অনুভবে ২ পর্ব-২৫+২৬

0
798

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ২৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“তোমার কাছে একটা চাওয়া আছে আমার।” দাদীজান বললেন। রাতে সবার খাওয়া শেষে তিনি ইনারাকে রুমে ডেকেছেন। দাদাজানও আছেন রুমে। সে চুপচাপ এককোণে দোলন চেয়ারে বসে ফাইলে কাজ করছিলেন।

দুপুরের পর দাদীজান তার প্রতি নরম হলেও বাড়ির অন্যসবার মতো তাকে এত ভালোবাসা দেখান নি। এত জলদি তাকে অনেক আদর করবে আশাটাও ইনারা করে নি। তবে দাদীজানের মনে খানিকটা মায়া জন্মেছে এটা সে বুঝতে পারছে।
ইনারা জিজ্ঞেস করল, “চেষ্টা করব দাদীজান। বলে দেখুন।”
“দেখো সভ্য তোমাকে নিশ্চয়ই বুঝেশুনে বিয়ে করেছে। তুমি আসার পর বাড়ির সবাইকে যেভাবে আপন করে নিয়েছ তাতেও আমি খুশি। তোমাকে নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের পরিবারের একটা সম্মান আছে। আমি চাই না পরিবারের বউ বাহিরে কাজ করুক। সম্পত্তি বা টাকা পয়সার তো অভাব নেই আমাদের। তাহলে কাজ করার প্রয়োজন কী? তাও আবার সিনেমাতে। ওখানে নারীরা হাজার ভালো হলেও, মানুষ তাদের খারাপ চোখেই দেখে। আমি চাই তুমি এই কাজটা ছেড়ে দেও।”

ইনারা বুঝতে পারলো না সে কী উওর দিবে? সে একবার তাকাল দাদাজানের দিকে। সে কিছু বলবে এই আশায়। কিন্তু দাদাজান ফাইল থেকে মুখ তুললেন না। অবশেষে ইনারা নিজের পক্ষ রেখে কথা বলল, “দাদীজান আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“করো।”
“আপনার পরিবারে আপনার এবং দাদাজানের আগে কী কারও লাভ ম্যারেজ হয়েছিল?”
“আমার কথার সাথে তোমার প্রশ্নের কী সম্পর্ক? যাই হোক, উওরটা না।”
“অর্থাৎ আপনি প্রথম লাভ ম্যারেজ করেছেন। আর তা কেন করেছেন?”
“ইনারা বড়দের এসব কথা বলতে নেই।”
“প্লিজ দাদীজান বলুন না।” আবদারের সুরে বলে ইনারা।
“কারণ তাকে ভালোবাসতাম তাই।”

দাদাজান এবার রুমের অন্যদিক থেকে বললেন, “নাতবৌ জানো তোমার দাদীই আমার কাছে এসে বলেছিল, ‘চলো পালিয়ে বিয়ে করে নেই, আমি তোমাকে হারালে বাঁচবো না।'”
তিনি অভিনয়টাও করে দেখালেন। ইনারা সে দৃশ্য দেখে নিজের হাসি আটকাতে পারে না।
দাদীজান চোখ রাঙিয়ে তাকায় দাদাজানের দিকে। সাথে সাথে সে চুপ করে ধ্যান দেয় নিজের কাজে।

ইনারা দাদীজানের হাত ধরে বলে, “দাদীজান আপনি কয়বছর ধরে দাদাজানকে ভালোবেসে তাকে ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। অথচ আমি ছোট থেকে এই স্বপ্ন নিয়ে বাঁচছি। আমার অভিনয়কে ভালোবাসছি। আমি স্বপ্নের এতো কাছে এসে কীভাবে ছেড়ে দেই? আর সবকিছুরই তো প্রথম আছে। আপনারা ছেলে মেয়েদের তফাৎ না করে সভ্যকে রান্না করা শিখিয়েছেন। তাহলে বউদের বাহিরে কাজ করতে কী সমস্যা? আর মানুষ কি ভাববে সে হিসেবে চলতে গেলে তো বাঁচাটাই দুষ্কর হয়ে যাবে। আমরা তো সবাইকে খুশি করতে পারবো না দাদীজান তাই না?”
দাদীজান কিছু বলছেন না। তিনি গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করছেন। ইনারা অস্থির হয়ে তার হাত আরও শক্ত করে ধরে বলল, “দাদীজান আমার পরিবার নেই। কিন্তু এখানে আসার পর সে শূন্য অনুভূতিটা যেন হাওয়ায় মিশে গেছে। আজ আমার মা যদি আমাকে অভিনেত্রী হিসেবে দেখতেন তাহলে অনেক গর্ব করতেন। তার চোখে সে গর্বিত অনুভূতিটা দেখার সুযোগ আমার নেই। তাই আমি চাই আপনাদের চোখে সে গর্বটা দেখতে। চাই আপনি নিজের নাতিদের মতো আমার সাফল্যতার উপরও গর্ব অনুভব করুন।”
দাদীজান এবার হাসলেন, “কথার জাল খুব ভালো বুনতে পারো দেখছি। না মেনে উপায় আছে? আচ্ছা যাও, তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করো। আমি বাঁধা দিব না।”
“সত্যি দাদী? ইউ আর গ্রেট। আপনি এত সুইট কেন?” বলে দাদীজানকে জড়িয়ে ধরলো।
“হয়েছে আর মাখন মারা লাগবে না। এখন অভ্রর মা’কে যেয়ে বলো আমার পান সুপারির বাক্সটা দিয়ে যেতে।”
“এখনই যাচ্ছি।”
ইনারা প্রায় দৌড়ে গেল সেখান থেকে।
দাদীজান বিরক্ত হয়ে বললেন,”বাচ্চা নেওয়ার বয়স হয়েছে আর এখন নিজেই বাচ্চার মতো লাফালাফি করে।”
দাদাজান হেসে উঠে এসে বসলেন দাদীজানের পাশে। বললেন, “তোমাকে বলেছিলাম না মেয়েটা মনের ভালো। সাথে আবার বুদ্ধিও আছে। তুমি এক কথার মানুষ। তোমার বলা কথা আজ পর্যন্ত আমি ঘুরাতে পারলাম না, অথচ মেয়েটা এই দুইদিনে কতবার তোমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দিলো।”
“কী করব? মেয়েটার মুখে যে মায়া মন কঠিন রাখতে পারি না। এর উপর ওকে দেখলে কেন যেন নিজের অতীত মনে পড়ে। মা হারা সন্তানরা কত কষ্ট পায় তা আমি জানি।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দাদীজান, “আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি মেয়েটা যখন বলেছে, সে কিছুতেই আমাদের পরিবারের সম্মান ডুবতে দিবে না। অভ্রর মা তো নরম মানুষ। যে কেউ নিজের স্বার্থে বোকা বানাতে পারবে। তাই ভয় হতো আমি মরার পর এই পরিবারের কি হবে। কিন্তু ইনারাকে দেখে শান্তি পেলাম। এখন নিশ্চিন্তে মরতে পারবো। ও ভালো হলেও, সময় হলে কঠিনও হতে পারবে। এখন অভ্রর জন্য এমন একটা মেয়ে পেয়ে গেলেই হবে। যেন আমার দুই নাতবৌ সুখে এক পরিবার হয়ে থাকে। এই শোনো, দেখো তো ইনারার কাছের কোনো বোন বা বান্ধবী আছে কি-না?”
“কেন?”
“অভ্রর জন্য দেখব। আর কেন?”
“ওর জন্য আর দেখার প্রয়োজন নেই। গতবার বিয়ের কথা শুনে কি রাগারাগি করে বের হয়েছে তোমার মনে নেই?”
.
.
ইনারা গুনগুন করতে করতে রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছিল। মা’য়ের কাছে যাবে বলে। মাঝরাস্তাতেই সে দেখে সভ্য এক দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করা। ইনারাকে দেখেই ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী ম্যাডাম আমার দাদীজানকে মাখন মারা শেষ?”
“আমি মাখন মারি না। আমি এতই মিষ্টি যে সবাই আমাকে দেখলেই গলে যায়।”
“এহ আসছে এমনিতেই গলে যায়। আমাকে দিয়ে আজ দুপুরে এত ভয়ানক নাটক করালে। এখন লজ্জা লাগে না এ কথা বলতে?”
“আপনার লজ্জা লাগে না আমার মতো সরল সোজা মেয়েটাকে ফাঁসাতে।”
সভ্যর চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল, “সরল সোজা আর তুমি? তোমার বুক কাঁপে নি এত বড় মিথ্যা কথা বলার আগে? চতুর শিয়ালের মতো সব অকপটে বুদ্ধি ভরা তোমার মাথায়।”
“কী বললেন আপনি আমাকে? নিজেকে দেখা যায় ব্যাঙের ছাতার মতো। প্লাস আছে তো এক খালি মাথা।আবার আসছে আমাকে কথা শুনাতে। এবার দেখেন ওয়াসিন খানের সাথে নতুন মুভি করছি না? বলে বলে রোমেন্টিক সিন দিবে। আর সে সিনগুলো সবার আগে আপনাকে দেখাব।”
“কী বললে তুমি?” সভ্য এক পা এগিয়ে এলো ইনারার দিকে, “আবার বলো তো। খুব রোমেন্টিক সিন করার শখ তোমার তাই না? তোমার শখ বের করছি।”
ইনারা আমতা-আমতা করে আশেপাশে তাকাল। সে বুঝতে পারল এই ব্যাপার নিয়ে সভ্যর রাগ তোলাটা নির্ঘাত বোকামি ছিলো তার। সভ্য নিশ্চয়ই চটে গেছে। সে এক পা পিছাল। এরপরও সভ্যকে নিজের কাছে আসতে দেখে এক দৌড় দিলো সে।

“এই মেয়ে কই যাচ্ছ? দাঁড়াও। তোমার শখ আজ মেটাচ্ছি আমি।” বলে সেও ইনারার পিছু গেল।
ইনারা ছুটে গেল রান্নাঘরে। যেয়ে মা’য়ের পিছনে যেয়ে লুকাল। মা জিজ্ঞেস করলেন, “আরে তোমার কী হলো?”
“মা দেখেন আপনার ছেলে আমাকে বকা দেয়।”
সে দেখে সভ্য ইনারার পিছনেই আসছে। সে রাগে ফোঁপাচ্ছিল। আসতেই ইনারাকে বলল, “এই তুমি এখনই মা’য়ের পিছন থেকে বের হও। তোমাকে আজ মজা দেখাচ্ছি আমি।”
“চুপ।” মা উঁচু স্বরে ধমক দিলেন সভ্যকে, “মেয়েটার পিছনে পরলি কেন হঠাৎ? পিচ্চি মেয়েটা কত ভয় পেয়েছি। সারাক্ষণ বিরক্ত করে।”
“কে পিচ্চি? এই মেয়ে আস্তো এক দজ্জাল।”
“মাইর দিব। লজ্জা লাগে না এত মিষ্টি মেয়ের ব্যাপারে এমন কিছু বলতে? ও কী করেছে বল তো।”
“হুম বলেন বলেন। কি করেছি আমি?” ইনারাও মা’য়ের কথায় তাল মেলায়। আর মা’য়ের পিছনে দাঁড়িয়ে। মাথায় দুই হাত রেখে ভেঙাতে শুরু করে সভ্যকে।

সভ্য চুপ করে যায়। সে তো আর মা’কে ইনারার কথাটা বলতে পারে না। কিন্তু ইনারার এমন ভেঙানি দেখে আরও চটে যায় সে। মা’কে বিচার দেয়, “দেখো মা তোমার এই মিষ্টি মেয়ে কীভাবে আমাকে ভেঙাচ্ছে?”
মা পিছনে তাকায়। সে তাকানোর পূর্বেই ইনারা সোজা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মুখ ফুলিয়ে, তার ঠোঁট উল্টে। সে ইনারার গালে হাত রেখে বলে, “দেখ কি সুন্দর করে দাঁড়িয়ে আছে। ও কোনো দুষ্টুমি করতে পারে না’কি?আর তুই অকারণে মেয়েটাকে বকছিস। আর একবার ওকে বকলে মাইর দিব তোকে।”

ইনারা মা’কে বলে, “মা দাদীজান বলেছিল তাকে পান সুপারির বাক্সটা দিতে।”
“আচ্ছা আমি যেয়ে দিয়ে আসছি। আর এই ছেলে আরেকবার তোমাকে বিরক্ত করলে আমাকে এসে জানাবা। আমি ওকে শিক্ষা দিব।”
“আচ্ছা মা।” মিষ্টি করে বলল ইনারা।

মা যাবার পর ইনারা দুষ্টুমি হাসি নিয়ে তাকাল সভ্যের দিকে। তার দিকে এগিয়ে বলল, “এইবার বকা দেন দেখি। জনাব আপনার চক্করে এই দুইদিন অনেক খাটুনি গেছে আমার। কাল বাসায় যেয়ে নেই। মজা বুঝাব আপনাকে।”
“কাল আমরা বাড়িতে যাচ্ছি না।”
“কী? তাহলে কোথায় যাচ্ছি?”
“একদম বলব না। আমি না বললে জানার জন্য তোমার পেট ব্যাথা করবে। আর তুমি আমার পিছু পিছু ঘুরবে। এখন মা বলেছে তাই তোমার ধমক দিতে পারব না। কিন্তু পিছনে তো ঘুরাতেই পারি।”
সভ্য তার পকেটে হাত রেখে বেপরোয়াভাবে হাঁটতে শুরু করে।
ইনারা বল, “যান। আপনি কী ভেবেছেন আমি আপনার পিছনে আসবো? জানা লাগবে না।”
কিন্তু সে তো ভারী ধৈর্যহারা মানুষ। কৌতুহল সামলাতে না পেরে আসলেই সভ্যের পিছনে ছুটে যায়।
.
.
রাতেই রওনা হয় দুইজনে। সবার কাছ থেকে দূড়ে যেতে একদম ইচ্ছা করছিল না ইনারার। কান্নাও পাচ্ছিল। এই দুইদিনে কারো প্রতি এমন মায়া জন্মায় ইনারা জানতো না। পারলে সে সেখানেই থেকে যায়। কিন্তু তা হলো না। আসার সময় সে না পেরে মা’কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। আর বলে আসলো আগামী মাসে আবার সে সবার সাথে দেখা করতে আসবে।

গাড়িতে উঠার কিছুক্ষণ পরই ঘুমিয়ে পড়ে ইনারা। এরপর দুইটা গাড়ি চেঞ্জ করে সভ্য। ইনারা ঘুমিয়ে থাকায় তাকে আর উঠায় না। কোলে তুলে অন্য গাড়িতে নিয়ে যায়। বড্ডই ঘুমকাতুরে মেয়েটা। তাকে উঠিয়ে নিয়ে দুইবার গাড়ি চেঞ্জ করল কিন্তু তার ঘুমই ভাঙলো না। সে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে রইলো সভ্যের বুকেতে। সে বুকের মাঝে যেন তার সারা জীবনের শান্তি।

ভোরের আলো যখন ইনারার মুখ ছুঁয়ে যায় তখন তার চোখ খুলে। চোখ খুলতেই সে দেখতে পায় সভ্য তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে হেসে বলল, “মহারাণী উঠে গেছেন?”
ইনারা কাঁচুমাচু করে আবার চোখ বন্ধ করে মুখ গুঁজাল সভ্যের বুকেতে। হঠাৎ তার জায়গাটার কথা মাথায় আসতেই লাফ দিয়ে উঠে বসে সে। জায়গাটা দেখে খুব অবাক হয় সে। আঁকাবাঁকা সড়কের দুইপাশে সবুজ গাছপালা এবং চা’য়ের গাছের বাহার। আকাশে রক্তিমা রঙের ছড়াছড়ি। ভোরের মিষ্টি রোদ্দুর আসছে জানালা ওপার হতে। ইনারা অবাক হয়ে তাকায় সভ্যের দিকে, “আমরা কোথায় এসেছি?”
“আমি ভেবেছি অন্তত এই জায়গাটা তুমি চিনবে। আজকের তারিখ দেখো।”
ইনারা তার ফোন অন করে তারিখটা দেখল। আজ তার মা’য়ের জন্মদিন। সভ্যের পরিবারের সাথে থেকে তারিখটাই খেয়াল করে নি সে। গত কয়েকবছর ধরে তার আর আসা হয় না এখানে। আজ এতবছর পর এখানে এসে তার হৃদয়ে কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে। বিশেষ করে এতটুকু ভেবে যে সভ্য তার থেকে বেশি তার খুশি, অনুভূতির খেয়াল রেখেছে। তার হৃদয় এই সুখের জন্য যেন খুব ছোট স্থান। কিন্তু এই সুখের মুহূর্তেও তার কান্না পেল। শব্দ করে কাঁদতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু সে কাঁদলো না। কিছু বললও না।
সভ্য তাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি খুশি হয়েছ?”
ইনারা কিছু বলল না। কেবল মাথা নাড়াল।

রিসোর্টে আসতে আরও সময় লাগে। তারা গাড়ি থেকে নেমে দেখে রিসোর্টের সকলে তাদের জন্য ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। আজ চার বছর পর এই একই স্থানে, একই সাথে আসলো তারা দুইজন। অথচ তাদের সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভিন্ন। আগে তাদের সম্পর্কের কোনো নাম ছিলো না। এখন আছে। পবিত্র এক সম্পর্কে আবদ্ধ তারা দুইজন।
সভ্য গাড়ি থেকে নেমে হাত এগিয়ে দিলো ইনারার দিকে। সে মৃদু হাসে। সভ্যের হাত ধরে নামে গাড়ি থেকে। নামতেই রিসোর্টের মালিক হাসিমুখে তাদের স্বাগতম করে। সাথে বলে, “আমার কত সৌভাগ্য আপনারা আমার রিসোর্টে এসেছেন। চার বছর আগে এত খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে এত বড় এক তারকা এসেছে আমাদের রিসোর্টে। আজ দুইজন জনপ্রিয় তারকা আমাদের রিসোর্টে পা রাখছে।”
সাথে সাথে তার বউ বললেন, “আমার তো গতবারই মনে হয়েছিল আপনাদের দুইজনের মধ্যে কিছু একটা চলছে। আপনাদের দুইজনকে একসাথে যে কত সুন্দর লাগে। একদম মেড ফর ইচ আদার। আসুন, আপনাদের ভেতরে নিয়ে যাই।”
সভ্য রিসোর্টের মালিকের সাথে কিছু কথা বলছিলো। এবং তার বউ ইনারাকে নিয়ে গেল সে রুমে। এই কয়বছরে রিসোর্টের অনেককিছু পরিবর্তন হয়েছে কেবল রুমটা ছাড়া। রুমটা যেমন ছিলো তেমনই আছে। সে রুমটা দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা আপনারা সবকিছু পাল্টেছেন, এই রুমটা পাল্টাননি কেন?”
“ওই টিনুর বাবাই করে নি। এই রুমটা তো ভাড়াও দেওয়া হয় না।”
”কেন?”
“কে জানি? চার বছর ধরে এই রুম কাওকে দেয় নি টিনুর বাবা। কেবল সভ্য স্যার ছাড়া। প্রতিবছর এই সময়েই তিনি এখানে আসেন এবং তখন সম্পূর্ণ রিসোর্ট তিনি বুক করে…” বলতে বলতে থেমে যান তিনি। বোধহয় বুঝতে পারে ভুল কিছু বলে ফেলেছে। তাই দাঁত দিয়ে জিহ্বায় কামড় দেয়। এমন সময় বাহির থেকে তার ডাক পড়ে। সে দ্রুত দৌড়ে যেয়ে ইনারার হাত ধরে বলে, “এ কথাটা বলার ছিলো না। টিনুর বাবা মানা করেছে। ভুলে বলে ফেলেছি। প্লিজ কাউকে জানাবেন না, নাহলে টিনুর বাবা অনেক রাগ করবে।”
আবারও ডাক পড়লো তার। তাই দৌড়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।

ইনারা হতভম্ব। তার অনুপস্থিতিতে সভ্য প্রতি বছর এখানে এসেছে? কিন্তু কেন? সে তো এতবছর ধরে তাকে ভালোও বাসতো না। তাহলে কেন এখানে আসতো? ইনারা এই একটি ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করতে থাকলো। তার হৃদয়ের ভেতর যেন ভারী কিছু এসে জমেছে। খুব অস্থির লাগছে তার।
এমন সময় রুমে প্রবেশ করল সভ্য। সে হাতে করে নিয়ে এলো একটি নীল রঙের মনিপুরী। আর বলতে থাকল, “দেখো ইনারা আমি কি এনেছি। আমি সাইয়ারা আন্টিকে এইরকম মনিপুরী শাড়ি পরতে দেখেছিলাম এক সিনেমাতে। আজ রাতে যখন আমরা দুইজন মিলে আন্টির জন্মদিন পালন করব তখন তুমি এই শাড়ি পরবে।”
সভ্যকে দেখে ইনারা তাকিয়ে রইলো মুগ্ধ নয়নে। আজ বুঝি সে আরেকবার প্রেমে পড়ল মানুষটার। সভ্য তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে শাড়িটি এগিয়ে দিলো, “তোমার ভালো লেগেছে ইনারা?”
“অনেক। আপনি ব্যালকনিতে যেয়ে অপেক্ষা করুন আমি পরে আসছি।”
“যো হুকুম মহারাণী।”
ইনারা তৈরি হলো। নীল শাড়ির সাথে সে সাজল নীল কাজল এবং টিপ দিয়ে। সাথে হাতে পরল কাঁচের চুড়ি এবং পা’য়ে এক জোড়া নুপুর। এতটুকুই। দরজা খুলে সে গেল সভ্যের কাছে।

সভ্য বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে তাকিয়ে ছিলো সামনের দিকে। সামনে কেবল আছে কিছু গাছ গাছালি। সেগুলো দেখতে দেখতেই হঠাৎ সে শুনতে পেল নুপুরের ছনছন শব্দ। চকিতে সভ্য পিছনে ফিরে তাকায়। নীলবর্ণের শাড়িতে এক রূপসী তার দিকে এগিয়ে আসছে। তার হাতের চুড়ি এবং পা’য়ের নুপুরের শব্দেই হৃদয়ে করুণ অবস্থা। এই রঙে তার সৌন্দর্য এমনিতেই ফুটে ছিলো। এর উপর তার নীলাভ চোখে সেই নীল কাজল যেন সভ্যকে হৃদয়ের স্পন্দনই আজ বন্ধ করে দিবে।

সে নীল কাজলের চোখ দেখে এক ঢোক গিলে সভ্য। চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস ফেলে। আজ সে নিজের এমন করুণ অবস্থা লুকায় না। বরং তার বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বলে, “মহারাণী এত সুন্দর করে সেজে আসার পূর্বে আমার এই নরম হৃদয়ের কথা চিন্তা করতেন। এত সৌন্দর্য এই হৃদয় যে সইতে পারবে না।”

ইনারা কিছুই বলল না। তার গলা দিয়ে যেন কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। সে কেবল তাকিয়ে রইলো সভ্যের দিকে। চুপ করে। মুগ্ধতাময় তার দৃষ্টি। হঠাৎ, নিজ অজান্তেই তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল এক বিন্দু জল। অথচ তার ঠোঁটে হাসি।

হঠাৎ এভাবে তার চোখে পানি দেখে অস্থির হয়ে পড়ল সভ্য। সে এগিয়ে এসে ইনারার গালে হাত রাখে, “কী হয়েছে ইনারা? তুমি ঠিক আছো তো? কাঁদছ কেন তুমি? আমি কি ভুল কিছু বলেছি? সরি…সরি ইনারা, তাও তুমি কান্না করো না। তোমার চোখের পানি যে আমাফ সহ্য হয় না।”
ইনারা কিছুই বলল না। কেবল ঝাপটে পরল সভ্যর বুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। মুহূর্তে যেন তার সকল অস্থিরতা মিশে গেল। শান্তি ছড়িয়ে গেল তার হৃদয়ের কোণে কোণে। সে সভ্যর বুকে মাথা রেখে কেবল জিজ্ঞেস করে, “সভ্য আমার সকল কাছের মানুষড়া আমার থেকে দূরে হয়ে যায়। আপনি কখনো আমার কাছ থেকে দূরে যাবেন না তো?”
সভ্য খানিকটা চমকায় হঠাৎ এই প্রশ্নে। তবুও এই নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে না। কেবল ইনারাকে তার বুক থেকে উঠিয়ে তার কপালে আলতো করে চুমু খায় এবং বলে, “আমি তোমাকে ছেড়ে কখনো যাব না। আমার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমি তোমার সাথে থাকব।”
ইনারা মৃদু হাসলো কথাটা শুনে। সভ্যের বুকে নিজের চিবুকটা রেখে দৃষ্টিমিলন করল এবং মনে মনে বলল, “আমিও প্রাণোপণ করছি, এই জীবনে কেবল আপনাকেই বারবার ভালোবাসবো।”

চলবে…

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ২৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারার পাহাড়ের এক কোণায় বসে আছে। এখানে বসে সামনের সৌন্দর্য দর্শনের জন্য বসার একটি স্থান করা। সত্যিই এই জায়গাটি দেখতে অপূর্ব। খোলা আকাশ এবং গভীর পাহাড়ের মাঝে যেন মেঘ ভাসছে।
ইনারার খুব ইচ্ছে ছিলো সভ্যের সাথে এই অঞ্চলের সৌন্দর্য ঘুরেঘুরে দেখবে। কিন্তু তা হবার নয়। সবকিছুরই একটা মূল্য পরিশোধ করতে হয়। তাদের দুইজনের স্বপ্নের মূল্যটা ছিলো তাদের স্বাধীনতা। মন মতো ঘুরে-বেড়ানোর উপায়টা যে নেই।

সভ্য মাটির দুই কাপে চা এনে বসল ইনারার পাশে, “এত গভীর মনোযোগ দিয়ে কী ভাবছেন মহারাণী?”
ইনারার ঘোর ভাঙে, “বিশেষ কিছু না। আচ্ছা বলুন তো এই রিসোর্টে যে আসলাম যদি কেউ আমাদের একসাথে দেখে নেয়? আপনার জন্য সমস্যা হয়ে যাবে না?”
“উঁহু, কেউ বলবে না। আমার রিসোর্টের মালিকের সাথে বোঝাপড়া হয়ে গেছে।”
“কিন্তু শেষবার যে এখান থেকে যাবার পর আপনি এখানে একটা মেয়ের সাথে এসেছিলেন সে নিউজ এসেছিলো। এখন তো আমরা দুইজনই সবার কাছে পরিচিত।”
“হ্যাঁ তা রিসোর্টের কেউ খবরে দিয়েছিল। কিন্তু এরপর তাদের সাথে ভালো হয় নি। ভয়ে আর কখনো মুখ কখনো মুখ খুলবে না।”
“মানে? আপনি কী করেছেন তাদের সাথে?”
“আমি কিছু করি নি। আমি এত কঠিন শাস্তি দিতে পারি না। অভ্র ভাইয়া জেনে গিয়েছিল। তার একজন কর্মীই বিষয়টা সামলে নিয়েছে। এরপর আর কারও সাহস হবে না মুখ খোলার।”
“ঘরে সবার কাছে অভ্র ভাইয়ার কথা শুনলাম অথচ তাকে এখনও দেখলাম না।”
“তুমি হয়তো অলরেডি তাকে দেখেছ কিন্তু চিনতে পারো নি। তার সাথে আমার চেহেরা বিশেষ একটা মিলে না।”
“দেখেছি? কোথায় দেখেছি?”
“সময় আসলেই জানবে। তবে তোমার যে ভিডিও লিক হয়েছিল না? তার ফুল ফুটেজ প্রথমে কেউ দিতে চাচ্ছিল না। ভাইয়ার এসিস্ট্যান্টকে দেখে নিজেরাই বের করে দিয়েছে।”
“বলেন কি? এত ক্ষমতা আপনার ভাইয়ার? আপনাদের থেকেও বেশি?”
“আই মিন টাকার ক্ষমতা থাকলেও আমাদের কারও সামনে যেয়ে হুমকি দেবার পারমিশন নেই। কিন্তু ভাইয়া এসব রুলস মানে না। এখন ভাইয়ার কথা বাদ দেও। আমার কথা বলো। আমার সাথে থাকলে কেবল আমাকে নিয়ে কথা বলবে বুঝলে।”
“কেন জনাব? অন্যকাওকে নিয়ে কথা বললে আপনার ঈর্ষা হয় না’কি?”
“হতেই পারে।”
ইনারা লজ্জামাখা হেসে মুখ ফিরিয়ে নেয়। চা’য়ে চুমুক দিয়ে বলে, “জায়গাটা একেবারে স্বপ্নের মতো তাই না?”
তবে সভ্য চোখ ফেরায় না ইনারার দিকে থেকে, “উঁহু, স্বপ্ন থেকেও সুন্দর।”
ইনারা তাকায় তার দিকে। চোখে চোখ মিলে। দৃষ্টিমিলনে হৃদয় কাঁপে। বাতাসে খেলা করার জন্য সভ্য খোঁপা থেকে ইনারার কেশ মুক্ত করে দেয়।

মুহুর্তে অবাধ্য চুলগুলো জ্বালায় ইনারাকে। সে বিরক্ত হয়ে বলে, “আপনার শান্তি নেই তাই না? আমায় জ্বালাতে খুব মজা লাগে আপনার।”
“তা লাগে। কিন্তু তোমাকে খোলা চুলে দেখতে আরও মজা লাগে। আমার হৃদয় কাঁপে।
কথাটা শুনে ইনারা চুপ করে গেল। সে মাথা রাখল সভ্যের কাঁধে, “এই শেষ কয়দিন আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটিয়েছি আমি। ইশশ আজ যদি বৃষ্টি পড়তো তাহলে সময়টা কত জাদুময় হয়ে যেত।”
কথাটা বলতেই সভ্যর চোখে ভেসে উঠলো সেদিনটা। যখন ইনারা পক্ষীর মতো দুইহাত ছড়িয়ে মুখ তুলে তাকিয়েছিল আকাশের দিকে। উপভোগ করছিল বৃষ্টির প্রতিটি জলের বিন্দু। আর সভ্য সেদিন এত সুন্দর এক কল্পনা করেছিলো। ইনারাকে কাছে পাওয়ার, তাকে ভালোবাসার। আজ এত বছর কেটে গেল অথচ এখানে এসে আজও সেদিনের প্রতিটি মুহূর্তের কথা মনে পড়ে তার।

বাহিরে না যাওয়া হলেও রিসোর্টেই বেশ মজা করে দুইজন। সারাদিন হাসি ঠাট্টায় কাটলো দুইজনের। রিসোর্টের মাঠে দোলনা দোলা, ছুটাছুটি করা, ঘুরে বেড়াতেই দিন কেটে গেল। বিকেলে তারা বের হলো আশেপাশে ঘুরতে। আশেপাশের চা বাগান, লেক এবং প্রকৃতির আরও কিছু সৌন্দর্য উপভোগ করল তারা। কিন্তু আফসোস গাড়ি থেকে নামতে পারে নি। কেউ তাদের চিনে নিলে সমস্যা। রাতে যখন দুইজনে ডিনার করে রিসোর্টে ফিরে তখন ইনারা দেখে তাদের রুমটা মোমবাতির আলো দিয়ে ভরা। চারদিকে বেলিফুলের ঘ্রাণ ম ম করছে। মেঝেতে, বিছানায় বেশিফুল ছড়ানো। এবং বিছানার মাঝখানে রাখা একটি সাদা রঙের কেক। কেক- লেখা, ‘Happy birthday maa…”
ইনারা এসব দেখে অবাক হয়ে বলল, “এসব কী?”
“আরে আজ আমার মা’য়ের বার্থডে আমি সেলিব্রেট করব না? তুমি কী ভেবেছ তোমাকে আমি একাই আমার মা’য়ের উপর অধিকার বসাতে দিব? তোমার মা’য়ের উপরও তো আমার অধিকার আছে না?”
সভ্য যেয়ে বসে বিছানায়।

ইনারা খুশিতে কিছু বলার শব্দ হারিয়ে ফেলে৷ সে বারবার অবাক হয় সভ্যের চিন্তার উপর। কিন্তু এবার সে আর আবেগী হয় না। এই খুশির সময়গুলো আবেগী হয়ে কাটানোর নয়। সেও যেয়ে বসে সভ্যের পাশে। আর দুষ্টুমি করে সভ্যের গালে কেক লাগিয়ে দেয়। আর হেসে বলে, “কেন দিব? আমি আমার দুইটা মা’কে নিজের কাছে রেখে দিব।”
“এত লোভ করা ভালো না বুঝেছে মহারাণী।”
“আমি তো করব। আরেকবার আপনার বাড়িতে যেয়ে নেই। পরিবারের সবাইকে আমার করে নিব। কেউ আপনাকে পাত্তাই দিবে না।”
“ছিঃ! এমনি এমনি তোমাকে জংলী বলি? আমার সব ছিনিয়ে নেবার চিন্তাভাবনা তোমার মাথায় ঘুরে তাই না?”
ইনারা খিলখিল হেসে উঠে। সভ্য ইনারার গালে হাত রেখে তার মুখ নিজের দিকে ফেরায়। চোখে চোখ রেখে বলেন, “সব ছিনিয়ে নেওয়ার পরও তো তুমি আমারই বউ থাকবে।”
সভ্য নিজের ক্রিম লাগানো গালটা ছোঁয়াল ইনারার গালে। সাথে সাথে ইনারা শিউরে ওঠে। লজ্জায় মেখে যায়। সে লজ্জামাখা চোখে সভ্যের দিকে তাকায়। সাথে সাথে সভ্য চোখ টিপ মেরে বলে, “এই লজ্জা পেলেই তোমাকে কেবল একটু মিষ্টি লাগে, নাহয় জংলী নাম্বার ওয়ান।”
ইনারা বিরক্ত হয়ে ধাক্কা দেয় সভ্যকে, “আপনি এত বাজে কেন?”
সভ্য হাসে, “আসো কেকটা কাটি। কাটার পর তো মহারাণী একাই সম্পূর্ণটা শেষ করে দিবেন।”
“আই উইশ।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনারা, “কিন্তু পুরশু থেক নতুন ফিল্মের শুটিং শুরু। তাই মেইনটেইন করতে হবে।”
“তা দেখা যাবে।”
এরপর দুইজনে মিলে কেক কাটে। একে অপরকে একটু করে খাওয়ায়।

পনেরো মিনিট পর সভ্য ইনারার দিকে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকে। তার অর্ধেক কেক খাওয়া শেষ। সভ্য ভ্রু নাচিয়ে বলে, “পুরশু থেকে না তোমার শুটিং শুরু?”
“হ্যাঁ, কেন?”
“তুমি না মেইনটেইন করবে?”
“ধ্যুর কী আছে জীবনে? এখন খেয়ে নেই। পরে ঘাসপুস খেয়ে ওজন কমায় নিব।”
“তুমি এক জিনিস বটে।”
হঠাৎ আকাশে ডাক দেয়। বাহিরর বজ্রপাতের শব্দ শোনা যায়। শব্দটা শুনতেই ইনারা হাতের কেক রেখে বারান্দায় যায়।

ব্যালকনিতে যেয়ে দেখে আকাশটা কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেছে। কালো মেঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশের বুকেতে। ইনারা বাচ্চাদের মতো উৎসুক হয়ে বলল, “দেখুন সভ্য আমি আজ সকালে বলেছিলাম আর বৃষ্টি নেমে পড়ল। আজ মনে হচ্ছে জোরেই বৃষ্টি হবে।”
সভ্য ইনারার পিছনে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। বলে, “তোমার মিষ্টি আবদার বৃষ্টিও ফেলতে পারে নি। বৃষ্টি থেকে ভালো আমার নয়নের সাগরে ভাসো।”
“এত চিজি লাইন পান কোথা থেকে বলেন তো?”
“আমি একটু রোমেন্টিক হতে নিলেই তোমার রোমেন্সে পানি ঢালা লাগবে তাই না?”
ইনারা পিছনে মুখ ফিরিয়ে ভেঙায় তাকে।

ঝুম বৃষ্টি ঝরে। মাতাল হাওয়ার সাথে বৃষ্টির জল ছুঁয়ে দেয় দুইজনকে। ভিজিয়ে দেয় খানিকটা। ইনারা বলে, “এখন তো এই বৃষ্টিতে আমি বিলাসী হয়েই ছাড়বো।”
সে সভ্যের বাহুডোর থেকে মুক্ত হয়ে ছুটে যায় নিচের খোলা জায়গায়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করে, “আপনি আসবেন না?”
“না মেডাম আপনিই বৃষ্টিবিলাসী হন। আমি আপনাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি।”
ইনারা নেমে গেল। ঝুম বৃষ্টির এক মুহূর্তের ছোঁয়াতেই ভিজে জবজবে হয়ে গেল। সে চোখ বন্ধ করে দুই হাত পক্ষীর ডানার মতো মেলল। আর অনুভব করতে থাকলো এই মাতাল বৃষ্টির ছোঁয়া।

সভ্য গ্রিলের বর্ডারে হাত রেখে তাকে দেখে মৃদু হাসি ঠোঁটের কোণে এঁকে রেখেছিল। ইনারা দুই হাত মেলতেই তার ঠোঁটের হাসি উড়ে গেল। তার মনে পড়লো চার বছর আগের কথা। সে মুগ্ধ হলো, মাতাল হলো। বৃষ্টির ছোঁয়ায় তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। মুগ্ধতায় ডুবে গেল সভ্য। এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে এগোল সে।
বৃষ্টিতে ভেজা তার সামনের চুলগুলো আঙুল দিয়ে আঁচড়ে পিছনে নিলো। ইনারার সামনে যেয়ে তার কোমরে হাত রেখে কাছে টেনে নিলো তাকে।

চমকে উঠে ইনারা। হঠাৎ এমন কিছু সে আশা করে নি। চোখ খুলে সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্যের এমন মাতাল দৃষ্টি কেমন শিহরণ জাগায় তার বুকে। সভ্য কিছুই বলে না। তবুও কেন যেন ইনারা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়।
সভ্য মৃদু হেসে তার ভেজা কেশের সাথে খেলা শুরু করে দেয়। বিরক্ত করে তাকে। তার চোখে, গাল, ঠোঁট আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেয়। অবশেষে চুমু খায় তার গলায়।
কেঁপে উঠে ইনারা। অস্থির হয়ে যায়। আঁকড়ে ধরে সভ্যের শার্ট। চেপে ধরে নিজের চোখ দুটো।
সভ্য মুখ তুলে তাকায় তার দিকে। গালে আঙুল বুলিয়ে মৃদুস্বরে বলে, “মহারাণী চোখ খুলুন।”
ইনারা ধীরে ধীরে চোখ খুলে। সভ্যের চোখে চোখ রাখতেই লজ্জায় মেখে যায়। সাথে সাথে সভ্য তার ঠোঁট দখলে নিয়ে নেয়।
এই মাতাল বৃষ্টির মাঝে সে ডুবে যায় সভ্যের ছোঁয়ার। তার বুকের ভেতর কেমন ধুকপুক করছে। সে যেন হারিয়ে ফেলছে নিজেকে সভ্যের মাঝে।

আচমকায় সভ্য তাকে কোলে তুলে নিলো। ইনারা বাঁধে দিলো না, বরং নীরব অনুমতি দিলো। এই বৃষ্টির রাতে মাতাল হলো। সভ্যের মাঝে ডুবে গেল।
.
.
শ্রীমঙ্গল থেকে দিল তার পরদিনই। ইনারার নতুন ফিল্মের শুটিং শুরু হয়ে গেছে। প্রথমদিন তার ভালোই লাগল। ভালো লাগার কারণও আছে৷ এখানে অন্তত আগের সিনেমার মতো বিপদ তৈরি করার জন্য আইজা বা জোহান নেই। এখানে সবার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। ওয়াসিন খান তো আসলেই তার জন্য সকাল থেকে কতগুলো মজার খাবার অর্ডার দিয়েছে। এমনকি দুপুরে তার ভ্যানিটিতে নিজে খাবার নিয়ে এসেছিল।

সারাদিন শেষে ইনারার লাস্ট সিন শ্যুট হলো। কাহিনীটা ফ্যান্টাসির। ইনারার ডার্ক কুইন লুক করা হয়েছে। তার সম্পূর্ণ পোশাক, মেকাপই কালো। কেবল তার গহনা এবং মুকুট ছাড়া। এইটাই ইনারার প্রথম লুক হবে। সারাদিনে তার কোনো দৃশ্যেই দুইটার বেশি রিটেক দিতে হয় নি। কিন্তু এই সামান্য ফার্স্ট সিনটার জন্য সে পনেরোবার রিটেক দিয়েছে। অথচ পরিচালকের মন মতো হয় নি। তারা দুইজন মিলে দৃশ্যটা আবার দেখছিল। কোথায় সমস্যা তা খোঁজার জন্য।

পরিচালক আজমল বললেন, “সম্ভবত আবার কাল এই সিন আবার রিটেক নিতে হবে। আমি শান্তি পাচ্ছি না।”
“ওকে স্যার। পার্ফেক্ট না হওয়া পর্যন্ত আমি রিটেক দিতে রাজি।”
“সব ঠিক আছে কিন্তু…” পরিচালক তাকালেন ইনারার দিকে। কেমন অদ্ভুত ভাবে। কিন্তু তার দৃষ্টিটা খারাপ নয়। ইনারার ভালো খারাপ যাচাই করার বুদ্ধি এখন হয়েছে। সে প্রশ্ন করে, “কিন্তু কী স্যার?”
“কিন্তু তোমার চোখে সে ভয়ানক বা হিংস্র ভাবটা দেখতে পারছি না। সম্ভবত তোমার চোখের মণির জন্য। তোমার নীল চোখটা বেশ শান্ত ও আবেগী ধরনের। এতে মায়া আছে, হিংস্র ভাবটা নেই।”
“লাল লেন্স পরলে কেমন হয়?”
আজমল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। মৃদুস্বরে বলে, “খারাপ না। তাই করো।”
“আপনাকে খুশি দেখাল না।”
সে কিছুটা চিন্তা করে বললেন, “ইনারা তুমি জানো এবার আমি তোমার অভিনয় দেখে তোমাকে সুযোগ দিয়েছি। কিন্তু এর পূর্বেও আমি তোমাকে সুযোগ দিয়েছিলাম। তখন তোমার অভিনয় এত ভালো ছিলো না। তুমি হারিয়ে যাওয়ায় অনেক দুঃখও পেয়েছি। তখন কেন তোমাকে সুযোগ দিয়েছি জানো?”
“কেন?” ইনারার চোখে কৌতুহল।
“কারণ তোমার চোখজোড়া আমাকে কারও কথা মনে করিয়ে দেয়। খুব কাছের কেউ।”
“কে স্যার?”
“বাদ দেও। সে এখন আর এই পৃথিবীতে নেই। বাই দ্যা ওয়ে, তোমার চোখগুলো খুব সুন্দর। তোমার পজিটিভ স্ক্রিনটাইমের জন্য আর লেন্স পরা লাগবে না। এই চোখই অনেক কথা বলে যাবে।”
“ধন্যবাদ স্যার। আপনার চোখগুলোও খুব সুন্দর। ধূসর কালো রঙের। আপনার দিনে এসব চোখের রঙের দেখা সহজে পাওয়া যেত না তাই না?”
“একদম। অনেক পপুলার ছিলাম আমার দিনে।” হাসলেন তিনি।
“শুনেছিলাম আপনি নাকি অনেক গম্ভীর মেজাজী। এখন দেখি কথাটা একদম মিথ্যা। কী সুন্দর হাসছেন আপনি!”
কথাটা শুনে আজমল সাহেব তাকালেন ইনারার দিকে, “আমি সহজে কারও সাথে হাসি ঠাট্টা করি না। জানি না আজ কি হলো। সম্ভবত তোমার মাঝে কাওকে খুঁজতে চাচ্ছিলাম। যাই হোক। বাদ দেও। আপাতত বাসায় যেয়ে রেস্ট নেও। কাল মর্নিং রুটিন আছে।”
“জি স্যার।”
.
.
ইনারা সেখান থেকে বাসায় গেল না। তার গাড়ি একটি বিল্ডিং এর সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। সে গাড়ি থেকে নেমে নিচতলার ফ্লাটের কলিংবেল বাজায়। আর হাত আড়া আড়ি ভাঁজ করে অপেক্ষা করতে থাকে দরজা খোলার।

“কে? কে এসেছে এ অসময়?” এক বিরক্তিভরা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো দরজার ওপাড় থেকে। কন্ঠের সাথে মিল রেখে একইরকম বিরক্তি ভাব নিয়ে দরজা খুলল এক মেয়ে। ইনারাকে দেখে যেন সে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে রইলো। তার নিশ্বাস যেন সে মুহূর্তেই আটকে গেছে।

ইনারা হেসে বলে, “অনেক বছর পর দেখা হলো অমৃতা। আমার কথা মনে আছে তো? আমি প্রিয়’র বেস্ট ফ্রেন্ড। তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক ভালো মতো মনে আছে। ভেতরে আসতে দিবে না।”
অমৃতা এক মুহূর্তটা লাগাল না দরজাটা ইনারার মুখের উপর বন্ধ করতে।
কিন্তু ইনারা মেজাজ খারাপ করল না। বরং হাসলো। আবারও কলিংবেল দিলো। বারবার দিলো। দরজার ওপাশ থেকে স্পষ্ট শব্দ শোনা যাচ্ছে, “কী এক অপয়ারে আনলাম বাড়িতে বউ কইরা। আমার পোলা মায়া কইরা একটা ধর্ষিতারে বিয়া কইরা আনলো। কিন্তু সে কী দিলো? একটা নাতি নাতনীর মুখ তো দেখাতেই পারে নাই। সারাদিন বইসা আমার পোলার টাকায় গিলতে জানে। দরজাও আমার খুলতে হয়।” একটু থেমে সে আবার বলল, “এই মাইয়া তুই দরজার সামনে দাঁড়ায় আসোস দরজা খুলোস না কেন? দেখি সর। আমিও দেখি কে মরসে যে এত কলিংবেল বাজায়।”
এবার দরজা খুললেন এক বৃদ্ধা। সে ভালো করে দেখল ইনারাকে। তারপর জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে কোথায় যেন দেখছি মনে হয়।”
ইনারা মিষ্টি হেসে সালাম দেয়, “আমি টুকটাক অভিনয় করি আন্টি।”
“অভিনয় করো? টিভিতে?”
“সিনেমায়।”
মহিলাটি চমকে বললেন, ” আমাদের বাড়িতে অভিনেত্রী আসছে? আমি এখনই সবাইকে ডেকে আনি।”
তিনি বেরোতে নিলেই থামায় ইনারা, “আপনি ব্যাপারটা কাওকে না জানালে খুশি হবো। আসলে অমৃতা আমার পরিচিত। তাই ওর সাথে দেখা করতে আসলাম।”
“পরিচিত?” সে পিছনে ফিরে অমৃতার দিকে মুখ বানিয়ে তাকায়। আবার বলে, “আচ্ছা তুমি ভেতরে আসো।”

ইনারা ভেতরে ঢুকে। ড্রইংরুমে বসে। মহিলাটি আবার বলে, “বাহিরের গাড়িটা তোমার?”
ইনারা মাথা নাড়ায়। মহিলাটি এবার উৎসুক ভাব নিয়ে বলে, “বলো কি? আমি তো জানতামই না আমার বউয়ের এত বড়লোক কারও সাথে পরিচয় আছে। তুমি আমার বউয়ের সাথে বসো। আমি তোমার জন্য চা নাস্তা আনি।”
ইনারা কথায় সায় দিলো।

মহিলাটি যাবার পর ইনারা তাকায় অমৃতার দিকে। সে ভয়ে পাথর হয়ে গেছে। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ইনারা পা’য়ের উপর পা তুলে বলে, “দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।”
অমৃতা বসল না। ইনারা হেসে বলল, “মাতৃত্ব একটা পবিত্র জিনিস৷ এ নিয়ে খারাপ কিছু বলা উচিত না। কিন্তু তোমার শাশুড়ির কথা শুনেছি বাহির থেকে। তোমার না-কি বাচ্চা হয় না। তোমার কি মনে হয় একটা মা’য়ের কোল খালি করে তুমি মাতৃত্বের স্বাদ পাবে? উপরওয়ালা এক না একদিন সবাইকেই কর্মের পরিণতি দেখায়।”
অমৃতা ঢোক গিলল। অনেক সাহস করে বলল, “প্লিজ আপনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।”
“বেরিয়ে যাব? আমি তো তোমাকে একটা অফার দিতে এসেছি।”
অমৃতা জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
ইনারা বলে, “আমি চাই তুমি সব সত্যিটা মিডিয়ার সামনে স্বীকার করো। যে প্রিয় তোমার কোনো ক্ষতি করে নি। আর এসব তোমাকে দিয়ে কে করিয়েছে তাও স্বীকার করো।”
“আমি এতটাও বোকা না যে নিজের সুখের জীবনটা এভাবেই বিসর্জন দিব। প্রি..প্রিয় এখন আর নেই। ওর জন্য আমি নিজের জীবন শেষ করতে পারব না। প্লিজ আমি এখানে অনেক সুখে আছি। আমার জীবনে আর হস্তক্ষেপ করবেন না।”
“একটু আগে তোমার শাশুড়ির কথা শুনে মনে হয় নি তুমি সুখে আছো। আর তোমার স্বামী যে তোমাকে অবলা ভেবে বিয়ে করেছে, তার কানে সত্যিটা গেল কী হবে একবার ভাবো। আমি তোমাকে পঁচিশ লক্ষ টাকা দিব। সাথে তোমার কোনো শাস্তি হবে না। অফারটা খারাপ না। ভেবে দেখো।”
অমৃতা কিছু মুহূর্তর জন্য কথা বলতে ভুলে গেল। অবশেষে তার মুখ দিয়ে বের হলো, “আমার আপনার কথায় বিশ্বাস হচ্ছে না। শেষ মুহূর্তে যদি নিজের কথা থেকে ফিরে যান?”
ইনারা বাঁকা হাসে, “ইনারার কথার দাম আছে। সে মানুষকে কথা দিলে তা রাখতে জানে। এখন তুমি সিদ্ধান্ত নেও। টাকা পেয়ে নিজের শাশুড়ীর কটু কথা বন্ধ করবে, না’কি তোমার স্বামীকে ব্যাপারটা জানানোর পর ঘর থেকে বের হয়ে ব্যাপারটা নিয়ে ভাববে?”

চলবে…

[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে