অতঃপর_তুমি পর্ব-২৩

0
4899

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-২৩
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

২৩.
ঘুম থেকে উঠেই একপলকে সারা রুমে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম।অভ্রকে কোথাও খুঁজে পেলাম না।ভোরের আলো সবে ফুটে উঠেছে।এতো ভোরে তার নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনের রহস্য উদঘাটনে আমার মন মস্তিষ্ক তৎপর হয়ে উঠে পড়ে লেগে গেলো।গোয়েন্দা হয়ে রহস্য উদঘাটনের আগে নিজেকে ফ্রেশ করে নেওয়াটা বাঞ্ছনীয় মনে করলাম।কিন্তু শরীর সায় দিচ্ছে না।আরেকটু ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে আলসেমি ভেঙে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম।দাঁত ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে একটি তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বারান্দায় এসে নিচে উঁকি দিয়ে দেখলাম অভ্র একটা পাতলা সাদা শার্ট পড়ে বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
স্নিগ্ধ সকালে স্নিগ্ধ মুখটি দেখেই মনটি ফ্রেশ হয়ে গেলো।ঘুম ঘুম ভাবটি রকেট গতিতে উধাও হয়ে গেছে।নিচের ঠোঁটটি আলতো করে চেঁপে হেঁসে হাতের তোয়ালেটি ছুঁড়ে ফেলে আমিও নিচে যাবার জন্য দৌঁড়ে গেলাম।
রুমের দরজার কাছে আসতেই একটু থেমে পিছিয়ে যেয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম।আমার পরনে কাল রাতেরই হালকা গোলাপি রঙের সাধারণ পাতলা সুতি থ্রি পিছ রয়েছে।চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিকঠাক করে ওড়নাটা ভালো মতো ঠিক করে নিলাম।চেহারাটা কেমন যেনো খালি খালি লাগছে।
ড্রয়ার খুলে এক জোড়া ঝুমকো কানের দুল বের করে তাড়াতাড়ি কানে পড়ে নিলাম।তারপর নিজেকে আরো একবার আয়নাতে ভালো মতো দেখেলাম।না অরু,খারাপ লাগছে না।ভালোই দেখাচ্ছে।

তাড়াহুড়োয় আমি খালি পায়েই বাগানে চলে আসলাম।কাল রাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিলো।বৃষ্টির বিন্দু গাছের সবুজ পাতার কোণায় জমে আছে।সকালের মিষ্টি নরম সূর্যের আলো সেই জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটায় যেনো আটকে গিয়ে মুক্তোর মতো চিকচিক করছে।আবার মাঝে মাঝে হঠাৎ টুপ করে গাতার গায়ে থেকে গড়িয়ে পড়ছে।
অভ্র প্যান্টের পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে হেঁটে হেঁটে হয়তো প্রকৃতির সেই সৌন্দর্য্যকেই উপভোগ করছেন।
ভেজা ঘাসে আস্তে আস্তে পা ফেলে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তার পেছনে গিয়ে বাম কাঁধে হাত দিয়ে একটি টোকা দিলাম।তিনি বাম কাঁধের দিকে দেখতেই আবার ডান কাঁধে টোকা দিলাম।পুনরায় বাম কাঁধে টোকা দেওয়ার আগেই উনি পেছনে না তাকিয়েই আমার হাত খপ করে ধরে ফেলে সোজা আমাকে তার সামনে নিয়ে এলেন।
ভ্রু ভাঁজ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘এই তুমি সকাল সকাল এখানে কি করছো?তোমার পড়া নেই?’

উনি আবারও আমার পড়া নিয়ে পড়ে গেলেন বলে আমি বিরক্ত বোধ করলাম।মাঝে মাঝে মনে হয় উনি আমার বর নন,আমার টিচার।অসহ্য!’
মুখ ভার করে উত্তর দিলাম,
‘মাত্রই তো ঘুম থেকে উঠলাম।একটু পর পড়তে বসবো।’
‘তুমি মাত্র ঘুম থেকে উঠেছো?’
‘হ্যাঁ।এনি ডাউট?’
‘মাত্র ঘুম থেকে উঠে এমন সাজগোজ করে ফেলতে পারলে আর পড়তে বসতে পারলে না?’

উনার কথা শুনে আমি হতবাক।শুধু কানে একটা ঝুমকো দুল পড়েছি আর একে তিনি সাজগোজ বলছেন।তাহলে আজকালকার মেয়েদের ফাউনডেশন,ম্যাট লিপস্টিক,কাউন্সিলার,ব্লাশ আরো কতো কী এসব দেখে কি বলবেন!

‘শুধুমাত্র কানের দুল পড়াতেই সাজগোজ করা হয়ে গেলো?’

‘আমি সেটা বলছি না।আমি বোঝাতে চাইছি যে ঘুম থেকে উঠেই তো আর কেউ কানে এতো বড় ঝুমকো পড়ে হাঁটতে বের হয় না।’

শুধুমাত্র একটা কানের দুল পড়েছি বলে এতো গুলো কথা!বুকে হাত গুঁজে অন্যদিকে তাকিয়ে আমি মুখ ভার করে রইলাম।অভ্র দু পা এগিয়ে আরো একটু কাছে এসে দাঁড়িয়ে পাশ থেকে আমার থুতনি ধরে একবার এদিক আরেকবার ওদিক নাড়িয়ে গভীর মনোযোগে দেখতে লাগলো।আমি ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালাম।আমার দৃষ্টি তাকে বলে দিচ্ছে ‘এভাবে কি দেখছেন?’
আমার অদৃশ্য প্রশ্নের উত্তর দিতে অভ্র বললেন,
‘দেখছি তোমার গালে কোনো সমস্যা আছে কি না।একটু পর পর শুধু ফুলে যায় কেনো?’

তার কথা শুনে রাগে আমার কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বেরোতে লাগলো।আমি দাঁত কিরমির করে দ্রুত গতিতে সেখান থেকে চলে আসতে লাগলাম।আর অভ্র পেছন থেকে পেটে খিল ধরে যাওয়া হাসি হাসতে হাসতে বললেন,

‘অরু,আই এম জাস্ট কিডিং।ঝুমকোয় দেখতে তোমাকে সুন্দর লাগছে।সত্যি।’

কে শোনে কার কথা!আমি জোরে জোরে হাঁটতেই লাগলাম।হঠাৎ পায়ে একটু তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব হতেই বাম পা উঁচু করে শব্দ করতে লাগলাম।আমার পায়ে কাটা ফুটে গেছে।অভ্র দৌঁড়ে এসে আমার পা ধরে উঁচু করে দেখে মৃদু হেঁসে বললেন,
‘আমার থেকে দূরে যেতে চাইলেও দূরে যেতে পারলে না, দেখেছো?’

কথাটা বলে একটা টান দিয়ে সে আমার পা থেকে কাটা টি বের করে ফেললেন।আচমকা তীক্ষ্ণ ব্যাথায় তার কাঁধের শার্টের খানিকাংশ আমি খামছে ধরলাম।ব্যাথাটি লাগলেও ব্যাথাটি অনুভব হলো না।তার বলা শেষের কথাটি তিনি মজার ছলে এই মুহুর্তকে নিয়ে বললেও তা আমার কানে অন্যরকম ভাবে বাজলো।কেমন একটা অনুভূতি হলো।কেমন যেনো ঘোর মাখা ভালোলাগা ময়।

২৪.
হাসপাতালের বেডে ভাঙা হাত পা নিয়ে বসে আছি।ভাঙা হাত পা বলতে হাত ভেঙেছে আর পায়ে খানিকটা আঘাত পেয়েছি।কপালের কোণেও একটু ছিলে গেছে।ভার্সিটি থেকে ফিরতি পথে রিকশা উল্টে পড়ে গিয়ে এই অঘটনটা ঘটেছে।তারপর আমাদের ভার্সিটির একজন নতুন ইয়াং প্রফেসর ঘটনাস্থলে আমাকে দেখে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন।
হাসপাতালের একজন ডাক্তার এসে আমাকে ব্যান্ডেজ করে চলে গেছেন।আসিফ স্যার এখন বাইরে গেছেন আমার জন্য কি একটা মেডিসিন আনতে।
বালিশের সাথে ঠেস দিয়ে বসে বসে আমি যেই কক্ষ টিতে আছি সেখানকার সমস্ত কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম।আমাকে দেখে অতটাও আহত,বিচলিত মনে হচ্ছে না।
এমন সময় অভ্র ঝড়ের গতিতে রুমে প্রবেশ করে আমাকে ধরে উদ্বিগ্ন মুখে দেখতে লাগলো।তাকে দেখে আমি প্রথমে চমকে উঠে তারপর থমকে গেলাম।তার মুখের এই কি অবস্থা!এলোমেলো চুল,ফ্যাকাসে চাহনি,শুকনো মুখ।মনে হচ্ছে আমার এক্সিডেন্ট নয় তার উপরই রীতিমত একটা বড় সড় ঝড় বয়ে গেছে।
উনি আমার গালে দু হাত রেখে আতংকিত মুখে অস্থির হয়ে বলতে লাগলেন,
‘অরু,তুমি ঠিক আছে তো?খুব বেশি ব্যাথা করছে?সব আমারই দোষ।আমিই যদি তোমাকে আনতে যেতাম!’

আমি চোখ বড় বড় করে হতবিহবল হয়ে তার কান্ড দেখতে লাগলাম।অভ্র’র পেছন পেছন কম বয়স্ক একজন ইন্টার্ন মেয়ে ডাক্তার শুকনো মুখে প্রবেশ করলো।অভ্র’র পেছনে দাঁড়িয়ে বললো,
‘থ্যাংক গড!স্যার আপনি আপনার ওয়াইফকে পেয়েছেন।’

আমার একটু ভ্রু কুঁচকে গেলো।উনি আমাকে খুঁজে পেয়েছেন এতে এই ডাক্তারের এতো খুশি কিসের!এরপর সেই ইন্টার্ন ডাক্তার থেকে যা শুনলাম তাতে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।কারণ ডাক্তারটি যা বললো তা হলো এই,
অভ্র পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে এসেছে।এরপর আমাকে খুঁজে না পেয়ে আরো অস্থির হয়ে গেছেন।আজ অরু নামের তিনজন এই হাসপাতালে এডমিট হয়েছিলো বিধায় আমাকে খুঁজে দিতে রিসিপশনিস্টের একটু সময় লেগেছিলো আর এতটুকু সময়ে উনি নিজে পাগল হয়েছেন এবং পুরো হাসপাতাল শুদ্ধ নার্স,ডাক্তারদের পাগল বানিয়ে ছেড়েছেন।ডাক্তারদের সাথে রাগারাগি,চিৎকার,চেচাঁমেচি করে একাকার করে ফেলেছেন।

আমাকে এতোসব কথা বলায় অভ্র একটু বিরক্ত হয়ে ডাক্তারটির দিকে তাকালো আর তাতেই সেই মেয়ে ডাক্তারটি ভয় পেয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।

অভ্র সেই মুহুর্তেই আমাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন।তার মতে এতো সব পেশেন্টের মাঝে ডাক্তাররা আমার ভালোমতো ট্রিটমেন্ট করতে পারবে না।তাই উনি বাসায় নিয়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকে নিজ দায়িত্বে আমার খেয়াল রাখবেন।তার জোরাজোরিতে ডাক্তারও রাজী হয়ে গেলো।
অভ্র গেছে কিছু ফর্মালিটি পূরণ করতে।উনি আমাকে যাওয়ার আগে এখান থেকে একচুলও নড়তে মানা করেছিলেন।কিন্তু বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগায় বিছানা থেকে নেমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দরজা পর্যন্ত এগোনোর চেষ্টা করলাম।দু কদম আগাতেই পা আর সায় দিলো না।পড়ে যেতে লাগলাম।ঠিক তখনই আসিফ স্যার এসে আমার হাত খপ করে ধরে ফেললো।

‘ব্যাথা পেয়েছেন?’

স্যারের স্বভাব এমনই।ভার্সিটিতে নতুন চাকরি পেয়েছেন।লাজুক মুখে সব মেয়েদেরকেই আপনি করে কথা বলেন।আমি একটু হাসবার চেষ্টা করে স্যারের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য বললাম,
‘না স্যার,আমি ঠিক আছি।’

ঠিক সেই সময় অভ্র চলে আসলো।আমাদের দুজনের দিকে একপলক তাকিয়ে দ্রুত এগিয়ে এসে ঝট করে স্যারের হাত থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিজের কাছে নিয়ে বললেন,
‘ধন্যবাদ প্রফেসর।শুনলাম আপনি অরুকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন।তার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।’

আমাকে দুই হাত দিয়ে আগলে ধরে অভ্র আসিফ স্যারকে কথাগুলো বলতে লাগলো আর আমি ভ্রু কুঁচকে অভ্র’র দিকে তাকিয়ে রইলাম।অভ্র মুখে স্যারকে ধন্যবাদ বললেও একটু আগে তার ঝট করে স্যারের হাতটা আমার থেকে ছাড়িয়ে নেওয়াটা দেখতে মোটেও সৌজন্যেমূলক ছিলো না।এবং তার কথার ধরণ এখনও যথেষ্ঠ অন্যরকম লাগছে।আমি যতটুকু জানি অভ্র যথেষ্ঠ সৌজন্যমূলক।কেউ উপকার করলে তার প্রতি প্রচুর কৃতজ্ঞতা দেখান।তবে আজ তার হলো টা কি?হেয়ার ইজ এ বিগ মিস্ট্রি!

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে