অতন্দ্রিলা_আর_বৃষ্টি পর্ব-২

0
2057

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০

লেখনীতে- সানজিদা তাসনীম রিতু

অতন্দ্রিলা_আর_বৃষ্টি পর্ব-২

গান শেষ করে কপট রাগ নিয়ে অতন্দ্রিলা বললো- “শুধু কি গান শুনলেই হবে মশাই, খেতে হবেনা?” যেতে দাও আমায় তা না হলে এবার সত্যি তোমার ঔষধ খেতে দেরি হয়ে যাবে। অতন্দ্রিলার কথায় অভ্র সম্বিত ফিরে পেলো, হালকা হাসি দিয়ে বললো-
-“আচ্ছা, তোমার ঐ দিনের কথা মনে আছে?”
=”কোন দিনের কথা?” অতন্দ্রিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকায় অভ্রর দিকে।
-“তোমার আমার দেখা হওয়ার দিন।”
=”ঐদিন কি ভোলা যায়! সত্যি বাবা, অদ্ভুত মানুষ ছিলে তুমি। রবীন্দ্র জয়ন্তির অনুষ্ঠান ছিলো ক্যাম্পাসে। আমি গান গাইছিলাম, গান শেষ করে চোখ খুলতেই দেখি একদম স্টেজের সামনে দাড়িয়ে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছো আমার দিকে, চোখে চোখ পড়তেও বেহায়ার মতো তাকিয়েই আছো। খুব অসস্তি লাগছিলো আমার।”
-“হাহাহা! হ্যা, পরে মনে হয়েছিলো ওটা ঠিক হয়নি, কিন্তু তোমার গানে এতোটাই বিভোর হয়ে গেছিলাম যে কখন সামনে চলে গেছি বুঝতেই পারিনি।”
=”শুধুই কি আমার গান শুনেই?” কথাটা বলেই উঠে চলে গেলো অতন্দ্রিলা, ঠোটে মুচকি হাসি।
হাসি নিয়েই খাবার গোছাতে লাগলো অতন্দ্রিলা। অদূর অতীত থেকে কানে এলো একটা পুরুষালি ভরাট কন্ঠ- “শুনছেন?” পিছন ফিরে দেখলো ঐ ছেলেটাই। অসস্তি নিয়ে দ্রুত বীণা রেখে স্টেজ ছেড়ে বাইরের দিকে যাচ্ছিলো অতন্দ্রিলা তখনই ডেকে উঠলো ছেলেটা। মুখে বিরক্তির ভাব এনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো সে।
-“আপনার নামটা বলবেন?”
=”কেনো?”
-“এমনিতেই, মানুষের নাম থাকে তো তাই।”
=”অতন্দ্রিলা।”
-“ও আচ্ছা।” বলেই পিছন ঘুরে হাটা শুরু করলো ছেলেটা। খুব অবাক হলো অতন্দ্রিলা, এ কেমন মানুষ! কিছুক্ষন ছেলেটার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে সেও চলে গেলো।
পরের দিন ক্যাম্পাসে গিয়ে ছেলেটাকে খুজছিলো অতন্দ্রিলা, তার অদ্ভুত আচরণের কারন জানতে চায়। ঘন্টাখানিক দাড়িয়ে থাকার পরও ছেলেটা আসলোনা দেখে অতন্দ্রিলা ভাবলো সে হয়তো আসেনি আজ। এদিকে খুব মেঘ করেছে, বৃষ্টি শুরু হলে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে ভেবে হাটতে শুরু করলো সে, তখন দেখলো ছেলেটা আসছে। ছেলেটাও তাকে দেখলো আর তখনই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। অতন্দ্রিলা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গত কালকের অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়া স্টেজে উঠে গেলো। ওদিকে ওই ছেলেটাও দৌড়ে এসে স্টেজের উপর উঠে দাড়ালো। অতন্দ্রিলা ওর সামনে গিয়ে দাড়াতে ছেলেটি ঘাবড়ে গেলো, অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলো।
=”এইযে মশাই, আমার দিকে তাকান কথা আছে।” ছেলেটি ইতস্থত হয়ে তার দিকে তাকাতেই বললো-
=”আপনি কাল অমন করলেন কেনো?” চোখে কৌতূহলের ছায়া।
-“কি করেছিলাম?”
=”নাম শুনেই কেউ ওভাবে হাটা ধরে?”
-“তাহলে কি করতাম? আপনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন তাছাড়া…”
=”তাছাড়া কি?”
-“আমরা তো পরিচিত নই যে গল্প শুরু করবো।”
=”আজব মানুষ তো আপনি!”
-“হ্যা, ওই একটু।” একথা শুনে হেঁসে ফেললো অতন্দ্রিলা তারপর বললো-
=”ওই একটুই তাইতো?”
-“জী, না মানে…”
=”থাক, মানে বলতে হবেনা। আপনার কি নাম আছে?”
-“কেনো, আমি কি মানুষ না?”
=”কি সেটা?”
-“অভ্র, এবার কি আপনি হাটা ধরবেন?” কৌতুকের ছলে বলে সে।
=”সেটাই করা উচিৎ ছিলো কিন্তু কিভাবে করবো বলেন, দেখছেন তো আকাশ তার কষ্ট ঝরাচ্ছে। এখন এর মধ্যে হাটা ধরলে আকাশের সাথে আমাকেও কষ্ট পেতে হবে।”
-“আপনি দেখছি বেশ সাবলীল ভাবেই গুছিয়ে কথা বলেন।”
=”কেনো, আপনি কি ভেবেছিলেন?”
-“না না, কিছু ভাবিনি। কাল যেভাবে অপ্রস্তুত হচ্ছিলেন ভাবা যায়না সেই মেয়ে এতোটা সাবলীল।”
=”আরে মশাই, কাল আপনি যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন যে কেউই অপ্রস্তুত হতে বাধ্য ছিলো।”
-“হুম তাও ঠিক।”
দুজনই হাসতে থাকে, শুরুটা সেখানেই হয়। ঝুম বৃষ্টির সাথে, আকাশের কষ্টের গল্পের সাথে শুরু হয় আরেক অজানা গল্প। তারপর পাঁচটা বছর কেটে গেলো, আজ তার আর অভ্রর এই সংসার।

ওহ্হো দেরি হয়ে যাচ্ছে, ভাবলো অতন্দ্রিলা তারপর তাড়াতাড়ি খাবার গুছিয়ে এনে অভ্রকে খেতে দিয়ে নিজে খেলো তারপর অভ্রর হাত ধুয়ে দিয়ে ঔষধ খাইয়ে সব গুছিয়ে রেখে এসে বসলো জানালার দিকে মুখ করে। হঠাৎ বিকট শব্দ হলো আর আবারও বিদ্যুৎ চলে গেলো। “ট্রান্সমিটার ব্লাস্ট করলো বোধহয়, বসো মোম জ্বালিয়ে আনি।” বসা থেকে উঠতে উঠতে বললো অতন্দ্রিলা।
-“না থাক যেওনা, অন্ধকারই ভালো।” একটু থেমে অভ্র আবার বললো- “আমাকে তোমার পাশে জানালা মুখো করে বসিয়ে দিবে? বাইরেটা দেখি একটু।”
=”হ্যা এইতো।” বলে অভ্রকে ধরে জানালার দিকে মুখ করিয়ে বসিয়ে তার পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে কাধে মাথা রাখলো অতন্দ্রিলা।
অনেক্ষণ কেটে গেলো, কেউ কোনো কথা বলছে না। চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে দুজনই।
অভ্রদের বাড়িটা শহরের শেষের দিকে, দোতালা ডুপ্লেক্স ধরনের বেশ বড় আর সুন্দর। অভ্রর বাবা বাড়িটা বানিয়েছিলেন অবসর কাটাতে। বাড়িতে মানুষ বলতে অভ্র আর অতন্দ্রিলা, কাজের লোক আছে কজন তারা কাজ শেষে ফিরে যায় যার যার বাড়ি।বাড়ির সামনে বিশাল বাগান, চেনা অচেনা হাজারও ফল-ফুল গাছ। বাগানের মাথায় বড় গেইট, তার সামনে আঁকাবাকা রাস্তা আর রাস্তার পাশ ঘেসে বিশাল বিস্তৃত সবুজ ঘাস আবৃত ফাঁকা মাঠ। বাড়িটা ওই মাঠ মুখোই। আশেপাশে বাড়িঘর খুব কম আর দূরে দূরে। মেঘ কেটে গেছে অনেক আগেই, আকাশ ভরা তাঁরার আবছা আলোতে আবৃত ঐ মাঠের দিকেই তাকিয়ে আছে অতন্দ্রিলা। এখনও ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাঁতাস বইছে, অভ্র অতন্দ্রিলার উষ্ণতায় চোখ বুজে বাঁতাস অনুভব করছে।

ভাবছে অতন্দ্রিলা, জীবনে কতো কিছু ঘটে গেলো, অভ্রর সাথে পরিচয় থেকে শুরু করে এতোগুলো দিন-মাস-বছর। তবে অবাক ব্যাপার এটাই যে তাদের প্রতিটা স্মরণীয় সময় কেটেছে বৃষ্টিমাখা হয়ে, হয়তো বৃষ্টিই তাদের সময় গুলো মধুর করে দিয়েছে আবার কিছু কষ্টও দিয়েছে আজীবন বয়ে নিয়ে বেড়ানোর মতো, সবই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা। ওই যে ওইদিনই তো বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে হাত ভর্তি করে কদম ফুল এনে অতন্দ্রিলাকে দিয়ে বিয়ের কথা বলেছিলো অভ্র। আর বিয়ের দিনও তো, সেকি ঝুম বৃষ্টি। সবকিছু ভালোই চলছিলো, ওইদিনের এক্সিডেন্টটাতেই দুজনের জীবন বদলে গেলো। “কি জানি বৃষ্টির সাথে কি সম্পর্ক আমার বা আমাদের দুজনের।” আপন মনেই বললো অতন্দ্রিলা।

হঠাৎ অতন্দ্রিলা দেখলো আকাশে খুব অদ্ভুতভাবে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের রেখা, যেনো বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ দিয়ে আকাশে কিছু লিখছে কেউ। ঝট করে সোজা হয়ে বসলো অতন্দ্রিলা, তার চমকানো দেখে অভ্রও চোখ মেলে তাকালো তারপর অতন্দ্রিলার চোখ অনুসরন করে আকাশের দিকে তাকিয়ে সেও খুব অবাক হলো। মেঘবিহীন তাঁরাভরা আকাশে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ তাও এভাবে! তখনি হরেক রঙের আলো ঝলকে উঠলো সাথে সাথে অভ্র আর অতন্দ্রিলা মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো আর দুজনই জ্ঞান হারালো।

চোখ মুখে পানির ঝাপটা পড়তে জ্ঞান ফেরে অতন্দ্রিলার, চোখ খুলতেই হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসে সে, অভ্র তার সামনে দাড়িয়ে আর তার শরীর থেকে অদ্ভুৎ আলো ঠিকরে পড়ছে যেনো! স্বপ্ন দেখছে ভেবে চোখ ডলে আবার তাকালো সে। নাহ, সে তো জেগেই আছে, তাহলে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে