অতঃপর সন্ধি পর্ব-২৩+২৪

0
1507

#অতঃপর_সন্ধি (২৩) (বোনাস)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

‘আচ্ছা শোধ তুলিস। তোর পায়ে হয়তো গরম পায়েস পড়েছে। বার্ন মলম লাগিয়েছিস?’

‘মনের ভেতর যে জ্বলন শুরু হয়েছে সেই জ্বলন সহ্য করতে গিয়ে বাহ্যিকটা টের পাইনি।’

তানজিফকে আর কিছু বলতে দিলো না। তার আগেই কল কে’টে দিলো। ধুপধাপ পা ফেলে মা বাবার কক্ষের দিকে গেলো সে।

শোয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন আফসানা হক আর আশহাব শেখ। মায়ের হাতে মোবাইল দিয়ে তেজি কন্ঠে বলল,

‘আমাদের স্বামী স্ত্রীর ব্যপারে একদম নাক গলাবে না কেউ।’

‘তুই ভুল করলেও আমরা চুপচাপ থাকবো?’ চোখ রাঙিয়ে বললেন আফসানা হক।

‘হ্যা, থাকবে।’ সহজসরল স্বীকারোক্তি পুষ্পিতার। বলে আর দাঁড়াল না সে। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো কক্ষ হতে।

‘তুমি তোমার মেয়েকে কিছু বলবে না?’

মশারী গুঁজছিলেন আশহাব শেখ। স্ত্রীর কথায় শির উঁচিয়ে চাইলেন।

‘কি বলবো?’

আফসানা হক আঙুল দিয়ে নিজের মাথার দিকে ইশারা করলেন।

‘আমার মাথা বলবে আমার মাথা।’

‘আচ্ছা, তোমার মাথা।’

‘দেখো?বাজে বকে আমার মেজাজ খারাপ করবে না।’

স্ত্রীর কথায় তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন আশহাব শেখ। মশারীর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি।

‘একটু আগে পুষ্পিতা কি বলে গেলো? যেন ওদের দু’জনের ব্যপারে যেন নাক না গলাই। ছেড়ে দাও না ওদের। নিজেদের ব্যপার নিজেরা সামলাক। স্বামী স্ত্রীর মাঝে মনমালিন্য হয়। আবার ভাবও হয়। নিজেদের ব্যপার নিজেরা মিটিয়ে নিবে। আমরা সবাই মিলে ঘাটাঘাটি করলে খুব খারাপ পর্যায়ে চলে যাবে।’

‘তুমি যেমনটা ভাবছো তেমনটা নাও হতে পারে।’

‘একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করি আফসানা। একেক স্টুডেন্ট একেক রকম। একেক টিচার একেক রকম। মাথা ঠান্ডা সবকিছুর সিদ্ধান্ত নেওয়া লাগে। রাগের মাথায় মানুষ সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলাম। রাগ দেখালাম৷ এতে ও ভুল কিছু করে বসলে?’

রুমের দরজাটা আটকে আসলেন আশহাব শেখ। স্ত্রীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে পুনরায় বললেন,

‘মাথা ঠান্ডা হলে দেখবে নিজে এসেই সব বলবে। তোমার আর আমার মাঝে কি কখনো ঝগড়া হতো না বলো? আমরা কি কেউ কাউকে ছেড়ে গিয়েছি? এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে দুই পরিবারের মিষ্টি সম্পর্কটা তিক্ততায় রূপ নিবে।’

আশহাব শেখের বলা প্রতিটা কথা ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভাবলেন আফসানা হক। সহসা উৎকন্ঠিত স্বরে বললেন,

‘মেয়েটা না খেয়ে এসেছে। এখানেও কিছু খায়নি।’

‘এখন ডাকলে আরো রেগে যাবে। মাথা ঠান্ডা যখন খিদে অনুভব হবে তখন ঠিক খেয়ে নিবে।’

___________________

বাসায় থমথমে পরিবেশ। তাজওয়ার নওশাদ বাইরে থেকে এসে পোশাকও ছাড়ার সময় পেলেন না। চড়া মেজাজ উনার। সারাদিন পরিশ্রমের পরে বাসায় এসে এমন খবর পেলে কার মাথা ঠিক থাকে? অপরাধীর মতো নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে তানজিফ।

‘বিয়েটাকে তোমার ছেলেখেলা মনে হয়?’

মাথা উঁচু করার সাহস পেলো না তানজিফ।

‘আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছি তানজিফ।’ গর্জে উঠলেন তাজওয়ার নওশাদ।

কেঁপে উঠল তিতির। ভয়ে সুমনা এহমাদ আঁচল চেপে ধরলো। এর আগে বাবাকে এতো রাগতে সে কখনো দেখেনি।

‘বিয়ের আগে বলেছি ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নাও। এটা বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়। যে চাইলাম আর বিয়ে করলাম।আবার চাইলাম ছেড়ে দিলাম। প্রতিটা মানুষকে দৌড়ের ওপরে রেখে বিয়ে করেছো। বছর ঘুরতেই মেয়েটাকে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সাহস পাও কোথা থেকে? এই সাহস কে দিলো তোমায়?’

উষ্ম শ্বাস ছাড়লেন তিনি। পুনরায় বললেন,

‘মেয়েটাকে কিভাবে বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে তুমি জানো। কিন্তু আমার পুত্রবধূ যেন এই বাড়িতে ফিরে আসে।’

নিজের রুমের দিকে এগিয়ে তিনি।

‘আজ তোদের বিবাহবার্ষিকী। সেজন্য মেয়েটা কত উৎফুল্ল ছিলো। কত শখ করে এসে বলেছিল, ‘মামনি আজকের দিনটার হয়তো তোমার ছেলে ভুলে গিয়েছে কাজে চাপে। চলো না ছোটখাটো আয়োজন করে ওকে সারপ্রাইজ দেই।’ উল্টো নিজে সারপ্রাইজ পেয়েছে।’

মায়ের কথায় ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো তানজিফ।

_________________

রুমে এসে রাগে গিজগিজ করছে তানজিফ। একবার রুমের এ মাথায় যাচ্ছে তো আরেকবার রুমের ওই মাথায়। আপনমনে বিড়বিড় করতে লাগলো।

‘ বিয়ের আগে আমাকে আল্টিমেটাম দিলো সাতদিনের। শুন তানজিফ, তোকে সাতদিন সময় দিলাম। সাতদিনের মাঝে বিয়ে করলে আমি তোর। না হয় আর কখনো পাবি না । লাজ শরমের মাথা খেয়ে নিজের বিয়ের কথা নিজেই গিয়ে বললাম বাপের কাছে। এতগুলো দিন বাদে প্রাক্তনের উপহার হাতে নিয়ে বসে বসে কাঁদবে। আমি কিছু বললাম ওমনি সমস্ত দোষ আমার। কেউ জিজ্ঞেস করলে কিছু বলতেও পারি না। উল্টো ঝারি খেতে হয়। এসব কথা বলা যায় কাউকে? কি বলবো? আমার বউ তার প্রাক্তনের জন্য কাঁদে। আমি যখন বললাম কথাগুলো তখন তো কিছু বলতে পারতি? না উল্টো সব ছেড়ে ছুড়ে বাপের বাড়ি চলে গেলো। আশ্চর্য।’

স্থির হয়ে খাটে বসল সে।

‘শহরের প্রতিটা কোণায় কোণায় সাইনবোর্ড লাগানো উচিত। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা দরকার, হে পুরুষজাতি, তোমরা তোমাদের জীবনের সমস্ত সুখ বিয়ের আগেই ভোগ করে নাও। কেনন বিয়ের পর সকল সুখ শান্তি স্ত্রীরা হরন করে নেয়।’

মায়ের কথাটা মনে পড়তেই প্রশস্ত হাসলো সে আসলেই তার মনে ছিলো না তার জীবনের স্মরণীয় দিনটার কথা। এইতো পুষ্পিতার জন্য সেদিনও কত পাগলামি করলো। এর মাঝে একটা বছর শেষ। ভাবতেই অবাক লাগে। পুষ্পিতার জন্য বরাদ্দকৃত জায়গাটার দিকে তাকায় তানজিফ।

‘গেলি তো গেলি আমার নিদ্রা সঙ্গে করে নিয়ে গেলি। দুচোখের পাতা যে আর আজ এক হবে না।’

______________________

ভোরের আলো চারিদিকে ফুটতে শুরু করেছে। সারারাত মাথার অসহ্য যন্ত্রণার পরে মাত্রই চোখে ঘুম নেমেছিল পুষ্পিতার। কলিংবেলের অসহ্যকর শব্দে ঘুম হালকা হয়ে গেলো। সাথে বিগড়ে গেলো মেজাজও। ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে দরজা খুলতেই ঘুম উবে গেলো পুষ্পিতার।

উসকোখুসকো চুল আর ফোলা ফোলা চোখমুখ নিয়ে হাজির তানজিফ। পরনে কালকের পোশাক আশাক। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো পুষ্পিতা। দাঁড়িয়ে রইলো দরজার কাছেই। তানজিফ একের পর এক কলিংবেল চেপেই গেলো। সহ্য করতে না পেরে আবারও দরজা খুলে সে।

‘দেখ? এটা ভদ্রলোকের এলাকা। সাতসকালে কোনো প্রকার সীন ক্রিয়েট করবি না। আমার বাবার একটা সম্মান আছে।’

হামি দিতে দিতে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন আফসানা হক। পুষ্পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘এতোবার কলিংবেল বাজায় কে? কে এসেছে পুষ্পিতা?’

দরজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াতেই দৃষ্টিগোচর হলো তানজিফের অসহায় চেহেরা। পুষ্পিতাকে ধমকে উঠলেন তিনি।

‘ছেলেটাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন?’

‘ও কে যে ভেতরে ঢুকতে দিবো?’

‘আমার বান্ধবীর ছেলে।’

দাঁতে দাঁত পিষে মায়ের পানে চাইলো পুষ্পিতা। দরজা ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল।

তানজিফ বাসার ভেতরে ঢুকতে পেরে রাজ্য জয়ের হাসি দিলো। গা জ্বলে উঠে পুষ্পিতার। নিজের রুমে যেতে যেতে বলল,

‘বান্ধবীর ছেলেকে বান্ধবীর ছেলের মতো ট্রিট করবে।একদম জামাই আদর করবে না। আর তোমার ওই বান্ধবীর সো কল্ড ছেলে যেন আমার রুমের চারপাশে ঘুরঘুর না করে। আমাকে যেন ডাকাডাকি না করে। খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।’

‘তোকে বলে আমি আমার জামাইকে আপ্যায়ন করবো?’

____________________

সকাল দশটা!

আশহাব শেখ বেরিয়ে গিয়েছেন অনেকক্ষণ। ফারদিনও স্কুলে। অবলা শিশুর মতো সেই কখন থেকে সোফায় বসে আছে তানজিফ। নাস্তাও করেনি। আফসানা হক তানজিফের দিকে তাকাচ্ছে
একটু বাদে বাদে। মাথায় শৈশবের মতো দুষ্টু বুদ্ধি আসতেই রান্নাঘরের দিকে গেলেন। কন্টেইনার থেকে গোটা শুকনো মরিচ গুলো বের করলেন। তানজিফের সামনে গিয়ে বললেন,

‘মরিচ গুলো কেমন নেতিয়ে পড়েছে। ছাদে গিয়ে একটু রোদ দিয়ে আসি। ভেতর থেকে দরজাটা আটকে দে তো। আমার আসতে দেরি হবে।’

পুরো বাসায় কেউ নেই তানজিফ আর পুষ্পিতা ছাড়া। ফাঁকা ঢুক গিলে গুটি গুটি পুষ্পিতার রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। শান্ত স্বরে ডাকল পুষ্পিতাকে। সাড়া দিলো না। আরো একবার ডাকতেই চেঁচিয়ে উঠলো পুষ্পিতা।

‘এই সমস্যা কি?’

শুষ্ক অধর যুগল জিহবা দিয়ে ভিজিয়ে নিলো তানজিফ।

‘আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনি।’

‘তো আমি কি করবো? আমি তোকে নিষেধ করেছি নাকি তোর চোখে ধরে রেখেছি। নাকি ঘুমশালা এটা?’

‘বিছানার বা পাশ আর বুকের বা পাশ দু’টোই তো খালি। ঘুম আসবে কি করে।’

একেবারে চুপসে গেলো পুষ্পিতা। কি উত্তর দিবে ভেবে পেলো না।

‘খুল না দরজাটা।’

‘খুলবো না। বাড়ি চলে যা।’

‘মানুষের হায়াত-মউত এর কথা বলা যায় না। তোর আর আমার যদি আর কখনো দেখা না হয়?’

অন্তঃস্থলে ছ্যাঁৎ করে উঠলো পুষ্পিতার। এমনটা ভাবতেও যে তার ভীষন কষ্ট হয়।

খট করে দরজা খুলে গেলো। তানজিফ এমনটা না বললে পুষ্পিতা কখনো দরজা খুলবে না। তাই কাল বিলম্ব না করে দ্রুত রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। নিজের বলিষ্ঠ হাতের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো নিজের প্রিয়তমাকে।

নিজের হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে তানজিফকে ধাক্কাতে লাগল পুষ্পিতা। তানজিফ তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

‘ছাড় আমাকে। একদম ছুবি না আমায়। তোর কোনো অধিকার নেই আমাকে ছোঁয়ার।’

এক পর্যায়ে না পেরে একবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলো পুষ্পিতা। তবুও তানজিফ ছাড়লো না। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

‘উহু! ছাড়বো কেন? একদম ছাড়বো না। এই মানুষটার উপর সমস্ত অধিকার তো আমারই। ভালোবাসি তো ভীষণ।’

#চলবে

#অতঃপর_সন্ধি (২৪)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

পুষ্পিতা থমকালো,চামকালো। চেনা জানা অনুভূতিগুলো আবারও কড়া নাড়ল হৃদয়ের দোরগোড়ায়। শরীর অসাড় আর নিস্তেজ হয়ে এলো। শরীর আর মন জুড়ে বয়ে গেলো শীতলতা, প্রশান্তি। আগে এই মুখে এই কথাটা শুনলে মেজাজ খারাপ হতো। আর এখন মিষ্টি একটা অনুভূতি। দপদপ করে অন্তঃস্থলে জ্বলতে থাকা রাগ, ক্ষোভ, অভিমান উবে গেলো মুহুর্তেই। কিন্তু তানজিফ কে তা বুঝতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই।আগে মিশে থাকুক মানুষটার সাথে। লেপ্টে যাক দেহ।

পুষ্পিতা মুখটা হাতের আঁজলায় নিলো তানজিফ। অপরাধীর স্বরে বলল,

‘স্যরি।’

তানজিফের হাতের বাঁধন না থাকায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো তাকে। হতভম্ব হয়ে গেলো সে। চোখ জুড়ে বিস্ময়করতা।

‘একদম আহ্লাদ দেখানোর চেষ্টা করবি না। তোকে আর তোর স্পর্শ আমি নিতে পারছি না।’

হতবিহ্বল চোখে নিমেষহীন চেয়ে রইলো তানজিফ

খাটে পা ঝুলিয়ে বসল পুষ্পিতা। উদাসীন, নির্লিপ্ত চোখে চাইলো তানজিফের হতভম্ব মুখের দিকে।

‘আমি কেঁদেছি বলে ধরে নিলি এখনো মায়ানকে চাই? অদ্ভুত না ব্যপারটা? আমি তোর জন্য সাজলাম, তোর প্রথম উপার্জনে কেনায় শাড়িটা আমার গায়ে জড়ালাম। তোর পছন্দের পায়েস রান্নার জন্য তোড়জোড় করলাম। সেগুলো তোর চোখে পড়লো না। তোর চোখে পড়েছে আমি কেঁদেছি।’

উবে যাওয়া রাগটা আবারও প্রজ্বলিত হলো পুষ্পিতার সর্বাঙ্গে।

‘মানুষ যখন অত্যোধিক কষ্ট পায় তখন কাঁদে। আবার যখন খুব খুশি হয় তখনো কাঁদে। ভুল করার পর যখন বুঝতে পারে তখনও কাঁদে। পানি চোখ দিয়েই আসে। তবে কারণ ভিন্ন। প্রেক্ষাপট ভিন্ন। হ্যা আমি কেঁদেছি। একটা ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিলাম বলে কেঁদেছি। জীবনের মূল্যবান সময় গুলো তাকে দিয়েছিলাম বলে কেঁদেছি। সে আমার ভালোবাসার মর্ম বুঝেনি। অনুভূতির মর্যাদা দেয়নি।’

আগুন লাল চোখে তানজিফের দিকে নেত্রপাত করল। রাগে, জেদে দাঁতে দাঁত পিষে।

‘আমাকে ওর হাতে তুলে দেওয়ার তুই কে? কে দিয়েছে তোকে সেই অধিকার? মায়ানকে বিয়ে করার হলে ওকেই করতাম। তোর কাছে যেতাম না একটু ভালোবাসার লোভে।’

তানজিফ পুষ্পিতার পায়ের কাছে এসে বসল। পুষ্পিতার হাত দু’টো আঁজলিতে নিলো।

‘আচ্ছা বললাম তো আমার ভুল হয়েছে।’

তানজিফের হাত দু’টো ঝাড়া দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো।

‘বড্ড শখ তো বউকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার। মায়ানের বন্ধু আতিকের নাম্বারটা আমার ফোনে সেইভ করা আছে। আমি এখনই উনাকে ফোন করবো। মায়ানের সাথে কানেক্ট করিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি ফিরবো মায়ানের কাছে। শত অপমান করলেও।’

পাগলপ্রায় হয়ে বালিশের তল হাতরে মোবাইল খুঁজে বের করলো। সুইচঅফ করে রাখা মোবাইল অন করলো। কল লগস গিয়ে আতিকের নামটা সার্চ অপশনে লিখার আগেই ছু মে’রে মোবাইল নিয়ে গেলো তানজিফ। গায়ের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে ছুড়ে মা’রে বা পাশের দেয়ালে। মোবাইল দ্বিখণ্ডিত না হলেও ফ্রন্ট গ্লাসের অবস্থা নাজেহাল। অক্ষি যুগল বড় হয়ে গেলো পুষ্পিতার। নাক ফুলিয়ে,আঙুল উঁচিয়ে কিছু বলার আগেই পুষ্পিতার দু’হাতের বাহু চেপে ধরে তানজিফ। খুব শক্ত করে। এতটা চাপ সহ্য করতে না পেরে মোচড়ামুচড়ি শুরু করলো পুষ্পিতা। ব্যথায় ঘোলাটে হলো চোখ। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তানজিফের।

‘সব সময় নিজের দিকটাই ভেবে গেলি। নিজের রাগ নিজের জেদ সবকিছুর উর্ধে তোর। মানে মন যখন যা বলে তাই করিস। অপর পাশের মানুষটা সহ্য করতে পারবে কি না তা ভাবিস না। রাগ জেদ তোর একাই আছে আমার নেই? তোর চোখে আমি ছ্যাছড়া, বিরক্তিকর একটা মানুষ। কিন্তু আমার কাছে তুই আমার ভালোবাসার মানুষ। আমার সবকিছু। আদরে মুড়িয়ে রাখার মানুষ। আমার উপস্থিতি তোর বিরক্ত লাগতে পারে। কিন্তু আমার কাছে তোর উপস্থিতি বক্ষঃস্থলে প্রশান্তির ঢেউ বইয়ে দেয়। রাগটা মানুষ সবার সামনে জাহির করে না। তুই বলেছিস তোকে এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করার জন্য। করেছি তো। সবার চোখে বেহায়া হয়েছি। নির্লজ্জ হয়েছি। ওসব নিয়ে আমি ভাবি না। কারণ আমি তোকে পেয়েছি। তোর কাছে এইসব কিছু ফিকে। তোর উপর আমার পূর্ণ অধিকার থাকার পরও কোনো রাতে নিজের অধিকার চাইনি। আমি সর্বদা চেয়েছি তুই নিজ থেকে আমায় কাছে ডাক। নিজের ভালোবাসার চাদরে আমায় জড়িয়ে নে। বিবাহিত জীবনের একটা বছর চলে গেলো। তোর হাতে তোর প্রাক্তনের উপহার চোখে পানি। আমি কি ভাববো? আমার কি ভাবা উচিৎ? ওই সময় আমার যা মনে হয়েছে তাই করেছি। হয়তো আমি ভুল ছিলাম। তুই অভিমান করলি। অভিমান ভাঙাতে এলাম। কেন আমার মেজাজটা বিগড়ে দিচ্ছিস?’

বিরতিহীন কথাগুলো বলে থামল তানজিফ। চোখেমুখে রাগ ভাসমান। রাগে নিজের চুল টেনে ধরলো সে। পুনরায় বলল,

‘একটা বার আমার জায়গায় নিজেকে বসা। আমার পরিস্থিতি কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারবি। তুই আমাকে ভালোবাসিস না। আমি জানি। এরপরও যদি আমি তোকে বলি আমি অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিবো। তুই সহ্য করতে পারবি না। হাসির ছলে বললেও না। স্বামী স্ত্রীর ব্যপারটাই এমন। পরিপূরকের পাশে কাউকে সহ্য হয় না। সবকিছুর ভাগ হয়। শুধু ভাগ হয় না জীবনসঙ্গিনীর।’

তানজিফের রাগে র’ক্তি’ম হওয়া মুখপানে চেয়ে রইলো পুষ্পিতা। অপলক, অনিমেষ। বাহুর ব্যথার কথাও ভুলে গেলো।

‘আমার চোখের দিকে শেষ কবে তাকিয়েছিলি, মনে আছে?’

পুষ্পিতার তৃষ্ণার্ত, কাতর নেত্র যুগলের দিকে চাইলো তানজিফ। পুষ্পিতা আবারও বলল,

‘বিয়ের পর কখনো আমার চোখের ভাষা বুঝার চেষ্টা করেছিস?’

বলে ফিচেল হাসলো।

‘না তুই আর না মায়ান। কেউ আমাকে ভালোবাসে না। কেউ ভালোবাসেনি। আমি একজনের চোখের মোহ। আরেকজনের মনের মোহ। মোহ কে’টে যায়।’

সহসা তানজিফের শার্টের কলার চেপে ধরে সে। দাঁতে দাঁত পিষে রুক্ষ স্বরে বলল,

‘তোকে কেউ নিজের অধিকার ছেড়ে দিতে বলেছে? সামনে আসবি না আমার। একদম সামনে আসবি না। মোহ হয়ে থাকার চেয়ে দূরে চলে যাওয়া ঢের ভালো। বের হ আমার রুম থেকে।’

_____________________

পুষ্পিতা এইবাসায় আছে আজ চারদিন হলো। তানজিফ সেই যে গেলো আর একটা ফোনও করেনি। আর না খোঁজ নিয়েছে পুষ্পিতা। আফসানা হক মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করেন না। তারপরও প্রশ্ন করে বসলেন,

‘তানজিফ কল করেছিলো?’

‘আমার মোবাইল ভাঙা।’ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল পুষ্পিতা।

‘আমার মোবাইল থেকে কল করতি।’

‘আমার এতো ঠ্যাকা পড়েনি।’

দাঁত কিড়মিড় করে মেয়ের দিকে চাইলেন আফসানা হক।

‘তোর শ্বশুর আজ ফোন করেছিলেন।তোর সাথে নাকি কথা বলবে।’ আশহাব শেখের কথায় চমকে উঠে পুষ্পিতা।

‘সময় হলে কথা বলবো।’ বলেই নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।’

সন্ধ্যায় পুষ্পিতার রুমের জানালা আটকানো হয়নি। জানালা আটকানোর জন্য জানালার ধারে যেতেই দৃষ্টি সূঁচালো হলো তার। বাইরে পরিচিত অবয়ব। হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। পর্দার আড়ালে দাঁড়াল সে। অয়বয় একবার উপরের দিকে তাকায়।।আরো একটু চেপে দাঁড়াল পুষ্পিতা।

‘আমার প্রণয়ের দহনে পুড়িয়ে তোকে একেবারে ভস্ম করে দিবো।’

__________________

সাতসকালে পুষ্পিতাকে ঘুম থেকে টেনে তুললেন আফসানা হক। পুষ্পিতা আবারও ধপাস করে শুয়ে পড়লো। ঘুমে চোখ জোড়া নিভু করছে। তানজিফ যতক্ষণ নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো পুষ্পিতাও ততক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে তানজিফকে দেখছিলো।

‘পুষ্পিতা সুমনা এসেছে সেই কখন। তোকে এমন ঘুমোতে দেখলে কি ভাববে।’

পুষ্পিতা ঘুমো ঘুমো গলায় বলল,

‘মামনি কিচ্ছু ভাববে না। জানে আমি ঘুমকাতুরে মানুষ।’

দৈবাৎ মাথায় হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ পিটপিটিয়ে তাকাল সে। একগাল হেসে সুমনা এহমাদের কোলে মাথা গুঁজল।

‘মেয়েদের এতো বেলা অব্দি ঘুমোতে হয় না।’

‘তোমার ছেলেটা আমাকে বড্ড জ্বালায় মামনি।’ বিড়বিড় করে বলল পুষ্পিতা। কথাগুলো সুমনা এহমাদের কান অব্দি এলো না।

‘নিজের সংসার ফেলে অনেক বেড়ানো হয়েছে বাপের বাড়ি। এখন চল আমি নিতে এসেছি।’

‘যাবো তো ও বাড়ি। আগে তোমাকে আর বাবাকে হানিমুনে পাঠাই। তারপর আমিও তোমার ছেলের সঙ্গে হানিমুন করবো।’

নিদ্রা উবে গেলো পুষ্পিতার। ঘুমের ঘোরে মুখ ফসকে কি বলতে কি বলে ফেলেছে নিজেও জানে না। জিভে কামড় দিয়ে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখল সে।

#চলবে

ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে