অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ১৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“তুমি বলেছিলে না আমি তোমার স্বামী। তোমার কাছে আসার, তোমার নয়ন সায়রে ডোবার, তোমায় ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার কেবল আমার আছে। অন্যকোনো পুরুষ তোমায় ছুঁলে আমার সহ্য হয় না।”
সভ্যের কথায় ইনারা চোখ নামিয়ে নেয়। তার নিয়ন্ত্রিত হওয়া পছন্দ না। তার জীবনের সিদ্ধান্ত কেবল সে নিজে নিতে পারবে। কিন্তু সভ্যের তাকে আয়ত্ত করাটা কেন যেন ভালো লাগে তার। সে মৃদু হাসে। কিন্তু তার এই খুশিটা প্রকাশ করে না। সভ্যকে উল্টো বলে,
“এখন আপনি তো আমার হাতে এই মলম লাগিয়ে দিলেন। খাব কীভাবে?”
“তুমি এখনো খাও নি?”
“সন্ধ্যা থেকেই তো কেক বানাচ্ছি। খাব কীভাবে? খিদে লেগেছে।”
সভ্য হেসে উঠে যায়। ডাইনিং রুম থেকে খাবার এনে খাইয়ে দেয় ইনারাকে। খাওয়ানোর সময়ই সভ্য বলে, “সরি। আমারও তোমার সাথে এভাবে ব্যবহার করা উচিত হয় নি।”
“একদম ঠিক বলেছেন। কিন্তু সরি বললে তো হবে না। ঘরের যা ময়লা হয়েছে সব আপনার পরিষ্কার করতে হবে।”
আদেশ দেয় ইনারা।
সভ্য ভ্রু কপালে তুলে অবাক হয়ে বলে,
“ভালোই তো, আমাকে সরি বলাতেই আমি মেনে গেছি। আর তোমার থেকে সরি মঞ্জুর করানোর জন্য আমার এই যুদ্ধের ময়দান পরিষ্কার করতে হবে?”
“মেয়েদের মানানো এত সহজ না বুঝলেন জনাব?”
সভ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “বুঝলাম। তোমাকে খাইয়ে কাজ শুরু করে দিচ্ছি।”
.
.
জোহানকে নিয়ে কথাগুলো বলার পর সভ্য আর ইনারার উপর প্রশ্ন উঠায় না। কিন্তু ইনারা চায় যেন সভ্যের মনে কোনো রকমের প্রশ্ন না উঠুক তার এবং জোহানকে নিয়ে। একারণে জোহানের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ জোগাড় করতে বলে সে রহমানকে। আইজার সাথে তাকেও শিক্ষা দিবে সে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সে এমন কিছুই পায় না। গত সাড়ে তিনবছর ধরে তার কোনো খারাপ রেকর্ডই পাওয়া যায় না। এমনকি আইজা ছাড়া অন্যকোনো মেয়ের সাথে তার নামও জড়িত হয় নি। ইনারা বিরক্ত হয় প্রচুর। আইজাকে আসলেই ভালোবেসে সব ছেড়ে দিলো না’কি জোহান?
এর মধ্যে ইনারার শুটিং এর তারিখ এসে পড়ে। তাকে এক বছরের কন্টেক্ট-এ সাধারণ একটা কোম্পানির আন্ডারে নেওয়া হয়। যেন ভবিষ্যতে সে বড় কোনো কোম্পানিতেও যেতে পারে এই ব্যবস্থা করে দেয় সভ্য। জুলি নামের এক মেয়ে তার এসিস্ট্যান্ট হিসেবে জয়েনও করে। মেয়েটিকে সাধাসিধা মনে হয়। গোল চেহেরা। চোখেও গোল গোল চশমা পড়ে সে।
শুটিং এর প্রথম দিনেই মেজাজ খারাপ হয় তার। একই সেটে সকালে প্রথম সিন স্যুট করিয়ে তার পরের সিন শেষ সন্ধ্যায় স্যুট করায়। তাকে কয়েক ঘন্টা অকারণে বসিয়ে রাখা হয়। যেখানে একসাথেই দুইটা সিন শেষ করে তাকে ছুটি দিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু এসব তাঁকে জ্বালানোর জন্য করা হচ্ছে তা ভালোভাবে বুঝতে পারছে সে। এখন আর তার ধৈর্য আগের মতো কম না। বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নেবার মানুষ সে। আজকের দিনটাই খারাপ। রহমান বলেছিল অমৃতার খোঁজ পেয়েছে সে। অথচ যেয়ে দেখে সে অমৃতা অন্য কেউ। ইনারার এই খবরটাতেও বিরক্ত লাগে।
শুটিং শেষে জোহান তার রুমে আসে। ইনারার চেঞ্জ করে বের হবার কথা তখন। কিন্তু জোহান এসে বাঁধা দিলো। রুমের অন্যসবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনারা সকলে একটু কষ্ট করে বাহিরে যান। আমার মিস ইনারার সাথে কথা আছে।”
ইনারা বলল, “আপনি তো এভাবে আমার রুমে এসে চাইলেই কথা বলতে পারেন না। কেউ কোথাও যাবে না।”
তার মানা করা সত্ত্বেও সকলে জোহানের কথানুযায়ী বাহিরে চলে গেল।
জোহান হেসে বলে,
“এখনো তুমি আমার সামনে কেউ না। তোমার আন্ডারে কাজ করা লোকেরাও আমার কথা মানে। লজ্জাজনক ব্যাপার তাই না?”
“আমি আপনাকে পাত্তা না দেওয়ায় আপনি নিজে আমার সাথে কথা বলতে এসেছেন, এটা লজ্জাজনক নয়? যাই হোক, আপনার সাথে তর্কাতর্কি করার মতো আমার কোনো ইচ্ছা নেই।”
“তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”
“আপনার কথা শুনারো আমার কোনো ইচ্ছা নেই।”
ইনারা জোহানের পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই সে শুনে, “তোমার আসল বাবাকে নিয়ে কথা বললেও তোমার ইচ্ছা হবে না?”
ইনারার পা সেখানেই থেমে যায়। সে স্তব্ধ হয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য তার নিশ্বাস আটকে এলো। তার নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না।
সে পা পিছিয়ে নিলো। পিছনে ফিরে তাকাল জোহানের দিকে।
জোহান বলল, “বসে কথা বলি আসো।”
ইনারা ও জোহান সামনা-সামনি চেয়ারে বসে। জোহান সোজাসাপটা কথা বলে,
“আমি চাই তুমি এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দেও। আর আমি তোমাকে তোমার বাবার পরিচয় দিব।”
“আর আপনি কেন চান আমি এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দেই? আপনার কী মনে হয় আমি এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে চলে গেলে আপনাদের কিছু করতে পারব না?”
“আমি কেবল চাই তুমি সকলের সামনে না আসো। আর তুমি ফেরত-ই বা এলে কেন? আগে যেমন লুকিয়ে ছিলে তেমনি….”
ইনারা তার কথা কেটে বলল,
“গুনাহ আপনারা করেছেন, আমি না। আমি কেন লুকিয়ে থাকব? আপনাদের পাপের শাস্তি আপনাদের দিয়েই ছাড়বো।”
“এত আত্নবিশ্বাস ভালো না। তিনবছর আগে কি হয়েছিলো মনে আছে?”
“ভালো মতো আছে। আর কারা করেছিলো তাও মনে আছে। আর আমার শেষ কথাগুলো প্রতি শব্দে শব্দে মনে আছে। সম্ভবত আপনারা ভুলে গেছেন। তা মনে করাতেই এলাম।”
“আবার তোমার সব হারাতে হতে পারে।”
“হারানোর মতো কি রেখেছেন শুনি?”
“ইনারা জেদ করো না। এককালে তুমি আমার কাছের কেউ ছিলে একারণে ওয়ার্নিং…”
ইনারা তার কথা কেটে বলে,
“ওহ প্লিজ, এসব ঢঙ আমার সামনে করবেন না। আপনার অন্যান্য গার্লফ্রেন্ডের সামনে করুন। তারা আপনার কথায় নেচে বেড়াবে। আমিও ভাবি আমার ছোট বেলায় টেস্ট এত খারাপ ছিলো কিভাবে? যাক বড় হবার সাথে সাথে আমার ছেলেদের মধ্যে টেস্টও ভালো হয়ে গেছে।”
জোহানকে বিরক্ত দেখায়। সে সরু দৃষ্টিতে ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে, “এজন্য সভ্যকে পছন্দ করেছ তুমি?”
ইনারা চোখজোড়া বড় করে তাকায় জোহানের দিকে, “আপনি জানতেন? তাও আমার সাথে বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন?”
জোহান নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে, “তুমি যদি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে আগের মতো হারিয়ে যাও তাহলে আমি তোমার বাবার পরিচয় জানাব। এই শর্তে রাজি তুমি?”
“আমার আপনার সাহায্যের কোনো প্রয়োজন নেই। আমি নিজের সব লক্ষ্যে নিজে পৌঁছাতে জানি। এখন আসি, আর আমাকে ডিস্টার্ব করার চেষ্টা করবেন না।”
ইনারা উঠে চলে যেতে নেয়। দরজার কাছে যেতেই জোহান বলে, “তোমার মনে হয় এসব করে তুমি খুশি থাকতে পারবে?”
“মানে আপনাদের জীবন বরবাদ করে? হেল ইয়েস। নিজের সুখের দিনের উল্টো গণনা করা শুরু করে দেন।”
ইনারা বাঁকা হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
বের হতেই জুলি তার পিছু পিছু আসে। ইনারার সাথে গাড়িতে উঠতে নেবার পূর্বেই তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়। ইনারা বলে, “অফিসের রাস্তা কী চিনো তুমি?”
জুলি জানালা দিয়ে ঝুঁকে ইনারার দিকে তাকিয়ে উওর দেয়, “জ্বি ম্যাম, চিনি।”
“গুড। আগামীকালকের মধ্যে নিজের ইস্থফা দিয়ে যাবে।”
“ম্যাম আমি কী করেছি যে হঠাৎ আপনি….”
“নিজের পুরনো বসের কথা মানা অভ্যাসটা সম্ভবত যায় নি তাই না? তুমি কি ভেবেছ আমি জানি না তুমি আগে জোহানের জন্য কাজ করতে? এসব ঢঙ বন্ধ করো।”
জুলির ভাব ভঙ্গি হঠাৎ করেই পরিবর্তন হয়ে যায়। সে নিজের চশমা খুলে জানালার ওপাড় থেকে বিরক্ত হয়ে তাকায় ইনারার দিকে,
“যখন জানতেই তখন কেন তোমার আর আমার দুইজনের সময় নষ্ট করলে বলো তো?”
“দুইটা কারণ। ম্যানেজার হিসেবে খুব ভালো তুমি। জোহানের গত তিনবছরের সকল ঝামেলা এভাবে পরিষ্কার করলে তুমি যে আমি একটা কিছুও খুঁজে পাইনি। ইনফ্যাক্ট তিন বছরেই সোশ্যাল মিডিয়াতে ওর পপুলারিটি নাকি দ্বিগুণ করে দিয়েছ। তাই নিয়েছিলাম। দ্বিতীয় তোমার দ্বারা জোহানকেই মিডিয়াতে আবার বদনাম করতে চেয়েছি।”
“তাহলে এখন কেন বের করছ?”
“কারণ তোমাকে জোহানই আমার কাছে পাঠিয়েছে এই সন্দেহ থাকলেও আজ কনফার্ম হলাম। আমি তোমার বস অথচ জোহানের একবার বলায় তুমি রুম থেকে বেরিয়ে গেলে। এর মানে তুমি ওর জন্যই কাজ করছ।”
“ওয়াও, আমার ভাবনা থেকেও তোমার বুদ্ধি বেশি। আই এম ইম্প্রেশড। যদি এবার আসলে তোমার জন্য কাজ করতে চাই তাহলে?”
“তাহলে আমার দ্বিতীয় কারণটা আগে সত্যি করে তখন এসো। আমি আবার কাজ ছাড়া কারো উপর টাকা খরচ করি না। আপাতত আমি যাই, আমার দেরি হচ্ছে।”
ইনারা ড্রাইভারকে আবার বলে, “ড্রাইভার গাড়িটা চালু করেন।”
ইনারার গাড়ি দ্রুত যেতেই জুলি এক পা পিছিয়ে যায়। বিরক্তি নিয়ে কিছু সময় ভাবে। ইনারা যদি তাকে কাজ থেকে বের করে দেয় তাহলে জোহানও রেগে আর তাকে চাকরিতে রাখবে না৷ জোহানের কাছ থেকে যত বড় অঙ্কের টাকা সে পায় তা অন্যকারো থেকে পাওয়াটা কঠিন হবে। ভালোই ফাঁসলো সে। না এদিকের রইল, না ওদিকের।
.
.
সুরভি ভার্সিটি থেকে বের হয়ে দেখে গেইটের সামনে আহনাফ দাঁড়ানো। সিগারেট খাচ্ছে সে। হঠাৎ তাকে এখানে দেখে অবাক হয় সে। তার কাছে যেয়েই প্রথমে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি যে সিগারেট খান তা কী আংকেল জানে?”
সুরভীকে দেখে চমকে উঠে আহনাফ। সাথে সাথে নিজের হাতের সিগারেট ফেলে বলে, “তুমি এখানে!”
“আমার ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে আমাকেই জিজ্ঞেস করছেন?”
“তুমি এখানে পড়ো?”
“ক’দিন আগেই তো বলেছিলাম। ভুলে গেছেন? আর আমার সাথে দেখা করতে না আসলে এখানে কী করেন আপনি?”
আহনাফ জোরপূর্বক হাসে। আমতা-আমতা করে বলে,
“বিশেষ কিছু না। এমনিতেই এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। সিগারেট খেতে দাঁড়ালাম।”
“লজ্জাও লাগে না বলতে তাই না? আজকের পর থেকে সিগারেটকে হাতও দিবেন না।”
“আর দিলে কি করবে তুমি শুনি?”
“আংকেলকে বলে দিব।”
“এখানের কথা ওখানে করা বাজে স্বভাব জানো না?”
“আর সিগারেট খাওয়া তো কত মহান কাজ। স্বভাব না ছাড়লে সোজা আংকেলকে বিচার দিব।”
বলে সুরভি হাঁটতে শুরু করে। আহনাফও তার পিছু নেয়, “তুমি আসলে আব্বাকে বলবে না, তাই না?”
“একশোবার বলবো। আমি নিজের কথা থেকে ফিরে যাই না।”
আহনাফ মাঝরাস্তাতেই তার হাত ধরে নেয়, “আব্বা আমাকে খুন করবে। প্লিজ বলো না।”
সুরভি মুখ চেপে হাসে, “আসলে বাপ তো বাপই। পাঁচ ফিট দশ ইঞ্চি হয়েও বাবার নাম শুনে কিভাবে ভয়ে কুঁকড়ে গেলেন?”
“তুমি আমার মজা নিচ্ছো?”
“আবার জিগায়।”
“অনেক খারাপ তুমি।” আহনাফ নিজেও হেসে বলে। এমন সময় তার নজর পড়ে দরজা থেকে বের হওয়া একটি মেয়ের উপর। হঠাৎ-ই তার হাসি মলিন হয়ে যায়।
হঠাৎ করেই তার এমন মলিন মুখ দেখে সুরভি অবাক হয়ে পিছনে তাকায়। একটি মেয়েকে দেখে। মেয়েটি তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আবার তাদের হাতের দিকে তাকাল, আর চলে গেল।
মুহূর্তও লাগলো না আহনাফের তার হাত ছাড়তে।
.
.
রাতে ইনারার ঘুম আসছে না। সে বারবার এদিক-ওদিক করছে। আজকের জোহানের কথা কেবল কানে বাজছে তার। সে কী স্বার্থপরের মতো কাজ করেছে তার বাবার পরিবর্তে তার প্রতিশোধ এবং তার স্বপ্ন বাছাই করে?
ইনারা উঠে বসে তার বালিশ বুকে চেপে ধরে। এমন ঘুমহীন রাত আগেও এসেছে তার জীবনে। সেরাতগুলো ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক রাত। এতকিছু একসাথে হারানোর পর সে কীভাবে সুস্থ থাকতে পারতো? প্রতিরাত তার চোখের সামনে প্রিয়’র মৃতদেহ ভাসতো, কানে ভাসতো আইজার কথাগুলো এবং মস্তিষ্কে বারবার ঘুরতো কেবল এতবছর তার মিথ্যা জীবনীর গল্প। তার ঘর, বাবা, ফুপি, বোন সব মিথ্যা। তার জীবনটাই মিথ্যা লাগছিলো। বারবার তার নিজের মা ও প্রিয়’র কাছে যেতে ইচ্ছা করতো। সে কয়েকবার আত্নহত্যা করার চিন্তাও করেছিলো। ব্লেডটা দিয়ে তার হাত কেটে, বিষ খেয়ে, এমনকি উঁচু মঞ্জিল থেকে লাফ দিয়েও। মরে গেলেই তো সকল কষ্ট শেষ, তাই না? আর তার এমন কোনো পিছুটান নেই যার জন্য বাঁচতো। সুরভির নিজের পরিবার ছিলো যারা তাকে সামলাতো। খালাজানের ছেলে আছে। আর সভ্য তো নিজেই তাকে ছেড়ে গিয়েছিল। তার আসল বাবার খবর তো সে কখনোই জানে নি। তাহলে কার জন্য বাঁচতো? এই দুঃখ সহ নিজের জীবন রাখাটা কী সঠিক না বেঠিক? তবুও প্রতিবার নিজের জীবন নিতে যেয়ে তাদের জন্যই দুর্বল হয়ে পড়তো সে। পরক্ষণেই আবার এইসব খেয়াল মাথায় আসতো, আবার সে সুসাইড করতে যেত। কিন্তু শেষ বার যখন সে এক উঁচু মঞ্জিলের ছাদে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাল। তখন সবকিছু পিঁপড়ার মতো ছোট ছোট লাগলো। একখান থেকে লাফ দেবার কিছু মুহূর্ত পর সব শেষ। তার জীবন, তার কষ্ট, সব। তাহলে লাফ দিচ্ছে না কেন সে? মুহূর্তে তার চোখের সামনে খালাজান, সুরভি ও সভ্যের ছবি ভেসে উঠে। কিন্তু তবুও সে নিজেকে বুঝায়। সে চলে গেলে সকলে হয়তো কয়দিন কাঁদবে কিন্তু পরে নিজের আপনজনদের সাথে সুখে থাকবে। তাই হাওয়ায় পা বাড়ায় ইনারা। ঠিক সে সময় তার নিজের একটি হাসতে থাকা ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে। কিন্তু তার কী? তার হাসির, স্বপ্নের, জীবনের কী? তার নিজের কাছে কোনো মূল্য নেই? তার জীবনের কোনো মূল্য নেই? সেই মুহূর্তেই ইনারা নিজের পা পিছিয়ে নেয়। সেদিন সে নিজের জীবন বাঁচায়। নিজেকে বাঁচায়। হয়তো সেদিন তাকে ভালোবাসার জন্য খুব কম মানুষ ছিলো কিন্তু সে নিজের জীবনকে এমনভাবে গড়ে তুলবে যে হাজারোজন তাকে ভালোবাসবে। এভাবে নিজেকে শেষ করে দিলে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করবে না সে। নিজের সাথে অন্যায় করবে না। সেদিনের পর আর কখনো ইনারা নিজেকে খুন করার কথা চিন্তাও করে নি। সেদিন সে প্রথম নিজের জীবনের কদর করেছিলো। অতীতের বেদনার অংশের জন্য নিজের জীবন নিলে এক মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে যাবে। সাথে ভবিষ্যতের আশাও। হতে পারে তার নিয়তিতে বেদনার পরবর্তী অধ্যায় অনেক ভালো কিছু আছে। যদি না থাকে, সে নিজে এই অধ্যায় লিখবে। এই ওয়াদাটা সে নিজেকে করেছিলো।
অস্থির লাগছিলো ইনারার। দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। মনে অশান্তি। আজ আকাশের কৃষ্ণমেঘের সাথে তার হৃদয়ও অশান্তিতে ঢাকা।
ইনারার কিছু ভালো লাগছিলো না। এই মুহূর্তে তার সভ্যকে ছাড়া অন্য কারও কথা মাথায় এলো না।
সভ্যের ঘুম ভাঙে দরজার শব্দে। সে ঘুমঘুম চোখে উঠে যায়। দরজা খুলে ইনারাকে দেখে অবাক হয় সে, “ইনারা তুমি এত রাতে এখানে?”
ইনারা কিছু বলে না। কিছু মুহূর্ত সভ্যের দিকে তাকিয়ে থেকে ঝাপটে পড়ে তার বুকেতে।
সভ্য হতভম্ব। এই মধ্যরাতে ইনারার এমন করাটা অবাক করে তাকে। সে ইনারার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, “কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?”
ইনারা উওর দেয় না। কেবল সভ্যের বুকে চুপটি করে মুখ লুকিয়ে রাখে। সভ্যও বেশি প্রশ্ন করে তাকে বিরক্ত করে না। সময় দেয় তাকে।
হঠাৎ ইনারা প্রশ্ন করে উঠে, “আচ্ছা সভ্য আমি কী খুব স্বার্থপর?”
আচমকায় এমন প্রশ্নে সভ্য অবাক হয়। সে ইনারাকে তার বুক থেকে তুলে মুখে হাত রেখে বলে, “এসব কী বলছ তুমি? আমি যে ইনারাকে চিনি সে সবাইকে ভালোবাসতে জানে, স্বার্থপর হতে নয়।”
“আজ জোহানের সাথে আমার আলাদাভাবে কথা হয়েছিল। সে আমাকে একটা শর্ত দিয়েছে।”
সভ্য এমনিতেই জোহানের নাম শুনে প্রভাবিত হয়। ইনারার মুখ থেকে জোহানের নাম শুনতেও কেমন ভয় লাগে তার। ভয় হয় ইনারাকে আবারও হারানোর। কিন্তু ব্যাপারটা সে বুঝতে দেয় না ইনারাকে। তাকে জিজ্ঞেস করে, “কী শর্ত দিলো?”
“আমি যদি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দেই তাহলে সে আমার বাবার পরিচয় জানাবে। কিন্তু আমি নিজের স্বপ্ন বাছাই করেছি। যেখানে রহমান ভাই এত চেষ্টা করা সত্ত্বেও তার খোঁজ পাই নি। আমি পারতাম তার পরিচয় জানতে। কিন্তু আমি…আমি তা করি নি। আমার পরিবারের শেষ অংশ ছিলেন সে। অথচ আমি….” অস্থির হয়ে প্রশ্ন করে ইনারা, “আমি তাকে বেছে নেই নি। আমি কি ভুল করেছি সভ্য?”
আগ্রহ নিয়ে উওরের আশায় তাকায় সে সভ্যের দিকে।
সভ্য ইনারার হাত ধরে নিয়ে তাকে বিছানায় বসায়। এবং সে মেঝেতে বসে ইনারার হাত নিজের হাতে নেয়। বলে, “তুমি স্বার্থপর না ইনারা। স্বার্থপর হলে এখন এই কথাগুলো ভাবতে না। তুমি যা করেছ, ঠিক করেছ। নিজেক ভালোবাসা তো কোনো অন্যায় না। আমি নিশ্চিত তোমার বাবাও এটাই চাইতেন যে তার মেয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করুক। আমি জানি তার পরিচয় জানা তোমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু পরিচয় জানলেই তো সে ফিরে আসবে না। যে এই পৃথিবীতে নেই তার নামের পরিবর্তে নিজের এত বছরের তপস্যা বিলিয়ে দেওয়াটা বোকামি। এছাড়া তোমার তো প্রিয় এবং তোমার মা’য়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে তাই না? তোমার স্বপ্নও পূরণ করতে হবে। এত নরম হয়ে পড়লে কীভাবে তুমি এত ক্ষমতাবান মানুষের সামনে দাঁড়াবে বলো?”
ইনারার চোখ ভিজে আসে। তবুও সে একগাল হেসে উঠে দাঁড়ায়। বলে, “ওটাই এত সহজে আমি নিজের স্বপ্ন ছাড়বো না। আমার লক্ষ্য থেকে পিছু হবো না। এত রাতে আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম। আমি যাই, রুমে যাই। আপনি এবার আরামে ঘুমান।”
ইনারা সেখান থেকে যেতে নেয়। কিন্তু সভ্য তার হাত ছাড়ে না, “তুমি চাইলে আজ এখানে ঘুমাতে পারো।”
ইনারা হ্যাঁ বলে না। কিন্তু না-ও করে না। কেবল এক’পা এগিয়ে আসে সে সভ্যের দিকে। সভ্য ইনারার উওর হ্যাঁ মেনে নেয়। সে ইনারার হাত ধরে এন বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ে পাশে।
আবার ইনারার কাছ থেকে অনুমতি নেয়, “তোমার খারাপ লাগলে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারো।”
ইনারা এবারও উওর দেয় না। সভ্য এবার তার উওর না ভেবে অন্যদিকে ফিরতে নিলেই ইনারা তার গেঞ্জি মুঠোয় আঁকড়ে ধরে। আর ধীরে ধীরে তার কাছে এসে বুকে মুখ লুকিয়ে নেয়। নীরবে।
সভ্য মৃদু হাসে। এক হাত দিয়ে ইনারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, অন্যহাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে।
ইনারা তার বুকের ভেতর থেকেই জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, না অন্যকাওকে?”
সভ্য উওরটার জন্য কিছু মুহূর্ত ভাবে। তারপর বলে, “অবশ্যই সকলের পরিবার তার সবচেয়ে বেশি কাছের থাকে। কিন্তু জীবনের বিভিন্ন মোড়ে অন্য কিছু মানুষও আমাদের জন্য অনেক বেশি মেটার করে। আমাদের নিজের থেকেও বেশি। ছোট বেলায় আমার মা আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি কাছের ছিলেন। তাকে ছাড়া কিছু বুঝতাম না আমি। কিন্তু অনেক বছর দূরে থাকার পর তার থেকে অনেক দূরত্ব সৃষ্টি হয় আমার। তখন জো…” নামটা বলতে যেয়েও নিজেকে থামায় সভ্য, “তখন আমার এক বন্ধু আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। সে আমাকে জীবনের নতুন এক দিক দেখিয়েছিল। তার জন্য নিজের পরিবারের সাথেও লড়াই করেছিলাম আমি। কিন্তু এক পর্যায়ে এসে তাকে অপরিচিত কেউ মনে হতে থাকে। এরপর আমি নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছি। এই পৃথিবীতে সবাই আপনাকে ছেড়ে যেতে পারে, সবাই আপনাকে ধোঁকা দিতে পারে। দিন শেষে কেবল আমরাই নিজের সাথে থাকি। আমি ভেবেছিলাম এই পৃথিবীতে আমি নিজের থেকে বেশি আর কখনো, কাওকে ভালোবাসতে পারব না। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। আমি নিজের থেকেও বেশি একজনকে ভালোবেসেছি।”
“কে সে?” কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে ইনারা।
“জেনে লাভ নেই৷ সে আমাকে ভালোবাসে নি। কিন্তু সে আমাকে হাসতে শিখিয়েছে। এই যান্ত্রিক জীবনের বাহিরে একটি সুন্দর জগৎ দেখিয়েছে। শিখিয়েছে এই যান্ত্রিক জীবন মূল্যহীন। জীবন তো সেটা যেখানে হাসি, কান্না, রাগ, অভিমান, অনুভূতি সব থাকে। তার পরিবারের জন্য ভালোবাসা দেখে আবার নিজের পরিবারের মূল্য বুঝেছি। তাদের কাছে গিয়েছি। তাদের আরও ভালোবেসেছি। আমার বন্ধুদের আরও ভালোবেসেছি। নিজেকে আরও ভালোবাসতে শিখেছি। আগের থেকেও গাঢ় ভাবে। এবার কেবল নিজের সাফল্যতাকে নিজের প্রতি ভালোবাসা মনে করেনি। আসলে ভালোবেসেছি। জানো ইনারা, এই পৃথিবীতে অন্যদের চেনা, তাদের জানা, তাদের ভালোবাসা যত সহজ, নিজেকে চিনতে পেরে নিজেক ভালোবাসা ততই কঠিন।”
কিন্তু মুহূর্ত চুপ রইল ইনারা। কিছু একটা ভাবলো। তারপর প্রশ্ন করল, “মেয়েটা কে এখনও আপনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন?”
“হ্যাঁ, তার জন্য এক মুহূর্তে আমি নিজের সব বিলিয়ে দিতে রাজি।”
ইনারা আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে সভ্যকে। যেন তাকে ছাড়লেও দূরে কোথাও হারিয়ে যাবে সভ্য। সে প্রশ্ন করে, “এখন কোথায় সে?”
সভ্য ইনারার হাত তার গেঞ্জি থেকে ছাড়িয়ে নিজের বুকের বাঁ পাশে রাখে, “এখানে। আমার হৃদয়ে, আমার অনুভবে….”
চলবে…
অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ১৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
একবছর পর……….
“হায় কি’যে মায়ায় জড়ালে আমায়
তোমাতে-ই মরি, আমি বারবারি,
হায় কি’যে মায়ায় ডুবালে আমায়
তোমাতেই মরি, আমি বারবারি….”
ইনারা মোবাইল হাতে নিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনে। আগের দিনের পঞ্চসুরের গান দেখছে সে। সভ্যের গানের এই পঙক্তি যে সে কতবার টেনে দেখেছে হিসাব নেই। যতবার দেখে ততবারই আরও মুগ্ধতায় জড়ায়। যেন সভ্য তাকেই বলছে। তার জন্যই গান গাচ্ছে। ইনারা ইচ্ছে করেই কল্পনা করল সভ্য তার সামনে বসা। তার হাতে একটি গিটার। গিটার বাজাচ্ছে এবং এই গানটিই গাচ্ছে সে। তার দিকে তাকিয়ে। মুগ্ধ নয়নে। সভ্য তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। তার হাতে হাত নেয়। তাকে সোফা থেকে উঠিয়ে তার হাত ধরে নাচতে শুরু করে। ইনারাও খুশি মনে ঝুমতে শুরু করে সারা ঘরজুড়ে। দরজার কাছে এসে সে সভ্যকে দেখে তার দিকে একগাল হাসে এবং জড়িয়ে ধরে তাকে।
সভ্য হতভম্ব। সে বলে,
“ঘরে ঢুকতেই এত সুন্দর করে স্বাগতম করবে জানতাম না।”
ইনারার হুঁশ আসে। সে চকিতে তাকায় সভ্যের দিকে। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। সভ্য তার চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে চোখ টিপ মারে।
ইনারা সাথে সাথে সভ্যকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে যায়। লজ্জা পায় সে। নিজেকে মনে মনে বকতে থাকে, “গাঁধি ইনারা কল্পনাতে যে কাওকে ছোঁয়া যায় না বা আসলে সে তোর সামনে থাকে না তাও কি ভুলে গেলি? এখন পরলি তো লজ্জায়!”
সে চোখ লুকিয়ে এগোয় ডাইনিং রুমের দিকে,
“পানি দিব?” সভ্যকে জিজ্ঞেস করে।
সভ্য তার কোর্ট খুলে রাখে সোফায়, “দেও। কিন্তু বলো তো বাসায় কেন তুমি? তোমার পুরো কাস্ট মার্কেটিং এ ব্যস্ত এবং তুমি বাসায় বসে আছো। এতে পপুলারিটি পাবে তুমি? অভিনয়ের পাশাপাশি ভালো পাবলিসিটিও দরকার। আগামী সাপ্তাহে তোমার ফিল্ম রিলিজ হচ্ছে আর তুমি ঘরে বসে বসে হাওয়ায় নাচ্ছো।”
ইনারা একগ্লাস পানি এনে তার সামনে রাখে এবং বলে, “আমি কিছু করতে গেলেই উল্টো হয়ে যায়। কত স্বপ্ন বেঁধেছিলাম আইজা আর জোহানকে শায়েস্তা করব উল্টো আমার ব্যান্ড বেজে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে ঢুকতে ভয় লাগে আর বাহিরে যাব! ককয়েকজন তো মাথা ফাটিয়ে দিতে পারে আমার। যতসব গুজব তাও সামলে নিতাম, ঘৃণাও। কিন্তু ওই বুইড়া টাকলার জন্য সে মুশিবতে পরলাম। ইচ্ছা করতেছে টাক ফাঁটায় দেই ওইটার।”
একবছর পেরিয়ে গেছে। রহস্যঘরের শুটিং শেষে তার মার্কেটিং শুরু হয়। ইতিমধ্যে ইনারা আলাদাভাবে বিশেষ কোনো কাজ না পেলেও একটি গানের ভিডিও স্যুট করেছিল৷ যা এখনো বের হয় নি। এই ছবিটা তার ভবিষ্যত এবং তার পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত নিবে। এই ছবিটার কারণেই সে এত মাস ধরে চুপ আছে৷ একবার ছবিটা এলেই তার চুপিটাও ভেঙে যাবে। ইতিমধ্যেই সে সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজের একাউন্ট খুলেছিল। সে ভেবেছিলো তার উপর সমালোচনার এখনও দেরি আছে। এখনো যে তাকে কেউ-ই চিনে না তাহলে সমালোচনা কে করবে? অথচ একাউন্ট খোলার সাথে সাথে তার ফলোয়ার থেকে হেইট কমেন্ট বেশি আসতে শুরু করে। বেশিরভাগই জোহান এবং আইজার ফ্যান থেকে। এই সময় তারা দেশের বড় তারকাদের মাঝে পড়ে। আর জোহান এবং আইজা সেরা জুটি সবার মাঝে। মাঝখানে ইনারা ও জোহানের আগের এক ছবি লিক হয়ে গিয়েছিলো। অনেকে ভেবেছে তা নতুন এবং সে দুইজনের মাঝে আসার চেষ্টা করছে। এরপর থেকে তাদের ফ্যান ইনারাকে টার্গেট করছে। ক’মাস আগে তো স্টুডিও বাহিরে তার উপর একজন পাথরও মেরেছিল। ভাগ্যিস লাগে নি! এর উপর শুটিং এ দীপা, জোহান এবং আইজা তারা জ্বালিয়ে মেরেছে। অবশ্য সে প্রস্তুত ছিলো। সে নিজের প্রতিশোধ নিবে এবং তারা চুপ থাকবে এমনও হওয়া সম্ভব না।
এছাড়াও অনেক গুজব ছড়ায় তাকে নিয়ে। সে এক্টিং পারে না, ভালো সম্পর্ক দিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকেছে। সে এত সুন্দর ছিলো না প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছে। আরও কত কী! তাও ইনারা এসব সামলে নিয়েছিলো। কিন্তু তাদের প্রথম মার্কেটিং এর দিন রিপোর্টাররা অনেক আজেবাজে প্রশ্ন করে তাকে। তার উওর-ও দেয় সে হাসিমুখে।
এসব থেকে ক্লান্ত হয়ে ব্রেকে সে পার্টিতে একটু আলাদাভাবে বসেছিলো। আর কোল্ড ড্রিংক পান করছিল। তখন প্রডিউসার মিঃ আনসারি তার পাশে এসে বসে। তার বিরক্তি লাগলেও মিডিয়ার সামনে সে কিছু বলে না। উঠে যেতে নেয়। কিন্তু লোকটা তার হাত ধরে নিয়ে নিজেও দাঁড়িয়ে তার সাথে বাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। বলে, “মিস ইনারা তুমি জানো তোমার মতো সুন্দরী আমি আর কখনো দেখি নি। তোমাকে আমি কয়েক মাসে দেশের সবচেয়ে বড় নায়িকা বানাতে পারব। কেবল আমাকে খুশি করতে হবে তোমার।”
হেসে হেসে কথা বলার বাহানায় তার দেহে হাত দেবারও চেষ্টা করে। ঠিক তখনই ইনারার ধৈর্য্যর সীমা পেরিয়ে যায়। তার মাথায় মিডিয়া, ফিল্ম কিছু আসে না। সে এক দুই না ভেবে তার হাতের কোল্ড ড্রিংক এর গ্লাসটা ভেঙে দেয় লোকটার মাথায়। সাথে সাথে সব চোখ এবং ক্যামেরা তার দিকে হয়ে যায়। লোকটার হাতে ধরে জোরে মোড়াতেই সে চিৎকার করে উঠে।
ইনারা কেবল বলে,
“বলেছিলাম না নিজের হাত আর চোখ সামলে রাখ নাহয় একটাও থাকবে না। মেয়েদের শরীরে হাত দিতে খুব ভাল্লাগে বুঝি? এই হাত না থাকলে মেয়েদের খারাপ ভাবে ছুঁবি কি করে?”
পরেরদিন টিভি চ্যানেল এবং নিউজ পেপারে খবর আসে। এভাবে আসে যে তারই দোষ। সে এক বয়স্ক লোকের উপর নির্যাতন করছে। এরপর থেকে আর কি! তার প্রতি ঘৃণা বেড়েই চলে। শুনেছে ছবিতে তার কতগুলো সিনও কাট করা হতো। কিন্তু তার কন্টেক্টের কারণে তা করা হয় নি।
সভ্য ইনারাকে জানায়, “এই মঙ্গলবার তোমাদের ফিল্মের শেষ মার্কেটিং হবে। তোমার যাওয়া উচিত।”
“সবার কটু বচন শুনতে যাব?” ইনারা বিরক্ত হয়ে বলে।
“আচ্ছা একটা কথা বলো, তুমি গুনাহ করেছ না’কি সে লোকটা? সে লোকটা তাইনা? তাহলে শাস্তি তুমি পাবে কেন? সেখানে যেয়ে তুমি মিডিয়াকে প্রশ্ন করো কেন তারা একটি মেয়েকে হ্যারেজ করার দৃশ্যটা অন্যভাবে দেখিয়েছে।”
“কিছু হবে না। উল্টো সবার সামনে খারাপ হয়ে যাব। আমার রাগ উঠলে কন্ট্রোল হয় না। আবার সবাই বলবে আমি রুক্ষ ব্যবহার করছি।”
“বলুক। আমাকেও তো বলতো, তবুও সারা দেশ আমাকে ভালোও বাসতো।”
“ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে তফাৎ আছে। আপনি করলে তা আকর্ষণীয় মনে হবে , আমি করলে তা অভদ্রতা। এইজন্যই দেখেন না এই ইন্ডাস্ট্রিতে সকল মেয়েরা কেমন মিষ্টি হয়ে থাকে? এখন এই এক্টিং ই আমার ভরসা।”
“দেখ ইনারা, আমি পাঁচ বছরের বেশি ইন্ডাস্ট্রিতে কাটিয়ে এসেছি। এতে একটা জিনিসই বুঝেছি। তুমি যখন নিজের আসল রূপ জনগণের সামনে তুলে ধরো তখন তারা কানেক্ট করে। আর ভিন্ন হতে সমস্যা কী? অনেকেই ভিন্নতা ভালোবাসে। এছাড়া তুমি যদি আজ যেয়ে সত্যি না বলো তাহলে তোমার জায়গায় আগামীকাল অন্যকেউ হ্যারেজ হবে। আর তোমার মতো সে-ও এটাই ভাববে, যে মানুষ কি বলবে? কিন্তু এমনও হতে পারে তোমার মতো মেয়েটা প্রতিবাদ করে লোকটাকে থামাতে পারবে না।”
কথাটা শুনে ইনারা একটু প্রভাবিত হয়। সে গভীর চিন্তা করে বলে, “আসলে ব্যাপারটা চিন্তা করার মতো। এখন চিন্তা করার জন্য এনার্জি লাগবে। একটু কেক বানিয়ে দিবেন?”
সভ্য কপালে হাত রেখে বলে, “তুমিই একমাত্র এলিয়েন যে কেক খেয়ে এনার্জি পাও।”
“তাহলে কফি কেক বানান। কফির কফি হবে আর কেকের কেক।”
“চিন্তা করো। বাকি বউরা স্বামী আসলে কত আদর যত্নে রান্না করে খাওয়ায়। আর এদিকে আমার বউ সারাদিন খেটে আসার পরও রান্নাঘরে খাটাবে।”
“থাক হয়েছে ভাব নিতে হবে না আর। আমিই বানিয়ে নিচ্ছি।”
ইনারা উঠে সোফা থেকে। কিন্তু রান্নাঘরে যাবার আগেই সভ্য তাকে আটকায়, “এই না তুমি যাবে না। একবার গিয়ে হাতের কি অবস্থা করেছিলে! আমিই করে দিচ্ছি।”
সভ্য শার্টের হাতা কণুই পর্যন্ত বটে নিলো। রান্নাঘরে যেয়ে কেক বানানোর প্রিপারেশন নিচ্ছিল সে। আর ইনারা কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিল মুগ্ধ নয়নে। এবং মনে মনে বলছিল, “হায় আমার জামাইটা কী হ্যান্ডসাম! আর কুকিং করার সময় তো আরও হ্যান্ডসাম লাগে। তাকে এত শান্তিতে কুকিং করতে দেখে আমার ভাল্লাগছে না। যাই একটু জ্বালাই।”
ইনারা সভ্যের পিছনে দাঁড়িয়ে বারবার উঁকি মারছিল তার বোলে।
সভ্য গভীর গলায় বলল, “ইনারা তুমি এখন আর বাচ্চা না। খবরদার কোনো দুষ্টুমি না। রুমে যাও।”
“এহ আমি কি দুষ্টুমি করি না’কি কখনো? আমি কত ভালো মেয়ে। এসব গুজব ছড়াবেন না বুঝলেন?”
বলার ঠিক পরের মুহূর্তে মেয়েটা এক মুঠো ময়দা নিয়ে সভ্যের গালে মাখিয়ে দিলো।
সভ্য পিছনে ফিরে কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে, “তোমার এবার ছাড় নেই।”
“আগে ধরে তো দেখান।”
বলেই সে দেয় এক দৌড়। পিছনে সভ্যও একমুঠো ময়দা নিয়ে যায়। দুইজনে ছুটাছুটি লাগায়। একসময় ইনারাকে ধরে নিয়ে সভ্য তার মুখে ময়দা লাগিয়ে দেয়। কিন্তু ইনারা রাগ হয় না। উল্টো খিলখিল করে হাসতে থাকে সে। তার হাসির শব্দ গুঁজতে থাকে ঘরের দেয়ালজুড়ে।
সভ্যের মনে পড়ে এমনই এক স্মৃতি। সেদিন ইনারা প্রথম তার বাসায় এসেছিল। এমনভাবে ছুটাছুটি করেছিলো। দুইজনে পড়ে গিয়েছিলো। সেদিন প্রথম সে ইনারার নীল চোখের নেশায় মারাত্মকভাবে আসক্ত হয়েছিলো। আর আজ আবার তার হাসির শব্দে আসক্ত হচ্ছে সে।
সভ্য বলে, “তুমি জানো প্রণয়ী, তোমাকে হাসিতে সবচেয়ে সুন্দর দেখায়?”
ইনারা সভ্যের কথায় থমকে যায়। সভ্যের দিকে তাকায় সে, “কী বললেন?”
“শুনেছ তো ঠিকই। আর বলব না। এখন ডিস্টার্ব করবে না খবরদার। দুষ্টুমি করলে এবার খবর আছে।”
“কী খবর করবেন শুনি? দাদাজানকে বলে দিব, তারপর আপনার খবর হবে।”
“যদি বলি সারারাত ভরে তোমাকে চুমু খাব, তাহলে দাদাজানকে বিচার দিতে পারবে?”
কথাটা শুনে লজ্জায় আধখানা হয়ে যায় ইনারা। চোখ নামিয়ে নেয়।
সভ্য মিটমিট করে হাসে, “তাহলে চুপচাপ বসে থাক। আমি কেক বানিয়ে আনছি।”
সভ্য চলে যেতেই ইনারার কানে আবার ভেসে উঠে, “তুমি জানো প্রণয়ী, তোমাকে হাসিতে সবচেয়ে সুন্দর দেখায়?”
প্রণয়ী!
এই শব্দ সভ্যের মুখ থেকে আগেও শুনেছে। তবে এই প্রণয়ী কে? যাকে সভ্য ভালোবাসতো? না, এসব আর সে ভাববে না। এসব নিয়ে ঘাটবেও না। বহু বছর পর তার জীবনে খুশি এসেছে সভ্যের রূপে। কোনো কারণেই এখন সে এই খুশি হাতছাড়া করবে না। অতীত সবারই থাকে। তারও ছিলো। তাই বলে অতীত নিয়ে তো পরে থাকলে হবে না৷ সে সভ্যের সাথে তার ভবিষ্যৎ গড়বে।
ভাবতেই একগাল হেসে আবারও দৌড়ে গেল রান্নাঘরে। সভ্যকে জ্বালাতে।
.
.
রহস্য ঘরের শেষ প্রেস কনফারেন্স হচ্ছে। বড়ভাবে। তাই সকলে উপস্থিত সেখানে। অনেক প্রশ্ন করা হচ্ছে। ছবির ব্যাপারে, অভিনেতাদের ব্যাপারে। এর মাঝখানেই ইনারা উপস্থিত হয়। তাকে দেখে সকলে অবাক, হতভম্ব। কেবল জোহান ছাড়া। কিন্তু স্টেজে উঠার পর সকলে স্বাভাবিক ব্যবহার করার চেষ্টা করল তার সাথে। সে সবার সাথে হাসিমুখে দেখা করে। তার জন্য একটা চেয়ার আনা হয়। সে বসে বলে, “সরি আমার আসতে একটু দেরি হলো। অনেক ট্রাফিক ছিলো। এছাড়া ভেবেছিলাম আসব না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।”
সে কথা শেষ করার আগেই একজন লেডি রিপোর্টার জিজ্ঞেস করে, “মিস ইনারা আপনি এতদিন কোনো মার্কেটিং এর সাথে যুক্ত হন নি। এর কারণ কী জানতে পারি?”
“আপনারা।”
“সরি?”
“সরি তো বলাই উচিত আপনাদের।” ইনারা পা’য়ের উপর পা তুলে কঠিন গলায় বলে, “তবে জনগণকে। আমি যতটুকু জানি আপনাদের দায়িত্ব জনগণের কাছে সত্য পৌঁছানো। অথচ আপনারা টি-আর-পির জন্য অর্ধ সত্য এবং অর্ধ মিথ্যা সাজিয়ে দেখান। এটা তাদের প্রতি এবং তাদের বিশ্বাসের প্রতি অন্যায় না?”
“মানে আপনি এখন নিজের দোষ মিডিয়ার উপর দিবেন? আপনি মিঃ আনসারির মাথায় গ্লাস মারেন নি?”
“মেরেছি কিন্তু…” ইনারার সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বেই রিপোর্টারটা আবারও বলে, “তাহলে আপনি স্বীকার করছেন আপনি দোষ করেছেন। তাহলে আমাদের উপর দোষ কেন চাপাচ্ছেন? দোষ করলে তার ভার নিতে শিখুন। আপনি কি এই দোষের কারণে নিজের মুখ লুকাচ্ছেন এতদিন ধরে?”
ইনারা তাচ্ছিল্য হাসে, “প্রশ্ন ঘুরাচ্ছেন? দরকার কী? এডিটিং করলেই তো হয়ে যাবে। ওদিন যেভাবে করেছেন। একটা মেয়ে উত্ত্যক্ত করার জন্য প্রতিবাদ করল অথচ আপনারা তাকেই অপরাধী বানিয়ে দিলেন?”
পরিচালক ইনারাকে থামাতে চাইল। এসবে তাদের ছবিতে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু জোহান তাকে থামিয়ে দেয়।
ইনারা আরও জানায়, “আপনাদের কাছে আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। শুধু জিজ্ঞেস করব, এখানে যারা মেয়ে রিপোর্টার আছে তাদের মধ্যে সবাই এমন এক পরিস্থিতিতে পরেছিলেন না? তখন কেমন লেগেছিল আপনার? নিশ্চয়ই সেটা আপনাদের দোষ ছিলো কারণ পুরুষরা হ্যারেজ তো করে আপনার দোষে। তাইতো এর প্রতিবাদ করলে আপনার দোষ হবে তাই না?”
এমন সময় একজন পুরুষ রিপোর্টার বলে, “মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন মিঃ আনসারি আপনাকে উত্ত্যক্ত করেছে?”
“কেন আপনারা দেখেন নি? সেখানে ছিলেন না আপনি?”
“ছিলাম… মানে…”
“আপনার বোন বা মা আছে? অথবা ওয়াইফ বা মেয়ে? তাদের যদি এমনভাবে উত্ত্যক্ত করে তাহলে আপনি চাইবেন তারা চুপ করে থাকুক? আপনাদের দ্বারা কী শিখবে তারা? আপনাদের নিষ্পাপ প্রডিউসার সাহেব আমাকে বলে আমি নাকি তাকে খুশি করতে পারলে সে আমাকে বড় অভিনেত্রী বানাবে। তাহলে অভিনয়ের কী প্রয়োজন? এই ইন্ডাস্ট্রিতে থাকতে হলে মেয়েদের এসব সহ্য করতে হবে? কেন? কয়েকবছর আগে আমি এমন এক পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছিলাম। তখন আমার উপর দিয়ে কি গেছে কেবল আমিই জানি। নিজেকে ঘৃণা লাগছিলো কিছু মুহূর্তের জন্য। খুব কষ্টে আমি সেদিন নিজেকে বাঁচিয়েছি। সেদিন আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমার সম্মানে যে হাত দিবে তার হাত ভেঙে দিব। আমি তাই করেছি। এতে আমার কোনো আফসোস নেই। আমি জানি আপনারা এসব কথাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চ্যানেলে দিবেন। কিন্তু আমি যে আজ এখানে এসে সাহস করে কথাগুলো বলেছি তার জন্যই আমি সন্তুষ্ট। হয়তো এসবের পর আমি আরও ঘৃণার স্বীকার হবো, হয়তো আর কোনো কাজ পাব না। কিন্তু আমার সম্মান এসব থেকে হাজারোগুণ বেশি দামী। এবার আসি। আপনাদের কথাগুলো এডিট করে ঘুরাতেও তো সময় লাগবে।”
ইনারা আর এক মুহূর্তও সেখানে থেকে সময় নষ্ট করল না। চলে এলো।
সে যা ভেবেছিল তাই। রাতে দেখলো ইন্টারভিউতে তার অংশটুকু কেটে দেওয়া হয়েছে। যদিও এর জন্য প্রস্তুত ছিলো সে। তবুও নিজেকে আশাহত হওয়ার থেকে থামাতে পারল না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে দেখে একটি চ্যানেলে তার ইন্টারভিউ এসেছে। তার সম্পূর্ণ কথা। সে লেডি রিপোর্টার তার পক্ষে বলেছে। এতটুকুই সে খুশি হয়। শান্তি পায়। কিন্তু তাকে অবাক করে সে ভিডিও ভাইরাল হয়। পরবর্তী দিনে সকল টিভি চ্যানেলে তার ইন্টারভিউ ছাড়ে। কয়েকদিনে তাকে নিয়ে নেগেটিভ কথার পাশাপাশি পজিটিভ দিক যুক্ত হয়। কতজনে তো এমনও বলে তার থেকে সাহস পেয়ে তারাও হ্যারেজমেন্টের উপর আওয়াজ তুলে। তার ফলোয়ার বাড়ে। ছবি প্রকাশ পাবার আগেই তার ভক্ত হয়ে যায় অনেক। সিনেমা থিয়েটারে প্রকাশ পাবার আগের দিন সে খবর পায় প্রডিউসার আনসারিকে ছবির নাম থেকে আলাদা করা হয়েছে।
পরবর্তী দিন যখন বড় স্ক্রিনে ছবি রিলিজ হয় তখন সকল কাস্টিংরা যায় ফাস্ট শো দেখতে। ইনারা ছাড়া। তার সেদিন অনেক ভয় লাগছিলো। সে সোফার সামনে থেকে নড়েচড়ে না। টিভিতে চোখ লাগিয়ে থাকে। ছবি শেষে যখন প্রথম একজন লোক বের হয়ে রিপোর্টারের প্রশ্নের উওরে বলেছিলো, “ছবিটা অসাধারণ ছিলো। আমি এক মুহূর্তের জন্যও স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতে পারি নি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে আমার চৈতীর চরিত্র। সম্পূর্ণ ছবিতে ঘৃণা করে এসেছি সে চরিত্রকে শেষ পাঁচ মিনিটের গানে সেরা মনে হলো। আমার ভাষা নেই। কান্না আসছিলো আমার। সে গানে অভিনেত্রীর পার্ফোরমেন্সটা অসাধারণ ছিলো। যে চরিত্রকে আড়াই ঘন্টা ধরে ঘৃণা করে এসেছি পাঁচ মিনিটে সে চরিত্রের অতীত দেখিয়ে তার জন্য সহানুভূতি তৈরি করাটা অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার ছিলো।”
এতটুকুতেই ইনারা শান্তি পেল। এরপর সে টিভি বন্ধ করে দিলো। আর কারও রিভিউ দেখল না সে। জলদি ছুটে গেল তার রুমে। আলমিরা থেকে তার একটি মা’য়ের শাড়ি বের করল।
বৃষ্টির মধ্যেও তাড়াহুড়ো করে বাড়ি পৌঁছায় সভ্য। ইনারার জন্য কেক ও মিষ্টি এনেছে সে। বাহিরে যে তার প্রশংসাই হচ্ছে সব জায়গায়। ইনারা জীবনের প্রথম ধাপ আজ পাড় করল। তাতে মিষ্টিমুখ না করলে হয়?
কেমন গর্ববোধ হচ্ছে তার ইনারার উপর। তার অর্জনের জন্য নিজে গর্বিত অনুভব করছে। এমনটা সম্ভবত সে কখনো নিজের সাফল্যেও অনুভব করে নি।
সে রুমে ঢুকে দেখে ইনারা নেই। সারাঘর জুড়েও তাকে পায় না সভ্য৷ ঘাবড়ে যায় সে। ইনারা হঠাৎ কোথায় যেতে পারে। অতঃপর বাগানে যায় সে। ইনারাকে খুঁজতে৷ সেখানে তাকে খুঁজে না পেলেও ছাদে কাউকে দেখতে পায়। সে ছাদে উঠে। ইনারাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে।
ছাদে যেয়ে সে দেখতে পায় গোলাপি রঙের শাড়ি পরে একটি কন্যা বৃষ্টিবিলাস করছে। চোখ বন্ধ করে, পাখির পেখমের মতো দুইহাত মিলে বৃষ্টি অনুভব করছে সে। তার একহাতে বেলিফুলের মালা।
সভ্য শান্তির নিশ্বাস ফেলে, “তুমি এখানে? আমি তোমাকেও খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত। ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে তুমি।”
ইনারা চোখ খুলে তাকায় সভ্যের দিকে। মুহূর্তে একগাল হেসে ছুটে এসে ঝাপটে পরে সভ্যের বাহুডরে। উঁচু স্বরে বলে, “আমি আজ অনেক খুশি সভ্য, অনেক। আমার আজ স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমার মা, প্রিয়, সবার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। দেখ আকাশও আজ আমার খুশিতে বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। গান গাইছে।”
ইনারা মুখ তুলে তার বুকে চিবুক রেখে তাকায় সভ্যের দিকে।
সভ্যর হৃদয়ের স্পন্দন থেমে যায়। বৃষ্টির মাতাল হাওয়ায় ইনারার দৃষ্টির নেশা তার হৃদয়ের জন্য ভালো নয়। তবুও সে তাকিয়ে রইলো।
ইনারা মৃদু হাসল, “কী দেখছ?”
“বৃষ্টির জল কী অলংকার হয়ে তোমার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিলো?”
সভ্য তার ভেজা চুল নিজের আঙুল দিয়ে আঁচড়ে বলল, “বাড়িতে চলো, নাহলে এই মাতোয়ারা বৃষ্টিতে আমিও মাতাল হয়ে গেলে তুমিই অসভ্য বলবে।”
সভ্য হাসল। ইনারার হাত ধরে তাকে বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য এগোল। ইনারা নড়ে না।
“আজ এই মাতোয়ারা বৃষ্টিতে ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না।” ইনারা সভ্যর সামনে এসে দাঁড়িয়ে তার হাত ধরে নিজের কোমরে রাখে। আর নিজে সভ্যের কাঁধে হাত আবদ্ধ করে পা’য়ের পাতা উঁচু করে সভ্যর সমান হবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। আর বলে, “প্রিয় রাজকুমার শুনুন, আপনি কি এই রাজকন্যার সাথে আজ বৃষ্টিবিলাস করবেন?”
সভ্য হাসে, “আমি রাজকন্যাকে মানা করব এত সাহস আমার আছে?”
“আপনার কন্ঠে গান শুনতে ইচ্ছা করছে। গান শুনাবেন একটা?”
সভ্য গুনগুন করতে করতে ইনারার চোখে তাকায়। ডুবে তার মায়ার সমুদ্রে। তাকে নিজের কাছে আরও টেনে আনে। তার ভেজা চুলগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে খালি গলায় গান ধরে,
“তোমার মায়ায় জড়িয়ে জগৎ ছাড়িলাম
তোমায় পেয়ে যে নিজেকে হারালাম,
ও’গো তোমার মায়ায় বেঁধে হলাম ছন্নছাড়া
তোমায় পেয়ে হবো আমি বাঁধনহারা,
হায় কি’যে মায়ায় জড়ালে আমায়
তোমাতে-ই মরি, আমি বারবারি,
হায় কি’যে মায়ায় ডুবালে আমায়
তোমাতেই মরি, আমি বারবারি…
চলবে…
[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]