তৈমাত্রিক পর্ব-১৪+১৫

0
968

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ১৪

🌿🌿
.
.
.
.

তনু তার ঘরে কাজ করছিলো ঠিক তখনই তার ফোনে ফোন আসে। তাকিয়ে দেখে তার খালামনি অর্থাৎ মেহরামের শাশুড়ী কুসুম বেগম। তনু জলদি করে ফোন রিসিভ করে…

তনু;; হ্যালো খালামনি কেমন আছেন?

কুসুম;; মা রে ভালো আর থাকলাম কোথায়।

তনু;; মানে খালামনি হয়েছে কি? (কপাল কুচকে)

কুসুম বেগম এবার কেদে দিলেন। আর তনুও অবাক, সে বারবার বলছে কি হয়েছে কিন্তু কুসুম বেগমের কাদার বেগ এতো টাই বেশি যে তিনি কিছু বলতেই পারছেন না।

তনু;; আহা খালামনি দেখুন এতো কাদবেন না শরীর খারাপ হয়ে যাবে আপনার। কি হয়েছে বলুন তো আর মেহরাম কোথায়?

কুসুম;; মারে সোহেলের ক্যান্সার হয়েছে!

তনু;; কিহহ এগুলো কি বলছেন। কিভাবে কবে মানে?

কুসুম;; হ্যাঁ মেহরাম আর সোহেল আগে থেকেই জানতো কিন্তু আমাকে বলেনি কারণ অতিরিক্ত চিন্তা করবো তাই। ক্যান্সার হয়েছে ওর।

তনু;; আল্লাহ এই সব কি বলছেন। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। আচ্ছা খালামনি আপনি ফোন টা রাখুন আর মেহরাম কোথায়?

কুসুম;; সোহেলের কাছেই আছে। জানো মা ছেলে টাকে এখন আর চেনা যায় না। সোহেল আম….

তনু;; খালামনি প্লিজ এভাবে কাদবেন না। আচ্ছা আপনি ফোন টা রাখুন আমি আসছি এখনই।

তনু এই বলে ফোন টা কেটে দেয়। যেমন ছিলো তেমন ভাবেই শুধু হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে পরে সে।

লায়লা (তনুর শাশুড়ী);; আরে তনু কোথায় যা….

তনু;; মা মা আমি না একটু মেহরাম দের বাসায় যাচ্ছি বুঝলে একটু দরকার। (দ্রুত যেতে যেতে)

লায়লা;; কিন্তু হয়েছে কি আর সাথে কাউকে নিয়ে যা।

তনু;; না মা থাকো তোমরা এদিক টা দেখো আমি যাই।

তনু যেন এক প্রকার দৌড়াচ্ছে। বাইরে আসতেই রিকশা নিয়ে চলে যায়। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর তনু এসে থামে মেহরামের বাসায়। কলিংবেল বাজাতেই নিলা এসে দরজা খুলে দেয়। তনু গিয়ে দেখে মেহরাম তার শাশুড়ী কে ঔষধ খাওয়াচ্ছে। তনু দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে কুসুম বেগমের পাশে বসে।

তনু;; মেহরাম কবে ধরা পরেছে সোহেল ভাইয়ের ক্যান্সার??

মেহরাম;; ২-১ মাস আগে।

তনু;; ২-১ মাস! এতো দিন আগে ধরা পরেছে তাও তুই আমাদের কাউকেই জনানোর প্রোয়জন মনে করিস নি?

মেহরাম;; সোহেল না করেছিলো তাই।

তনু;; কিন্তু মেহরাম এতো বড়ো একটা ঘটনা এটা অবশ্যই সবাইকে বলা দরকার ছিলো।

মেহরাম;; কি আর বলি।

তনু;; আচ্ছা ভাইয়া কোথায়?

মেহরাম;; রুমে শুয়ে আছে।

তনু;; এখন কেমন আছেন?

মেহরাম;; আছেন কোন রকমে।

তনু খেয়াল করে দেখে মেহরামের চোখের নিচে দাগ, পেট টা হাল্কা বের হয়েছে, একদম ছন্নছাড়া। নিজের প্রতি কেয়ার বা খেয়াল যে করে না তা তাকে দেখেই প্রমাণিত।

মেহরাম;; কিরে কোথায় হারিয়ে গেলি?

তনু;; ননা কোথাও না। আচ্ছা শোন ভাইয়ার সাথে দেখা করা যাবে না?

মেহরাম;; আরে যাবে তো কেন যাবে না। তুই আমার রুমে যা আমি একটু পর আসছি।

তনু;; হুম।

তনু সিড়ি বেয়ে ওপরে রুমে চলে গেলো। ভেতরে যাওয়ার আগে নক করে গেলো।

তনু;; সোহেল ভাইয়া আসবো?

সোহেল;; আরে তনু যে এসো এসো।

তনু ভেতরে এসে বসে। দেখে সোহেল বিছনাতে হেলান দিয়ে আধো শোয়া হয়ে আছে। কম্বল দিয়ে কোমড় অব্দি রেখে দিয়েছে। তনু তো দেখে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে এতো সুন্দর একটা লোকের এই অবস্থা হয়েছে। তার হাতে রয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের একটি বই। তাই হয়তো বসে বসে পরছিলো।

সোহেল;; কেমন আছো অনেকদিন পর দেখলাম আর কখন এসেছো মেহরাম কিছু বললো না তো আমায়!

তনু;; না ভাইয়া আমি এইতো কিছুক্ষণ আগেই এসেছি আর এতোক্ষণ নিচে মেহরাম আর খালামনির সাথেই ছিলাম।

সোহেল;; ওহহ তা বাসায় সবাই কেমন আছে তোমার?

তনু;; আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?

সোহেল;; হয়তো তুমি জানো!

তনু;; জ্বি ভাইয়া জানি আর তার জন্যই ছুটে এসেছি।

সোহেল;; হাহা, কি আর করবো বলো কেউ তো আর ইচ্ছে করে এইসব চায় না। আল্লাহ হয়তো আমার ভাগ্যে এটাই রেখেছিলেন।

তনু এবার কাদো কাদো হয়ে গেলো।

তনু;; ভাইয়া প্লিজ এভাবে বলবেন না, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সবকিছুরই সমাধান আছে এটারও আছে। দরকার হলে বাইরে যাবো ট্রিটমেন্টের জন্য।

সোহেল;; তনু আসলে আমার ভেতরে ক্যান্সার টা বাসা বাধছিলো অনেক দিন ধরেই কিন্তু আমরা কেউ সেটা টের পাই নি। ডক্টর বলেছেন যে আগে হঠাৎ করেই যখন তীব্র শ্বাসকষ্ট হতো বা বুকে ব্যাথা করতো তখনই যদি ডাক্তার দেখাতাম তাহলে হয়তো কিছু করা যেত। কিন্তু আগে তো বুঝি নি আর আমাকে বাইরে বাইরেই থাকতে হতো বেশি তাই।

তনু;; এখন ডক্টর কি বলেছেন?

সোহেল;; লাস্ট স্টেজ। আর আমাকে দেখেই তো বুঝতে পারছো যে কি হালে রয়েছি। প্রথমবার টেস্ট করালে ধরা পরেনি কিন্তু দ্বিতীয়বার একদম রিপোর্টের লেখা গুলো যে জ্বলজ্বল করে বলছিলো যে “এটা ক্যান্সার”।

তনু;; ভাইয়া প্লিজ এভাবে বলবেন না। মেহরাম প্রেগন্যান্ট (চোখের জল গুলো মুছে)

সোহেল;; জানো তো তনু খুব ইচ্ছে ছিলো যে নিজের নবজাতক বাচ্চা টাকে কোলে নিবো। এটাও জানি যে মৃত্যু একদিন না একদিন সবারই হবে কিন্তু আমার মৃত্যু যে এতো জলদি ঘনিয়ে আসবে বুঝি নি।

তনু;; ভাইয়া কিছুই হবে না আপনার। অযথা এগুলো বলবেন না। আপনি আপনার বাচ্চার মুখও দেখতে পারবেন আর কোলেও নিবেন।

সোহেল;; যাজ্ঞে ছাড়ো তো এইসব কথা আর ভালো লাগে না। তুমি যে এসেছো মেহরাম কি দেখে নি নাকি। কিছু খেতে দেবে, বসে গল্প করবে। মেহরাম কোথায়?

মেহরাম;; আছি আমি।

সোহেল;; ওহহ এসেছো। দেখো না তনু শুধু শুধু মন খারাপ করছে।

মেহরাম;; ও এসেছেই আপনাকে দেখতে।

তনু;; ভাইয়া এতো বড়ো কথা টা আপনি লুকাতে কেন বলেছেন? আপনি জানেন সবাই জানলে কি হবে? তাদের ওপর কি ঝড় বয়ে যাবে?!

সোহেল;; কিন্তু…

মেহরাম;; বলে দিস সবাইকে।

মেহরাম এই কথা বলেই এক গাদা মেডিসিন নিয়ে সোহেলের পাশে বসে পরে তাকে খাইয়ে দিতে থাকে। মাঝে মাঝে মেহরামের সাথে টুকটাক কথা বলছে সোহেল। তনু এবার বুঝতে পারলো যে মেহরাম কেন এতো চুপচাপ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি তাকে এমন বানিয়ে দিয়েছে। কোথায় ছিলো ভার্সিটি লাইফের মেহরাম আর এখন হাহ্ চেনায় যায় না। তনুর বিয়ের আগ পর্যন্তও সব ঠিক ছিলো। তনু বসে এই সব কিছুই ভাবছিলো। হঠাৎ মেহরাম বলে ওঠে…

মেহরাম;; তোর বাসায় সবাই কেমন আছে?

তনু;; ভালোই। আমি কাউকে কিছুই বলে আসিনি শুধু জলদি বাড়ি থেকে বের হয়ে পরেছি। জানি না এই বেপার টা আমি বাসায় কি করে কিভাবে জানাবো। আর বড়োমা, মা, বাবা ওদেরই বা আমি কিভাবে বলবো। বড়ো মা ঠিক থাকতে পারবে না এটা শোনার পর।

সোহেল;; সত্য মেনে নিতেই হবে উপায় নেই।

তনু আরো বেশ কিছুক্ষন সেখানে বসে সোহেলের সাথে কথা বললো। অবশেষে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে এসে পরে। তনু কুসুম বেগমের পাশে বসে তাকে অনেক বুঝায় অনেক কথা বার্তা বলে এসে পরে। এখন মেহরাম আর তনু বাড়ির দরজাতে দাঁড়িয়ে আছে।

তনু;; ভাইয়ার এমন কেন হলো বল তো!

মেহরাম;; আহা তনু কাদিস না।

তনু;; বড়োমা পাগল হয়ে যাবে রে এটা শোনার পর।

মেহরাম;; মাকে একটু বুঝিয়ে বলিস। আমি বলি নি কারণ মায়ের সামনে আমার মুখ থেকে বের হবে না কিছুই।

তনু;; আমি তো নিজেই ঠিক থাকতে পারছি না (কেদে)

মেহরাম;; তনু..

মেহরাম তনু কে জড়িয়ে ধরে। তনু তো এবার শব্দ করেই কেদে দিয়েছে। মেহরাম তনু কে বুঝি শুনিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তনু একদম ফ্যাকাশে একটা চেহারা নিয়ে বাড়ি প্রবেশ করে। তনু কে ফিরতে দেখেই কণা-লায়লা খাতুন একদম আকড়ে ধরে। তনু অবশেষে বলে সোহেলের ক্যান্সার। সবাই যেন এক প্রকার ঝটকা খায়। তনু কাদতে কাদতে শেষ কণা কোন রকমে সামলাচ্ছে। লায়লা বেগমও প্রায় কাদো কাদো একটা ভাব। কারণ নিজেরও তো একটা ছেলে রয়েছে। তনুর তো প্রথমে সাহসই হলো না যে বাড়িতে কি করে জানাবে। খুব কষ্টে তনু বাড়িতে ফোন দেয়। বাড়িতে ফোন দিতেই তনুর বাবা ফোন ধরে…

বিল্লাল;; হ্যালো..

তনু;; হ্যালো বাবা।

বিল্লাল;; হ্যাঁ রে তনু মা কেমন আছিস?

তনু;; ভালো বাবা। বাবা কিছু কথা ছিলো।

বিল্লাল;; হ্যাঁ বল না।

তনু;; শুধু তোমার সাথেই না সবার সাথেই।

বিল্লাল;; মা হয়েছে কি সব ঠিক আছে তো। মেহরাম তো শশুড় বাড়ি। ও ঠিক আছে তো??

তনু;; কিছুই ঠিই নেই বাবা, কিছুই না।

বিল্লাল;; তনু মা কাদছিস কেন, কি হয়েছে?

বিল্লালের আওয়াজ শুনে বাড়ির সবাই একে একে ছুটে এলো।

আতিয়া;; আরে হয়েছে কি এমন করছো কেন?

কনিকা;; ভাইজান কি হয়েছে?

বিল্লাল কিছু না বলে ফোন সোজা মেহরামের মা কনিকার হাতে দিয়ে দেয়। বিল্লাল মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে।

কনিকা;; তনু মা কাদছিস কেন?

তনু;; বড়োমা সোহেল,, সোহেল ভাইয়ের ক্যান্সার হয়েছে। লাস্ট স্টেজে আছে। এটা মেহরাম আর সোহেল ভাই আগে থেকেই জানতো কিন্তু কাউকে কিছুই বলে নি।

তনুর বলা শেষ হতেই কনিকার হাত থেকে ফোন টা ঠাস করে নিচে পরে যায়। তিনি পরে যেতে ধরলে আতিয়া দ্রুত তাকে ধরে সোফায় বসিয়ে দেয়। একে একে সবাই জানতে পারে বিষয় টা। সবার মাথার ওপরে যেন বাজ ভেংগে পড়েছে। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না। সারা বাড়িতে এক দুঃখের কালো ছায়া ছেয়ে গেছে। কারো মনেই নেই কোন শান্তি। কেমন এক মরা মরা ভাব। এমনও হয়েছে যে কাদতে কাদতে চোখের পানিই এক সময় বলে দিয়েছে যে “” থাক না চোখের কার্নিশ গুলো–গাল গুলো একটুখানি শুষ্ক””। পরেরদিনই মেহরামের বাবা মা চাচি আর চাচ্চু আসে দেখা করতে। তার দিদুন কে আনা হয় নি। উনি সামলাতে পারবেন না তাই। মেহরাম সোজা বলে দিয়েছে যে সোহেলের কাছে যেন কেউ না কাদে। কেননা উনার মন এমনিতেই খারাপ মেহরাম চায়না যে আরো বেশি খারাপ হোক। এদিকে কুসুম বেগম কে সামলানো দায় হয়ে পরেছে। ছেলেকে হারানোর আহাজারি তার মধ্যে আছেই। তারা এসেছে বলে সোহেল একপ্রকার মেহরামের সাথে জিদ ধরেই নিচে চলে গিয়েছে। সোহেল বসে আছে আর তারা সবাই কথা বলছে। কুসুম বেগম ছেলে কে ছেড়ে এক মিনিটের জন্যও দূরে যাচ্ছেন না। মেহরামের মা এবার খেয়াল করলো মেহরাম কাজ করছে। অন্যান্য দিকে তার খেয়াল নেই। আপন মনে কাজ করে যাচ্ছে। মুখে নেয় কোন হাবভাব। দেখে মনে হচ্ছে যে ভাগ্য কে সে মেনে নিয়েছে। এগুলোই যেন তার জীবনের প্রাপ্তি ছিলো। জীবনের কাছে কোন অভিযোগ নেই তার, নেই কোন নালিশ। যেভাবেই হোক যেমনই হোক মেনে নিয়েছে, রাজি সে। মেহরাম পরিবেশ রক্ষার্থে সকলের সামনে চা দিলো। দিয়েই সে আবার কাজে মনোযোগ দিলো। তবে এবার মেহরামের মা কনিকা উঠে গিয়ে মেহরামের সামনে গিয়ে দাড়ালো।

মেহরাম;; আরে আম্মু, কিছু বলবে?

কনিকা;; আমার মেয়ে (মেহরামের মাথায়-মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে)

কনিকা মেহরামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তার কপালে চুমু খায়। হাত টা মাথা থেকে নামিয়ে মেহরামের পেটের ওপরে রাখে। সেদিকে তাকিয়ে কনিকা মুচকি হাসে। মেহরাম তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে। কিন্তু হুট করেই মেহরাম বলে ওঠে…

মেহরাম;; আমিও তো এভাবেই তোমার পেটে ছিলাম তাই না মা!

মেহরাম তার মায়ের দিকে তাকিয়ে কথা টা বললো। কনিকা এখনো মেহরামের পেটে হাত রেখে তাকিয়ে আছে। মুখে ঝুলছে মুচকি হাসি।

কনিকা;; হ্যাঁ, যখন তুই ছিলি সবাই ভেবেছিলো হয়তো দুটো বাচ্চা যমজ। এতো টাই বড়ো ছিলো পেট। কিন্তু অবশেষে হলি তুই। (মেহরামের দিকে তাকিয়ে)

মেহরাম তার মায়ের কথাতে এবার হেসেই দেয়।

মেহরাম;; এভাবে বলো, শুনো তুমি খুব লাকি বুঝলে যে আমার মতো মা পাগল একটা মেয়ে পেয়েছো!

কনিকা;; এহহ আসছে রে মা পাগল।

মেহরাম;; মা..

মেহরাম এবার এগিয়ে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। কনিকাও তাই। তিনি বেশ বুঝতে পারলেন যে তার মেয়ে কাদছে। মেহরামের দূর্বলতা হচ্ছে একমাত্র তার মা। মেহরামের বাবার সাথে তার তেমন কোন মিল নেই। আসলে মেহরাম তার বাবাকে তেমন পছন্দই করে না। আর এর কারণ সে নিজেও জানে না। প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথাও বলে না। কিন্তু মেহরাম তার মা বলতে পাগল।

মেহরাম;; মা. .

কনিকা;; হুমম বল।

মেহরাম;; কিছু না ডাকতে ভালো লাগছে।

কনিকা;; পাগলি একটা।

মেহরাম;; মা শুনো না!

কনিকা;; হ্যাঁ বল শুনছি তো।

মেহরাম;; আমাকে, আমাকে ফফেলে কককখনো যযদি দূদূরে গিয়েছো তাতাহলে কিন্তু ভালো হবে ননা ববলে দিচ্ছি। (কান্না কোন রকমে আটকিয়ে)

কনিকা;; যদি আমার দিন শেষ হয়ে যায়। আমার আয়ু আল্লাহ তোকে দান করুক। (মহরামের গালে হাত দিয়ে)

মেহরাম;; কবরে তোমায় নামানোর আগে আমাকে নামাতে হবে।

কনিকা;; নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখিস মা।

মেহরাম;; রাখি তো। আচ্ছা চলো।

মেহরাম তার মাকে নিয়ে গিয়ে সবার মাঝে বসে পরলো। মেহরামের চাচি চাচ্চু বাবা প্রায় সবারই কাদার মতো অবস্থা। কুসুম বেগমের শরীর ইদানীং খারাপের দিকে যাচ্ছে ছেলের চিন্তায়। তারা সবাই এক বিকেল থেকে কুসুম বেগম কে কোন রকম আস্থা দিয়ে চলে যায়।


তনু সারাঘরে পায়চারি করছে। যতোই হোক মেহরাম যেমন তনুকে ভালোবাসে তনুও ঠিক তেমনই। দুইজন একে ওপরের কলিজা। কিন্তু এদিকে তো তনুর মনে শান্তি নেই। সকাল বেলা মেহরামের বাসা থেকে এসে পরার পর কমপক্ষে ১৬ বার ফোন দিয়ে মেহরামের সাথে কথা বলেছে। কিন্তু এখনো যেন তনুর ভালো ঠেকছে না। সে আয়ুশকে ফোন দেয় প্রথমবার বেজে কেটে যায় কিন্তু পরেরবার দেবার সাথে সাথে রিসিভ হয়।

তনু;; আয়ুশ।

আয়ুশ;; হ্যাঁ মানে ফোন কেবিনে ছিলো আর আমি বাইরে বুঝি নি।

তনু;; তা বেপার না। আয়ুশ..

আয়ুশ;; কি হয়েছে তনু গলার আওয়াজ এমন কেন। সবকিছু ঠিক আছে তো?

তনু;; না। আয়ুশ, আয়ুশ সোহেল ভাইয়ের ক্যান্সার।

আয়ুশ;; What?!

তনু;; হ্যাঁ,

আয়ুশ;; কি বলছো এইসব। মাথা ঠিক আছে?

তনু;; আয়ুশ আমি সিরিয়াস। আজ সকালে আমি মেহরামের বাসায় গিয়েছিলাম। ভাইয়ার অবস্থা খুব বেশি ক্রিটিকাল। বাড়ির সবাই জানে। মেহরাম আর ভাইয়া প্রায় অনেকদিন আগেই জেনেছে কিন্তু কেউই এই খবর টা শোনার পর ঠিক থাকতে পারবে না তাই তারা কাউকে কিছুই বলে নি।

আয়ুশ;; মানে কি এইসবের, কি থেকে কি হলো। আচ্ছা এখন কেমন আছেন?

তনু;; বেশি একটা ভালো না। খালামনি তো কাদতে কাদতে শেষ।

আয়ুশ;; মেহরাম কেমন আছে?

তনু;; মেহরাম। তার কথা আর বলোই না। বোন টা আমার মরে গেছে পুরো। কোন সাড়াশব্দ নেই, কিচ্ছুনেই। আয়ুশ মেহরাম প্রেগন্যান্ট, এই অবস্থায় নিজের হাসবেন্ডের এমন খবর শোনার পর কেউই ঠিক থাকতে পারবে না।

আয়ুশ;; হুমম।

তনু;; আয়ুশ চলো আমরা আগামীকালই যাবো সেখানে।

আয়ুশ;; আমাকে কাল আউট অফ ঢাকা যেতে হবে আমরা বরং আগামী পরশু যাই কেমন।

তনু;; আচ্ছা। তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো।

আয়ুশ;; হুমম।


পরেরদিন সকালে~~

মেহরাম;; আস্তে ধীরে উঠুন।

সোহেল;; সমস্যা নেই আমি উঠতে পারবো।

মেহরাম সোহেল কে ধরে ধরে উঠায়। মূলত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে চেকাপের জন্য। সোহেল নিজেই রেডি হয়ে নিলো। মেহরাম খুব সাবধানে তাকে ধরে ধরে নিচে নামিয়ে আনে। বাড়ির বাইরে বের হতেই ড্রাইভার গাড়ি বের করে। কুসুম বেগম কেদে কেদে বলছে মেহরামকে তাকেও যেন সাথে নিয়ে যায়। কিন্তু মেহরাম অনেক ভালো করে বুঝিয়ে তাকে বাড়িতেই রেখে যায়। কেননা একে তো অসুস্থ মানুষ তাকে এভাবে হস্পিটালে নেওয়া ঠিক হবে না।

মেহরাম;; মা তুমি একদম চুপ করে বসে থাকবে। বেশি হাটা হাটি করবে না মাথা ঘুড়িয়ে যাবে নয়তো। আর প্লিজ কেদো না তো। একটু চুপ করো। আর এই নিলা..

নিলা;; জ্বি আপা!

মেহরাম;; মাকে এক সেকেন্ডের জন্যও একা ছাড়বি না। সবসময় পাশে থাকবি।

নিলা;; আচ্ছা।

মেহরাম;; আর দরজা আটকিয়ে রাখ, অপরিচিত কেউ আসলে একদম খুলবি না।

নিলা;; আচ্ছা আপা, আপনে ভাই রে নিয়া যান চিন্তা কইরেন না। আমি আছি।

মেহরাম;; হ্যাঁ মা আমি যাই।

মেহরাম সোহেল কে নিয়ে গাড়িতে উঠে হস্পিটালের উদ্দেশ্যে চলে যায়। বেশ সময় পর এসেও পরে। ডাক্তারের কাছ থেকে স্পেশাল এপোয়েন্টমেন্ট নেওয়া ছিলো তাই তাদের যাওয়ার সাথে সাথে একজন নার্স এসে তাদের একটা কেবিনে নিয়ে যায়। ডাক্টার সোহেল কে দেখেই কিছু কুশল বিনিময় করেন। তারপর চেকাপ শুরু করে দেন। প্রায় এক ঘন্টার কাছাকাছি হয় ডাক্তার সোহেল কে দেখছে। টেস্ট দিয়ে একদম ভরে ফেলেছে। ডাক্তার নিজেই সেগুলো করিয়ে নেন। সোহেল হস্পিটালের জামা পরে বেডে বসে আছে। আর ডাক্তার তার পাশে বসে লিখালিখি করছে। কয়েক মিনিট পরেই সোহেলের নতুন রিপোর্ট আসবে। শরীরের সিচুয়েশন কতোটা ঠিক হয়েছে বা কতো টা অবনতি হয়েছে সব ক্লিয়ারলি বুঝা যাবে। মেহরামও সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তখনই মেহরামের ফোনে ফোন আসে। মেহরাম একটু বাইরে যায় কথা বলার জন্য।

.

সোহেল;; ডক্টর রিপোর্ট!

ডাক্তার;; এসেছে (রিপোর্ট দেখতে দেখতে)

সোহেল;; কি এসেছে রিপোর্টে ?

সোহেলের কথায় ডাক্তার শূন্য দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। সোহেল হয়তো ডাক্তারের এমন চাহনির মানে বুঝে গেছে। তাই সে শুকনো কিছু ঢোক গিলে তারপর বলে ওঠে…

সোহেল;; ডক্টর আর কতো দিন সময় আছে আমার কাছে?

ডাক্তার;; ________________

সোহেল;; ১ মাস বাকি নাকি তার থেকেও কম?!

ডাক্তার;; আর ১ মাস ৩ দিন বাকি আছে।

সোহেল;; জ্বি সে তো আমার ভাগ্য (মুচকি হেসে)

তখনই হঠাৎ মেহরাম ডাক্তারের কেবিনে ঢুকে। মেহরামকে দেখে সোহেল মুচকি হাসে। মেহরাম তাকিয়ে দেখে ডাক্তারের হাতে রিপোর্ট গুলো বাতাসে উড়ছে। তার মনের ভেতরে ধুকপুকানি ক্রমশ বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে কেউ শক্ত কোন বস্তু দ্বারা খুব জোরে জোরে পিটাচ্ছে। মেহরাম সোহেলের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়।





🥀চলবে~~

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ১৫

🍂
.
.
.
.

মেহরাম সোহেলের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। মেহরামের যেতেই সোহেল কিছুটা তাড়া দিয়ে রিপোর্ট গুলো লুকানোর চেষ্টা করে। আর সোহেল এমন একটা ভাব ধরে যেন কিছুই হয় নি। মেহরাম অবাক হয়ে ডাক্তারের দিকে তাকায়। তখন সোহেল বলে ওঠে…

সোহেল;; আব..মেহরাম এসেছো কোথায় গিয়েছিলে?

মেহরাম;; এইতো একটু বাইরেই আর কি। রিপোর্ট এসেছে?

সোহেল;; হ্যাঁ হ্যাঁ এসেছে তো। আগে থেকে একটু রিকভার করেছি আমি। তোমায় বলেছিলাম না যে আস্তে আস্তে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে একদম।

মেহরাম;; ______________

সোহেল;; মেহরাম, তুমি খুশি নও?

মেহরাম;; রিপোর্ট গুলো কোথায়?

সোহেল;; ওগুলো রয়েছে তুমি পরে দেখো তো আগে এখানে কিছুক্ষণ বোস।

মেহরাম;; হুমম।

ডাক্তার;; মিসেস মেহরাম.

মেহরাম;; জ্বি

ডাক্তার;; হয়তো মিস্টার সোহেল কে কিছুদিন পর হস্পিটালে এডমিট করতে হবে।

ডাক্তারের কথা শুনে মেহরাম কিছুটা ভ্রু কুচকায়।

মেহরাম;; কেন?

সোহেল;; কারণ এখানে থাকলে আমার কেয়ার বেশি করা হবে তাই।

মেহরাম;; মানে কি?

সোহেল;; কিছু না, মানে ডাক্তার যা বলছে তাই শুনবো শেষ।

মেহরাম;; জ্বি আচ্ছা।

এই বলেই ডাক্তার বের হয়ে পরে। মেহরাম কতোক্ষণ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সোহেলের দিকে। সোহেলের যেন কোন হেলদুল নেই সে তার মন মতো কথাই বলে চলেছে।

সোহেল;; মেহরাম।

মেহরাম;; __________

সোহেল;; মেহরাম..

মেহরাম;; হ্যাঁ জ্বি ববলুন।

সোহেল;; বাসায় নিয়ে যাবে না আমায় (হেসে)

মেহরাম;; হ্যাঁ যাবো তো, চলুন।

মেহরাম উঠে সোহেলের হেল্প করে দিতে থাকলো। তারপর আস্তে ধীরে উঠে সোহেলের এক হাত মেহরামের কাধের ওপর রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তখনই দুজন ওয়ার্ডবয় আসে তারা এসে মেহরামের সাহায্য করে। সোহেল কে ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। মেহরাম হস্পিটাল থেকে বের হয়ে এসে পরবে তখন একজন নার্স মেহরামের সাথে কি যেন কথা বলতে থাকে। আর সোহেল গাড়ি থেকে জানালা দিয়ে বাইরে মেহরাম কে দেখছে। সোহেল তার আরেক ব্যাগের দিকে তাকিয়ে দেখে রিপোর্ট গুলো। সে লুকিয়ে ফেলে। এবার সোহেল গাড়ির উইন্ড-এর দিকে আরেকটু লেগে বসে। বাইরে তাকিয়ে মেহরাম কে দেখছে। নার্স টার সাথে হয়তো মেহরামের আগে থেকেই পরিচয় ছিলো তাই একটু হেসেই কথা বলছে। সোহেল লক্ষ্য করে দেখলো যে যেই মেহরামকে বিয়ে করে সে নিজের ঘরের বউ করে এনেছিলো তা আর এখন নেই। মেহরাম এবার সোজা হেটে চলে আসে। সূর্যের প্রখর রোদ মেহরামের মুখের ওপর আছড়ে পরলে বাম হাত তুলে মুখের ওপর রোদ আসাকে আটকে দেয়। তারপর এসে গাড়ির পেছন সীটে সোহেলের পাশে বসে পরে। মেহরাম আসতেই সোহেল কিছুক্ষণ তার দিকে তাকয়ে থাকে। মেহরাম তার ব্যাগের ভেতরে কি যেন চেক করে এবার ভালোভাবে বসে। সোহেল তার হাত টা মেহরামের হাতের ওপর রাখে। মেহরাম সোহেলের দিক তাকালে সে মুচকি হাসে। মেহরাম এক বড়ো দম ছাড়ে।

সোহেল;; মেহরাম

মেহরাম;; জ্বি

সোহেল;; ধন্যবাদ

মেহরাম;; কেন?

সোহেল;; আমার জীবনে আসার জন্য। হয়তো তোমার সাথে আমার জীবনের সময়সীমা কম ছিলো কিন্তু আমি লাকি তোমায় ক্ষনিকের জন্য পেয়েও। ধন্যবাদ।

মেহরাম;; হুমম (মুচকি হেসে)

মেহরাম আর সোহেল বাড়ি এসে পরে। ড্রাইভার তাদের সাহায্য করেন। বাড়ি এসেই কুসুম বেগম আস্তে করে নিজের ছেলেকে ধরেন তারপর সোফায় বসিয়ে দেন।

কুসুম;; মেহরাম ডাক্তার কি বললো?

মেহরাম;; বলেছেন কিছুদিন পর হস্পিটালে এডমিট করাতে হবে।

কুসুম;; কেন বাসায় থাকলে কি সমস্যা?

মেহরাম;; মা বাসায় হস্পিটালের সব Possibilities নেই। আর এখানে যদি কিছু সমস্যা হয় তখন দ্রুত হস্পিটালাইস করাতেও প্রব্লেম হবে বুঝলে। তাই ডাক্তার হস্পিটালে এডমিট করাতে বলেছেন।

কুসুম;; ওহহ আচ্ছা। সোহেল বাবা এখন কেমন লাগছে?

সোহেল;; আমি ভালো আছি মা।

সেইদিন এভাবেই কেটে যায়। মেহরাম সোহেল কে ঘরে এনে শুইয়ে দেয়। খাইয়ে দেয় তারপর সোহেল ঘুম। এর মধ্যে দুবার মুখ-নাক দিয়ে রক্ত পরেছে। মেহরাম সামলে নিয়েছে। রাতের বেলা মেহরাম টেবিলে বসে লিখালিখি করছিলো। তখন সোহেল ঘুম থেকে ওঠে পরে।

সোহেল;; কি লিখছো?

মেহরাম;; উঠে পরেছেন?

সোহেল;; হুমম, আচ্ছা কি লিখছো?

মেহরাম;; তেমন কিছুই না। আসলে একা থাকলে আমার লিখালিখির অভ্যাস আছে তাই আর কি।

সোহেল;; তোমার হাতের লিখা গুলো অনেক সুন্দর জানো!

মেহরাম;; মোটেও না, এই হাতের লিখার জন্য স্যারদের কাছে কতোই না বকা শুনেছি।

সোহেল;; আমার থেকে হ্যান্ড রাইটিং তোমার অনেক ভালো দেখেছি আমি। আমার লিখা তো এক প্রকার কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং।

মেহরাম;; (মেহরাম হেসে দেয়) না সুন্দর।

সোহেল;; গল্প পরতে ভালোবাসো?

মেহরাম;; বাসতাম।

সোহেল;; আর এখন?

মেহরাম;; পড়াই হয় না। যাই হোক এই সব কথা ছাড়ুন। খিদে পেয়েছে?

সোহেল;; না। মেহরাম অনেক দিন তোমার হাতের চা খাওয়া হয় না খাওয়াবে।?

মেহরাম;; এমা এটা কেমন কথা, আমি এক্ষুনি আনছি।

মেহরাম উঠে টেবিল টা কোন রকমে গুছিয়ে নিচে চলে যায়। চায়ের পানি গরম দিয়ে কিছুক্ষণ হাটে। পানি গরম হয়ে গেলে তাতে বেশি করে আদা-লং এগুলো দিয়ে কড়া চা বানিয়ে নিয়ে যায় রুমে। রুমে যাবার আগে কুসুম বেগমের ঘরে একবার দেখে যায়। নাহ, ঠিকই আছে তিনি গভীর ঘুম। মেহরাম চলে যায় রুমে।

মেহরাম;; এই নিন আপনার গরম গরম চা।

সোহেল;; চিনি..

মেহরাম;; এক চামচ আমি জানি।

সোহেল;; মনে আছে।

মেহরাম;; খান।

মেহরাম চেয়ারে বসে পরে। সোহেলের খাওয়া শেষ হলে সেগুলো আবার নিচে রেখে আসে। রুমে মেহরাম আর সোহেল দুজনেই বসে আছে একদম চুপ। কারো মাঝে কোন কথা নেই। সোহেল খেয়াল করে দেখে মেহরাম তার হাত বারবার চোখে দিচ্ছে। সোহেল কিছুটা কপাল কুচকে তার দিকে তাকায়।

সোহেল;; মেহরাম

মেহরাম;; ১ মাস ৩ দিন তাই না!! (কেদে)

সোহেল;; মেহরাম! তুমি…

মেহরাম;; আমি জানি। রিপোর্ট গুলো লুকিয়ে লাভ নেই। আজ হস্পিটালে যখন ডাক্তার আপনাকে বলেছিলো যে আপনার কাছে আর ১ মাস ৩ দিন আছে আমি তখনই শুনেছিলাম। কেন লুকাচ্ছেন আমার কাছ থেকে।

সোহেল;; প্লিজ এভাবে কান্না করো না।

মেহরাম;; আপনি একবার ভেবেছেন এটার কথা মা জানলে সেখানেই……

সোহেল;; মেহরাম কান্না করো না শরীর খারাপ হয়ে যাবে আর তার ইফেক্ট পরবে বেবির ওপর প্লিজ কান্না করো না।

সোহেল এবার উঠে গিয়ে মেহরামের সামনে বসে। মেহরামের গালের পানি গুলো মুছে দেয়।

সোহেল;; কান্না থামাও।

মেহরাম;; ___________

সোহেল;; মেহরাম কান্না থামাতে বলছি।

মেহরাম;; ___________

সোহেল;; এই মেয়ে কান্না থামাও (ধমক দিয়ে)

সোহেলের এমন ধমকে মেহরাম কেপে ওঠে। ফট করে মাথা তুলে তাকায়। আসলে মেহরাম অবাক। কারণ এর আগে সোহেল তার সাথে জীবনেও এভাবে কথা বলে নি, ধমক দেওয়া তো দূরের কথা। মেহরাম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সোহেল এবার হেসে দেয়।

সোহেল;; আরে ভাই আর্মি তে ছিলাম কিছু তো রেস্পেক্ট দাও। তুমি যে বলতে না খিটখিটে-বদমেজাজী, খবিস টাইপের লোক হয়। আরে আমার মধ্যে সব টাইপের কোয়ালিটি-ই আছে। কিন্তু প্রকাশ-ই যা করি না। কারণ আমার ভালো লাগে না রুড বিহেভ।

মেহরাম;; তাই বলে ধমক দিবেন। সত্যি ভয় পাইছি।

সোহেল;; ভয় পাবার জন্যই তো দিয়েছি। কানবা না একদম না তাতে আমার যাই হোক যেমনই হোক কানবা না।

সোহেলের বারণ করা সত্বেও যেন মেহরামের এবার আরো বেশি কান্না পাচ্ছে। সোহেল মেহরামকে জড়িয়ে ধরে। এভাবেই সেদিন কেটে যায়।


আয়ুশ;; মেহরাম দের বাসায় নাকি যাবে?

তনু;; হ্যাঁ রেডি হয়ে নাও।

আয়ুশ;; আমি রেডি চলো।

তনু আর আয়ুশ সবাইকে বলে বের হয়ে পরে। খানিক সময় পর এসেও পরে। তনু কলিংবেল বাজাতেই কুসুম বেগম এসে দরজা খোলে দেয়। কুসুম বেগম কে দেখেই তনু দ্রুত জড়িয়ে ধরে। কুসুম বেগম কেদে দেন। তনু তার চোখের পানি মুছে দেয়। কুসুম বেগম নিজেও স্বাভাবিক হয়ে তাদের তাড়াতাড়ি ভেতরে এনে বসায়।আয়ুশের সাথেও কুসুম বেগম অনেক কথা বলে। কুসুম বেগমের কাছে আয়ুশ আর সোহেল যেন সমান। তাদের ভেতরে আসতেই মেহরাম নিচে নেমে যায়। আর নিচে নামার সাথে সাথেই আয়ুশের আর মেহরামের চোখাচোখি হয়ে যায়। মেহরাম চোখ নামিয়ে ফেলে।আয়ুশ সে প্রথমেই মেহরামের দিকে তাকায়। সে প্রেগন্যান্ট, আর আয়ুশ তাকে দেখার পর অন্য পাশে তাকায়। মেহরামের প্রেগন্যান্সির পর এই প্রথম আয়ুশ তাকে দেখলো। তনুর সাথে মেহরাম অনেক কথা বলে। এভাবে যেতে থাকে। সোহেল নিচে নেমে পরে। নিচে নামতেই সোহেল গিয়ে আগে আয়ুশের সাথে কথা বলে। আয়ুশও হাসি মুখে অনেক কথা বলে। এবার তনু মেহরাম আর কুসুম বেগম রান্নাঘরে চলে যায় তারা কথা বলছে। মেহরামের মতে আজকে তনুকে যেতে দিবে না। কিন্তু আয়ুশের কাজ আছে তাই তাকে যেতেই হবে। এখন করিডরে আয়ুশ আর সোহেল বসে গল্প করছে। তবে কেন যেন সোহেল এক মূহুর্তের জন্যও আয়ুশকে ছাড়ছে না। আর আয়ুশ সেই বেপার টা খেয়াল করেছে।

আয়ুশ;; সোহেল…

সোহেল;; আয়ুশ জানো একটা কাহিনি আছে।

আয়ুশ;; কিহ (কপাল কুচকে খানিক হেসে)

সোহেল;; আগের যুগে একটা গ্রামে একটা মেয়ে ছিলো। নাম ছিলো ‘বাহার’। সে এতো টাই সুন্দর ছিলো যা বলার বাইরে। তবে কি জানো মানুষ তার সৌন্দর্যে বিমহিত হতো না। বাহারের সাথে কিছুদিন থাকলে, কথা বললে বা বন্ধুত্ব করলে তার দিকে এক আলাদা মায়া অনুভব করতো। মানে সবাই বাহারের প্রেমে পরে গেতো। কিন্তু তার সৌন্দর্য দেখে না, আচার আচরণ, কথা বার্তা এই সব দেখে। যাকে বলে ভেতরের সৌন্দর্য আর কি। বাহারের মাঝে এমন কিছু ছিলো যা আর কারোর মাঝেই ছিলো না। সে ছিলোই এমন, না ভালোবেসে, না প্রেমে পরে কেউ থাকতেই পারতো না।

আয়ুশ;; হুমম।

সোহেল;; তবে মূল বেপার কি জানো। মূল কথা হচ্ছে এটা যে সেই বাহার প্রকৃতপক্ষে কাকে ভালোবাসতো সেটা। সবাই তো তাকে ভালোবাসতো কিন্তু আসলে বাহার কাকে চাইতো?

আয়ুশ;; তো এই যে বাহার আছে। তুমি এর কাহিনি আমায় কেন বলছো? (হেসে)

সোহেল;; কারণ এখানে বাহারের বাস্তব চরিত্র হচ্ছে ‘মেহরাম’।

সোহেলের কথা আয়ুশ কপাল কুচকে তার দিকে তাকায়।

আয়ুশ;; মানে কি?

সোহেল;; মেহরামকে অনেক ভালোবাসতে তাই না?

আয়ুশ;; সোহেল, তুমি..

সোহেল;; মেহরাম কে আমি একটা প্রমিস করেছিলাম যে যদি কখনো তার ভালোবাসা ফিরে আসে আমি নিজে তাকে হেল্প করব তার কাছে ফিরে যেতে। কিন্তু মেহরাম নিজে বলেছিলো আমায় যে তার সম্ভব নয়।আমি ধারণাও করিনি যে সেটা তুমি হবে। এখানে কারো কোন দোষ নেই। না তোমার না মেহরামের আর না ই তনুর। সে বেচারি তো কিছু জানেই না।

আয়ুশ;; সোহেল বাদ দাও ওসব কথা। আমি পায়নি ওকে।

সোহেল;; একদিন মেহরাম কাজ করছিলো, আসলে তার ভার্সিটিতে পরিক্ষা ছিলো আর বিয়ের পরও ফাইনাল এক্সাম পর্যন্ত মেহরাম তার স্টাডি চালিয়ে গিয়েছিলো। আমি বাসায় ছিলাম। মেহরাম তো তার এক্সামের জন্য তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু কিছু ফাইল নিতে গিয়ে হঠাৎ তার ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি নিচে পরে। আমি মেহরাম কে বললে সে আমায় বলে গুছিয়ে রাখতে। ডায়েরি টা হাতে নিলাম আমি। ওপরে সুন্দর করে লিখা ছিলো ‘মেহরাম’। আমি জানি যে কারো কিছু বিনা পারমিশনে ধরা ঠিক না কিন্তু কেন যেন সেদিন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। তুমি জানো পুরো কয়েক ঘন্টা লেগে গিয়েছিলো আমার ডায়েরি টা পরতে। হয়তো পুরো ডায়েরি টা হাজার বার পরলেও মেহরামের ভেতরের খবর কেউ জানবে না। মেহরাম কখনো তার বাবার আদর পায়নি। সে বুঝে না বাবার আদর কাকে বলে। তার মা তার কাছে সবার ওপরে। মেহরাম এটাও লিখেছিলো তাতে যে “সে ততোদিন অব্দি হজ্জ করতে যাবে না যতোদিন তার মা বেচে আছে”। নিজের পুরো লাইফের কাহিনি হয়তো লিখে দিয়েছে তাতে। সব লিখা ছিলো তাতে। অনেক কিছু লিখে রেখেছে মেহরাম। তোমার বেপারেও।

সোহেলের এই কথায় আয়ুশ মাথা ঘুড়িয়ে তার দিকে তাকায়।

সোহেল;; হ্যাঁ তোমার বেপারে। যেগুলো হয়তো কখনো তোমাকে বলতে পারে নি সেগুলো।

আয়ুশ;; সোহেল ভালোবাসা না করা যায় না, এটা কোন কাজ বা জিনিস না যে পছন্দ হলো করে নিলাম। এটা হয়ে যায়। যারা ভালোবাসি মুখ ফুটে বলে নিজের করে নিতে পারে হয়তো তাদের মতো লাকি আর দ্বিতীয় জন হয় না। আমি বুঝি মেহরামের অবস্থা টা। সে একদম মাঝ খানে পরে গিয়েছিলো না যেতে পারছিলো এইদিকে আর না যেতে পারছিলো ওইদিকে।

সোহেল;; এখনো ভালোবাসো মেহরাম কে?

আয়ুশ;; তুমি বলছো এই কথা?

সোহেল;; হ্যাঁ আমি বলছি। জনাব তুমি মেহরামের প্রেমিক হতে পারো তবে আমি, আমি ওর বেস্টফ্রেন্ড। সব খবর রাখি।

আয়ুশ আর সোহেল হেসে দেয়।

আয়ুশ;; কাশ ভুলতে পারতাম তাহলে আমার জীবন টাই সফল হয়ে গেতো। মৃত্যু ব্যাতীত সম্ভব না।

সোহেল;; বুঝি আমি।

আয়ুশ;; হিংসে হয় না?

সোহেল;; কার তোমার থেকে?!

আয়ুশ;; হ্যাঁ এইতো আমি যে এক সময় মেহরামের প্রাক্তন ছিলাম আর এখনো ভুলি নি?!

সোহেল;; মোটেও না। হিংসা তার ওপর করা যায় যে একজনের জিনিস আরেকজনের কাছ থেকে কেড়ে নেয়। আমি মেহরাম কে কাড়ি নি। সে আমার ভাগ্যে এসেছিলো। আরে হিংসা তো আমার ওপর তোমার করা উচিত। যে আমি মেহরামের সাথে আছি। কেননা মেহরামের জীবনে আমার আগে তুমি ছিলে। হিংসে হয়?

আয়ুশ;; না হিংসে না তবে হ্যাঁ কষ্ট ঠিকই হয়।

সোহেল;; হবারই কথা।

আয়ুশ;; এটা জরুরী না যে “যাকে তুমি ভালোবাসো তারও তোমাকেই ভালোবাসতে হবে”। একাও ভালোবাসা যায়, মেহরামকে ভালোবাসার জন্য আমার মেহরামেরই দরকার নেই।

সোহেল;; ডায়েরি টা মেহরাম খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছে। সে জানে না যে আমি সব জানি।

আয়ুশ;; খুব ভালোবাসো মেহরামকে তাইনা?

সোহেল;; হাহা, বললাম তো যে বাহার কে ভালোবাসতো সবাই কিন্তু মূল বেপার ছিলো এটা যে বাহার কাকে ভালোবাসতো।

আয়ুশ;; 😅😅।

তীব্র হাসিতে অতিমাত্রায় চাপা কষ্ট নিয়ে কথা বলা কাকে বলে তা জানার জন্য কারোর এখন আয়ুশ আর সোহেলকে দেখলেই হবে। একসময় আয়ুশ আর তনু সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে পরে। তনুর সাথে মেহরামের আগেই কথা হয়েছে। আয়ুশ আর তনু চলে গেলে সেখানে মেহরাম আসে না আর এটা আয়ুশ সোহেল দুজনেই লক্ষ্য করেছে। প্রায় রাত ৮ টার দিকে তারা তাদের বাসায় এসে পরে। সকল কাজ টাজ করে যে যার রুমে চলে যায়। আয়ুশ তনুর দিকে তাকিয়ে দেখে সে ঘুম। সেও শুয়ে শূন্য দৃষ্টিতে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সোহেলের বলা কথাগুলো যেন তার কানে বাজছে। এদিকে হুট করেই সোহেলের গা ভরে জ্বর আসে। মেহরাম তার পাশে বসে সোহেলের মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। আর সে নিজের আপন ভাবনায় মগ্ন।





🍁চলবে~~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে