#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
লেখনীতে- সানজিদা তাসনীম রিতু
অতন্দ্রিলা আর বৃষ্টি পর্ব-১
খুব থমথমে নিঃস্তব্ধ পরিবেশ, চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। পুরোটা আকাশ কালো মেঘে মেঘাচ্ছন্ন, একটা তাঁরাও দেখা যাচ্ছেনা। ঝিঝিপোকার একঘেয়ে ডাক, থেকে থেকে নিরবতা ভেঙ্গে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আর অদূরে নিশাচর পাখিদের হুটোপুটির শব্দ। হঠাৎ রাস্তা থেকে কেউ একজন বলে উঠলো- “আজ বৃষ্টি হবেই যা বোঝা যাচ্ছে।” কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে কথাটি কে বললো বোঝা গেলো না।
অতন্দ্রিলা লোডশেডিং এর কারনে রাস্তার পাশের বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলো, কথাটা শুনে সে একবার রাস্তার দিকে তাকালো তারপর মেঘে ঢাকা অন্ধকার আকাশের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আনমনে নিজের সাথেই কথা বলে উঠলো- “অনেকদিন হলো বৃষ্টি দেখিনা, বৃষ্টি হলে মন্দ হয়না।” প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া এবং বজ্রপাতের শব্দের সৃষ্টি করে বৃষ্টি তার আগমনের খবর হয়তো আগেই জানিয়ে দিতে চাইছে। বারান্দায় দাড়িয়ে অতন্দ্রিলা বাতাসে জামগাছের পাতার সরসর শব্দ শুনতে পাচ্ছে। বারান্দার ওপাশের অন্ধকার যেনো ক্রমশ আরোও ঘন হচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টি এলোনা, আর এদিকে লোডশেডিং চলতেই থাকলো।
অতন্দ্রিলার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো, এতো অপেক্ষার পরেও বৃষ্টি হলোনা। তার মনটা আরোও খারাপ করতেই যেনো ঝড়ো হাওয়া মেঘ ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো, সাথে করে নিতে লাগলো অতন্দ্রিলার কষ্টভরা শ্বাস আর খোলা চুলের বুনো গন্ধ। বারান্দার গ্রীলে মাথা লাগিয়ে অতন্দ্রিলা মনে মনে বকতে লাগলো ঐ অচেনা পথচারিকে যে বলেছিলো, বৃষ্টি হবে…কিন্তু তবুও অতন্দ্রিলার মধ্যে একধরনের অপেক্ষা কাজ করছে, কিসের অপেক্ষা সে নিজেও বুঝতে পারছেনা, বৃষ্টির নাকি… আনমনা হয়ে যায় অতন্দ্রিলা। হ্যা, হয়তো সে বৃষ্টিরই অপেক্ষা করে যাচ্ছে। সে চোখ দুটো বন্ধ করে ভাবতে থাকে, বৃষ্টি… এই বৃষ্টি নিয়ে কতোইনা স্মৃতি তার, কতো অজানা ভালোলাগা আর মন খারাপের কেটে যাওয়া সময়। রাত বাড়তে থাকে, মেঘ সরে গিয়ে তাঁরার চাঁদোয়া ফুটে ওঠে আকাশে, আর এদিকে অতন্দ্রিলার মনে মেঘ জমতে থাকে, বৃষ্টি আজ হবেই…
সে চোখ বুজে বারান্দার গ্রীলে মাথা লাগিয়ে দাঁড়িয়েই থাকে, দুফোটা গরম অশ্রু গড়িয়ে যায় তার গাল বেয়ে। আচমকা চোখ খুলে মাথা তুলে দাড়ায় সে, ঘরের ভিতর থেকে তাকে ডাকছে অভ্র। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সে ভিতরে চলে যায়। অভ্র, অতন্দ্রিলার বর। ভিতরে যেতেই অভ্র বলে উঠলো-
-“কি হয়েছে?”
=”কই কিছুনা তো।”
-“কখন থেকে বারান্দায় দাড়িয়ে আছো।”
=”হ্যা, আসলে বিদ্যুৎ নেইতো আর…”
-“বৃষ্টি নামার অপেক্ষা করছিলে তাইতো?” অতন্দ্রিলার কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠলো অভ্র।
=”না, এমনিতেই…”
-“কেনো অপেক্ষা করো এতোকিছুর পরও?”
কিছু বললো না অতন্দ্রিলা, অভ্রর পাশে গিয়ে বসে অভ্রকে টেনে তুলে বসিয়ে বালিশ দিয়ে রাখলো। হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে গেলো অভ্র।
অভ্র একা একা কিছুই করতে পারেনা। তার কোমরের নীচের পুরোটাই অবস। বিয়ের ২ বছর পর বেড়াতে যাচ্ছিলো অভ্র আর অতন্দ্রিলা। খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন, সাবধানেই গাড়ি চালাচ্ছিলো অভ্র। হঠাৎ গাড়ির চাকা পিছলে যায়, তাল হারিয়ে ফেলে অভ্র আর তখনই ওপাশ থেকে আরেকটি গাড়ি এসে সজোরে ধাক্কা দেয়…
প্রচন্ড পেট ব্যাথা নিয়ে জ্ঞ্যান ফেরে অতন্দ্রিলার, চোখ খুলতেই দেখে পাশে ডাক্তার দাড়িয়ে। অতন্দ্রিলার জ্ঞ্যান ফিরছে দেখে ডাক্তার বলে ওঠে- “এখন কেমন বোধ করছেন?”
–“জী কিছুটা ভালো, ডক্টর আমাকে ব্লাড কেনো দেওয়া হচ্ছে? পেটে এতো ব্যাথা কেনো? কি হয়েছে?”
-“খুব বড় এক্সিডেন্ট ছিলো, আপনার বেশি লাগেনি, তবে প্রচন্ড ঝাঁকুনি আর ধাক্কায় আপনার বেবিটা নষ্ট হয়ে গেছে, তাছাড়া”…কিছুক্ষণ থেমে আবারও বললেন- “আপনি আর বেবি নিতে পারবেন না। ২মাস ছিলো মাত্র, ভ্রূণটা চাপে নষ্ট হয়ে ছড়িয়ে ছিলো। অপারেশন করে বের করতে হয়েছে, আপনার সেফটির জন্য জরায়ু আলাদা করতে হয়েছে।” ডুকরে কেঁদে ওঠে অতন্দ্রিলা… কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলো- “আমার হাজবেন্ড কোথায়?” ডাক্তার বললেন- “উনি ইমার্জেন্সি কেয়ারে আছেন।”
–“কীহ!”
-“উনার মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। একটা সার্জারী করা হয়েছে, আরো একটা লাগতে পারে। জোড়া লাগার পসিবিলিটি অনেক কম, খুবই বাজে ভাবে আঘাত পেয়েছেন। একসিডেন্টের ধাক্কার চাপ উনার দিকেই বেশি ছিলো হয়তো।”
সব অন্ধকার হয়ে গেলো অতন্দ্রিলার চোখের সামনে। মাথা ঘুরে উঠে, সে আবার জ্ঞ্যান হারায়।
“কি হলো চুপ করে আছো যে।” অতন্দ্রিলার কথায় বাস্তবে ফিরলো অভ্র।
-“হ্যা, কিছু বলছো?”
=”বললাম চুপ কেনো? কি ভাবছো?”
-“না, কিছু ভাবছিনা, এমনি চুপ ছিলাম।”
এসময়ে বিদ্যুৎ আসলো। অতন্দ্রিলা উঠে যাচ্ছিলো, অভ্র অতন্দ্রিলার হাত ধরে বললো-
-“কোথায় যাচ্ছো?”
=”খাবেনা? ১০টা বাজে।”
-“খাবো, সবেতো ১০টা, বসো তুমি।”
=”হুম বলো।” অতন্দ্রিলা বসে অভ্রর দুহাত ধরে কোলের উপর নিলো।
ঠান্ডা বাতাস বইছে, কাছেই কোথাও বৃষ্টি হয়েছে হয়তো। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস এসে অতন্দ্রিলার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছিলো, সে অভ্রর হাত ছাড়িয়ে চুল বাঁধতে গেলে অভ্র বাধা দিলো, বললো- “থাক না, তুমি বরং ১টা গান শুনাও তারপর খাবো।” অতন্দ্রিলা মুচকি হেসে বললো-
=”তুমি তো গান শুনতে শুরু করলে আর থামবে না, ঔষধ খেতে দেরি হয়ে যাবে তো।”
-“একদিন দেরি হলে কিছু হবেনা, শুরু করো।”
=”কোনটা শুনবে?”
-“তুমি তো জানো।”
=”আচ্ছা।” বলে অতন্দ্রিলা চোখ দুটো বন্ধ করে গাইতে লাগলো অভ্রর প্রিয় গান- ‘আমি তোমারও সঙ্গে বেঁধেছি আমারও প্রাণ
সুরেরও বাঁধনে, তুমি জানোনা…’
হিমেল বাতাস আর অতন্দ্রিলার গানে বিভোর হয়ে গেলো অভ্র, খুব প্রিয় গান তার এটা। অতন্দ্রিলার হাত দুটো শক্ত করে ধরে অপলক তাকিয়ে দেখতে লাগলো অতন্দ্রিলাকে। তাকে সেদিনের মতই অপরুপ প্রতিমার মতো লাগছে, স্মৃতিতে ডুব দিলো অভ্র।
ক্যাম্পাসে সেদিন কি যেনো অনুষ্ঠান চলছিলো। এসব আচার অনুষ্ঠানের প্রতি কখনো আগ্রহ জাগেনি অভ্রর, সে ক্লাস শেষ করে ফিরছিলো এমন সময় আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামলো। খুব বিরক্ত হলো অভ্র, যে জোড়ে বৃষ্টি নেমেছে গেইট অব্দি যেতে কাক ভেজা ভিজতে হবে, তাই উপায় না পেয়ে অনুষ্ঠানের স্টেজের এককোণে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো বৃষ্টি কমার। বক্তৃতা চলছে সাউন্ড বক্সে, ওদিকে কোনো মনোযোগ নেই তার। ‘মানুষ কেনো যে এসব অনুষ্ঠান করে আর কেনই বা অন্যের ধৈর্যের পরীক্ষা নেয় এতো কথা বলে, উফ বিরক্তিকর।’ আপনমনেই বিড়বিড় করে অভ্র। বিরক্তির শেষ সীমায় পৌছে ভাবলো ভিজতে ভিজতেই ফিরবে, এখানে দাড়িয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়ার আর কানে তালা লাগানোর ইচ্ছা নেই তার। হাটতে শুরু করতেই অতিন্দ্রীয় সুর কানে এলো তার, বৃষ্টির রিমঝিম আর গানের কথাগুলো যেনো প্রকৃতির সাথে মিশে যাচ্ছে। অসাধারন নারী কন্ঠে ছড়িয়ে পড়ছে অভ্রর প্রিয় গানের প্রিয় কথামালা- ‘বাশরি বাজায় ললিত বসন্তে, সুদূরও দিগন্তে…
থেমে গেলো অভ্র, স্টেজের দিকে তাকিয়ে খুজতে লাগলো সুরের অধিকারিনীকে। দেখলো প্রতিমার মতো সুন্দরী একটা মেয়ে বীণা হাতে বসে চোখ বুজে গভীর আবেগে সুর ছড়াচ্ছে। বিভোর হয়ে শুনতে লাগলো অভ্র…