স্বপ্ন?পর্ব_৪০/৪১/৪২
#অনামিকা_সিকদার_মুন
#পর্ব_৪০
.
.
.
নিঝুম চমকালো না। মুখে কিছু বললোও না । ধীরে ধীরে নিশির হাতটা ধরলো শুধু । খুব শক্ত করে । শীতল দৃষ্টিতে তাকালো । নিশি দেখলো সেই দৃষ্টিতে কি যেন আছে । বলতে লাগলো,
—আজ থেকে সাত বছর আগে আমাকে রেপ করা হয়েছিল ।
এতটুকু বলেই থামলো নিশি । নিশি কথাটা শুনে নিঝুম মনে হয় কারেন্টে শক্ খেল । চমকে উঠে তাকালো নিশির দিকে । একটু আগের শক্ত করে ধরে রাখা হাত মুহুর্তেই ঢিল হয়ে গেল । তারপর আপনাআপনি নিশির হাত ছেড়ে দিল নিঝুম । বিষ্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিশির দিকে । আর নিশি কথাটা বলেই তাকিয়ে ছিল নিঝুমের দিকে । নিঝুমের রিয়েকশন দেখার জন্য । যখন নিঝুম নিশির হাত ছেড়ে দিল তখন নিশি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যময় হাসি দিল । ও জানতো এমন কিছুই হবে । এটাই যে স্বাভাবিক । কারণ আমরা যে সমাজে বাস সেই সমাজের নিয়মই যে এমন । দোষ যার সে কখনো শাস্তি পায় না । শাস্তি পায় নির্দোষ মানুষটা । ধর্ষণকারীকে সমাজ কিছু বলে না । তার দিকে আঙ্গুল তুলে না । আঙ্গুল তুলে ধর্ষণের স্বীকার মেয়েটির দিকে । দোষ দেওয়া হয় তাকে । সমাজের চোখে সে সবচেয়ে বড় অপরাধী ।
নিশি চুপ করে রইলো । ওর আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না । চোখ উপচে পানি আসছে । কিন্তু ফেলতে পারছে না । বাঁধা দিয়ে রাখছে অশ্রুগুলোকে । কারণ ও কারো সামনে নিজেকে দূর্বল প্রমাণ করতে চায় না । এদিকে নিঝুম চাতকের মতো নিশির মুখপানে তাকিয়ে আছে । সবটা শোনার জন্য । কিন্তু নিশি যে নিশ্চুপ ।
—কিভাবে হয়েছে এসব?
নিঝুম আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেললো । নিশি নিঝুমের দিকে না তাকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
—শুনে কি করবে? আর কিছু শোনার কোনো প্রয়োজন তো দেখছি না ।
—নিশি আমি তোমার থেকে সবটা জানতে চাইছি । বলো প্লিজ ।
নিঝুম একটু রেগে বললো । শান্ত দৃষ্টিতে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে নিশি বলতে শুরু করলো,
—আমি আর অনু খুব ছোট থাকতে আব্বু মারা যায় । আব্বু বেঁচে থাকতে কষ্ট কি বুঝতাম না । আত্মীয়ও অভাব ছিল না । কিন্তু আব্বু চলে যাওয়ার সাথে সাথে সব পাল্টে গেল । আমার আব্বু চাচাদের মধ্যে সবার বড় ছিল । আমাদের বংশের নিয়ম হচ্ছে প্রথম সন্তান সম্পত্তির অংশ বেশি পায় । সেই নিয়ম অনুসারে আব্বুর সম্পত্তির অংশ বেশি ছিল । এটা নিয়ে চাচাদের অনেক ক্ষোভ ছিল আব্বুর উপর । উপরে উপরে আব্বুকে অনেক সম্মান দেখাতো । ভালো সাজতো । কিন্তু মনে মনে হিংসায় জ্বলতো । তাই আব্বুকে মার্ডার করে ।
এতটুকু বলে নিশি একটু থামে । ওর চোখের কোণা বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে । নিঝুম চুপ করে আছে । কি বলবে বুঝতে পারছে না । তাই চুপ করে আছে । নিশি আবার বলতে শুরু করলো,
—আব্বুকে মার্ডার করে সবাইকে বলে যে সেটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল । মা বুঝতে পারলেও কিছু করার ছিল না । একমাত্র আব্বু ছাড়া আর কেউই যে ছিল না আমাদের । নানুবাড়ি থেকেও ছিল না । তাই আব্বু মারা যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই আমাদের উপর অশান্তি নেমে আসে । নানারকম ভাবে অত্যাচার করতে লাগলো চাচারা । একসময় অতিষ্ট হয়ে আমাদের নিয়ে মা বেরিয়ে আসে ঐ বাড়ি থেকে । তবুও চাচারা শান্ত হয় নি । চিরতরে আমাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায় । তখন একবারে এলাকা ছেড়ে চলে আসি আমরা এভাবেই কাটে কয়েক বছর ।
আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি । একদিন আমি বাসায় একা । কারণ আমি একটু অসুস্থ ছিলাম । অনু ওর স্কুলে আর আম্মুও স্কুলে যাবে । তো আম্মু বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই কে যেন কলিংবেল বাজায় । আমি ভেবেছি হয়তো আম্মু কিছু ফেলে গেছে তাই নিতে আবার এসেছে । এটা ভেবে আমি না দেখেই দরজা খুলে ফেলি । আর সাথে সাথে আমাকে ধাক্কা মেরে ঝড়ের বেগে কেউ ঘরে ঢুকে পড়ে । এত জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে আমায় যে মাটিতে পরে কপালে অমেক আঘাত পাই আমি । উঠে দাঁড়িয়ে দেখি আমার ছোট চাচা । উনাকে দেখেই আমি ভয় পেয়ে যাই । বুঝতে পারি যে খারাপ কিছু হতে চলেছে । তাই বাঁচতে ভেতরের ঘরে যাওয়ার জন্য দৌড় দিয়ে যাওয়ার আগেই আমাকে ধরে ফেলে । ছাড়া পাওয়ার জন্য চাচার হাতে এলোপাথারি খামচাতে থাকি আমি । কিন্তু অত ছোট আমি পেরে উঠি নি চাচার শক্তির সাথে । উনি আমাকে বিশ্রি ভাষায় গালাগাল করতে করতে আমার গায়ে থেকে ওড়না টেনে নিয়ে আমার মুখ বেঁধে ফেলে । চিৎকার করতে গিয়েও পারলাম না । আর তার আগেও চিৎকার করার কথা ভুলে গিয়েছিলাম ভয়ে । হাত পা ঠান্ডা হয়ে অসাড় গিয়েছিল আমার । নড়তেও পারছিলাম না । আমার হাত ধরে রেখেই আরো একটা ওড়না খুঁজে বের করে আমার হাত পা বেঁধে ফেলে চাচা ।
বলতে বলতে ডুকরে উঠে নিশি । চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি ঝড়ছে নিশির । এতক্ষণ চেষ্টা করছিল নিঝুমের সামনে না কাঁদার জন্য । কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারলো না নিজেকে ধরে রাখতে । হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছলো নিশি । তাতে বিশেষ কোনো লাভ হলো না । আবার পানিতে ভরে উঠলো ওর দু’চোখ । নিঝুম দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো শুধু । দম নিয়ে নিশি আবার বলতে শুরু করে,
—ইচ্ছে মতো খুবলে খায় আমাকে । তাতেই শেষ হয় নি । কোথা থেকে একটা ব্লেড এনে আমার হাতে টান মারে । তারপর পেটে, গলায়, পায়ে আর…
আবার থেমে যায় নিশি । শুনতে শুনতে নিঝুমের চোখেও পানি এসে পড়েছে কখন ও নিজেও টের পায় নি । ওর ইচ্ছে করছে নিশিকে জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় হাত রাখতে । কিন্তু পারছে না কেন জানি ।
—প্রায় সেন্সলেস অবস্থা ছিল আমার । তার উপর এভাবে শরীর পোঁচ দেয়ায় ব্লিডিং হতে থাকে প্রচুর । একসময় জ্ঞান হারাই । যখন চোখ খুলি তখন আমি হাসপাতালের বেডে । নার্সের থেকে জানতে পারি পাঁচদিন অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম । তখন কাউকে দেখলেও ভয় পেতাম । পাগলেী মতো চিৎকার করতাম । আম্মুকেও কাছে আসতে দিতাম না । এজন্য প্রায়ই আমাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হতো । দু’মাস হাসপাতালে রাখা হয়েছিল । তখনও আমি সুস্থ হইনি । বাসায় নিয়ে আসার পরও পাগলের মতো আচরণ করতাম । একবছরের বেশি সময় লেগেছিল আমার ঠিক হতে । এই একবছরে চারবার সুইসাইড করতে চেয়েছি । কিন্তু বিধিবাম একবার কিছু হয় নি । বেঁচে গেছি । আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছিল । বেঁচে থাকলেও যখন বাহিরে বের হতাম তখন মানুষ ঘুরে ঘুরে তাকাতো আমার দিকে । কেমন দৃষ্টি নিয়ে যেন তাকাতো । ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম আমি । মাথা উঁচু করতে পারতাম না । মনে হতো এই বুঝি কেউ এসেই আমাকে আবার অত্যাচার করবে ।
নিশি কাঁদতে কাঁদতে আরো বললো,
—কোনোদিন কোনো ছেলের সাথে মিশি নি ভয়ে । কোনো মেয়েকে বন্ধু করতে পারি নি । বিশ্বাস করতে পারতাম না কাউকে । কাউকে নিজের কষ্টগুলো শেয়ারও করতে পারতাম না । একমাত্র অনুটা আমাকে সামলাতে পারতো । আমার মুখ দেখে সব বুঝতে পারতো । মা-র কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম আমি । ভয় লাগতো । খুব ভয় লাগতো । কিন্তু আযান জানি কিভাবে আমাদের বন্ধু হয়ে যায় । কিন্তু প্রথমে ওকে দেখলেও ভয়ে আমি পালাতাম । স্বাভাবিক একটা জীবন ছিল না আমার । একমাত্র অনুর জন্য আমি আবার হাসতে শিখেছি । বাঁচতে শিখেছি । মাথা উঁচু করতে পেরেছি । কিন্তু যা হারিয়েছি তা তো আর ফিরে পাই নি । আর না পাব । কেন আমার সাথে এমন হলো বলতো নিঝুম? কেন আমি-ই? আব্বুকে হারালাম । নিজের সবচেয়ে বড় সম্মান হারালাম । মায়ের কাছ থেকে নিজে দূরে সরে মাকে হারালাম । শুধু হারালামই । আমার প্রাপ্তির খাতাটা কেন শূণ্য? কেন?
নিশি নিঝুমের কাছে গিয়ে ওর কলার ধরে বললো,
—আমি জানি আমি তোমাকেও হারিয়ে ফেলেছি । পাওয়ার আগেই হারিয়েছি । আজকের পর হয়তো তুমি আর আমার মুখটাও দেখতে চাইবে না । কেন আমাকেই সব হারাতে হবে? বলো? প্লিজ বলো….
নিশি নিঝুমের কলার ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে শেষ কথাগুলো বলছিল । হঠাৎ নিশির কথা থেমে গেল । লুটিয়ে পড়লো নিঝুমের বুকে । বুক থেকেও পড়ে যাচ্ছিল তার আগেই নিঝুম আঁকড়ে ধরলো নিশিকে । নিশি পুরোপুরি ভর ছেড়ে দিয়েছে । নিশিকে ধরে রেখেই ওর গালে ধরে আলতো থাপ্পর মেরে ডাকলো নিঝুম । কোনো সারা নেই । বুঝলো সেন্সলেস হয়ে গেছে নিশি । সাথে সাথে নিশিকে কোলে তুলে নিল নিঝুম । কোলে তুলতে গিয়ে দেখলো নিশির পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে । নিঝুম দ্রুত নিশিকে নিয়ে নিশির রুমে গেল । রুমের সামনে গিয়ে দেখলো দরজা খোলা । ভেতরে ঢুকে পড়লো নিঝুম । ভেতরে ঢুকে দেখে অনু পায়চারি করছে ঘরময় । নিশিকে কোলে নিঝুমকে ঘরে ঢুকতে দেখে দৌড়ে নিঝুমের কাছে যায় অনু ।
—সেন্সলেস হয়ে গেছে ।
নিঝুম বললো । অনু বিছানা দেখিয়ে বললো,
—ওখানে শুইয়ে দিন ।
নিঝুম বিছানায় কাছে গিয়ে নিশিকে শুইয়ে দিল । উঠার সময় বাঁধা পেয়ে তাকিয়ে দেখে নিশির চুল আটকে আছে ওর শার্টের বাটনে । নিশির দিকে তাকালো নিঝুম । কি মায়াবী একটা মুখ । কেউ বলতে পারবে না যে এই মুখটার পিছনে এত কষ্ট লুকানো । এত কষ্ট নিয়ে কিভাবে বেঁচে এই মেয়েটা । কয়েক মুহুর্ত নিশির দিকে তাকিয়ে থেকে শার্ট থেকে নিশির চুল ছাড়িয়ে নিল নিঝুম৷। তারপর কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল ।
ঠাস করে ডায়েরিটা বন্ধ করে দিল বিভাবরী । মুখে দু’হাত চেপে হু হু করে কেঁদে উঠলো……
.
.
.
চলবে?
(বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন । )
.
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
#স্বপ্ন?
#অনামিকা_সিকদার_মুন
#পর্ব_৪১
.
.
.
ওর এতটা কষ্ট লাগছে যে ওর মনে হচ্ছে এই কাহিনীটা ওর নিজের । এত কষ্ট লুকিয়ে একটা কিভাবে হাসি মুখে থাকতে পারে! এটা ভেবে ওর কষ্টটা আরো দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে । বুকের ভেতর মুচড়ে উঠছে থেমে থেমে । ওড়নার কোণে চোখ সুন্দর করে মুছে নিল । তারপর ডায়েরিটা আরো কয়েকটা বইয়ের মধ্যে নিয়ে স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে এলো । উপরে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে “বিভা” বলে ডাক দিল বিভাবরীর মা । পিছন ফিরে বিভাবরী বললো,
—হ্যাঁ, মা বলো ।
বিভাবরীর মা এগিয়ে এসে বললো,
—এতক্ষণ স্টাডি রুমে কি করছিলি?
হুট করে এমন প্রশ্নে চমকে যায় বিভাবরী । তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দেয়,
—কিছু দরকারি বই খুঁজছিলাম মা ।
—ওহ । আচ্ছা শোন, বিকালে তোর ফুপ্পি আসবে । আজ কোথাও বের হস না আবার ।
দু’দিকে মাথা এলিয়ে বিভাবরী বললো,
—আচ্ছা যাবো না । আর কিছু বলবে মা?
সবসময়ের মতো মুখে হাসি টেনে বিভাবরীর মা বললো,
—না । যা ঘরে যা ।
আর কথা না বাড়িয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো বিভাবরী । দ্রুত পায়ে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিল । তারপর বিছানায় গিয়ে বসলো । হাতের নীল রঙা ডায়েরীটার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ । বিভাবরীর চোখের সামনে যেন ডায়েরীর প্রতিটা কথা জ্যান্ত ভেসে উঠছে । যতক্ষণ সম্পূর্ণটা পড়া শেষ হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত শান্তি মিলবে না এটা খুব ভালো করে বুঝে গেছে বিভাবরী । তাই ডায়েরীটা নিয়ে আবার বসে পড়লো । ডুব দিল লিখাগুলোর মাঝে ।
নিশিকে রুমে দিয়ে এসে একমুহুর্তের জন্যও শান্তি পাচ্ছিল না নিঝুম । বার বার নিশির কান্নাময় চেহারাটা ভেসে উঠছিল চোখে । আর বুকের ভিতর কেমন জানি ব্যাথ্যা করছিল । মিনিট বিশেকের সময় আবার নিশির রুমে ফিরে গেল নিঝুম । গিয়ে দেখে দরজা খোলাই । লাগায় নি । চিন্তায় নক করার কথা মনে নেই নিঝুমের তাই এমনি ঢুকে গেল । রুমে ঢুকে দেখে অনু নিশির মাথাটা কোলে নিয়ে নিশির চুলে হাত বুলাচ্ছে । নিঝুম ধীর পায়ে গিয়ে দাড়ালো বিছানার পাশে । অনু মুখ তুলে তাকালো নিঝুমের দিকে । এই কিছুক্ষণের মধ্যে নিঝুমের চেহারাটাও কেমন বিধস্ত লাগছে । নিঝুম কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই অনু ইশারায় চুপ থাকতে বললো । তারপর আস্তে আস্তে নিশির মাথাটা কোল থেকে সরিয়ে বালিশে রেখে বিছানা থেকে নেমে নিঝুমকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো ।
নিঝুম তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে । আর অনু পাশে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে । এভাবেই নিরবতায় কাটে অনেকক্ষণ । হঠাৎ অনু কোনো ভুমিকা ছাড়াই বলতে শুরু করে,
—আপি ডিপ্রেশনে আছে । যদিও কেউ বুঝতে পারে না । কারণ আপি খুব হাসিখুশি থাকে সবার সামনে । যখনই আপির এই অতীত আপির মনে পড়ে ব্রেনে প্রেশার পড়ে তখনই আপি সেন্সলেস হয়ে যায় । একটু আগেই সেন্স ফিরে ছিল আপির । আমি ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি । টেনশন নেই কোনো ।
কথাগুলো বলেই অনু থেমে গেল । অপেক্ষা করলো নিঝুমের কিছু বলার । কিন্তু নিঝুম নিশ্চুপ । কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অনু আবার বললো,
—নিঝুম ভাইয়া সত্যি করে এটা কথার উত্তর দিন তো?
নিঝুম অনুর দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললো,
—কি?
অনু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—এতকিছু শোনার পরেও কি ভালোবাসেন আপিকে?
নিঝুম অনুর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল । নিঝুমকে অন্যদিকে তাকাতে দেখে অনুর বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো । মনে মনে নিজেকে নিজে বললো,
—তুই ভুল ভেবেছিল অনু । এসব শুনেও হয়তো একটা মেয়েকে একটা ছেলে মেনে নিতে পারে না ।
ভাবতে লাগলো নিশির কথা । কারণ নিশির জন্য এটা আরেকটা বড় ধাক্কা । কিভাবে সামলাবে নিশি । পারবে তো সহ্য করতে । অনুর ভাবনার সুতো কাটলো নিঝুমের কথায় ।
—আজ থেকে আরো আড়াই বছর আগে হঠাৎ একদিন রাতে অদ্ভুত এক #স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায় । শোয়া থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠে বসি তখন । ভাবছিলাম এ কেমন #স্বপ্ন ? কি দেখেছিলাম জানো?
শেষ কথাটা বলে নিঝুম অনুর দিকে তাকায় । দেখে অনু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । নিঝুম আবার আগের জায়গায় দৃষ্টি দিয়ে বলতে শুরু করে,
—একটা মেয়ে আমার পাশে বসা । সে কে জিজ্ঞাসা করলে তার উত্তর না দিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দেয় । আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর হাসি বোধ হয় ওটাই ছিল । মেয়েটা আমার মনের কথা পড়ে ফেলতো মাইন্ড রিডারের মতো । তারপর হঠাৎ আমার হাতে হাত, চোখে চোখ রেখে জায়গা ছেড়ে উঠে আমার সামনে দু’পায়ে ভর দিয়ে বসতো । খুব গভীর আর স্পষ্ট কন্ঠে আমার নাম ধরে ডাকতো । তারপরই খুব কাছে চলে আসতো আমার । এই #স্বপ্ন সেইদিনের পর থেকে প্রতিদিন দেখতাম । ঠিক একই সময়ে । আর ঠিক একই সময়ে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে যেত । প্রতি নিয়ত আমি এই #স্বপ্নটা দেখতাম । এভাবেই দুইবছর কাটে । হঠাৎ এক বৃষ্টিস্নাত রাতে গাড়িতে থেকে নুপুরের ছমছম শব্দে মন কেমন করে উঠলো । একদম ফাঁকা নিরব রাস্তায় নুপুরের ছমছম শব্দ কোথা থেকে আসবে । খুঁজতে শুরু করলাম । চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে এক বৃষ্টিবিলাসীর দিকে নজর যায় । আরেকটু ভালো করে তাকাতেই থমকে গেলাম আমি । কারণ সেই বৃষ্টিবিলাসী আর কেউ না আমার স্বপ্নকন্যা । সেদিন পেয়েও হারিয়ে ফেলেছিলাম আমার স্বপ্নকন্যাকে । পরে আবার অনেক খুঁজে বের করেছিলাম । ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম স্বপ্নকন্যা আমার বুকের বা পাশটা দখল করে আছে । ভালোবাসি সেই তখন থেকে যখন সে শুধু আমার জীবনে স্বপ্ন হয়েছিল ।
নিঝুম একটানা বলেই যাচ্ছিল । ওর গলা ধরে আসছিল কান্নায় । তাও নিজে সামলে রাখে বহু কষ্টে । আর অনু অবাক হয়ে শুনছিল নিঝুমের কথা । কারণ নিঝুমের কথা অনুযায়ী অনু যেটা বুঝতে পারছে সেই মেয়েটা নিশি । আড়াই বছর ধরে নিঝুম নিশিকে…. এসব ভাবতেই অনু মাথা ঘুরছে যেন । কিভাবে সম্ভব!!!
নিঝুম কাঁপা গলায় আবার বললো,
—আমার সেই স্বপ্নকন্যা অন্য কেউ না অনু । আমার স্বপ্নকন্যা নিশি ।
অনু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো নিঝুমের দিকে । ওর আর বুঝতে বাকি নেই যে নিঝুম সব জানার পরেও নিশিকেই ভালোবাসে ।
.
ভোর হতে আর বেশি সময় নেই । কারো হাতের কোমল উষ্ণ ছোঁয়ায় চোখ মেলে তাকালো নিশি । অনু ওর পাশে বসা । নিশির চোখ অসম্ভব লাল । সাথে ফুলেও গেছে । নাকের ডগা দেখে মনে হচ্ছে লাল রং লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে । নিশিকে তাকাতে দেখে অনু বললো,
—জলদি উঠ আপি । নাহলে সূর্যাদয় দেখাটা মিস হয়ে যাবে ।
নিশি অনুর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—আমি আজই ফিরে যাব অনু…..
.
.
.
চলবে??
(বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।)
#স্বপ্ন?
#অনামিকা_সিকদার_মুন
#পর্ব_৪২
.
.
.
অনু নিশির শান্ত দৃষ্টি দেখেই যা বোঝার বুঝে গেল । চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবলো । তারপর বললো,
—আচ্ছা যাব চলে । কিন্তু আজকে না কালকে । আজকে…
অনুকে কথার মধ্যে থামিয়ে দিল নিশি । বললো,
—কাল না আজই ।
অনু হেসে বললো,
—আচ্ছা আজই যাব । কিন্তু এখন না । হেলিপ্যাড থেকে সূর্যাদয় দেখে এসে তারপর যাব । এখন উঠ ।
অনু নিশিকে ঠেলে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে পাঠালো । নিশি চট জলদি ফ্রেশ হয়ে বের হলো । অনু নিশির হাতে একটা ড্রেস দিয়ে বললো,
—এটা পড়ে আয় আপি ।
নিশি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় অনুর দিকে । অনু বুঝতে পেরে বলে,
—পরে শুনিস । এখন জলদি কর ।
নিশি আর কথা বাড়ালো না । অনুর দেয়া ড্রেস পড়ে নিল । নিশিকে অনু হালকা সাজতে বলেছিল । কিন্তু নিশি রাজি হয় নি । অনু নিশির চুল খোলা রাখতে বলে ।
হেলিপ্যাডে দাড়িয়ে আছে নিঝুম, নিশি, নীল, অনু, আযান আর মাহি । পূব আকাশের কোণ থেকে একটু একটু করে জেগে উঠছে সূর্যটা । মেঘের ভেলা ভেসে যাচ্ছে । আর সেই মেঘের মধ্যে থেকে একটু সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে একটু একটু করে। সাজেকের সৌন্দর্যের মধ্যে মেঘের খেলা আর সূর্যের আলো মেলা অন্যতম । যা দেখলে বিমোহিত হতে হবেই । নিশি চুপচাপ দাড়িয়ে আছে । দৃষ্টি দূর পুব আকাশে সূর্যের আলোর খেলা দেখায় ব্যস্ত । চোখ দু’টো লাল হয়ে আছে । নাকটাও লাল । মুখ হালকা ফোলা । সামনের কাটা গুড়ো চুলগুলো ভ্রু থেকে একটু নিচে চোখের একটু উপরে পড়ে আছে । মাঝে মাঝে হালকা বাতাসে সেই চুলগুলো উড়ে সরে যাচ্ছে । আবার এসে আগের মতো বিছিয়ে পড়ছে কপালে । আর পেছনে বাঁকা চুলগুলো পুরো পিঠ ছেয়ে পড়েছে কোমড়ের নিচে পর্যন্ত । সাদা রংয়ের একটা লং ফ্রক পড়া নিশি । মুখে কোনো প্রসাধনীর বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই । যেন একটুকরো মেঘ । নিঝুম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল নিশির দিকে । মুগ্ধ ছড়িয়ে আছে ওর ঠোঁটের কোণের হাসিটায় ।
রাতের পর থেকে নিশি নিঝুমের সাথে একটা কথাও বলে নি । এমনি একবার তাকায় পর্যন্ত নি ।
চুপচাপ নিজের মতো আছে । নিশি নিঝুমের দিকে না তাকালেও এটা ঠিকই বুঝতে পারছে যে নিঝুম ওর দিকে ঠিকই তাকিয়ে আছে । নিশি অনুর পেছনে আড়াল হয়ে দাঁড়ালো যাতে ওকে দেখা না যায় । ফিসফিস করে অনুর কানের কাছে বললো,
—আমার ভালো লাগছে না অনু । আমি চলে যাব।
অনুও তখন নিশির মতো ফিসফিসিয়ে জবাব দিল,
—আরেকটু পরেই চলে যাব ।
নিশি আর কিছু বললো না । চুপচাপ করে আগের মতো তাকিয়ে রইলো দূরে কোথাও । যার শেষ সীমানা আকাশ আর পাহাড় মিলে গেছে । হঠাৎ কি জন্য যেন পাশ ফিরে তাকায় নিশি । দেখে অনু নেই । অনুকে খোঁজার জন্য চারপাশের সবদিকে চোখ বুলায় । দেখে শুধু অনু না । নীল, মাহি, আযান নিঝুম কেউ নেই । ঘাবড়ে গেল নিশি । একটু আগেও তো সবাই-ই ছিল । মুহুর্তের মধ্যেই কোথায় গেলো ।
হঠাৎ গিটারের টুং টাং সুর কানে এলো নিশির । ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো নিশি ।
…..Dil Ka Yeh Kya Raaz Hai,
…………. Jaane Kya Kar Gaye
……Jaise Andhero Mein Tum,
……………..Chaandni Bhar Gaye
…….Kare Chaand Taaron Ko,
……….Mashoor Itna Kyun
….Kambakht Inn Se Bhi Khoobsurat Hai Tu
……I Love You, Tu Ru Ru .. Yeah Yeah
…..I Love You, Tu Ru Ru .. Yeah Yeah
….I Love You, Tu Ru Ru .. Yeah Yeah
নিঝুম যখন আই লাভ ইউ বলছিল তখন নিশির দিকে ইশারা করছিল । নিশির চোখে মুহুর্তই কাল রাতে নিঝুমের হাত ছেড়ে দেওয়াটা চোখে ভেসে উঠল । চোখের এসে পানি জমতে লাগলো ।
।
….Din Bhar Kare Baatein Hum,
…Phir Bhi Lagey Baatein Adhoori Aaj Kal
…..Mann Ki Dehleezon Pe Koi Aaye Na,
……… Bas Tum Zaroori Aaj Kal
…..Abhr Main Hoon,
….Tu Aasmaan Hai
…..Paas Hai Tu,
..Par Kahaan Hai
…Zidd Meri Tu Nahin,
….Meri Aadat Hai Tu
………I Love You
………. I Love You
……….. I Love You
নিঝুম নিশির চারপাশে ঘুরে ঘুরে গাইতে লাগলো ।
…….Kabhi Kabhi Main Khud Se Hoon Yeh Poochta
……..Main Tere Kaabil Bhi Hoon Kya
….Itna Toh Mujhe Hai Maloom Mil Ke Tujhe
………….Behtar Main Insaan Bann Gaya
………….Thoda Thoda,
…………… Tujhse Seekha
..Pyaar Karne Ka Tareeka
…..Dil Ke Khuda Ki Mujhpe Inaayat Hai Tu
…..I Love You
……. I Love You
…….I Love You
….
…..Dil Ka Yeh Kya Raaz Hai,
……..Jaane Kya Kar Gaye
…..Jaise Andhero Mein Tum,
………….Chaandni Bhar Gaye
……….Kare Chaand Taaron Ko,
…………Mashoor Itna Kyun
….Kambakht Inn Se Bhi Khoobsurat Hai Tu
I Love You..
গান শেষে শেষবার যখন আই লাভ ইউ বলবে নিঝুম তখন নিশি দৌড়ে চলে যাওয়া ধরে । নিশি চলে যাওয়ার জন্য যেই ঘুরে দাঁড়িয়ে এক পা বাড়ায় তখনই নিঝুম পেছন থেকে নিশির হাত টেনে ধরে । দাঁড়িয়ে যায় নিশি । ওর চোখ থেকে অলরেডি পানি ঝরতে শুরু করে দিয়েছে । এমনিতেই মুখ ফুলে ছিল কালকে কান্না করার জন্য । তারপর আবার এখনও কান্না করায় মুখ লাল হয়ে উঠেছে নিশির । নাক টানছে ।
নিঝুম নিশিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করালো । নিশি তখনো মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে । নিঝুম নিশির হাত তখন আবার ছেড়ে দিল । যখন নিঝুম নিশির হাত ছেড়ে দেয় তখন নিশি মাথা তুলে নিঝুমের দিকে তাকায় । মনে মনে বলে,
— ” তুমি আবারও আমার হাতটা ছেড়ে দিলে!! ছেড়েই যখন দিবে তাহলে হাত ধরার দরকার ছিল কি? হয়তো ভুল আমারই । অচেতন মনে আবার ভাবতে শুরু করেছিলাম যে তুমি আমাকে ভালোবাসো । কিন্তু সেটা ভুল… ”
নিঝুম নিশির মুখ দেখেই ওর মনে মনে বলা কথাগুলো বুঝে নিল । মুচকি একটা হাসি দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো নিশির সামনে । নিশির হাতটা ধরে বললো,
— স্বপ্নকন্যা, এক স্বপ্ন হয়ে তুমি হঠাৎ আমার জীবনে এসেছিলে রিমঝিম বৃষ্টিস্নাত এক রাতে । তোমার নুপুরের ছমছম শব্দে সেদিন থমকে গেছিলাম আমি, থমকে গেছিল আমার হৃদয় । তোমার কাজল কালো চোখে সেদিন দেখেছিলাম আমার ছায়া । একটু ছোঁয়ার আগেই সেদিন হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি । সাথে নিয়ে গেছিলে আমার মন । অনুভূতি গুলো যে তখন থেকেই হয়েছে অবাধ্য । আমি জানি না কিভাবে ভালোবাসার কথা বলতে হয় ।
স্বপ্নকন্যা তুমি স্বপ্ন না সত্যি হও আমার জীবনে । বৃষ্টি হয়ে ঝরো আমার আকাশে, রাত হয়ে নামো আমার শহরে ।
নিঝুম নিশির হাতের উল্টো পিঠে একটা চুমো দিল । কেঁপে ওঠে নিশি । সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলে । তারপর আবার পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় । নিঝুম এখনো হাঁটু গেড়েই বসে আছে । নিশি চোখ মেলে তাকাতেই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো নিঝুম । নিশির মুখটা দু’হাতে আঁজলা করে নিয়ে ডান চোখের পাতায় একটা চুমু দেয় । গাঢ় স্বরে বলে,
—“ভালোবাসি”
নিশি চোখ খুললো না । চুপ করে শুধু অনুভব করছে । নিঝুম আবার বাম চোখের পাতায় একটা চুমু দিয়ে বললো,
—” খুব বেশি ভালোবাসি ”
.
.
.
চলবে?
.