#অনিয়ন্ত্রিত_মন
#jannat_Nur
#প্রথম_পর্ব
যে মানুষটা আমাকে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। সারারাত আমার এই ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে ঘরের বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, ঘরে ঢুকতে দেয়নি। তার সাথে আমি আর সংসার করবো না। সে আমাকে এবং আমার সন্তানকে নির্দ্বিধায় মেরে ফেলতে পারবে।
মরিয়মের মুখ থেকে কথাটা শুনে মরিয়মের স্বামী আকবর আলী এগিয়ে এসে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইলো মরিয়মকে। সেটা সহ্য করতে পারল না মরিয়মের বাবা। সে দ্রুত আকবরের সামনে এসে গালে থাপ্পর মারব, আকবরও সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুরের গালে কষে থাপ্পর বসিয়ে দিল। মরিয়ম কল্পনা করতে পারেনি আকবর তার বাবার গায়ে হাত তুলবে। বৃদ্ধ মানুষ থাপ্পড়ের ধকল সইতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায়। সেখান থেকে তাকে টেনে তুলে আকবরের চাচাতো ভাই সবুজ মিয়া। সবুজ মিয়া আকবরকে বলে, ভাইয়া এটা তুমি কি করলে সে তোমার শ্বশুর তুমি তার গায়ে হাত তুলতে পারলে? আকবর চিৎকার করে বলল।
” কিসের শ্বশুর আমি তাকে শ্বশুর বলে মানিনা, মেয়েকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সে রেহাই পেয়ে গিয়েছে। ভেবেছিলাম আমার চাকরি নেওয়ার জন্য লাখ দশের টাকা দিবে কিন্তু সেটা দিতে তিনি অস্বীকার করেছে। কোথাও আমার চাকরি হচ্ছে না ব্যবসা করতে গেলে লস খাচ্ছি, অপয়া একটা মেয়েকে বিয়ে করে আমার জীবনটা নষ্ট হতে যাচ্ছে। তার মেয়েকে নিয়ে আমি কখনো সুখী হতে পারব না এ কারণে আমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছি।
মরিয়মের বাবা শফিকুল ইসলাম রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, তোকে আমি দেখে নেব তুই আমার গায়ে হাত তুলেছিস। আমার মেয়ের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করছিস, তাও তোর ভয় নেই। তোকে আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো। আমার কাছে তুই যৌতুক দাবি করিস আমি কি তোকে বলেছিলাম তোকে আমি দশ বিশ লাখ টাকা দেবো। তুই নিজেই আমার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিলি আর এখন যৌতুকের দাবি করিস।
” আরে যান যান কি করতে পারবেন করেন আমি আপনাদেরকে ভয় পাই নাকি। আপনার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যান। তাকে বুঝিয়ে বলেছিলাম আমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছি তবু তাকে ডিভোর্স দেবো না, সে যেন তার সন্তানকে নিয়ে চুপচাপ থাকে কিন্তু না সে আমার কথা রাখেনি তাই সে বাড়িতে থাকতে পারবে না।
মরিয়ম আকবরের কথার জবাবে বলল, তোমার মত অমানুষের সঙ্গে আমিও সংসার করবো না। আমার বাচ্চা হয়েছে মাত্র চার মাস হলো আর তুমি এই চার মাসের ব্যবধানে বদলে গেলে। একজনকে বিয়ে করে নিয়ে আসলে সন্তানের কথা একবারও চিন্তা করলে না। তোমার মত বেইমানের সঙ্গে কখনো থাকা যাবে না। তুমি আমার বাবার গায়ে হাত তুলেছ এটার শাস্তি তোমাকে পেতে হবে।
” আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার চাকরির জন্য তোমার বাবার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে আসতে তুমি আমার মুখের উপর না করে দিয়েছো। বলেছ আমার টাকার ব্যবস্থা আমাকেই করতে। আমি যাকে বিয়ে করেছি তার বাবা আমাকে চাকরি নেওয়ার জন্য টাকার ব্যবস্থা করে দিবে। তাই আমি তাকে বিয়ে করছি। এখন তোমাদের যা করার করো তবে এটা মনে রেখো তুমি আমাকে কিছু করতে পারবে না। মামলা করলে আমি ঠিকই জামিন নিয়ে বের হয়ে আসবো, মাঝখান থেকে তোমার নিজেরই বদনাম হবে। লোকে বলবে তুমি স্বামীর সংসার করতে পারোনি, যে মেয়েকে রেখে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে এই সমাজ ওই মেয়েকে খারাপ বলে। আমাকে কেউ খারাপ বলবে না।
মরিয়মের বাবা বুঝতে পারল এই অমানুষটার সঙ্গে তর্ক করে কোন লাভ হবে না, তাই মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসলো। আসার আগে আকবরকে বলল তোমার সন্তানকে তুমি রেখে দাও আমার মেয়েকে নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি। বাবার কথা শুনে মরিয়ম তার চার মাসের ছোট্ট শিশু রাইয়ানকে বুকে চেপে ধরে বলল, না বাবা এই মানুষটার কাছে আমার সন্তানকে রেখে যাবো না। আমি আমার সন্তানকে কাউকে দেবো না। প্লিজ বাবা তুমি এ কথা বলো না।
আকবর হেসে বলল, আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নাই। বাচ্চাকে রেখে যেতে চাইলে রেখে যেতে পারেন। আমার সন্তান আমি তো আর ফেলে দেবো না।
মরিয়ম কান্না করতে করতে তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে বাবার সঙ্গে চলে আসলো স্বামীর বাড়ি ছেড়ে। মরিয়ম কখনো ভাবতে পারেনি তার ভালোবাসার মানুষ তার সাথে এভাবে বেইমানি করবে। আকবর মরিয়মকে ভালোবেসে বিয়ে করে। আকবরের মনে ছিল অন্য কিছু সে ভেবেছিল মরিয়মকে বিয়ে করার পর তার বাবার কাছ থেকে যৌতুক নেবে। শফিকুল ইসলাম যৌতুক দিতে রাজি না হওয়ায় আকবর আলী বড়লোকের ডিভোর্সি মেয়ে শান্তাকে বিয়ে করে। শান্তার বাবা আকবরকে সরকারি চাকরি নিয়ে দিবে এবং ঢাকা শহরে থাকার জন্য ফ্ল্যাট দিবে এটা শোনার পরে আকবরের মাথা নষ্ট হয়ে যায়। সে তার ভালোবেসে বিয়ে করা স্ত্রীকে এবং চার মাসের নবজাতক শিশুকে ছুড়ে ফেলে দিতেও দ্বিধাবোধ করল না।
মরিয়মকে নিয়ে বাড়িতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মরিয়মের মা এবং ভাবী দৌড়ে এসে সবকিছুই শুনলো শফিকুল ইসলামের কাছ থেকে। সব শুনে মরিয়মের মা রহিমা বেগম আহাজারি করে বলতে থাকলো, আল্লাহু আমার মেয়ের কি হবে কেন আমার মেয়ের কপালে এমনটা হল। কি পাপ করেছিলাম আমরা। শাশুড়ির কান্না এবং আহাজারি দেখে মরিয়মের ভাবী মীরা মুখ বাঁকিয়ে বলল।
” এখন আর আহাজারি করে কি হবে তখন তো বলেছিলাম এই ছেলেটা ভালো না। আপনার মেয়ে কি শুনেছিল! আর আপনারাও তো শুনেন নাই। যাই হোক কার কপালে কি আছে সেটা তো আর বলা যায় না। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বাচ্চাটা নেওয়ার দরকার কি ছিল? বিয়ে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চা নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছে। এখন যদি মরিয়মের ডিভোর্স হয়ে যায় বাচ্চাটার কি হবে! বাচ্চাটার তো মা ছাড়া বড় হতে হবে। সৎ মা কি আর নিজের মায়ের মত ভালবাসবে।
” ভাবী আপনি এটা কি বলেন, আমি আমার ছেলেকে কেন দিয়ে দেবো! আমি আমার সন্তানকে কখনো দিবোনা।
” শুনো মরিয়ম এত বড় বড় কথা বলো না, তুমি ডিভোর্স নিয়ে চলে আসলে বাবা ভাইয়ের সংসারে থাকবে, তোমাকে না হয় আমরা খাওয়ালাম কিন্তু তোমার সন্তানের দায়িত্ব কে নিবে? তুমি তো আর ইনকাম করতে পারো না তোমার সন্তানকে নিয়ে তুমি চলতে পারবে। তোমার বয়স কম দুইদিন পর আমরা তোমাকে বিয়ে দেবো। তখন তোমার সন্তানের কি হবে ভেবে দেখেছো! তখন আকবরের ছেলে আকবরকে দিয়ে দিতে হবে।
” না আমার ছেলেকে আমি কাউকে দেবো না, রাইয়ান শুধু আমার ছেলে।
” সেটা যদি হয় তাহলে সতীন নিয়ে সংসার করো, চলে আসলে কেন! সহ্য করে সেখানেই থাকো সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে।
শফিকুল ইসলাম ছেলের বউকে বলল, বৌমা সেখানে আর মরিয়ম থাকতে পারবে না। আমার মেয়েটাকে ওই অমানুষটা মেরে ফেলবে। তুমি জানো এই মানুষটা আমার গায়ে হাত তুলেছে, তার নামে আমি মামলা করব।
কি বললে বাবা আকবর তোমার গায়ে হাত তুলেছে? শুনে তো আমার ইচ্ছা করছে তাকে এখনই গিয়ে খুন করে আসি। চলো এখনই আমরা থানায় যাব, তাকে দ্বিতীয় বিয়ে করার স্বাদ মেটাবো।
রুমে ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো বলল শফিকুল ইসলাম এর বড় ছেলে মামুন। বাবার গায়ে হাত তুলেছে এটা শুনে কোন ছেলে সহ্য করতে পারবে না। মামুন তার বাবা এবং বোনকে নিয়ে থানায় চলে গেল আকবরের নামে মামলা করার জন্য।
চেয়ারে বসতে বসতে এসআই নুরুল আলম বললেন, হ্যাঁ বলেন আপনাদের অভিযোগ কি?
” স্যার আমার এই ছোট বোনের বিয়ে হয়েছিল দেড় বছর আগে আমাদের পাশের গ্রামে। আমার বোনের এই যে চার মাসের একটা বাচ্চা আছে। এখন তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে নিয়ে এসেছে তাকে কোন কিছু না জানিয়ে। তার অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করেছে। আবার আমার বোনকে মারধর করে তার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমার বাবা প্রতিবাদ করায় ওই আকবর আমার বাবার গায়ে হাত তুলেছে এবং বলেছে আপনারা দশ লাখ টাকা দিতে পারেন নাই বলেই আমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছি। কি করতে পারেন করবেন আমি কোন আইন আদালত ভয় পাই না।
” সে ভয় পায় কিনা সেটা আমরা পরে দেখবো। আমি আপনার বোনের মুখ থেকে শুনতে চাই আপনি যা বললেন তা সত্য কিনা।
” মরিয়ম স্যারের কাছে সব কিছু বল।
মরিয়মের মুখ থেকে সবকিছু শুনে এস আই নূরুল আলম অভিযোগ লিখে নিল আকবরের নামে। এসআই নুরুল আলম বলল, আমরা কালকে আকবরের বাড়িতে গিয়ে তদন্ত করব, সে দোষী হলে অবশ্যই তাকে শাস্তি পেতে হবে। এটা কি মগের মুল্লুক পেয়েছে প্রথম বউ রেখে বিয়ে করে নিয়ে আসবে আবার বউয়ের উপর অত্যাচার করবে। দেশে আইন বলে কিছু আছে সেটা মনে হয় তার অজানা।
থানায় মামলা হয়েছে এই কথাটা যখন আকবর শুনলো মনে মনে খুব ভয় পেলো। সে বাড়িতে এসে তার দ্বিতীয় স্ত্রী শান্তাকে বলল।
” চেয়ারম্যান সাহেবের কাছ থেকে জানতে পারলাম আমার নামে থানায় মামলা করেছে মরিয়ম। পুলিশ যেকোন সময় আমাকে ধরতে আসতে পারে এখন আমি কি করবো। চলো আমরা পালিয়ে ঢাকা শহর চলে যাই। পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেলে অনেক মারবে।
” চোরের মতো পালাবে কেন? ধরে নিয়ে গেলে তোমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসব। ভয় পেয়ো না মারবে না। আমার বাবার অনেক টাকা আছে তোমার চিন্তা করতে হবে না, কিছু করতে পারবে না ওই ছোটলোকের বাচ্চাগুলো। তোমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসলে তুমি তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। আমরা এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাব। আমি আছি তো ভয় পেতে হবে না।
” আচ্ছা ওরা যদি বাচ্চাটাকে দিয়ে দিতে চায় তখন আমি কিভাবে তাকে পালবো!তুমি কি তাকে মায়ের আদর স্নেহ দিয়ে লালন পালন করবে?
” না কখনোই না, সতীনের সন্তান কখনো নিজের সন্তান হয় না। তাকে আমি কখনোই লালন পালন করে বড় করব না।
” ওরা যদি দিয়ে দিতে চায় তাহলে তো আমার নিতে হবে তখন কি করব।
” হ্যাঁ নিয়ে আসবে, নিয়ে এসে বাচ্চাটাকে কারো কাছে দত্তক দিয়ে দিবে। আর নাহয় তোমার কোন আত্মীয়র কাছে রেখে বড় করবে। আমি এত ঝামেলা নিতে পারব না।
” আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যা বলবে তাই হবে, আমার এত ঝামেলা ভালো লাগেনা। যদি আমাকে দিয়ে দিতে চায় তাহলে নিয়ে এসে কোথাও দত্তক দিয়ে দেবো আমার মন বলছে মরিয়ম তার সন্তানকে দেবে না।
” না দিলেই ভালো, আমি তো এটাই চাই। তুমি আর আমি সুখের সংসার সাজাবো, আমার নিজের সন্তান হবে তাকে নিয়ে হবে আমাদের সুখের সংসার। অন্যের ঝামেলা কেন বয়ে বেড়াবো আমি।
চলবে….