অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ১৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
রাতে ইনারা নিজের রুমে বসে সুরভির সাথে গল্প করছিলো। বিশেষ করে দাদাজানের কথা জানাচ্ছিল। তারা দুইজন যতই দূরে থাকুক না কেন বা যতই ব্যস্ত থাকুক সাপ্তাহে তিন চারদিন একে অপরের সাথে কথা বলবেই। সব কথা শেয়ার করবে। যদিও সুরভি এখনও আহনাফের সাথে তার ডিলের কথা জানায় নি। সে জানে ইনারাকে এই মুহূর্তে আর প্রেশার দেওয়া ঠিক হবে না। ইনারা নিজের মতো সুরভীকে দাদাজানের গল্প বলতে থাকে। এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে সভ্য। তাকে দেখেই ইনারা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে দ্রুত সুরভিকে বলে, “তোকে পরে কল দিচ্ছি, অসভ্য এসেছে।”
“এই মাইয়া আমার দুলাভাইকে সম্মানের সাথে সম্বোধন কর। আর আজ রাতে কি হয়েছে তা কাল সকালেই জানাবি।”
“আমি তোকে এখনই জানাচ্ছি, তোর অসভ্য দুলাভাই আজ বারান্দায় ঘুমাবে।” পরক্ষণেই ধমকে বলে, “ফোন রাখ, শালী মিরজাফর।”
সভ্য এক লাফে বিছানায় এসে শুয়ে পরে। আরাম করে। সাথে সাথে ইনারা বলে, “এই’যে নবাব সাহেব আপনি এখানে কি করছেন?”
“দাদাজান না বলল আজ রাত এখানে ঘুমাতে হবে আমাদের দুইজনকে?”
“আপনি বিছানায় ঘুমাতে পারবেন না।”
“আমি তো এখানেই ঘুমাব। দেখব কে আটকায় আমাকে।”
ইনারা দাঁড়িয়ে সভ্যের হাত ধরে টেনে তাকে উঠানোর চেষ্টা করে, “উঠেন আপনি। আপনি মেঝেতে ঘুমাবেন, নাহলে বারান্দায়।”
ইনারা তো আর সভ্যের সাথে পেরে উঠে না। কিন্তু সভ্য ফেরত একটান দিতেই ইনারা তার বুকের উপর এসে পড়ে।
ইনারা ঘাবড়ে যায়, “কি করছেন?”
সে সভ্যের বুক থেকে উঠে যেতে নিলেই সভ্য তার কোমরে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে। অন্য হাত দিয়ে তার কপালে এসে থাকা চুলগুলো সরিয়ে বলে, “দাদাজানকে না বিচার দিয়েছিলে আমি তোমাকে অনেক বিরক্ত করি, তাই এখন বিরক্ত করছি।”
“ফাজলামো করলে এখনই দাদাজানকে যেয়ে আবার বিচার দিব।”
“কী বিচার দিবে শুনি? বলবে আমার স্বামী আমার সাথে রোমেন্স করছে, এখন আপনি বিচার করুন। দাদাজান তো বলবে জলদি তাকে পর নাতির মুখ দেখাতে।”
কথাটা শুনে ইনারা লজ্জায় শেষ। সভ্যের বাহুতে মেরে সে বলে, “কী অসভ্য আপনি! ছিঃ!”
সভ্য হাসে, “তো আজ যে অকারণে এত বকা খাওয়ালে তার শাস্তি তোমাকে দিতে হবে না?”
“কি শাস্তি দিবেন আমিও দেখব। হাড্ডি গুড্ডি ভেঙে এক না করলে আমার নামও ইনারা না।”
সভ্য সাথে সাথে ইনারার গলায় একখানা চুমু খায়। সাথে সাথে শিউরে ওঠে ইনারা। ঘাবড়ে যায়।
সভ্য তার চুলের খোঁপা খুলে দেয়। সাথে সাথে তার স্বর্ণোজ্জ্বল চুলগুলো ঝরে এসে পরে সভ্যের মুখের উপর। সভ্য চোখ বন্ধ করে নেয়। গভীর নিশ্বাসের সাথে তার চুলের ঘ্রাণ নেয় সভ্য। নেশাভরা দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে। তার নীল সাগরের মতো চোখদুটো দেখে এক ঢোক গিলে। এই চোখদুটোর যে কাওকে নেশায় ডুবাতে পারে, নেশায় আসক্ত করতে পারে। যেমন তার করছে।
তার ইনারার ঠোঁটগুলো ছুঁয়ে দেয়। তারপর চুলগুলো কানের কাছে গুঁজে দিয়ে বলে,”আজ রাতের নেশা, না তোমার? নিজেকে মাতোয়ারা লাগছে।”
সভ্যের ছোঁয়াতেই কেঁপে উঠে ইনারা।কাঁচুমাচু হয়ে যায় সভ্যের বাহুতে। সভ্য যখন তার চুলের মাঝে হাত রেখে তাকে নিজের দিকে এগিয়ে আনছিলো তখন ইনারার কেমন অপ্রস্তুত লাগছিলো। তাই সে বলে উঠে, “সভ্য প্লিজ, আমার ভালো লাগছে না।”
মুহূর্তও লাগলো না সভ্যর ইনারাকে ছাড়তে। সভ্য বলল, “আমি তোমাকে কখনো জোর করব না।”
বলেই সে সরে যায়। ইনারা সেখানেই বসে থাকে। তার রাগ উঠছিলো। হ্যাঁ, সে সভ্যকে মানা করছে। কিন্তু সভ্য তাকে একটা চুমু তো দিতেই পারতো। পরক্ষণেই নিজের উপর রাগ উঠলো ইনারার এসব কি ভাবছে সে? এত সহজে কীভাবে সভ্যের ছেড়ে যাওয়াটা ভুলতে পারে সে। রাগটা সম্পূর্ণ যেয়ে পরে সভ্যের উপর। সভ্যকে বিছানায় শুতে দেখে তাকে বালিশ মেরে বলল, “খবরদার আমার কাছে শুবেন না। আমার আপনার উপর একবিন্দুও বিশ্বাস নেই।”
“তুমি একবার বলাতে আমি ছেড়ে দিলাম তোমায়, তাও না।”
“না, আপনি নিচে ঘুমাবেন।”
“আমার ঘরে আমাকেই মেঝেতে ঘুমাতে বলছ? সাহস তো কম না তোমার।”
“আমার সাহস দেখছেন না’কি এ পর্যন্ত?”
সভ্য আয়েশে শুয়ে বলে, “আমি তো এখানেই ঘুমাব। যা করার করে নেও।”
“তাহলে আমি নিচে ঘুমাব না’কি?”
“তোমার ইচ্ছা। আমার তো তোমার সাথে বেড শেয়ার করতে সমস্যা নেই। তোমার আছে। তোমার ঝামেলা তুমি নিজেই সামলাও।”
“আপনার লজ্জা লাগবে না আপনি একটি মেয়ের সাথে বেড শেয়ার করবেন?”
“সে মেয়েটি আমার বিয়ে করা বউ।”
“এ বিয়ে আসল না।”
সভ্য ইনারাকে পাত্তা না দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে।
ইনারা রাগে সভ্যকে ক’টা কথা শুনিয়ে দেয়। কিন্তু সভ্য কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখায় না।
কিন্তু ইনারা তো আর নিচে শুবে না। এমনিতেই তার ঠান্ডার সমস্যা। তাই সে না পেরে তাদের দুইজনের মাঝে দুটো বালিশ রেখে বলে, “খবরদার ওপাশ থেকে এপাশে হাত আনলে হাতই কেটে দিব।”
সে শুয়ে পরে।
ইনারা ঘুমিয়ে যাবার পর সভ্য উঠে। উঁকি মেরে দেখে ইনারাকে। সভ্য ধীরে তাদের মাঝের দুটি বালিশ মেঝেতে ফেলে দিয়ে ইনারাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। চন্দ্রিমার আলোয় তার প্রণয়ীকে দেখে মৃদু হাসে। কী অপরূপ দেখাচ্ছে তাকে! যে সদ্য কোনো পরী চন্দ্রিমার দেশ থেকে নেমে তার বাহুডোরে এসে পড়েছে।
যখন সে ইনারাকে ভালোবেসেছিলো তখন থেকেই তার সাথে বিয়ের স্বপ্ন বেঁধেছিল সভ্য। ভেবেই নিয়েছিল বিয়ের পর প্রতি রাতে ইনারাকে তার বুকের মাঝে নিয়ে ঘুমাবে। তার সবচেয়ে বেশি মূল্যবান মানুষটিকে নিজের হৃদয়ে ভরে রাখবে। আজ এত বছর পর তার ইচ্ছা পূরণ হচ্ছে। তার ঠোঁটের কোণে এক স্বস্থির হাসি। সে ইনারাকে বুকে ভরে তার কপালে আলতো এক চুমু খায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আর এভাবে তোমাকে বুকে ভরার সুযোগ পাব কি-না জানি না। তাই আজ রাতের এক মুহূর্তও হাতছাড়া করছি না আমি। কখনো তোমাকে বলা হয় নি। কিন্তু ভালোবাসি প্রণয়ী, ভালোবাসি।”
সে রাতভর সভ্য তাকে বুকের ভেতর ভরে অনেকক্ষণ অনুভব করল তার হৃদয়ের প্রশান্তি। তার স্পন্দনের অনুভূতি। এই কিছু মুহূর্ত। তার মনে হলো এ ক’টি নীরব মুহূর্ত তার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের তালিকায় আসতে পারে।
ভোরে সভ্যের চোখ লেগে আসে। সে ইনারাকে বুকে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। তার চোখ খুলে ইনারার ধমকে, “এই আপনার সাহস কত! আপনাকে না বলেছি আমার কাছে আসবেন না।”
ধমকে লাফিয়ে উঠে বসে পড়ে সভ্য। ভয়ে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “তুমি জানো না ঘুমন্ত মানুষকে ধীর কন্ঠে, আদর করে উঠাতে হয়। এভাবে জংলীদের মতো চিল্লিয়ে না।”
“আদর করে তাই না? মাইর দিব আপনাকে। আপনাকে না মানা করেছি আমার এদিকে হাত আনলে খবর আছে।”
সভ্য বুঝলো এই মুহূর্তে কোনো বাহানা না বানালে ইনারার হাত থেকে তার রেহাই নেই। তাই সে উল্টো জোর গলায় বলল, “আমি আসি নি, তুমি এসেছ। এই যে তুমি আমার দিকে। মেডাম নিজে রাতে লাথি দিয়ে বালিশ ফেলে আমার গায়ের উপর চড়ছিলো , এখন আমার দোষ দিচ্ছো? ছিঃ! আমি কত চেষ্টা করলাম সরাতে কিন্তু আমার উপর চড়ে গিয়েছিলে। ঘুমের মধ্যে কিসও করার চেষ্টা করেছ।”
“আমি!” অবাক হয়ে বলে ইনারা।
“নয়তো কী? কীভাবে যে আমার সম্মানটা বাঁচালাম কেবল আমি জানি। এখন আমার এদিকে এসে আমার উপর চড়ার শাস্তি কি দেওয়া উচিত তোমাকে বলো?”
ইনারা আমতা-আমতা করে বলল, “আমিই মনে হয় ঘুমে এসেছি তাহলে। দেখেন আমরা স্বামী স্ত্রী। আমি আসতেই পারি। নট আ বিগ ডিল। এই ছোট ছোট জিনিস নিয়ে কাহিনী করবেন না তো।”
ইনারা উঠে যেতে নিলেই সভ্য তার হাত ধরে নেয়। তাকে একটানে নিজের কাছে এনে বলে, “নিজের বেলায় আমরা স্বামী স্ত্রী? আর আমার বেলায়? তোমার তো শাস্তি পাওয়া লাগবে। কাল যে দাদাজানের কাছে এত বকা খাওয়ালে তার এবং রাতে আমার এদিকে আসারও।”
“কী শাস্তি দিবেন শুনি?”
“একটি গুড মর্নিং কিস দিয়ে যাও।”
“গুড মর্নিং কিস লাগবে?”
সভ্য উৎসুকভাবে মাথা নাড়ায়। ইনারা তার গালে আস্তে চড় মেরে বলল, “এই নিন কিস, আমি গেলাম।”
ইনারা যেতে নিবে এর পূর্বেই সভ্য তার কোমর জড়িয়ে ধরে, “এই বিচার আমি দাদাজানের কাছে দিব। বলব যে রাতে একতো আমার উপর চড়ে বসে কী করার চেষ্টা করছিলো এরপর সকালে কিস চাইলে চড় মারলো।”
“আপনি একথা বলতে পারবেন? কী নিলজ্জ আপনি!”
“দেখবে?” বলে সভ্য জোরে দাদাজানকে ডাক দেয়, “দাদা…”
সম্পূর্ণ বলার পূর্বেই ইনারা তার মুখ চেপে ধরে, “পাগল হয়েছেন না’কি? আচ্ছা করছি। কিস করলেই ছেড়ে দিবেন।”
ইনারা দ্বিধা নিয়েই সভ্যের গালে চুমু দেয়। সভ্য থেকে ছাড় পেতেই এক দৌড়ে পালায়।
সভ্য তার গালে হাত রেখে খুশিতে আত্নহারা হয়। তার খুশি কে দেখে। মনটা ভীষণ উড়ু উড়ু তার। সে তার বালিশটা বুকে চেপে ধরে আবার শুয়ে পড়ে আর বলে, “দাদাজান আজ তোমার কারণে গতরাতটা এত ভালো হলো। দাদাজান তুসসি গ্রেট হো।”
.
.
দাদাজানের আজ সভ্যের সাথে অফিসে যাবার কথা। সেখান থেকেই সে বাড়িতে ফিরে যাবে। একারণে ইনারার মন খুব খারাপ। তারা সকলে ডাইনিং টেবিলে বসে একত্রে নাস্তা করছিলো। ইনারা বলে, “দাদাজান ক’দিন থেকে যান এখানে।”
“না নাতবৌ থেকে গেলে তোমার দাদীজান রাগ করবেন। আবার আসব তো আমি।”
সভ্য বসে ছিলো ইনারার পাশের চেয়ারে। সে ইনারার দিকে ঝুঁকে। তার কানের কাছে মুখ এনে বলল, “রাত আমার সাথে কাটাতে ইচ্ছা করছে বললেই তো হয়। দাদাজানকে থামানো লাগে না’কি?”
ইনারা রাগী দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। তাকিয়ে সে নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়। আবার দাদাজানকে জিজ্ঞেস করে, “এরপর সবাইকে নিয়ে আসবেন?”
“না নাতবৌ, তোমার দাদীজানের এই সিনেমা বেশি একটা পছন্দের নয়। এখন তোমার সাথে দেখা করাতে গেলে তোমাকে আর কাজ করতে দিবে না। তুমি একটু সাফল্যতা পাও, তারপর সবার সাথে দেখা করাব। তখন আমি সামলে নিব। আর এর মাঝে সময় পেলে আমাকে একটা পর নাতি নাতনী দেবার চিন্তা ভাবনা করো।”
কথাটা শুনে ইনারার কাশি চলে আসে। খাবার গলায় আটকে আসে৷ সে দ্রুত পানির গ্লাস নিয়ে পান করে নেয়।
সে সভ্যের দিকে তাকিয়ে দেখে লোকটা মিটিমিটি হাসছে তার অবস্থা দেখে।
দাদাজান ঘাবড়ে গিয়ে বলে, “আরে তুমি চিন্তা করো না, আগে তুমি তৈরী হও। আগে নিজের স্বপ্ন পূরণ করো। আসলে বয়স হয়েছে তো, কবে যে কিছু হয়ে যায়। এর আগে আমার পর নাতি বা নাতনীর চেহেরা দেখলে শান্তি পাব।”
ইনারা জোর পূর্বক হেসে মাথা নাড়ায়। এরপর আর একটা কথাও মুখে আনে না। কিন্তু সভ্য ঠিকই এই বিষয় নিয়ে তার সাথে মজা করতে থাকে কয়দিন ধরে।
.
.
আজ “রহস্য ঘর” এর এনাউন্সমেন্ট হবে। তাই মিডিয়া একত্রিত হয়েছে। সকল অভিনেতারও আসার কথা। আজকের এই আয়োজনের বিশেষ কারণ হচ্ছে আইজার নাম পরিষ্কার করা। ইনারাকে নিয়ে তার নামে যত সমস্যা হয়েছিল তা সব থেকে নিজের নাম মুক্ত করা। আজকের ইন্টারভিউ লাইভ হবে।
আইজা অস্থির হয়ে বলল, “ইনারা এখনও আসছে না কেন? ও নিজের মন পাল্টে নিলো না তো।”
জোহান তার পাশের চেয়ারেই বসা ছিলো। সে বলল, “পালটে নিলেই ভালো।”
“বলছটা কী তুমি? ও এসে আমার পক্ষে স্টেটমেন্ট না দিলে কত বড় সমস্যা হবে তুমি জানো? একবার সোশ্যাল মিডিয়াতে ঢুকে দেখেছ? আমাকে কত বাজে কথা শুনিয়েছে সবাই?”
জোহান হাসে। বেখেয়ালিভাবেই বলে, “নিয়তি আইজা, নিয়তি। একসময় এই তোমার কারণে জনগণ ওকে খারাপ কথা বলছিলো। এখন ওর কারণে তোমাকে শোনাচ্ছে। আসলে তুমি ওর তুলনায় কমই শুনছি।”
“ওহ প্লিজ, এমন ব্যবহার করো না যেন তুমি ধোঁয়া তুলসি পাতা। তুমি কিছু করো নি।”
“অন্তত তোমার মতো তো করি নি। আমি তো এতকিছু হবে জানতামও না। তুমি উল্টো দোয়া করো ইনারা যেন আজ না আসে৷ আসলে যদি বাই চান্স তোমার বিরুদ্ধে স্টেটমেন্ট দেয় তাহলে তুমি আসলেই শেষ। ”
আইজা চমকে উঠে। এদিকটা তো সে ভাবেনি আগে। সত্যিই তো যদি ইনারা একবার তার নামে উল্টো কিছু বলে দেয় তার কাছে যা আছে সব শেষ হয়ে যাবে।
ভাবতে ভাবতেই সে খবর পায় ইনারা এসে পড়েছে। তাকে আলাদাভাবে এনাউন্সমেন্ট করে স্টেজে আনা হবে তাই এই মুহূর্তে তাকে ব্যাক স্টেজে বসানো হয়েছে। আইজা শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয় ইনারাকে সে আসতে দিবে না। কিন্তু কাওকে বলার পূর্বেই ইন্টারভিউ শুরু হয়ে যায়। লাইভ চলছে৷ তাদের ফিল্মের কথা এনাউন্স করা হলো। চারপাশে এসি লাগানো। তাও আইজা ঘামছে। পাঁচমিনিট পর কি হবে তা ভেবে। হয়তো সে নিজের ক্যারিয়ার ফিরে পাবে, নয়তো সব শেষ হয়ে যাবে। মাঝখানে কিছু নেই। ইন্টারভিউ শুরু হবার পর প্রথম প্রশ্নই আসে আইজার কাছে,
“মিস আইজা এটা কী সত্যি যে ইনারার সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক আছে? সে কী হয় আপনার বোন না বান্ধবী?”
আইজা ঘাবড়ে যায়। তবুও হাসিমুখে উওর দেয়, “ও আমার বোনের মতো ছিলো।”
“তাহলে আপনার বোনের মতো কারও উপর এত বড় মিথ্যা অপবাদ লাগবে আর আপনি চুপ থাকবেন? আর যে তার সাথে এত খারাপ আচরণ করেছে তার প্রডাকশনে আপনি কাজ করছেন, এটা আপনার সঠিক মনে হয়? এছাড়া মিস ইনারা এখন কোথায়? কীভাবে আছেন? আপনি কিছুই জানেন না?”
আইজা এবার কি বলবে বুঝতে পারে না। তার হাতের ট্যাবে আসা সকল বাজে কমেন্ট দেখে৷ তা দেখে সে ‘আরও বেশি ঘাবড়ে যায়।
তখন মুভিতে জড়িত একজন বলে, “মিস ইনারা আজ আমাদের সাথেই আছে। প্রশ্নগুলো আপনি তাকেই জিজ্ঞেস করতে পারেন।”
তারপর লোকটা ইশারা দেয় কাওকে। ইনারাকে স্টেজে আনার জন্য লোক পাঠানো হয়। কিছু মুহূর্ত পর দুইজন ইনারাকে নিয়ে উঠে স্টেজে। মুহূর্তে সকল রিপোর্টারদের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে তার সৌন্দর্য দেখে। ইনারা স্টেজে উঠেই সবাইকে সালাম দিয়ে মিষ্টি হাসি দেয়। সবাই মুগ্ধ হয় তার হাসিতেও। মুহূর্তে প্রশ্ন ছেড়ে চারদিকে তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করা হয়।
এই এক ঘটনাতেই মেজাজ বিগড়ে যায় আইজার। সে ট্যাবের দিকে চোখ যেতেই দেখে বেশিরভাগ কমেন্ট এখন ইনারার সৌন্দর্যকে নিয়েই। ঈর্ষায় গা জ্বলে উঠে আইজার। সে দীপাকে কানে কানে কিছু একটা বলে।
ইনারাকে বসতে বলা হয়। ইনারা সকলের সামনে দিয়ে শেষ চেয়ারের দিকে যেতে নিলেই দীপা তার পা একটু এগিয়ে দেয়। ইনারা পা’য়ে ঠোকর লেগে পড়ে যাবার যেতে নিবে তখনই জোহান তার হাত ধরে নেয়।
.
.
“সভ্য স্যার আপনি কাজ করছেন? ম্যামের ইন্টারভিউ তো শুরু হয়ে গেছে। ম্যাম সম্ভবত এসেও পরেছে।”
রহমান সভ্যের কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে বলে। সভ্য কাজ করছিলো। রহমানের কথা শুনে হাসে সে। বলে, “আমার থেকে তো তুমি বেশি উৎসুক। তুমি ভিডিও ছাড়ো। ফাইলগুলো সাইন করা প্রায় শেষ।”
রহমান জলদি করে ছাড়ে ভিডিও। সভ্য একপলক কেবল ইনারাকে দেখে একগাল হাসে। তারপর আবার তার শেষ ফাইলটি সাইন করার জন্য চোখ ফাইলে আটকায়। সাইন শেষে ফাইল রেখে সে বলে, “এখন শান্তি মতো দেখতে পারবো।”
সে ল্যাপটপের দিকে চোখ রাখতেই দেখে ইনারা নিচে পরে যাচ্ছিলো। কিন্তু একটি লোক তার হাত ধরে নেয়। ইনারা পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। সে তাকিয়ে দেখে লোকটার দিকে। এক মুহূর্তের হয় দৃষ্টিচার। তারপর ইনারা উঠে দাঁড়িয়ে হেসে লোকটাকে ‘থ্যাঙ্কিউ’ বলে নিজের সিটে যেয়ে বসে। সে লোকটা আর কেউ নয় জোহান।
সভ্যের ঠোঁটের হাসি উধাও হয়ে যায় মুহূর্ত। হাত মুঠোবন্দী করে নেয় সে। চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। সে কঠিন গলায় রহমানকে জিজ্ঞেস করে, “এই সিনেমার নায়ক কে?”
“ছোট স্যার এই যে ম্যামকে যে বাঁচিয়েছে উনিই। জোহান।”
“তোমার ম্যাম এ কথা জানতো?”
“হ্যাঁ স্যার, ম্যাম জানবে না কেন বলেন তো? সেদিনও তো অডিশন দিতে যেয়ে দেখা হয়েছিলো জোহানের সাথে।”
সভ্যের চোখের মাঝে রাগ ও কষ্ট দুটো একসাথে ভেসে উঠে। রাগে কটমট করছিলো সে। অগ্নি দৃষ্টিতে সে ল্যাপটপের দিকে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ল্যাপটপটা হাতে নিয়ে সজোরে তা দূরে ফেলে দিলো।
রহমান ভয়ে লাফিয়ে উঠে, “এই কী করলেন স্যার?”
“এক্ষুণি গাড়ি বের করো, আমি বাসায় যাব। আর ইনারার জন্যও গাড়ি পাঠাও। ও বের হয়ে যেন সবার আগে আমার সাথে দেখা করে। ওর কিছু জবাব দিতে হবে আমাকে।”
চলবে…
অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ১৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
ইনারা পিছনে ফিরে দেখে জোহান তার হাত ধরে রেখেছে। জোহানের বিশ্বাসঘাতকতার পর তার ছোঁয়া থেকেও বিরক্ত লাগে ইনারার। সে উঠে দাঁড়ায়। জোহানকে তো ছুঁতেও দেয় না সে। কিন্তু মিডিয়ার সামনে কিছু বলল না। অবশ্যই সে নিজের ইমেজ নষ্ট করতে পারে না। সে জোহানকে “থ্যাঙ্কিউ” বলে নিজের চেয়ারে যেয়ে বসে। সকলের ধ্যান তার উপরই স্থির। সকলের মধ্যে হুল্লোড় মেতে উঠে তাকে প্রশ্ন করার জন্য। এক এক করে রিপোর্টারকে বাছাই করা হয় প্রশ্ন করার জন্য এবং ইনারা বুঝে শুনে হাসিমুখে সকল প্রশ্নের উওর দেয়,
“মিস ইনারা, শোনা গেছে আপনি এই মুভিতে কাজ করছেন? যে লোক আপনার সাথে জোর জবরদস্তি করার চেষ্টা করে তার প্রডাকশনে কীভাবে আপনি কাজ করতে পারেন?”
“প্রশ্নটার জন্য ধন্যবাদ। এবং উওরে আমি বলব, সে লোকটা এখন আর এই প্রডাকশনের সাথে জড়িত নয়।
সে তার যোগ্য স্থানে, পুলিশস্টেশনে। আমাকে জানানো হয়েছে যে তাকে এই প্রডাকশন থেকে বের করা হয়েছে এবং আমার কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়া হয়েছে। একারণে আমি এখানে মুভি করার জন্য রাজি হয়েছি। এখন যার দোষ কেবল তারই তো শাস্তি হওয়া উচিত তাই না?”
“আপনি এত বছর কোথায় ছিলেন মিস ইনারা?”
“আপনাদের মাঝেই ছিলাম।”
“আপনার এবং আইজার সম্পর্কের ব্যাপারে শুনলাম। কিন্তু মিস আইজা যে এত বছর আপনার খবর নেয় নি এবং আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করা লোকটির সাথেই এতবছর কাজ করেছে তা নিয়ে আপনার মতামত কী?”
আইজা এবার ইনারার দিকে তাকায়। ঘাবড়াচ্ছে সে। ইনারাকে বলা হয়েছিলো এতটুকু বলতে যে আইজা এসব ব্যাপারে কিছু জানতো না। এমনকি সে হঠাৎ হারিয়ে যাবার কারণে সে ভিডিওটার উপর বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলো। আইজা কেবল দোয়া করতে থাকলো ইনারা যেন এ কথাই বলে। বিপরীত কিছু বলে না ফেলে।
ইনারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একপলক তাকাল আইজার দিকে। তার ঘাবড়ে যাওয়া মুখ দেখে মৃদু হাসলো। তারপর বলল, “আইজা আপু ভুল করেছিলো তার জন্য ক্ষমাও চেয়েছে। এমনকি আমি তো ফিল্মটাই করতাম না। আপু আমার পা’য়ে পড়ে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। এখন আমার মন তো এত কঠিন না যে আপুর এমন করুণ অবস্থা দেখে আমি মানা করে দিব। কেউ নিজের ভুল বুঝতে পারলে তাকে একটা সুযোগ তো দেওয়াই উচিত। তাই না আইজা আপু?” ইনারা আবার তাকায় আইজার দিকে। তার লজ্জিত মুখ দেখে বহু কষ্টে হাসি থামায় সে। আইজা এই কথাটা মানতে বাধ্য, নাহয় তার সত্যটাও সামনে আসতে পারে। কিন্তু সকলের সামনে সে অপরাধী এবং তার পা’য়ে পরার মতো লজ্জাটাও সে সামলাতে পারবে না। আইজা বিমূঢ় দৃষ্টিতে ইনারার দিকে তাকায়। না চাওয়া সত্ত্বেও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়।
এরপর অনেকক্ষণ ধরে তাদের প্রশ্ন করা হয়। ছবি নিয়ে, ছবিতে তাদের চরিত্র নিয়ে, ছবি রিলিজ নিয়ে ইত্যাদি। অবশেষে ছবির এনাউন্সমেন্ট করার সময় প্রডিউসার আসে। তিনি সকলের সাথে একত্রে ছবি তুলে। ইনারা একবার তার দিকে তাকায়। তার দৃষ্টি দেখে সুবিধার মনে হলো না। কিন্তু এটাকে নিজের মনের ভুল মনে করে সে। তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে প্রডিউসার ইনারার কাঁধে হাত রাখতেই একরকম বিশ্রী অনুভূতি হয় তার। কিন্তু সে এক মুহূর্তের জন্য নিজের মনের ভুল মনে করে। পরক্ষণেই কাঁধে হাত বুলাতে শুরু করেন তিনি। ইনারা চকিতে তার তার দিকে। লোকটা তার দিকে তাকিয়েই দাঁত কেলিয়ে হাসে।
এই মুহূর্তে মিডিয়া উপস্থিত না থাকলে তার হাত পা ভেঙে দিতো সে। কিন্তু নিজেকে সামলালো। সকলের সামনে এত বড় তামাশা সে করতে পারবে না। তাই উনার হাত ধরে নিচে নামিয়ে হাসিমুখেই সে বলল, “নিজের হাত ও চোখ নিজের কাছে সামলে রাখেন, নাহয় পরেরবার একটাও থাকবে না।”
কথাটা শুনেই লোকটার মুখ লটকে যায়। সে কেমন অদ্ভুতভাবে তাকায় ইনারার দিকে। তারপর তার পাশ থেকে সরে আইজার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়।
ইভেন্ট শেষে সকলে ব্যাক স্টেজে যায়। ইনারার কারও সাথে কথা বলার বিশেষ কোনো ইচ্ছা থাকে না। তাই সে চলে যেতে নেয়। তখনই আইজা এসে ইনারার হাত ধরে তাকে এককোণে নিয়ে যায়। আর ইনারাকে দবকতে শুরু করে, “তোকে আমি বলেছিলাম এই স্টেটমেন্ট দিবি যে আমি কিছু করি নি, জানতাম না। তুই হারিয়ে গিয়েছিলি বলে আমি কিছু জানতে পারি নি। এখানে আমার কোনো দোষ নেই। কিন্তু তুই…”
আইজার কথা শুনে ভীষণ বিরক্ত হয় ইনারা, “আমি নিলজ্জ দেখেছি কিন্তু তোমার মতো দেখি নি।”
“কী বললি আমি নিলজ্জ? তোর সাহস কত বড়!” আইজা ইনারার উপর হাত তুলতে নিলেই কেউ এসে তার হাত ধরে নেয়। আইজা পাশে তাকিয়ে দেখতে পায় জোহানকে। সে বলে, “আইজা এখানে তামাশা করো না। কেউ দেখলে তোমার সমস্যা হবে।”
আইজা ইনারার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে জোহানের বাহু ধরে বলে, “তুমি আমার কত চিন্তা করো।” আবার সে ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে, “ভুলেও ভাববি না ও তোর জন্য আমার হাত ধরেছে। এই ভেবে আবার নিজের মনের ভেতর স্বপ্ন পালার দরকার নেই। ও কেবল আমার এবং আমাকে ভালোবাসে। তাই না জান?”
আইজা ভেবেছিল ইনারা এই কথা জ্বলবে। ক’বছর আগে ইনারা জোহানের জন্য পাগল যে ছিলো। কিন্তু ইনারা উল্টো শব্দ করে হাসতে শুরু করে।
আইজা হতভম্ব।
ইনারা বলে, “একদম মেড ফর ইচ আদার। দুইজনকে কেবল একে অপরের সাথেই মানায়। দুইজনে মিথ্যুক, অপরাধী, ধোঁকাবাজ। আর মিস আইজা, আপনি বেশি উড়বেন না। ভিডিওটার কথা মনে আছে তো? সবার সামনে আপনার আসল কীর্তি কাহিনী বলিনি এটা তো আপনার ভাগ্য। আমি এত এত সহজে আপনাকে শাস্তি দিব না। আস্তে আস্তে পুড়বেন আপনি।” সে এক পা এগিয়ে আইজার মুখোমুখি হয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “তুমি ভুলে যেতে পারো তোমার পাপগুলো কিন্তু আজও আমার চোখের সামনে প্রিয়’র মৃতদেহ ভাসে। নিজের মামাকে জানিয়ে দিও তার পাপের ভাণ্ডার ফুরিয়ে গেছে। নিজের জীবনের উল্টো গণনা শুরু করতে।”
ইনারা চলে যেতে নিলেই জোহান তার সামনে এসে দাঁড়ায়, “তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
“কিন্তু আমার আপনার সাথে কোনো কথা নেই।”
ইনারা জোহানের কোনো কথা না শুনেই সেখান থেকে চলে যায়।
.
.
বাড়িতে ঢুকতেই সে দেখতে পায় সভ্যকে। সভ্য সোফায় বসে ছিলো। ইনারা তাকে দেখতেই এক দৌড়ে তার কাছে যেয়ে বসে। উৎসুক গলায় বলে, “জানেন আজ কী হয়েছে?”
“জানি তো।” গম্ভীর গলায় বলল সভ্য।
“জানেন? আপনি ইন্টারভিউ দেখেছেন?”
“দেখেছি।” সভ্য তাকায় ইনারার দিকে, “সাথে এটাও দেখেছি যে কত সুন্দর করে হেসে জোহানকে থ্যাঙ্কিউ বলেছ। কোথায় আমার দিকে তো এভাবে তাকিয়ে কখনো হেসে থ্যাঙ্কিউ বলো না।”
“হঠাৎ আপনার কি হলো?”
সভ্য রাগে ইনারার দুই বাহু ধরে। অগ্নি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলে, “জোহানের সাথে তোমার কীসের এত হাসাহাসি হ্যাঁ? আর তুমি এত কিছুর পর ওর সাথে ফিল্ম করো কীভাবে?”
ইনারা সভ্যের ব্যবহারে হতবাক, “আপনার হঠাৎ কী হলো?”
“তুমি বুঝো না কী হয়েছে? আমি টিভিতে দেখব যে আমার বউ তার প্রাক্তনের দিকে তাকিয়ে হাসছে, সে তোমাকে ধরছে আর আমি শান্ত থাকব বলছ?”
“আপনি তো এমন ব্যবহার করছেন যেন বিয়েটা আসল। আমি কি করব না করব এটা তো আপনি বলবেন না।” ইনারাও রাগে উল্টো শুনিয়ে দেয়।
সভ্য ইনারার দিকে কিছু মুহূর্ত শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “তাইতো এ বিয়ে তো আসল না। আমার তোমাকে কিছু বলারও অধিকার নেই। তুমি যা ইচ্ছা তাই করো। কেবল আজকের পর থেকে আমার সাথে কথা বলবে না।”
“আপনার সাথে কথা বলার জন্য আমি মরে যাচ্ছি না।”
সভ্য আর এক মুহূর্তটা সেখানে দাঁড়ালো না। ঝরের বেগে বেরিয়ে গেল। সাথে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে গেল।
এদিকে ইনারাও জেদে জ্বলছিল। সভ্যের এমন ব্যবহার সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।
ইনারা খাবারের সময় অপেক্ষা করল সভ্যের। কিন্তু সভ্য এলো না। যে লোক রাত আটটার সময় বাসায় এসে উপস্থিত হতো। সে রাত এগারোটার দিকেও এলো না। কিন্তু ইনারা ডাইনিং টেবিলে বসে তার অপেক্ষা করছিলো। রাত বারোটার পর এলো সভ্য। ইনারাকে ডাইনিং টেবিলে বসে থাকতে দেখেও ক্ষোভ দেখিয়ে নিজের রুমে যেয়ে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলো।
রাগে, জেদে, ক্ষোভে রাতে ইনারা না খেয়েই ঘুমিয়ে পরে।
.
.
“তোর কি সমস্যা বল তো? দুলাভাইকে তো সোজাসাপ্টা বলতে পারতি জোহানের সাথে তোর কোনো মতলব নেই। কিন্তু না, নিজে তো উল্টো জেদ দেখাবেন। ভাই সব কথা ক্লিয়ার করলেই তো পারতি।” সুরভি বলল। সে এখন বসে আছে ইনারার সামনে। ইনারার বাড়িতে৷ আজ ভার্সিটি ফাঁকি দিয়ে তার এখানে আসা। এসেই সে শুনে গতকালের কান্ড।
ইনারা উল্টো ক্ষেপে বলে, “আমি কেন ক্লিয়ার করব? ও কেন আমার উপর রাগ দেখাবে? সাহস কত ওর? আমি কী তাইলে মিডিয়ার সামনে জোহানকে থাপ্পড় মারতাম না’কি আমাকে বাঁচানোর জন্য? আর আমি জোহানের সাথে ফিল্ম করলে তার কী?”
“কারণ একসময় তুই সারাক্ষণ জোহান জোহান করতি।”
“তো ওর কী? ও কী হিসেবে জোহানকে নিয়ে আমার সাথে রাগ করবে?”
“তোর স্বামী হিসেবে। দেখ আমি মানছি দুলাভাইয়ের রাগ দেখানো উচিত হয় নি। কিন্তু কোন স্বামী সহ্য করবে তার স্ত্রী এমন কারও সাথে থাকুক। আর জোহানের সাথে তো তোর এনগেজমেন্টও ঠিক হয়েছিল। দুলাভাই তো তাও তোকে এত স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু জোহানকে নিয়ে তার অস্বস্তি ফিল করাটা স্বাভাবিক।”
“কিন্তু সভ্য তো এই বিয়ে আমাকে ভালোবেসে করে নি। বিয়েটা কেবল একটা ডিল।”
“তবুও বিয়ে তো। আর সে তোর স্বামী। হয়তো উনার পক্ষ থেকে এই বিয়েটা আর নকল না। কথা বলে দেখ।”
“এহ আমি তার সাথে কথা বলব না। আসছে আমার সাথে রাগ দেখতে, ঢং কত!”
“ইনু তুইও রাগ করে তাকে বিয়ে নিয়ে উলটা পালটা শুনিয়েছিস। তুই তাকে সরি বলবি।”
“কচু বলব। ঠিকাছে আমার ভুল হয়েছে কিন্তু আমি সেই বলব না। আমি উনার কাছে ছোট হব না।”
“তাই না?” সুরভি মৃদু হেসে বলে, “তোর কাছে কাঁচি আছে?”
“আছে। দাঁড়া দিচ্ছি।” ইনারা উঠে যেয়ে অন্যরুম থেকে একটা কাঁচি এসে সুরভির হাতে দেয়। আর সুরভি সেই কাঁচি দিয়েই ইনারার চুলের কাছে রেখে বলে, “বল এবার সরি বলবি না’কি এখনই তোর চুল কাটব?”
“শালী তুই আমার ফ্রেন্ড না ওই অসভ্যের।”
“আমার দুলাভাইয়ের শালী তো। আগে প্রমিজ কর সরি বলে সব সলভ করবি। নাহলে কাঁচি চালিয়ে দিলাম।”
“এই না। বলব বলব, সরি বলব।”
সুরভি এবার শান্ত হয়ে বসে। হেসে বলে, “এইত্তো গুড গার্ল। তোর থেকে কাজ কীভাবে বের করতে হয় তা আমি ঠিকই জানি।”
“লেডি মীরজাফর প্রো ম্যাক্স।”
সুরভি হাসে। তার ফোনটা বেজে ওঠে। আহনাফ কল দিয়েছে। সুরভি ফোনটা ধরে না। একপাশে রেখে দেয়। ইনারা বলে, “কে কল দিলো?”
“আহনাফ। পরে যেয়ে কল ব্যাক করব। এখন আমার সব সময় কেবল তোর জন্য।”
“মনে তো হচ্ছে না, কল না ধরে উপায় আছে। একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে।”
“ছেলেটা অনেক অস্থির টাইপের। ধ্যুর বাদ দে, তুই তোর কথা বল। আইজার এক্সপ্রেশনটা ডিটেইলে বল আমাকে। আমার সেই মজা লাগছে।”
সুরভি ও ইনারার গল্প করতে করতে বিকেল হয়। সুরভি যাবার পর পরই সকল কাজের লোকেরা চলে যায়। ইনারা তখন বাসায় একা। সুরভি তাকে সরি বলার জন্য জোর করলেও তার ইচ্ছা হয় বিশেষ কিছু করে সরি বলতে। তাই সে প্রথমবার রান্নাঘরে কফি ছাড়া কিছু বানাতে ঢুকল।
গভীর রাতে ঘরে প্রবেশ করে সভ্য। ঘরে এসেই হতভম্ব। এটা তার ঘর? ঘরের মেঝেতে ময়দা পরা, সোফার উপর প্লেট, ফ্রস্টিং এর পাইপ। সে এগিয়ে রান্নাঘরের সামনে দাঁড়াতেই আর প্রবেশ করার সাহস হলো না তার। আজ কী হাসনা আপা এবং বাকি সহযোগীরা আসে নি। সভ্য বিরক্ত হয়ে তার রুমের দিকে এগোল।
রুমের দরজা খুলতেই সে থতমত খেয়ে যায়। তার বিছানার সামনে একটি ছোট টেবিলে ক’টা ক্যান্ডেল এবং একটি কেক রাখা। সে এগোয়। দেখতে পায় একটি অদ্ভুত আকৃতির লাল রঙের কেক-এ “Sorry Mr. Osabhya” লেখা। সে কেকটি দেখছিল এর মাঝেই ইনারা বারান্দা থেকে দৌড়ে এসে সভ্যের সামনে দাঁড়ায়। এক হাত দিয়ে কান ধরে মুখ ফুলিয়ে বলে, “সরি।”
সভ্য তার দিকে সরু চোখে তাকায়, “সরি কেন? আর আমি তোমার কে যে সরি বলবে?”
সভ্য তাকে এড়িয়ে আলমিরার দিকে এগোয়। ইনারা আবারও দৌড়ে যেয়ে তার সামনে দাঁড়ায়, “সরি বলছি না? ভাব নিলে এই কেক আপনার মুখে মেরে দিব। আমি যে মেয়ে সারাজীবনে পানিও ফুটায় নি, আপনার জন্য কেক বানিয়েছি। আর আপনি ভাব নিচ্ছেন?”
সভ্য অন্য দিকে তাকায় ভাব নিয়ে। ইনারা রাগান্বিত হয়ে সভ্যের হাত ধরে তাকে এনে বিছানায় বসায়। তার পাশে বসে একটি ছুরি তার হাতে দিয়ে বলে, “এবার কেক কাটেন।”
“তোমার মতো দেখতে এলিয়েন সেপের কেক বানিয়েছ না’কি? ও বাহিরের এই করুণ অবস্থা তুমি করেছ?”
“এইজন্যই তো বলছি দ্রুত কেক কাটুন, তারপর বাহিরে সব পরিষ্কার করে দিবেন।”
সভ্য চোখজোড়া বড় করে তাকায় ইনারার দিকে, “নষ্ট করলে তুমি পরিষ্কার করব আমি?”
“উফফ কেক কাটেন তো।”
সভ্য নিজের মনের খুশিটা লুকানোর যথেষ্ট চেষ্টা করল। ইনারা জীবনে প্রথম কিছু বানিয়েছে, তাও কেবল তার জন্য? ভাবতেই তার মন বাগানের ভেতর প্রজাতিরা নাচতে শুরু করে। কিন্তু সে নিজের রাগী ভাবটা ছাড়ে না।
সে কেক কেটে সবার পূর্বে নিজেই খায়। মুখে দিতেই লবণের নোনতা স্বাদে তার বমি এসে পরে। মেয়েটা চিনির পরিবর্তে লবণ দিয়ে দিলো না’কি? কিন্তু সে ঠোঁটে হাসি এঁকে ইনারাকে বলল, “ওয়াও অনেক মজা হয়েছে। এর থেকে বেশি মজার কেক। আমি আগে খাই নি।”
“বলেন কি? আমাকেও খাওয়ান।”
“একদমই না। এটা আমার কেক, তাই কেবল আমি খাব। আর কেউ না।”
“এহ আমি বানিয়েছি না? একটু টেস্ট করি।”
ইনারা কেকের একপিস উঠাতেই সভ্য তাকে আটকানোর চেষ্টা করে। এমন সময় তার চোখ পড়ে ইনারার হাতের দাগের উপর। সে ইনারার হাত নিজের কাছে টেনে আঁতকে উঠল, “তোমার হাতের এ অবস্থা কেন?”
সে অন্যহাত ধরেও দেখে একই অবস্থা। দুইহাতের মধ্যেই লালচে-কালো দাগ বসে গেছে। চামড়াও উঠে যাচ্ছে। সে ঘাবড়ে যায়। চকিতে ইনারার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে “কীভাবে হলো?”
ইনারা জোরপূর্বক হাসে, “ওই’যে ওভেন থেকে বাটি বের করার সময় ভুলে খালি হাতে ধরে নিয়েছিলাম।”
সভ্য রাগী দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে। তাকে ভালো মতো ক’টা ধমক দিতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু চিন্তায় সে আপাতত এই চিন্তা বাদ দিলো। দ্রুত যেয়ে একটি মলম নিয়ে ফিরে এসে ইনারার হাতে ধরে লাগাতে নিলেই সে হাত পিছিয়ে নেয়, “লাগাব না, ব্যাথা লাগবে।”
“থাপ্পড় দিব একটা বেয়াদব মেয়ে। একতো হাত পুড়িয়ে বসে আছো এর উপর মলম লাগাতে গেলে ব্যাথা লাগবে?” সভ্য ধমক দিয়ে বলল। তার ইনারার উপর যেমন রাগ উঠছিলো তেমনি তার ব্যাথা দেখে বুক জ্বলছিল তার। তার নিজেরই হাত কাঁপছিলো মলম লাগাতে। সে সহজে কাঁদে না, অথচ আজ ইনারার আঘাতেই তার চোখ ভিজে গেছে। বুক কাঁপছিল তার।
ইনারা তার ধমক শুনে বাচ্চা মেয়ের মতো চুপটি করে বসে ছিলো। হঠাৎ তার আজ সুরভির কথা মনে পড়ে। সে বলে উঠে, “আমি জানতাম আপনি আমার বাছাই করা ফিল্ম সম্পর্কে সব খবর জানেন। যেহেতু বাকিসব খবরও রহমান ভাই আপনাকে দেয়। জোহানের সাথে ফিল্ম করছি তাও ভেবেছি জানেন। তাই আর জানানোর চেষ্টা করি নি। এছাড়া আমি তখন মিডিয়া সামনে আছে বলে ওর সামনে হেসেছিলাম, নাহলে সে আইজা এবং মুশতাকের সাহায্য করেছে জানার পর তার দিকে তাকিয়ে হাসবো আমি? আমি কেবল তাদের ধ্বংস করতে চাই। এই তালিকায় জোহানও আছে। ওর প্রতি আমার অনুভূতিগুলো অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।”
সভ্য ইনারার কথা শুনে তার দিকে তাকায়, “আর তুমি কথাগুলো আমাকে বলছ কেন?”
“কারণ আপনি আমার স্বামী।” মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলার পর সে আবার বলে, “দুইবছরের জন্য হলেও তো স্বামী। আপনি মানা করলে এই ছবিটা আমি করব না।”
অজান্তেই সভ্যর ঠোঁটে হাসি এঁকে উঠে। সে ইনারার হাতের দিকে তাকিয়ে মলম লাগাতে লাগাতে আবার বলে, “ঠিকাছে, আমার সমস্যা নেই। কিন্তু একটা কথা বলে দেই, তুমি জোহান কেন কোনো নায়কের সাথে কোনো ধরণের রোমেন্টিক সিন করতে পারবে না।”
“কেন?”
সভ্য ইনারার হাতে মলম লাগানো শেষ তা ইনারার কোলে রাখে। ইনারার দিকে এগোয় সে। চোখে চোখ রাখে। হয় মিষ্টি দৃষ্টিচার। তার কপালে চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে, “তুমি বলেছিলে না আমি তোমার স্বামী। তোমার কাছে আসার, তোমার নয়ন সায়রে ডোবার, তোমায় ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার কেবল আমার আছে। অন্যকোনো পুরুষ তোমায় ছুঁলে আমার সহ্য হয় না।”
চলবে…
[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]