অন্তর্দহন প্রণয় ২ পর্ব-০৫

0
1813

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#দ্বিতীয়_খন্ড
৫।
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
❌(কপি করা নিষেধ) ❌

সূর্য সেই কখন পাড়ি জমিয়েছে। রেখে গেছে তার ছি
ছিটেফোঁটা আলো। যেন কুড়িয়ে নিচ্ছে সেই আলো প্রকৃতির অপরূপ । চারিদিকে ঝাপিয়ে নেমে এলো কিছুক্ষণের মাঝেই কালি অন্ধকার। দূরে পাহাড়, গাছ-পালা কালো ছায়াময়। দূর দিগন্তে থেকে থেকে চলে যাচ্ছে উড়ে পাখিদের দল। জয়নব শূণ্য দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে গাড়ির জানালার বাহিরে। পাশেই বসে আছে আদর। চোখ-মুখ শক্ত। জয়নবের বড্ড অস্বস্তি লাগতে শুরু করেছে। গাড়ির এই অস্বস্তিকর পিনপতন নিরবতা ভেঙ্গে জয়নব কথা শুরু করলো….

” ডা. আদর… আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

আদরের চোখ-মুখেরের মাঝে রাগের স্পষ্টতা…গভীর। যা দেখে জয়নব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার চুপ মেরে গেলো। এবং আবার বাহিরে তাকিয়ে রইলো উদ্দেশ্য হীন… ঠিক সেই মুহূর্তে জয়নব শুনতে পেলে আদরের ঠান্ডা গলা…

” তোমার এটা করা উচিত হয়-নি জয়নব! তুমি জানো না… কত বড় ফাদে পা ফেলেছো তুমি!”

এই-টুকু শুনে জয়নব কিছুটা চমকে গেলে-ও পরমুহূর্তেই হেসে দিলো ফিক করে। তা দেখে আদরে ভ্রু যুগল কুচকে গেলো। জয়নব সেই মুহূর্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

” হে জানি তো! যে দিন থেকে আপনাকে বিয়ে করেছি? সেদিন থেকেই মৃত্যু-কে আপন করে নিয়েছি ”

আদর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তার মনের কোনে, কথাটি যেন সূচের মতো বিধলো। এবার আর রাগ নেই চোখে মুখে। ফুঁটে উঠেছে বেদনার ছাপ। আদর তখন অনুভূতিহীন কন্ঠে বলল,

” তোমার কাছে কি আমি এতটাই খারাপ জান?”

জয়নব ফিকে হাসলো। বলল,

” এর থেকে-ও বেশি!”

এবার বুকের ভেতরটা ভার মনে হলো আদরের। তার ফ্যাকাসে চোখ জোড়াতে নেমে এলো ভয়ংকর বেদনা। আবারো শুরু হলো তাদের মাঝে অদ্ভুত নিরবতা…

ডা. আদর জয়নবকে সে-ই প্রথম দেখাতে-ই পছন্দ করে ফেলেছিলো। যখন জয়নব ছিলো ছোটটি… অভিনব যখন রুফাইদা আর তার ছোট বোন জয়নবের ছবি তাকে দেখিয়ে ছিলো? ঠিক তখন থেকে-ই….
সেই ছোট মেয়েটির আষ্টেপৃষ্টে এভাবে বাঁধা পড়ে যাবে আদর কখন-ও জানতো না। তখন ছিলো শুধু ছোট মেয়েটির প্রতি ভালোলাগা…. কিন্তু যখন মেয়েটি তার স্টুডেন্ট হিসেবে এলো? আদর হারিয়ে গেলো। প্রণয়ে প্রণয়ে দহন করে দিলো তাকে। কত রাত এই ছোট মেয়েটিকে কোনো বিরতি ছাড়া-ই দেখেছে৷ কত যত ছুটে গেছে গভীর রাতের আধারে। যার কিছুটি জানে না জয়নব। আদর ভাবনার গহ্বর অতলে যখন ঢুবে? ঠিক তখনি তাদের গাড়ি গিড়ে ফেলে কয়েকটি গাড়ি। আদর সাথে সাথে ব্রেক কসে। ধীরে ধীরে নেমে আসা কালো পোশাক ধারী লোক ঘিরে ধরে তাদের গাড়ি। জয়নব ভয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু আদরের দিকে। আদর ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো তাদের দিকে। বুঝতে আর বাকি নেই এরা কারা…..।

তখনি গাড়ির গ্লাসে লম্বাটে শেতাঙ্গ এর লোক নক করে। এবং স্পষ্ট ইংরেজিতে বলে উঠে,

” স্যার… বস আমাদের সাথে আপনাকে যেতে বলেছেন?”

আদর মাথা নাড়লো। ঠিক তখনি চোখ বড় বড় করে বলল,

” কোন বস? আর আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

আদর চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণের মাঝে-ই বেড়িয়ে এলো গাড়ি থেকে তারা। এবং জয়নবের হাত ধরে তাদের গাড়িতে বসে পড়লো। জয়নব এত এত লোক দেখে ভয়ে আধমরা। হাজারো প্রশ্ন তার চোখে। সে বলল,

” ডা. আদর আপনি কি বলবেন আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

আদর এবারো চুপ। গাড়ির সিটে হেলে চোখ বুঝে রইলো। জয়নবের এবার মনের মাঝে কেমন করতে লাগলো। সে এবার রাগে ফোঁসফোঁস করে উঠলো,

” আপনি কি কিছু বলবেন? এরা কারা? আর… আর আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?”

আদর চোখ বুঝে তখন ঠোঁট নাড়লো,

” তুমি সাপের লেজে পা দিয়েছো। সে কি ছোবল দিবে না?”

জয়নব না বুঝতে পেরে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। তখন আদর হেসে বলল,

” ওয়েট করো কিছুক্ষণের মাঝে-ই সব জেনে যাবে!”

জয়নব চুপ করলো ঠিকি। কিন্তু মনের মাঝে অস্থীকর অনুভূতি নিয়ে। অচেনা ভয় নিয়ে বসেই রইলো।

ঘন্টা খানিক পর….

বড় একটি আলিশান বাড়ির সামনে এসে থামলো আদরের বি এম ডাব্লিউ। জয়নব হা করে দেখছে বাড়িটি। বিট্রিশদের বাড়ির মতো… না না বাড়ি নয় যেন মহল….

” এসো!”

আদরের কন্ঠে ভাঙ্গলো ধ্যান জয়নবের। আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করতে করতে নেমেলো সে। সুবিশাল অট্টালিকা ঘিরে আছে হাজার হাজার গার্ডসরা। এরা যেন ফিকে করে চলছে এই অট্রালিকার সুন্দর্য।

খট খট আওয়াজ তুলে যখন তারা ভিতরে ঢুকলো তখন যেন আরো চমক। বাড়ির প্রবেশ রাস্তায় একটি বড় ছবি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে হাসোজ্জল কিছু মুখ যা ফ্রেমে বাধাই করা। জয়নব থমকে ছবিটি দেখে। একজন ব্রিটিশ আর্মির সাথে দাঁড়িয়ে আছে এক বঙ্গললনা আর তার পাশেই দাঁড়ানো দুটি সুঠামো সুদর্শণ ছেলে। কাকতালীয় ভাবে ছেলে দুটি জমজ। আর তার থেকে বড় কথা… ছেলে দুজনের চেহারা সেইম। এ দেখে জয়নব চমকে বলে উঠলো,

” ডা. আদর আপনি কোনটা? আর এখানেই বা আপনার ছবি কেনো?”

আদর কিছু বলল না ছবিটি সামনে তার শক্ত পক্ত চোয়াল নিয়ে চেয়ে রইলো। জয়নব আবারো একই প্রশ্ন করতেই আদর তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,

“নান ওফ ইউর বিজনেস। ”

জয়নবের ভ্রু কুচকে গেলো। সে বলল,

“আশ্চর্য! এখানে আপনার ছবি, তা কি আমি জানতে পারি না? কেন এখানে আপনার ছবি? কেনোই বা এসেছি এখানে আমরা?”

আদর ভাবলেশহীন ভাবে বলল,

” নো!”

” বাট হোয়াই? আমার কি জানার অধিকার নেই?”

আদর এবার সরাসরি তাকালো জয়নবের দিকে। দু কদম এগিয়ে এলো। ঠোঁটের কোনো অভিব্যক্তিহীন হাসি। জয়নবের হঠাৎ মনে হলো, এই মুহূর্তে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আদর বুঝি অন্য কেউ? জয়নবের মনের কোনো অজানা ভয় হতে লাগলো৷ তখনি আদরের কন্ঠে ভেসে এলো,

” যা হচ্ছে, যা হবে হতে দাও। এই সবে তোমার কোনো কাজ নেই। ডা. সাহির মরে গেছে। তোমার ইনতেকাম, তোমার বদলা তোমার প্রতিশোধ যেটাই বলো, শেষ। আর এখান থেকে নতুন ভাবে অধ্যায় আমি লিখবো। আর এখানের রুলস হবে শুধু-ই আমার। সো বি কোয়াইট। ”

জয়নব এবার খেপে গেলো,

” কি সব আবল তাবল বলছেন? আপনার কথার আগা মাথা তো কিছু-ই বুঝতে পারছি না। আমাকে সব ক্লিয়ার করুন!”

আদর আবার হাসলো। লিভিং রুমের সোফার রাজকীয় স্টাইলে বসলো। এবং বলল,

” তোমার যতটুকু জানার ততটুকু আপাতত জানো। এর বেশি জেনে তোমার কাজ নেই! আর হ্যাঁ এখন থেকে আমরা এখানেই থাকবো!”

জয়নব আরেকদফা চমকালো,

” এখানে থাকবো? এখানে থাকবো কেন? এটা কি আপনার বাড়ি নাকি? সত্যি করে বলুন তো? আপনি আবার আমার সাথে নতুন কোনো গেইম খেলছেন নিশ্চয়ই? আবারো কোনো নতুন নাটক শুরু করেছেন??”

আদর রহস্যময় হাসলো। বসা থেকে উঠে এসে জয়নবের বাহু জোড়ায় শক্ত করে চেপে ধরে হিসহিসি করে বলল,

” জীবন একটা নাট্যমঞ্চ। ”

বলেই হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো জয়নবকে। জয়নব ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো শুধু আদরের দিক।

খট খট করে জুতার শব্দ শোনা গেলো সিঁড়ির কোঠার কাছে। জয়নব সাথে সাথে তাকালে৷ একজন মাঝ বয়সি মহিলা পড়নে একটি সুন্দর কলাপাতা রঙ্গে ড্রেস। সেই ছবিটির মহিলাটি। মহিলাটি হেসে এগিয়ে এলো। দু হাত বাড়িয়ে গদগদ সুরে টেনে নিলো বুকে আদরকে,

” ওহো মাই স্যান। ইউ কাম ব্যাক। আই মিসড ইউ সো মাচ!”

আদর নিজে-ও মহিলাকে জড়িয়ে নিলো। কিছুক্ষণ আগের অভিব্যক্তহীন মুখ এখন হাস্যজ্বল। আদর বলল,

” আমি-ও তোমায় অনেক মিস করেছি মা।”

জয়নব মা কথাটি শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো। জয়নব জানতো আদরের মা ছোট বেলায় মারা গেছে। তাই তো ডা. সাহির ভ্যারনিকাকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু??? এই কিন্তুটা টার উত্তর সে মিলাতে পারছে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে দেখছে। ঠিক তখনি মহিলাটি জয়নবকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” আমাদের বাড়ির বউ নাকি?”

আদর প্রতি উত্তর হাসি উপহার দিলো। তখনি মহিলাটি এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে নিলো জয়নবকে। এবং খুশিতে বলল,

” ওয়েলকাম হোম। ”

জয়নব সৌজন্যে পূর্বক হাসলো। তখনি মহিলাটি বলল,

” আমি অর্ণিকা আদরের মা।”

জয়নব চোখ বড় বড় করে বলে ফেললো,

” কিন্তু আদর বলেছিলো?”

মহিলা জয়নবকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

” এটাই যে আমি মারা গেছি?”

জয়নব স্ট্যাচুর মতো মাথা নাড়লো। অর্ণিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

” সে অনেক কথা মা। আস্তে আস্তে সব জানতে পারবে!”

জয়নব চুপ করে রইলো। ভিতরে ভিতরে এক গাদা রাগ পুশতে লাগলো। এই লোকটা তাকে কত মিথ্যা কথা বলেছে? সামনে আর কত সত্যি জানবে জয়নব? এটি কি সবে শুরু? আচ্ছা আদরের চেহারার পিছনে আর-ও ভয়ংকর কোনো চেহারা নেই তো?

জয়নব শুঁকনো ঢুক গিললো। আদরের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। অর্ণিকা বলল,

” ওকে ঘরে নিয়ে যা, তোর বাবা আসচ্ছে কিছুক্ষণের মাঝেই, তারপর এক সাথে ডিনার করবো কেমন?”

আদর মাথা নাড়লো। অর্ণিকা জয়নবের মাথায় হাত বুলিয়ে রান্না ঘরের দিকে গেলো। অর্ণিকা দেয়ালের পিছনে হারিয়ে যেতেই জয়নব রাগে ক্ষোভে আদরের মুখো মুখো দাঁড়িয়ে বলল,

” বাবা মানে? ডা. সাহির আপনার বাবা নয়? উনি তো মারা গেছেন। আমি মেরেছি বেঁচে গেলো কিভাবে? আর উনি আপনার মা হলে ভ্যারোনিকা কে? ”

আদর এত এত প্রশ্ন শুনেও চুপ। আর ভাবলেশহীন। তা দেখে জয়নবের মাথা আরো খারাপ হতে লাগলো। সে এবার আদরে কলার চেপে চেচিয়ে বলল,

” আমাকে সত্যি টা বলুন। ডা. সাহির উনিকে তাহলে?”

আদরের চোখে মুখে বিরক্তি ফুঁটে উঠলো। জয়নবের হাত দুটো ছাড়িয়ে নিলো। এবং জয়নবের দিকে রাঙ্গানিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

” ডা. সাহির আমার বাবা নয়। উনি শুধু পেয়াদা। ”

জয়নব ভ্রু কুচকে বলল,

” মানে।”

আদর উত্তর দিলো না। উল্টো জয়নবের হাতের কব্জি ধরে টেনে নিয়ে গেলো সিড়ির ঘরের দিকে……….

এবং একটি ঘরের ভিতরে এনে জয়নবে ধাক্কা দিয়ে বিছায় ফেলে দিয়ে তার শক্ত থমথমে কন্ঠে বলল,

” তোমার যতটুকু জানার জেনেছো। এর পর একটি প্রশ্ন নয়। আর হ্যাঁ ডা. সাহির এমনিতে মরতো। তোমার হাতে না মরলেও সে আমার হাতেই মরতো৷ সো দ্যা চ্যাপ্টার ইজ ক্লোজড। স্বামীর সংসারে এসেছো। মন দিয়ে সংসার করো। আর কোনো দিকে কান, নাক দিয়েও না। এর ফল ভালো হবে না কিন্তু!”

বলেই গট গট করে বেড়িয়ে গেলো আদর। জয়নব এখন-ও বিছানার উপর। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না এটি কি সেই আদর? নাকি অন্য কেউ? আচ্ছা আদরের বদলে অন্য কেউ নয়তো???

জয়নব আবারো আকাশ কুসুম ভাবতে লাগলো। ঠিক তখনি দরজা আবার খুলে গেলো। এবং সাথে সাথে ভিতরে ঢুকলো দুজন নার্স একজন ডাক্তার। এদের দেখেই জয়নবের চোখ মুখ কুচকে গেলো।

” আপনারা? এখানে কেন? কি চাই? ”

কেউ কিছু বলল না। উল্টো নার্স দুজন এসে বেঁধে ফেললো জয়নবের হাত পা। আর ডাক্তার একটি ইনজেকশন বের করে পুশ করে দিলো। সাথে সাথে ঘোলাটে হয়ে গেলো জয়নবের দুনিয়া। চোখের কোন থেকে গড়িয়ে পড়তে লাগলো নোনা জল। চোখ বোঝার আগে শুধু দেখতে পেল আদরের আদল খানি। ভাবলেশহীন ভাবে প্যাকেটে হাত গুঁজে আছে সে। জয়নব এবার চোখ বুঝে ফেললো। কি হতে চলছে জয়নবের সাথে। কেন করছে আদর এসব? এগুলো করার পিছনে কি লুকিয়ে আছে কোনো বড় উদ্দেশ্য????

চলবে,

ভুল-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে