অনিয়ন্ত্রিত মন পর্ব-০৩

0
954

#অনিয়ন্ত্রিত_মন
#jannat_Nur
#তৃতীয়_পর্ব

দেনমোহরের ৫ লাখ টাকা নিয়ে ডিভোর্স হয়ে গেল মরিয়মের। মরিয়মের বাবা চাইলো মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে টাকাটা ব্যাংকে একাউন্ট করে রাখতে। কিন্তু মরিয়মের দুই ভাই মামুন আর সুমন টাকাটাকে তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে খাটাতে চাইলো। এটা নিয়ে শুরু হলো সংসারে মনমালিন্য। ছেলেদের মন রাখার জন্যই শহিদুল ইসলাম টাকাটা ছেলেদের হাতে তুলে দিল ব্যবসা করার জন্য। এতে করে খুশি হল শহিদুল ইসলামের দুই ছেলে। মরিয়ম কিছু বলতে চেয়েও কিছু বলতে পারল না সে জানে তার বাবা এখন অবসরপ্রাপ্ত যা টাকা পেনশন পেয়েছে সেগুলো দুই ভাই নিয়ে ব্যবসা করছে। বাবা মাকে যদি তারা না দেখতে চায় তাহলে তার বাবা-মা এই বৃদ্ধ বয়সে যাবে কোথায়। আর তারও তো তার সন্তানকে নিয়ে ভাইদের উপরে এখন নির্ভর করে থাকতে হবে। এই কথা ভেবেই চুপ করে রইল মরিয়ম। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে নেওয়া ছাড়া তার কোন উপায় নেই। কিছুদিন ভালোই চলল, মরিয়মের বড় ভাবি সায়মা মরিয়মকে কোন কিছুই বলল না। মাস ছয়েক পর থেকে আবার শুরু হয়ে গেল অশান্তি। মামুন তার দেড় বছরের ছেলে রুমেলের জন্য বাজার থেকে এটা সেটা নিয়ে আসে সেই খাবার দেখে কান্না করে মরিয়মের ছেলে রাইয়ান, মাঝে মাঝে একটু আকটু খাবার খেতে দিলেও সব সময় দিতে চায় না সায়মা। মরিয়মকে বলে তোমার ছেলেটা কেমন যেন হয়েছে অন্যের খাবার দেখলে কান্না করে। ছেলেকে ভালো বানাতে পারলে না। ভাবীর এই কথা শুনে মরিয়ম ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকে। তখন মরিয়মের মা ছেলের বউকে বলে।

” বৌমা তুমি এটা কি কথা বলো, এটুকু ছোট বাচ্চা সে কি আর কিছু বুঝে! তোমার ছেলের জন্য খাবার নিয়ে এসে তাকে খাওয়াও সেটা দেখলে তো সেও কান্না করবেই। সেখান থেকে একটু খাবার দিলে তোমাদের কি কম পড়ে যাবে? তোমার কি মায়া লাগেনা এই অবুঝ বাচ্চাটার প্রতি।

” মায়া লাগে বলেই মাঝেমধ্যে দেই, নাহলে তো দিতামই না। এর জন্য যখনই আমার ছেলেকে খাওয়াবো তখনই তার ছেলেকে দিতে হবে আমার কি এতই ঠেকা পড়েছে। যে ছেলের বাবা আছে তার বাবা তাকে নিতে চাইল না, আর নিতে চাইবেই বা কিভাবে মরিয়ম তো দিতে চাইলো না। রাইয়ানকে তার বাবার কাছে দিলে এভাবে অসহায়ের মত বড় হতে হতো না। এখন আমাদের ছেলের জন্য আমরা যা করব তার ছেলের জন্য তাই করবো নাকি? আমাদের তো দায় পড়েনি।

মরিয়ম তার মাকে থামায়, সে বলে আমাকে নিয়ে তুমি ভাবীর সঙ্গে ঝগড়া করতে যেও না। আমার কপালে যা আছে তাই হবে। দরকার নাই আমার ছেলেকে ভালো কোন কিছু খাওয়ানোর।

সায়মা তার ছেলেকে খাবার খাওয়ালেও মরিয়ম এখন তার ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয় না। যেন রাইয়ান খাবার দেখে কান্না না করে এই ভয়ে। মাঝে মাঝে মরিয়মের ছোট ভাই সুমন ভাগ্নের জন্য এটা সেটা নিয়ে আসে পপিও তেমন কিছু বলেন না, তার বিয়ে হয়েছে তিন বছর এখনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি তাই মরিয়মের ছেলেকে সে আদর সোহাগ করে।

মরিয়মকে ডিভোর্স দেওয়ার পর আকবর তার গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে ঢাকায় শান্তাদের বাসায় চলে যায়। আকবরের বাবা-মা অনেক আগেই মারা গিয়েছে আকবরের ভাই বোন নেই। আকবরের একটা আপন চাচা আছে সে বারবার বলেছিল গ্রামের বাড়িটা বিক্রি করে দিস না, কিন্তু সে তার চাচার কথা না শুনে বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠেছে। ঢাকায় যাওয়ার পর শশুর আরাফাত মোল্লা আকবরকে এক সরকারী প্রতিষ্ঠানে ভালো পোস্টে চাকরি নিয়ে দিয়েছে। আরাফাত মোল্লা চায় তার মেয়ে জামাই তার কাছেই থাকুক, একমাত্র মেয়েকে সে দূরে কোথাও রাখতে চায় না। এ কারণে আকবরের গ্রামের বাড়িটা সে বিক্রি করিয়েছে। আরাফাত মোল্লার এক ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে আমেরিকাতে এক খ্রিস্টান মেয়েকে বিয়ে করে সিটিজেন হয়ে গিয়েছে। বছরে একবার করে বাংলাদেশে আসে বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য। আকবর শ্বশুরবাড়ি থেকে খুব সুখে শান্তিতে বিলাসী জীবন যাপন করছে। সে মনে মনে অনেক খুশি এমন একটা অভিজাত্য জীবন পেয়ে। তার কত স্বপ্ন ছিল সেই স্বপ্ন তার শান্তার কারণে পূরণ হয়েছে। এই কারণে আকবরের একবারের জন্যও মরিয়মের কথা এবং তার সন্তানের কথা মনে হয় না। আকবর মনে করে মরিয়মকে ছেড়ে দেওয়ার জন্যই তার জীবনে এতটা সুখ এসেছে। মরিয়মের সঙ্গে থাকলে সে কখনো সুখী হতে পারত না।

রাইয়ানের বয়স এখন দুই বছর, প্রায় সময় রাইয়ান বাবা বাবা বলে ডাকে। এটা দেখে মরিয়মের খুব কষ্ট হয়। জন্মের পর থেকে ছেলেটা বাবা হারা হলো, কখনো হয়তো বাবার মুখ দেখতে পারবেনা। এই নিষ্পাপ শিশুটার কি দোষ ছিল তার ভাগ্যটা কেন এমন হলো। এটা ভেবেই খুব কান্না করে মরিয়ম। আশেপাশের প্রতিবেশীরা অনেকেই বলে মরিয়মকে বিয়ে করতে। যেই তাকে এই কথা বলে মরিয়ম খুব রেখে গিয়ে বলে, বিয়ে একবার হয়েছে, আমি আর কখনো বিয়ে করবো না। তার এই কথার জবাবে প্রতিবেশী একজন ভাবী বলে উঠলো।

” হ্যাঁ বিয়ে করবে কেন, ভাইয়ের সংসারে চাকরানীর মত কাজ করে সারাজীবন কাটিয়ে দিবে। আমরা তো তোমাকে ভালো বুদ্ধি দেই তোমার সেটা ভালো লাগছে না। এখন না হয় তোমার মা-বাবা আছে তোমাকে তারা ততটা অবহেলা করছে না, তোমার মা বাবা যখন না থাকবে তখন দেখবে তোমাকে ঘাড় ধরে এই বাড়ি থেকে বের করে দিবে। তোমার ছেলেটার ভবিষ্যৎ কি হবে একবার কি ভেবে দেখেছো! তুমি যদি একজন ভালো কাউকে দেখে বিয়ে করো তবুও তো ছেলেটাকে নিয়ে মাথা গোজার ঠাই পাবে। আমরা তোমার ভালোর জন্যই বলছিলাম।

মরিয়ম আর কোন জবাব দিতে পারেনা। সত্যিই সে এই সংসারে চাকরানির মত হয়ে আছে। কাজ করার জন্য ছেলেটাকে সময় দিতে পারে না, ছেলেটা সারাদিন তার নানীর কাছে থাকে। বলতে গেলে তার বড় ভাবী সায়মা কোন কাজই করেনা। ছোট ভাবী পপি আগে কাজ করলেও এখন বাচ্চা হওয়ার কারণে সেও আর কোন কাজ করে না। সংসারের সমস্ত কাজ মরিয়মকে এবং তার মাকে করতে হয়। ভাইয়ের ছেলেদের পুরনো পোশাক তার ছেলেকে পরানো হয়। ঈদ ব্যতীত কোন নতুন পোশাক কিনতে পারেনা ছেলের জন্য। এ কারণে তার মনে আরও বেশি কষ্ট। দুই ভাই তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন পোশাক কিনে আনলেও মরিয়মের ছেলের জন্য নিয়ে আসে না। বলতে গেলেও ভাবীদের কথা শুনতে হয়। এর মধ্যেই একদিন মামুনের সঙ্গে একজন লোক আসে বাসায়। লোকটার বয়স ৪০ এর কাছাকাছি হবে মরিয়মের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, সেটা বুঝতে পেরে মরিয়ম লোকটার সামনে থেকে সরে যেয়ে তার রুমে চলে যায়। সায়মা মরিয়মের রুমে গিয়ে বলে।

” তোমার ভাইয়া তোমাকে ডেকে নিয়ে গেল, তুমি ড্রয়িং রুম থেকে চলে আসলে কেন?

” ভাবী ভাইয়ার সঙ্গে যে লোকটা এসেছে সে আমার দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে তুমি খেয়াল করে দেখেছো! লোকটা কেমন নির্লজ্জার মত অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি লজ্জা পেয়ে চলে এসেছি।

” তোমার ভাইয়া তোমাকে আবার যেতে বলেছে তাড়াতাড়ি আসো।

” কেন ওই লোকটার সামনে আমাকে আবার যেতে হবে কেন?

” আমরা তোমাকে লুৎফর ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবো। লুৎফর ভাইয়ের অনেক টাকা পয়সা আছে। স্ত্রী মারা গেছে এক বছর আগে, কোন বাচ্চাকাচ্চানেই, তার কাছে তোমার বিয়ে হলে অনেক সুখেই থাকবে।

” আপনি এসব কি বলছেন ,আমাকে জিজ্ঞেস না করে আপনারা বিয়ে ঠিক করে ফেলছেন! আমি আমার ছেলেকে রেখে কোথাও যাচ্ছি না।

” যা বলছি তাই কর, আমার সঙ্গে আসো। তোমার ভাইয়া তোমাকে এখনই যেতে বলছে।

” প্লিজ ভাবী আপনি জোর করবেন না আমি বিয়ে করবো না। আমি আমার সন্তানকে এতিম বানাতে চাই না। বাবা হারা হয়েছে আর মা হারা হতে দেবো না।

মরিয়মের কথা মাঝখানে তার বাবা শফিকুল ইসলাম সে বলল, তোর ভাবী যা বলছে তাই কর। ছেলেটা অনেক ভালো, অনেক বড় ব্যবসা আছে, ছেলেটা প্রথম বিয়ে করেছিল ৫ বছরের সংসারে সন্তানাদি হয়নি স্ত্রী মারা গিয়েছে। তোর বিয়ের পর তোর ছেলেকে তার সঙ্গে রাখবে এটা নিয়ে তো ভাবতে হবে না। তোর ভাইয়া আমার সঙ্গে সবকিছু বলেছে আমারও এই বিয়েতে মত আছে।

” কিন্তু বাবা আমার এটা বিশ্বাস হয় না, অন্যজনের ছেলেকে আরেকজন কখনোই মেনে নিবে না। এটা বিয়ের আগে বললেও পরে দেখবে এটা নিয়ে সমস্যা হবে।

” আচ্ছা তুই যা ছেলেটার সঙ্গে কথা বল, তুই কথা বললে তো বুঝতে পারবি সে সত্যি বলছে কিনা মিথ্যা বলছে।

মরিয়মের মা,ও মরিয়মকে জোর করে আবার ড্রয়িং রুমে পাঠালো লুৎফরের সঙ্গে কথা বলার জন্য। ইচ্ছা না থাকলেও পরিবারের জোরাজুরিতে লুৎফরের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হল মরিয়ম। তাদেরকে কথা বলার জন্য সুযোগ দিয়ে সবাই ড্রয়িং রুম থেকে বের হয়ে আসলো। প্রথমে কথা বলা শুরু করলো লুৎফর।

” তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে, আমি তোমার ভাইয়ার কাছ থেকে শুনেছি তোমার একটা ছেলে আছে দুই বছর বয়সে। আমি বিয়ে করেছিলাম পাঁচ বছর সংসার করেছি তারপর আমার স্ত্রী ক্যান্সার হয়ে মারা গিয়েছে। আমার স্ত্রীর মা হবার ক্ষমতা ছিল না তবু আমি তাকে কখনো অবহেলা অবজ্ঞা করিনি। ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম তাকে কিভাবে অবহেলা করি। এখন তুমি যদি আমাকে বিয়ে কর তোমাকে আমি অনেক সুখে রাখবো। কথা দিচ্ছি তুমি যে কষ্ট পেয়েছো সে কষ্ট তোমাকে আর কখনো ছুঁতে পারবে না।

” আমি আমার ছেলেকে রেখে বিয়ে করতে চাই না, ছেলেটাকে নিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। ছোট থেকে আমার ছেলেটা বাবার আদর ভালোবাসা পেল না, আমি মা হয়ে কিভাবে তাকে এতিম করে রেখে চলে যাব।

” এতিম করতে হবে কেন? আমাদের বিয়ে হয়ে গেলে তুমি তোমার সন্তানকে আমাদের সঙ্গে রাখতে পারবে এতে আমার কোন সমস্যা হবে না।

” এটা আপনি যত সহজে বলছেন ততটা সহজ হবে না। আমি যদি আপনাকে বিয়ে করে ফেলি তারপর যদি আমার সন্তানকে আপনি মেনে নিতে না চান আমি কি করবো। আমার তখন কোন রাস্তা খোলা থাকবে না।
না পারবো আপনাকে ছাড়তে না পারবো আমার সন্তানকে ছাড়তে। তার চেয়ে ভালো আমি বিয়ে করবো না, এটাই আমার সিদ্ধান্ত।

” মরিয়ম তুমি আমাকে ভুল বুঝছো, আমি যা বলছি তাই করবো। দুনিয়াতে কিন্তু সবাই একরকম না। অনেকেই আছে স্ত্রীর প্রথম সন্তানকে মেনে নিয়ে সংসার করছে তাহলে আমি পারবো না কেন, আমিও পারবো। তোমাকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না রাজি হয়ে যাও। ভেবে দেখো বাবা মায়ের সংসারে কতদিন থাকবে তোমার ছেলেটাকেও তো মানুষ করতে হবে।

” আপনি মেনে নিলেও আপনার পরিবার আমার সন্তানকে মেনে নিতে চাইবে না। আর যখন আপনার সন্তান হবে তখন আপনিও আমার সন্তানকে অবহেলা করবেন সহ্য করতে পারবেন না।

” আমার পরিবারের আমি বড় ছেলে আমার কথা মা বাবা ভাই বোন কখনো ফেলবে না। আর আমার টাকায় সংসার চলে আমি যা বলব তাই হবে তুমি এ ব্যাপারটা নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না। তুমি এখন বলো আমাকে বিয়ে করতে রাজি কিনা।

” আমি এখন কিছু বলতে পারব না, এখন আমি আসছি।

মরিয়ম উঠে ড্রয়িং রুম থেকে চলে গেল। তারপর লুৎফরের পাশে এসে বসলো মামুন আর সুমন। পপি আর সায়মা নাস্তা রেডি করে নিয়ে এসে লুৎফরের সামনে দিল। মামুর লুৎফরকে বলল, কিভাবে তাকে রাজি করাতে হয় সেটা আমরা দেখবো আপনি এটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনার সম্পর্কে আমরা সব খোঁজখবর নিয়েছি আর আপনার সঙ্গে তো আমি কিছুদিন ধরে চলেছি, জেনেছি আপনি কতটা ভালো মানুষ।

” মামুন ভাই সত্যি কিন্তু আপনার বোনকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। তাকে বলবেন আমি কখনোই তাকে বা তার সন্তানকে কোন অবহেলা করব না। আর আমার সাধ্যমত গহনা দিয়ে তাকে আমি বউ করে নিয়ে যাব আমার বাড়িতে।

” ঠিক আছে আমরা আপনাকে রাতে পাকা কথা জানিয়ে দেবো, ধরে নেন বিয়েটা হয়ে যাবে আপনার ভাবতে হবেনা।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে