অন্তর্দহন প্রণয় ২ পর্ব-০৭

0
1810

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#দ্বিতীয়_খন্ড
৭।
গভীর রাত। ইট পাথরের রাস্তায় জনমানবশূন্য হয়ে আছে। শব্দ ভেসে আসছে শুধু কেউ একজনের প্রাণপনে দৌঁড়ে চলার। নিরবতায় ঘিড়ে থাকা চারপাশ আর ঝিঁঝি পোকার ডাক এক ভৌতিক অনুভূতির সৃষ্টি করছে যেন।অনেকটা পথ ছুটে চলায় খালি পায়ের চোট গুলো থেকে বেড়িয়ে আসা রক্ত গুলো সাক্ষী দিচ্ছে জয়নবের কঠিন একটি পথ পাড়ি দেয়ার। জয়নব এবার থামলো। হাপাতে লাগলো। অপরিচিত এক শহরে কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছে না। বুক ফাঁটা চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে জয়নবের। জয়নব এবার চারপাশে তাকালো। যত দূর দেখা যায় বড় বড় গাছ আর জঙ্গল। হঠাৎ হঠাৎ শোনা যাচ্ছে শেয়ালের হাঁক। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে জয়নবের। জয়নব আর দৌঁড়াতে পারছে না। চাঁদের হালকা আলোয় একটি বট গাছের নিচে ঠাই নিয়েছে সে । গাছের দিকে হেলে এবার তার বুকের ডান পাশের ক্ষতটি দেখলো জয়নব। কিছুক্ষণ আগেই ধারালো ছুরি চালিয়েছে এখানে, এবং বের করে নিয়েছে ইউয়ানের ফিট করা ডিভাইসটি। জয়নব এবার ক্ষতটিতে আবারো ভালো করে কাপড় বেঁধে নিলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে আবারো আঁধারের মাঝে জায়গাটি দেখতে বৃথা চেষ্টা করলো জয়নব। ব্যর্থ হলো আবারো। হা করে হতাশার শ্বাসটি ফেললো। ধীরে ধীরে চোখ বুজে গা এলিয়ে দিলো গাছের সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠলো পুরোনো স্মৃতি। আদর, জয়নবের বাবা-মা, রুফাইদা। সবার কথা…এসব ভাবতে ভাবতেই এক পর্যায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে জয়নব। যখন চোখ খুলে তখন নিজেকে পায়.. এক আলিশান বাংলোর একটি কামরায়। চারিদিকে তখন আলো ফুঁটেছে। সোলালী রোদের আলো খেলা করছে ঘরটির আনাচে-কানাচে। নিজেকে এভাবে অন্য একটি জায়গায় আবিষ্কার করেই ভয়ে কেঁপে উঠলো জয়নব। বিড়বিড় করে বলল,

” ইউয়ান আমাকে আবার ধরে ফেলেছে?”

মনের কোনের ভয় নিয়ে নিচে নেমে এলো জয়নব। ঠিক তখনি একটি চিকন কন্ঠ ভেসে আসলো, যে ইংরেজিতে বলে যাচ্ছে,

” ম্যাম গুড মর্নিং। এখন কেমন লাগছে?”

জয়নবের মাথা কাজ করছে না। সামনের ব্যক্তটিকে দেখে যতটুকু বুঝতে পেরেছে, মহিলাটি মাঝ বয়সি নারী, হয়তো এখানের সার্ভেন্ট। জয়নব মাথা কাত করলো,

” ইয়া আই এ’ম ফাইন। আপনি কি বলতে পারবেন আমি এখানে কিভাবে এলাম?”

মহিলাটি মিষ্টি হেসে উত্তর দিলো,

” আমাদের প্রিন্স আপনাকে নিয়ে এসেছিলো মিস!”

জয়নব ভাবনায় পড়ে গেলো, এই প্রিন্সটা আবারকে? ইউয়ান নয় তো?” জয়নব আবার জিজ্ঞেস করলো,

” আপনাদের প্রিন্স কোথায় এখন?”

মহিলাটি আবার বলল,

” জানি না মিস। ”

” আচ্ছা।”

এর পর আবার নিরবতা। জয়নব ভেবে যাচ্ছে তার সাথে হচ্ছে টা কি? কেনোই বা একের পর এক নতুন মানুষ এন্ট্রি হচ্ছে তার জীবনে, কেউ ভালো, তো কেউ খারাপ।মেডিকেল কলেজের ঢুকা, প্রতিশোধ নিয়া থেকে শুরু করে এই ভীনদেশে এসে হারিয়ে ফেলা তার স্বামীকে। সব যেন এক গোলোক ধাঁধা। কিছু ঠিক হওয়ার বদলে সব আরো গুলিয়ে যাচ্ছে। কবে হবে এর শেষ? এসবের মাঝের মুল কাহিনি কি? কেনোই বা জয়নব এসবেন মাঝে জড়িয়ে? সব কিছু যেন কোনো গল্পকে হার মানায়। জয়নব তার ভাবনার দরজা থেকে বের হয়ে মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” আমি কি একটা ফোন করতে পারি?”
” শিউর ম্যাম!”

জয়নব খুশি হয়ে গেলো। টুট টুট করে টেলিফোনের বাতাম গুলো স্পিডে চালিয়ে গেলো। ফোনের ওপাশের প্রতিটি রিং বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটাবার মতো শব্দ করে যাচ্ছে। এক পর্যায় ফোনটি উঠালো কেউ। হ্যালো বলতেই জয়নব গড়গড় করে বলতে লাগলো,

” কুয়াশা… ই’টস মি.. জয়নব!”

কুয়াশা অবাক হয়ে হাজারটা প্রশ্ন বিদ্ধ করলো। জয়নব শুরু থেকে শেষ বলতেই কুয়াশা ঠিকানা জানতে চাইলো। কাজের মহিলা থেকে ঠিকানা নিয়ে জয়নব জানাতেই কুয়াশা আধঘন্টার মধ্য আসবে বলে জানালো। জয়নব মনে মনে খুশি হলেও বুঝতে পারছে না.. সব কি সত্যি এত সহজে হয়ে যাচ্ছে? নাকি নতুন কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস? জয়নব তবুও নিজে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। কাজে মহিলাটি তাকে খাবার টেবিলের দিকে ইশারা করে বলল,

” ম্যাম কিছু খেয়ে নিন। প্রিন্স বলেছেন নাস্তা করে যেতে।”

জয়নবের এত কিছুর মধ্যে তাদের প্রিন্সের কথা তো ভুলেই গেছিলো। এবার মনের মধ্যে কেমন জানি প্রশ্ন উঁকি দিতে লাগলো,

” কে এই প্রিন্স?”

প্রায় ১০ মিনিটের মাথায় একটি গাড়ি এসে থামলো বিশাল বড় বাড়িটির সামনে। জয়নব এক প্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে এলো। কুয়াশাকে দেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো জয়নব। বান্ধবীকে এতদিন পরে পেয়ে চোখের কোনে জল টলমল করে উঠলো দুজনের। কুয়াশা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

” আই মিস ইউ জয়নব। তোকে সুস্থ সবল দেখে ভালো লাগাচ্ছে অনেক। তুই দেখি আরো সুন্দরী হয়ে গেছিস, ছেলে হলে এখনি তোকে নিয়ে পালাতাম!”

জয়নব হেসে ফেললো। কাঁধের উপর চাপড় মেরে বলল,
” শুরু হয়ে গেছে তোর আবল তাবল কথা। এখান থেকে চল এখন!”

কুয়াশা সম্মতি দিলো। গাড়ির কাছে আসতেই অন্য প্রান্তের দরজাটি খুলে একজন সুদর্ষণ পুরুষকে নামতে দেখে জয়নব বরফের মতো জমে গলো। রোবটের মতো থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো একজায়গায়।

” জান, কেমন আছিস?”
মেহজাবের কাতর কন্ঠ জয়নবের ভেতরটা নাড়িয়ে দিলো। কিশোর জীবনের প্রথম ক্রাশটি ছিলো তার খালাতো ভাই মেহজাব। মেহজাব নিজেও পছন্দ করতো জয়নবকে, কিন্তু মেহজাবের পরিবার তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গেছে জয়নবকে সব সময়, যেখানে রুফাইদা ছিলো তাদের রাজকন্যা। তখন না জানলেও এখন জানে জয়নব, তার পরিচিত, তার আইড্যান্টি ছিলোনা বলেই। মেহজাবকে দেখে জয়নব খুব একটা খুশি হয়নি, তবে চমকে গেছে সে। কুয়াশার মুখে জয়নবের বিয়ের কথা শুনে মেহজাব খুব আহত হয়ে গেলেও আদর মিসিং শুনে মনের কোনে এক ফোঁটা আশার আলো দেখা দেয়। তাই তো তার এখানে আশা।মেহজাব এগিয়ে গেলো জয়নবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের ভিতর মিশিয়ে নিতে চায় সে। কিন্তু জয়নব দু কদম পিছিয়ে গেলো।তা দেখে মেহজাব থেমে গেলো। বুকের ভিতরে কাঁচ ভাঙার মতো শব্দ হচ্ছে যেন তার।

কয়েক ঘন্টা পর…..

কুয়াশা বলল,

” তুই সত্যি আদকে খুঁজতে চাষ?কিন্তু কিভাবে?”

জয়নব জানালা দিয়ে বাহিরের পরিবেশ দেখছে। দূরে একটি ডালে দুটি পাখি বসে গল্প করছে তাদের নিজস্ব ভাষায়। জয়নব বলল,

” আমায় ভালোবেসে ডা. আদর অনেক কিছু সাফার করেছে। এবার না হয় আমি হই তার প্রণয়ে অন্তর্দহন। ”

কুয়াশা হাসলো। এক পলক মেহজাবের থমথমে মুখটির দিকে তাকিয়ে থেকে। আবার প্রশ্ন করলো,

” তুই আর কিছু জানিস? ইউয়ান তোকে আর কি বলেছে?”

” তেমন কিছুই না। শুধু বলেছে, আদরকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ব্ল্যাক হোল, মাটির তলায় যাষ্ট এসব বলেছে।”

মেহজাব ব্ল্যাক হোল কথাটি শোনে রিয়েক্ট করলো,

” কি বললে? ”

” ব্ল্যাক হোল!”

মেহজাব বলল,

” দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর এই দেশে অনেক গুলো এরিয়া আছে যেখানে মাটির নিজে অন্য দলের মানুষদের অত্যচারের জন্য ঘর করা হয়। এই শহরে এমন তিনটি জায়গা রয়েছে। এই ঘর গুলোকে কালো গর্ত বা ব্ল্যাক হোল বলা হয়। কিন্তু এগুলো তো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।”

জয়নব যেন আসার ঝলক দেখতে পেলো,
” মেহজাব ভাইয়া! প্লিজ আদরকে খুঁজতে সাহায্য করো!”

মেহজাব বুকের ভিতর পাথর রেখে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। জয়নবের মায়াবী চোখ জোড়ায় জলের টলমল সে কিভাবে সইতে পারবে? একটা সময় ছিলো জয়নবের জন্য কিছু করতে পারেনি সে। কিন্তু এবার করবেই।

——————

এভাবেই দু’টো দিন কেঁটে গেলো। মেহজাব তার পাওয়ার ইউস করে তিনটি এলাকার খোঁজ করলো। এবং পেয়েও গেলো। গত দুইটি ব্ল্যাক হোল দিয়ে ভড়ে ফেলা। এবার তৃতীয়টির খোঁজে যাচ্ছে তারা। কিন্তু গন্তব্যের যত কাছেই যাচ্ছে না কেন? জয়নব আবকতার শেষ চুড়ায়…

শুধু মুখ ফেঁটে বলল,
” এইটাতো আদরের বাবার বাড়ি!”

কুয়াশা বলল,

” কি বলছিস?”

” সত্যি বলছি! আদর নিজেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলো!”

” কিন্তু কিভাবে? এই বাড়িটি বা এই এরিয়াটা তো পরিত্যক্ত। ”

জয়নবের লোম দাঁড়িয়ে গেলো গায়ের। বলল,

” আমি লাস্ট এ বাড়িটি থেকেই গায়েব হয়েছিলাম!”

কুয়াশা আর মেহজাব একে অপরের দিক তাকালো। ঠিক তখনি মেহজাব বলল,

” আমার মনে একটা প্রশ্ন ছিলো জায়নব!”

” কেমন প্রশ্ন?”

” আদর আর ইউয়ান কি সত্যি ভাই? নাকি এরা এক জনই?”

প্রশ্নটি শুনে জয়নব হতভম্ব হয়ে গেলো,

” হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন করছেন?”

” তোমার সব কথা শোনার পর আর এই বাড়িটি দেখার পর মনে হচ্ছে। এসবের পিছনে অন্য বড় কোনো কারণ আছে। কারণ এই বাড়িটি যাদের ছিলো, তার প্রায় দশবছর আগেই পুড়ে মারা গেছে। আর তোমার কথা মতোই সেই লোকটি ব্রিটিশ আর্মি ছিলেন এবং তার দুটি ছেলে ছিলো জমজ, একজনের নাম এরিক অন্য জনের নাম এরিকস্যান।”

জয়নবের মাথা এবার ঘুরতে লাগলো। কি হচ্ছে এসব তার সাথে?এ আবার নতুন কি কাহিনি??

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে