অনুভবে ২ পর্ব-১৪+১৫

0
801

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ১৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

জোহান শুটিং এর জন্য বাহিরের দেশে গিয়েছিল। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এলো নতুন মুভির জন্য সাইন করতে। যেহেতু সকল ফিল্ম বাছাই করার দায়িত্ব জোহানের টিমের তাই এখনো সে স্ক্রিপ্টই পড়ে নি। তাই যতটুকু পারছে এই পথেই পড়ে নিচ্ছে। সে দ্রুত এজেন্সির ভেতর ঢুকছিল। এখান থেকে তার আবার একটা নতুন গানের রেকর্ডিংও করতে হবে।

তাড়াহুড়ো করে ভেতরে যাওয়া এবং তার স্ক্রিপ্টের দিকে চোখ থাকার কারণে সামনের দিকে নজর ছিলো না তার। তাই তার সামনে থাকা একজনের সাথে ধাক্কা লাগে তার। সে থেমে যায়। পিছনে ফিরে দেখে একটি মেয়ের সাথে ধাক্কা লেহেছে তার। মেয়েটি লেভেন্ডার ড্রেস পরে আছে। তার সরি বলার আগেই মেয়েটি নিচে বসে পরে তার ফোন নেবার জন্য এবং বিরক্তির সুরে বলে, “দেখে চলতে পারেন না? দেখে চললে কী বিশেষ সমস্যা হয়?”

কন্ঠটা শুনে জোহান এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। কন্ঠটা যে তার ভীষণ চেনা মনে হলো। মেয়েটির দিকে স্থির থাকে তার দৃষ্টি। মেয়েটা উঠে দাঁড়াতেই তার স্থির থাকা চোখ দুটো যেন কোটের থেকে বের হয়ে আসতে চাইল। তার সামনে ইনারা দাঁড়ানো। নিজের দৃষ্টিকে বিশ্বাস হলো না তার।

ইনারা উঠে জোহানকে দেখতেই অপ্রস্তুত হয়ে যায়। জোহানের সাথে এখনই দেখা হবার পরিকল্পনা সে করেনি। তার মনে পড়ল সভ্য এখনো ফোনে আছে। সে জোহানের দিকে তাকিয়েই ফোনটা কানের কাছে নিলো। বলল, “আমি আপনাকে এখান থেকে বের হয়ে কল দিচ্ছি।”
বলে সে ফোন কেটে দেয়।

জোহান তার হাতের স্ক্রিপ্টটা মেঝেতে ফেলে গর্জন করে উঠে, “তুমি এখানে কী করছ?”
তারা এক কথাতেই সকলের দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় তাদের দুজনের উপর। এখানে চোখ বুলিয়ে সবার দিকে একনজর তাকায়। তারপর হঠাৎ নিজের ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে আনে, “আপনি মিঃ জোহান না? আহা দেখলন আপনাকে চিনতেই পারি নি আমি। আমি তো অডিশন দিতে এসেছি। আপনি এখানে কী করছেন? ওহ আপনিও এই মুভিতে আছেন। আমিই না ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা আমি যাই, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।” ইনারা জোহানের পাশ কাটিয়ে যাবার সময় তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, “নিজের কন্ঠ এবং হাত দুটোই কন্ট্রোলে রাখুন, নাহয় প্রশ্ন উঠলে নিজের কুকর্মের কথা কীভাবে সবাইকে বলবেন। তাই ভেবেচিন্তে মুখ আর হাত চালাবেন। বুঝলেন?”

জোহান ইনারার দিকে তাকায়। ইনারার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে এখনই তার চোখের ভেতর থেকে আগুনের ফুলকি বের হয়ে তাকে ধ্বংস করে দিতে প্রস্তুত। সে নিজেকে সামলায়। কোনো এক ভুল পদক্ষেপ অনেক বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই নিজের স্ক্রিপ্টটা নিয়ে সে ভেতরের দিকে যায়।

ইনারা অনেকক্ষণ পর খুঁজে পায় অডিশন রুমটা। রুমের দরজার বাহির থেকে জিজ্ঞেস করে, “আসবো?”
“আসুন।”
অনুমতি মেয়ে ইনারা ভিতরে ঢুকে। দেখে সেখানে আগের থেকে কয়েকজন উপস্থিত। এর মধ্যে দীপাকে দেখে সে খানিকটা অবাক হয়।
পরিচালক রফিক তার দিকে তাকিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলে, “আপনার আসতে এত দেরি হলো কেন?”
“রুম খুঁজে পেতে সমস্যা হচ্ছিল।”
“তাহলে আগে আসবেন খোঁজার জন্য। ” রুক্ষ গলায় বলে পরিচালক রফিক, “আমাদের কোনো কাজ কাম নেই যে আপনার জন্য এখানে অপেক্ষা করব আমরা? আপনার কি সময়ে আসার মতো ভদ্রতা নেই?”

এবার ইনারার মেজাজ বিগড়ায়। সে হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় পরিচালকের দিকে। জোর গলায় উওর দেয়, “আর আপনার এতটুকু ভদ্রতা নেই যে আপনার কর্মীদের এতটুকু শিখাবেন কেউ ডিরেকশন জিজ্ঞেস করলে তা বলতে হয়। আর আপনি কি শিখাবেন? আপনার মাঝে কোনো ভদ্রতা আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।”

ইনারার মুখ থেকে এমন সরাসরি কথা শুনে গলা দিয়ে কিছু মুহূর্তের জন্য শব্দ বের হলো না রফিকের। এত জনের সামনে তাকে একজন অপমান করছে সে ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না। প্রায় সাত বছর ধরে সে পরিচালক হিসেবে কাজ করছে। আজ পর্যন্ত কেউ তার সাথে এভাবে কথা বলে নি। আর এই মেয়ে কি না প্রথম দেখাতেই তার মুখের উপর এভাবে কথা বলছে? তাও চরিত্র পাবার আগেই! সে আঁতকে উঠল, “তোমার সাহস তো কম না আমার সাথে এ সুরে কথা বলছ?”
“কেন? আপনি বলতে পারলে আমি পারব না কেন? আপনি আমার সাথে যে সুরে কথা বলছেন আমিও সে সুরে বলছি। আপনি ভালোভাবে কথা বললে আমিও আপনার সাথে ভালোভাবে কথা বলব। সোজাসাপটা ব্যাপার।”
রফিক সাহেব সামনে কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলেন। সে দরজা দিয়ে জোহানকে ঢুকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে যায়। বিনয়ের সাথে তাকে বলে, “আরে জোহান তুমি এসেছ? তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম। আসো তোমার সাইনের কাজটা আগে সারিয়ে আসি।”
“আপনার না এখন অডিশন নেবার সময়? আমি দেখা করতে আসলাম কেবল।”
“আরে ওরা অপেক্ষা করতে পারবে। তুমি গুরুত্বপূর্ণ। তোমার কাজ আগে সারিয়ে আসি।”
রফিক জোহানকে নিয়ে দরজা থেকে বের হবার পূর্বেই ইনারা বলে, “আমি কারও অপেক্ষা করতে পারব না। আপনি এখন অডিশন না নিলে আমি চলে যাচ্ছি। আমার এত সময় নেই।”

রফিক ইনারার দিকে তাকায় অবাক দৃষ্টিতে, “তুমি এখানে অডিশন দিতে এসেছ। কিন্তু তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে কত বড় অভিনেত্রী তুমি!”
ইনারা বাঁকা হাসে, “আপনি আমার পাঁচ মিনিট দেরিতে আসায় আমাকে ভদ্রতার লেকচার দিয়েছিলেন। যেখানে আমাকে না রুম নাম্বার বলা হয়েছে, আর না দেখানো হয়েছে। এখন আপনি আমাদের অপেক্ষা করতে বলছেন। কেন এখন অডিশনে দেরি হবে না। আর হ্যাঁ আমি এখন কোনো বড় নায়িকা নই। আর এক কাজ করুন, আপনার স্ক্রিপ্ট আপনি রাখুন। আমি চললাম।”

ইনারাকে যেতে দেখে রফিক সাহেব মেজাজ খারাপ করে বলেন, “এক মিনিট, অডিশন করেই যাচ্ছি।”
জোহানের দিকে সে তাকিয়ে আবার বলে, ” জোহান এই ঝামেলা আগে শেষ করে নেই। তারপর আরামে বসে তোমার চরিত্র ও মুভি সম্পর্কে কথা বলতে পারব।”
পাশ থেকেই জোহানের এসিস্ট্যান্ট বলে, “কিন্তু স্যারের দেরি হয়ে যাচ্ছে। উনার তো আরও কাজ আছে না’কি?”
জোহান ইনারার দিকে তাকায়। চোখ সরায় না। তার দিকে তাকিয়ে থেকেই উওর দেয়, “না, আমার কোনো তাড়া নেই।”
জোহানকে রফিকের পাশে বসার জন্য একটি চেয়ার দেয়া হলো। সামনের বেঞ্চে বসে ছিলো ইনারাসহ চারটি মেয়ে। সবাই অভিনেত্রী। আগে কোনো না কোনো সিনেমায় কাজ করেছে। এর মাঝে কেবল ইনারাই নতুন। তার হাতে একটি কাগজ দেওয়া হলো। কাগজে লেখা তার এই মুহূর্তে কি পরিস্থিতিতে অভিনয় করতে হবে। পরিস্থিতিটা এমন যে একটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ছেলে অন্য সম্পর্কে জড়ায়। মেয়েটিকে একথা জানানোর পর তার প্রতিক্রিয়া দ্বারাই এই দৃশ্য উপস্থাপন করতে হবে।

ইনারার সম্পূর্ণ ধ্যান ছিলো তার স্ক্রিপ্টের উপর। আর জোহানের সম্পূর্ণ ধ্যান তার উপর । রফিক এই সিনেমা নিয়ে অনেক কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু সেদিকে জোহানের মাথাব্যথা নেই। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইনারা দিকে।
হঠাৎ করে রফিক তার বাহু ধরে নাড়িয়ে বলে, “জোহান তুমি আমার কথা শুনছো?”
জোহান আগে পরে কিছু না ভেবে বলে, “রফিক এই মেয়েকে আমি মুভিতে চাই না।”
“কী? কিন্তু ওর অডিশন নেবার কথা প্রডিউসার নিজে বলেছে। আইজাও রিকুয়েষ্ট করেছে।”
“আমি ফ্রী তে এই মুভি করতে রাজি কিন্তু ও যেন এই মুভিতে না থাকে।”
রফিক অনেকটা বিস্মিত সুরে বলে, “ওর সাথে তোমার কোনো সমস্যা আছে?”
“সেটা তোমার না জানলেও চলবে। কেবল আমি এই মেয়েকে মুভিতে চাই না।”
“ঠিকাছে। যেভাবে বলছ সেভাবেই হবে।”

দীপা ইনারার সামনে এসে দাঁড়ায়, “তুমি অকারণে এত কষ্ট করে স্ক্রিপ্ট পড়ছ। স্যারের সাথে এমন বেয়াদবি করার পর তোমাকে এই চরিত্রে নিবে ভেবেছ? একতো এতগুলো অভিজ্ঞ অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে অডিশন দিতে এলে আর প্রথম দেখায় পরিচালকের সাথে খারাপ ব্যবহার করলে? নিজের পা’য়ে নিজে কুড়াল মারে কীভাবে তা তোমার থেকে শেখা উচিত।”
ইনারা মুখ তুলে তাকাতেই দীপার কপাল কুঁচকে যায়। মুখে কালো ছায়া এসে জমে, “তোমাকে কোথায় যেন আমি দেখেছি। তু-তুমি ইনারা না?”
“চিনতে বেশি দেরি হলো না। আর কী বললেন নিজের পা’য়ের নিজে কুড়াল মেরেছি? এক সময়ের বিখ্যাত অভিনেত্রী আজ নতুন আসা মানুষদের সাথে একটি সাইড ক্যারেক্টর এর জন্য অডিশন দিচ্ছে। এতে তো মনে হয় আপনিই নিজের পা’য়ে নিজে কুড়াল মেরেছেন।”
দীপার সম্পূর্ণ কথা কানেও গেল না৷ সে হা করে তাকিয়ে রইলো ইনারার দিকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যাচাই করল। একসময় যে ছেলেদের মতো বেখেয়ালি ভাবে চলাফেরা করতো তাকে কখনো এত সুন্দর দেখাতে পারে কল্পনাও করে নি সে। তার গলায় সকল শব্দ এসে জমাট বেঁধেছে। তাই ইনারার কথার উওরও দিতে পারছে না সে।

একজন স্টাফ ঘোষণা করল তাদের অডিশনের সময় শুরু হয়ে গেছে। সবার পূর্বে দীপার পালা এবং শেষে ইনারার। মাঝখানে আরও তিনজন আছে। যেহেতু সবাইকে একই স্ক্রিপ্ট দেওয়া হয়েছে সেহেতু দীপার চরিত্র পাবার সুযোগ সবচেয়ে বেশি এবং ইনারার সবচেয়ে কম। একজন স্টাফকে তাদের সাথে অভিনয় করার জন্য দাঁড় করানো হয়েছে। ছেলেটি তার ডায়লগ বলার পর অভিনয় করছে মেয়েরা। দীপার অভিনয়টা আসলেই বেশ ভালো এবং আবেগী ছিলো। সে অডিশন দিয়েই ইনারার পাশে এসে বসে বলে, “তখন কি বলছিলে যেন? আমি প্রধান চরিত্রে এখন আর অভিনয় না করলেও এই চরিত্রের জন্য ফার্স্ট চয়েজ আমি। তাইতো আমাকে সবার আগে সুযোগ দেওয়া হয়েছ। দেখেছ দ্বিতীয়জন আমার মতো অভিনয় করছে। সবাই এই অভিনয় করবে। কারণ কোনো বিকল্প নেই। তাই পরিচালক প্রথম পার্ফোরমেন্স এর উপর প্রভাবিত হবে এবং আমাকে বাছাই করবেন।”
ইনারা হাসে। সে উওর দেয় না। তার স্ক্রিপ্ট পড়ায় ধ্যান দেয়। তবে দীপার কথাটা ঠিক হয়। সকলেই দীপার মতো আবেগপ্রবণ অভিনয় প্রদর্শন করে।

ইনারার সুযোগ আসে। সে উঠে যেয়ে দাঁড়ায় ছেলেটার সামনে। ছেলেটা স্বাভাবিকভাবেই তার সংলাপের অংশটি বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দেও, আমি এখন আর তোমাকে ভালোবাসি না। গত ছয় বছর খুব ভালো সময় কাটিয়েছি আমরা। কিন্তু তোমার প্রতি এখন আর ভালোবাসা অনুভব করতে পারি না আমি। আমি অন্যকাওকে ভালোবাসি।”
ইনারা থিয়েটারে এমন দৃশ্যতে অভিনয় আগেও করেছে। সবগুলোতে সে কান্নাকাটির দৃশ্য। সবাই এই মুহূর্তে তাকে এমন অভিনয় করার প্রত্যাশাই করছিল। এবং একই ধরনের অভিনয় দেখে দেখে সকলের মাঝে একরকম বিরক্তিও এসে পড়েছে। কিন্তু ইনারা উল্টো কাজ করল।

“ভালোবাসা অনুভব করতে পারো মানেটা কী?” শান্ত গলায় বলে ইনারা। পরক্ষণেই সে রাগে গর্জন করে উঠলো, “ভালোবাসার অনুভূতি হারিয়ে যাওয়াটা কি এতটাই সহজ? আমার জীবনের এতটা বছর বরবাদ করার পর তুই এখন অন্যকাওকে ভালোবাসিস? তাহলে এতটা বছর আমাদের মাঝে কী ছিলো?”
ইনারার গর্জন শুনে তার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি কেঁপে উঠে। সে ভয়ে পিছনে সরে যায়। ইনারা তার কলার চেপে ধরে রাগান্বিত সুরে বলে, “আমাকে খেলনা পেয়েছিস তুই? যখন ইচ্ছা ভালোবেসে কাছে টেনে নিবি আর যখন ইচ্ছা জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিবি? একজনের সাথে সম্পর্কে থাকার পর অন্যকাওকে ভালোবাসা এতই সহজ তোর জন্য? একবার আমার কথা চিন্তা করেছিলি তুই? এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে ভালোবাসলে আমাকে কষ্ট দেবার পূর্বে হাজারোবার ভাবতি তুই।”
ইনারার গলা কেঁপে উঠে। তার চোখে ভিজে আসে।

“স্যার এসব ডায়লগ তো স্ক্রিপ্টেই নেই।” একজন কথাটা বলল পরিচালক রফিককে। রফিক সাহেব ইনারার পার্ফোরমেন্স দেখায় ব্যস্ত। তাকে উৎসুক দেখাচ্ছে। সে ছেলেটিকে বলল, “স্ক্রিপ্ট থেকে বেটার। চুপ করো তো।আর আমাকে অভিনয়টা দেখতে দেও। একদম আসল মনে হচ্ছে।”

ইনারা কাঁপছিলো। কিন্তু তাও তার ভেজা চোখে যেন অগ্নির ফুলকি উঠছে। সে ক্ষোভের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমাকে আঘাত দেবার আগে একশোবার ভাবা উচিত ছিলো। আহত বাঘিনী কারও জীবনও নিতে পারে। কি ভেবেছিস? এভাবে এসে বলবি তুই অন্যকাওকে ভালোবাসিস আর আমি বিগত ছয় বছর ভুলে তোর খুশি চাইবো। আমাকে কষ্ট দেবার পরিবর্তে জীবন বরবাদ করে দিব তোর। আমি ফুলের মতো মিষ্টি হতে পারলে, সে ফুলের কাঁটাও হতে পারি।”

“মাফ করে দেন আপু। ভুল হয়ে গেছে।” ইনারার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি ভীত গলায় বলল। ইনারা থতমত খেয়ে গেল, “আমরা তো এক্টিং করছি।”
“আপনি যেভাবে বললেন ভয় পাইসি আমি।”

রফিক সাহেব শব্দ করে হাসে। সে ইনারার সামনে এসে দাঁড়ায়, “তুমি বাকি সবার থেকে উল্টো অভিনয় করলে কেন জানতে পারি?”
“অবশ্যই পারেন। আমি স্ক্রিপ্ট পড়ে চরিত্রটাকে যতটা বুঝেছি সেই চরিত্র আবেগ প্রকাশ করে না। এছাড়া ব্যক্তিগত ভাবে যে বিশ্বাসঘাতকতা করবে তার কাছে ভালোবাসার ভিক্ষা করার অর্থ হয় না।”
“ওয়েল ডান। এই চরিত্রটা তোমার।”

জোহান বিস্মিত ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পূর্বেই রফিক তাকে কথা দিয়েছিলো সে ইনারাকে কাস্ট করবে না আর এখনই তাকে মুভিতে নিয়ে নিলো!
দীপা আঁতকে উঠে বলল, “কিন্তু আমাদের রেজাল্ট তো একসাপ্তাহ পর দেবার কথা। আর ও আপনার দাথে বেয়াদবি করেছিল তার কী?”
“আমি ব্যক্তিগত ক্ষোভ আমার কাজের উপর তো ফেলবো না। এছাড়া ওর মতো পাওয়ারফুল অভিনেত্রীর সাথে অনেক বছর হলো কাজ করি নি। কিন্তু ডোন্ট ওয়ারি, তোমাদের অন্য চরিত্রের জন্য বাছাই করার চিন্তা ভাবনা করেছি। আর মিস ইনারা, অভিনন্দন। এভাবেই এটাটিউড রাখবেন চৈতীর চরিত্রের সময় কাজে লাগবে।”
রফিক সাহেব হাত বাড়ালে ইনারাও মৃদু হেসে হাত মেলায়, “আপনার সাথে কাজ করার অপেক্ষায় থাকব।”

রফিক সাহেব যেতে নিলে জোহান দরজায় তাকে আটকায়, “আপনি বলেছিলেন ওকে নিবেন না।”
রফিক হাসে, “এখন জোহান তুমি তো ওর অভিনয় দেখেছ। ওকে না নিলে আমার নিজের কাছেই বোকা লাগবে। আর আমি চাই না আমার পূর্বে ওকে অন্যকেউ কাস্ট করুক। ওর অভিনয় সুন্দর হলে নাম তো আমারও হবে। এছাড়া আইজা ও প্রডিউসার দুইজনকে ওকে নিতে বলেছে। আর এত হাই বাজেট ফিল্মে তোমাকে কিছু টাকা দিলে তো বিশেষ সমস্যা হবে না। আর টাকা না দিলে আহামরি লাভও হবে না। এসব বাদ দিয়ে আসো তোমার সাইনটা করে নেও।”
“আপনি যান, আমি একটু পর আসছি।”

ইনারা বেঞ্চ থেকে তার ব্যাগ নিয়ে দীপার দিকে তাকিয়ে হাসি দিলো। হাসিটা দেখেই যেন দীপার শরীর জ্বলে উঠছিল। ইনারা বিড়বিড় করে বলে, “শুটিং করতে যা মজা হবে তা ভেবেই আমার আর তর সইছে না।”
সে ফিরে যেতে নিলেই পথে জোহান তার হাত ধরে নেয়, “তুমি এই মুভি করতে পারো না।”
“আমি কি করতে পারি আর কি না তা আপনার থেকে জিজ্ঞেস করতে হবে?”
“ইনারা তুমি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আসতে পারবে না।”
“তাহলে থামিয়ে দেখান।”
“চেলেঞ্জ দিচ্ছ? তোমার কী মনে হয় তুমি আইজাকে ব্লাকমেইল করে যা ইচ্ছা করতে পারবে? আমি এতদিন এই দেশে ছিলাম না, নাহলে তুমি এইখানে অডিশন দিতেও আসতে পারতে না।”
ইনারা তাচ্ছিল্য হাসে, “আপনার মনে হয় আপনি আমাকে আটকাতে পারবেন? আচ্ছা আইজার সাথে আমার ছবি ছাপা, হঠাৎ আমার আপনাদের সামনে উপস্থিত হওয়া, এখানে অডিশনে এসে সিলেক্টও হয়ে যাওয়া। এসব নিয়তি মনে হয় আপনার? একটা মজার কথা বলি? এসব আমি করেছি। আপনি আমার আপন কেউ না তো তাই আপনি আমাকে এত আঘাত দিতে পারেন নি। কিন্তু যতটা আঘাত দিয়েছেন তার থেকে বেশি ফিরিয়ে দিব। নিজের সীমায় থাকুন, এখনো আপনার পরিণতির সময় আসে নি। বেশি লাফালাফি করলে আইজার আগে আপনাকে শিক্ষা দিতে বাধ্য হবো আমি। আর আমার হাত ধরার সাহস করবেন না।”
ইনারা এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে নিলো।

জোহান হাতটা মুঠো করে। চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল।
.
.
ইনারা অডিশন দিয়ে বাসায় যাবার পূর্বে সুরভির সাথে দেখা করে নেয়। বাসায় যেতে যেতে রাত হয় তার। সে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে পিছনে ফিরে সভ্যকে দেখে চমকে উঠে। সে নিজের বুকে হাত রেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে, “এভাবে দরজায় ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
“আমার বউয়ের অপেক্ষা করছিলাম।”
“আপনাকে মানা করেছি না এই বউ বউ করবেন না।”
সভ্য ইনারার কাঁধের একপাশের দেয়ালে হাত রেখে তার দিকে ঝুঁকে বলে, “তাহলে কী বলব তুমিই বলে দেও।”
সভ্যের তার দিকে আসা দেখে ইনারা লজ্জায় ডুবে যায়। তার চোখে লজ্জার ছোঁয়া দেখা যায়। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সভ্যর বুকে হাত রেখে ধীরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে, “বিরক্ত করবেন না।”
“অডিশন কেমন গেল তা তো বলো।”
ইনারা ব্যাগ বিছানায় রেখে বসে বলে, “আমি সিলেক্ট হয়ে গেছি।”
“আমি জানতাম। এখন ট্রিট কোথায়? আজ খুশিতে আমি মিষ্টি কিছু খাব।”
“মিষ্টি আর আপনি! অবাক কান্ড। আপনি নিজের মত পাল্টাবেন না। বসে থাকুন আমি এখনি রহমান ভাইকে মিষ্টি আনতে বলছি।”
ইনারা উঠে যেতে নিলেই সভ্য তার হাত ধরে এক টানে তাকে বিছানায় বসায়। তার গালে হাত রেখে আঙুল বুলিয়ে বলে, “মিষ্টি তো তোমার কাছেই আছে।”
“আমার কাছে? কীভাবে?”
সভ্যের দৃষ্টি ইনারার ঠোঁটের উপর। তার আঙুলের ছোঁয়া ইনারার ঠোঁটে পেতে সে কেঁপে উঠে। নম্র দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্যের দৃষ্টি মুগ্ধ, নেশায় আসক্ত। সে দৃষ্টি যেন তার হৃদয়ে তীরের মতো লাগছে। সভ্য ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে তার দিকে মুগ্ধতা ভরা দৃষ্টিতে চাইলো। তার চুলে হাত বুলালো। এরপর তার দিকে এগিয়ে এলো। তাকে চুমু খাওয়ার জন্য। ইনারাও শক্ত করে মুঠোয় আঁকড়ে ধরে তার স্কার্ফ। চেপে বন্ধ করে রাখে তার চোখ
জোড়া।

দরজা খোলার শব্দে দুইজনে চমকে উঠে। চোখ খুলেই সরে যায় দুইজনে। সভ্য বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বছর, “এই দুনিয়া আমার প্রেমের দুশমন। এমনিতেই আমার বউ দজ্জাল। এর মধ্যে আধ একটু রোমেন্স করার সুযোগ পাই কেউ না কেউ টপকাবেই।”
সে দেখে দরজায় রহমান দাঁড়ানো। সে ক্ষেপে উঠে, “তুমি এখানে কী করছ?”
“আপনাদের মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে?”
“এই তুমি নক করে আসতে পারো না? সবাই কী সভ্যতা, ভদ্রতা ভুলে যাচ্ছে না’কি আজকাল?”
“স্যার..স্যার এখন সভ্যতা, ভদ্রতার সময় নেই। নিজের জান বাঁচান।”
“কোন জায়গায় ভূমিকম্প এসেছে?”
“ভূমিকম্প না, দাদাজান এসেছে।”
কথাটা শুনতে না শুনতেই সভ্যর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। নিজেকে না সামলাতে পেরে বিছানা থেকে ঠাস করে পড়ে যায় সে। এক ঢোক গিলে সে। তার গলার স্বর চিকন হয়ে আসে। সে ভীত গলায় বলে, “কে…কে এসেছে?”
“দাদাজান।”

চলবে…

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ১৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারা রহমানকে দেখে প্রথমে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও যখন জানতে পারলো রহমান কিছু দেখে নি তখন শান্তির নিশ্বাস ফেলে। পরক্ষণেই সে শুনে সভ্যের দাদাজান এসেছে। তার মুখের খুশি কে দেখে? তার সাথে দেখা করার অনেক বছরের ইচ্ছা ছিলো ইনারার। যে এত বছর ধরে তার এত সাহায্য করেছে তাকে দেখার খুব শখ ছিলো। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার শখ ছিলো। সে দেখলো দাদাজানের কথা শুনে সভ্য বিছানা থেকে নিচেই পড়ে যায়। কিন্তু সেদিকে ইনারা পাত্তা না দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি জলদি করে উনার সাথে দেখা করে আসছি।”
ইনারা দ্রুত রহামানের পাশ কাটিয়ে চলে গেল সেখান থেকে।

সভ্য ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ আতঙ্কিত সুরে রহমানকে বলল, “ওকে আটকাও।”
“কেন স্যার? বড় স্যারের সাথে দেখা করার জন্য কত উৎসুক ম্যাডাম দেখুন।”
“আরে গর্দভ ইনারা জানে দাদাজান আমাদের বিয়ে করিয়েছে। আর দাদাজান বিয়ের সম্পর্কে কিছু জানে না। জানলে তোমাকে আমাকে দুইজনেকে ফাঁসিতে চড়াবে।”
“এই কথা তো ভাবি নি।”
বলে রহমান এক দৌড় দিলো ইনারার পিছনে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। ইনারা দাদাজানের সামনে দাঁড়ানো।

সভ্যও দ্রুত উঠে যায় রহমানের পিছনে। ইনারাকে দাদাজানের সামনে দেখে ঘাবড়ে যায়। তবুও সে যেয়ে প্রথমে দাদাজানকে সালাম দিয়ে ইনারার দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বলে, “অনুমতি না নিয়ে এখানে এলে কেন?”
ইনারা সভ্যের কথার ধরণ দেখে অবাক হয়, “অনুমতি নেওয়া লাগবে মানে?”
“মানে নিজের রুমে যাও। না ডাকা পর্যন্ত আসবে না।”
“আমি তো কেবল দাদাজানের সাথে দেখা…”
সভ্য তার কথা কেটে আদেশের সুরে বলে, “ইনারা নিজের রুমে যাও।”

ইনারা সরু দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। দাদাজানের সামনে মারতেও পারবে না সভ্যকে, নাহলে এতক্ষণে হাড্ডি ভেঙে দিতো। সাহস কত বড় তার সাথে জোর গলায় কথা বলছে। সে মৃদু গলায় বলল, “একা দেখা হোক, পরে মজা বুঝাচ্ছি।”
সভ্য তার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ইনারার যাবার পর্যন্ত অপেক্ষা করল। সে যেতে না যেতেই সভ্য দাদাজানের দিকে তাকায়। দাদাজানের দৃষ্টিই যথেষ্ট ভয়ে তার নিশ্বাস বন্ধ করার জন্য। সে এক ঢোক গিলে। দাদাজান তার হাতের লাঠিটা মেঝেতে বারি দিয়ে কাঠ-কাঠ গলায় বলে, “তুমি কি বুঝেছ এক মেয়ের সাথে তুমি আমার বাড়িতে থাকবে অথচ আমি জানব না?”
সভ্য রহমানের দিকে তাকাতেই সে বলে উঠে, “সত্যি আমি কিছু জানাই নাই।”
দাদাজান আবার প্রশ্ন করেন, “ওর দিকে কি তাকাচ্ছ? এই বাড়িতে কি হচ্ছে না হচ্ছে এর খবর অন্য কেউ দিতে পারে না আমাকে? এখন বলো মেয়েটা কে?”

সভ্য একদৌড়ে যেয়ে তার দাদাজানের পা’য়ের কাছে যেয়ে বসে। ভীতিকর ও অস্থির গলায় বলে, “দাদাজান…দাদাজান ক্ষমা করে দেন আপনাকে না জানিয়ে আমি বিয়ে করে ফেলছি। আমি জানি আমার এটা করা উচিত হয় নি। কিন্তু কিছু করার ছিলো না। ক্ষমা করে দেন দাদাজান। আর ভুল হবে না দাদাজান। সরি…সরি…”
দাদাজান সভ্যের কাঁধে হাত রাখতেই সে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।
দাদাজান বলেন, “সাব্বাশ এই না হলে আমার নাতি।”

সভ্য চোখ খুলে প্রথমে অবাক হয়ে দাদাজানের দিকে তাকায়। সে ভাবে নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে সে। নিজের হাতে চিমটি কেটে ব্যাথায় লাফিয়ে উঠে। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দাদাজানের দিকে। তার চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। যেন ভীষণ অবাক করা কিছু দেখে নিয়েছে সে। সে আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করে, “আপনি রাগ হন নি?”
“রাগ হবো কেন? জীবনে প্রথম কোনো প্রশংসনীয় কাজ করলি?”
“কী প্রশংসনীয় কাজ করলাম?”
“প্রেম করে বিয়ে করলি।”
“এটা প্রশংসনীয়?”
“তো কী? তুই প্রমাণ করে দিলি তুই আসলে আমার মতোই। যুদ্ধের আগে তো তোর দাদীজানকে নিয়ে পালিয়ে যেয়ে বিয়ে করেছিলাম আমি। সে কী অবস্থা! কিন্তু রোমাঞ্চকরও ছিলো বটে। আমার বাবাও তো প্রেম করে মা’কে বিয়ে করেছিলেন। আর অন্যদিকে তোর বাপ, ছাগল একটা। একটা প্রেমও করতে পারে নাই, ধ্যুর! তোর ভাই তো আরও এগিয়ে। বিয়ের কথা বললে যেভাবে কাজের বাহানায় বিয়ের কথা এড়িয়ে যায় মনে হয় তার থেকে বেশি কাজ আর কেউ করে না। তুই আমার দিল খুশি করে দিলি।”
সভ্য জোরপূর্বক হাসে। সারাজীবন সে পড়াশোনায় প্রথম হতো, খেলাধুলাতেও। দেশের সবচেয়ে বড় ব্যান্ড তার ছিলো। তার গানের প্রশংসা পৃথিবী জুড়ে। কিন্তু আজ সে প্রথম তার দাদাজানের কাছে সাব্বাশি পাচ্ছে তাও প্রেম করে বিয়ে করায়।

দাদাজান পরক্ষণেই ধমক দিয়ে বললেন, “কিন্তু তোর সাহস তো কম নয়, আমার সামনে আমার নাতবৌকে তুই ধমক দিয়েছিস! আমাদের ঘরে নারীদের সাথে উঁচু আওয়াজে কথা বলার শাস্তি তুই জানিস না?”
সভ্য বিড়বিড় করে বলল, “আপনার নাতবৌ একটুপর আমার জীবন হারাম করে দিবে।”
“এখন কী বলছিস তুই? আমি কি বলেছি তার উওর দে।” দাদাজানের কঠিন কথার ধরণে ছোটবেলা থেকেই ভয় পায় সভ্য। তার কথা শুনলেই বুকের ভেতর কেঁপে উঠে।
সভ্য সোফায় বসে আমতা-আমতা করে বছর, “আসলে দাদাজান আমি চাই নি ওর সাথে আপনার কথা হোক।”
“কেন?”
“আপনাকে একটা ব্যাপার জানানোর আছে। দয়া করে রাগ করবেন না।”

সভ্য দাদাজানকে ইনারার অতীতের সব ঘটনা বলে। সাথে এটাও জানায় যে দাদাজানের নাম নিয়ে সে ইনারাকে সাহায্য ও বিয়ে করেছে । সবটা শুনে দাদাজান গম্ভীর গলায় বলে, “সব ঠিক আছে। ওর সাহায্য করে ভালো কাজও করেছিস তুই। আমি খুশি হয়েছি। আমার নাম এসবে আছে তাও আমার সমস্যা নেই। কিন্তু যেখানে ও তোকে ভালোবাসে না সেখানে তুই ওর অসহায়তার লাভ উঠিয়ে বিয়ে করেছিস এটা মানতে পারলাম না।”
“কিন্তু দাদাজান ওকে দূরে রাখলে যদি ও কোনো সমস্যায় পরে তখন কী করব আমি? কীভাবে জানবো আর কীভাবে ওকে প্রটেক্ট করব?”
“তাও ঠিক। আবার ওই যে বেয়াদ্দব ছেলেকে ভালোবাসে সেও তো ভালো না। তাহলে ঠিক আছে। মানুষ এত খারাপ! এত মিষ্টি মেয়ের সাথে এত খারাপ করতে পারলো! তুই আমাকে বললেই তো সবাইকে মুহূর্তের মাঝে জেলে ভরতাম।”
“না, দাদাজান। ইনারার লড়াই ও নিজে লড়বে। তাহলেই শান্তি পাবে ও।”
“তাও ঠিক। এই শুন, জলদি নাতবৌ যেন তোকে ভালোবাসা শুরু করে। আমাদের পরিবারে আজ পর্যন্ত তালাক হয় নি। আগেও হবে না। কিন্তু ওকে জোর করে নিজের সাথে রাখবি তাও আমি চাই না।”
“জ্বি দাদাজান। আশা করি এমনই হবে।”
“এখন আমার নাতবৌকে ডেকে আন, যা।”
“আমি?”
“তুই নয়তো কে?”
সভ্য জোরপূর্বক হাসে, “ওটাই আমি নয়তো কে?”

সভ্য নিজের জন্য শুভকামনা করতে করতে গেল ইনারার রুমে। দরজা খুলে দেখে ইনারা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। সে বল, “ইনারা শুনো।”
ইনারা চোখ তুলে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো সভ্যের দিকে। সভ্য নিজের জানের দোয়া করে এগিয়ে গেল তার দিকে, “দাদাজান তোমাকে ডেকেছে।”
ইনারা তার পাশের বালিশ একের পর এক ছুঁড়ে মারে সভ্যের দিকে, “আপনিই জান দাদাজানের কাছে। জাহান্নামে যান। আমি এই রুম থেকেই আর বের হবো না।”
“ইনারা প্লিজ রাগ করো না।”
“না রাগ করব না। আপনাকে আদর করব তো। আমাকে এমন বকাঝকা করে এসেছন কাহিনী করতে?”
“আরে আমার কথা তো শুনো। এভাবে হুটহাট করে দাদাজানের সামনে গেলে কি ভাববে বলো? ভাববে কি মেয়ে না ডাকাতেই সামনে এসে পড়লো।”
ইনারা থেমে যায়। বলে, “ভুল তো বলেন নি। ঠিকাছে যান মাফ করলাম।”
“আচ্ছা তুমি একটু চেঞ্জ করে আসো। যেহেতু দাদাজানের সাথে প্রথম দেখা করবে ওয়েস্টার্ন ড্রেস বিশেষ মানায় না। দাদাজান কিছু মনে করবে না তাও।”
“আমি এক্ষুনি চেঞ্জ করে আসছি।”
ইনারা দৌড়ে আলমিরা থেকে একটা আনারকলি নিয়ে ওয়াশরুমে গেল।

সভ্য তার বুকে হাত রেখে শান্তির নিশ্বাস ফালায়, “আজ দুই দুইবার বাঘের মুখ থেকে বেঁচে আসলাম।”
ইনারার আসতে আসতে সভ্য রুম পরিষ্কার করে নেয়।
ইনারা আসে একটি আকাশী রঙের আনারকলি পরে। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটি টিপ কপালে দিলো এবং চোখে কাজল পরতে পরতে বলল, “এখন ঠিক আছে?”
সভ্য পিছনে তাকায়। ইনারাকে আয়নাতে দেখে মোহিত হয় সে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। অপলক তাকিয়েই রয়।
ইনারা আবারও জিজ্ঞেস করে, “বললেন না তো ঠিক আছে কী?”
সভ্য এগিয়ে যেয়ে ইনারার পিছনে দাঁড়ায়।
ইনারা কানেরদুল পরে গলায় একটি মুক্তোর মালা পরতে নেয়। সভ্য সে মালাটি তার হাত থেকে নেয়। ইনারার চুলগুলো কাঁধের একপাশ থেকে সরিয়ে সে মুক্তোর মালাটি ইনারার গলাতে পরায় এবং আয়নাতে ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কালো মেঘের পরী কৃষ্ণকলির গল্প চারধারে,
পরন্তু আমার মন কেবল এক আসমানীর জন্য মরে।”

ইনারা আয়নার দিকেই মুখ বানিয়ে বলল, “কোন গল্পের কোন আসমানী? আর কোন কৃষ্ণকলি? দেখুন এসব কবিতা টবিতা আমি ভালো বুঝি না। নরমালি বলুন তো।”
সভ্য হাসে। মুহূর্তে ইনারার পেটে দুইহাত আবদ্ধ করে তার পিঠ নিজের বুকের সাথে মেশায়। তার কাঁধে মাথা রেখে বলে, “মানে তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।”

ইনারা শিউরে ওঠে। সভ্য হঠাৎ এমন কিছু করবে সে ভাবে নি। সে ঘাবড়ে যায়, “করছেনটা কি? আবার কেউ এসে পড়বে।”
“আসুক।”
“আপনাকে বলেছি আমার কাছে আসবেন না।”
সভ্য চোখ বন্ধ করে ইনারার কাঁধে নিজের নাক বুলায়। তারপর আলতো করে চুমু খেয়ে বলে, “তাই?”
ইনারা চোখ দুটো চেপে বন্ধ করে নেয়। সভ্যের ছোঁয়া পেতেই সে শিউরে ওঠে। তার নিশ্বাস বেগতিক হয়ে যায়। সে সভ্যের হাতের উপর হাত রেখে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তা। সভ্য আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তাকে। নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।

দরজায় টোকা পরে। রহমানের গলার শব্দ ভেসে উঠে দরজার ওপাশ থেকে, “সভ্য স্যার, বড় স্যার আপনাদের ডাকছে। জলদি আসতে বলল।”

সভ্যের হুঁশ ফিরে। ইনারার মুগ্ধতা থেকে নিজেকে বের করে তাকে ছেড়ে দূরে সরে বলে, “দেখলে তো তোমার জন্য দাদাজানের আমাদের ডাকতে হলো। বলো তো কি ভাববে সে?”
“আমার জন্য!”
“আচ্ছা থাক থাক মাফ চাওয়া লাগবে না। জলদি আসো।”
সভ্য দরজা পর্যন্ত যেয়ে আবার কি মনে করে দৌড়ে আসে। ইনারার ওড়না চেয়ার থেকে নিয়ে তার মাথায় দিয়ে বলে, “এইত্তো এখন আমার বউ লাগছে।”
বলে ইনারার গালে চুমু খেয়ে এক দৌড়ে পালাল।
ইনারা নিজের গালে হাত রেখে লজ্জামাখা কন্ঠে বলে, “আসলেই লোকটা অসভ্য।”
.
.
ইনারা বসে আছে দাদাজানের সামনে। সভ্য ও রহমানের মুখের থেকে সে শুনেছে দাদাজান অনেক রাগী। তাই সে একদম চুপচাপ। তার চোখ নিচু। ভয়ে সে আঙুল নিয়ে খেলছে। সভ্য তা খেয়াল করে। সে ইনারার হাত ধরে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, “ভয় পেও না। দাদাজান মেয়েদের সাথে রাগী গলায় কথা বলে না। বিশেষ করে ঘরের মেয়ে ও বউদের সাথে।”

দাদাজান ভারী গলাতেই বলে, “এই প্রথম তোমার সাথে আমার দেখা হচ্ছে। সামনা-সামনি দেখে ভালো লাগলো।”
“আমারও আপনার সাথে দেখা করার অনেক ইচ্ছা ছিলো। আপনি আমার জন্য যা করেছেন তার কৃতজ্ঞতা আমি কখনো শোধ করতে পারব না।”
“জানো তো ছেলে মেয়ে থেকে নাতি নাতনির প্রতি আদর বেশি থাকে। তুমি আমার নাতবৌ হও। মানে আমার নাতির থেকেও বেশি আদরের। এদিকে আসো, আমার পাশে বসো।”
সভ্যও ইশারায় বলে তাকে যেতে। ইনারা তাই করে। পাশে যেয়ে বসতেই দাদাজান হেসে তার মাথায় হাত রেখে বলেন, “আমার নাতির ভাগ্য খুলে গেছে। কী মিষ্টি মেয়ে! সবসময় খুশি থাকো। সব স্বপ্ন পূরণ হোক তোমার।”
ইনারা চেয়েও তার চোখ জোড়া ভেজা থেকে আটকাতে পারলো না। দাদাজান ঘাবড়ে গেলেন, “আরে নাতবৌ তুমি কাঁদছ কেন? আমি ভুল কিছু বললাম?”

ইনারা ভেজা চোখ নিয়েই হাসিমুখে তাকায় দাদাজানের দিকে। কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে, “জানি না। তবে মনে হলো আপন কারও হাত মাথায় আছে। এভাবে আগে কেউ মাথায় হাত রেখে দোয়া করে নি আমার জন্য।”
“আমি জানি তোমার পরিবারের কথা। কাঁদে না নাতবৌ। এখন আমি তো আছি। সভ্যের সম্পূর্ণ পরিবার এখন তোমার। আর সভ্যের আগে আমি তোমার দাদাজান বুঝেছ?”
ইনারার হাসি আরও গাঢ় হয়। সে তার চোখ মুছে দ্রুত মাথা নাড়ায়। দাদাজান ইনারাকে তার পকেটে ঝুলানো স্বর্ণের ঘড়ি দিয়ে বলে, “এটা তোমার জন্য। আমাদের বংশে ঘরের বউয়ের সাথে প্রথম দেখা হলে তাকে স্বর্ণ দেওয়া লাগে। তোমার সাথে দেখা হবে জানলে তোমার জন্যই কিছু আনতাম। কিন্তু আপাতত এটা রাখো।”
“না দাদাজান এটা আমি কীভাবে… ”
“বলেছি না রাখো। আর শুনলাম তুমি না’কি নায়িকা সাইয়ারার মেয়ে? তিনি আমার সবচেয়ে পছন্দের অভিনেত্রী ছিলেন। তোমাকে প্রথম দেখেই তার কথা মনে পড়লো। তোমার চোখ ছাড়া প্রায় সবই তার মতো দেখতে।”
“সত্যি দাদাজান মা আপনার পছন্দের নায়িকা ছিলো?”
“একদম। আর আমি জানি তুমিও হবে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক নাম কামাবে তুমি।”
দাদাজানের কথা বলতে বলতে নজর গেল সভ্যের উপর। সে তাকিয়ে আছে তাদের দুইজনের দিকে। তা দেখে দাদাজান বললেন, “তুই তাকিয়ে কী দেখছিস? যেয়ে আমাদের জন্য একটু পায়েশ বানিয়ে নিয়ে আয়। প্রথম আমার নাতবৌকে দেখছি মিষ্টি কিছু খাব না?”
“বাহিরের থেকেই আনাব দাদাজান?”
“কেন বাহির থেকে আনাবা? নিজে বানিয়ে আনো, যাও।”
ধমক শুনে সভ্য দ্রুত উঠে দাঁড়ায়।

দাদাজান ইনারাকে বলে, “শুনো নাতবৌ, তোমার যা মন চায় ওকে দিয়ে রান্না করাবা। আমার ছেলে, নাতি সবাইকে সকল ধরনের কাজ শিখানো হয়েছে। ওদের তো প্রফেশনাল সেফ দিয়ে রান্নার ক্লাস করিয়েছিলাম। আরাম করবে আর ওকে হুকুম দিবে।”
“আরে দাদাজান বলেন না যে জ্বালায় আমাকে। সারাক্ষণ বকা দেয়।”
“সাহস কত বড় ওর? আমার নাতবৌকে বকা দেয়? ওর খবর আছে আজ। রান্না শেষ করে আসুক। আসল মজা বুঝাব। আর তুমিও ওকে টাইটে রাখবে বুঝলে? স্বামীদের টাইটে না রাখলে হাত থেকে ছুটে যায়।”
সভ্য যাবার সময় কথাটা শুনে পিছনে তাকায়। দুইজনের এমন খাতির দেখে সে বিরক্ত হয়ে বলে, “বাহ দুইজনে কি কারসাজি করছে। একদম হিন্দি বৌ-শাশুড়ির সিরিয়ালের মতো প্লানিং প্লটিং। যাক, আমারও সময় আসবে। একবার দাদীজানের সামনে গেলে দেখব কার কত সাহস।”
বলে সে রাগে হনহনিয়ে গেল রান্নাঘরে। পায়েশ বানাতে।
.
.
সকলে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। ইনারা দাদাজানের পাশে বসে বলছিল, “দাদাজান জানেন আপনার নাতি আমাকে এসেই প্রথমদিন যা বকা দিয়েছিল। আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম।”
সভ্য এবার তাকাল ইনারার দিকে। সে কখন থেকে দাদাজানের সামনে তার খারাপদিক গুলো বলে তাকে বকা খাওয়েই যাচ্ছে। আর থামছে না। সে এবার বিরক্ত হয়ে বলল, “তুমি বকা খাওয়ার কাজ করলে বকব না?”

তখনই দাদাজানের ধমক এলো, “এই আমার নাতবৌকে আমার সামনে ধমকাচ্ছিস তুই সাহস তো কম না।”
ইনারা আরও উসকানি দেয় তাকে, “দাদাজান এখন তো কিছু না। আগে তার বাসায় গেল সোফার বালিশ একটু এদিক ওদিক হলে যা বকা দিতো। আর আমাকে তো কতদিন এত কাজ করিয়েছে যে আমি অসুস্থ হয়ে গেছি।”
“মিথ্যুক! তুমি কোনো অসুস্থ হও নি।” সভ্য প্রতিবাদী সুরে বলল।
দাদাজান আবার উঁচু স্বরে বলে উঠে, “এই কন্ঠ নিচে। আমার নাতবৌ মিথ্যা কেন বলবে? তোর সাহস তো কম না ওকে দিয়ে এত কাজ করিয়েছিস। কাল অফিসে গেলে বুঝাব তোকে কাজ কি হয়।”
সভ্য রাগে কটমট ইনারার দিকে তাকাল
আর ইনারা টেবিলের অপরপাশে বসে নিঃশব্দে হাসছিলো। আর সভ্যকে ভেঙাচ্ছিল। সে হেসে মুখে পোলাওর লোকমা তুলতেই দাদাজানকে বলতে শুনে, “শুন আজ তোর রুমে আমি ঘুমাব। অন্যরুমে ঝি ঝি পোকার শব্দে ঘুম আসে না। তুই আর নাতবৌ আজ পশ্চিম দিকের রুমে ঘুমাস।”
সাথে সাথে ইনারার কাশি চলে এলো। তার খাবার গলায় আটকে যায়। সে তার হাতের কাছের গ্লাসটি নিয়ে এক নিশ্বাসে পানি পান করে অবাক হয়ে দাদাজানকে জিজ্ঞেস করে, “আমরা একসাথে ওরুমে ঘুমাব?”
“এটাতে অবাক হবার কী আছে নাতবৌ? এমন ভাবে বলছ যেন তোমরা আলাদা রুমে ঘুমাও।”
ইনারা জোরপূর্বক হাসে, “না মানে আমি বলছিলাম আপনার নাতির সাথে এতদিন পর দেখা হলো, আপনি চাইলে আজ যদি উনার সাথে…”
“না না নাতবৌ, প্রয়োজন নেই। আমি একাই ওরুমে ঘুমাব।”
“আচ্ছা।”
ইনারা মন মেরে বলল। ভয়ে সে মুখে আর লোকমা তুললো না। আজ সভ্যকে যে হারে বকা খাওয়াল, তার খবর আছে আজ। এর উপর আজকাল যা রোমেন্স শুরু করল লোকটা। মনে হয় আসলেই বিয়ে করে এনেছে।

সাথ সাথে সে নিজের ফোনে সভ্যের মেসেজ পেল, “আজ তোমার রেহাই নেই।”
ইনারা ঢোক গিলে। ভয়ে ভয়ে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্যের চোখ সরু ও ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি হাসি।

চলবে…

[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে