাহ পর যদি বাড়িটা ফিরিয়ে দেয়। যা করার এই সাপ্তাহেই করে নিব। আমি আবার কথা দিয়ে কথা ফিরিয়ে নেই না। দেখুন মুশতাক আহমেদ জীবনেও এই কথায় রাজি হবে না। একটি সাধারণ মেয়ের সামনে সে পরাজয় স্বীকার করবে তা অসম্ভব। সে এতদিন টুকটাক কাজে আমাকে ইন্ডাস্ট্রি থেকে বের করতে চেয়েছে। ভালোভাবে চেষ্টাও করে নি। আমার শর্ত জানার পর সে নিশ্চয়ই ক্ষেপে যাবে। তাই এর পূর্বেই আমার উনাকে জেলে ভরার পরিকল্পনা করতে হবে। নাহয় উনি আমার বড় ক্ষতি করতে পারে। আর মুশতাক আহমেদ মানা করার পর আইজা আপু নিজে উকিলের সাথে দেখা করতে যাবে। আপুর পিছনে আমি একজনকে আগের থেকেই লাগিয়ে রেখেছি। সে উকিলের ঠিকানা পেলেই আমি আমার মা’য়ের চিহ্নটা ফিরে পাব। আমি নিশ্চিত মা’য়ের একমাত্র সন্তান হবার কারণে সে বাড়িটা আমার নামেই আছে। কিন্তু… ”
“এর মধ্যে আবার কিন্তু আনছ কেন?”
“আমি সবার শাস্তির ব্যবস্থা করতে পেরেছি। কিন্তু মিঃ হক আর জোহানের বিরুদ্ধে কিছুই পাচ্ছি না।”
সভ্য কিছু মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, “আমি অনেক বছর কোম্পানির আন্ডারে কাজ করেছি। তাই কিছু সিক্রেট জানি। উনার ব্যবস্থা আমি করব। সে ব্যাপারে চিন্তা করো না।”
ইনারা হেলান দেয় সভ্যের বুকেতে। গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “মানুষ কত জলদি পালটে যায় তাই না? মানুষের প্রায়োরিটি পালটে যায়। আমি যখন কলেজে ছিলাম সাইদ ভাইয়া আর আইজা আপুকে দেখে ভাবতাম যেন তাদের মতো আমারও একটা লাভ স্টোরি হয়। খুব সুন্দর একটা লাভ স্টোরি। উনাদের লাভ স্টোরিটা পার্ফেক্ট ছিলো। দুইজনে একে অপরের জন্য পার্ফেক্ট ছিলো। অথচ এখন সাইদ ভাইয়া অন্যকাওকে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়েছে। কিন্তু আইজা আপুর কিছু আসে যায় না। সে বয়সে মনে হতো লাভ স্টোরিগুলো অনেক সুন্দর হয়। কিন্তু লাভ স্টোরিগুলো কেবল স্টোরিতেই সুন্দর হয়। আসল জীবনে না।”
“তুমি কাঁদছ ইনারা?”
“আমার কষ্ট হওয়া উচিত না। কিন্তু কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে। আইজা আপু এখন লোভে, ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারছে না সে নিজের সবটা হারিয়ে ফেলছে। যেদিন বুঝবে সেদিন অনেক কষ্ট পাবে সে।”
“যে মেয়ে তোমার সাথে এতকিছু করেছে তার জন্য তুমি কষ্ট পাচ্ছ?”
“সে মেয়েটাই ছোটবেলা থেকে আমার খেয়াল রেখেছিল জানেন? সে বাড়িতে খালাজান, ফুফা এবং আইজা আপু বাদে কেউ আমার সাথে ঠিক ভাবে কথাও বলতো না। যেহেতু আমাকে বাড়ি থেকে তেমন বের হতে দিতো না, সেহেতু আমার বন্ধুও ছিলো না তেমন। আইজা আপু আমার সাথে খেলতো, আমাকে পড়াতো, আবার বড় বোনের মতো শাসনও করতো। সে কখনো এমন খারাপ ছিলো না। সে গরীবদের সাহায্য করতো, সবসময় অন্যের খেয়াল রাখতো, আমাকে ভালোবাসতো। অন্তত দেখাতো। কেউ ছোটবেলা থেকেই তো ভালো হবার নাটক করতে পারে না তাই না? আমার না তখন এত কষ্ট লাগে নি যখন মুশতাক আহমেদ বলেছিলেন সে আমার বাবা না। কিন্তু যখন আইজা আপু বলল সে আমাকে কষ্ট দেবার জন্য এতকিছু করেছে। তখন আবার হৃদয়টার হাজারো টুকরো হয়ে গিয়েছিলো। আজও তার নামের পরে আপু যোগ না করলে আমার বুক কাঁপে।” ইনারা পিছনে ফিরে তাকায় সভ্যের দিকে, “জোহানের কথা বলতে আগে আপনারও এমন অনুভূতি হতো তাই না?”

হঠাৎ এমন প্রশ্নে সভ্য স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মুখের হাসি হাসি ভাবটা আর নেই। সে মলিন মুখে মাথা নাড়ায়। তারপর একগাল হাসি দিয়ে বলে, “কিন্তু আইজার জায়গা পূরণের তোমার কাছে সুরভি আছে, আর আমার কাছে সামি। তাই এত কষ্ট পেও না।”
ইনারা আবারও সামনে তাকায়, “জীবনে কারও জায়গা কেউ নিতে পারে না। কেবল নতুন জায়গা তৈরি করতে পারে। আচ্ছা সভ্য আমার জায়গা আপনার জীবনে কোন জায়গায় আছে?”
সভ্য শক্ত করে ধরে ইনারাকে, “মুখে বলে কাওকে তার গুরুত্ব অনুভব করানো যায় না। সময় আসুক নিজে জেনে যাবে।”
“কম হলে আপনাকে খুন করে ফেলবো।” ধমকের সুরে বলে ইনারা।
“তুমি না একটু আগে কাঁদছিলে? এখন হঠাৎ ধমক দিচ্ছ?”
“তো এখন কান্না করতেছিলাম বলে কি আপনাকে হুমকি দেওয়া যাবে না?”
“এই তোমার হঠাৎ মুড সুইং ভীষণ বিরক্ত লাগে আমার।”
“লাগবেই তো। আমাকে কবে তোমার ভালো লেগেছে শুনি? যখন সুযোগ পাও আমার সমস্যা খুঁজতে বসে পরো।”
সভ্য বিরক্ত হয়ে বলে, “তোমার মতো পাগল আমি একটাও দেখি নি।”
“কিন্তু আপনার মতো ছাগল আমি অনেক দেখেছি।”
“কি বললে? কি বললে তুমি? আমি ছাগল?”
“ছাগল না। ছাগলদের মহারাজা।”
“আর তুমি কী? আস্ত একটা জংলী।”
“আমি জংলী…আপনি আমাকে জংলী বলতে পারলেন? আমি দাদাজানকে ফোন দিয়ে বিচার দিব। মা’কেও বলব।”
ইনারা রাগে ফোঁপাতে ফোপাঁতে উঠে যেতে নিলেই সভ্য বলল, “আর এই পাস্তা?”
“খাব না আপনার রান্না করা পাস্তা।”
“ঠিকাছে। আমি তাহলে পাস্তা খেতে খেতে আনিকার সাথে মিটিং নিয়ে কথা বলে নেই।”
সভ্যের মুখের থেকে মেয়ের নাম শুনে ইনারা দরজা থেকে প্রায় দৌড়ে এলো। এসে সভ্যের সামনে বসে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এই আনিকা কে?”
“তোমায় কেন বলব?”
ইনারা সভ্যের গেঞ্জির কলার চেপে ধরে, “বলেন নাহয় মা’কে ফোন দিয়ে বলব আপনি আমাকে ধমক দিসেন।”
“মিথ্যুক। নিজে আমাকে গুন্ডির মতো ধমক দিয়ে আমার নাম বদনাম করো? আনিকা আমার সেলস ডিপার্টমেন্টের হেড।”
“ডিপার্টমেন্ট হেড হবে অফিসে। তুমি বাসায় আমার সামনে ওর নাম নিসো কেন? এজন্যই যাওয়ার সময় আমাকে আটকাও নাই তাই না?”
ইনারা রাগে ফোঁপাতে ফোপাঁতে কথাগুলো বলছিলো। তখনই সভ্য হঠাৎ করে ইনারার ঠোঁটে চুমু খেয়ে নেয়। আর বলে, “এভাবে হঠাৎ করে রাগলে তোমাকে কিউট লাগে।”

মুহূর্তে ইনারার ভাব ভঙ্গি পালটে গেল। সে চুপচাপ বাচ্চাদের মতো আগের মতো বসে সভ্যের বুকে নিজের পিঠ ঠেকায়। আর মুখ ফুলিয়ে মিনমিনে বলে, “খবরদার আমার সামনে কোনো মেয়ের নাম মুখে আনলে একদম খুন করে ফেলব।”
“ঠিকাছে মহারাণী। আর হবে না।”
“আই হেইট ইউ।”
সভ্য হাসে। ইনারার আঙুল তুলে চাঁদের দিকে ইশারা করে বলে, “দেখুন চাঁদটা মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। একটুপর লাইট থাকবে না।”
সভ্য ইনারার হাতটা নিজের হাতে নেয়। আঙুলে আঙুল ভরে। বলে, “জানেন মহারাণী আঁধারে মানুষ তীব্রভাবে আবেগে ভাসে। এই এই আঁধারের রাতটা নাহয় আমার সাথে এখানেই কাটাও।”
.
.
“আইজা পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই? আমি… আমি মহান পরিচালক মুশতাক আহমেদ ওই তেইশ/চব্বিশ বছরের মেয়েকে ভয় পেয়ে এই বাড়ি ওকে দিয়ে দিব? এখন এই বাড়ি চাইছে কয়দিন পর ওর মা’য়ের সব সম্পত্তি চাইবে। আমি আমার রাজত্ব এভাবে হাতছাড়া করব না।” মুশতাক সাহেব উঁচু স্বরে বললেন আইজার কথা শুনে। আইজা ও তার মা সামনের সোফায় বসা। সে কেঁপে উঠে মুশতাকের গলায়। তবুও সে শান্ত গলায় বলে, “মামা দেখো আমি কিছুতে আমার খ্যাতি হারাতে চাই না। ওর কাছে সে ভিডিওটা আছে। তা ছাড়লে আমাদের অনেক বড় সমস্যা হয়ে যাবে।”
“কিছু হবে না। আমি চাইলে দুইদিনে ওই মেয়ের জীবন শেষ করে দিতে পারি। কিন্তু তুই-ই তো আমাকে মানা করছিলি। এখন পরিণাম দেখলি? ও আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
“মামা এসব কি বলো তুমি? ও তোমার নিজের মেয়ে না হোক অথবা আমার বোন না হোক কিন্তু ও আমাদের সাথে এগারোটা বছর কাটিয়েছে। একটু মায়া তো…”
মুশতাক সাহেব তার কথা কেটে তাচ্ছিল্য গলায় বলল, “মায়া? কীসের মায়া? এই জীবনে আমি সাইয়ারাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলাম। ওকে যখন প্রথম দেখেছিলাম তখনই ওর উপর আমার মন এসে পড়েছিল। আমি ওকে প্রথম ফিল্মে আসার সুযোগ দেই। ওর নাম হয় আমার জন্য। কিন্তু ও কার প্রেমে পড়ে? ওই নায়ক ইমতিয়াজের। তার সাথে বিয়েও করে নেয় আমাকে না জানিয়ে। ভেবেছিল কত সুখে থাকবে। কিন্তু কেউ আমাকে কষ্ট দিয়ে সুখে থাকতে পারবে না। আমি যে জিনিস চাই তা নিজের করেই ছাড়ি। এক্সিডেন্ট করিয়ে দিলাম ইমতিয়াজের। ওর মেয়েকে ভালোবাসা দেখিয়ে, ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়েও করে ফেললাম। কিন্তু তারপরও ওই শালীর মন থেকে ইমতিয়াজকে বের করতে পারলাম না। আমি কাছে যেতে নিলেই ইমতিয়াজের কথা বলতো। একদিন আমার মাথা ঘুরে গেছে। যাকে আমি তেরো বছর ধরে ভালোবেসেছি তাকে ছাদের থেকে ধাক্কা দিতে আমার বুকে কাঁপে নি আর এখন তার মেয়েকে আমার পথ থেকে সরাতে বুক কাঁপবে? তোর কথায় হাসব আমি?”
মুশতাক সাহেব উঠে সেখান থেকে উঠে যায়। আইজা পিছন থেকে বারবার তাকে ডাকতে থাকে। সে তার মা’কে বলে, “মা তুমি কিছু বলো নি কেন মামাকে?”
“আমি কেন কিছু বলব? তোর পথের কাঁটা সরছে, এইসব টাকা আমাদের কাছে থাকছে তাহলে তোর সমস্যা কোথায়? তুই টাকা কামালেই তো হলো। এতদিকে তোর দেখার তো দরকার নেই।”
আইজা উঠে দাঁড়ায়। বিরক্তি নিয়ে বলে, “টাকা আর টাকা। তুমি তো পারলে আমাকেই বেঁচে ফেলো টাকার জন্য। তোমার এসব ব্যবহারেই বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আমিও একদিন চলে যাব তখন বসে থেকো টাকা নিয়ে।”
আইজা রাগে হনহনিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।
.
.
আজ সময়ের আগে শুটিং শেষ হয় ইনারার। তাই সে স্যারপ্রাইজ দিতে যায় সভ্যের অফিসে। তাকে অপেক্ষা করাতে মানা করা হয়েছে তাই অনুমতি ছাড়াই তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়।
ইনারা খুশিমনে দরজা খুলে। কিন্তু সে খুশিটা না বেশি সময় থাকে না। দরজা খুলতেই সে দেখে সভ্য একটি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। মেয়েটি ঐশি। কিন্তু সভ্য তো বলেছিল ঐশির সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই। সভ্য মিথ্যা বলেছিল তাকে? কিন্তু কেন?

সে শুনতে পায় ঐশির কন্ঠ, “আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ সো মাচ।”
সভ্য হাসে, “আই লাভ ইউ টু।”
ক’টি বাক্যই ইনারার বুকের ভেতর জঘন্যভাবে আঘাত করল। খুব ব্যাথা হলো তার বুকে। সভ্যের সাথে তার এত সুন্দর মুহূর্তগুলো চোখের সামনে ভাসল। সাথে সাথে সে দরজা বন্ধ করে নিলো। মনে হচ্ছে তার হৃদয়ের ভেতর ভারী কিছু এসে জমেছে। অশান্তি ঘিরে ধরেছে তাকে।
তার পাশ থেকে একজন বডিগার্ড জিজ্ঞেস করে, “মেডাম আপনি ভেতরে যাবেন না?”
“না।”
ইনারা অপরদিকে হাঁটতে শুরু করে। নিজেকে শক্ত রেখে। সে গাড়িতে যেয়ে বসে। ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বলে। সে প্রথমে নিজেকে খুব শক্ত রেখেছিল। কিন্তু শেষের দিকে আর পারে নি। তার চোখ দিয়ে পানি বইতে শুরু করে দিলো। ঐশিকে নিয়ে সে প্রথম থেকেই ইনসিকিউরড ফিল করতো। সভ্য এবং ঐশিকে নিয়ে সব সংবাদ, তাদের এত কাছে থাকা, সভ্যর তার প্রতি যত্ন সবটা তাকে কেমন অস্বস্তি অনুভব করাতো। আর আজ নিজের চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখা এবং সে বাক্যগুলো শুনে আর নিজেকে এসব চিন্তা থেকে আটকাতে পারছে না সে। সবটা সত্যি মনে হচ্ছে। যদি সভ্য অন্যকাওকে ভালোই বাসতো তাহলে তার সাথে সব কথা, ওয়াদার মানে কী? চারবছর আগে তাকে ভালোবাসার অনুভব করিয়ে তাকে ছেড়ে গিয়েছিল আর এখন তাকে নিজের করে নিয়ে এসে অন্য মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছে? তার অনুভূতি নিয়ে খেলা করে কী সভ্য শান্তি পায়?
.
.
“আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ এন্ড আই মিসড ইউ সো মাচ।” ঐশি সভ্যকে ছেড়ে বলে, “তোর কষ্ট হয় নি এতবছর আমাদের ছেড়ে থাকতে। সামি না বললে তো আমি জানতামও না তোর ঠিকানা।”
“অনেক কষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিছু করার ছিলো না। ইরফান খুব রাগ করে আছে না আমার উপর? ও ভাবে আমার কারণে আমাদের গ্রুপটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।”
ঐশি তার চোখের পানি মুছে আমতা-আমতা করে বলল, “ওর কথা বাদ দে। ওকে তো তুই আমাদের বিয়েতে এসেও মানিয়ে নিতে পারবি।”
“সরিরে আমার পাবলিকে যাওয়াটা মানা। নাহলে তোদের থেকে এতবছর যোগাযোগ না রেখে থাকতে পারি। আমি জানি না আমার পক্ষে…”
সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বেই দরজায় টোকা পড়ে। একজন বডিগার্ড রুমে ঢুকে বলে, “সরি স্যার অনুমতি না নিয়ে আসলাম। কিন্তু ইনারা ম্যাম এসেছিলো। রুমে ঢুকে কেন যেন চল গেল। তাকে দেখে ঠিক মনে হচ্ছিল না। মনে হলো কান্না করে দিবে। তাই আপনাকে জানাতে এলাম।”
“ইনারা…” ঐশি হতভম্ব হয়ে বলল, “ইনারার সাথে এখনো তোর পরিচয় আছে?”
“ঐশি শুন। আমি তোকে পরে সব কথা বিস্তারিত জানাব। সরি রে তুই মাত্র এলি আর আমার এভাবে যেতে হচ্ছে। আমি আসছি।”
সভ্য প্রায় দৌড়ে গেল বাহিরে। ইনারা ভুল সময়ে ভুল কিছু দেখে উল্টাপাল্টা কিছু মনে না করলেই হলো।

সে গাড়ি নিয়ে সোজা গেল বাড়িতে। প্রথমেই ইনারার রুমে যায়। দেখে সে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখ মুখছে আর ব্যাগ গুছাচ্ছে। সে ইনারার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, “তুমি ব্যাগ গুছাচ্ছ কেন?”
ইনারা চুপ থাকে। কিছু বলে না।
সভ্য আবার জিজ্ঞেস করে, “ইনারা আমার কথা শুনো তুমি কি দেখেছ আমি জানি না কিন্তু ঐশি কেবল আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো।
ইনারা এবারও কিছু বলে না।
“আমি কিছু বলছি ইনারা। আমার কথা শুনো।”
সভ্য এবার ইনারার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরায়। ইনারা এক ধাক্কায় সরায় দেয় তাকে, “খবরদার আমার ছুঁবেন না।” সে আবার ব্যাগ গোছাতে থাকে।
“আচ্ছা কি হয়েছে বলবে তুমি? ঐশিকে আমার সাথে দেখে রাগ করেছ তুমি? ও আমার ফ্রেন্ড, দেখা করতে আসতে পারে না? ইনারা কথা বলো। কথা না বললে আমি বুঝবো কীভাবে যে তুমি ঠিক কি নিয়ে এত রেখে আছো। আর তুমি ব্যাগ গোছাচ্ছ কেন?”
“কারণ আমি আর এখানে থাকবো না।”
“থাকবে না মানে কী? এটা তোমার বাড়ি। তুমি কোথায় যাবে। ইনারা…” সভ্য তার দুই বাহু শক্ত করে ধরে নিজের দিকে মুখ করায়। জোর গলায় জিজ্ঞেস করে, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি উওর দেও।”
“কী উওর দিব? কেন উওর দিব? আমাদের দুইবছরের কন্টেক্ট ছিলো না? আমি এর পূর্বেই আপনাকে মুক্তি দিচ্ছি। আপনাকে কোনো প্রকার উওর দিতে আমি বাধ্য নয়। ছাড়ুন আমাকে। ছাড়ুন বলছি।”
সভ্য স্তব্ধ হয়ে যায় ইনারার কথা শুনে। সে ভেবেছিলো ইনারা এখন আসলেই এই বিয়েটা মানে। এই বিয়ে নিয়ে খুশি। তাদের এই ছোট সংসারটা নিয়ে খুশি। তাহলে এখন হঠাৎ করে কী হলো। তার বুকের ভেতর কাঁপতে শুরু করল। সে কাঁপা-কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “ই-ইনারা এসব কী বলছ তুমি? আমরা না বলেছিলাম একে অপরকে ছেড়ে কখনো যাব না? তাহলে কেন এমন করছ তুমি? আ-আমার কোনো ভুল হয়েছে? সরি… সরি মহারাণী। প্লিজ তুমি এমন করো না। হঠাৎ কেন তুমি এমন ব্যবহার করছ?”
“আমি কেন এমন ব্যবহার করছি? আপনি অন্য মেয়েকে জড়িয়ে ধরে তাকে ‘আই লাভ ইউ’ বলে জিজ্ঞেস করছেন আমি কেন এমন ব্যবহার করছি?”
“তুমি ভুল ভাবছ ইনারা এমন… ”
“আমি মাঝখানে ভুল ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম আপনার আমার প্রতি কোনো অনুভূতি আছে। কিন্তু না আপনি কেবল আমাকে ব্যবহার করেছেন। আপনাকে আমি এক মুহূর্তের জন্য এই অবস্থায় দেখেছি। না জানি অন্যসময় আপনি কত কি করেন। আপনি আমাকে অন্য নায়কদের সামনে রোমেন্টিক সিন করতে মানা করেছিলেন। আমি তাদের নিজের কাছেও ঘেঁষতে দেই না। আর আপনি কাওকে জড়িয়ে ধরে আই লাভ ইউ বলছিলেন? আর আমি পাগলের মতো ভাবছিলাম আপনি আমাকে…”
বলতে বলতে থেমে যায় ইনারা। তার দম বন্ধ হয়ে আছে। তার চোখ থেকে বয়ে যায় এক ধারা জল। সভ্য তার গাল মুছে দেয়, “আমি সত্যি এমন কিছু করি নি ইনারা।”
ইনারা এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে বলে, “খবরদার আমাকে ছুঁবেন না। আপনার কথা কীভাবে বিশ্বাস করব আমি? আপনি কয়দিন আগে আমাকে মিথ্যা বলেছেন। বলেছিলেন ঐশির সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই। মিথ্যা বলেছেন আপনি আমাকে। আপনাদের দুইজনের সম্পর্ক খুব আগের থেকে চলছে তাই না? আপনি আজ পর্যন্ত আমাকে একটিবার ভালোবাসি বলেন নি অথচ ওকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসা প্রকাশ করছিলেন? সবাই ঠিকই বলতো, আমিই পাগল ছিলাম। একটা কথা বলেন যদি আপনাদের দুইজনের সম্পর্ক ছিলো তাহলে কেন আমার সাথে এত মিষ্টি কথা বলতেন? আমার কাছে আসার চেষ্টা করতেন আপনি? কাছে এসেছেন কেন আমার?”
“ইনারা রাগে তোমার মাথা কাজ করে না। তুমি শান্ত মাথায় আমার কথা শুনো।”
“কী কথা শুনব? আবার আরেক মিথ্যা? নিজের কানে শোনাটাকে মিথ্যা মানব না’কি নিজের চোখে দেখা দৃশ্যকে মিথ্যা মেনে নিব? আপনার আর মিথ্যা বলা লাগবে না তো। এই সম্পর্ক থেকে আপনাকে তো মুক্তি দিচ্ছি আমি। আচ্ছা ঐশিই যদি ভালোবাসেন তাহলে কেন আমার কাছে এসেছেন আপনি? দুইবছর শেষ হওয়ার আর কয়মাস বাকি তাই না? এরপর কী আপনি আমাকে ছেড়ে দিতেন? ছেড়ে দিতে হলে আগেই ছেড়ে দিতেন, না’কি আমার কাছে আসার জন্য এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রেখেছিলেন?”
সভ্য যেন আকাশ থেকে পড়লো, “কী? কী বললে তুমি?”

ইনারা নিজেও স্তব্ধ হয়ে যায়। শেষ করাটা বলার মতো চিন্তা তার মাথায় আসে নি। কথাটা কীভাবে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল সে নিজেও জানে না। কথাটা বলে সে নিজেও বোকা হয়ে গেল। কিন্তু সভ্যের করণীয় এর পর নিজের ভুল স্বীকার করে ছোট হবে? অসম্ভব।

সভ্য ভেজা চোখে তাকায় ইনারার দিকে। জিজ্ঞেস করে, “আমি তোমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করার জন্য তোমার সাথে সম্পর্ক রেখেছি? তোমার কাছে আসার জন্য? এমনটা হলে বিয়ের পরই তোমার উপর অধিকার জমাতে পারতাম আমি। দেড় বছর তোমার অনুমতি নেবার অপেক্ষা করতাম না।”
ইনারা তার হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে অন্যদিকে তাকায়। সভ্যের সাথে চোখ মিলায় না, “আপনার কোনো কথায় এখন আর আমার বিশ্বাস নেই। কোম্পানি নিজের নামে করার জন্য তো করেছেন। আপনার মতলবটা তো শেষ। আমার মতলব আমি বুঝে নিব। এখন এই সম্পর্ক থেকে আমাদের মুক্তি নেওয়া উচিত। এরপর আপনার ঐশি বা যে মেয়ের কাছে ইচ্ছা যেতে পারেন।”
“তুমি এটাই চাও তাই না?” সভ্য কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে। কিন্তু কাঁপা গলায় বলে, “তাই হবে। আমার থেকে যত দূরে পারো ততদূরে চলে যাও। আমি আর তোমাকে আটকাব না।”
কথা শেষেই সে মুখ ফিরিয়ে নেই। তার ভেজা চোখের জল গালে গড়িয়ে পড়ে।

চলবে…

[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে