এসো শব্দহীন পায়ে পর্ব ৮

0
976

এসো শব্দহীন পায়ে
পর্ব ৮
মিশু মনি
.
রাত বাড়ছে। সেইসাথে বাড়ছে তিতাসের অস্থিরতা। কি করতে এসে কি হয়ে গেলো। এই বাড়ি থেকে উদ্ধারের উপায় না পাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু রূপসার সাথে একবার কথা বলা খুবই দরকার। যেভাবে ঝড়ের তীব্রতা বাড়ছে তাতে আজ আর কোনোভাবেই রূপসার সাথে কথা বলা সম্ভব না। রাত্রিটা তবে নির্ঘুম ই কাটাতে হবে।
দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। এমন সময় ছোটমামার মেসেজের রিপ্লাই এলো। মামা লিখেছেন, ‘কায়েসের সাথে কোনোভাবে ওয়ামিয়ার সন্ধি করিয়ে দিতে পারবি? শুনেছি মেয়েটা প্রথমে কায়েসকেই পাত্র ভেবেছিল। পছন্দও হয়েছিলো। ওদের মাঝে একটা জট লাগিয়ে দিতে পারলে আপাতত এই বাড়ি থেকে ছাড়া পাবি। রূপসার সাথে পরেও কথা বলা যাবে।’

তিতাস লিখল, ‘কিন্তু মামা, ওর সাথে কথা না বললে তো আমি ঘুমাতেই পারবো না। যার জন্য এতদূর ছুটে আসা…’
– ‘ওহে বৎস, এত অস্থির হলে তো হবে না। ধৈর্য ধরতে হবে। টেনশন করিস না, আমি চিন্তা করছি।’

টেনশন করতে বারণ করলে যদি সত্যিই টেনশন না হতো, তাহলে তো কথাই ছিলো না। তিতাস উঠে এসে জানালা খুলে দিলো। বৃষ্টির ঝাঁপটা আসছে। চারিদিক অন্ধকার। থেকে থেকে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তখনই গাছপালা গুলো চোখে পড়ে। এমন আবহাওয়ায় কাথা মুড়িয়ে শুয়ে ঘুম দেয়াতেই যত আনন্দ। কিন্তু আজ আর ঘুম হবে বলে মনে হয় না।

হঠাৎ একটা বুদ্ধি এলো মাথায়। তিতাস ভালোভাবে পরিকল্পনা এঁটে ভদ্র হয়ে বসে রইলো। মন্তাজ মাস্টার ঘরে আসামাত্রই বললো, ‘চাচা আপনি যদি কিছু মনে না করেন আমি আপনার মেয়ের সাথে কিছু কথা বলতে চাই।’
উনি ইতস্তত করতে লাগলেন। এই অসময়ে মেয়ের সাথে কথা বলতে দেয়াটা ভালো ঠেকছে না। তবুও না করতেও পারছেন না। পাত্রটা হাতছাড়া হয়ে না যায় আবার। উনি ভেবে বললেন, ‘আচ্ছা বাবা। আমি ওকে পাঠাচ্ছি।’

কিছুক্ষণ পর ওয়ামিয়া ওর ছোটবোন সহ ঘরে প্রবেশ করলো। ছোট মেয়েটা ঠোঁট টিপে হাসছে। তিতাস ওয়ামিয়ার কাছাকাছি এসে বললো, ‘কথাগুলো শুধু আপনাকেই বলতে চাই।’

ছোট মেয়েটা এবার খিলখিল করে হাসলো। ওয়ামিয়া বললো, ‘ আপনি বলেন। ও কাউরে কিছু বলবে না।’

তিতাস কথাগুলো সাজিয়ে বলতে শুরু করলো, ‘দেখুন আমার বন্ধু কায়েসকে তো দেখেছেন। ও ছেলে হিসেবে ভীষণ চমৎকার। আর মানুষ হিসেবে অসাধারণ। আমার বন্ধু বলে বলছি না, ওকে ছোটবেলা থেকেই চিনি। অন্যের জন্য জান দিয়ে দেবার মত একটা মানুষ ও। আপনি ভুল বুঝবেন না। ও মেয়েদের সাথে খুব একটা কথা বলে না। কিন্তু আপনাকে প্রথম দেখেই ওর ভীষণ ভালো লেগে গেছে। আমিও অনেক ভেবে দেখলাম, আপনি সবদিক থেকে পারফেক্ট হলেও আমাদের জুটিটা হয়তো ভালো হবে না। প্লিজ খারাপভাবে নেবেন না। আপনি চাইলে কায়েসের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন। দুজনের বন্ধনটা খুব ভালো হবে। বিশ্বাস করুন, আপনাকে আমাদের পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আমরা দুজন দুজনের জন্য নই। কায়েসের কথাটা বলার জন্যই আমি এতদূর এসেছি।’

কথাগুলো বলে চুপ করলো তিতাস। বুকটা ঢিপঢিপ করছে। গ্রামের মানুষদের সম্পর্কে নানান কথা শুনেছে ও। অনেকে নাকি ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেয়। ওয়ামিয়ার প্রতিক্রিয়া না পেয়ে তিতাসের মনে ভয় জন্মাতে লাগল যে, আবার ওকেই ধরেবেঁধে বিয়ে দিয়ে না দেয়। মন্তাজ মাস্টার ওকে ভীষণ পছন্দ করেছেন। তিনিও চাইবেন না ছেলেটা এভাবে ফিরিয়ে দিক। হার্টবিট ক্রমশ বাড়ছিল, তখন ওয়ামিয়া বললো, ‘বিয়ে শাদির ব্যাপারটা আমি পুরোপুরি বাবা মায়ের উপর ছেড়ে দিছি। তারা যাকে পছন্দ করবেন, আমি তাকেই বিয়ে করবো।’
– ‘খুব ভালো। আপনি কায়েসের সাথে কথা বলে দেখুন না?’
– ‘এটা আমি পারবো না। বাবা জানতে পারলে কষ্ট পাবেন। জীবনেও ছেলেদের সাথে কথা বলিনাই। সম্পর্ক তো দূরের কথা। এই সময়ে এসে আর ঝামেলায় জড়াতে চাই না। আপনার বন্ধুকে বলবেন প্রস্তাব দিতে, আব্বায় রাজি হলে আমার আপত্তি নেই।’

তিতাসের কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়লো। খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ঝাঁপটা এসে টেবিল ভিজে যাচ্ছে। ওয়ামিয়া ছুটে গিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলো। তৎক্ষনাৎ তিতাসের মনে হলো, রূপসার বাড়ির সেই জানালায় গিয়ে একবার ওকে ডাকলে কেমন হয়? তিতাস ও বাড়িতে যে কয়েকবার গেছে রূপসাকে ওই ঘরেই দেখেছে। কিন্তু ডাকতে গেলে আবার বাড়ির লোকজন ডেকে আরেকটা বিপদ ডেকে আনে কি না সেটাও ভাব্বার বিষয়। পরে সম্মানের সাথে সাথে রূপসাকেও হারাতে হবে।

ওয়ামিয়া জানতে চাইলো ,’আরো কিছু বলতে চান?’
– ‘না।’
– ‘আমি আসি।’

ধীরপায়ে এলেও দ্রুত পদক্ষেপে চলে গেলো ওয়ামিয়া। তিতাসের ভয়ভয় লাগছে। এরপর কি হবে কে জানে! এমন দিনেই ঝড় বাদল শুরু হতে হলো। ওয়ামিয়া ওর বাবাকে এসব বলে দিলে তিনি এসে খাতির যত্নের পরিবর্তে আবার চলে যেতে বলেন কি না। বিভিন্ন চিন্তায় তিতাসের মাথা এলোমেলো হতে শুরু করেছে।

ছোটমামাকে ফোন দিয়ে মৃদুস্বরে সব কথা খুলে বললো তিতাস। মামা বললেন, ‘তুই মন্তাজ মাস্টারকেই প্রস্তাবটা দে। দ্যাখ উনি কি বলে। এটা না বললে পরবর্তীতে আরো ঝামেলা হবে।’
– ‘কিন্তু মামা কায়েস তো এসবের কিছুই জানে না। যদি উনি রাজি হয়ে যান তখন কায়েসের কি হবে? ও তো বিয়েতে রাজি হবে না।’
– ‘আরে ব্যাটা তুই বলেই দ্যাখ না। আগে ওই বাড়ি থেকে কোনোক্রমে বেড়িয়ে আয়। পরে কি হয় দেখা যাবে।’
– ‘মামা বিপদ হলে কিন্তু তুমি দায়ী।’
– ‘হ আমি দায়ী। এখন তোকে যা বললাম তাই কর।’

তিতাস চিন্তায় পড়ে গেছে। নিজে বাঁচতে গিয়ে বন্ধুকে ফাঁসিয়ে দিতে ওর খারাপই লাগছে। কিন্তু এ ছাড়া তো উপায়ও নেই। এই অবস্থায় রূপসার কথা বললে মন্তাজ মাস্টার কষ্ট পাবেন। ওয়ামিয়াকে পছন্দ হয়নি এটাও বলা যাবে না।

মন্তাজ সাহেব তিতাসকে পায়চারি করতে দেখে উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা কোনো সমস্যা হয়েছে?’
তিতাস চমকে উঠে বলল, ‘না না চাচা। আপনার সাথে একটা জরুরি বিষয়ে কথা বলতে চাই। আপনি যদি কষ্ট না পান।’
– ‘বলেন।’
– ‘আপনি আমার পাশে এসে বসুন।’

মন্তাজ মাস্টার কৌতুহলী চোখে তিতাসের পাশে এসে বসলেন। দুজনেরই এই মুহুর্তে বুক ঢিপঢিপ করছে। তিতাস ঢোক গিলে বলতে আরম্ভ করলো, ‘চাচা, আসলে আপনি যা ভাবছেন সেটা সত্যি নয়।’
– ‘কোনটা?’
– ‘আমি আসলেই আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই না।’

মন্তাজ সাহেব মাথা নিচু করে কি যেন ভাবছেন। কোনো জবাব দিলেন না। তিতাস দ্রুত ভাবছে কায়েসের কথাটা বলবে কি না। ভাবতে ভাবতে বলেই ফেললো, ‘আমার বন্ধু কায়েসের ওয়ামিয়াকে খুব পছন্দ হয়েছে। আমি সেটা বলতেই এসেছিলাম। যাতে আপনারা আমাদেরকে ভুল না বোঝেন।’

মন্তাজ মাস্টার নিশ্চুপ হয়ে রইলেন। এই কথাটা ঘটকের মাধ্যমে বললেও তো হতো- কথাটা মুখে এসেও আটকে গেলো। উনি নিজেকে সংযত করে নিলেন। তবে তিতাসের প্রতি স্নেহ বড়ই বেড়ে গিয়েছিল, মনে মনে জামাই হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন উনি। তার মুখে এমন কথা শুনে কিঞ্চিৎ কষ্ট পেয়েছেন সত্যি।

তিতাস বললো, ‘চাচা আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনি চাইলে কায়েসের সাথে…’

তিতাস চুপ করে রইলো। মন্তাজ মাস্টার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘গরম ভাতের সাথে হাঁসের মাংস রান্না হয়েছে। আপনি পাশের ঘরে খাইতে আসেন।’


রূপসা ভাতের থালায় বারবার দলা পাকাচ্ছে। খাবার মুখে তুলে আবার নামিয়ে রাখছে। একদমই খেতে ইচ্ছে করছে না। মনের ভেতর সেই সন্ধ্যার মোহময়ী দৃশ্যটা ঘুরপাক খাচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি, একই ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে তিতাস ও রূপসা। আবছা অন্ধকারে ওর মুখ অস্পষ্ট লাগছিল। তারই মাঝে কেমন করে তাকিয়েছিলো ছেলেটা! ওর চাহনীতে কি যেন মিশে ছিলো। বুকের ভেতর ছিড়ে খানখান হয়ে যাচ্ছিল রূপসার। পায়ের নিচে মাটি নেই এমন মনে হচ্ছিল। কি যে আবেগ, কি যে অসীম যন্ত্রণা কাজ করছিল তখন। সেইদিনের পর থেকে রূপসা চেতনে, অবচেতনে সবসময়ই চাইতো তিতাস একবার আসুক। কেন আসবে সেটা না ভাবলেও তার আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলো ও। এখন সেটা সত্যি হওয়াতে ঘোর ঘোর লাগছে। মানুষটা এলো সত্যিই, কিন্তু সব কথা শোনা হলো না। কি যেন বলার জন্য এতদূর হতে, এত কষ্ট করে এই ঝড়ের মধ্যে ছুটে এসেছে, সেই অমোঘ সত্যটা শোনা হলো না। তাই তো এখন অস্থির না লেগে উপায় নেই।

মা ধমক দিলেন, ‘কি রে তুই ভাত খাইতাছোস না ক্যান?’
রূপসা চমকে উঠে বলল, ‘খাইতে ইচ্ছে করতেছে না মা।’
– ‘না ইচ্ছা করলে খাইস না। বড় হইলে তামাশা শুরু হয়। কত রকমের কেচ্ছা কাহিনি দেখবো যে আল্লাহ ই জানে!’

রূপসা হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়াল। এখানে বসে থাকলে মায়ের বকুনি শুনতে হবে। বারান্দার মেঝেতে বসে সবাই মিলে খাবার খাচ্ছিল। উঠে যাওয়ার সময় দূর্ঘটনা বশত রূপসার পায়ের সাথে লেগে ডালের বাটিটা কাৎ হয়ে পড়ে গেলো। ডাল গড়িয়ে ঢুকে গেলো শীতলপাটির নিচে। ব্যস, আজ আর রক্ষে নেই। রূপসা দ্রুত ছুটে গেলো ঘরে। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। বুকটা ধুকধুক করছে। এক্ষুনি মায়ের বিখ্যাত বয়ান শুরু হয়ে যাবে। কাচুমাচু হয়ে বিছানায় বসে রইলো ও। কি যে হচ্ছে বুঝতে পারছে না। মানুষ টা কি এই গ্রামেই আছে, নাকি চলে গেছে! আর কি দেখা হবে না?
রূপসা অবাক হয়ে খেয়াল করলো আজকে মা কোনো বকাই দিচ্ছে না। একেবারে নিরব। শুধু বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ। আশ্চর্য! আজকে মা বকছে না কেন!

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে