শিরোনামহীন পর্বঃ৭

0
1629

শিরোনামহীন
সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
পর্বঃ৭

এ গ্রামে কখনো সূর্য উঠে না,সূর্য আসে। এক ফালি রোদ এসে রাঙিয়ে দিয়ে যায় পুরো গ্রাম।
ভোরবেলায় বৃষ্টি হয়েছে। ঝুম বৃষ্টি। গাছের পাতায় এখনো জমে আছে বিন্দু বিন্দু জল। ঘরের সামনেই জবা গাছ৷ জবা গাছের গা এখনো ভেজা। চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে পানি।
ঘরের বারান্দায় বসে সেদিকেই তাকিয়ে আছেন আনতারার বৃদ্ধ মা।
বয়স ষাটের মোহনায়। স্বামী গত হয়েছে বছর সাতেক আগে।
তারপর দুই পুত্র,পুত্রবধূ এবং দুই নাতীনাতকুর নিয়েই তার বাস। এক মেয়ে সে তো চোখের সামনে থাকবে বলেই সাবেতের কাছে বিয়ে দিয়েছে।

উঠোনের দক্ষিণ পাশটায় শ্যাওলা জমেছে। যেকোন সময় আছাড় খাবে যে কেউ।
সেদিকটায় এক টুপড়ি গোবর এনে ফেললেন বাড়ির রাখাল ছেলে।
এরা তিন পুরুষ ধরেই কাজ করছে আনতারাদের বাড়ি।বাধা কাজের লোক বলা চলে, তবে এ ছেলেটা শুধু গরুর দেখাশোনা করে বলেই নিজেকে রাখাল বলে দাবী করে।মাঝেমধ্যে বাঁশিও বাজায়।
পনেরো কি সতেরো বছর বয়সের হবে তবে কাজে বেশ দুরন্তর।
উঠোনে গোবর লেপ দিচ্ছে সে। এক হাতে বাঁশের ঝাড়ু অন্য হাতে একটা প্লাস্টিকের মগ।
মগ দিয়ে একটু পানি গোবরের মধ্যে ঢালছে অন্য হাতে ঝাড়ু দিয়ে গোবর পানি ছড়িয়ে দিচ্ছে পুরো উঠোনে।
আনতারার মায়ের দৃষ্টি তখন ঝাড়ুর দিকে।পানি,গোবর এবং ঝাড়ুর প্রতিটি সংঘর্ষ মনে করিয়ে দিচ্ছে মস্তিষ্কের কোথাও ধুলো জমে যাওয়া এক পশলা স্মৃতি।

সেবার আনতারা দশে পা দিয়েছে। জৈষ্ঠ্যমাস, পুরো বাড়ির উঠোন জুড়ে জমা হয়েছে ধানের আঁটি।
তখন বাড়ির কর্তা জীবিত ছিলেন। বাড়ি ভর্তি কাজের জন্য আনা লোক। যাদের কেউ ধান আনছে আবার কেউ মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত।
আনতারার মা-ভাবী তখন ব্যস্ত পাক ঘরে।
এক এলাহী কান্ড বলা চলে। বড় ভাইয়ের সাইকেলে করে স্কুল থেকে ফিরলো আনতারা।
ফিরেই ঢুকেছে পাকঘরে ভাবীর কাছে। ঘামে ভেজা কুমুদের পিঠে বুক ঠেকিয়ে গলা আকড়ে ধরে আদায় করে নিলো তার পাওনা।
পাওনা আদর নিয়ে বেরিয়ে আসতেই পা দিলো উঠোনে রাখা গোবরে।
কয়েকদিনের বাসী গোবরে জন্মেছে কিছু সুর্দশন। আস্তে-ধীরে তারা জায়গা করে নিয়েছিলো আনতারার পায়ে।
যখন আনতারা বুঝতে পারলো পায়ে কিছু একটা লাফাচ্ছে, মেয়ে সে কি কান্না!
ভয়ে এতটুক হয়ে গিয়েছিলো তার মুখ।
এরপর থেকে উঠোনে গোবর দেওয়ার সময় সে ঘর থেকেই বের হতো না।এতদিনেও সে অভ্যেস মেয়ে ছাড়তে পারেনি।

মেয়ের ওমন ছেলে মানুষীর স্মৃতি মনে হতেই এক চিলতে
হাসি দেখা দিলো ভদ্রমহিলার ঠোঁটের কোণে তবে দীর্ঘ স্থায়ী হলো না সে হাসি।
সাবেতকে তো কম আদর করেনি তারা, আনতারাও কম ভালোবাসেনি সাবেতকে। তাহলে এমন কেনো করলো সে?
দু-চোখ উপচে নোনাস্রোত নেমে এলো গাল বেয়ে।

দুই গ্রামের সীমানা নির্ধারণ করেছে চেয়ারম্যান বাড়ি।সাবেতদের বাড়ি তাদের গ্রামের শেষ প্রান্তে, আনতারাদের গ্রামের শুরুতে। মাঝে রয়েছে চেয়ারম্যান বাড়ি,সাবেতদের ফলের বাগান,একটা পুকুর এবং কবরস্থান।
আনতারাদের বাড়ি সইসই রয়েছে সাতটা পুকুর। সাত পুকুরে মাছ চাষ হয়। পুকুরের মালিকানা কারো নামেই নেই কারণ যার জমি ছিলো মতিন মিয়া, সে যুদ্ধের সময় নিহত হয়। বেঁচে ছিলো তার বৃদ্ধা মা।মারা যাওয়ার আগে সাত পুকুর গ্রামের মসজিদ,মাদ্রাসার নামে দিয়ে যান বৃদ্ধা।মৃত্যুর আগে ভদ্রমহিলা গ্রামের চেয়ারম্যানের হাত ধরে শুধু বলেছিলেন,

“বাবা পুকুর ভরাট করিস না।আমার পুকুরে মাছ হবে অনেক, তোরা নিস, তয় আমার পুকুর একবেলার বেশি নির্জলা রাখিস না।”

এমন নয় যে সবাই বৃদ্ধার কথা মেনেছে। বৃদ্ধার মৃত্যুর পর পুকুর সেঁচে মাছ তোলার পর পুকুর পানিশূন্য হওয়ার ঘন্টা দুয়েক পর একজন মানুষ মারা যায়। তারপর কোথা থেকে পানি এসে যেনো টইটম্বুর হয় পুকুর। পরপর তিন বছর যখন এমন হলো, তারপর থেকে এই সাত পুকুরকে গ্রাম বাসী কখনো নির্জলা রাখেনা।

একটা পুকুরের পাড়ের উপর শুয়ে আছে মাহির।
সাবেতের এমন করার কোন মানে সে খুঁজে পাচ্ছে না। মুখে সিগার রেখেই ডান হাত দিয়ে ফোন বের করে নিজের পকেট থেকে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে এতটা এক্টিভ না হলেও নাম মাত্র একাউন্ট আছে৷
লগিন করেই সাবেতের নামে সার্চ করলো মাহির।
তার কোন অধিকার নেই ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলার তবে মনে হচ্ছে কোন একটা কারণে সাবেত – আনতারা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না।

কয়েকজোড়া বুনো তিতির ঘুরাঘুরি করছে আনতারার চারপাশে। ছোট ভাই এনে দিয়েছিলো আনতারা কে। দুই জোড়া, সেই দুই জোড়া ডিম দিয়েছে, বাচ্চা ফুটেছে। এবার অনেকগুলো ছোট ছোট বাচ্চা ফুটেছে।
ঘরের কাজ বা কিছুতেই মন বসাতে পারছে না সে। আজ মনে হচ্ছে শ্বাশুড়ি কিছুটা উল্টো পথে চলছে।
হয়তো এমন একদিন আসবে সাবেত ফিরে আসবে গ্রামে, সাথে নিয়ে আসবে মারিয়াকে।
বাড়ি এসে বলবে তাদের জন্য, মারিয়ার জন্য ঘর ছেড়ে দিতে। শ্বাশুড়িও নতুন বউয়ের মান রাখতে আনতারাকে তার সাথে থাকতে বলবে।
তারপর তার চোখের সামনেই চলবে মারিয়া- সাবেতের প্রেমের সংসার। আজ ভোরবেলা দেখা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে আনতারার।সাবেত ফিরে এসেছিলো। স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো।হয়তো সাবেত আর কখনো ফিরবে না।না হলে ফিরবে মারিয়া সমেত। সত্যি হবে চিন্তাভাবনা।
এসব ভাবতেই একরাশ কষ্ট দলা পাকিয়ে বুক বেয়ে উঠে এলো আনতারার গলার দিকে।
প্রচন্ড ব্যথা করছে কন্ঠনালীতে। কয়েকটা ফাকা ঢোক গিলে কান্না গিলতে চাইলেও পারলো না।আঁচলে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে।
পাকঘর থেকে আনতারার শ্বাশুড়ি দেখে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনেই ভাবলো,

“নারীর জীবন ব্যর্থ যদি সে তার স্বামীকে আগলে রাখতে না পারে।আর তুই সে অভাগী ব্যর্থ নারী বৈ কিছুই না।”

হায়রে নারী, হায়রে মা। পরের মেয়ের দোষ শুধু চোখে লাগলো, নিজের ছেলের দোষ দেখেও দেখলো না।

সময়ে সময়ে সমুদ্রের পানি এসে পা ভিজিয়ে দিচ্ছে সাবেতের। আনতারা তাকে ব্লক কেনো দিলো? সে কি সত্যি মায়ের সাথে এদেশে আসবে? এলে যদি মারিয়াকে মেনে না নেয়? যদি ছেড়ে দিতে বলে মারিয়াকে? তাহলে কি করবে সে?মারিয়াই বা কি করে মেনে নিবে আনতারা কে?
আনতারাকে আগেই সবটা বলা উচিৎ ছিলো।উচিৎ ছিলো মারিয়ার সম্পর্কে সব জানানোর। ধীরেধীরে সাবেতের
দুচোখে জমছে পানি। তবুও সাবেতের দৃষ্টি তখন সমুদ্রের পানির দিকেই।
আবছা চোখে সেখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার অতীত কাল।
ষোড়শী আনতারা প্রতিচ্ছবি।

(শুরু হলো আনতারা-সাবেতের অতীত রোমন্থন)

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে