অনুভবে ২ পর্ব-২৪

0
854

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ২৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

কলেজের বাহিরে দাঁড়ানো ইনারা ও সুরভি। দুইজনে কথা বলছে। হাসী-ঠাট্টা চলছে। প্রিয় তাদের জন্য আইস্ক্রিম এনে বলল, “আমাকে ফ্রী ফ্রী পেয়ে যে কত কাজ করাস। তোদের দুইটাকে বিয়ের পর খাটতে খাটতে দিন কাটাতে হইবো দেখিস।”
ইনারা ভেংচি কেটে বলল, “তোর মতো জামাইকে দিয়েও এমন খাটামু আর নিজে বইসা বইসা রাজত্ব করব।”
সুরভিও তাল মেলায় ইনারার সাথে, “তাইলে কি? বিয়া কি কাজ করার জন্য করমু না’কি? কী ছাগলের মতো কথাবার্তা!”

“কলেজ ছেড়ে গল্প করা হচ্ছে দেখি।” মেয়েলি এক কন্ঠ শুনে তিনজনে পাশে তাকায়। আইজাকে দেখে ইনারা বলল, “ক্লাস শেষ আপু। টাকলা স্যার…মানে সহিভ স্যার অসুস্থ তাই ছুটি দিয়ে দিসে। আইস্ক্রিম খাবা?”
আইজা হাসে। ইনারার ঠোঁটের পাশের আইস্ক্রিম মুছে না, “তুই-ই খা।”
প্রিয় তার আইস্ক্রিমটা আইজার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “আপু আমারটা নেন। আমার এমনিতেই আইস্ক্রিম আহামরি পছন্দ না।”
“আরে না। লাগবে না।”
“আপু প্লিজ। আমার অনুরোধ রাখবেন না?”
আইজা হেসে আইস্ক্রিমটিতে হাত দিতেই দেখলো সাদা রঙের আইস্ক্রিমটি লাল রক্ত হয়ে মাটিতে পড়ছে। আইস্ক্রিম ধরা প্রিয়’র হাতের চামড়া গলে যেয়ে ভেতরের মাংস স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে চকিতে তাকাল প্রিয়র দিকে। আশেপাশের সকল মানুষ, বিল্ডিং কালো হতে শুরু করল। প্রিয়’র মিষ্টি চেহেরাটা ভয়ানক রূপ নিতে শুরু করল। চোখদুটো বড় বড় হয়ে এলো। চোখের মণিটা আর নেই। ঠোঁটে কেমন ভয়ানক হাসি। মুখটা প্রথমে ধবধবে ফর্সা পরক্ষণেই কালো এবং অবশেষে লাল রক্তে ভরে গেল। চামড়া গলে গলে নিচে পরছে। আইজা চিৎকার করে পিছিয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে চিৎকার করতে থাকে। যখন চোখ খুলে আশেপাশে কেউ থাকে না। সে গভীর নিশ্বাস ফেলে। তার নজর যায় নিজের হাতে। তার হাত রক্তাক্ত। সে কাঁপতে শুরু করে। তার হাতে কি প্রিয়’র রক্ত লাগানো?

স্বপ্ন ভাঙতেই উঠে বসে আইজা। এসির মধ্যেও ঘাম এসে জমেছে তার কপালে। সে কাঁপছে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিতে যেয়ে তা পরে যায় মেঝেতে। ভয়ে তার জান বেরিয়ে যাচ্ছি। এমন স্বপ্ন সে এ কয়বছরে কতবার দেখছে হিসেব নেই। হয়তো তার কর্মের ফলই তার পিছু ছাড়ছে না। না, এটা তার ভাবা উচিত না। এই চিন্তা থেকে নিজেকে কত আটকানোর চেষ্টা করে সে। পারে না। মুক্তি পেতে চায় সে এই ভয় থেকে। তাও পারে না। দিনদিন এই ভাবনা তাকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে। কিন্তু তার কিছু করার নেই।
প্রতি মুহূর্তে তার মনে হয় কেউ তাকে দেখছে। প্রিয় তাকে দেখছে।
.
.
ইনারার রুমে আসতে রাত একটা বাজল। সভ্যর এতক্ষণে ঘুমিয়ে যাবার কথা। একটু আগে যা হলো তারপর সভ্যর সাথে চোখ মেলাতে কেমন লজ্জা করছে তার। রুমে ঢুকে দেখে আসলেই সভ্য শুয়ে পড়েছে। সে শান্তির নিশ্বাস ফেলে। মা বলেছেন এই লেহেঙ্গাটা নিজের কাছে রাখতে। তাই নিজের হাতের লেহেঙ্গাটা আলমারিতে রেখে নিজেও যেয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুমানোর পূর্বে সভ্যের দিকে তাকিয়ে তার কপালের আসা চুল আলতো করে সরিয়ে দিলো। তারপর মৃদু হেসে গাল টেনে বলল, “ঘুমানোর সময় কত কিউট লাগে। আর জেগে থাকলে আমায় জ্বালিয়ে মারে।”
সে হাত সরাতে নিলেই সভ্য তার হাত ধরে নেয়। চোখ খুলে তাকায় ইনারার দিকে, “আমি আপনাকে জ্বালালাম কখন মহারাণী?”

ইনারা চমকে উঠে, “আপনি না ঘুমাচ্ছিলেন?”
সভ্য ইনারাকে একটানে নিজের কাছে নিয়ে আসে। তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে, “তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। তুমি তো আমার ঘুমানোর অপেক্ষাতেই মা’য়ের কাছে যেয়ে এতরাত পর্যন্ত বসে ছিলে তাই না?”
“আ…আপনার ভয়ে সেখানে বসে থাকব কেন? আপনি কী বাঘ না ভাল্লুক?”
“সেটা তুমি জানো। আমি কীভাবে বলব বলো?”
সভ্য ইনারার ঠোঁটের একপাশে চুমু খেল তাকে জ্বালানোর জন্য।

সাথে সাথে ইনারা স্তব্ধ হয়ে যায়। জড়োসড়ো হয়ে যায়। সভ্য কাঁধে, গলায়, চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে , “আমার ঘুমানোর অপেক্ষা তোমার কেন করা লাগবে? আমাকে তো তুমি সারাদিন দেখতে পারো। মুখের উপর কিউটও বলতে পারো। আমি কিছু মনে করব না।”
“কিউট না ছাই। ব্যাঙের মতো দেখতে। লুচ্চামি করবেন না ছাড়েন তো।”
“লুচ্চামি? ছিঃ নিজের স্বামীকে কেউ এভাবে বলে? আমি তো আদর করছি মহারাণী।”
“আদর লাগবে না আমার। নিজের হাত সামলান। এমনিতেই আগামীকালের চিন্তায় মরছি আমি।”
সভ্য হাসে, “নিজের সিনেমাতে ঢোকা, প্রতিশোধ নেওয়া, এরপর সিনেমাটা রিলিজ হবার পর জনগণের প্রতিক্রিয়া নিয়েও তোমার এত ভয় ছিলো না। যা দাদীজানকে পাচ্ছো।”
ইনারা ছোট এক নিশ্বাস ফেলে। সভ্যের বাহুতে মাথা রাখে। তার পরা পাঞ্জাবিটা হাতের মুঠোয় আঁকড়ে রেখে বলে, “ভয় পাচ্ছি না। কিন্তু দাদাজানকে কথা দিয়েছিলাম তার জন্য একটু চিন্তিত। এছাড়া সে আপনার পরিবার। তাদের আমাকে মেনে নেওয়াটাও তো প্রয়োজন।”
সভ্য আজ বহুদিন পর শান্তির নিশ্বাস ফেলে। ইনারার স্বভাব দেখে এখন আর তার ডিভোর্সের ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা নেই। নিশ্চিত ইনারার মাথা থেকে সে ব্যাপারটা চলে গেছে। এই তো সে চাইতো। এ কথা ইনারার সামনে আর কখনো তুলবে না সে। আচ্ছা ইনারাকে কি বলা উচিত এক সময় সভ্য তাকে ভালোবাসতো? না থাক। যদি এতে আবার ইনারা তার থেকে দূরে সরে যাক। ইনারার মনে আগে তার প্রতি ভালোবাসা আসুক। যেদিন ইনারা নিজে বলবে সে সভ্যকে ভালোবাসে, সেদিন ইনারার সামন নিজের সকল অনুভূতি খুলে বলবে।

“সে বিষয়ে তোমার এত চিন্তার দরকার নেই। একদিনেই সবাই তোমাকে অনেক পছন্দ করেছে। রইলো ফুপির কথা, সে আজ পর্যন্ত আমার মা’য়ের পিছু ছাড়ে নি আর তুমি তো নতুন। তাকে মানানোর প্রয়োজন নেই।”
“আর দাদীজান?”
“আগামীকাল দেখো কি হয়। মেনে গেলে তো ভালো, নাহয়…. ”
” নাহয় আপনার একটা কাজ করতে হবে।”
“কী?”
“তা নাহয় আগামী কালই বলব।”
.
.
সকাল সকাল ফিল্মের সেটে যায় আইজা। শুটিং এর জন্য তার মেকাপ করা হচ্ছে। সাইদ তার ভ্যানিটি ভ্যানে ঢুকে সবাইকে বাহিরে পাঠাল। আইজা উঠে সাইদের কাছে এসে বলল, “বাহ অবশেষে আজ আমার সাথে একা সময় কাটাতে ইচ্ছা হলো তোমার?”
আইজা এসে সাইদের গলা জড়িয়ে ধরে । সাইদ তার হাত নিজের হাতে নিয়ে সরাসরি বলে, “আইজা চলো না আমরা বিয়ে করে নেই।”
“হোয়াট?” আইজা তার হাত সরিয়ে নেয় সাইদের হাত থেকে, “হঠাৎ এ কথা আসছে কোথা থেকে?”
“মা, বাবা অনেক প্রেশার দিচ্ছে আমাকে। তাদের কসম দিচ্ছে। এর উপর সুরভি তো বলেই দিয়েছে আমি বিয়ে না করলে ও নিজেও বিয়ে করবে না।”
“তাহলে আমার সাথে বিয়ে করলে সবাই মেনে নিবে? ফালতু কথা বলো না তো সাইদ।” আইজা আবার যে চেয়ারে বসলো।
“আমি মানিয়ে নিব। আমার যা করা লাগে আমি তা করবো।” সাইদ যেয়ে আইজার সামনে বসে, “তাও আমার সাথে বিয়ে করে নেও। নাহলে যে মা বাবা আমাকে অন্য মেয়ের সাথে বিয়ে করিয়ে দিবে। তারা মেয়েও দেখে রেখেছে।”
“তাহলে বিয়ে করে নেও।”
সাইদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে, “কী? তুমি কী বললে আইজা?”
“তুমি বিয়েটা করে নেও। আমাদের বিয়ে হলে আমরা কেউ সুখে থাকব না। তোমাকে বিয়ে করলে আমার স্বপ্ন, শখ, ক্যারিয়ার সব যাবে। আর আমাকে বিয়ে করলে তোমার পরিবার। দুইদিকেই ক্ষতি।”
সাইদ আঁতকে উঠে, “লাভ ক্ষতি দিয়ে ভালোবাসা হয় না’কি? তুমি আমাকে ভালোবাসো না আইজা?”
আইজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে সাইদের দুইগালে হাত রেখে শান্ত গলায় বলে, “এই পৃথিবীতে আমি মা বাবার পর কেবল তোমাকে ভালোবাসি সাইদ। কিন্তু কেবল ভালোবাসা দিয়ে জীবন চলে না। ভবিষ্যতে যখন আমরা সব হারিয়ে একসাথে থাকব তখন আর এই ভালোবাসা থাকবে না। থাকবে একে অপরের উপর ক্ষোভ। সব হারানোর ক্ষোভ। আর ভালোবাসার শেষ গন্তব্য বিয়ে তা কোথায় লেখা আছে? আমি জানি তোমার জীবনে যে মেয়েই আসুক না কেন তুমি কেবল আমাকে ভালোবাসবে। এটা আমার বিশ্বাস। আর আমিও ওয়াদা করছি এই জীবনে আমি কেবল একটি পুরুষকে ভালোবাসব। সে হলো তুমি। তুমি বিয়ে করে নেও সাইদ। কেবল একটা জিনিস মনে রাখবে। বিয়ে করার অনুমতি তোমার আছে, অন্যকোনো মেয়েকে ভালোবাসার নয়।”
.
.
ঘুম থেকে উঠে ইনারা দেখে সকাল নয়টা বাজে। সকালে উঠে তার সুজির হালুয়া বানানোর কথা ছিল। কিন্তু এই ঘুমের চক্করে আর হলো না। সময় দেখে এক লাফে উঠে সে। শাড়ী পরল। তারপর দৌড়ে গেল নিচে। যে দেখে অলরেডি নাস্তা শুরু হয়েছে। সভ্যর মা তাকে দেখে বলল, “আরে ইনারা উঠে গেছ? আসো, নাস্তা করে নেও। তোমাকে আধাঘন্টা আগে উঠাতে গিয়েছিলাম কিন্তু অনেক গভীর ঘুমে ছিলে তাই উঠাই নি। কী মিষ্টি দেখাচ্ছিলো ঘুমে। ভাবলাম পরেই নাস্তা করে নিবি।”
সভ্য খাবার খেতে খেতে বলল, “লেডি কুম্ভকর্ণ।”
ইনারা চোখ রাঙ্গিয়ে তার দিকে তাকায়। সকলের সামনে কিছু বলে না। সে মা’কে বলে, “সরি মা আমি ভেবেছিলাম সকলের জন্য সকালে উঠে কিছু মিষ্টি বানাবো কিন্তু তা আর হলো না।”
দাদীজান গম্ভীর গলায় বললেন, “উদাস হবার কিছু নেই। গতকাল সন্ধ্যায় সভ্য বলেছিল তুমিই না’কি ঘরে রান্না করো। অনেক ভালো রান্না জানো না’কি। আজ তুমি দুপুরের খাবার রান্না করবে। আমরাও তো দেখি আমার নাতির বউ কেমন ভালো রান্না জানে।”
কথাটা শুনে ইনারা কিছু মুহূর্তের জন্য নিজের মধ্যেই ছিল না। সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল দাদীজানের দিকে। আসলে ঠিক শুনেছ কিনা তা নিশ্চিত হবার জন্য জিজ্ঞেস করে, “দুপুরের সম্পূর্ণ খাবার আমি তৈরি করব?”
“হ্যাঁ। কেন পারবে না?”
“পারবো না কেন? ভালো করেই পারব।” সে সভ্যের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন এখনই কাঁচা গিলে খাবে।

সভ্যও তার তাকানো দেখে ভয়ে চোখ নামিয়ে নেয় এবং দ্রুত খাবার খেতে শুরু করে। সে যেয়ে বসে সভ্যের পাশের চেয়ারে। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলে, “আমার তো আপনাকে কুঁচিকুঁচি করে কেটে পাতিলে সিদ্ধ করে ভর্তা করতে মন চাইছে।”
সভ্য আমতা-আমতা করে বলে, “ওই গতকাল তুমি কথা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে না তাই রাগ করে ভুলে মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে।”
“ভুলে আপনার উপর এক পাতিল গরম পানি ঢেলে দিয়ে আমার মন ঠান্ডা করি তাইলে?”
সভ্য হাসে, “তুমি তো পানিও গরম করতে পারো না।”
ইনারা জোরে লাথি দেয় তার পা’য়ে। যা সভ্য মুখ বুঝে বহু কষ্টে সহ্য করে। রাগে কটমট করে তাকায় সে ইনারার দিকে, “আসলেই তুমি একটা জংলী।”
“আপনি তো কত ভালো তাই না? ভালো ফাঁসাইছেন। এরপর আইসেন আমার কাছে ভর্তা না বানালে আমার নাম ইনারা না।”

দাদীজান দুইজনকে ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে বলে, “খাবারের টেবিলে খাবারে মনোযোগ দেও। কথাতে না।”
দাদাজান বলেন, “ওদের দেখলে না আমার, তোমার আমার দিনগুলো মনে পড়ে যায়। তোমার মনে আছে আমরাও সুযোগ খুঁজতাম কথা বলার জন্য?”
“বাচ্চাদের সামনে কিসব বলেন আপনি? লজ্জা লাগে না। খান চুপচাপ।”
দাদাজান ভয়ে সে যে খাবারের প্লেটের দিকে তাকালেন আর মাথা উঠালেন না।
সভ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “বউকে তো বাঘও ভয় পায়। আর আমার মতো নিরীহ স্বামীদের উপর অত্যাচার হতে থাকে। আহারে!”
.
.
দুপুরের খাবারের সময় হলো। ইনারা তার ফোনে খাবারের ভিডিও দেখে রান্না করার চেষ্টা করলো। তবুও সে নিশ্চিত একটা খাবারও আহামরি ভালো হয় নি। যদিও কিছু জায়গায় মা সাহায্য করেছে বলে দেখতে খারাপ না হলেও মশলা দিয়েছে সে। এই জায়গাতেই ভেজাল লাগবে সে নিশ্চিত। এই রান্নার চক্করে সে তার হাত তিন চারবার পোড়াতে নিয়েছে। ভাগ্যিস সেখানে আরও লোক ছিলো বলেই তার কিছু হয় নি। আজ রাতেই যেহেতু তারা রওনা দিবে সেহেতু এই কিছু ঘন্টার মধ্যেই দাদীজানের মন জয় করতে হবে তার।

খাবার টেবিলে দেওয়া হলো। এক এক করে সব খারাপ পরিবেশ করা হলো। সবাই এসে খেতেও বসে। বাবা বলে, “খাবারের ঘ্রাণ তো ভালো আসছে। আমি তো তর সইতে পারছি না খাবার জন্য।”
ফুপি মিটিমিটি হাসে। সে পাশে বসা মিনুকে বলে, “খাবার মুখে দিতেই সবাই মুখ থেকে বের করে দিবে দেখিস।”
“এভাবে বলছ কেন মা? ভালোও তো হতে পারে।”
“হবে না। রান্না শেষে যখন রান্নাঘরে কেউ ছিলো না তখন আমি সব খাবারে লবণ, মরিচ আর জিরাগুঁড়া দিয়ে ভরে দিসি।”
“কী দরকার ছিলো এসব করার? ভাবি এত কষ্টে সব রান্না করল আর তুমি…”
“চুপ। আসছে ওই বেয়াদব মেয়ের গুনগান গাইতে। এর পর দেখব আমার উপর কীভাবে কথা বলে। তামাশা দেখ শুধু।”

ইনারা সকলকে খাবার প্লেটে দেয়। সবাই উৎসুক হয়ে খাবার মুখে দেয় কিন্তু সাথে সাথে মুখ থেকে বের করে নেয়। বাবা তো তারকারি খেয়ে পানির জন্য লাফিয়ে উঠে।
দাদীজান বলে, “এসব কী রান্না করেছ তুমি? এসবকে খাবার বলে?”
ইনারা করুণ দৃষ্টিতে তাকায়, “কেন দাদীজান ভালো হয় নি?”
“ভালো? জঘন্য হয়েছে।”
ফুপিও তাল মেলায়, “ছিঃ! ছিঃ! এসব কি বাজে। খাবার মতো না।”

“আপনি তো খাবার মুখেই৷ তুললেন না ফুপি। কীভাবে বুঝলেন খাবার মজার কি-না?” সভ্য জিজ্ঞেস করে।
“না মানে…”
“আমিই বলছি। বলছি না, দেখাচ্ছি।”
সভ্য ফোন বের করে সবাইকে একটি ভিডিও দেখায় যেখানে তার ফুপি রান্নাঘরে যেয়ে খাবারে মশলা আর লবণ ভরে ভরে ঢালছিল। ভিডিওটা দেখে সবাই বড় বড় চোখ করে তাকায় ফুপির দিকে। দাদাজান ধমক দিয়ে উঠে। ফুপিকে বলে, “এসব কী দেখছি আমি? বাচ্চা একটা মেয়ে, এত কষ্টে এতকিছু রান্না করল সকাল থেকে আর তুই….”
ইনারা তাকে থামায়, “দাদাজান থাক। বকা দিয়েন না ফুপিকে।”

সভ্য রাগান্বিত সুরে বলে, “ওকে এখানে আনাটাই ভুল হয়েছে আমার। গতকাল থেকে ও সবার মন জয় করার জন্য এতকিছু করছে তাও এসব হলো। আমি ভেবেছিলাম ওর পরিবার নেই। এখানে এসে একটা পরিবার পাবে কিন্তু…. না আমরা আর এখানে থাকবো না।”
সভ্য উঠে ইনারার হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতে নিলেই বাবা তাকে থামায়, “না বাবা। এতকিছুর পরও যখন দাদীজানের মন গলে নি। ফুপি এতকিছু করার পরও যখন সে কিছু বলছে না তখন আর না। হয়েছে। মেয়েটা তো খারাপ কিছু করে নি। কেবল সবার ভালোবাসা চেয়েছিল।”
ইনারা তাকে থামায়, “এভাবে যাওয়া উচিত না সভ্য। জেদ করো না।”
“এতকিছুর পরও তুমি… ”
“থাক ফুপি যদি এতে খুশি হয়। থাক।” এবার সে কান্না করতে শুরু করে দেয়, “আমার তো কেবল আফসোস লাগছে দাদীজানের কথা রাখতে পারি নি আমি।” বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে, “সরি দাদীজান।”
এবার আর দাদীজানের মন শান্ত থাকতে পারে না। সে উঠে যায়। ইনারার চোখ মুছে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, “আরে এই রান্নার জন্য কেউ এভাবে কাঁদে। তুমি আমার জন্য এত কষ্টে রান্না করেছ আমি এতেই খুশি।”
“সত্যি দাদীজান? আপনি রাগ না তো?”
ইনারা দাদীজানের কাঁধে মাথা রেখে তার সামনে দাঁড়ানো সভ্যের দিকে চোখ টিপ মারে।

সভ্য নিজের হাসি লুকানোর জন্য অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ভিডিওটা তাকে পাঠিয়েছিল ইনারাই এবং কিভাবে পরিবারের কথা তুলে রেগে তাকে নিয়ে যেতে হবে তাও শিখিয়ে দিয়েছিল। অথচ এখন এমন নাটক করছে যে দাদীজানের মনও গলিয়ে দিলো।

“তোমার দোষ না থাকলে তোমার উপর কেন রাগ করব? যার দোষ তার শাস্তি হবে।” দাদীজান ইনারাকে ছেড়ে তাকালেন ফুপির দিকে, “তোর এই কাজের শাস্তি পরে দিব। এখন তোর একসাপ্তাহ ঘুরা হয়েছে না? এখন নিজের শশুড়বাড়ি চলে যা।”
“মা তুমি আমার কথা তো শুনো।”
“আমার আর কিছু শোনার নেই। লজ্জা লাগে নি তোর এসব করতে? আমি তোকে নিজের চোখের সামনে দেখতেও চাই না। আর অভ্রর মা, বাহির থেকে খাবার আনাও। এনে সবাইকে ডাক দিও। আজকের এই কান্ডে আমার মাথা গরম হয়ে গেছে।” সে ইনারার গালে হাত রেখে নরম সুরে বলে, “আর তুমি যেয়ে আরাম করো। আর কাঁদবে না। বুঝেছ?”
ইনারা মাথা নাড়ায়।

এক এক করে সবার যাওয়া হলে ইনারা তার কান্নামাখা মুখ হঠাৎ পরিবর্তন করে একগাল হাসি আঁকে। ছুটে এসে ফুপিকে জড়িয়ে ধরে। তাকে ছেড়ে গালে একটা চুমু দিয়ে বলে, “থ্যাঙ্কিউ ফুপি। আপনি তো বেস্ট।”
ফুপি যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ইনারার দিকে। যে এই কিছুক্ষন আগেও ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সে এখন হাসিতে মেতে আছে। ইনারা আবার বলে, “হয়েছে কি ফুপি আমি তো রান্নার ‘র’ ও পারি না।”
“হে!” ফুপি চোখদুটো বড় করে বলল।
“হে নয়, হ্যাঁ। এখন রান্না তো এমনিতেই জঘন্য হতো। আপনি এসে এই মসলাপাতি মিশিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন। সাথে দাদীজানের মনও গলিয়ে দিলেন। মা’য়ের ফোন রান্নাঘরে ছিলো তা নিতে এসেই আপনার কান্ড দেখি আর রেকর্ড করে পাঠাই সভ্যকে। এরপর তো যা নাটক করলাম তা তো দেখলেনই। আপনি না থাকলে আরও খাঁটতে হতো। আচ্ছা একটা কথা বলেন আপনি কি প্রতিদিনই এমন ষ্টুপিড কাজ করেন না আজ বিশেষ দিন ছিলো? মানে সাধারণত এমন ষ্টুপিডিটি দেখতে পাই না তো।”
“মুখ সামলে কথা বলো। আমি মা’কে এসব বলে…”
ইনারা তার কথা কেটে হেসে বলে, “আপনার মনে হয় এসব দেখার পর দাদীজান আপনার কথা বিশ্বাস করবে? অসম্ভব। উনি কি বলেছে শুনেন নি? গেইট আউট হন। আর শুনেন, এই বাড়ি, এই বাড়ির লোকজন এখন আমারও পরিবার। আসলে ভালোমতো থাকবেন, নাহলে আমি আপনার সাথে কি করব তা কল্পনাও করতে পারবেন না। বিশেষ করে আমার মা’য়ের সাথে বেয়াদবি করলে আপনাকে এত সহজে ছাড়বো না আমি। জীবনটা জাহান্নাম করে দিব। তারপর আফসোস করতে থাকবেন, কেন আমার সাথে লড়াই করতে গেলেন। বিশ্বাস করেন, অনেকে সময় থাকতে না শুধরে এখন এটাই আফসোস করে। আপনি আমার ফুপি শাশুড়ী বলে স্পেশাল ওয়ার্নিং দিলাম। ও বাই দ্যা ওয়ে, থ্যাঙ্কিউ সো মাচ। আপনার জন্য দাদীজান আমাকে মেনে নিবে।”
বলে ইনারা তাকে আরেকটা চুমু দিয়ে চলে যায়।

ফুপি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই। বলে, “বাবারে মেয়েটা আসলে ডেঞ্জারাস। আমি এখনই চলে যাই, নাহলে আমার এ ঘরে আসাও বন্ধ করিয়ে দিবে।”
.
.
ইনারা রুমে যেয়ে দেখে সভ্য দরজাতেই তার অপেক্ষা করছে। তাকে দেখে সভ্য তার ভ্রু কপালে তুলে জিজ্ঞেস করল, “নিজের সব প্ল্যান করলে। কিন্তু যেভাবে কাঁদছিলে আমিই এক মুহূর্তের জন্য ভয় পেয়ে গেছি।”
“এমনিতেই অভিনেত্রী হয়েছি না’কি? অভিনয় করা তো আমার রক্তে আছে।”
“আর আমার অভিনয়ের মূল্যটা কে দিবে শুনি?”
ইনারা ড্রেসিং টেবিলের নিজের কানের দুল খুলতে খুলতে বলল, “ফাঁসিয়েছে কে আগে শুনি? আপনি এইটা নাটকে অংশগ্রহণ না করলে, আমি যে আপনাকে কি করতাম তা বুঝতে পারছেন।”
“খুব ভালোভাবে।” সভ্য এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ইনারাকে।
ইনারা বলে, “শুধু আমার কাছে আসার সুযোগ খুঁজেন না? আমাকে ফাঁসানোর সময় তো এসব মনে থাকে না।”
সভ্য হাসে। ইনারার কাঁধে মাথা রেখে তাকে আয়নায় দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে বলে, “তোমাকে শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগে। যদিও সবকিছুতেই সুন্দর লাগে। কিন্তু শাড়ি পরলে আর নিজেকে আটকাতে পারি না।”
“সকাল থেকে এই অবস্থায় রান্নাঘরে আছি। আয়নাকে দেখে নিজেকে ভয় পেলাম। আর আপনার কাছে আমাকে সুন্দর লাগছে?”
সভ্য মৃদু হাসে, “হুম, খুব সুন্দর লাগছে। ভালো কথা, তৈরি হয়ে থাকো। আগামীকাল সকালে একটি স্যারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে