মিসটেক পর্ব- দ্বিতীয়

0
1448

গল্প- “মিসটেক”
পর্ব- দ্বিতীয় (মোট ৫ পর্বের গল্প)
লেখা- মিশু মনি

আমি বাড়িতে এসে মেজো আপাকে নিয়ে বসলাম। তার ডিভোর্সের কারণ জিজ্ঞেস করতেই আপা এড়িয়ে গিয়ে বললো, ‘এতদিন পর আবার এটা নিয়ে লাগলি কেন?’
আমি বললাম, ‘আপা, আমার জানা লাগবেই। তোমার আর দুলাভাইয়ের মাঝে কতদিন ধরে ঝামেলা চলছে আর কি কি ব্যাপার ছিলো আমাকে ক্লিয়ার করে বলো তো?’

আপা মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘সুমনের একটা মেয়ের সাথে অনেকদিনের সম্পর্ক। মেয়েটাকে ছাড়া ও নাকি বাঁচবে না। আমার সাথে প্রতিদিন রাতে কথা কাটাকাটি হতো। বনিবনা নাই একদমই। কথায় কথায় আমাকে খোটা দিতো। আমি নাকি দেখতে ধুমসি, আমার রূপ নাই, গুণ নাই। আমার সাথে থাকলে নাকি ও মরে যাবে এসব বলতো।’

আমি বললাম, ‘তুমি আব্বুকে মামলা করতে দিলা না কেন? এখানে তো তোমার কোনো দোষ নাই।’
‘দেখ ভাই, তোকে কেউ মুখের উপর যদি বলে তোকে আমার ভালো লাগে না। তোর সাথে শুয়েও শান্তি পাইনা তোর মুখ দেখেও শান্তি পাইনা। তুই কি এরপরও তার সাথে থাকবি?’

আমি আপার হাত ধরে বললাম, ‘আমি জানি আপা এটার ফিলিংস কেমন। নাজিয়া আমাকে যে অপমান টা করলো.. কিন্তু এর কি কোনো শাস্তি হবে না?’
আপা বললো, ‘যে যেভাবে ভালো থাকে থাকুক না। আমরা কষ্ট হলেও তো আর অন্যের ক্ষতি চাইতে পারি না। ও সুখে থাকুক। তুইও দোয়া কর তোর বউ সুখে থাকুক।’
‘এটা আমি চাইতে পারবো না। কারণ আমারও কোনো দোষ নাই আর তোমারও নাই। আমরা পুরোপুরি নির্দোষ হয়ে দুজন অপরাধীকে সুখে শান্তিতে থাকতে দিবো তা তো হয় না।’

আপা কিছু না বুঝেই বললো, ‘তুই তোর দুলাভাইকে কিছু বলিস না। ও ভালো থাক।’
‘আপা দুলাভাই আর নাজিয়ার অবৈধ সম্পর্ক ছিলো।’

শায়লা আপার মুখটা হঠাৎ করে আমাবস্যার আকাশের মতো গভীর কালো হয়ে গেল। বড়সড় কোনো ধাক্কা খেয়েও আপা স্বাভাবিক গলায় বললো, ‘আমি এটাই সন্দেহ করেছিলাম।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তুমি আগে থেকেই জানতে! কই আমাকে তো কিছু বলো নাই?’

আপা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘সুমন আর নাজিয়ার আচার আচরণে ওরা কখনো কিছু বুঝতে দেয় নাই। আমি একবার দুবার সন্দেহ হলেও মন থেকে তাড়িয়ে দিতাম। ভাবতাম নাজিয়া অনেক ভালো মেয়ে, তোদের তো প্রেমের বিয়ে। তোর মতো সুন্দর একটা ছেলেলে জীবন সাথী হিসেবে পেলে কোনো মেয়ের আর কি লাগে। কিন্তু যখন শুনলাম নাজিয়া তোর কাছে ডিভোর্স চায় সেদিনই নিশ্চিত হইছিলাম যে সুমনের সাথে আসলে ওরই সম্পর্ক ছিলো।’

আমি মাথায় হাত দিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার সবকিছু এলোমেলো লাগছে। আপার ভেতরের অবস্থা অনুভব করে আমার কষ্টে আত্মা ফেটে যেতে চাইছিলো। কি নিদারুণ কষ্ট নিয়েই না এই মানুষটা এতদিন বেঁচে আছে।

আপা বললো, ‘নাজিয়া আর তুই একবার আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলি মনে আছে? আমরা সবাই একসাথে খাবার খাচ্ছিলাম, আড্ডা দিচ্ছিলাম। তুই তো বাসায় ছিলি না অনেক্ষণ। আমি রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত থাকতাম। ওরা দুজন গল্প করত আর টিভি দেখতো। রান্নাঘর থেকে সুমনের হাসির শব্দ শোনা যেতো। আমি ঘরে গেলেই সুমন বলতো, নাজিয়া তো অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে। শিহাবের মতো একটা বোকা ছেলে কিভাবে পেলো ওকে বলোতো?’ ওর কথা শুনে আমিও হেসে উড়িয়ে দিতাম। সুমন নাজিয়াকে নিয়ে বাড়ির বাইরে হাঁটতে যেতো। আমি স্বাভাবিক ভাবেই নিতাম বিষয়টাকে। ভাবতাম ছোট বোনের মতো দেখছে। কথা বলছে বলুক না। কিন্তু কে জানতো ভেতরে ভেতরে ওরা নষ্ট হয়ে গেছে একেবারে।’

আপার কথা শুনে নাজিয়ার প্রতি আমার ঘেন্নায় বুক ভরে যেতে লাগলো। সেবার বিয়ের সময় আমার দেয়া চেইন কিংবা নাজিয়ার পছন্দে কেনা শাড়ি দুটোর চেয়ে দুলাভাইয়ের দেয়া শাড়িটাই নাজিয়াকে বেশি আকর্ষণ করতো। ও বারবার শাড়িটা বের করে আমাকে দেখাতো, পরতো। বিয়েতে পরপর তিনবার ও শাড়িটা পরেছে। অথচ নিজে পছন্দ করে যে দুটো শাড়ি কিনেছিলো তার প্রতি একেবারেই উদাসীন ছিলো নাজিয়া। যেন ও দুটো রাস্তায় পড়ে পাওয়া।

বিয়ে বাড়িতে প্রায়ই দেখতাম নাজিয়া মিষ্টি কিংবা শরবতের গ্লাস আলাদা করে নিয়ে যাচ্ছে দুলাভাই দের জন্য। তবে ও বড় দুলাভাইকেও যেভাবে সম্মান করতো, মেজোটাকেও সেভাবেই সম্মান করতো বলে আমি কিছু মনে করি নি। বাসায় ফেরার পর প্রায়ই বলতো, ‘মেজো আপা আর দুলাভাইকে একদিন বাসায় দাওয়াত দাও না।’

আমি বলতাম, ‘হাতে টাকা আসুক। ওরা বড়লোক মানুষ রে ভাই, ভালো খাওয়াইতে হবে।’
এভাবে একদিন কিছু টাকা জমিয়ে আপা দুলাভাইকে বাসায় দাওয়াত করলাম। আপা বললো, আগে তোরা এসে ঘুরে যা। তারপর আমরা যাবো। আর তোর দুলাভাই বলেছে তোরা কিন্তু এখানে তিন/চার দিন থাকবি। এসেই চলে যাবি তা কিন্তু হবে না।

আমি আপার কথায় রাজি হয়েছিলাম। আপার বিশাল বাড়ি। দুজন কাজের লোক। একজন মহিলা সকাল বিকাল ঘর মোছে আর রান্নাঘরে টুকিটাকি কাজ করে। দৌড়ে দৌড়ে এটা সেটা এনে খেতে দেয়। নাজিয়া বেশ উপভোগ করছিলো ব্যাপারটাকে। আমি বাসার বাইরে বের হয়ে ঘুরতাম। আশেপাশের পরিবেশ মোটামুটি ভালো। উন্নত এলাকা। এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করতাম। আমি জানতামও না বাসায় নাজিয়া ও দুলাভাই একান্তেই বসে গল্প করে সময় পার করছে।

তবে একটা ব্যাপার ঘটে ছিলো। আপার বাসায় গিয়েই একদিন রাতে আমি বারবার নাজিয়াকে বললাম চলো ঘুমাতে যাই। নাজিয়া টিভির রুম থেকে উঠতেই চাইছিলো না। টিভিতে ইংলিশ মুভি চলছিলো। আমি, দুলাভাই ও নাজিয়া বসে টিভি দেখছিলাম। আপা মাঝেমাঝে আসছিলো আবার রুমে যাচ্ছিলো। হঠাৎ একটা আপত্তিকর দৃশ্য শুরু হয় সিনেমায়। আমি রিমোট নিয়ে চ্যানেল ঘোরানোর চেষ্টা করি। দুলাভাই বলে ওটা সরাসরি নেটফ্লিক্স থেকে চলছে। নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বললাম, চলো রুমে যাই। নাজিয়া তবুও উঠতেই চাইছিলো না। আমি উঠে রুমের দিকে এগোলাম এই ভেবে যে নাজিয়া আমার উঠে যাওয়া দেখে আমার সাথে রুমে চলে আসবে। কিন্তু না, ও ঠায় বসেই রইলো। আমি আবার ফিরে এসে দেখি নাজিয়া ও দুলাভাই একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে কিভাবে যেন হাসছে। দুজনের দৃষ্টিতেই কিছু একটা ছিলো। তখন টিভির পর্দায় চলছে একটা গভীর রোমান্টিক সিন। আমি নাজিয়ার হাত ধরে বললাম, ‘ঘুম পাচ্ছে চলো না।’

দুলাভাই বললো, ‘যান ভাবী। আমার শালার ঘুম পাচ্ছে না কি পাচ্ছে কে জানে। তারাতাড়ি যান।’

আমি নিতান্তই ফাজলামো হিসেবেই নিলাম কথাটাকে। কিছু মনে করি নি। সোজা নাজিয়াকে নিয়ে ঘরে চল্র আসি। বোঝার উপায় ছিলো না ভেতরে ভেতরে তখন দুজনে দুজনের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছে।
নাজিয়া ঘরে এসে আমাকে বললো, ‘ওদের টিভিটা কত বড় দেখছো? এত বড় টিভি থাকলে আর কি লাগে।’
‘আরো অনেক কিছুই লাগে। টিভি হইলে বলবা এসি লাগবে, বাসায় দুজন কাজের বুয়া লাগবে।’
‘আমার অত চাহিদা নেই।’
‘আমি জানি। সেজন্যই তো তোমাকে বিয়ে করেছি। তুমি খুব ভালো মেয়ে নাজিয়া।’

নাজিয়া আমার হাত ধরে বললো, ‘আসলেই আমি কিছু চাই না। কিন্তু আমাদের একটা বিশাল সাইজের টিভি কিনতে হবে কি বলো? বড় টিভিতে মুভি দেখতে যে কি মজা। মনে হচ্ছিলো ওরা আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় করছে।’

নাজিয়ার উজ্জ্বল চোখ আর কথা বলার ভঙ্গি দেখে আমি মনে মনে ভাবলাম, ‘টাকা জমিয়ে একটা বড় টেলিভিশন ই কিনে দেবো আমার বউকে। সে অনেক খুশি হবে।’

কিন্তু না, নাজিয়া সে সুযোগ আমাকে দেয় নি। টিভির কথা আর কখনো মুখেও আনে নি। কিন্তু সে কথায় কথায় বিভিন্ন বিষয়ে মন খারাপ করতো। কখনো বলতো, ‘আমাদের সোফাগুলা অনেক নরমাল হয়ে গেছে। একটা অভিজাত টাইপের কিছু আসবাব কিনতে পারলে ভালো হতো।’ কখনো বলতো, ‘তোমার ঘড়িটা এত বাজে লাগছে। একটা দামী ঘড়ি কিনতে পারো না?’ আবার কখনো, ‘বাসায় কি যে গরম লাগে। কবে যে আমাদের অনেক টাকা হবে, একটা এসি কিনবো।’

মাঝেমাঝে আমার ওপর রেগে যেতো, ‘শিহাব, তুমি এত ক্ষ্যাত কেন? কি ফালতু ড্রেস আপ তোমার। একটু ভালো কিছু পরো।’

আমি ধীরেধীরে নাজিয়ার পরিবর্তন লক্ষ করছিলাম। ও আমার কোনোকিছুতেই সন্তুষ্ট হচ্ছিলো না। একদিকে আমার আর্থিক অবস্থাতে তো নয়ই, অন্যদিকে আমার চেহারা, শরীর নিয়েও কটুক্তি করতো। অথচ এই নাজিয়া একদিন আমার জন্য পাগল ছিলো।

আমি বাসায় ফিরে সিগারেট ধরাই। আপার মানসিক অবস্থা ভালো না। বাইরে থেকে তাকে দেখলে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও আমি বুঝতে পারি তার ভেতরে কি বয়ে যাচ্ছে। নাজিয়াকে কি করবো জানিনা, কিন্তু দুলাভাইকে একটা উচিত শিক্ষা তো আমার দিতেই হবে। আমার বোনকে এভাবে কষ্টের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলো। অবশ্য নাজিয়ার মতো লোভী স্বার্থপর মেয়ের জন্যই এমন হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছু একটা তো করতেই হবে আমাকে। নয়তো নিজেও শান্তি পাবো না, আর আপার কষ্টও সহ্য করতে পারবো না।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে