অতঃপর_তুমি পর্ব-১৫

0
5115

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-১৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

১৯.
অভ্র একা একা অন্ধকার ছাদে বসে আছে।মুখের সামনে অফিসের একটি মোটা ফাইল।ফোনের টর্চ জ্বেলে ফাইলের উপর আলো ফেলে গভীর মনোযোগে তার চোখদুটো এখন সেখানেই নিবদ্ধ।
তাকে খুঁজতে খুঁজতে আমিও ছাদে চলে আসলাম।সত্যি বলতে তাকে না ক্ষ্যাপালে আমার এখন একদমই ভালো লাগে না।সারাদিন শুধু সুযোগ খুঁজি কিভাবে তার পেছনে লাগা যায়।

আস্তে আস্তে খালি পা টিপে টিপে হেঁটে তার কানের পেছন থেকে হঠাৎ ‘ভোঁ’ করে চিৎকার করে উঠলাম।অভ্র স্বাভাবিক ভাবেই পেছনে ঘুরে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।তিনি একটুও চমকে উঠলো না দেখে আমি একটু মুখ ভার করলাম।
‘চিৎকার করছো কেনো?’
‘অন্ধকারে বসেও আপনি একটু চমকালেন না কেনো?’
‘আমি তো আর তোমার মতো ভীতু না।’
‘আমি ভীতু?’
অভ্র আবার ফাইলের দিকে চোখ নিয়ে বললো,
‘ভীতুর থেকেও বেশি।’

আমি রাগে ঠোঁট ফুলিয়ে বললাম,
‘আমি ভীতুর থেকেও বেশি?
অভ্র ভ্রু কুঁচকে ফাইলের দিকে তাকিয়েই বলল,
‘হুম।’
‘আমি মোটেও ভীতু না।বুঝেছেন?’
‘হুম।’
‘জানেন আমি ছোটোবেলায় একবার কি করেছিলাম।’
অভ্র আবার বলল,’হুম।’

আমি এবার উনার দিকে তাকিয়ে খেয়াল করে দেখলাম আদতে উনি আমার কোনো কথাই খেয়াল করে শুনছেন না।শুধু হুম হুম করে যাচ্ছেন।আমি আবার বললাম,
‘আমার নাম কি?’
‘হুম।’
আমার মেজাজটাই বিগড়ে গেলো।কোথায় এসেছিলাম তার সাথে একটু মজা করতে।কিন্তু ইনি তো আমার কোনো কথাই কান দিয়ে শুনছেন না।তার হাত থেকে ফাইলটা কেঁড়ে নিলাম।অভ্র ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘অরু,প্লিজ ফাইলটা দাও।’
‘না দিবো না।’
‘দিতে বলছি কিন্তু।’
‘পাবেন না।’
অভ্র হাত বাড়িয়ে আমার থেকে ফাইল নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলো।আমিও সহজে ছাড়ার পাত্রী নই।ফাইলটা বারবার এ হাত থেকে ও হাত করে তাকে জ্বালাতে লাগলাম।
অভ্র হঠাৎ আমার পেছনের দিকে ইশারা করে চেঁচিয়ে বলল,
‘ভূত!’
আমি চমকে উঠে পেছনে তাকালাম।আর অভ্র এই সুযোগে আমার উপরে থাকা ডান হাতটা শক্ত করে ধরে হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে নিলো।আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তার শক্ত বাঁধনে পারিনি।
ফাইলটি নিয়ে তিনি একটি বাঁকা হাসি দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন।আমিও পেছন থেকে আবার ফাইলটি তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে উল্টো দিকে দৌড় দিলাম।কিন্তু আমার সাথে কি আর সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে কোনোদিন হবে! তাই এবারও হলো না।দৌড়ে একটু এগোতেই পা পিছলে ধপ করে পড়ে একেবারে নিচে বসে পড়লাম।অভ্র ভ্রু যুগল ভাঁজ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো।।আমি হাত থেকে ধুলো ঝেড়ে তার হাতকে ধরতে যেতেই সেই হাত সেদিনের মতো পুনরায় আমার হাতকে ক্রস করে পাশে পড়ে থাকা ফাইলটি তুলে নিলো।নিচের ঠোঁটটি মৃদু কামড়ে ধরে মুখে একটা ডেম কেয়ার ভাব তুলে রাখলো।যেন আমাকে তিনি দেখছিনই না।দেখেই বোঝা যাচ্ছে ছেলেটা এখন ব্যাপক মুডে আছে।

আমি তো হতবাক।রাগে মুখ ফুলিয়ে সেখানেই বসে থাকলাম।সবসময় তার এমন ভাব নেওয়া চলবে না।ছেলেরা এতো ভাব নিবে কেনো?ভাব নিবে মেয়েরা।আজকে তাকে একটা শিক্ষা দিতেই হবে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেলো তবুও আমি মুখ ফুলিয়ে বসে থেকে উঠছি না দেখে অভ্র পাশে ঘুরে একটু মুচকি হাসি দিয়ে পুনরায় সামনে এসে তার হাত বাড়িয়ে দিলো।আমি এবার এমন ভাব করলাম যেনো আমি তার হাত দেখছিই না।অভ্র বলল,
‘আজকে সারারাত ছাদে কাটানোর প্লান আছে নাকি?’
আমি মুখ ভার করে চুপ করেই রইলাম।অভ্র আবার বললো,
‘অরু,হাতটা ধরো।’
এবারও আমি নিশ্চুপ।প্রয়োজনে সারারাত ছাদে এভাবেই থাকবো তবুও তার হাত আমি ধরবো না আর এখান থেকে যাবোও না।না মানে না।

‘ঠিকাছে।তুমি যেহেতু উঠবে না আমি চলে যাচ্ছি।
তবে রাতে কিন্তু ছাদে মানুষদের একা একা থাকতে হয় না।অন্যরাও ঘোরাঘুরি করে তো।’

আমি এমন ভাব করলাম যেনো তার কথা আমি শুনতেই পাইনি।আড়চোখে একবার অভ্রকে দেখার চেষ্টা করে দেখলাম তিনি তার ফোন আর ফাইলটা হাতে নিয়ে সত্যি সত্যিই দরজা দিয়ে চলে যাচ্ছেন।যখন তাকে আর দেখা গেলো না তখন আমি চোখ বড় বড় করে পুরোপুরি মাথা ঘুরিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তিনি সত্যিই এই অন্ধকার ছাদে আমাকে একা ফেলে চলে গেছেন।একটুও ভাবলো না আমার কথা।

রাগে,অভিমানে আমার চোখে পানি চলে এলো।বসা অবস্থাতেই পেছনে ঘুরে হাঁটুতে মুখ ঢাকতেই টের পেলাম কেউ যেনো ঝট করে আমায় শুন্যে তুলে নিচ্ছে।চমকে গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার চোখ আরো বড় বড় হয়ে গেলো।অভ্র আমাকে কোলে করে নিয়ে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে।
অবাক ভাবটা সামলিয়ে আমি পুনরায় মুখ ফুলিয়ে হাত পা ছোড়াছুড়ি করে বললাম,
‘নামান আমাকে।আমি যাবো না।’

উনি সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললেন,
‘একদম নড়াচড়া করবে না নয়তো কিন্তু এখন ছাঁদ থেকে সত্যি নিচে ফেলে দিবো।’

তার কথা শুনে আমি আর কিছু বলার সাহস পেলাম না।মুখটা ভার করে তার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখলাম।উনি আমাকে বিছানায় কোল থেকে নামিয়ে রেখে চলে গেলেন।আমি ওপাশ ফিরে বালিশে মুখ গুঁজে কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়লাম।

কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না।একসময় ঘুমের মধ্যেই টের পেলাম অভ্র আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডেকে বলছে,’অরু উঠো,খাবে না?’
আমি তখন গভীর ঘুমে মগ্ন।চোখও খুলতে পারছি না।শুধু শুনলাম,
‘অরু,তারাতারি উঠো।কতো রাত হয়ে গেছে জানো!খাবে না?’
আমি চোখ না খুলেই কোনো মতে বললাম,
‘উঁহু।’
‘কি উঁহু?তাড়াতাড়ি উঠো।রাতে না খেয়ে ঘুমানোটা একদম ভালো না।’

অভ্র আমাকে আবারো অনবরত ডাকতেই থাকলো।তার ডাকাডাকির জ্বালায় না উঠে পারলাম না।ঘুম ঘুম চোখে বললাম,
‘আমি খাবো না।আমি এখন ঘুমাবো।আমার ঘুম পাচ্ছে।’
‘যতো ঘুমানোর খাওয়ার পরে ঘুমিয়ে নিয়ো।এখন একটু খেতেই হবে।’
আমি একটু বিরক্ত হয়ে চোখ কঁচলে বললাম,
‘বললাম তো খাবো না।একেবারে সকালে একসাথে খেয়ে নিবো।এখন আপনি যান।’

অভ্র চলে গেলো।আমি একবার দরজার দিকে তাকিয়ে আবারো ঘুমানোর জন্য বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লাম।কিন্তু কিছুক্ষন পরই অভ্র এসে হেঁচকা টানে আমাকে একদম শোয়া থেকে বসিয়ে দিলো।এবং আমি কিছু বলার আগেই আমার মুখে নিজের হাতে এক নলা খাবার তুলে দিলো।ঘুমে ছোট হয়ে আসা চোখ নিয়েই আমি ঈষৎ বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকালাম।মুখ ভর্তি ভাত তাই কিছু বলতেও পারছি না।অভ্র আমার পাশে বসে খুব যত্নে ভাত মেখে মেখে আমার মুখে তুলে দিতে লাগলো।আর বলল,
‘না খেয়ে কখনো ঘুমাবে না।এটা আমি একদম পছন্দ করি না।যতই ঘুম পাক প্রথমে খাবে তারপর ঘুমাবে।মনে থাকবে?’

আমার হঠাৎ মনে পড়লো আমি তার উপর রাগ করেছি।সাথে সাথে আমি মুখ ভার করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম,
‘হুম।’
‘তুমি কি ভাতের সাথে লবণ খাও?’
‘হুম।’
‘কতটুকু?’
‘হুম।’
অভ্র ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো।আর আমি কোনো ভাবান্তর না করে সেভাবেই একদম সোজা সামনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলাম।
‘পানি খাবে?
‘হুম।’
অভ্র দাঁড়িয়ে টেবিল থেকে পানি নিয়ে আমার সামনে গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘এই নাও।’
আমি গ্লাস না ধরে না তাকিয়ে আবারো বললাম,
‘হুম।’
অভ্র হেঁসে ফেললো।
মুখ ভরা খাবার নিয়ে আমি তার মতো করেই ভ্রু কুঁচকে তার দিকেই চোখ তুলে তাকালাম।

আমার মাথায় আস্তে একটা হাত দিয়ে বারি দিয়ে অভ্র মুচকি হেঁসে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
‘পাগলী।’

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে