বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1217



গল্প:-♥ফুলশয্যা♥ পর্ব:- ০৭

0

গল্প:-♥ফুলশয্যা♥
পর্ব:- ০৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

আবিরের এমন হু,হু করে হেসে উঠা,টিপ্পনীকাটা মেনে নিতে পারছে না নীলিমা। আর তাই রুম থেকে কিছু না বলেই বের হয়ে যাচ্ছিল।ঠিক তখনি__
আবির:- কোথায় যাচ্ছ?
নীলিমা:- মণির কাছে….
আবির:- শুবে না???
নীলিমা:- শুইব…
আবির:- তো? মণির কাছে কি???
নীলিমা:- আমি মণির সাথে শুইব….
আবির:- আর ইমন???
নীলিমা:- আপনার সাথে….ইমন ভাইয়া শুইবে আপনার সাথে।
আবির:- কিন্তু…..
নীলিমা:- আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওর সাথে ঘুমাতে। একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে…
আবির:- ওহ,আচ্ছা।তাহলে যাও….
নীলিমা:- হুম…..

নীলিমা হনহনিয়ে আবিরের রুম থেকে বেরিয়ে ওর রুমে চলে যায়।
মণি-ইমন তখন একজন আরেকজনের কাছে যাচ্ছিল। ঠিক সে সময়টাতে রুমে আচমকা নীলিমা প্রবেশ করে কোনোরকম নক ছাড়া’ই। ইমন-মণি ভিষণ রকম অপ্রস্তুত ছিল। নীলিমাকে দেখে দু’জনেই দু’জনকে সামলে নিয়ে আমতাআমতা করে বলে__
” নীলি…মাাাা….”
নীলিমা চোখ দুটো বন্ধ করে বলে__
” আমি স্যরি…”
Extremely sorry….
মণি:- কিছু বলবি???
নীলিমা:- না, না।
কিচ্ছু বলব না। আমি দেখতে আসছিলাম কয়টা বাজে….???
আমি যায়, তোরা ঘুমা….

কথাগুলো বলে নীলিমা একরকম লাফিয়ে রুম থেকে বের হলো। ইমন-মণি একে-অপরের দিকে তাকিয়ে বলল হা, হা লজ্জা পাইছে….

এদিকে আবির?!!!
দরজা খুলে শুয়ে আছে।
অপেক্ষায় আছে কখন ইমন আসবে।
কিন্তু ইমন আর আসছে না।
এদিকে ঘুমে আবিরের চোখ দুটো লেগে আসে। আবির ঘুমিয়ে পরে এই ভেবে যে ইমন এসে না হয় দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পরবে।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় আবিরের। আবির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে বাইরে মুসলধারে বৃষ্টি পরছে।ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখে ১২টা বাজে। আবির মনে মনে ভাবছে__
“মাত্র ১২টা বাজে?”
আচ্ছা, ইমন আসে নি কেন এখনো?
ওরা কি তাহলে বৃষ্টির দিন পেয়ে গল্পে মেতে উঠেছে???
আমি কি যাব ঐখানে????
যায় দেখেই আসি।
দেখি গিয়ে ওরা কি করে???
আবির নীলিমার রুমের দিকে পা বাড়ায়। নীলিমার রুমের কাছে গিয়ে আবির থমকে দাঁড়ায়। দরজাটা যে বন্ধ আর লাইটও অফ করা…..
আবির আস্তে আস্তে দরজায় নক করে মণিকে ডাকে।
মণি-ইমন কেহ’ই এখনো ঘুমায়নি।
তাই প্রথম ডাকেই ইমন সারা দিয়ে বলল__
” কিছু বলবেন ভাইয়া?”
আবির:- ইমন না আমার সাথে শুইবে? তো ও কখন আসবে? রাত যে অনেক হলো….
ইমন:- আবির ভাই! আমি আপনার সাথে শুইব সেটা কে বলেছে আপনাকে?
আবির:- কেন? নীলিমা…
আর নীলিমা’তো বলছে মণির সাথে সে ঘুমোবে।কেন সে আসেনি???

মণি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে। তারপর__
” কি বলছেন ভাইয়া? ও আমার সাথে শুইবে বলে এ রুমে এসেছিল?”
আবির:- তাই তো বলল। ও কোথায়?
মণি:- ভাইয়া ও তো ঘন্টাখানেক আগেই চলে গেছে…..
আবির:- চলে গেছে মানে? ও এ রুমে নেই????
মণি:- না ভাইয়া! ও চলে গেছে….
আবির:- কি বলছ তুমি এসব?
ও তো রুমেও যায়নি….
মণি:- ভাইয়া অন্য রুমে দেখবেন প্লিজ???অন্য কোথাও ঘুমিয়েছে কি না???
আবির:- হতে পারে সেখানেই ঘুমোচ্ছে। ঠিক আছে তোমরা ঘুমাও।
গুড নাইট….

আবির এ রুম ও রুম করে পুরো বাড়ি খুঁজে হয়রান।তবুও নীলিমাকে খুঁজে পাচ্ছে না কোথাও???
সবশেষে আবির ছাদে গেল। যদিও জানে নীলিমা এমন বৃষ্টির সময় ছাদে থাকবে না, কারন বৃষ্টির একফোঁটা ওর শরীরে পরলেই হাঁচি শুরু হয়। এ এক ভয়ংকর অসুখ।
হাঁচি থেকে শ্বাসকষ্ট। বিয়ের প্রথম বর্ষায় শখ করে আবির নীলিমাকে জোর করে নিয়ে বর্ষাস্নাত বিকেলে বৃষ্টিতে নেমেছিল।
তারপর নীলিমার কি জ্বর….
হাঁচি, শ্বাসকষ্ট..!!!!
আবির তো ভয় পেয়ে গিয়েছিল সেদিন নীলিমার ভয়ংকর এমন অসুখ দেখে। সেই থেকে নীলিমাকে নিয়ে আর কখনো বৃষ্টিতে ভিঁজার ইচ্ছে পোষন করেনি আবির। যদিও বিয়ের আগে আবির ঠিক করেই রেখেছিল বর্ষাস্নাত বিকেল বেলায় আবির ওর বউকে নিয়ে রাজপথে বৃষ্টিতে হেঁটে বেড়াবে কখনো বা বর্ষামুখর সন্ধ্যা কিংবা রাত্রিবেলায় বউকে নিয়ে ছাদে বৃষ্টিবিলাস করবে।আবিরের মনের আশা মনেই রইল।
পূরণ আর হলো না….

আবির জানে নীলিমা ছাদে থাকবে না তারপরও একনজর দেখার জন্য ছাদে গেল। ছাদের ছোট্ট ঘর থেকে ছাদে উঁকি দিয়েই আবিরের চোখ ছানাভরা হয়ে যায়।
নীলিমা এই বৃষ্টিতে ছাদের কর্ণারে চুপটি করে বসে আছে। আবির দৌঁড়ে নীলিমার কাছে গেল……

আবির:- তুমি এখানে?
এইভাবে বসে আছ আর তোমাকে পুরো বাড়ি খুঁজে আমি হয়রান হয়ে গেছি। এখানে এসেছ কেন????

নীলিমা আবিরের দিকে একনজর তাকিয়ে আবারো আগের ভঙ্গিতে হাটুতে ভর দিয়ে আছে।
মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি।

আবির:- কি হলো? কথা কানে যাচ্ছে না? এভাবে বৃষ্টিতে ভিঁজতে কে বলেছে তোমায়???
নীলিমা:-……..
আবির:- কথার উত্তর তো দাও…..
নীলিমা:-…….

আবির আর পারছে না।
অনেক হয়েছে বলে আবির একটানে নীলিমার হাত ধরে নীলিমাকে বসা থেকে দাঁড় করিয়ে দেয়। নীলিমার ঠোঁটজোড়া শীতে নীল হয়ে গেছে। আর নীলিমাও ভিঁজে রীতিমত কাঁপছে। আবিরও এতক্ষণে ভিঁজে একাকার…..
আবির নীলিমার হাত ধরে আছে, আর নীলিমা নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁপছে….

আবির:- চলো….
নীলিমা:- না……
আবির:- চলো…….
নীলিমা:- না……..
আবির:- চলো……….
নীলিমা:- না, না, না……..

আবির আর একটা কথাও বলেনি।
সোজা নীলিমাকে কোলে উঠিয়ে নেয়। নীলিমা “থ” হয়ে গেছে।স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে আবিরের দিকে।আবিরও কিছুক্ষণ নীলিমার দিকে তাকিয়ে ছিল, তারপর ওর দিকে তাকিয়েই সিড়ির প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করতে থাকে। আবির নীলিমাকে নিয়ে সোজা বাথরুমে চলে যায়।বাথরুমে গিয়ে নীলিমাকে দাঁড় করিয়ে__
” তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি আসছি।”

নীলিমা ছোট্ট বাচ্চাদের মত আবিরের কথামত চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষাণিকবাদে’ই আবির ফিরে আসে হাতে একটা শাড়ি নিয়ে…..
নীলিমা:- আমি শাঁড়ি পরতে পারি না।পরলেও সামলাতে পারি না।
আবির:- তোমায় সামলাতে হবে না।
আমি আছি না? আমি’ই সামলিয়ে দিব। তুমি শুধু কোনোরকম ভেঁজা জামা চেঞ্জ করে শাঁড়িটা প্যাচিয়ে রুমে আসো….
নীলিমা:- তারপর???
আবির:- এত কথা বলো না তো…
তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করো।
নীলিমা:- আচ্ছা….
আবির:- হুম করো।।।।।
নীলিমা:-……. (চুপ)
আবির:- এভাবে স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে আছ কেন???
নীলিমা:- আপনি একটু বাইরে…(…..)….???????
আবির:- Oh,sorry….??
আসলে মনে’ই ছিল না……???
নীলিমা:- ???
আবির:- ????

আবির বাথরুম থেকে বেরিয়ে রুমে চলে যায়।রুমে গিয়ে পরনের কাপড়-চোপড় চেঞ্জ করে নেয়।

একটু পর নীলিমা বাথরুম থেকে আসে। আবির নীলিমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নেয়।তারপর কোনোরকম হাসি আটকিয়ে বলে__
” এই তাহলে তোমার অবস্থা?”☺☺
নীলিমা:- আমি তো বলছি আমি পরতে পারি না। আপনি’ই তো বললেন শাঁড়ি প্যাচিয়ে রুমে আসতে।
আবির:- বলছি….
তাই বলে সত্যি সত্যি তুমি…???????????

নীলিমা:- ????
আবির:- ??????
নীলিমা:- ????????
আবির:- হয়ছে,হয়ছে।এদিকে আসো……

নীলিমা:- কেন???
আবির:- শাঁড়ি পরিয়ে দেয়।
নীলিমা:- না, লাগবে না….
আবির:- পরে যাবে তো;
নীলিমা:- পরব না।ঠিক সামলে নিব।
আবির:- ভালো।
নীলিমা:- হুম।
আবির:- ঘুমাবে না????
নীলিমা:- হুম।
আবির:- শুয়ে পরো তাহলে।
নীলিমা:- দরজা দিবেন না???
আবির:- নাহ…..
নীলিমা:- মিশিয়ে আসি???
আবির:- দরকার নাই…..
নীলিমা:- আচ্ছা….
আবির:- কি আচ্ছা???
নীলিমা:- দরকার নাই।
আবির:- হুম।দরকার নাই।ঘুমাও….
নীলিমা:- একটু জায়গা দেন….
আবির:- হুম, যাও…(সরে গিয়ে জায়গা দিয়ে)
নীলিমা:- গুড নাইট….
আবির:- নাইট…..
নীলিমা:- এটা কোনো ওয়িশ হলো?
আবির:- দুঃখী মানুষের আবার ওয়িশ…..এটুকু যে মুখ থেকে আসল। তুমি বলে এটুকু বললাম।যা মুড খারাপ অন্য কেউ হলে তো কথায় বলতাম না।
নীলিমা:- Mood off? Why?
আবির:- জানি না….
নীলিমা:- Oh….
আবির:- ঘুমাও……
নীলিমা:- আচ্ছা……….

ঘন্টাখানেক পর_
“নীলিমা…..”
ঐ নীলিমা…….?!!!
নীলিমা….

আবির নীলিমাকে ডেকেই চলছে।
নীলিমা ঘুমের ঘোরেই বলছে__
” হুম?”
আবির:- চলো না….
নীলিমা:- কোথায়???
আবির:- সুখের দেশে।
নীলিমা:- সেটা আবার কোথায়? আর কিভাবে যাব???
আবির:- খুব কাছে….
যেতে হয় সুখের নায়ে চড়ে….
নীলিমা:- সুখের না’য় কোথায় পাব???
আবির:- বুকে আসো…..

আবিরের কথা শুনে নীলিমা রীতিমত লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসে। ঘুম যেন একলাফেই নীলিমার চোখ থেকে পালিয়ে গেছে।
নীলিমা আবিরের দিকে তাকায়।
আবির তখনও বিড়বিড় করে কথাগুলো বলেই চলছে। নীলিমা আবিরকে আস্তে করে ডাক দেয়। আবির বিছানায় উঠে বসে। ঘুমন্ত চোখ নিয়ে নীলিমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে?
নীলিমা ভ্রু কুঁচকে বলে সেটা তো আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করব। কি হচ্ছে এসব???
আবির চোখ বড় বড় করে বলে__
” কি হচ্ছে?”
নীলিমা:- আপনি বাজে বকছিলেন ঘুমের ঘোরে।
আবির:- তো..???
নীলিমা:- কেন বলছেন ওসব?
আবির:- আশ্চর্য! আমি কি বলছি আমি নিজেই তো জানি না। আর আমি কি ইচ্ছে করে বলি নাকি? ঘুমের ঘোরে বলে ফেলি….
নীলিমা:- আর বলবেন না কখনো….
আবির:- নীলিমা!
ঘুমের ঘোরে কথা বলাটা আমার ছোটবেলার অভ্যাস। আমি তো চাই না বলতে, মুখ দিয়ে এসে যায়। মানুষ ঘুমিয়ে নিরবে স্বপ্ন দেখে, আর আমি সবাইকে জানান দিয়ে স্বপ্ন দেখি।
আমার মত খোলা মনের অধিকারী আর কয়জন আছে বলো????????
নীলিমা:- ভালো…..

নীলিমা বিছানা থেকে উঠে গিয়ে টিভি ছাড়ে। আবির নীলিমার পিছুপিছু সোফায় গিয়ে বসে। নীলিমা টিভি অন করে একের পর এক চ্যানেল পাল্টেই যাচ্ছে।

আবির:- টিভিতে এত রাত্রে বাজে জিনিস ছাড়া আর কিচ্ছু পাবে না।আমার ল্যাপটপে একটা মজার মুভি আছে।দেখবে???

নীলিমা শুধু একবার আবিরের দিকে ফিরে তাকালো। আবির বসা থেকে উঠে ল্যাপটপ’টা আনে। নীলিমার পাশে বসে। আবির ল্যাপটপ ওপেন করে নীলিমার দিকে ফিরিয়ে দেয়।

নীলিমা:- আমি ইংলিশ মুভি দেখি না….
আবির:- দেখো’ই না, মজা পাবে…

আবির-নীলিমা একসাথে বসে
মুভি দেখছে। নীলিমার কাছে ভালো’ই লাগছে মুভি’টা। ভিষণ হাসির একটা মুভি….
নীলিমা মুভি দেখছে আবির নীলিমা’কে দেখছে।ওর মায়ামাখা হাসিমুখটা দেখছে। হঠাৎ করে’ই নীলিমা চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। আবির হকচকিয়ে উঠে।
দু’চোখ বন্ধ করে নীলিমা ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আবির যেন কিছু’ই বুঝতে পারছে না। নীলিমার হাটু থেকে ল্যাপটপ’টা নিয়ে আবির ল্যাপটপের দিকে তাকালো। ল্যাপটপটা নিয়ে আবির সেটার স্ক্রিনে তাকালো। স্ক্রিনে তাকিয়ে আবির ওর জিহ্বায় কামড়ে মুচকি হেসে মনে মনে বলে উঠে_
” ওহ্! এই কাহিনী তাহলে?”

সুপ্রিয় পাঠক/পাঠিকাবৃন্দ__
নীলিমা ঠিক তখন’ই চোখ বোজে যখন মুভির হিরো তার হিরোইনকে অকস্মাৎ জাপটে ধরে লিপকিস করা শুরু করে। চোখ বোজার পরও বার বার ওর মনের ক্যানভাসে ভাসছিল ঐ দৃশ্যটা। কেন জানি, ভিতরের মুহূর্তেই অস্থিরতা শুরু হলো। আর তাই নীলিমা চোখ বোজেও ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

আবির:- কি হলো?!!!???
নীলিমা:- আমি ঘুমাবো।

নীলিমা সোফা থেকে দৌঁড়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পরে।
আবিরও মুচকি হেসে নীলিমার পাশে গিয়ে শুয়ে পরল। নীলিমাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে চোখ দুটো বন্ধ করে আবির। এদিকে নীলিমা?!!!
ওপাশ থেকে আবিরের দিকে ফিরে। আবিরের ঠোঁটের খুব কাছে হাত নিয়ে গিয়ে হাতটা পিছিয়ে আনে নীলিমা। কিছুক্ষণ পর একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে আবিরের ঠোঁটের দিকে নীলিমা ওর ঠোঁটজোরা নিয়ে যায়। ঠোঁটগুলো বিকৃত করে নীলিমা যে’ই না আবিরের ঠোঁটে ঠোঁট লাগাতে যাবে, ওমনি আবির চোখ মেলে তাকাই। নীলিমাকে ওভাবে দেখে আবির চোখ বড় বড় করে নীলিমার দিকে তাকালো।নীলিমা ইয়ে মানে বলে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে।

আবিরও শুয়া থেকে উঠে বসে নীলিমাকে বলে__
” কি করছিলে?”
নীলিমা ভয়ে অন্য দিকে ফিরে তাকাই।
আবির আবারো জিজ্ঞেস করে কি হলো? কি করছিলে???
নীলিমা ওদিকে মুখ করে’ই বলে কিছু না….
আবির আবারো বলে__
” সত্যি করে বলো মতলব কি?”
নীলিমা কোনো কথা না বলে চুপ করে বসে আছে ওদিকে তাকিয়ে।

আবির:- এই দেখো! আমি কথা বলছি আর ওনি অন্যদিকে ঘুরে বসে আছে।??
এদিকে তাকাও বলছি….??

নীলিমা ভয়ে ভয়ে আবিরের দিকের তাকাই।
আবির:- সত্যি করে বলো তো কি করতে চাইছিলে???
নীলিমা:- ফুঁ।
ফুঁ দিচ্ছিলাম। আপনার চোখের পাতায় মাছি এসে বসেছিল, যদি আপনার ঘুম ভেঙে যায় তাই ফুঁ দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছিলাম।
আবির:- মিথ্যে কথা বলো কেন?
তুমি ফুঁ নয়,চোঁ করছিলে। আমি স্পষ্ট দেখেছি তোমার ঠোঁট এরকম বাকা হয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। কি???
এবারো মিথ্যে বলবে??????
এবার তো অন্তত সত্যিটা বলে দাও। বলো যে তোমার মতল….(….)…..???

আবির সম্পূর্ণ কথা বলতে পারেনি।
তার আগেই নীলিমা ওর ঠোঁট দ্বারা আবিরের মুখটা বন্ধ করে দেয়। নীলিমা আবিরের ঠোঁট….(………)….???

মিনিট দু’য়েক পর নীলিমা ছেড়ে দেয় আবিরকে।
নীলিমা:- এবার হলো? এই করতে চাইছিলাম আমি আপনাকে…..

আবির হতভম্ব হয়ে নীলিমার দিকে তাকিয়ে আছে।

চলবে…..

গল্প:-♥ফুলশয্যা♥ পর্ব:- ০৬

0

গল্প:-♥ফুলশয্যা♥
পর্ব:- ০৬
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

আবির-নীলিমার এমন চোখাচোখি দেখে ইমন মণিকে ধাক্কা দিয়ে সে দৃশ্য দেখায়। মণি কিছুক্ষণ সে দৃশ্য অবলোকন করে একটা বার কয়েক শুকনো কাশি দিয়ে রসিকতার ছলে বলে__
“এখানে আপনারা ছাড়াও আরো জলজ্যান্ত দু’দুটো প্রাণী আছে ভাইয়া।”
আবির-নীলিমা একে অপরের দিক থেকে লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নেয়।
তারপর সবাই চুপচাপ খাওয়া শুরু করে। নীলিমা’কে আবির একটা বারের জন্যও বলেনি খেয়ে নাও কিংবা খেয়েছ???
নীলিমাও তাই খাইনি।
সবার খাওয়া শেষ।
আবির চলে গেলে ইমন-মণিকে নীলিমা ওপরে ওর রুমে পাঠিয়ে দিয়ে বাসনপত্তর পরিষ্কার করার কাজে লেগে যায়।বাসনপত্তর ধোঁয়ার সময় নীলিমা টের পায় ওর আঙ্গুলটা সত্যি’ই অনেকাংশে কেঁটে গেছে।
বা’হাত দিয়ে নীলিমা কোনোরকম ভরা বালতিতে বাসনপত্তর চুবিয়ে উঠিয়ে ফেলে। তারপর ধুয়া বাসনগুলো ধাপে ধাপে সাজিয়ে রেখে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
-ঠিক সে সময় টান পরে নীলিমার হাতে। মনে হচ্ছে পিছন থেকে কেউ হাতটা টেনে ধরে আছে। নীলিমা পিছু ফিরে তাকালো। আবির নীলিমার হাতটা টেনে দাঁড়িয়ে বলছে__
“চলো খাবে…”
নীলিমা পলকহীনভাবে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে_
হঠাৎ করে আবিরের এতটা চেঞ্জ কিভাবে সম্ভব?

আবির:- কি হলো? খাবে বলছি শুনছ না??? বসো….

আবির নীলিমার দিকে একটা চেয়ার টেনে দেয়। নীলিমা অবুঝ শিশুর মত কোনো কথা না বলে বসে পরে চেয়ারে। আবির প্লেটে ভাত বেড়ে এনে তরকারী দিয়ে এগিয়ে দেয় নীলিমার দিকে।
_ নাও…এবার খেয়ে নাও।
নীলিমা এবারো কোনো কথা না বলে হাত ধূয়ে যেই না ভাত মাখতে যাবে ওমনি উহ্ করে কুকিয়ে উঠল।
কাঁটাস্থানে তরকারীর মরিচ লেগে যাওয়ায় প্রচন্ড জ্বলছে সে স্থান। আবির নীলিমার সামনে থেকে প্লেট’টা নিয়ে যায়। অতঃপর নিজে হাত ধূয়ে ভাত মাখে। আবির ভাত মেখে নীলিমাকে বলে চেয়ারটা সামনে নিয়ে আসতে যাতে ভাত মুখে তুলে দিতে সুবিধে হয় কিন্তু নীলিমা ওর জায়গা থেকে চুল পরিমান নড়েনি।শেষে আবির নিজেই ওর চেয়ার’টা নীলিমার কাছে টেনে নেয়। তারপর চেয়ারে বসে প্লেটটা হাতে নেয়। একমুঠো ভাত হাতে নিয়ে নীলিমাকে হা করতে বলে। পরপর তিনবার বলার পর মুখ খুলে নীলিমা। হা করে সে।
আবির নীলিমার মুখের ভিতর একমুঠো ভাত পুরে দেয়। প্রথমে একটু লজ্জা পেলেও পরে আবিরের ধমক শুনে অনায়াসে আবিরের দেওয়া মুঠোর পর মুঠো ভাত গিলে খেয়ে নেয় নীলিমা। খাওয়া শেষে পানি খাওয়ার জন্য যেই গ্লাসটি আনতে যাবে ওমনি আবির গ্লাসটা ধরে ফেলে। তারপর_
” তুমি না! আমি খাইয়ে দিচ্ছি…!”
নীলিমা অবুঝ বালিকার মত আবিরের কথা শুনে নিয়ে আবিরের হাতেই পানি খেয়ে নিল।
খাওয়া শেষে আবির নীলিমাকে বসিয়ে প্লেট ধূয়ে রেখে আসে। তারপর_

আবির:- কি হলো? চলো….
নাকি রাত’টা এখানেই কাটাবে ভাবছ???
নীলিমা:- আচ্ছা…..
আবির :- কি আচ্ছা???
নীলিমা:- আপনি উপরে যান আমি আসছি।
আবির:- কোনো কথা নয়…
তুমি এখন যাবে আমার সাথে।
নীলিমা:- ঠিক আছে, চলেন…..

আবির-নীলিমা সিড়ি বেয়ে একসাথে উঠলেও উপরে উঠে সিড়ির ডানদিকে মোড় নেয় নীলিমা।

আবির:- দাঁড়াও….
নীলিমা :- কিছু বলবেন???
আবির:- কোথায় যাচ্ছ?????
নীলিমা:- আমার রুমে….
আবির:- ও রুমে ইমন-মণি শুয়ে পরেছে।
নীলিমা:- তাতে কি হয়েছে? আমি ডাক দেয় গিয়ে…?!
আবির:- মাথা নষ্ট???
ওরা এতদূর থেকে জার্নি করে এসে কেবল শুইল আর তুমি কিনা ওদের…(…..)….???
নীলিমা:- তাহলে আমার কি হবে? আমি কোথায় ঘুমাবো???
আবির :- আমার রুমে চলো….
নীলিমা:- আ…আ…আমি???
আ..আ…আপনার রুমে????
আবির:- ভয় পেয়েছ???
নীলিমা:-……….
আবির:- কি?!!!
ভয় পেয়েছ?????
নীলিমা:- ভয় পাওয়ার কি আছে? আপনি কি বাগ না ভাল্লুক???
আবির:- তার থেকেও বড় কিছু…..
নীলিমা:- ঠিক বুঝলাম না…..
আবির:- আগে রুমে চলো। তারপর বুঝাচ্ছি…..
নীলিমা:-…………
আবির:- কি হলো? চলো…..

নীলিমা আবিরের পিছুপিছ আবিরের রুমে ঢুকে। রুমে ঢুকে’ই ধপাশ করে আবির দরজাটা লাগিয়ে দেয়। দরজা লাগানোর শব্দে নীলিমা কিছুটা ভরকে যায়। তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে_
“দরজা বন্ধ করছেন কেন?”

ঘুমাবো…
খুব ঘুম পাচ্ছে তাই দরজা বন্ধ করলাম।
নীলিমা কাঁপা স্বরে বলল__
” দরজা’টা বন্ধ করে’ই ঘুমোতে হবে?”
আবির:- জি, বন্ধ করেই ঘুমোতে হবে। কেন তোমার কোনো সমস্যা???”
নীলিমা:- আমি আবার রুমের দরজা বন্ধ করলে ঘুমোতে পারি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।মনে হয় এই বুঝি মরে যাব…..
আবির:- চুপ!
একদম চুপ। আর কখনো যাতে এমন কথা না শুনি। আমি দরজা খুলে দিচ্ছি….

আবির নীলিমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে দরজা’টা খুলে দিয়ে আসল।

আবির:- এবার কোনো সমস্যা???
নীলিমা:- না…..
আবির :- এবার তাহলে ঘুমিয়ে পরো।
নীলিমা:-…….
আবির:- কি হলো? আবার গাল ফুলিয়ে বসে আছ যে??? আবার কি সমস্যা???
নীলিমা:- আমি বেড শেয়ার করে শুইতে পারব না।
আবির:- তো…???
নীলিমা:- আমি সোফায় শুইব আর আপনি খাটে শুয়ে থাকুন….

আবির আর কোনো কথা বাড়ালো না।রাগে কটমট করতে করতে বলল_
” ঠিক আছে! তোমার যখন এতই সমস্যা আমার সাথে থাকতে তখন থাকতে হবে না। তবে তোমায় সোফায়ও দিতে পারব না। সোফায় শুইব আমি। তুমি শুইবে খাটে….”

নীলিমা:- ঠিক আছে….
আবির:- হুম, এবার শুয়ে পরো।একটু পর ফজর নামাজের আজান দিবে।

নীলিমাকে খাটে শুইতে বলে আবির সোফায় শুয়ে পরে।
নীলিমা খাটে শুয়ে আছে আর ভাবছে__
” এ আমি কোন সে মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছি? আমি তো কারো মায়ার বন্ধনে আটকা পরতে চাই না। তবে কেন ওনার জন্য এত খারাপ লাগছে?
কেন বুকটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে???

নীলিমা বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে। ঘুমতো ধরা দিচ্ছে’ই না উল্টো কেউ যেন বুকের ভেতর হাতুড়ি দিয়ে পিটাচ্ছে….
নীলিমা একবার কুলবালিশ বুকে জড়িয়ে নিচ্ছে তো আরেকবার কুলবালিশ ছেড়ে এপাশ-ওপাশ করছে…
এ এক অন্যরকম দৃশ্য।
যা সোফায় শুয়ে থেকে আড়চোখে খেয়াল করছে আবির।

কিছুক্ষণ পর_
আবির সোফা থেকে উঠে পরে। শরীরটা টানা দিয়ে বলে_
” সারাদিনে অনেক ধকল গেছে শরীরের উপর দিয়ে। খুব ঘুম পাচ্ছে। এখন ঘুমিয়ে পরলে আবার একটু পরই উঠে পরতে হবে। রান্না বান্নায় হেল্প করতে হবে। আমি বরং কাজের লোকদের ফোন করে জানিয়ে দেই!
আবির কাজের লোকদের ফোন করে বলে সকালে ৭টার ভেতর যাতে বাসায় থাকে। তারপর ক্যালসিয়ামের ট্যাবলেট হাতে নিয়ে বলে__
” এই হলো ঘুমের ট্যাবলেট! আজ একসাথে ৫টা খাবো। তারপর ঘুম দিব। আহা! কি মজার ঘুম…????”
আবির ক্যালসিয়ামের ট্যাবলেট থেকে ৫টা ট্যাবলেট খেয়ে সোফায় শুয়ে পরে। এদিকে খাটে শুয়ে নীলিমা চোখ বন্ধ করে রাখলেও আবিরের কথাগুলো ঠিক শুনতে পেল। আবির এখন ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমের প্রস্ততি নিচ্ছে। না জানি কতক্ষণ ধরে ঘুমায়? ওনি আবার জার্নি করে এসেছেন। যায়…
ওনাকে বরং সোফা থেকে ডেকে আনি। খাটে শুইতে বলি। একটা রাতেরই তো ব্যাপার!!! ”

নীলিমা আবিরকে ডেকে তুলে।তারপর_
আবির :- নীলিমা! আমি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছি।খুব ঘুম পাচ্ছে।ডাকো কেন???
নীলিমা:-ইয়ে মানে বলছিলাম কি আপনি খাটে ঘুমাতে পারেন। আমার কোনো সমস্যা হবে না….??
আবির:- কিন্তু আমার সমস্যা হবে মিসেস…..
নীলিমা:- কি সমস্যা???
আবির:- আমি ঘুমের সময় একজায়গায় স্থির থাকি না। হাত-পা ছুড়াছুড়ি করি। আর সাথে যদি কেউ থাকে তাহলে তো কোনো কথায় নেই। একেবারে সাথের মানুষটাকে কুলবালিশ বানিয়ে হাত-পা উঠিয়ে দিয়ে শুয়ে থাকি….??

নীলিমা:-……
আবির :- হা, হা চুপ হয়ে গেলে???
নীলিমা:- আপনি শুইতে পারেন।আমার কোনো অসুবিধে হবে না। আর আমি কিছু মনেও করব না।
আবির:- Oh,Really?
নীলিমা:- হুম…..
আবির :- দেখো আবার পরে কোনো ঝামেলা যেন না হয়…!!!
নীলিমা:- আমি কোনো ঝামেলা করব না।আপনি নিশ্চিন্তে শুয়ে পরুন।

আবির আর কোনো কথা না বলে একলাফে সোফা থেকে খাটে চলে আসে। তারপর সোজা হয়ে শুয়ে চোখটা বন্ধ করে ফেলে।

একটু পরই আজান দিয়ে দেয়।
নীলিমা আবিরকে ডাকতে গিয়েও ডাকল না যদি ঘুমের ব্যাঘাত হয় সে জন্য।নীলিমা অজু করে নামাজ পরার জন্য উঠে নিচে চলে গেলে আবিরও লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। তারপর চটজলদি অজু করে নামাজটা আদায় করে নেই রুমে।অতঃপর নীলিমা আসার আগেই পূর্বেই ন্যয় ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে।

এদিকে নীলিমা এসে দেখে আবির তখনও বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। নীলিমা আবিরের কপালে গিয়ে ছোট্ট একটা চুমু এঁকে দিয়ে সোফায় শুয়ে পরল। যেহেতু এটা শহর এলাকা তাই নামাজ পরে একবার শুইলে সকাল আট’টায় উঠলেও নো প্রবলেম….
নীলিমা একটা ঘুম দেওয়ার জন্য সোফায় গিয়ে শুইল।
কিন্তু আবিরের মুখের দিকে তাকাতেই ভেতরটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে ওর। নীলিমা সোফায় শুতে পারল না। দরজাটা বন্ধ করে ধীর পায়ে আবিরের পাশে গিয়ে শুয়ে পরে। আবিরের পাশে গিয়ে শুয়ার পরও নীলিমার অস্থির অস্থির ভাবটা যেন কাটেনি। নীলিমা মিনিট ত্রিশেক বিছানায় এপাশ ওপাশ করে।এরই মাঝে বার কয়েক আবিরকে ছুঁতে গিয়েও ছুঁইনি।
এদিকে পুরো ব্যাপার চোখ বোজে থেকেও জেনে যায় আবির।
বুঝতে পারে আবির একটা হাত বার বার ওর পিঠের খুব কাছে এসেও সরে গেছে। আবির চোখ বোজেই ওপাশ থেকে নীলিমার মুখী হয়ে শুইলো। নীলিমা আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে জল ছলছল চোখে। একটু পর’ই আবির ইচ্ছেকৃতভাবেই নীলিমার উপর ওর একটা হাত রাখে। নীলিমা হাতটা সরিয়ে দেয়।এবার আবির ঘুমের মধ্যেই নীলিমার অনেকটা কাছে চলে আসে। তারপর আলতো করে নীলিমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমের ভান করেই। আবির জানে নীলিমা ওকে এখনি সরিয়ে দিবে।
কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেল নীলিমা কিছুই করছে না। আবির ব্যাপারটা বুঝার জন্য নীলিমার থেকে একটু পিছু সরে যাচ্ছিল ঠিক তখন’ই নীলিমা আবিরকে জড়িয়ে ধরে। আবির আবারো নীলিমা আলতো করে জড়িয়ে ধরে। নীলিমা আবিরকে প্রথমে জড়িয়ে ধরে। তারপর শক্ত করে জাপটে ধরে। শক্ত থেকে আরো শক্ত করে নীলিমা আবিরকে জড়িয়ে ধরে আছে। আবির বার কয়েক চেষ্টা করে সারিয়ে নিতে কিন্তু পারেনি। নীলিমা এমন নিবিড়ভাবে ওকে জড়িয়ে ধরে আছে যে আবির সেখান থেকে বেরোতে পারছে না।

আবির আর চেষ্টা করেনি ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য। আবির অবশ্য ঘুমাইনি তবে চোখ বোজে আছে….

একটু পর নীলিমা আবিরকে ছেড়ে দেয়। উঠে চলে যায় আবিরের কাছ থেকে।

অনেকক্ষণ হয়ে গেল।
নীলিমা রুমে আসছে না দেখে আবির শুয়া থেকে উঠে পরে। বেরিয়ে যায় রুম থেকে। বাথরুম ওয়াশরুম খুঁজে ছাদে যায় আবির। দুর থেকেই আবির দেখে নীলিমা ছাদের কর্ণারে চুপটি করে দু’হাটু চেঁপে বসে আছে। আবির একটু কাছে যেতেই টের পায় নীলিমা কাঁদছে। আবির আর একমুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালো না। দৌঁড়ে নিচে নেমে যায়। মণির কথামতো ফোন করে আবির আবিরের বাবা-মা, বোন দুলাভাইকে।
আবির ফোন করে জানাই নীলিমা মা হতে চলেছে। ওকে যেন সবাই এসে দেখে যায়….
এদিকে কাজের লোক চলে আসে।
মণি ছাদে যায় নীলিমাকে আনতে।

সন্ধ্যার পর পর’ই আবিরের পুরো ফ্যামিলি এসে উপস্থিত হয় ঢাকায়। সবাই এসেই কি খুশি।
আবিরের মা তো খুশিতে আত্মহারা।
নীলিমাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে থাকে। আবিরের বাবা এসে নীলিমার হাতে হরেকরকমের ফলের প্যাক ধরিয়ে দিয়ে বলে__
“এগুলো তোমার জন্য। তুমি খাবে সব।”
আবিরের বোন এসে নীলিমার পাশে বসে বলল__
” শুনো নীলিমা! একদম কাজকর্ম করবে না। সবসময় হাসিখুশি থাকবে আর টেনশন মুক্ত থাকবে।”

আবিরের দুলাভাই_
” নীলিমা! এটা কিন্তু তোমার প্রথম বেবি। সো বি কেয়ারফুল।”

কাজের মেয়ে নীলিমার হাতে একটা বাচ্চার ক্যালেন্ডার ধরিয়ে দিয়ে বলল সেটা যাতে প্রতিদিন দেখে।তাহলে ঐ রকম চাঁদের মত সুন্দর বাচ্চা হবে।

নাহ!
আর পারছে না নীলিমা।
অনেক হয়েছে।
এবার কথা বলতেই হবে আবিরের সাথে….

নীলিমা হুট করে আবিরের রুমে প্রবেশ করে। আবির তখন বসে ল্যাপটপ টিপছিল, নীলিমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব রেগে আছে। যেকোনো মুহূর্তে একটা কিছু ঘটে যেতে পারে। আবির আগেবাগেই ল্যাপটপটা বন্ধ করে নীলিমার দিকে তাকালো।

নীলিমা অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল__
” কেন করলেন এমনটি?”
আবির নীলিমাকে বসতে বললে নীলিমার জবাব__
” আমি বসতে আসিনি। আমি জানতে এসেছি। জেনেই চলে যাব।”

আবির:- নীলিমা!
তুমি শান্ত হয়ে বসো আগে।
নীলিমা:- আমি কিভাবে শান্ত হবো?
আমি এটা কিভাবে করলেন? কেমন করে আপনি ওদের এত বড় মিথ্যেটা বলতে পারলেন???
ওরা সত্যিটা যখন জানতে পারবে, তখন কি অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন? বুঝতে পারছেন ওরা কতটা কষ্ট পাবে???
কেন করলেন এমনটা???
সত্যিটা জানার পর ওদের আমি কিভাবে মুখ দেখাব???
আবির:- শান্ত হও নীলিমা।
মাথা ঠান্ডা করো….
নীলিমা:- আমি পারছি না শান্ত হতে।পারছি না মাথা ঠান্ডা করতে।
আবির:- আমি বুঝতে পারিনি এমন হয়ে যাবে। পরিণাম না ভেবেই আমি এমনটা করছি। স্যরি….
নীলিমা:- Sorry, বললে সবকিছুর সমাধান হয়ে যায় না আবির সাহেব।
আপনি ভুল করছেন। অনেক বড় ভুল। যার কোনো সঠিক সমাধান নেই।

নীলিমা চলে যাচ্ছিল।
আবির পিছন থেকে ডেকে বলে__
“কোথায় যাচ্ছ?”
নীলিমা:- মায়ের কাছে যাচ্ছি সব সত্যি বলতে। বলতে যাচ্ছি ওরা যা জানে সব মিথ্যে….
আবির:- নীলিমা প্লিজ এ কাজ করো না। ওরা কষ্ট পাবে জানলে….
নীলিমা:- ওরা যখন পরে সত্যিটা জানবে তখন? ওদের সব ধারণা মিথ্যে এটা শুনলে ওরা কি পাবে না কষ্ট???
আবির:- না….পাবে…..না……

নীলিমা:- মানে????
আবির:- মানে ওরা কষ্ট পাবে না।
নীলিমা:- কিভাবে সম্ভব???
আবির:- চলো না আমরা মিথ্যেটাকে সত্যি করে ফেলি….
নীলিমা:- মানে????

আবির:- অতি সহজ কথা। সেটাও বুঝতে পারছ না???
তুমি না সায়েন্সের স্টুডেন্ট ছিলে?
বায়োলজিতে পড়’নি জীবের বিকাশ সম্পর্ক???
পড়’নি কিভাবে কালক্রমে জীবনের উৎপত্তি আর বিকাশ ঘটে চলেছে???
নীলিমা:- You…..????
আবির:- চলো না সেই নিয়মেই একটু সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আমাদের বাবা-মা’কে উপহার দেয় ডজনখানেক নাতি-নাতনী…..??

নীলিমা:- আ….প….আপনি…??????
আবির:- ?????

চলবে………

গল্প:- ♥ফুলশয্যা♥ পর্ব:- ০৫

0

গল্প:- ♥ফুলশয্যা♥
পর্ব:- ০৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

আবির নীলিমার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল। তারপর মণির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল_
” মণি! এখনো দাঁড়িয়ে আছ?
যাও…চালু করো।দেখি, সিসি টিভির ফুটেজ কি বলে….???”
মণি যাচ্ছি বলে হাসি চেপে এগিয়ে মিছেমিছি এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। হঠাৎ’ই পিছন থেকে ডাক দেয় নীলিমা। মণি পিছু ফিরে তাকায়। জিজ্ঞেস করে_
“কিছু বলবি?”
নীলিমা এক নিঃশ্বাসে এত্তগুলো কথা বলে ফেলে। নীলিমার ভাষ্যমতে__
” মণি!
আসলে কয়েকদিন যাবৎ লক্ষ্য করছিলাম রুমটা খুব অপরিষ্কার এবং নোংরা। তাই আজ যখন ওনি বাসা থেকে বের হয়ে গেল, ভাবলাম এই সুযোগে রুমটা পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। পরিষ্কার করার জন্য রুমের সব জিনিসপত্র একসাথে জরোও করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে ঘুম চলে আসে চোখে, সেই সাথে ক্লান্তিভাবটাও।তাই ভাবলাম একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক।কিন্তু এভাবে ঘুমিয়ে যাব যে বুঝতে পারিনি।
তোরা যখন ডাক দিলি, তখন’ই জাগলাম।”

মণি “থ” হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ইমন মণির দিকে তাকিয়ে বলল_
” ব্যস! হয়ে গেল।
বোন আমার খাসা গল্প শুনিয়ে দিল।এরপর আর কষ্ট করে সিসি টিভির ফুটেজ চালু করার মানেই হয় না। কি বলেন আবির সাহেব?”

আবির-মণি দুজন তখন মুখ টিপে হাসছিল, ইমনের কথা শুনে আবির কোনোরকম হাসিটা চেপে উত্তর দিল__
“হ্যাঁ, সেটাই তো ইমন ভাই…”

ইমন:- তা মিসেস আবির!
আমাদের কি রাতভর এখানে এভাবেই দাঁড়িয়ে রাখবেন? কতদূর থেকে খুশির খবর শুনে এসেছি কয়েকদিন বেড়াবো বলে। বেড়ানোর স্বাদ যে প্রথম দিনেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।”
নীলিমা:- খুশির খবর?
সেটা আবার কি???
মণি:- ঐ যে ইমন মামা হতে চলেছে।
নীলিমা:- কি???
কার মামা???
কিসের মামা????
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
মণি:- তুই এসব বুঝবি কিভাবে?
তুই তো ভেঁজা মাছটা উল্টে খেতেও জানিস না, থাক।
তোর বুঝে কাজ নেই। আবির ভাইয়া!
একটু এদিকে আসেন তো।
বজ্জাত মাইয়া তো কিছু বলবে না, আপনার থেকেই বরং শুনে নেই আপনাদের কাছে আসার ইতিহাস….!!!!☺☺☺

মণি-আবির-ইমন একসাথে রুমের বাহিরে চলে গেল।
নীলিমা কিছু বলতে যেয়েও পারল না। মণিকে রুমে রেখে তিনজন মিলে প্রায় মিনিট ত্রিশ হবে কিসব ফুসুর ফুসুর করল। তারপর একসঙ্গে রুমে প্রবেশ করল। নীলিমা ততক্ষণে রুমটা ঝাড়ু দিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। ওরা আসার সাথে সাথেই নীলিমা সোফার উপর ঝাড়ু রেখেই মণির কাছে ছুটে গেল। তারপর__
“মণি! শুন না..(…)….”
মণি:- চুপ, একদম চুপ!
আমি তোর কোনো কথায় শুনতে চাই না। যা শুনার শুনে নিয়েছি ভাইয়ার থেকে।
নীলিমা:- আমিও শুনাতে চাই না।
মণি:- তো..!!!??
এভাবে ডাকছিস কেন???
নীলিমা:- ওনি তোদের কি বলছেন?
মণি:- সেটা তোকে বলতে যাব কেন?
ওনি আমাদের বিশ্বাস করে বলছে।সবকিছু খুলে বলছে। তা তোকে শুনাবো কেন?????
নীলিমা:- সব মানে…???
ইমন:- সব মানে সব….
যা হয়ছে আর কি….(….)…..??
নীলিমা:- ???

আবির:- নীলিমা! ওরা অনেক দুর থেকে জার্নি করে এসেছে। ওদের আগে বসতে তো দাও। আর কি রান্না করছ? খেতে দাও। খুব খিদে পেয়েছে…..
নীলিমা:- ঠিক আছে…..
ভাইয়া-মণি চল….

ইমন মণি নীলিমার পিছু পিছু নীলিমার রুমে ঢুকল।নীলিমা ওদেরকে নিজ রুমে রেস্ট নিতে বলে রান্না করে প্রবেশ করল। চুলোয় ভাত বসিয়ে চটজলদি তরকারী কুটতে লাগল নীলিমা। আবিরের এভাবে ফিরে আসা সাথে ইমন-মণির আগমন, সুখবর কিছুই যেন নীলিমার মাথায় ঢুকছে না। আনমনে ভাবতে ভাবতে ধারালো ছুড়িটা কখন যে আঙ্গুলে বিধে যায় সেটা টের’ই পায়নি নীলিমা। যখন টের পায় তখন আঙ্গুল থেকে অনেকটা রক্ত ঝরে যায়। ব্যথায় কুকিয়ে উঠে নীলিমা। আহ্ করে চিৎকার দেয়।
পাশেই ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে ঢুকছিল আবির।
প্রাণপাখি নীলিমার চাপা কান্না তার বুকে শিলের মত বিধে। ছুটে আসে ওয়াশরুম থেকে রান্নাঘরে।

নীলিমা তখন কাটা আঙ্গুল ধরে কান্না করছিল। আবির নীলিমার কাটা আঙ্গুল দেখে শিউরে উঠে।ছুটে যায় নীলিমার কাছে। চোখের সামনে নীলিমার এমন করুণ অবস্থা সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছিল আবিরের। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আবির নীলিমার কাটা আঙ্গুলটা ধরে সেটা মুখে পুরে দেয়। শুষে নেয় নীলিমার আঙ্গুলের সবটা রক্ত। নীলিমা অবাক বিস্ময়ে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর আবির ছেড়ে দেয় নীলিমার হাত।
নীলিমা তখনও আবিরের দিকে সেভাবেই তাকিয়ে আছে।

আবির:- তোমাকে রান্না করতে কে বলছে???(জল ছলছল চোখে)
নীলিমা:- আসলে সকালে ছুটি দিয়ে দিছিলাম কাজের লোকদের। পরে আর রান্না করা হয়নি…
তাই ভাবছিলাম আমি’ই রান্না করি…
আবির:- মানে???
ছুটি দিয়েছ মানে? কিসের ছুটি দিয়েছ ওদের???
নীলিমা:- আপনি তো বিদেশ চলে যাবেন বলছেন, তাই… (…)….
আবির:- তাই আমার সাথে রাগ করে ওদের বিদায় করে দিয়েছ এই তো???
নীলিমা:- না, না…ঠিক তা না…
আমি তো…..(…)….
আবির:- ব্যস, এনাফ!
আর শুনতে চাই না। রুমে যাও….
নীলিমা:- কিন্তু….
আবির:- কোনো কিন্তু নাই।
তুমি রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। রান্না’টা আমি দেখছি।
নীলিমা:- আপনি…(….)…..
আবির:- বললাম না রুমে যেতে। এক কথা আর কতবার বলব???(ধমকের স্বরে)
নীলিমা:- যাচ্ছি….(কাপা স্বরে)

নীলিমা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শাঁড়িটা পাল্টে নিল। তারপর আবারো চলে আসল কিচেনে__
“আমি বলছিলাম কি আপনি তো…(…)….”

আবির:- তুমি আবারো এসেছ এখানে???তোমায় বলছি যে রুমে যাও সেটা কি তোমার কানে ঢুকেনি???
নীলিমা:- ঢুকছে।
আবার বেরও হয়ে গেছে।
আবির:- মানে???
নীলিমা:- মানে ওরা শুধু শুধু বসে আছে। আপনি গিয়ে বরং ওদের একটু সঙ্গ দেন আর মুড়ি-চানাচুর মেখে দিয়ে আসুন। আমি ততক্ষণে নুডলস রান্না করে ফেলি। মণি আবার নুডলস খুব পছন্দ করে।
আবির:- যা করার আমি করছি। তুমি বরং ওদেরকে গিয়ে মুড়ি চানাচুর মেখে দিয়ে আসো।
নীলিমা:- আমার হাত যে কেটে গেছে…..???
আবির:- ওহ্…স্যরি।
তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি ওদের দিয়ে আসছি মুড়ি…..

আবির চলে গেলে নীলিমা তাড়াতাড়ি নুডলসটা রান্না করে ফেলে। আবির এসে দেখে নুডলস রান্না কমপ্লিট। নোডলসের বাটিটা নিয়ে যায় আবির রুমে। দিয়ে আসে মণিকে। মণি ততক্ষণে এক তরকারী চুলা থেকে উঠিয়ে আরেক তরকারী বসিয়ে দেয় চুলায়। এদিকে ভাত হয়ে যাওয়াতে ঐ চুলায় চাও বসিয়ে দেয়।

আবির এসে চা চুলায় দেখে বলে__
” বাব্বাহ! চাও বসিয়ে দিয়েছ?”

নীলিমা:- হুম। মণি তো নুডলস খাবে, চা’টা ইমন ভাইয়ার জন্য…..
আবির:- ওহ্, ইমন ভাইয়ার জন্য? ???
আমি তো ভাবছিলাম আমার জন্য…. ????

নীলিমা:- ওহ্, আপনিও খাবেন?
দাঁড়ান দিচ্ছি….
আবির:- থাক…….???
আমি না হয় না’ই বা খেলাম…?
নীলিমা:- কেন??????
আবির:- এমনি….
দাও। চা দাও। দিয়ে আসি….

নীলিমা চায়ের কাপটা আবিরের হাতে ধরিয়ে দিলে আবির চা’টা দিয়ে আসে ইমনকে। দিয়ে আর একমুহূর্ত দেরী নয়। আবার চলে আসে কিচেনে। আজ কেন যেন একমুহূর্তের জন্যও আবিরের মন চাচ্ছে না নীলিমাকে চোখের আড়াল করতে। চা দিয়ে এসে কিচেনের দরজার সামনে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রাণের নীলিমাকে দেখছে। নীলিমা কি মনে করে যেন পিছু ফিরছিল। আবিরকে ঐভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে “থ” হয়ে যায়। কিছুক্ষণ আবিরের দিকে তাকিয়ে থেকে লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিল নীলিমা। এলোমেলো শাঁড়ি দিয়ে শরীরটা ভালো করে তাড়াতাড়ি ঢেকে নেয় নীলিমা। তারপর__
” আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? কিছু লাগবে?”

আবির:- হুম…..
নীলিমা:- কি লাগবে?
আবির:- তোমাকে……???
নীলিমা:- কি???
আবির:- কিছু না। রান্না কতদুর???
নীলিমা:- এইতো প্রায় শেষের দিকে।
আপনি যান। আমি ৫মিনিটের ভিতর খাবার নিয়ে আসছি…..
আবির:- হেল্প করতে হবে???
নীলিমা :- না, আমি পারব…..
আবির:- ঠিক আছে। আসো তাহলে।আমি রুমে গেলাম…..

আবির রুমে চলে গেলে নীলিমা চুলা থেকে তরকারীর পাতিল উঠিয়ে চটজলদি কিচেন’টা গুছিয়ে নেয়। অতঃপর খাবার থরে বিথরে টেবিলে সাজিয়ে রেখে ইমন-মণিকে ডাকতে যায়। ইমন -মণি কিছুতেই খাবার খাওয়ার জন্য রাজি হচ্ছিল না, তথাপি নীলিমা একরকম জোর করে টেনে আনে ওদের। খাবার টেবিলে ওদের বসিয়ে ইচ্ছে মত নিয়ে খাওয়ার জন্য বলে আবিরকে ডাকার জন্য উপরে যায়। আবির তখন রুমের দরজা ক্ষাণিক’টা মিশিয়ে চেঞ্চ করছিল। নীলিমা ভাবল আবির হয়তো রুমে শুয়ে আছে তাই নক না করেই অকস্মাৎ রুমে প্রবেশ করে। অতঃপর নীলিমা ওর চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে।
আবির ড্রেস চেঞ্জ করে নীলিমার দিকে এগিয়ে আসে। তারপর_
” যা হবার তো হয়েই গেছে।
চোখ খুলুন ডাক্তার আপু……..”

নীলিমা ধীরে ধীরে চোখ খুলে।
লজ্জায় আবিরের দিকে তাকাতে পারছে না, তাই নিচের দিকে তাকিয়েই বলল_
” Sorry…..”

আবির:- কি হবে আর স্যরি বলে?
আমার তো সব শেষ হয়েই গেছে……???
নীলিমা:- আমি আসলে বুঝতে পারিনি আপনি রুমে এভাবে…(….)…..
আবির:- বাদ দাও তো।
চলো…..খাবো……

নীলিমা মাথা নিচু করে আবিরের পিছুপিছু রুম থেকে বের হলো। আবির খাবার টেবিলে বসতে বসতে ইমন-মণির দিকে তাকালো।তারপর__
” কি হলো? ভাইয়া বসে আছেন যে?”
ইমন:- বোন-ভগ্নিপতির বাড়ি আসছি। ওদের রেখে খাই কি করে?

আবির বসা থেকে উঠে মণি ইমনের প্লেটে খাবার দিল। তারপর নিজের প্লেটে খাবার নিয়ে বলল__
” নাও মণি!
এবার তোমরা খাওয়া শুরু করো।”

নীলিমা মাথা নিচু করে ডাইনিং টেবিলের বেশ ক্ষাণিক’টা দুরে দাঁড়িয়ে আছে।

মণি:- তোর আবার কি হলো???
এভাবে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন???
নীলিমা:-……..
ইমন:- নীলিমা! তুইও বসে পর…
রাত তো প্রায় শেষের দিকে….
আবির:- মণি…
কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নাও। ভাইয়া ও আর কি খাবে???
ও তো খেয়ে নিয়েছে….
মণি:- সে কি?
কখন খেলো????
আবির:- এই তো একটু আগে রুমে।
মণি:- রুমে???
রুমে খাবার এলো কোথা থেকে???
রুমেও খাবার আছে???
আবির:- আছে…
স্পেশাল খাবার…….
মণি:- কিরে?
আমাদের রেখে স্পেশাল খাবার খেয়ে নিলি…???
তা স্পেশাল খাবারটা কি???

নীলিমা লজ্জায় পারছে না মাটির নিচে চলে যেতে।

ইমন:- আবির!
ও কি সত্যি’ই খেয়েছে নাকি তুমি মজা করতেছ???
আবির:- ভাইয়া মজা নয়।
ও খেয়েছে। কিভাবে বলব আপনাদের? ও খেয়েছে।
শুধু খায়নি। অনেক বেশী খেয়েছে। এতটাই বেশী খেয়েছে যে মিনিট দুয়েক চোখ বোজেও ছিল….
কি আমি কি মিথ্যে বলছি নীলিমা?

নীলিমা এতক্ষণে চোখ তুলে তাকায় আবিরের দিকে। আবির মুখ টিপে হাসছে তখন…….

চলবে….

গল্প:-♥ফুলশয্যা♥ পর্ব__ ০৪

0

গল্প:-♥ফুলশয্যা♥
পর্ব__ ০৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

আবিরের দু’চোখ গড়িয়ে যখন অশ্রু পরছে, নীলিমা তখন ওর বাবা-মাকে বকতে বকতে রুমে ঢুকছে। রুমে ঢুকে’ই নীলিমা আবির’কে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা চমকে যায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য যেই না পা বাড়ালো নীলিমা ওমনি আবির পেছন থেকে ডেকে উঠল_
“নী….লি..মা……”
নীলিমা থমকে দাঁড়ায়। আবির চোখের পানি মুছে নীলিমার সামনে যায়। তারপর__
“আমি চলে যাব। আজ এখনি চলে যাব। তার আগে তোমার কাছ থেকে আমার কিছু জানার আছে, বুঝার আছে…”
আবিরের কথা শুনে নীলিমা মাথা নিচু করে ফেলল। আবির আবারো বলা শুরু করল__
” বিশ্বাস করো নীলিমা! আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে গেলে আমি আর কখনো তোমার সামনে আসব না,কখনো না…”
নীলিমা চুপটি করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আবির আবারো বলছে__
” আমি তোমায় জোর করব না আমার সাথে যাওয়ার জন্য, আমি শুধু একটা কথায় জানতে চাই। আর সেটা হলো_
“আমি কি সত্যি’ই তোমার অযোগ্য?”
নীলিমা চুপ।
নীলিমা চুপ করে থেকো না।
তুমি যত তাড়াতাড়ি উত্তর দিবা, ততই তোমার ভালো। কারন, আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলে আমি চলে যাব তোমার বাড়ি থেকে। শুধু বাড়ি নয়, তোমার জীবন থেকেও। আর কখনো কোনো দাবি নিয়ে তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে না এই আবির।”

নীলিমা মুখ খুলে। কাঁপা কাঁপা স্বরে জবাব দেয়_
” জি, বলুন! কি জানতে চান?”
আবির আবারো বলে ঐ যে বললাম,
আমি কি সত্যি’ই তোমার অযোগ্য?
নীলিমা কাঁপা গলায় জবাব দেয়__
“আপনি অযোগ্য হতে যাবেন কেন?”
আবির:- নীলিমা! আমি প্রশ্নের বদলে প্রশ্ন নয় উত্তর চাই….
নীলিমা:- বলছি….
বাইরে যাবেন???
আবির:- বাইরে? কোথায়???
নীলিমা:- আগে চলেন’ই না…
আবির:- তুমি বাইরে গিয়ে কথা বলতে চাচ্ছো???
ঠিক আছে, চলো….

নীলিমা আবিরকে নিয়ে যায় সবুজ মাঠের ভেতর দিয়ে দুরে কোথাও। আবিরও নীলিমার পিছু পিছু গ্রামের মেঠুপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে।বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর নীলিমা থেমে যায়। একটা বিশালাকার আম গাছের নিচে গিয়ে নীলিমা দাঁড়ায়। আমগাছটা একটা বিরাট বড় পুকুরের সামনে গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে ওরা পুকুরের সামনে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে। কারো মুখে’ই যেন কোনো কথা নেই।শুধু ক্ষাণিক বাদে বাদে গাছের মগডাল থেকে ভেসে আসছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। দু’জনের মনেই এখন হাজারো কথারা এসে ভীড় করেছে, কিন্তু কেউ শুরু করতে পারছে না। মুখ খুলে প্রথম নীলিমা__
” জায়গা’টা বেশ দারুণ,তাই না?”
আবির:- হুম, ঠিক তোমার মতো….
নীলিমা:- মানে…..???
আবির:- সে কিছু না…
নীলিমা:- ওহ….
আবির:- তারপর…???
কেমন চলছে ডাক্তারি জীবন???
নীলিমা:- মন্দ না, ভালো’ই।
আচ্ছা, বাবা-মা, আদিবা আপু, দুলাভাই ওনারা কেমন আছেন???

আবির:- জানি না কেমন আছে। তবে বেঁচে আছে মনে হয়….
নীলিমা:- সে আবার কেমন কথা???
আবির:- মানে বাড়িতে যাওয়া হয় না ৮বছর ধরে। এই ৮বছরে ওদের খুঁজ নেওয়া হয়নি, শুধু সময় সময় আব্বুকেই কল দেওয়া হয়। যেহেতু ওদের সাথে কোনো কথা হয়না, তাই জানাও নেই ওরা কেমন আছে। বেঁচে আছে এই কারনে বললাম কারণ মরে গেলে এতদিনে ঠিক কারো না কারো মাধ্যমে খবর পেয়ে যেতাম। এবার বুঝেছ???
নীলিমা:- হুম….
,
আপনি না সত্যি’ই একটা রোবট।
আবির:- Sorry, কি বলছ???
নীলিমা:- এইভাবে এতটা বছর ধরে ওদের থেকে আলাদা আছেন, আপনার খারাপ লাগে না ওদের জন্য???
আবির:- না….
নীলিমা:- এই জন্য’ই আপনাকে রোবটের সাথে তুলনা করলাম…..
আবির:- হুম, রোবট’ই বটে।না হলে মানুষের দেওয়া এত আঘাত সয়ে যেতে পারতাম না…..

আবির একরকম খোঁচা দিয়ে’ই কথা’টা বলে। আবিরের কথা শুনে নীলিমা চুপ হয়ে যায়….

যায় হোক….
আমার প্রশ্নের উত্তর’টা কি আমি পাবো???
গম্ভীর ভাব নিয়ে আবির নীলিমার দিকে তাকালো…

নীলিমা আবিরের দিকে তাকিয়েও তাকাতে পারেনি অজানা কারনে। যার কারণে পুকুরের দিকে তাকিয়ে’ই জবাব দেই__
” আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। প্লিজ,এ ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন করে আমায় বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবেন না…”

নীলিমার কথা শুনে আবির নীলিমার দিকে চোখ তুলে তাকালো। তারপর__
” আমিও সেটাই চাই নীলি! আমি সব প্রশ্ন ভুলে যেতে চাই। তুমি শুধু প্লিজ আমার সাথে চলো। তুমি যদি এভাবে আমায় ফিরিয়ে দাও তাহলে আমি জীবনেও এ মুখ দেখাতে পারব না আমার বাবাকে। নীলি! আমি কখনো আমার বাবাকে এতটা খুশি দেখিনি, যতটা খুশি হতে দেখেছি বাবা যখন তোমার বাবাকে বলেছিল__
” আবির বিয়েটা করছে”।
নীলি! আমি আমার বাবার জন্য এই একটি কাজ ছাড়া কখনো কিছু করতে পারিনি, আর পারব কি না জানিও না। তাই বলছি__
নীলি! প্লিজ এমন করো না তুমি। চলো আমার সাথে…”

নীলিমা চুপ হয়ে আছে।
আবির নীলিমার কাছে গিয়ে হাত দুটো ধরল। তারপর__
“নীলি! প্লিজ একটা কিছু বলো। এভাবে চুপ করে থেকো না।”

নীলিমা হাত দুটো সারিয়ে নিয়ে বলল__
“তা কিছুতেই সম্ভব নয়..”

আবির:- নীলি! আমি বলছি না তোমায় আমার সাথে সংসার করতে হবে, তুমি শুধু মিছেমিছি আমার সাথে থাকবে। যাতে করে শেষ বয়সে এসে আমার বাবা না কষ্ট পেয়ে মরে। শুধু আমার নয় তোমার বাবা-মায়ের কথা’টাও একটু ভাবো….
,
নীলিমা:- ঠিক আছে।
আমি আপনাকে পরে জানাচ্ছি….আজকে রাতটা আমায় ভাবতে দিন।
আবির:- ঠিক আছে….

সেদিন সারা রাত ভেবে চিন্তে নীলিমা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে,
যায় হোক!
সে কখনো পারবে না ওর সিদ্ধান্ত থেকে লড়তে। নীলিমা আবিরকে জানিয়ে দেয় তার পক্ষে আবিরের ঘর করা সম্ভব নয়। আবির অনেক বুঝিয়ে শুনিয়েও নীলিমাকে ওর সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারে নি। নীলিমা ওর সিদ্ধান্তে বড্ড পরিকর।

একবুক হাহাকার আর হতাশ মন নিয়ে আবির ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। ঢাকায় গিয়ে অনেক চেষ্টা করেছে নীলিমাকে ভুলার জন্য, কিন্তু পারে নি। যতবার’ই ভুলার চেষ্টা করেছে ততবার’ই নীলিমার মায়া মায়া মুখ’খানি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আবির না পারছে নীলিমাকে আপন করে কাছে পেতে, না পারছে নীলিমাকে ভুলে যেতে।
ভুলবে কি করে???
নীলিমা যে ওর প্রথম প্রেম,
প্রথম ভালোবাসা….
প্রথম ভালোবাসাকে কি কেউ কখনো ভুলতে পারে?
না…
কখনো না…
শত ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও আবির পারেনি একমুহূর্তের জন্য ওর নীলিমাকে ভুলে যেতে। এদিকে নিজেকে কন্ট্রোলও করতে পারছে না। আবিরকের ভেতরের প্রেমিক মন যেন সবসময় নীলি, নীলি করে চিৎকার করত। নীলিকে কাছে চাইত। বড্ড আপন করে কাছে পেতে চাইতো….
কিন্তু সেটা বোধ হয় উপরওয়ালা চাইনি। তাইতো এমন ভাবে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। মাঝে মাঝে’ই আবির ভাবে__
আচ্ছা আমি কি ওকে সত্যি’ই ভালোবাসতে পেরেছি??? নাকি কোথাও একটা কমতি আছে…?!!!
আচ্ছা, সত্যি’ই কি আমি ওর অযোগ্য নাকি কোথাও একটা ভুল হচ্ছে….
এমন হাজারো প্রশ্ন আবির নিজেকে নিজে’ই করে। কিন্তু কোনোটার সঠিক জবাব পায় না। এদিকে আবির ভার্সিটিতে ঠিক ভাবে স্টুডেন্টসদের পড়াতেও পারছে না। মানসিক শান্তির জন্য আবির চাকরীটা ছেড়ে দেওয়ার দরখাস্ত করে। আবিরের মত মেধাবী টিচার হাতছাড়া করতে চাইনি ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ।আবিরের দরখাস্ত মঞ্জুর না করে আবিরের সার্বিকদিক বিবেচনা করে আবিরকে ৬মাসের ছুটি দেয় ভার্সিটি থেকে। আবির দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা রুমে আবদ্ধ থাকায় কয়েকদিনের ভেতর আবির অসুস্থ্য হয়ে যায়। খবর পেয়ে ছুটে আসে নীলিমা….

দিন রাতে জেগে আবিরের সেবা এবং পরিচর্যা করে করে আবিরকে সুস্থ করে তুলে ডাক্তার নীলিমা। মাত্র ২মাসের ব্যবধানে আবির অনেকটা সুস্থ হয়ে যায়। আবির নীলিমাকে নরসিংদীতে চলে যেতে বলে, যেহেতু ওর হসপিটাল আছে। নীলিমার ভাষ্যমতে_
” আপনি এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হোন’নি। এই অবস্থায় আপনাকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আর গেলেও বাবা-মা পাঠিয়ে দিবে এইখানে। আর হসপিটালের জন্য আমার সহকারী এবং দুইটা নার্স আছে। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন…”

নীলিমার সাহচর্যে আবির আবার আগের মত হয়ে যায়। সুস্থ হয়ে উঠে। কিন্তু মনটা উত্তরোত্তর দুর্বল হতে থাকে নীলিমার প্রতি। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব, আমাকে যে করে’ই হোক নীলিমার আড়ালে যেতে হবে। নিজের জন্য না হলেও নীলিমার সুখের জন্য ওর আড়ালে চলে যেতে হবে। দুরে চলে যেতে হবে, খুব দুরে….
যেখানে গেলে আমার ছায়াও নীলিমা দেখতে না পায়….

আবির নীলিমার থেকে দুরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। আবির দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে যাওয়ার সব বন্দোবস্ত করে ফেলল। নীলিমার সামনে যাওয়ার সাহস আবিরের নেই, যদি দুর্বল হয়ে পরে সেই ভয়ে। আবির দুরে উড়াল দেওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ওর পরিকে এসএমএস করবে। তার আগে আবিরের যেতে হবে মণির বাসায়। মণি নীলিমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ইন্টার এবং মেডিকেলে একই কলেজে ওরা একসাথে পড়ত। আবির যাচ্ছে তার’ই বাসায়। বিদেশে গিয়ে এই মণির মাধ্যমেই আবির ওর পরীর যাবতীয় খবরাখবর নিতে চায়।

দুপুর ২টার দিকে আবির গিয়ে পৌঁছায় মণিদের বাসায়…..

মণিদের বাসায় পৌঁছে’ই আবির প্রথমে নীলিমাকে বার্তা পাঠাই। বার্তা মারফত জানিয়ে দেয় সে দুরে কোথাও চলে যাচ্ছে। খুব দুরে। আর এও জানালো যে বাকি জীবনটা সে সেখানেই কাটিয়ে দিবে…

প্রিয় বান্ধবী নীলিমার হাজবেন্ড এসেছে, সেটা শুনে হসপিটাল থেকে ছুটে আসে ডাক্তার মণি। এসে সালাম ও কুশল বিনিময় করেই ব্যস্ত হয়ে পরে বান্ধবীর বরের জন্য কি রান্না করবে না করবে সেসবে। আবির মণিকে শত চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি। বলতে পারেনি বোন! আমার হাতে সময় নেই। আমি আজ রাতের ফ্লাইটের বিদেশ চলে যাচ্ছি।
মণি যখন কাজের বুয়ার সাথে রান্না বান্নায় ব্যস্ত, মণির হাজবেন্ড তখন বাহির থেকে কলিংবেলে চাপ দেয়।
আবির গিয়ে দরজাটা খুলতে’ই চমকে যায়। আবিরের সাথে সাথে ইমনও চমকে যায়….
চমকে গিয়েও মুখে হাসি ফুটে উঠে ইমনের….
রুমে ঢুকতে ঢুকতে আবিরকে বলে_
” এতদিনে তবে আমি মামা হতে চলেছি??? তা কোথায় আমার বোন নীলিমা..???”

ইমনের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারেনি আবির। কি বলছে এসব? কিসের মামা? আর বোন?!!!
কোন নীলিমার কথা বলছেন ওনি? আর ওনি তো সেই ছেলে যে ছেলের সাথে খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল নীলিমার। সেই ছেলে এখানে কেন?

এমন হাজারো প্রশ্ন আবিরের মনে এই মুহূর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে।ইমন রুমে ঢুকেই সোফায় গা এলিয়ে দেয়। আবিরকেও বসতে বলে। আবির সোফায় বসলে ইমন বলা শুরু করে_
” আমি ইমন! ইঞ্জিনিয়ার ইমন। আমার আরেকটা পরিচয় আছে আর সেটা হলো আমি মণির হাজবেন্ড।”

আবির কিছু একটা বলতে যাবে তখনি ইমন বলে__
” নীলিমা মণির বান্ধবী। সেই হিসেবেই প্রথম ওর সাথে আমার পরিচয়। ওর বড় ভাই নেই। ও আমাকে তাই ভাইয়া বলেই ডাকত। আমিও ওকে বোনের মত স্নেহ করতাম। ও ওর যাবতীয় কিছু আমার আর মণির সাথে শেয়ার করত। একদিন ও ওর জীবনের গল্প আমায় শেয়ার করে। ওর গল্প শুনে আমি কেঁদে দিয়েছিলাম। আমার ওয়াইফ তো সেদিন সারারাত প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর জন্য কেঁদেছে। যে কথাটি বলছিলাম….
সেদিন নীলিমার কষ্টের কথা শুনে ওকে বলেছিলাম,
কখনো যদি কোনো হেল্পের প্রয়োজন হয়, এই ভাইকে বলবি। এই ভাই জীবন দিয়ে হলেও তোর উপকার করার চেষ্টা করবে। একদিন নীলিমা আমায় কল দেয়। ওর নাকি খুব বিপদ তাই আমায় পার্কে যেতে বলে। আমি ছুটে যায় পার্কে। সেখানে গিয়ে যা শুনলাম তাতে আমি বাকরূদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। যাকে আমি নিজের বোনের মত স্নেহ করতাম সেই বোন আমায় বলেছিল__
” ওর প্রেমিক হয়ে অভিনয় করতে, ওর সাথে এমন ভাবে মিশতে যাতে ওর আবির ওকে ঘৃণা করে দুরে সরে যায়।”

আবির একথা শুনে লাফ দিয়ে সোফা থেকে উঠে পরে। তারপর_
” অভিনয় মানে? কেন???
ও আমার সাথে কেন এমন করল? আর ওর থেকে দুরে সরাতেই বা কেন চাচ্ছিল?”

ইমন আবারো বলা শুরু করল__
ঢাকায় নিয়ে এসে ওর আবির নাকি ওকে একটা পার্টিতে নিয়ে গিয়েছিল। আবিরের বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে। সেখানে যাওয়ার পর ওর আবির সবার সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দেয়। আবির যখন ওকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে কোথায় একটু গেছিল ঠিক তখনি আবিরের মানে আপনার কিছু বন্ধু বান্ধব নীলিমার পাশে এসে দাঁড়ায়।”

আবির:- তারপর???
ইমন:- তারপর ওদের মধ্যে একটা মেয়ে নীলিমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বলে, এই মেয়েকে আবির বিয়ে করেছে, যার হাসি দিলে দাত ছাড়া কিছুই দেখা যায় না??? কথাটা এমন ভাবে ব্যাঙ্গ করে বলে যে বাকি সবাই হু হু করে হেসে দেয়। হাসি থামিয়ে আরেকজন বলে__
আবির শেষ পর্যন্ত একটা কালিতারাকে বিয়ে করল???
আরেকজন বলল__
যে ছেলে একটা তুরি বাজালেই হাজারটা মেয়ে লাইন ধরত সে ছেলে কি না এমন গেয়োভূতকে বিয়ে করেছে?!!!!
জবাব আবির সাহেব, সেদিন আপনার একটা বন্ধ বলেছিল,
আরে বুঝিস না….
রাত্রে লাইট নিভালে তো সবই অন্ধকার। আবির কেবলমাত্র ওকে…….. (…….)…… করার জন্য’ই বিয়ে করেছে। আরেকজন বলেছিল_
ওর যদি এতই মেয়েদের নিয়ে রাত কাটানোর শখ ছিল তো আমাদের বলত। আমাদের কেন বলেনি??? আমার বললে তো হাইয়ার লেভেলের মেয়ে এনে দিতাম….
জনাব আবির সাহেব আপনি যার জন্মদিনের পার্টিতে গিয়েছিলেন তার জিএফ কি বলেছিল জানেন???
বলেছিল আপনি নাকি আপনার বাবার কথা রাখার জন্য বিয়েটা করেছেন। আপনি নাকি ওকে কখনো স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারেন নি, আর পারবেনও না। ঐ মেয়েটি এও বলেছিল স্ত্রী হিসেবে মেনে নেওয়া তো দুরের কথা আপনারা নাকি আজও অবধি আলাদা রুমে ঘুমান। আপনার আরেকটা বন্ধু খুব বাজে ভাষায় গালি দিয়ে বলেছিল__
” কিরে মেয়ে! তোর রেট কত?”

তারপর আপনি চলে আসাতে ওরা কথার টপিক চেঞ্জ করে ফেলে। আর আপনি ঐ সকল মানুষরূপি জানোয়ারদের সাথে হেসে কথা বলেছেন।

বোকা মেয়েটির সেদিন থেকে কান্নাই হলো নিত্যদিনের সঙ্গী। ও কেঁদে কেঁদেই এমবিবিএসটা শেষ করে। আর আপনার থেকে দুরে সরে যাওয়ার প্ল্যানটা সেদিন’ই করে।

আবির দাঁড়ানো থেকে বসে পরে। ইমনেরও গলাটা জমে আসে। মণি চায়ের ট্টে’টা সামনে এনে রেখে বলা শুরু করে__

” ভাইয়া জানেন?!!!
কালো’রাও মানুষ। ওদেরও মন আছে। আর সে মনে আছে ভালোবাসা। ওদেরও ভালোবাসতে ইচ্ছে করে ভাইয়া। নীলিমা চাইত। খুব করে চাইত আপনাকে কাছে পেতে, ভালোবাসতে। জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। আপনি যখন রাত্রে ওকে ঘুমানোর কথা বলে শুয়ে পরতেন, তখন ও চোখ বোজে ঘুমানোর ভান করে থাকত। আপনি যখন ঘুমিয়ে পরতেন ঠিক তখনই ও চুপি চুপি ও আপনার রুমের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াতো। ও ঘুমাতো আপনার মুখ দেখে, আর ঘুম ভাঙলেও আপনার মুখটা দেখার জন্য জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াত। ভোরের আলোয় আপনাকে প্রথম দেখে ও ওর দিনটা শুরু করত। আর আপনার স্বপ্ন চোখে নিয়েই ও ঘুমিয়ে পরত। সেদিন আপনি যখন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ওর স্বপ্ন কি???
ও মনে মনে বলেছিল__
“আমার স্বপ্ন তো আপনি”
মুখে বলার সাহস পায়নি, কারণ ওর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ও কালো….”

আপনি যখন সেদিন ওর বাসায় গিয়েছিলেন ও খবর শুনে হসপিটাল থেকে ছুটে আসে খুশিতে আত্মহারা হয়ে। ইচ্ছে ছিল আপনাকে জড়িয়ে ধরতে, অভিমানী স্বরে বলতে__
এতদিন পরে এলে???”
কিন্তু পারেনি, কারণ ও কালো। সেদিন আপনি যখন বলেছিলেন ওকে ফিরে আসার জন্য ও যা খুশি হয়েছিল বলে বুঝানো যাবে না কিন্তু যখন বললেন আপনার বাবার জন্য আপনি ওকে এতবার রিকোয়েস্ট করতেছেন, তখন নিমিষেই ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল। আপনার সাথে আসবে না কথাটা ও সাথে সাথে বলে দিতে পারত, কিন্তু বলেনি। কারন_
ও চেয়েছিল আপনি একটা ওসিলায় ও বাড়িতে থাকুন। আর ও আপনাকে একটা রাতের জন্য কাছে পাক। একই রুমে হয়তো শুয়া হয়নি, কিন্তু ও মনকে শান্তনা দিয়েছিল একই ছাদের নিচেই তো আছি আমরা…”

আপনি চলে আসার সময় আপনার সামনে আসেনি, কারন সকাল থেকেই কেঁদে কেঁদে ওর চোখ লাল রক্তবর্ণ ধারণ করেছিল। আপনার অসুস্থতার কথা ও ওর বাবা মা নয়, আপনার বাসার কাজের মেয়ের থেকে জেনেছিল। কারণ, ও কাজের মেয়ের সাথে প্রতিদিন মিনিমাম ঘন্টাখানেক কথা বলত শুধুমাত্র আপনার খুঁজ খবর নেওয়ার জন্য।
ভাইয়া! সাদা-কালো কোনো ফ্যাক্ট না। আসল কথা হলো মানুষের মনটা কেমন???

আমি এ ব্যপারে ১০০%গ্যারান্টি দিতে পারব, আমার বান্ধবী খাঁটি সোনা।
আর ওর মনটা ছোট শিশুদের মত নিষ্পাপ…..

ইমন:- এবার যখন ঢাকায় আসে তখন আমি বলছিলাম আপনাকে নিয়ে এখানে আসতে। ও বলল, আসলে সুখবর নিয়েই আসবে। আচ্ছা, সুখবর কি? আপনাদের মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে তো?!!!

আবির সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। পকেট থেকে পাসপোর্টের কাগজটা বের করে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে। মণি আর ইমনের দিকে তাকিয়ে বলে__
“বড় ভুল হয়ে গেছে। অনেক বড় ভুল…”
তারপর ব্যাগপত্র রেখে’ই একরকম দৌঁড়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে। এদিকে ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাসপোর্টের টুকরো দেখে মণির ভেতরটা আঁতকে উঠে। তবে কি নীলিমার কিছু হয়েছে???
ইমন- মণি একমুহূর্ত দেরী করল না। আবিরের রেখে যাওয়ার ব্যাগপত্র নিয়ে ওরাও রওয়ানা হয়ে যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে।

এদিকে নীলিমা!!!!
ফোনে আবিরের বার্তা পেয়ে পাগলের মত হয়ে যায়। রুমের দরজা বন্ধ করে আবিরের রুমের দেয়ালে আবিরের যতগুলো ছবি আছে সবগুলো নামিয়ে ফেলে। সবগুলো ছবি একসাথে জড়ো করে সেগুলোকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল নীলিমা। একবার বুকে তো আরেকবার ফ্রেমে বন্দি আবিরের ছবি মুখের কাছে নিয়ে কাঁদতে থাকে নীলিমা।কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করে বলতে থাকে__
” আমি দুরে সরাতে চেয়েছি, এত দুরে তো যেতে বলিনি। আমি এখন কাকে নিয়ে থাকব? কার জন্য বাঁচব?”
কেঁদে কেঁদে একটা সময় নিস্তেজ হয়ে যায় সে।ফ্লোরেই ঐ অবস্থায় ঘুমিয়ে পরে নীলিমা।
এদিকে সে রাত্রেই বাসায় পৌঁছে আবির, মণি এবং ইমন।

রাত্রি ১২টা_
আবির ওর দরজায় এসে একের পর এক নক করতেছে। কিন্তু ওর নীলি আর দরজা খুলছে না। এদিকে মণি কল দিচ্ছে নীলির ফোনে। ফোনটাও রিসিভ করছে না। রীতিমত ভয় পেয়ে যায় সবাই। আবির তো কেঁদে অস্থির। নীলির কিছু হলো না তো???
এদিকে দরজা যে ভাঙবে তারও উপায় নেই। কারন দরজাটা স্টিলের, হাতের কাছে এমন কিছু নেই যা দিয়ে দরজা কাটবে। মণি বিরামহীন ভাবে একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে যায় নীলিমার। ফোনে আলো জ্বলে উঠতেই দেখে ৩০০মিসড কল। নীলিমা ঘুম চোখে কল বেক করে….
ওপাশ থেকে মণি উদ্ভীগ্ন কন্ঠে বলে__
” নীলিমা! দরজাটা খুল। কথা আছে। ইমন, আবির ভাইয়া সবাই দাঁড়িয়ে আছে।”

আবিরের নাম শুনে নীলিমার চোখ থেকে ঘুম লাফিয়ে দুরে সরে গেল।একমিনিট খুলছি বলে নীলিমা লাফিয়ে ফ্লোর থেকে উঠে। দরজা খুলতে গিয়েও খুলেনি। ফ্লোরে রাখা ছবিগুলো টানানোর জন্য উঠে পরে লেগে যায় নীলিমা। লাফিয়ে একবার ফ্লোরে আরেকবার ফ্লোর থেকে ছবি নিয়ে খাটে উঠে সেগুলো দেয়ালে টানাতে শুরু করে। এদিকে আবির দরজায় একের পর এক নক করতেই থাকে। ১০মিনিট পর দরজা খুলে নীলিমা। আবিরসহ সবাই রুমে প্রবেশ করে। রুমে প্রবেশ করে আবিরের চক্ষু চরকগাছ……..

সকালেও তো রুমটা সাজানো গোছানো ছিল, একদিনের ব্যবধানে কি করে হলো এসব???

মণি এবং ইমন দুজনেই নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলল__
” ইয়া ছি! তোর এই অবস্থা কেন? শাড়ি, চুল এমন এলোমেলো কেন? আর রুমে এত ধূলোবালি…..রুম কি গুছাস না???পঁচা মেয়ে….”

ইমন বিছানায় বসতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরল। ধুলোয় চাদর কচকচ করতেছে__
” নীলিমা! তুই না নোংরা পছন্দ করিস না বোন?!!! তো এসব কি??? বিছানায় বসা যাচ্ছে না কেন????”

আবির ইমন আর মণিকে সোফায় বসতে বলল।ওরা সোফায় বসতে গিয়ে লাফিয়ে উঠল। আবির কি হলো জিজ্ঞেস করতেই মণি জবাব দেয়__
” সোফায় জুতা কে রেখেছে?”

আবির বিছানা ঠিক করার জন্য বারান্দা থেকে বিছানা পরিষ্কার করার ঝাড়ু আনতে গিয়ে বারান্দায় ওর একটা ছবি আবিষ্কার করে। ছবিটা হাতে নিয়ে রুমে ঢুকে আবির বলে__
” আমাদের বিয়ের যে ছবি আলমারির ভেতর ছিল, সে ছবি বারান্দায় গেল কিভাবে? ছবিরও কি পা আছে নাকি?”

মণি:- ভাইয়া! ঐ যে খাটের নিচে দেখেন আপনার ল্যাপটপ। ল্যাপটপেরও কি পা আছে???

ইমন:- চায়ের কাপ পরে আছে টেবিলের নিচে। টেবিলও কি আজকাল চা খায়?????

আবির:- মণি! সিসিটিভির ফুটেজটা অন করে দেখো তো আজকে কয়টায় ভূমিকম্প হয়েছিল? আর ঠিক কয়মিনিটের জন্য….???

কথাটা বলে আবির নীলিমার দিকে তাকাই।নীলিমাও তখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে……

চলবে……

গল্প:-♥ফুলশয্যা♥ পর্ব_ ০৩

0

গল্প:-♥ফুলশয্যা♥
পর্ব_ ০৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

নীলিমার কাজের মেয়ের দিকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কাজের মেয়ে বুঝে যায়। আর তাই কাজের মেয়ে বিনীত ভঙ্গিতে করুণ চাহনিতে চোখের ভাষায় নীলিমাকে বুঝিয়ে দেয়_
” স্যরি, ভাবি! আমায় মাফ করো… আমি পারলাম না প্রতিবারের মতো কথা লুকাতে, পারলাম না তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে…”
কাজের মেয়ের চোখের ভাষা বুঝে গিয়ে নীলিমা আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। আমি পূর্বের ন্যায় ওর দিকে জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। ও যেন বুঝে উঠতে পারছিল না কি করবে, এদিকে আমি একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছি। সবশেষে ও__
” চলে এলেন যে? কোনো সমস্যা? মা দেখেছেন? দাঁড়ান আমি বলে আসছি..”
একটানা কথাগুলো বলে নীলি আমায় ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছিল রুম থেকে, ঠিক তখন’ই আমি ওর হাত’টা ধরে ফেলি। কোথাও যাবে না তুমি। আমার কথার উত্তর না দিয়ে কোথাও যেতে পারবে না। নীলিকে টেনে আমার বুকের খুব কাছে এনে কথাগুলো বললাম।এদিকে এ দৃশ্য দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না কাজের মেয়ে। লজ্জায় চোখ ঢেকে সেখান থেকে চলে যায় সে। আমি নীলিকে কাছে টেনে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছি আর নীলি আমার মুখের দিকের মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ যা বলছি তার একটাও ওর কানে ঢুকেনি। ওর চোখে চোখ পরতেই বন্ধ হয়ে যায় আমার কথা।
তাকিয়ে থাকি আমি আমার মায়াপরিটার দিকে। কি অদ্ভুত এক মায়াভরা মুখ, যে মুখে তাকালে রাজ্যের ক্লান্তি দুর হয়ে যায়।
বেশকিছু ক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকার পর নীলি চোখ’টা ফিরিয়ে নেয় আমার থেকে। নিচের দিকে তাকিয়ে বলে__
” ছাড়েন…..”
আমি নীলির হাত’টা ছেড়ে দিলাম। নীলি দৌঁড়ে রুম থেকে চলে গেল। দুপুরে সবাই খাবার টেবিলে বসে আছি। কাজের মেয়ের সাথে নীলিও খাবার দিচ্ছে আমাদের সবাইকে। আপু সবার সাথে নীলিকেও খেতে বসতে বললে আম্মু নীলির আগে আগে জবাব দেয়__
” ও খেয়েছে একটু আগে। ওর মনে হয় খিদে নাই। ও না হয় পরে খাবে। তোরা খেয়ে নে…”
সকালের ঘটনায় মায়ের উপর ভিষণ রেগে ছিলাম আমি। কেন যেন মনে হচ্ছে নীলি খায়নি। আর কাজের মেয়ে যা বলছে তা যদি ঠিক হয়ে থাকে তাহলে নীলি সত্যি’ই খায়নি। আর খেলেও সবার পরে খায়। ঐ যে সবার পরের যে উচ্ছিষ্ট’টুকু থাকে কুকুর বিড়ালের জন্য, সেটুকু খেতে দেওয়া হয় ওকে। আর তাই আমি বলে উঠি_
” নীলি খেয়েছে কিনা সেটা’তো নীলির থেকে বেশী তুমি’ই ভালো জানো, তাই না মা? আর জানবে’ই তো। কারন খাবার শেষের উচ্ছিষ্ট খাবার বেছে বেছে তুমি’ই তো জমা করো।কখন খাওয়া হবে সবার, আর কখন তোমার বৌমা আই মমিন এ বাড়ির কুকুরকে দিবে, তাই না???”

কথা শুনে মা আমার দিকে চমকে তাকালো। মায়ের সাথে উপস্থিত সকলে অবাক বিস্ময়ে তাকালো।
– আদিবা আপু আমায় ধমকের স্বরে বলে__
” এসব কি বলছিস আবির?”
আব্বু আমায় বলে__
“এসব কি বলছিস আবির? নীলিমা এ বাড়ির বউ, ওকে কেন উচ্ছিষ্ট খাবার দিবে তোর মা?”
আমার দুলাভাই বলে__
” আবির! ওনি তোমার মা হয়। মায়ের সাথে এভাবে কথা বলতে নেই..”

আপু! আমি ভুল কিছু বলিনি। আমার এই মা নীলিমার সাথে দিনকে দিন বাজে ব্যবহার করে আসছে। এমন বাজে ব্যবহার যা আমার মুখ দিয়ে এই মুহূর্তে আসবে না। এটুকু বলে আমি কেঁদে দিলাম।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি বলছিস কি তুই আবির? তোর মা…(……)…???
হ্যাঁ, বাবা! আমি সব ঠিক বলছি। আমার মা….(….)…
নীলি আমার থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল, চুপ করেন।হাত জোর করছি আপনার কাছে, প্লিজ চুপ করুন। আব্বা!
আপু আপনারা ওকে চুপ করতে বলেন। ওনার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে, তাই মায়ের বিরুদ্ধে এসব বলতে একবারও বিবেকে বাধছে না ওনার। নীলির কথা শুনে মা কান্না করা শুরু করে, আর আমার রাগ চরমে উঠে যায়। আমি_
” চুপ! একদম কাঁদবে না তুমি মা। আর নীলি! মিথ্যে আমি নই, মিথ্যে তুমি/তোমরা আমাকে বলছ। দিনের পর না খেয়ে, মায়ের সব নির্যাতন মুখ বোজে হজম করে আমাকে বলে এসেছ, মা নাকি তোমাকে অনেক আদর করেন… এতটাই আদর করেন যার নমুনা না দেখালে’ই নয়। আমি চেয়ার থেকে উঠে নীলির কাছে গিয়ে আঁচল’টা টান দিয়ে সরিয়ে ফেলি।
তারপর নীলির পিঠটা ওদের দিকে দিয়ে সবাইকে বলি__
” এই হলো সেই আদরের চিহ্ন, তার নমুনা।”

সবাই চমকে উঠে নীলির পিঠের দিকে তাকালো। আমার মা লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে পরল। আমি মনে মনে__
” ক্ষমা করো মা! আজকে এসব কথা না বললেই নয়”
আমার আপ-দুুলাভাই-আব্বু বসা থেকে উঠে পরল। আপু আমার দিকে তাকিয়ে বলল__
” আবির! এসব কিভাবে হয়েছে ওর? কিভাবে এতটা পুড়ল???”
আব্বুও ঠিক এক’ই প্রশ্ন করল। আমি কাজের মেয়ের দিকে তাকালাম। কাজের মেয়ে পূর্ব থেকে’ই প্রস্তুত ছিল কথা বলার জন্য। কারন ওকে আশ্বাস দিয়েছিলাম চাকরী চলে গেলেও ওকে আপুর বাসায় কাজে দিয়ে দিব। কাজের মেয়ে অকপটে নীলির সাথে করে আসা দূর্ব্যবহারের বর্ননা দিয়ে গেল। সব শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে যায়।
বাবা একটা কথাও বলেনি। জলে ছলছল চোখ নিয়ে চলে যায় খাবার টেবিল ছেড়ে….
আপু:- ছি! মা তুমি?!!!
এতটা নিচে নেমে গেছ???
আমি জাস্ট বিশ্বাসও করতে পারছি না আমার মা…(…)…!!!
আদিবাও চলে গেল। আদিবার পিছু পিছু আমিও নীলিমাকে নিয়ে রুমে চলে গেলাম। আমাদের লক্ষ্য ক দুলাভাইও চলল। আমরা রুমে ঢুকার একটু পরেই দুলাভাই রুমে ঢুকল। নীলি তখন বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে, একটু আগে’ই ওকে ধমক দিয়েছি, মার হয়ে ওকালতি করতে আসছিল, তাই ধমক দিয়ে দিয়েছি। ধমক দেওয়ার পর থেকে’ই কাঁদছে। অকস্মাৎ দুলাভাই রুমে আসে। এর একটু পর আদিবা আপুও। দুলাভাই রুমে প্রবেশ করেই আমার হাতে একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে বলে যেভাবেই হোক ঔষধগুলো আনতে, সবার আগে মলমটা আনতে। আমি প্রেসক্রিপশন হাতে পেয়ে ছুটে চললাম ফার্মেসির দিকে। কাছেই ফার্মেসিতে ঔষধগুলো পেয়ে যাওয়াতে বাইরে কোথাও যেতে হয়নি। ঔষধ নিয়ে রুমে ঢুকার সময় আব্বুও আমার সাথে রুমে ঢুকে। মলম’টা তখন’ই ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দেওয়া হয়। আব্বু আম্মুর কৃতকর্মের জন্য ভিষণ ভাবে লজ্জিত। আপু নিজেও আম্মুর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিল।

৩দিন পর সকাল বেলা__
আমি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আছি নীলির বের হওয়ার অপেক্ষায়। আজ’ই নীলিকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাব। না, না! মামার বাসায় নয়। বাবা আমাদের জন্য একটা বড় এপার্টমেন্ট কিনে দিয়েছে। সেখানেই যাচ্ছি। সেখান থেকে’ই ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করব। আমি চাই না আর কোনো কালো ছায়া আমার নীলিকে স্পর্শ করুক, আর তাইতো ওকে নিয়ে যাচ্ছি সাথে করে। আমি যখন ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছি ঠিক তখন’ই আম্মু এসে আমার পাশে বসল। আমি আমার মা’কে দেখে মুখ’টা বিপরীত পার্শ্বে ফিরিয়ে নিয়ে মায়ের থেকে একটু দুরে সরে বসলাম। আমার মা আমার আরো কাছে এসে বসল। তারপর আমার হাত দুটো ধরে বলল__
” বাবা! এভাবে রাগ করে যাসনে। আমি আর কখনো এমন করব না। প্লিজ ছুটির দিনটা এখানে কাটিয়ে যা, আর আমার ঘরের লক্ষ্মী’কে এখানে রেখে যায়। ও আজ থেকে আমার মেয়ে হয়ে থাকবে। ওকে আমি কলেজে ভর্তি করাবো। উচ্চ শিক্ষিত করব। মানুষ ওকে দেখে হিংসা করবে। ও সবার অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হবে। বাবা! প্লিজ তুই থেকে যা কয়টা দিন। আর বউমাকে রেখে যা।”
আমি মায়ের মুঠো থেকে হাতটা সরিয়ে নিলাম।তারপর__
” মা! তুমি ওকে পছন্দ করো না জানতাম, কিন্তু এত’টা ঘৃণা করো সেটা আমি বুঝতে পারিনি। আজ যখন বুঝতে পারলাম তখন কেন যেন মন সাই দিচ্ছে না ওকে এভাবে একা ফেলে যেতে এখানে। তাই আমি ওকে আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি। Sorry, মা! আমাকে ক্ষমা করো। আমি পারলাম না তোমার এ কথা’টা রাখতে। আর একসেকেন্ডও সেখানে বসে থাকতে পারলাম না। দৌঁড়ে নীলির কাছে গিয়ে ওকে একরমক টেনে নিয়ে আসলাম। নিচে মা চাইবে ওর সাথে কথা বলতে তাই ওর হাত ধরে টেনেই ওকে বাইরে নিয়ে আসলাম। রওয়ানা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। রাত সাড়ে আট’টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম বাবার দেওয়া ঠিকানায়। আমাদের নতুন বাসায়। কাজের লোক ৪টা সাথে করে’ই নিয়ে এসেছিলাম। একজন সার্বক্ষণিক নীলির দেখাশুনার জন্য আর ৩জন রান্না-বান্নাসহ বাসার যাবতীয় কাজকর্ম করার জন্য। সেরাত্রে বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে খেয়ে নিলাম। তারপর রুম গুছাতে গুছাতে রাত প্রায় ১২টা বেজে গেল। রাত ১২টার দিকে নীলিকে বললাম__
” সারাদিনে তো অনেক ধকল গিয়েছে। জার্নি করে এসেছ। তাই বলছিলাম কি আর বেশী রাত না জেগে ঘুমিয়ে পরাটাই ভালো হবে।তুমি ঘুমিয়ে পরো নীলি…”
_ নীলি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় ঘুমাবো আমি???
আমি হেসে বললাম, বোকা!
কোথায় ঘুমোবে সেটাও বলে দিতে হবে? ঘুমিয়ে পরো না সে রুম তোমার চয়েজ হয়…”
নীলি আবারো আমার দিকে তাকালো। তারপর__
” আপনি ঘুমাবেন না?”
আমি বললাম_
হুম, ঘুমাবো। তুমি শুয়ে পরলেই তোমার পাশের রুমে আমি ঘুমাবো….”
_ পাশের রুমে ঘুমাবেন মানে? আপনি আলাদা ঘুমোবেন?(নীলি)

আমি বললাম হ্যাঁ…
আমরা আলাদা রুমে’ই ঘুমাবো। তুমি-আমি সম্পূর্ণ আলাদা রুমে ঘুমাবো। আমার কথা শুনে নীলি আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মুখে না বললেও ওর মনে যে এই মুহূর্তে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটা আমি ওর মুখ দেখে’ই বুঝে গিয়েছিলাম।
যায় হোক।
ওকে সেসব কিছুই বুঝতে দিলাম না। দোতলার ছিমছাম গোছানো ছোট্ট একটা রুম পছন্দ করে ও। ও রুমে’ই ওকে শুইতে বলে সিড়ির অপর পাশের একটা রুমে আমি শুয়ে পরলাম।
পরদিন বিকেলে গল্প বলার চ্ছলেই জেনে নিলাম ও ছিল ভিষণ মেধাবী এবং স্বপ্নবিলাসী একটা মেয়ে।ওর ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওর বাবা-মায়ের মত অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে।তাদের দিকে সেবার হাত বাড়িয়ে দিতে। মানে নীলির ইচ্ছে ছিল ও একজন ডাক্তার হবে।
মনে মনে বললাম__
” তুমি শুধু তোমার স্বপ্ন পূরণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকো নীলি! তোমার পাশে স্বয়ং আল্লাহ আছে।তুমি জয়ী হবে নিশ্চিত…”

সেদিন রাত্রে’ই আমি একটা কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে নীলির ভর্তির ব্যপারে কথা বলে রাখলাম। পরদিন ভোরে নীলিকে নিয়ে নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। নরসিংদী নীলির বাসা থেকে নীলির স্কুলের সব কাগজপত্র নিয়ে একদিন থেকে তারপরের দিন ঢাকায় চলে আসলাম। ঢাকায় এসে একদিন পর ভর্তি করিয়ে দিলাম। ঢাকার একটা নামকরা কলেজে নীলিকে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিলাম। শুরু হলো নীলির কলেজ জীবন।
আমি প্রতিদিন নীলিকে বাবার গিফ্ট করা গাড়িতে করে কলেজে দিয়ে এবং নিয়ে আসতাম। আমার ভার্সিটির ছুটি শেষ হয়ে গেল। নীলিকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে আমি ভার্সিটিতে চলে যেতাম। ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে নীলির কলেজে গিয়ে নীলিকে নিয়ে আসতাম। কোনো কোনো সময় নীলি আমার জন্য কলেজ গেইটের সামনে অপেক্ষা করত। দিনে কলেজ আর রাত্রে পড়াশুনা। বেশ ভালো’ই চলছিল। নীলি বেশ মেধাবী ছাত্রি ছিল। পড়াশুনার ব্যাপারে ওর সাথে বেশী প্যাঁচাল পারতে হতো না ও নিজ দায়িত্বে ক্লাসের পড়াগুলো কমপ্লিট করত। ওকে আমি রুটিন তৈরি করে দিয়েছিলাম। ও সে রুটিন মাফিক পড়াশুনা করেও পার্টটাইম জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বই পড়ত।দেখতে দেখতে নীলির এইচএসসি কমপ্লিট হয়ে যায়। এইচএসসিতে নীলি বিজ্ঞান শাখা থেকে গোল্ডেন জি.পি.এ পেয়ে উত্তীণ্ন হয়।

নীলি মেডিকেলে কলেজে ভর্তির জন্য পরিক্ষা দেয়। পুরো বাংলাদেশের মধ্যে আমার নীলি মেধাক্রমে ২য় স্থান অধিকার করে। নীলি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় চান্স পেয়ে যায় ঢাকা সরকারি মেডিকেল কলেজে। যে জায়গায় নীলির বান্ধবী ৫লক্ষ টাকা দিয়ে চান্স পায় ঠিক সে জায়গায় নীলি ভর্তি হয় ভর্তির ফি শুধু ১০হাজার টাকা দিয়ে। আমার শান্তশিষ্ট বউ’টা যে কিনা কারো সাথে মিশত না কিংবা কেউ যার সাথে মিশত না আজ তার অসংখ্য ফ্রেন্ডস। শুধু মেয়ে নয়, ওর রয়েছে অসংখ্য ছেলে ফ্রেন্ডও। নীলি পড়াশুনার পাশাপাশি ওদের সাথে আড্ডা দিত, কোনো কোনো সময় ওদের নিয়ে আমাদের বাসায়ও আসত। নীলি এখন আর আগের সেই গ্রাম্য মেয়েটি নেই। নীলি এখন ঢাকা শহরের একজন স্মার্ট মেয়ে। আজকাল নীলির সাথে কথায় পেরে উঠি না আমি। মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট বলে কথা…..

দেখতে দেখতে নীলির কোর্স প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে যায়। ইন্টার্নি শেষ হলেই নীলি একজন সফল ডাক্তার। সেদিন রাত্রে খাবার টেবিলে নীলিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম__
” নীলি! পড়াশুনা তো প্রায় শেষের দিকে। তারপর? কি ভেবেছ???”

অকপটে নীলির জবাব__
আমার স্বপ্ন পূরণ করব।
আমি নীলিকে জিজ্ঞেস করলাম__
” তোমার স্বপ্ন? কি সেটা??”

নীলির জবাব__
“ছোট্ট থেকে দেখে আসা স্বপ্ন পূরণ করব। আমি গ্রামে একটা হসপিটাল খুলে সেখানে বসব গরিব ও অসহায়দের সেবা করার জন্য…. ”

– আর কিছু না???
~নীলি আমার দিকে তাকিয়ে বলে__
আর কি???
আমি বললাম__
” নাহ, মানে বুঝাচ্ছিলাম তোমার স্বপ্ন এটুকুই???”

নীলি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব দিল__
” জি, আমার স্বপ্ন এটুকু’ই”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম- ওহ্!

দেখতে দেখতে ইন্টার্নিসহ নীলিমার কোর্স সম্পূর্ন হয়ে যায়। নীলিমা এখন একজন সফল ডাক্তার। নীলিমা ভোরে’ই ওর দেশের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে। রাত্রে খাওয়া শেষে নীলিমা যখন ওর জিনিসপত্র গোছাচ্ছে তখনি ওর রুমে প্রবেশ করলাম আমি__
” বাব্বাহ! জিনিসপত্র গোছানো শুরু করে দিয়েছ?”
নীলিমা ব্যাগে কাপড় ঢুকাতে ঢুকাতে বলল__
“হুম”….
-” গুড। সকালে কয়টাই রওয়ানা দিবা?”
আমার প্রশ্নের জবাবে নীলিমা জবাব দেয়_
” ৭টায়…”
আমি নীলিমার দিকে তাকিয়ে বললাম__
” নীলিমা!সকাল ৭টায় যাওয়ার কি আছে? তুমি বরং একটু দেরিতে বের হও, এর ভিতর আমি ভার্সিটি থেকে একটা ক্লাস করে আসতে পারব।”
– জনাব আবির সাহেব! আপনাকে ধন্যবাদ এটুকু বলার জন্য। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আর নয়….”
– মানে? তুমি আমার সাথে যাবে না???
নীলিমা সিরিয়াস মুডে জবাব দেয়_
” না! আমি যাচ্ছি না….আমার একটা ফ্রেন্ড যাবে আমার সাথে আমার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে। আমি ওর সাথে’ই যাচ্ছি…”

তোমার ফ্রেন্ড মানে?কে সে?
আমার নীলি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকালো। তারপর_
” আমার ফ্রেন্ড মানে ফ্রেন্ড। স্রেফ ফ্রেন্ড। আজব মানুষ তো আপনি! সবকিছুর কি জবাব আপনাকে দিতে হবে নাকি?”

নীলির এভাবে কথা বলা দেখে আমার বুকের ভেতর’টা হাহাকার করে উঠল। মুচড় দিয়ে উঠল। ৭বছরের বৈবাহিক জীবন আমাদের। এত বছরের বৈবাহিক জীবনে নীলির এমন ভাবে কথা বলা আগে কখনো শুনিনি। কিন্তু বিগত কয়েকটা মাস ধরে ও যেন কেমন হয়ে গেছে। আমার সাথে কথা বলে না। আমি কথা বলতে গেলে কেমন কেমন যেন করে। মুখ কালো করে উত্তর দেয়। তারউপর আজকে এমন ভাবে কথা বলার পর যেন নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারিনি। একরকম দৌঁড়ে চলে গেলাম রুম থেকে। পরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙে হাসাহাসির আওয়াজে। ঘুম চোখে রুম থেকে বের হলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি ড্রয়িংরুমে নীলি আর ঐ ছেলেটি বসে আছে। যে ছেলেকে নিয়ে নীলি এর আগে একাধিকবার এই বাসায় এসেছে এমনকি ঘুরতেও গেছে।
আজও সেই ছেলে এই বাসায়। নীলি জোর করে ছেলেটির মুখে বিস্কুট তুলে দিচ্ছে, আর গল্প করছে। হাসাহাসিও হচ্ছে, হচ্ছে চোখাচোখি। আমি উপরে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য অবলোকন করছি। বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি এভাবে, নীলি আমায় দেখে ফেলে। আমি নিচে নামলাম। নীলি ওর ছেলে বন্ধুর সাথে আমায় পরিচয় করিয়ে দেয় এইভাবে_
” ইমন! এ আমার বন্ধু আবির। এখানকার একটা ছোট্ট ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন…আর আবির সাহেব! এ আমার বন্ধু ইমন।এবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া কমপ্লিট করে এখানকার সেরা নামকরা কোম্পানিতে এমডি হিসেবে জয়েন করেছে….

নীলি পরিচয় পর্বের মধ্যেই আমায় অদ্ভুতরকম ভাবে ছোট করেছে। তারপরও আমি হেসে হেসে নীলির ঐ ছেলে বন্ধুর সাথে হেসে করমর্দন করলাম। নীলি রওয়ানা দেয় ওর ছেলে বন্ধুর সাথে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে আর আমি হতভাগা দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখছি।

আমার চোখের সামনে দিয়ে আমার পরি উড়ে যায় দুর অজানায় সুখের উদ্দেশ্যে। আর আমি চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে আমার পরির জন্য দোয়া করলাম__
” হে আল্লাহ! তুমি আমার পরিটাকে সুখে রেখো…শান্তিতে রেখো…
কোনো কষ্ট যেন ওকে স্পর্শ না করে….”

আমার গল্প এখানে’ই সমাপ্ত……

এটুকু লিখে আবির অফলাইনে চলে যায়। আর কখনো আবিরকে অনলাইনে পাওয়া যায়নি। এরপর আবির আর কখনো ওর পরিকে নিয়ে কিছু লিখেনি। আবিরের নামের পাশের সবুজ দাগটাও আর কখনো দেখেনি কোনো পাঠক।

লেখিকার কথা-
“সত্যি’ই কি গল্প এখানে সমাপ্ত???”
নাহ!!!
গল্প এখানে সমাপ্ত নয়। এরপর আবির গিয়েছিল নরসিংদীর সেই অজপাড়া গায়ে যেখানে আবির ওর নীলিকে প্রথম দেখেছিল। আবির ওখানে পা রাখার সাথে সাথে ঐখানকার ছেলে মেয়ে’রা ছুটাছুটি করতে থাকে নীলি আপুর জামাই এসেছে, জামাই এসেছে বলে।
আবিরের বাবা হাসি মুখে ওর বন্ধু পুত্রকে রুমে নিয়ে যায়। আবিরের মা হেসে জবাব দেয়-
“এতদিন পর মনে পরল তবে আমাদের কথা? আমরা তো ভাবছিলাম ভুলেই গেছ…”
আবির বলে__
” কি যে বলেন না!
বাবা মাকে কি কেউ ভুলতে পারে?!!!”

আবির আসার খবর শুনে নীলিমা হসপিটাল থেকে আসে। উঠোনে আসতে’ই শুনে ওর বাবা কার সাথে যেন বলছে_
” জামাই আইছে। রুমে বইয়্যা আছে। বাজার করতে অইব…”
নীলিমাকে দেখে ওর বাবা বলে__
” মা এসেছিস? রুমে যা। জামাই আইছে…”

আবির রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই….

এদিকে নীলিমা বিরক্ত গলায় উঁচু স্বরে জবাব দেয়_
“তোমরা এত জামাই, জামাই করো কেন সেটাই বুঝি না।”
নীলিমার মা রুম থেকে বের হতে হতে বলে__
” জামাইরে জামাই কইব না তো কি কইব?”
নীলি আরো জোরেশোরে বলে_
” মা-বাবা! তোমাদের আর কত বলব?!!! ওনি আমার বন্ধু, স্রেফ বন্ধু। আর কিচ্ছু না।”

মা:- কি বলছিস তুই এসব? তুই না আবিবের বিয়ে করা…. (….)….
নীলিমা:- বউ, এইতো?!!!
কিন্তু আমি মানি না এসব বিয়ে।
বাবা:- কি কস তুই এসব?
নীলিমা:- বাবা আমি ঠিক বলছি। ওনি আমার বন্ধু’ই শুধু। আর তাছাড়া ওনার বয়স আর আমার বয়সটা খেয়াল করেছ????
তাই বলছি, ওনার সাথে আমার যায় না।

নীলিমার কথা শুনে নীলিমার বাবা মা অবাক আর আবির?!!!
দুর থেকে’ই সবকিছু শুনে নিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিল…..

চলবে….

গল্প:-♥ফুলশয্যা♥ পর্ব_ ০২

0

গল্প:-♥ফুলশয্যা♥
পর্ব_ ০২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

নীলিমার মাথা থেকে ঘোমটা’টা সরিয়ে দিলে নীলিমা লজ্জায় চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। আমি মুগ্ধ নয়নে আমার পরি’টাকে দেখছি। ওর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে অজান্তে’ই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে মাশাআল্লাহ।
যেন এক স্বর্গের পরি আমার সামনে বসে আছে।
যত দেখি তৃষ্ণা মেটে না…
নীলিমা তখনও চোখ দুটো বন্ধ করে আছে। প্রশ্ন করলাম__
~নীলিমা, তুমি কি জানো একটি মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর কাছে কিসের ভিত্তিতে মূল্যায়িত হয়?

নীলিমা চোখ খুলে বলল, আমি জানি না।
তখন আমি তাকে বললাম একটি মেয়ে যত সুন্দরীই হোক না কেন, বিয়ের পর তার সৌন্দর্যের দাম স্বামীর কাছে থাকে না। কারণ আমরা অনেক সময় অনেক পছন্দ করে মার্কেট থেকে কোনো পোশাক কিনলে প্রথমে সেটি খুবই যত্ন করি এবং বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে পরি। কিন্তু কিছুদিন পর ঐ পোষাকটি যখন পুরনো হয়ে যায় তখন সেটি আমরা সাধারণ ভাবে ব্যবহার করি। তেমনি একজন স্বামীর কাছে স্ত্রী এবং স্ত্রীর কাছে স্বামীর দেহের সৌন্দর্য প্রতিনিয়ত পাঠ করা হয়। তখন তাদের মধ্যে দেহের সৌন্দর্যের আর কোণো আকর্ষণ থাকে না। বরং তখন একে অপরের বিভিন্ন গুন দ্বারা প্রভাবিত হয়। তখন দেহের সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে যায় একের প্রতি অপরের টান, ভালোবাসা, সহমর্মিতা প্রভৃতি গুনাবলি।

কথা বলা শেষ করে দেখলাম নীলিমা আমার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। রাত প্রায় শেষের দিকে। এর’ই মাঝে বার কয়েক লক্ষ্য করলাম নীলিমা চোখ কচলাচ্ছে। বোধ হয় ঘুম পাচ্ছে খুব।
আমি নীলিমাকে বললাম__
“নীলিমা! রাত অনেক হয়েছে। তুমি বরং ঘুমিয়ে পরো।”
নীলিমা বলল__
” না, না! আপনি বলেন। আমি শুনতেছি…”
আমি হেসে বললাম__
তোমার ভাবিরা কি শিখিয়ে দিয়েছে রাত জেগে আমার গল্প শুনতে? যদি শিখিয়ে দেয়, তাহলে শুনো। নাহলে ঘুমিয়ে পরো। নীলিমা চুপ করে রইল। ঘুমে ঢুলুঢুলু নীলিমা আমার সামনে শুইতে ইতস্তত বোধ করছিল। আমি বিছানা’টা ছেড়ে নীলিমা’কে বললাম__
” এই নাও তোমার বিছানা। এবার তুমি দরজা’টা লাগিয়ে শুয়ে পরো। কথা’টা বলে আমি অন্যরুমে ঘুমানোর জন্য বেরিয়ে আসছিলাম, ঠিক তখন’ই নীলিমা পিছন থেকে ডাক দেয় আমায়। বলে__
” আপনি ঘুমাবেন না?”

আমি নীলিমার দিকে তাকিয়ে বললাম__
” ঘুমাবো। পাশেই একটা রুম আছে, ঐখানে’ই ঘুমাবো। তুমি ঘুমিয়ে পরো।”
আমার কথা শুনে নীলিমার মুখ’টা ইষৎ অন্ধকার হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে সে আবারো ডেকে বলে__
” আপনি এ রুমে বিছানায় ঘুমান, আমি না হয় ফ্লোরে ঘুমাবো।”
নীলিমার কথা শুনে আমি ওর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তাকালাম। নীলিমা নিচের দিকের দিকে তাকিয়ে বলল__
” ঠিক আছে! আপনার যা ইচ্ছে।”
আমি গম্ভীর ভাব নিয়ে বললাম__
” কেন তোমার কি ইচ্ছে?”
আমি এ রুমে ঘুমাই, সেটা?”
নীলিমা কোনো কথা না বলে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ধমকের স্বরে বললাম__
” কি হলো? কথা’তো বলো?”
নীলিমা মাথা নেড়ে বলল হুম। আমি আবারো প্রশ্ন করলাম__
কিসের হুম???
নীলিমা ধীর গলায় বলল__
” আপনি এ রুমে ঘুমান। আমার অসুবিধা হবে না কোনো।”

কন্ঠে গাম্ভীয্যের ভাব এনে আমি নীলিমাকে জবাব দিলাম_
” তোমার অসুবিধা হবে না, কিন্তু আমার হবে। আমি আবার অচেনা কারো সাথে ঘুমোতে পারি না। আর সেই জায়গায় তুমি তো ঘোর অচেনা। তোমায় না জানি, না চিনি না মানি…
নীলিমা আমার দিকে তাকিয়ে বলল__
” মানেন না মানে?”
আমি সহাস্যে জবাব দিলাম_
” মানে অতি সহজ। তোমায় বিয়ে করেছি ঠিক কিন্তু আমি তোমায় আমার স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারিনি।”
নীলিমা মুখটা অমাবস্যার কালো অন্ধকারের মত করে বলল__
” আমি জানি…”
চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলাম__
” কি জানো? ”
নীলিমা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল__
” এই যে আপনি আমায় স্ত্রী হিসেবে মানতে পারেন নি আর পারবেন না কখনো।

আমি নীলিমাকে আবারো প্রশ্ন করলাম__
” তোমার এমন ধারনার কারন?”
নীলিমার জবাব_
” আমি কালো। ভীষণ কালো। কালো মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। আর সে জায়গায় আপনি অনেক সুন্দর। রাজপুত্রের মত যার চেহেরা, সে কি না বিয়ে করবে কালিতারাকে? আমি আগেই জানতাম__
আমি কারো স্ত্রী হবার যোগ্য না। আমি সাগরে ভাসা কচুরিপনার….(….)…..???
নীলিমার কথা শুনে কেমন যেন বুকের ভেতরটা মুচর দিয়ে উঠল। ভিষণ রাগ হলো ওর প্রতি। আর তাই ওর কথার মাঝখানে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলাম। তারপর__
” একটা কথাও হবে না।চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো। আমি সোফায় ঘুমোচ্ছি। আর জীবনেও যাতে এমন কথা না শুনি।”
নীলিমা আর একটা কথাও বলে নি। আমি দরজা বন্ধ করে সোফায় শুয়ে পরলে কিছুক্ষণ পর দেখি লাইট’টাও অফ। তার মানে ও শুয়ে পরেছে।
সোফায় শুয়ে আছি মাথার নিচে একটা হাত দিয়ে। ঘুম যেন চিরতরে বিদায় নিয়েছিল আমার চোখের পাতা থেকে। মনের কোণে হাজারো ভাবনা এসে জড়ো হচ্ছে। আনমনে’ই বলে যাচ্ছি__
” নীলি! তুমি কালো হতে পারো কিন্তু তোমার মন’টা অনেক ভালো। আমি তোমার শরীর নয়, সেই ভালো মনটা পেতে চায়। সে মনের ভালোবাসা পেতে চায়। আমি চাই তুমি আমায় ভালো ভাবে চিনো, বুঝো, জানো। ব্যস, এটুকুই।
নীলি! তুমি জানো???
আমি তোমাকে দেখা অবধি কাউকে এতটা অনুভব করিনি, তোমাকে দেখার পর থেকে বুকের ভিতর কেমন যেন অচেনা অনুভূতি নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। নীলি!
আমি তোমার শরীর নয়, তোমায় ভালোবাসতে চাই। তোমায় আমি স্ত্রী নয় আমার প্রেয়সী করতে চায় প্রথমে।
নীলি! আমি তোমার পাশে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকতে চাই। আমি তোমার দুঃখ-সুখ দুটোরই সাথী হতে চাই। বলো নীলি!
এটুকু কি আমার খুব বেশী চাওয়া হবে???
নীলি! এটুকু কি আমি পেতে পারি না???”
অবচেতন মন নিজেকে নিজে’ই শান্তনা দিল_
” কেন নয় আবির?!!! তুই তো কোনো অন্যায় কিছু আবদার করিসনি! তবে কেন পাইবি না এটুকু। তুই অবশ্যই পাবি। তুই দেখে নিস, তুই জয়ী হইবি। তুই পারবি তোর নীলির মন উজাড় করা ভালোবাসা পেতে। সেটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেই পর্যন্ত ধৈর্য ধর, ধৈর্যের ফল সবসময় সুমিষ্ট’ই হয়।”

পরদিন রাত্রিবেলা__
” নীলিমা! একটা কথা বলব?”
নীলিমা ধীর গলায় বলল, জি বলেন!
আমি নীলিমাকে প্রশ্ন করলাম__
” তোমার এত্ত বড় নাম’টা কে রেখেছে???”
নীলিমা আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখটা ফিরিয়ে নিল।অন্যদিকে তাকিয়ে বলল__
” দাদা…”
আমি দুষ্টুমি করে বললাম__
” ঐ শালা কি দুনিয়াতে আর কোনো নাম খুঁজে পাননি? শালা, এত্ত নাম থাকতে এত বড় নাম রাখছে…”
নীলি আমার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে বলল__
” ওনার নাম শালা নয়। রমজান। রমজান আলী ওনার নাম…”
আমি হেসে বললাম এই হলো আর কি….
আচ্ছা, তুমি কি অন্য নামে ডাকতে পারি না???!!!
– কি নামে???
_ অন্য নামে। এই যেমন ধরো নীলিমার মা’টা কেঞ্চি দিয়ে কেটে খাটো করে দিলাম। নীলিমা আমার দিকে তাকিয়ে বলল__
” মানে নীলি?!!!”
আমি হেসে বললাম, জি! নীলি…..
কেন? পছন্দ হয়নি???
নীলিমা জোর গলায় বলল,
না, না! হয়েছে। আপনি আমায় নীলি বলে’ই ডাকবেন। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
_ আমি হেসে বললাম, ওকে! এখন থেকে আমি তোমায় নীলি বলে’ই ডাকব। তুমি নীলি। শুধু আমার নীলি….??
স্যরি, অন্য কিছু ভেব না। আমি আমার নীলি বলতে বোঝাতে চাচ্ছি যে-
” এই নামে অন্য কেউ তোমায় ডাকতে পারবে না।”

নীলিমা চুপটি করে বসে রইল। আমি নীলিমার দিকে তাকিয়ে বললাম__
” নীলিমা! আমার মা যে তোমার সাথে এমন করল আজকে, তোমার কষ্ট হয়নি? সত্যি বলবা, মিথ্যে বলো না…”
নীলিমা হেসে বলল,
কি যে বলেন না! কষ্ট পাবো কেন? ওনি তো আমার গুরুজন। কতকিছু’ই তো বলতে পারে, তাই বলে আমরা সব কথা কি মনে রেখে দিব??? আমি কিচ্ছু মনে করিনি।”
__ নীলিমা তুমি কি জানো তোমার বয়স কত???
~নীলিমা আমার কথায় জবাব দিল__
হ্যাঁ, জানি….
— কত???
নীলিমা কাঁপা গলায় জবাব দিল,
খুব কম।
আমি নীলিমার দিকে তাকিয়ে বললাম__
” এই এত ছোট্ট হয়েও তুমি কিভাবে এত গুছিয়ে, সুন্দর করে কথা বলতে পারো???”
প্রশ্নোত্তরে নীলিমা কোনো জবাব দেয়নি….

দেখতে দেখতে ১৫টা দিন চলে যায়। দু’দিন পর পহেলা জানুযারি। আমার ভার্সিটির ছুটির দিন শেষ। আজকেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে। ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে রেখেছি আগে থেকেই। আমি চলে যাব, সেটা নীলিমা জানে।তারপরও যাইবার কালে আবার বলার জন্য রুমে এলাম। নীলিমা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। আমার ডাক শুনে বিছানায় উঠে বসে। এই কয়দিনে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে নীলিমা। দু’জন অনেকটা বন্ধুর মত হয়ে গেছি। নীলিমা বিছানায় উঠে বসতে’ই আমি নীলিমাকে বললাম__
” আসি….”
নীলিমা আমার দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসি দেওয়ার চেষ্টা করল। তারপর বলল__
” আচ্ছা ”
আমি নীলিমাকে বলে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে দিলাম। ট্রেনে বসে আছি। রাস্তা প্রায় অর্ধেক অতিক্রম করে ফেললাম। হঠাৎ মনে হলো ফোন’টা বেজে উঠল।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম ঢাকা থেকে স্যার কল দিয়েছে। কলটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো জামাল স্যারের কন্ঠ।
– আবির স্যার! আপনার জন্য সুখবর আছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ আপনার কাজে খুশি হয়ে আপনাকে একমাসের ছুটি দিয়েছে। আপনি বেতন পাবেন, কিন্তু এই একমাস আপনার ভার্সিটিতে আসতে হবে না। আপনি আরাম করে হানিমুন করেন…..

স্যারের কথা শুনে আমার খুশি আর দেখে কে?
তাড়াতাড়ি করে ট্রেন থেকে একটা স্টেশনে নেমে গেলাম। আমি কখনো বাস দিয়ে যাতায়াত করিনি, কিন্তু আজ করলাম। ট্রেন আসতে দেরী হবে শুনে আর বসে থাকিনি। নিকটস্থ বাস স্টপে গিয়ে বাসে উঠে পরলাম। চিটাগাংয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। এই কয়দিনে নীলিমার মায়ায় পরে গিয়েছিলাম। ওকে ছেড়ে আসার পর থেকে বুকের ভেতরটাই অদ্ভত এক শূন্যতা অনুভব করছি। ভাবতেই অবাক লাগছে ওকে আরো একটা মাস কাছে পাব। দেখতে পারব।

বাসায় পৌঁছলাম পরদিন দুপুরে। বাসায় প্রবেশ করে দেখি বাসায় কেমন যেন থমথমে ভাব।অদ্ভুত এক নিরবতা….
দৌঁড়ে উপরে উঠলাম।
মা ঘুমোচ্ছে জানতাম, তাই মায়ের কাছে না গিয়ে রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। দরজার সামনে যেতে’ই শিউরে উঠলাম।
– আমার প্রাণপাখি নীলি বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে। গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে আর তার পাশে’ই বসে আছে বাসার কাজের মেয়ে’টি। মেয়েটি বার বার বলছে__
” ভাবি! কাঁদবেন না। কাঁদলে আপনার শাশুড়ি শুনতে পাবে যে, তখন ওনি আবার আপনাকে….
এটুকু বলে দরজার সামনে তাকিয়ে আমাকে দেখে থমকে গেল মেয়েটি। কোনো কথায় যেন ওর মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। ইশারায় আমি মেয়েটিকে ডাকলাম। রুম থেকে একটু দুরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম__
” ও হয়েছে তোর ভাবির?”
মেয়েটি চুপ হয়ে আছে।
আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম__
কি হলো বল? নীলি কাঁদছে কেন? কে কি বলছে ওকে???
এবারো কাজের মেয়েটি চুপ। আমি এবার ওকে ধমক দিয়ে বললে ও যা বলল তাতে আমার সারা শরীর শিহরণ দিয়ে উঠল।
– কি?!!!
আমার মা ওকে মেরেছে?
ওর পিঠে গরম হাতা দিয়ে মেরেছে???
আমি যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দৌঁড়ে গেলাম আমার নীলির কাছে। ও আগের মতই উপুড় হয়ে আছে। আর ওর ঘাড়ের কাছে কিছুটা চামড়া উঠে গিয়ে লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ গরম জাতীয় কিছু এ স্থানে ফেলেছে। নীলি তখনও উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুজে কাঁদছে। নীলির এ অবস্থা আমি যেন মেনে নিতে পারছিলাম না। ওকে আস্তে করে ডাক দিলাম।
– নীলি…..
ও হকচকিয়ে উঠে বসল। আমাকে দেখে আঁচল দিয়ে পিঠ’টা যথাসম্ভব ঢাকার চেষ্টা করল।

আমি নীলিকে প্রশ্ন করলাম__
” কি ঢাকতেছ?”
নীলিমা যেন আঁতকে উঠে আমার দিকে তাকালো….
আমি ভেঁজা কন্ঠে বললাম__
” বলো…
কি ঢাকতেছ আঁচল দিয়ে?”

নীলিমা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কাজের মেয়েটির দিকে একবার তাকালো….

চলবে….

গল্প:-♥ফুলশয্যা♥ পর্ব_ ০১

0

গল্প:-♥ফুলশয্যা♥
পর্ব_ ০১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

আমি আবির।
মাহমুদুল হাসান ‘আবির’। পেশায় একজন শিক্ষক। ঢাকার কোনো এক স্বনামধন্য ভার্সিটির বাংলার প্রভাষক। বাবার ইচ্ছে লেখােড়া শেষ করে ওনার ব্যবসায়ে যোগ দিতে, কিন্তু বরাবরের মতই মুক্তমনা আমি কিছুতেই যেন মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বাবার ব্যবসায়ে জয়েন করতে পারি নি।ব্যবসায়ে ফাঁকি দিয়ে কাঁধে একটা গিটার নিয়ে বন্ধুদের অবাধে দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরে বেড়াতাম। বাবা বোধ হয় বুঝে গিয়েছিল স্বাধীন ও মুক্তমননের অধিকারী এই আমি’কে কিছুতেই ব্যবসায়ের কাজে লাগানো যাবে না। আর সে জন্যই বাবা আমায় ঢাকায় মামার বাসায় পাঠিয়ে দেয়। মামা যে ভার্সিটির সভাপতি সেই ভার্সিটিতেই বাংলার লেকচারার হিসেবে জয়েন করি। শুরু হয় আমার শিক্ষকতার জীবন। আজ ৫বছর অতিবাহিত হলো আমার শিক্ষকতার জীবনের।

সে বার পরিবারবর্গ সহ ২মামাকে নিয়ে যাচ্ছিলাম নরসিংদীর একটি ছোট্ট অজপাড়া গায়ে। যাকে নিয়ে কিংবা যার কথা শেয়ার করার জন্য এই লিখা সেই নীলিমার সাথে এই গ্রামেই প্রথম দেখা।
নীলিমা এ গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র। নীলিমা এ গল্পের নায়িকা। নীলিমার পদচারণা গল্পের শুরু থেকে শেষ অবধি।

নীলিমা পল্লীগাঁ’য়ের এক সহজ-সরল ও অত্যন্ত শান্তশিষ্ট একটি মেয়ে। পড়াশুনা এসএসসি পর্যন্ত’ই। এস.এস.এসি পাসের পর মেধাবী নীলিমার আর কলেজে ভর্তি হওয়া হয়নি। যদিও অন্য ৮/১০টা মেয়ের মত তারও দু’চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল….
স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে অনেক বড় হওয়ার,
স্বপ্ন ছিল জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করার,
স্বপ্ন ছিল অসহায় বাবা-মায়ের মুখে জয়ের হাসি অঙ্কন করার,
স্বপ্ন ছিল ছোট্ট বোন’টিকে ঈদে নতুন জামা-জুতো আর স্নেহের ভাইটিকে একটা ল্যাপটপ কিনে দেয়ার।

নীলিমার স্বপ্ন কিন্তু খুব বেশী বড় ছিল না,
ওর স্বপ্নগুলো ছিল ছোট ছোট। তবুও সেসব কিছু’ই যেন নীলিমার করা হয়ে উঠেনি।

পাড়া প্রতিবেশীর নিন্দার আগুনে দগ্ধ হতে হতে একটা সময় নীলিমার লেখাপড়ায় ইতি টেনে দেয় নীলিমার গরিব ও অসহায় বাবা। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কলেজ প্রাঙ্গনে যেতে পারে নি নীলিমা। নীলিমার ছোট্ট থেকে দেখে আসা স্বপ্নগুলো একটু একটু করে ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায় নিন্দুকের কথার আঘাতে। নীলিমাকে জর্জরিত হতে হতো প্রতিনিয়ত, নিন্দুকের কথার আঘাতে।
,
নীলিমার অপরাধ__
নীলিমা কালো। নীলিমার গায়ের রং কালো, ভিষন রকম কালো….

তরুন শিক্ষক আবির এবং তার পরিবার আজ সেই বাড়িতেই যাচ্ছে। আবিরের বাবার বাল্যকালের বন্ধু ‘ছমির’….আর তারই মেয়ে নীলিমা। আবিরের বাবার ইচ্ছে বাল্যবন্ধু ছমিরের মেয়েকে ওনার পুত্রবধূ হিসেবে বাড়িতে তুলে নেওয়ার। প্রসঙ্গ আবিরের বাবা ঠিক তখন’ই তুলে যখন আবিরসহ ওর মামারা সবাই ঐ বাড়িতে রাতের খাবার খেয়ে নেয়।
আবিরের মা’তো অন্ধকার রাত্রেই হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পরে রাগে। আবিরের ছোট মামাও বোনের পক্ষ নিয়ে রাতের আঁধারে বেরিয়ে আসতে চায় বাড়ি থেকে। ওদের একটাই কথা আর সেটা হলো_
“এমন কালো মেয়েকে নিয়ে গেলে সোসাইটিতে মুখ দেখানো যাবে না।ওরা হাসাহাসি করবে।”

আবিরের বড় বোন আদিবার ভাষ্যমতে__
“মামা শুনো!
কালো’রাও মানুষ। ওরাও আমাদের মত এক’ই রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। আর সবচেয়ে বড় সত্য হলো ওরাও আমাদের মতই এক আল্লাহর সৃষ্টি। তাই দয়া করে বন্ধ করেন বাজে কথা আর দেখেন আবির কি চাই? এ ব্যপারে ওর মতামত কি???

ঠিক তাই।
এই মুহূর্তে আবিরের মতামতটি নেওয়া সবচেয়ে জরুরী। তাই চলুন বন্ধুরা ঘুরে আসি আবিরের প্রোফাইল থেকে। দেখে আসি গল্পের নায়ক আবির কি বলে???

আবিরের ভাষ্য__
বাবা! মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে। আর আমি জানি, আমি এই মেয়েকে নিয়ে অনেক সুখী হবো যদি তোমার/তোমাদের সবার দোয়া থাকে। তাই আমি এই মেয়েকেই বিয়ে করতে চাই।
আমার কথা শুনে বাবা,মা আপু আর ডাক্তার দুলাভাই সবাই একসাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে।

ডিসেম্বরের তেইশ তারিখ আমি আমার ঘরের লক্ষ্মীকে নিয়ে বাসায় ফিরি। এইদিনেই ওকে আমি বিয়ে করি। বিয়েটা খুব সাদাসিধে ভাবেই হয়েছে। তার একমাত্র কারন আমার মা এবং এক মামার বিরোধ।

বিয়েটা সাদাসিধে ভাবে হলেও বাসর ঘর’টা সাজানো হয় আমার ইচ্ছে মত’ই। বাসর ঘরে প্রবেশ করে দেখি বউ আমার গুটিসুটি মেরে বিছানায় বসে আছে। আমাকে দেখে’ই খাট থেকে উঠে সালাম করে আবার খাটে গিয়ে বসল ইয়া লম্বা ঘোমটা দিয়ে।

মাথা থেকে পাগড়ীটা খুলে ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে আমি আমার সদ্য বিয়ে করা বউয়ের পাশে গিয়ে বসলাম।বেশ কিছুক্ষণ কাশি দেওয়ার পরও বউয়ের কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না।বউ আমার পূর্বের ন্যায় মাথায় আধহাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। কি আর করার???
এভাবে বসে থাকলে যে পুরো রাত চলে যাবে। আর তাই কালবিলম্ব না করে আমি আমার বউয়ের একটা হাত আলতো করে ছুঁয়ে দিলাম।
মনে হচ্ছে নীলিমা আমার পরশে একটু কেঁপে উঠেছে কিন্তু তার বেশী কিছু নয়।আমার হাতের মুঠো থেকে হাত ছাড়ানোর কোনো চেষ্টা না করে ও বসে আছে। চুপটি করে আছে। ওর এই মৌনতা যেন আমায় জানান দিচ্ছিল ও সর্বপ্রকার পরাজয় স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু আমি তো এটা চাই না।
আমি চাই আমার বউ আমায় প্রথমে চিনুক, জানুক, ভালোবাসুক তারপর অন্যকিছু। কিন্তু ও কি না..???
– বিয়ের পর একজন স্বামী শুধু স্ত্রীর সাথে শারীরিক বন্ধনে নয়, ভালোবাসার বন্ধনেও আবদ্ধ হয়। কেবল শারীরিক সম্পর্ক নয়, বৈবাহিক সম্পর্কের আরেক নাম স্বামী-স্ত্রীর অপার প্রেমের এক বন্ধন। আর সেই বৈধ প্রেম’টা শুরু হয় ফুলশয্যার রাত থেকে’ই….

যায় হোক…
ফুলশয্যার রাত্রে আমি আমার বউকে প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলাম__
” নীলিমা! ফুলশয্যার রাত তো প্রতিটি মানুষের জীবনের একটি সর্বশ্রেষ্ঠ রাত, তাই না?”
– নীলিমা ঘোম’টার ভেতর থেকে মাথা নাড়ে। হ্যাঁ কিংবা না কোনোটাই বুঝিনি আমি। তবুও ওর এই মাথা নাড়ানো হ্যাঁ বোধক মনে করে ওর দিকে আরো একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম। আর সেটা ছিল__
” তাহলে নিশ্চয় এ রাত সম্পর্কে তুমি জানো?”
নীলিমা এবারো মাথা নাড়লো। আমি নীলিমাকে উদ্দেশ্য করে বললাম__
“নীলিমা! আমি সাংকেতিক ভাষা বুঝিনা, তুমি যা বলার মুখে বলো। তুমি শুধু এটুকুই বলো এ রাত সম্পর্কে তুমি কিছু জানো কি না…???
নীলিমা এবার মুখ খুলল…
কাঁপা গলায় জবাব দিল_
” জি, জানি…”
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম কি জানো???
ও লজ্জানত হয়ে নিচুগলায় বলল__
” ভাবিরা যা শিখিয়ে দিয়েছে।”
ওর দিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম__
তা তোমার ভাবিরা কি শিখিয়ে দিয়েছে? আমায় কি বলা যাবে???

নীলিমা ক্ষাণিক’টা কেঁপে উঠল। তারপর নিচু স্বরে জবাব দিল_
” আপনি যা বলেন তাই করতে।”
_ আচ্ছা, তাই নাকি???
নীলিমা মাথা নেড়ে বলল হুম। আমি নীলিমাকে আবারো প্রশ্ন করলাম__
” আচ্ছা, আমি তোমাকে কি বলতে পারি???”
__ বউ আমার লজ্জায় বলল, জানিনা!
আমি দু’হাত দিয়ে বউয়ের ঘোমটা সরিয়ে বললাম-
“তোমার ভাবি এতকিছু শিখিয়ে দিল, তো এটা বলেনি আমি কি বলব/করব???”

লজ্জাবতী আমার লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে চুপসে গেল লজ্জাবতী পাতার মত’ই…..

চলবে……………

কৃষ্ণকলি পর্ব:- ১৩(অন্তিম পর্ব)

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব:- ১৩(অন্তিম পর্ব)
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

অন্যদিকে হেলে যাওয়ার সময় বাঁধন মায়াকে ধরে ফেলে। অতঃপর মায়া বাঁধন আর বাঁধন মায়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ এভাবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকার পর মুখ খুলে বাঁধন। মায়ার কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে যায় বাঁধন। ফিসফিসিয়ে বলে-
” বাবা আসছে। বাবাকে বলব নাকি আগেভাগেই উঁচু রেখে একটা আরএফএল চেয়ার বানিয়ে রাখতে?”
বাঁধনের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাই মায়া। মায়ার এরকম দৃষ্টি দেখে ঢোক গিলে বাঁধন। মুখে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে বলে-
” না মানে বলছিলাম কি আমি যখন অফিস থেকে ফিরব, তখন তো আমি ক্লান্ত শরীরে ঘেমে একাকার হয়ে যাব। তখন আমার সেই ঘামে ভেঁজা মুখটা তো আমি মুছতে পারব না, মুছবে আমার বউ! এখন ঘটনা হলো__
আমার বউ যেরকম পিচ্চি, মনে হয়তো না ও উঁকি দিয়েও ও আমার মুখ নাগাল পাবে। তাই একটা আরএফএল চেয়ার বানালে দু’জনের’ই ভালো হয় আর কি।”
সংসার শুরু না হতে’ই আরএফএল চেয়ার? ব্যাপারটা কি? প্রশ্নটা করতে করতে রুমে প্রবেশ করে বাঁধনের বাবা। মায়া বাঁধনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে চুপটি করে। বাঁধন মায়ার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে,
” কি! বলব নাকি বাবাকে???”
বাঁধনের দিকে একবার মাথা উঁচু করে তাকিয়ে লজ্জায় দৌঁড়ে রুম থেকে চলে গেল মায়া।
পরদিন বাঁধনের পরিবার মায়া-বাঁধনের বিয়েটা ঠিক করে রওয়ানা দিতে চাচ্ছিল। কিন্তু বাঁধ সাধে মায়ার ভাবি। আপনারা প্লিজ আজকের দিনটা থেকে যান। মায়ার ভাবির বোনের বিয়ে। ভাবির আপন বলতে বাবা আর বোনটা ছিল। বাবা মারা গেছেন একবছর আগে। এখন মায়ার ভাবি চাচ্ছে ছোট্ট বোনটার বিয়ে এ বাড়ি থেকেই হোক। আর সে মতেই সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে। মায়ার ভাই- ভাবির জুড়াজুড়িতে সেদিনের মত থেকে যায় বাঁধন ও তার পরিবার। ঠিক হয় যে, বিয়ে খেয়েই তবে রওয়ানা দিবে ঢাকার উদ্দেশ্যে।
বিকেল থেকেই মেহমানরা আসা শুরু করে বিয়ে বাড়িতে। একে তো বিয়ে বাড়ি, তারউপর এত এত মেহমান। জায়গার সংকুলান হচ্ছিল না দেখে বাঁধনের আড্ডা ঠিক করেন ওনি ওনার নাতি নাত্নি নিয়ে রাত্রে ঘুমোবেন না। রাতভর আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিবেন রাতটা। যেই কথা, সেই কাজ। রাত্রে মায়া বিছানায় শুইলেও সুইটি, নুসরাত, দাদা ও বাঁধন নিচে শুইল। শুধু মায়া বিছানায় শুয়ে ফেসবুকে বন্ধু শফিকের সাথে চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত। চ্যাট করতে করতে আর বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে কখন যে মায়া বিছানার একদম কিনারায় চলে যায় বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারে তখন, যখন ধপাস করে কারো উপর পরে যায়। খাটের পাশেই ফ্লোরে শুয়েছিল বাঁধন।
খাট থেকে মায়া বাঁধনের বুকে’ই পরে, আর সেটা টের পায় বাঁধনের ‘উহ্’ করে উঠার পর। কি হয়েছে, কি হয়েছে বলে লাইট অন করে সুইটি। মায়া তখনও বাঁধনের বুকে। এটা দেখে সবাই ফিক করে হেসে দেয়। মায়া লজ্জায় ইয়ে মানে, না, আসলে করতে করতে বাঁধনের বুক থেকে সরে যায়।

সে রাতে মায়া কিংবা বাঁধন কারো’ই ভালো ঘুম হয়নি।

পরদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে বাঁধন ও তার পরিবার চলে যায়। যাওয়ার আগে বাঁধন মায়ার বিয়ের ফাইনাল ডেট দিয়ে যায়। বিয়ের ব্যাপারে বাঁধনের বাবার তাড়াহুড়োটা একটু বেশী’ই ছিল। তাই আসছে সপ্তাহের শুক্রবার বিয়ের দিন ধার্য করা হয়।
একসপ্তাহ চোখের পলকে শেষ হয়ে গেল। যদিও বাঁধন-মায়ার জন্য তা ছিল একবছরের সমতুল্য।
যায় হোক। নির্দিষ্ট দিনে বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়ে যায়। রাত্রি সাড়ে নয়টা নাগাদ বউ নিয়ে বাসায় পৌঁছে বাঁধন ও তার পরিবার। বিয়ের বিভিন্ন রীতিনীতি পালন করতে যেয়ে ঘড়ির কাটা সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে দশটায় চলে যায়। এগারোটার মিনিট পাঁচেক আগে মায়াকে বাসরঘরে পাঠানো হয়। তার মিনিট পাঁচেক পর রুমে প্রবেশ করে বাঁধন। মায়া তখন ফুলের বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিল। বাঁধনকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে চিরাচরিত নিয়মে খাট থেকে নেমে পা ছুঁয়ে সালাম করে মায়া।
বাঁধন কোনো কথা না বলে মায়াকে নিয়ে নামাজ পড়তে যায়। দু’জন মিলে একসাথে নামাজ আদায় শেষে খাটে গিয়ে বসতে যাচ্ছিল মায়া। পিছন থেকে ডাক দেই বাঁধন।
দাঁড়িয়ে পরে মায়া। বাঁধন মায়াকে ঐ রুমে থাকতে বলে যে রুমে ও আগেও থেকেছিল। অবাক দৃষ্টিতে বাঁধনের দিকে তাকাই মায়া।
” কি হলো? শুনতে পাচ্ছো না? আমি খুব টায়ার্ড। তাড়াতাড়ি রুমটা খালি করো, আমায় একটু একা থাকতে দাও।”
মুখে বিরক্তির ভাব এনে কথাটা বলেছিল বাঁধন। প্রচন্ড অভিমানে রুম ত্যাগ করে মায়া। আগেকার সেই রুমে প্রবেশ করে দরজার ছিটকিনি এটে হাউহাউ করে কেঁদে উঠে মায়া। কাঁদতে কাঁদতে একটা সময় দরজায় হেলান দিয়ে ক্লান্ত হয়ে বসে পরে সে।
এদিকে বাঁধন চটজলদি রুম থেকে বের হয়ে গেল। বন্ধু শফিক সবুজ বেনারসি আর আরএফএল চেয়ার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে’ই ছিল। সবুজ বেনারসি আর আরএফএল চেয়ারটা গাড়িতে রেখে কতগুলো রেশমি চুড়ি আর একজোড়া নূপুর কিনে আনে বাঁধন। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক নুসরাতকে ডাক দেয় বাঁধন। নুসরাতের হাতে সবুজ বেনারসি শাড়িটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
” তাড়াতাড়ি যান।”
নুসরাত শাড়ি হাতে মায়া মায়া করতে করতে দরজায় কড়া নাড়ে। ভিতর থেকে দরজা খুলে দরজা খুলে মায়া। চোখ মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে খুব করে কেঁদেছে পাগলীটা। রুমে প্রবেশ করে দরজাটা বন্ধ করে নুসরাত। মায়া অবাক দৃষ্টিতে সবুজ বেনারসিটার দিকে তাকিয়ে আছে।
” কি হলো?
তাড়াতাড়ি আয়! মধুর রাত যে বয়ে গেল।”
মায়া কোনো কথা না বলে ছোট্ট বাচ্চাদের মত হাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছে। নুসরাত মায়াকে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। শাড়ি পরানো শেষে নুসরাত মায়াকে নিয়ে বাঁধনের রুমের সামনে যায়। বাঁধন আগে থেকেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল মায়ার অপেক্ষায়। নুসরাত বাঁধনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই নিন আপনার বউ!
আর মায়া!!!
যদি পারিস তো মুখের ঐ মেকাপ, লিপস্টিক ধূয়ে নিস। না হলে বেচারার পেট খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
দুষ্টু হাসি দিয়ে চলে যায় নুসরাত। নুসরাত চলে যাওয়ার পর বাঁধন নুসরাতকে একটানে রুমে নিয়ে নেয়।
রাত্রি তখন এগারো’টা ঊনষাট মিনিট। বাঁধন মায়াকে বলে, “চোখ বন্ধ করো।”
মায়া চোখ বন্ধ করতেই বাঁধন রেশমি চুড়ি আর নূপুর জোড়া মায়ার হাতে, পায়ে পরিয়ে দিয়ে বলে, চোখ খোল।
চোখ খুলে মায়া অবাক। প্রায় মিনিট পাঁচেক বাঁধনের দিকে চেয়ে থেকে, কেঁদে ফেলল। বাঁধন মায়ার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, কান্না নয়! আবার চোখ বন্ধ করো।
মায়া চোখ বন্ধ করলে বাঁধন লুকিয়ে রাখা আরএফএল চেয়াটা মায়ার সামনে রাখে। মায়া চোখ খুলে চেয়ারটা দেখে বাঁধনের দিকে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকালো। বাঁধন দুষ্টু হাসি দিয়ে মায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
এ শুধু ঘাম মুছার জন্য নয়,
এ কিন্তু আমাদের অন্য কাজেও লাগবে।
লজ্জায় মায়া বাঁধনের বুকে মুখ লুকালো। বাঁধন মায়ার মাথায় হাত রেখে ডাকল। তারপর মায়া এমন একটা হাসি দিল, মনে হলো সারা ঘর ওর হাসিতে কেঁপে উঠল। দালান ঘরে হাসিটা চার দেয়ালে প্রতিধ্বণিত হতে লাগল। বাঁধন বিশ্বাস করতে পারছিলনা__মায়া এভাবে হাসতে পারে। সেদিনই বাঁধন মানল, মায়ার মত পৃথিবীতে আর কেউ হাসতে পারে না। বাঁধন মুগ্ধ হয়ে মায়ার হাসি দেখছিল। তা দেখে মায়া লজ্জা পেয়ে বাঁধনের বুকে মাথা রাখল।
বাঁধন চুপিচুপি বলল-
ওঠো, খেয়ে নিই। আজ তোমাকে অনেক ভালোবাসা দেব। আর তা নিতে তো শক্তির প্রয়োজন তাই, না?
মায়া বলল, চলো খেয়ে নিই।
তারপর আবার সেই হাসি, মায়াবী হাসি।

♦সমাপ্ত♦
[ দুটি কথা:- কেউ কাউকে না দেখেও ভালোবাসতে পারে। কারন সত্যিকার ভালোবাসা সৃষ্টি হয় মন থেকে, রূপ থেকে নয়।। আর ভালোবাসা মন দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়।]

কৃষ্ণকলি পর্ব- ১২

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ১২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

চোখ খুলে অবাক মায়া চোখের ভ্রম ভেবে চোখটা বার কয়েক কচলায়। তারপর আবারো এদিক-ওদিক তাকায়। মায়া নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা কি সত্যি’ই! বাঁধনের পুরো পরিবার আমার সামনে???
না, না! এ হতে পারে না।
এ সত্যি নয়। আমি স্বপ্ন দেখছি। শুধু’ই স্বপ্ন।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজে নিজেকেই চিমটি কাটে মায়া। সাথে সাথে ব্যথায় কুকিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠে সে। বাঁধনের বাবা তখন মায়ার পাশেই দাঁড়িয়ে।
” স্বপ্ন নয়গো বন্ধু, স্বপ্ন নয়। আমরা সত্যি সত্যি তোমাদের বাসায় চলে আসছি।”

মায়ার দৃষ্টি এতক্ষণে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাঁধনের বাবার দিকে গেল। যেহেতু ফেসবুকে একাধিকবার মায়া তার বন্ধু শফিকের ছবি দেখেছে, তাই জনাব শফিক সাহেবকে চিনে নিতে খুব বেশী বেগ পেতে হয়নি মায়াকে। আজ শফিক সাহেব বাঁধনের বাবার স্থানে না থাকলে মায়া কত গল্প’ই না জুড়ে দিত ওনার সাথে।
কিন্তু আফসোস! ওনি এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন যার সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলা যায়, গল্পও করা যায়। কিন্তু রসিকতার ছলে হাসি তামাশা করা যায় না। কারণ- ওনি বাঁধনের বাবা।
ছি, কি লজ্জা!
আমি কি না আপন বাপের সাথে তার ছেলের ব্যাপারে নানা ঘটনা শেয়ার করেছি!

ফোনে কথা বলে ভেবেছিলাম আমার মায়া বন্ধু ভিষণ হাসি খুশী আর খোলামনের অধিকারী। এখনটু দেখছি তার উল্টো’টা। মুখ ভাপা পিঠার মত ফুলিয়ে গম্ভীর করে রেখেছে। মায়ার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে কথাটা বললেন বাঁধনের বাবা।
জি, না— আমার বান্ধবী মোটেও গুমড়ামুখী না। আপনার প্রথম ধারনা’ই ঠিক। আমার বান্ধবী ভিষণ খোলামনের একজন মানুষ। বাঁধনের বাবার প্রশ্নের জবাবে কথাটা বললেন নুসরাত।

বাঁধনের বাবা আড়চোখে মায়ার দিকে তাকিয়ে বললেন-
” তার নমুনা তো আমি দেখতেই পাচ্ছি। এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি, আমায় একটা বার Hi,Hlw কিংবা সালামটাও দিতে পারেনি। জিজ্ঞেস করতে পারে নি বন্ধু আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?”
বাঁধনের বাবার কথাগুলো শুনার পরও চুপ করে আছে মায়া। আসলে ও এরকম এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে যে, জড়তা কাটিয়ে যে একটু কুশল বিনিময় করবে সেটাও পারছে না। কথা বলতে চেয়েও বলতে পারছে না মায়া। কেন জানি মনে ও ওর বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তা না হলে একসময়কার প্রিয় ব্যক্তিত্ব, মন খারাপের সাথী বন্ধু শফিকের সাহেবের সাথে কথা না বলে থাকতে পারত না।
পুরো রুম জুড়ে থমথমে নিরবতা। মায়ার হঠাৎ আগমন সবার সব উচ্ছ্বাস বন্ধ করে দিয়েছে কিছুক্ষণের জন্য।
” ভাইয়া! ওয়াশরুমটা কোনটিকে?”
সবার সব নিরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে বাঁধন।
মায়ার ভাই জনাব মামুন আঙ্গুল উঁচু করে বলেন, সোজা গিয়ে ডানে। মায়া ওকে একটু ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দিয়ে আয়’তো!!!!
ভাইয়ের কথায় জি আচ্ছা বলে মৃদু মাথা নাড়ে মায়া। তারপর সামনের দিনে চলা শুরু করে। পিছনে মায়াকে অনুসরন করে বাঁধন চলছে। কিছুদুর গিয়ে থেমে যায় মায়া। বাঁধনের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় সে। মাথা নিচু করে বলে- সামনেই ওয়াশরুম।
ধন্যবাদ আপনাকে—–
কথাটা বলে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে বাঁধন।
মিনিট পাঁচেক পর ভেঁজা শরীর নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে বাঁধন। বাঁধনের হাত, মুখ, শার্টের ক্ষাণিকটা অংশ ভিঁজে একাকার হয়ে আছে।
“তোর এই অবস্থা কেন?”
প্রশ্ন করেন বাঁধনের বাবা তার ছেলে বাঁধনকে। বাঁধন মাথা নিচু করে জবাব দেয়, আসলে শরীর মুছার জন্য কিছু নিয়ে যায়নি ওয়াশরুমে…..
মায়ার ভাইয়া বসা থেকে উঠে ডাক দেয় মায়াকে। ভাইয়ার ডাক পেয়ে রুম থেকে ছুটে আসে মায়া।
” জি, ভাইয়া! কিছু বলবে?”

অতিথিরা বাড়িতে এলে তাদেরকে অজু গোসলের পানি তুলে দেওয়ার সাথে সাথে তাদের দিকে গামছা বা তোয়ালে এগিয়ে দিতে হয়,সেটা তুমি জানো না???
কিছুটা রাগী স্বরে প্রশ্ন করেন মামুন ওনার বোন মায়াকে।
” ইসরে! কি ভুল’টাই করে ফেললাম”….
মনে মনে কথাটা বলে মায়া।
” কি হলো? ওর থাকার জন্য একটা রুম দেখিয়ে দে, আর একটা তোয়ালে দে….”

জি, আচ্ছা…
আসুন ভাইয়া বলে বাঁধনকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় মায়া। একটা রুমের সামনে গিয়ে থেমে যায় মায়া। বাঁধনের দিকে না তাকিয়েই বলে, আপনি রুমে যান। আমি তোয়ালে নিয়ে আসছি। বাঁধন রুমে যায়। বেশ সুন্দর, ছিমছাম, গুছানো একটা রুম। মনে হচ্ছে প্রতিদিন রুমটা মুছা হয়+আসবাবপত্র পরিষ্কার করা হয়। একটা বড়সড় ক্লান্তির নিঃশ্বাস ফেলে সোফায় ধপাস করে বসে পরে বাঁধন। মায়া ততক্ষণে তোয়ালে নিয়ে এসে হাজির। বাঁধনের দিকে তোয়ালে’টা বাড়িয়ে দিয়ে বলে-
” এই নিন”…..
বাঁধন তোয়ালে না ধরে মুগ্ধ চোখে মায়ার গভীর কালো চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। এ চোখে আমার জন্য এত মায়া, এত ভালোবাসা রয়েছে সেটা আমি এত কাছাকাছি থেকেও বুঝতে পারলাম না আমি অভাগা। উল্টা পাল্টা কথা শুনিয়ে দিনের পর দিন ওকে শুধু কষ্ট’ই উপহার দিয়েছি। মায়ার চোখের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁধন।
এদিকে বাঁধনের এরকম ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে থাকায় লজ্জা পায় মায়া। আমতা আমতা করে বলে উঠে-
” আ… আ…আপনার তোয়ালে…”
মায়ার কথায় ঘোর কাটে বাঁধনের। চোখ ফিরিয়ে নেয় মায়ার চোখ থেকে। দাও বলে মায়ার থেকে তোয়ালে’টা নিয়ে নেয় বাঁধন।
তোয়ালে দিয়ে মায়া যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। কোনো রকম তাড়াহুড়ো করে বের হচ্ছিল রুম থেকে। পিছন থেকে ডাক দেয় বাঁধন_
” ও ইয়ে শুনেন….”
ফিরে তাকাই মায়া। নিচের দিকে তাকিয়েই বাঁধনকে জিজ্ঞেস করে সে, কিছু বলবেন?
বাঁধন তোয়ালে’টা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে দেখে বলে-
” বেশ পুরনো।”
বাঁধনের কথা শুনে চমকে তাকাই মানে। বাঁধন আবারো বলে,
” তোয়ালে’টা বেশ পুরনো। মনে হচ্ছে কেউ ইউজ করেছে।”
হ্যাঁ, এটা আমার। ইউজ করেছি, তবে পুরনো নয়। মাত্র আজকেই কিনে এনেছে ভাইয়া আমার জন্য। আচ্ছা, আপনার প্রবলেম হলে দিয়ে দিতে পারুন এটা। মাথা নিচু করে কথাগুলো বলে মায়া।
বাঁধন মায়ার হাতে তোয়ালে’টা তুলে দেয়। তোয়ালে হাতে নিয়ে চটজলদি রুম থেকে কেটে পরতে চাইছিল মায়া। পিছন থেকে আবারো বাঁধনের ডাক।
” ও ইয়ে…….”
মায়া ফিরে তাকাই। দূর থেকেই বলে, কিছু বলবেন?
‘এতদূর থেকে বলা যাবে না।’
বাঁধন মায়াকে কাছে ডাকে। মায়া একপা দুপা করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
” জি, বলুন….”
বাঁধন এদিক-ওদিক তাকিয়ে আস্তে করে বলে, আপনার তোয়ালে’টা তো নিয়ে গেলেন। এদিকে প্রচন্ড গরমে আমার শরীর থেকে যে ঘাম ঝরতেছে সেটার কি হবে?

—- আমি টিস্যু এনে দিচ্ছি, একটু ওয়েট করেন। কথাটা বলে চলে যাচ্ছিল মায়া। পিছন থেকে বলে উঠে বাঁধন, শুনোন!আমার টিস্যুতে হবে না…..
তাহলে? ঘাম মুছবেন কিভাবে?
প্রশ্ন করে মায়া।
~ ওড়না দিয়ে….
দুষ্টু হেসে জবাব দেয় বাঁধন। মায়ার অবাক মাত্রাটা এবার দ্বিগুন বেড়ে যায়। বোবার মত হয়ে বাঁধনের দিকে জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মায়া।
” কি হলো? বুঝতে পারছেন না? আপনি আপনার ওড়নার কথা বলছি। আবারো দুষ্টু হাসি দিয়ে কথাটি বলে বাঁধন।”
এদিকে লজ্জায় মায়ার নাক মুখ লাল হয়ে গেছে। কোনো কথা না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে হাতের আঙ্গুল মুচড়াচ্ছে সে।

কি হলো?
আপনি মুছে দিবেন নাকি আমি’ই মুছব?
সোফা থেকে উঠে কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে কথাটা বলে চুপ করে সোফায় গিয়ে বসে পরে বাঁধন। মায়া লজ্জায় একেবারে মাটির দিকে মিশে যাচ্ছে। বাঁধনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত শক্তি এবং সাহস কোনোটাই এই মুহূর্তে ও খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে বাঁধন?!!!
একটু একটু করে মায়ার দিকেই এগিয়ে আসছে। মায়ার কাছে এসে দাঁড়িয়ে যেই মায়ার ওড়নায় একপাশে হাত দিবে ওমনি মায়া চোখ বোজে বলে উঠে-
” আমি দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি……”

জি, দিন….
বলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাঁধন। মায়া গায়ে পরা অবস্থায়’ই ওর ওড়নার একপাশ হাতে নেয়। ওড়না হাতে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মায়া। আসলে কি করতে কি করবে ও বুঝে উঠতে পারছে না।
এটা দেখে বাঁধন আবারো বলে উঠে_
” ওড়নাটা দিন’তো।
আপনার মুছতে হবে না।”
মায়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলে-
” না, না! আমি মুছে দিচ্ছি।”

মায়ার ভীরু হাতদুটো বাঁধনের মুখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাঁধন যদিও চোখ বোজে আছে, তবুও আড়চোখে মাঝে মাঝে মায়ার দিকে তাকাচ্ছে। বাঁধন মায়ার থেকে অনেক লম্বা। মায়ার তাই বাঁধনের মুখের নাগাল পেতে কষ্ট হচ্ছে। মায়া পা উঁচু করে আপ্রাণ চেষ্টা করছে বাঁধনের ঘামে ভেঁজা মুখটা মুছে দিতে। কিন্তু পারছে না।
মায়া ওর Hight এর জন্য মনে মনে নিজেকে নিজেই গালি দিচ্ছে আর পা দুটো আরেকটু উঁচু করার চেষ্টা করছে। বাঁধন চোখ বোজে ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে আর মনে মনে হাসছে। অপরদিকে মায়া চেষ্টা করেই যাচ্ছে।

এদিকে বাঁধনের বাবা রুমে প্রবেশ করছে-
” মায়া! কইরে তুই? একটু বাঁধনের রুমে আয়……”
আওয়াজটা এদিক থেকেই আসছে ভেবে চোখ খুলে বাঁধন। এদিকে মায়া ভয় পেয়ে উঁচু করা পা দুটো নিয়ে হেলে পরে বাঁধনের দিকে। অতঃপর…………

চলবে………

কৃষ্ণকলি পর্ব:- ১১

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব:- ১১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।.

এয়ারপোর্টে জনাব শফিক সাহেবকে রিসিভ করার জন্য একদিকে দাঁড়িয়ে আছেন বাঁধন ও তার পরিবার অন্যদিকে মায়ার বন্ধু শফিককে রিসিভ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তার নুসরাত। নুসরাত বাঁধন ও তার পরিবারের সাথে এয়ারপোর্টে এসেছে ঠিক’ই কিন্তু সেটা বাঁধনের বাবা শফিক সাহেবের জন্য নয়। নুসরাত এসেছে মায়ার ফেসবুক বন্ধু শফিককে রিসিভ করতে। ওনার জন্য অধির আগ্রহে এই কারণে অপেক্ষা করছেন যে, ওনি যেহেতু এই এলাকারই সেহেতু বিয়েটা ওনি ভাঙ্গতে পারবেন। নুসরাত জানত, শফিক সাহেব মায়ার খুব ভালো একজন বন্ধু। আর এও জানত, শফিক মায়া-বাঁধনের মিলনের সেতুবন্ধন হতে পারে।

দূরে দেখা যাচ্ছে একজন ভদ্রলোক কোর্ট কাঁধে হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে হাসোজ্জ্বল মুখে এদিকেই এগিয়ে আসছেন। দূর থেকে লোকটাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে এই মায়ার বন্ধু শফিক, তবে শিউর নয়। একটু কাছে আসতেই নুসরাতের সব কনফিউশন দুর হয়ে যায়। হ্যাঁ, ওর অনুমান’ই ঠিক। ইনিই শফিক সাহেব, মায়ার বন্ধু। অবশেষে তাহলে সব অপেক্ষার অবসান ঘটল। জনাব শফিক হাসোজ্জ্বল মুখে ওনার বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু নুসরাত সেটা না বুঝেই ওর হাতটা বাড়িয়ে দেয়_
Hi! I am Nusrat.
শফিক সাহেব নুসরাতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেন-
Hlw! Nice too meet you…
প্রথম দিনেই হবু শ্বশুরের সাথে নুসরাতের এমন ব্যবহারে অবাক বাঁধন ও তার পরিবার। শফিক সাহেব সবার মুখের অবস্থা খেয়াল করে বলেন-
Oh, sorry…..
নুসরাত আসো তোমাকে আমার ফ্যামিলির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। কথাটা বলেই শফিক সাহেব ওনার বাবা, ভাই ও স্ত্রী ছেলে মেয়ের দিকে তাকালেন। নুসরাত এ হচ্ছে আমার ভাই রফিক, এ হচ্ছে আমার ছোট ভাই কফিল, এ আমার বাবা, এ আমার স্ত্রী শাহনাজ, এ আমার ছেলে বাঁধন, আর এ আমার ছোট্ট মেয়ে সুইটি।
নুসরাতের হাসোজ্জ্বল মুখ নিমিষেই কালো অন্ধকারের ন্যায় হয়ে গেল। নুসরাত মনে মনে ভাবছে, ওনার ছেলের বিয়ে আর আমি কি না ওনাকেই আনলাম বিয়ে ভাঙ্গাতে?
হায় আল্লাহ!
এ তুমি আমায় কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন করলে? আমি এখন কি করব? শফিক সাহেব যদি এখন’ই সব বলে দেয়? এ মুখ আমি কোথায় লুকাবো???
এদিকে বাঁধন ও তার পরিবারের অবাক হওয়ার মাত্রাটা উত্তরোত্তর বেড়েই চলছে। বাঁধনের দাদা প্রশ্ন করেন বাঁধনের বাবাকে।
“শফিক! তুই কি নুসরাতকে আগে থেকেই চিনিস?”
নুসরাত না করতে যাবে আর আগেই হাসোজ্জ্বল মুখে গড়গড় করে বলা শুরু করে শফিক_
” বাবা! এ হচ্ছে নুসরাত। এর সাথে পরিচয় আমার ফেসবুকে ৬/৭বছর আগে। এর বিয়ে ঠিক হয়ছে। কিন্তু এ কিছুতেই বিয়েটা করবে না। এখন নুসরাত চাচ্ছে বিয়েটা যেকোনো মতে ভেঙ্গে দিতে। আর সেই বিয়ে ভাঙ্গার জন্য’ই আমার এখানে ছুটে আসা।”
উপস্থিত সকলে বাঁধনের বাবার কথায় চমকে উঠে। বাঁধনের বড় কাকা বলে উঠে, ভাই! তোর মাথা’টা যায়নি তো?!
বাঁধনের ছোট কাকা বলে উঠে, ভাইজান! কি বলছো তুমি? ভেবে বলছ তো?
সুইটি বলে উঠে, আব্বু! তুমি নুসরাত আপুর বিয়ে ভাঙ্গতে এসেছ?
সবশেষে বাঁধন প্রশ্ন করে, বাবা! তুমি আমার বিয়ে ভাঙ্গতে এসেছ?
বাঁধনের প্রশ্ন শুনে চমকে উঠে বাঁধনের বাবা। তোর বিয়ে মানে?
বাঁধনের মা প্রতিউত্তরে বলেন- তুমি যে মেয়ের বিয়ে ভাঙ্গতে এসেছ, সেই মেয়ের সাথেই বাঁধনের বিয়ের কথা বার্তা চলছে।
– কি?!!!
নুসরাত এই বাঁধনের সাথেই তোমার বিয়ে হচ্ছে?
বাঁধনের বাবার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সাহস এবং ক্ষমতা কোনোটাই নুসরাতের নেই।
নুসরাত শুধু মাথা নিচু করে নির্বাক দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। নুসরাতের থেকে কোনো প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে প্রশ্ন করেন, বাঁধনের মাকে। জিজ্ঞেস করেন, শাহনাজ! এই মেয়ে কি তোমাদের সাথে একই বাসায় থাকে? বাঁধনের মাথা অস্ফুট স্বরে মাথা নাড়িয়ে বলে হ্যাঁ…..
বাঁধনের বাবা আবারো প্রশ্ন করেন- এই মেয়ের বান্ধবীও কি তোমাদের সাথেই থাকে? এবারো বাঁধনের মা হ্যাঁ সূচক জবাব দেন। কিছুক্ষণের জন্য বাঁধনের বাবা চুপসে যান। তারপর নিরবতা ভেঙ্গে বলেন-
Okey, fine.
এটা পাব্লিক প্লেস। এখানে বেশী কথা না বলাই Better. চলো, বাসায় চলো…..
বাঁধন এবং ওর পরিবারের সবাই নিঃশব্দে গাড়িতে উঠে বসে। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। নিরবতা ভাঙ্গে বাঁধনের দাদা। প্রশ্ন করে নুসরাতকে।
” বিয়েতে মত ছিল না বললেই পারতে। এভাবে অপমানের কোনো মানে ছিল কি?”
বাঁধনের দাদার প্রশ্নের পর পরই প্রশ্ন করে বাঁধনের মা_
” তোমাকে আমি মেয়ে মানতাম। সেই তুমি যে আমাকে এভাবে হেয় করবে কখনো কল্পনাতেও ভাবিনি।”
এবার মুখ খুলে বাঁধনের ছোট বোন সুইটি।
” আপু! এতগুলো মানুষের ভালোবাসার প্রতিদান যে তুমি এভাবে দিবে, কখনো সেটা বুঝতেই পারিনি।”
নুসরাত চুপ হয়ে আছে। কারো প্রশ্নের কোনো উত্তরই ও দিতে পারছে না। এদিকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে সবাই নুসরাতকে। শফিক সাহেব আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। গাড়িটা রাস্তার পাশে থামাতে বলে, মুখ খুলেন ওনি। মায়ার বাঁধনের ব্যাপারে একে সব ঘটনা খুলে বলেন ওনি। সেই প্রথম পরিচয় থেকে আজকের এ দিন পর্যন্ত সব। সব বলে অকপটে বলে দিলেন শফিক সাহেব ওনার পরিবারের সবার সামনে। সবার উৎসুক দৃষ্টি তখন বাঁধনের দিকে। বাঁধনের বাবা বললেন, কথা পরে হবে। আগে বাসায় চলো।
এই মুহূর্তে বাঁধনের পরিবারের সবার অবস্থান ড্রয়িংরুমে। ড্রয়িংরুমে একেকজন একেকরকম মোড করে বসে আছেন। সবাই নিরব। নিরবতা ভাঙ্গে বাঁধনের মা। বাঁধনের বাবার দিকে তাকিয়ে বলে-
” তার মানে বাঁধন কখনো মায়াকে দেখেনি?”
___ নাহ্! দেখেনি। কারণ- মায়া ছিল কালো। খুউব কালো। আর তাই সবসময় একটা ভয় ওকে তাড়িয়ে বেড়াত। আর সেটা হলো এমন কালো চেহারা নিয়ে বাঁধনের সামনে গেলে যদি বাঁধন ফিরিয়ে দেয় ওকে। হারিয়ে যায় যদি ভালোবাসার এই তীব্রতা’টুকু? তাই বোকা মেয়েটি বাঁধনের সামনে যেতে পারেনি। সিদ্ধান্ত নেয়, বাঁধনকে ও দুর থেকেই ভালোবেসে যাবে।
এটুকু বলেই চোখের জল ছেড়ে দেয় বাঁধনের বাবা।
বাঁধনের মা বাঁধনের কাছে ছুটে যায়। জিজ্ঞেস করে, বাঁধন! ওরা যা বলছে তা কি….. (……)….????
অশ্রুভেঁজা চোখে মাথাটা আংশিক নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয় বাঁধন।
অশ্রুভেঁজা চোখ নিয়ে বসা থেকে উঠে পরে বাঁধনের মা। ছুটে যায় উপরে মায়ার রুমে। রুমে গিয়ে মুচড় দিয়ে উঠে বাঁধনের মায়ের ভেতরটা। পুরো রুম শূন্য। কোথাও মায়া নেই। এ রুম থেকে ও রুম, তারপর বাথরুম, কিচেন। সবশেষে ছাদ। কোথাও নেই মায়া। একটা বিকট চিৎকার দিয়ে ফ্লোরে বসে পরে বাঁধনের মা। বিলাপ করে বলে উঠে-
” এ তুই কি করলিরে মা? এভাবে আমাকে স্বার্থপর বানিয়ে চলে গেলি? আমি কি তোর একটুও আপন ছিলাম না?”

নিচ থেকে চিৎকার শুনে ছুটে আসে বাঁধনের পরিবারের সবাই। পুরো বাড়ি জুড়ে মায়ার কোনো অস্তিত্ব না থাকা, আর বাঁধনের মায়ের এমনভাবে কান্না করাতে সবাই বুঝে যায় মায়া আর এ বাড়িতে নেই। মায়া চলে গেছে। দুর- বহুদূর চলে গেছে। বাঁধন অকস্মাৎ দাঁড়ানো থেকে হাটুগেড়ে ফ্লোরে বসে পরে। জমিয়ে রাখা অশ্রুকণাগুলো বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ঝরঝর করে ঝরে পরে বাঁধনের চোখ থেকে। হায় আল্লাহ!
এতটা কাছে থাকা সত্ত্বেও আমি আমার ভালোবাসার মায়াপরীটাকে চিনে নিতে পারলাম না! এতটা অভাগা আমি….
যে গল্পের একটা সুন্দর পরিসমাপ্তি ঘটতে পারত, সেটা এভাবে শেষ হয়ে গেল???
আমার জীবন গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দিয়ে গেল ও….
এখানেই তবে শেষ হয়ে গেল আমার জীবন গল্পের?

নাহ! গল্প শেষ হয়নি।
যেখানে গল্পের শেষ হয়, কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটে ঠিক সেখান থেকেই শুরু হয়েছে বাঁধনের জীবন। বাঁধন হৃদয়ের সমস্তটুকু আবেগ দিয়ে ভালোবাসত অচেনা মায়াকে। সেই ভালোবাসা এত সহজেই শেষ হয়ে যেতে পারে না। যদিও মুখে মায়ার প্রতি চরম আক্রোশ প্রকাশ করত, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ঠিক’ই কাঁদত বাঁধন ওর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা মায়ার জন্য। সেদিন রাত্রে বাঁধনের পরিবার নুসরাতের সহযোগীতায় বাঁধনকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হয় মায়াদের বাসায়। মায়ার একমাত্র সৎ ভাই এবং ভাবি’ই ছিল তখন মায়ার একমাত্র অভিভাবক। তারা মায়ার ভাই-ভাবিদের কাছ থেকে এটা জেনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যে মায়া এই বাড়িতেই আছে। সম্পর্কে মায়ার সৎ ভাই-ভাবি হলেও এদের আচার-ব্যবহারে মুগ্ধ বাঁধনের পরিবার। ভদ্রতা, মার্জিত ও শালিনভাবে কথা বার্তা, আতিথিপেয়তা সবগুনেই অনন্যের দাবিদার এরা। বাঁধনের পরিবার সেদিন সবটা খুলে বলে মায়ার ভাই-ভাবিদের। আর এটাও বলে মায়ার- বাঁধনের মিলনে ওদের সাহায্যটাও খুব দরকার। মায়ার ভাই ভাবি আশ্বাস দেয় যে, আল্লাহ চাহেতো এদের দুজনের মিল হবেই…..

সদ্য নির্মিত বিশাল বড় এই বাড়িটিতে মায়ার ভাই ভাবি একা একাই থাকত। আজ এতগুলো মানুষকে একসাথে পেয়ে আনন্দে চোখে জল এসে গেল মায়ার ভাই-ভাবির। সবাই যখন হাসি আনন্দে মাতোয়ারা তখন চোখ কচলাতে কচলাতে উপর তলা থেকে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে মায়া। চোখ বোজেই প্রশ্ন করে- কি হয়েছে ভাবি? বাসায় এত হৈহুল্লুর কিসের? সবাই চুপসে গিয়ে মায়ার দিকে তাকালো। মায়া তখনো ঘুমে ঢুলুঢুলু। চোখ নিয়ে তাকাতেই পারছে না।
বাঁধনের বাবা সোফা থেকে উঠে এসে বাঁধনের পাশে দাঁড়িয়ে আচমকা বলে উঠল-
” হৈহুল্লুর, নাচ-গান, আরো কত কি হবে।
মায়া বন্ধুর বিয়ে বলে কথা….!”

বন্ধু?!!!!
চমকে উঠে চোখ মেলে তাকালো মায়া…..

চলবে………

কৃষ্ণকলি পর্ব- ১০

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ১০
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

সংযত হয়ে কথা বলুন মিস নুসরাত।
নুসরাতের উদ্ভট আচরণে রাগান্বিত হয়ে কথাটা বলে বাঁধন। নুসরাতের রাগ উত্তরোত্তর বেড়েই চলছে। সেই রাগের বশবর্তী হয়েই নুসরাত বলে ফেলে-
” তুই আমার কলিজায় হাত দিয়েছিস। তোর সাথে আমি কিভাবে ভালো ভাবে কথা বলব তুই’ই বলে দে।”
অকস্মাৎ নুসরাতে এ হেন আচরণে অবাক হয় বাঁধন। আর তাইতো নুসরাতের কোনো কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে বাঁধন। এদিকে নুসরাত বিরামহীন ভাবে বলেই চলছে_
” মায়া আমার বান্ধবী। ও আমার এমন একজন বান্ধবী যার জন্য আমি আমার কলিজাটাও কেটে দিয়ে দিতে রাজি। আর তুই কি না সেই মেয়েকেই ফালতু বললি। তোর সাহস তো কম নয়।”

নুসরাতের কথার মাঝখানে নুসরাতকে থামিয়ে দেয় বাঁধন। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে- ওহ!
পরাণের বান্ধবী….!!!
তাইতো বলি নিজের খেয়ে বনের মোষ কেন তাড়াচ্ছে?!
নুসরাত বাঁধনকে কিছু একটা বলতে যাবে তখনই ওদের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলাম আমি। আমায় দেখে বাঁধন কিছুটা স্থির হলো। আর নুসরাতের সব রাগ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বাঁধনের সামনে গিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়ালাম আমি।
” স্যরি, বাঁধন ভাইয়া। আমার বান্ধবীর কৃতকর্মের জন্য আমি সত্যি’ই লজ্জিত। আসলে ও উন্মাদ হয়ে গেছে। ভালোবাসার মানুষটি থেকে ধোঁকা খেয়ে বড্ড উন্মাদ হয়ে গেছে। সেই থেকে ও কোনো পুরুষ মানুষের মুখে ভালোবাসি কথাটা সহ্য করতে পারে না। ওর চোখের সামনে কোনো পুরুষ কোনো নারীকে নিয়ে কটুক্তি করলেই হলো, ব্যাস! ও লেগে যায় কোমর বেঁধে তার বিপক্ষে।”
আমার কথা শুনে বাঁধন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে-
ওহ, তাই বলুন! আমি তো ভাবলাম ওনি সত্যি সত্যি মায়ার কোনো কালের বান্ধবী।

আরে না, না!
ওহ, হ্যাঁ যে কথাটি বলতে এসেছিলাম—
আন্টি আপনাদের ডাকতেছে। বলল কি জানি কথা আছে! কথাটা বলেই রুমের দিকে পা বাড়ালাম। বাঁধন নুসরাত আমার পিছু পিছু চলল বাসার দিকে।
বাসায় প্রবেশ করেই নুসরাত রাগে হনহন করে উপরে চলে যায়, আর বাঁধন মায়ের পাশে গিয়ে বসল। এদিকে নুসরাতের রাগ ভাঙ্গাতে ওর পিছু পিছু চললাম আমি।
কিন্তু রাগ আর ভাঙ্গাতে পারলাম না। যে মিথ্যেটা কখনো সহ্য করতে পারে না নুসরাত, সেই মিথ্যেটাই বললাম। তাও আবার ওকে জড়িয়ে। পাগলী ভীষণ ক্ষেপেছে বুঝতে পারলাম। নুসরাতের রাগ ভাঙ্গানোর বৃথা চেষ্টা করে মিনিট পাঁচেক পর ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ালাম।
বাঁধনের মায়ের একটা কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। দাঁড়িয়ে পরলাম দেয়ালে হেলান দিয়ে পর্দার আড়ালে।
বাঁধনের মা বাঁধনের জীবন সঙ্গীনি হিসেবে নুসরাতকে পছন্দ করেছে। আর সেই পক্ষে সবার মতামত জানতে চাইছে। বাঁধনের দাদাই প্রথম মুখ খুলে। ওনি ওনার মতামত পেশ করেন এভাবে__
” বউমা! আমি তো ভাবছিলাম তুমি বাঁধনের জন্য মিষ্টি(মায়া)কে পছন্দ করেছ। কিন্তু তুমি যে তার বান্ধবীকে পছন্দ করবে সেটা বুঝতে পারিনি। আসলে বাঁধনের জীবনসঙ্গীনি হিসেবে নুসরাত নয়, ঐ মেয়েকেই আমার উপযুক্ত মনে হয়েছিল। চলায়, বলায়, আচার- আচরণে অনন্য ঐ মেয়েটি। যদিও একটু কালো কিন্তু কালো’টা কোনো ফ্যাক্ট না।”
বাঁধনের দাদার মুখ থেকে কথা ছুঁ মেরে কেড়ে নেয় বাঁধনের বড় কাকা। বাপের কথার প্রতিউত্তরে ওনি বলেন-
” কি বলছেন আপনি আব্বা? ঐ কালো মেয়েকে বিয়ে করবে আমাদের বাঁধন? শেষমেষ নাতির জীবনটা শেষ করে দিয়ে যাবেন? বাঁধন মুখ দেখাবে কিভাবে মানুষকে? ঐ কালো মেয়েকে নিয়ে ও কি পারবে বন্ধুদের সামনে যেতে? পারবে কোনো প্রোগ্রামে যেতে? আমাদের স্ট্যাটাস আর ওর স্ট্যাটাস মিলবে???”
বাঁধনের বড় কাকার মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয় ওর বড় কাকি। রাগে গজগজ করে বলে_
” কেন? কালোরা কি মানুষ না? ওরা কি আল্লাহর সৃষ্টি না? ওদের শরীরে কি অন্য রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে নাকি? আর স্ট্যাটাসের কথা কেন বলছেন? যারা নিঃস্ব ওদের কি বিয়ে হচ্ছে না? গরীব’দের বড় পরিবারে বিয়ে হচ্ছে না?”
বাঁধনের ছোট কাকা বলে উঠে_
” ভাবি তো ঠিক’ই বলেছে। আর ঐ মেয়ের কি নেই? শিক্ষায় দীক্ষায় আচার আচরণে সব দিক দিয়ে অনন্য।”
বাঁধনের ছোট কাকিও বলে উঠে__
” হ্যাঁ, ঐ মেয়েকে আমারও পছন্দ হয়েছে।
থাক কালো। কালোতে কি আসে যায়?”

মিষ্টিকে আমি মেয়ে মানি। আর বউ হিসেবে আমার নুসরাতকেই ভালো লেগেছে। তাই বলে ভাববেন না ওর কথা ভুলে যাব। ওকে আমরা ধূমধামের সাথে অনেক বড় ঘরে ভালো পরিবারে বিয়ে দিব। তাই ওর জন্য আপনারা এত চিন্তা না করে শুধু এটুকু বলুন, নুসরাত বউ হিসেবে যোগ্য কি না?
বাঁধনের মায়ের কথা শুনে বাঁধনের দাদা বলে, তাহলে তো হলো’ই। আমি বিয়েতে রাজি। বাঁধনের দাদার কথা শুনে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে সবাই একসাথে বলে উঠে—
আলহামদুলিল্লাহ!!!!

আমার পুরো শরীর কাঁপছিল।
আমি কি পড়ে যাব? বাঁধন কি সত্যি’ই নুসরাতের হয়ে যাবে? হতে পারে না। আমার ভালোবাসা অন্য কারো হতে পারে না। ঝরঝর করে চোখ থেকে পানি পরছিল আমার। পর্দার আড়াল থেকেই বাঁধন- নুসরাতের বিয়ের ব্যপারে হাজারো কথা শুনছিলাম আমি। বুঝতে পারছিলাম না কি করব? বাঁধনের মাকে বলতেই পারব না। যিনি আমাকে এতটা ভালোবাসেন, বিশ্বাস করেন এ সত্য মেনে নেওয়ার ক্ষমতা তিনি রাখেন না।
অনেক ভেবে দেখলাম, ওনার স্নেহের ঋন, ওনার ভালোবাসা আর আমাকে আগলে রাখারা আপ্রাণ চেষ্টা আমাকে স্বার্থপর হতে শেখায়নি।
মনে মনে বললাম, তুমি এবার বিয়েটা করে নিও বাঁধন। বিয়েটা করে নিও। আমার মত কালো মেয়ের আশা নাইবা হলো পূরণ। কিন্তু তোমার মায়ের ইচ্ছে’টা পূর্ণ করো তুমি।
ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বাঁধন। খুব ভয় লাগছে। ভীষণ ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে কি যেন হারিয়ে ফেলছি। যখন তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলে, তখন মন শঙ্কায় ছিল। তোমায় ফিরে পাবো কি পাবো না। সে দিনগুলোতেও এতটা অসহায় লাগেনি, যতটা আজ লাগছে। আজ ততটা ভয় লাগছে। পার্থিব এই পৃথিবীতে তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আজ পাচ্ছি বাঁধন।
আমার সব আশা যেন বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে। অদৃশ্য এক আয়নায় দেখতে পাচ্ছিলাম সাজানো একটা বাগানের সুন্দর ফুলগাছগুলো উপড়ে পড়ে আছে। কেউ যেন প্রচন্ড আক্রোশে গাছগুলো উপড়ে ফেলেছিল।
ওদের দেখার আগেই পর্দার আড়াল থেকে সরে গেলাম। ছুটে গেলাম রুমের দিকে। দরজা বন্ধ করে, বালিশে মুখ গুজে গুমড়ে গুমড়ে কেঁদেছি। পরদিন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। বিয়ের ব্যাপারে নুসরাতকে অলরেডি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। নুসরাত তাই শুধু আমায় খুঁজছে। একান্তে কথা বলার জন্য নুসরাত আমাকে একটাবারেরও জন্যও একা পায়নি। পাইনি বললে ভুল হবে। আমি’ই ওর থেকে দুরে দুরে থাকি। গাড়িতেও ওর সাথে বসিনি। নুসরাত যে গাড়িতে উঠেছে সে গাড়িতে না উঠে অন্য গাড়িতে উঠলাম। বাঁধনের দাদার পাশের সিটে চুপটি করে বসে আছি। গাড়ির গ্লাস দিয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। বাসায় গিয়ে খুব বিজি হয়ে গেলাম আমি। দিনে কলেজ+টিউশন+কোচিং।
সন্ধ্যায় নামাজ+কুরআন তেলওয়াত। এরপর বাঁধনের মায়ের সাথে সাথে এটা ওটা করা, আর রাতের খাবারের শেষে দরজা বন্ধ করে কলেজের কাজের অজুহাতে মুখ লুকিয়ে কাঁদা।
আমাকে আর পাই কে???

সেদিন ছিল শুক্রবার। শুক্রবার ছুটির দিন।
তবুও মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য একটাই। নুসরাতের থেকে দুরে থাকা। কিন্তু চালাক নুসরাত হসপিটালে যাওয়ার কথা বলে বাসায় লুকিয়ে থাকে। আমি বাসা থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে আমার পিছু নেয়। বেশি দুর যেতে পারিনি, তার আগেই ধরে ফেলে। পথ আগলে দাঁড়ালো নুসরাত।
মুখে ব্যস্তভাব এনে বললাম, প্লিজ আমায় যেতে দে সোনাপাখি। আমার কলেজে কোচিং আছে। রাগান্বিত ভঙ্গিতে নুসরাত বলে উঠে-
” একটা থাপ্পর দিমু আরেক বার যদি মিথ্যে কথা শুনি।”
আমি আবারো বললাম প্লিজ আমায় যেতে দে, আমার কলেজে ইমারজেন্সি মিটিং আছে। কথাটা বলতে দেরি, থাপ্পর দিতে দেরি না। আমি কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে জেনেছি আজ কলেজে কিচ্ছু নেই। মিটিং ফিটিং কিচ্ছু নেই। নুসরাত আমার হাত ধরে টেনে আমায় নিয়ে হাজির হয় একটা পার্কের সামনে।
এই মুহূর্তে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি ওর সামনে। চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। ও আমার থুতনি ধরে আমার মাথাটা উচু করে। চোখে চোখ রেখে বলে এখনো সময় আছে, বাঁধনের কাছে ধরা দে। ও বেচারা ওর হারিয়ে যাওয়া মায়াকে আজও ভালোবাসে। হয়ত মুখে উল্টাপাল্টা কথা বলে কিন্তু ভিতরটা ঠিকই কাঁদে। আমি অশ্রুভেঁজা নয়নে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে আছি। নুসরাত অনবরত বলেই যাচ্ছে-
” যা মায়া! যা…..
তুই যা তোর বাঁধনের কাছে।”
নুসরাতের থেকে চোখটা ফিরিয়ে নিলাম। আমি পারব না বলতে। তুই বিয়েটা করে নে।
আবারো এক থাপ্পর।
নুসরাত আমার হাতে একটা মোবাইল দিয়ে বলে তোর বলতে হবে না। শফিক সাহেবের নাম্বারটা তোল। আমি সবকিছু ওনাকে খুলে বলব। ওনি সব শুনে বিদেশ বসে থাকতে পারবেন না। ওনি ঠিক ছুটে আসবেন দেশে ওনার মায়া বন্ধুকে হেল্প করতে। শফিক সাহেবের নাম্বার দিতে অস্বীকার করলে নুসরাত হুমকি দেয় আমায়-
যানবাহন চালিত রাস্তা দিয়ে দৌঁড় দিবে, ওর প্রাণটা দিয়ে দিবে।
নাম্বার’টা বাধ্য হয়ে দিতে হলো। ও দুর থেকে ফোনে কি কথা বলল নিজেও জানি না। তারপর আমার কাছে এসে বলল,
চল! বাসায় চল…..

দেখতে দেখতে একসপ্তাহ চলে গেল।
সেদিনও ছিল শুক্রবার।
প্রচন্ড জ্বরে শয্যাশায়ী হয়ে শুয়ে আছি গত ৩,৪টা দিন ধরে। বাঁধনের পরিবারে সাজসাজ রব। কিসের জন্য এত সাজসাজ রব সেটা আমি জানি না। আর জানবার কথাও নয়। কারন- অসুস্থ হওয়ার পর থেকে প্রত্যহ বাঁধনের মা এসে আমায় খাইয়ে দিয়ে যেত। সেদিন আর বাঁধনের মা আসেনি। এসেছিল নুসরাত। নুসরাতকে দেখে শুয়া থেকে উঠার চেষ্টা করলাম। নুসরাত আমায় খাটে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। ক্লান্তচোখে দিকে তাকিয়ে বললাম-
” নিচে এত হৈহুল্লুর কিসের’রে? তোর বিয়ে উপলক্ষ্যে আমন্ত্রিত অতিথীরা আসা শুরু হইছে নাকি?”
নুসরাত আমার দিকে হাসি হাসি মুড নিয়ে বলে- আরে না!
বাঁধনের বাবা আসতেছে। মানে তোর হারিয়ে যাওয়া শ্বশুর। ওনার আগমনেই বাসায় এত খুশির জোয়ার। ওরা সবাই যাচ্ছে তোর শ্বশুরকে আনতে। নুসরাতের পোষাকের দিকে তাকিয়ে বললাম-
তুইও যাচ্ছিস নাকি?
” আরে না! আমার একজন বিগ ফ্রেন্ড ইয়ারপোর্ট দাঁড়িয়ে আছেন আমার জন্য। ওনাকেই আনতে যাচ্ছি। তোকে খাইয়ে দিয়ে যাচ্ছি। লক্ষ্মী মেয়ের মত চুপটি করে বিছানায় শুয়ে থাক, কেমন?”
নুসরাত আমায় খাইয়ে দিয়ে কপালে আলতু চুমু দিয়ে তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বের হয়ে গেল। নুসরাতসহ বাসার সবাই যখন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই তখন কাঁপা কাঁপা শরীরে নিজ রুম থেকে বাঁধনের মায়ের রুমের দিকে পা বাড়ালাম। মাথাটা বড্ড ব্যথা করছে, দেখি কিছু পায় কি না।
হেলেদুলে বাঁধনের মায়ের রুমে গিয়ে হাজির হলাম। রুমটা বেশ পরিপাটি। আজ আরো সুন্দর করে সাজানো হয়ছে। যা, ভালো লাগছে না….
মাথা ব্যথার জন্য ট্যাবলেট কিংবা মলমের কৌটা কোনোটাই খুঁজে পাইনি। টেবিলের উপর ঢেকে রাখা পানিভর্তি গ্লাসটা হাতে নিলাম। ধকধক করে পানি খেলাম। গ্লাসটা যথা স্থানে রাখতে যাওয়ার সময় সদ্য দেওয়ালে টানানোর ছবিটার দিকে নজর যায়। অল্পবয়সী বাঁধনের মায়ের পাশে একজন সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে। দেখতে বাঁধনের মতই কিন্তু বাঁধন নয়। ডাক দিলাম কাজের মেয়েকে। জিজ্ঞেস করলাম আন্টির পাশে দাঁড়ানো লোকটা কে?
মেয়েটি হাসি মুখে জবাব দেয়, ইনি শফিক আংকেল। বাঁধন ভাইজানের বাপ। আঠারো বছর পর ওনি বিদেশ থেকে দেশে ফিরছেন।
মেয়েটি চলে গেল।
শফিক?!!!
মানে এই শফিক ঐ শফিক নইতো?
গ্লাস হাতে নিয়েই ছুটে গেলাম রুমের দিকে। রুম থেকে মোবাইলটা নিয়ে এসে গ্যালারীতে বন্ধু শফিকের ছবির সাথে দেয়ালে টানানো ছবিটা মিলালাম।
তার মানে ওনিই বাঁধনের…..(……..)….???
হাত থেকে গ্লাসটা পরে টুকরোটুকরো হয়ে গেল। আজ নুসরাত এবং এ বাসার সবাই একই ব্যক্তিকে রিসিভ করতে গেছেন এয়ারপোর্ট।
ইয়া মাবুদ!!!
বন্ধু শফিক মানে বাঁধনের বাবার মুখ থেকে বাঁধনের পরিবার যখন কথাগুলো শুনবেন তখন ওদের কিরকম রিয়েক্টশন হবে আল্লাহ’ই জানে? না, না।
আমি এ বাড়ির বউ হতে চাই না। আমি চাই না মায়ের মত মহিলার মনে কষ্ট দিতে।
আমি চলে যাব। এখনি চলে যাব।
বাঁধনের ভালোবাসা পেতে গিয়ে আমি আমার একমায়ের মনে কষ্ট দিতে পারব না। আমি চলেই যাব।

মায়া চলে গেল।
মাঝে মাঝে বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিতে হয়। বন্ধু শফিকের সেই কথাটায় বার বার ওর কানে বাজছিল। মায়া তাই চলেই গেল। সবার থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে নিল। অনেক অনেক দুরে……

চলবে…..

কৃষ্ণকলি পর্ব:- ০৯

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব:- ০৯
Writer:- Anamika Islam Antora

বহুদিন পর সমধুর কন্ঠে প্রিয় রবীন্দ্র সংগীত!
আহ্, প্রাণটা জুড়িয়ে গেল!
আপু তুমি! তুমি এত্ত সুন্দর করে গাইতে পারো?
উফ্, অসাধারণ এক পারফরমেন্স দেখলাম। সত্যি আপনার কোনো তুলনায় হয় না মিস কৃষ্ণকলি ম্যাম!
উপস্থিত দর্শকের বিভিন্ন মন্তব্যে আপ্লুত আমি। আজ কেন জানি মনে হচ্ছে, সত্যি’ই আমি বোধ হয় ভালো গাইতে পারি!
গান+চা+আড্ডা। বেশ ভালো’ই জমছিল সেদিনের আড্ডার আসর। দীর্ঘ আড্ডাবাজির পর রাত্রি ঠিক ১০টায় সবাই হাতে ১টা করে চেয়ার নিয়ে রুমে চলে গেলাম। রাত্রি সাড়ে ১০টায় খাবারের জন্য ডাক পরল। রুমটার চারিপাশটা এত সুন্দর কারুকাজ দ্বারা খচিত ছিল যে আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত এপাশ থেকে ওপাশে তাকাচ্ছিলাম।
কিগো নতুন গিন্নী?!!! শুধু কি রুম জুড়ে ঘুরঘুর করবে নাকি কিছু মুখেও দিবে?

বাঁধনের দাদার কথায় হুশ হয়। দেয়াল থেকে মুখ ফিরিয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে চেয়ার টেনে নুসরাতের পাশে বসলাম। খাবার সামনে নিয়েও বারবার বাঁধনের দিকে তাকাতে লাগলাম। আজ বাঁধনকে উদাসীন লাগছে। কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে খাবার হাত রেখে বসে আছে বাঁধন! আচ্ছা, তবে কি ওর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা মায়ার কথা মনে পরছে? আচ্ছা, ও কি আজকে আমার নাম্বারে কল দিবে?
কিন্তু আমার নাম্বার তো বন্ধ! ও কি আমার নাম্বার বন্ধ পেয়ে সেই চিরচেনা মায়া আইডিতে নক করবে?
ও কি আমায় বলবে__
মায়া ভুল হয়ে গেছে। আমি তোমাকে শুধু শুধু কষ্ট দিয়ে ফেললাম।
চলো না মায়া আমরা আবার নতুন করে সব শুরু করি….!!!
অবুঝ মন এরকম হাজারো প্রশ্ন করে যাচ্ছে নিজে নিজেকেই।

রাত্রি ২.৪৫মিনিট_
সবাই হয়তো দিনের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে নিদ্রাজগতে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু আমি?
আমার চোখে ঘুম নেই। মেসেঞ্জার ওপেন করে ফিল্টার মেসেজের দিকে তাকিয়ে চাতকের মত বসে আছি। অচেনা আইডি থেকে আসা প্রতিটা মেসেজ রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করছি। মাঝে মধ্যে হাই, হ্যালোও করছি। কিন্তু চাতকের মত আশায় চেয়ে থাকা এই আমার আশা পূরণ হয়নি। কোনো আইডি থেকেই বাঁধন আমায় নক করে নি।
পরদিন লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে যায় নুসরাত বাঁধনকে। জিজ্ঞেস করে ওর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা মায়ার ব্যাপারে। কিছুক্ষণের জন্য বাঁধন স্তব্ধ হয়ে যায়। এক পা দু’পা করে নুসরাতের থেকে সামনে এগিয়ে যায়। দীঘির কাছাকাছি পলাশ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে দুর অজানায় তাকিয়ে আছে। কিছু বলতে গিয়েও চুপসে যায় নুসরাত। ভয়ে বাঁধনের সামনে থেকে কেটে পরার সিদ্ধান্ত নেয়। বাঁধন ঠিক তখন’ই পিছন থেকে ডাক দেয়। নুসরাত থমকে দাঁড়ায়। কাঁপা কাঁপা দৃষ্টি নিয়ে বাঁধনের দিকে ফিরে তাকায় নুসরাত।
– কি হয় মায়া আপনার?
বাঁধনের প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকালো নুসরাত। এদিকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে বাঁধন। নুসরাত ঠান্ডা মাথায় ভাবছে, আচ্ছা! আগে তাহলে ওনার মনের কথাটা জেনে নেই। জেনে নেওয়া যাক ওনি এখনো মায়াকে ভালোবাসেন কি না?!!! তারপর’ই না হয় সত্যের মোড়ক উন্মোচন করা যাবে। আর সেজন্য কথা ঘুরিয়ে
নুসরাত জবাব দেয়-
আপনার পূর্বের একটা আইডির ফ্রেন্ড ছিলাম আমি। ঐখানে মায়াকে নিয়ে আপনার অসংখ্য স্ট্যাটাস দেখেছিলাম। তাই আর কি জানতে চাইছিলাম কি খবর আপনার সেই মায়ার?

– Okey, আমি আমি আপনার কৌতূহল মিটিয়ে দিচ্ছি মিস নুসরাত। আপনি শুধু নিরব শ্রোতার মত মন দিয়ে শুনে যান। বাঁধন বলা শুরু করে_
মায়া আমার জীবনের এক দুঃসর্হ অতীতের নাম। মায়া এরকম এক মেয়ে ছিল যার কাছে আমার চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য ছিল না। ও আমায় অনেক কাঁদিয়েছে। শুধু কাঁদিয়েই শান্ত হয়নি নিজ হাতে আমার ভালোবাসাকে গলা টিপে হত্যা করেছে। প্রথম প্রথম ওর জন্য কাঁদতাম। কিন্তু এখন আর কাঁদি না। কেন কাঁদব? আর কার জন্য কাঁদব? যার জন্য কাঁদব সেতো আমায় কখনো’ই ভালোবাসেনি।
বাঁধনের কথা শুনে আর চুপ থাকতে পারল না নুসরাত। কথার মাঝখানে বাঁধনকে থামিয়ে দিল সে।
” ১মিনিট বাঁধন সাহেব। জাস্ট ১মিনিট।”

জি, বলুন…..(বাঁধন)

আপনার কেন মায়ার প্রতি এমন বিরুপ ধারনার জন্ম হলো? ও কি বলছে কখনো আপনাকে ভালোবাসে না???
নুসরাতের এরূপ প্রশ্নের জবাবে মুখ খুলে বাঁধন। বলা শুরু করে, সব কথা মুখে বলতে হয় না মিস নুসরাত। কিছু কথা বুঝে নিতে হয়। আমিও বুঝে নিয়েছি। মায়া ওর কর্মকান্ড দ্বারা আমায় বুঝিয়ে দিয়েছে ও আমায় ভালোবাসে না। ভালোবাসলে আমি যেদিন সুদূর ঢাকা থেকে ওর কাছে ছুটে গিয়েছিলাম, সেদিন ঠিক আমার সামনে আসত। আমায় এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখত না অচেনা জায়গায়। ও আমায় ভালোই বাসে নি…..

Wow!
মেয়েটি আপনার সামনে আসেনি আর আপনি ওমনি ভেবে নিয়েছেন ও আপনাকে ভালোবাসে না? ও আপনাকে ছবি দিতে অনিহা প্রকাশ করেছে আর এতেই আপনার মনে হলো ও আপনাকে ভালোবাসে না?
মিস্টার বাঁধন সাহেব!
আপনি কি কখনো ওকে জিজ্ঞেস করেছেন ও কেন আপনাকে ছবি দিতে চাই না, আপনার কাছে আসতে চাই তো না? ভালোবাসার দোহাই দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন কি কখনো কেন বলত ও আপনাকে দূর থেকেই ভালোবেসে যাবে?!!!

নুসরাতের প্রশ্নের জবাবে বাঁধন বলে উঠে__
ভালোবাসার দোহাই কেন দিব? আমি তো বুঝেই গিয়েছি ও আমার সাথে Time pass করেছে। Just time pass…..

চুপ, একদম চুপ! আর একটা কথাও শুনতে চাই না আমি মায়া সম্পর্কে। বাঁধনের করা মন্তব্যে রাগান্বিত হয়ে কথাটা বলে উঠে নুসরাত। বাঁধনও উত্তেজিত হয়ে বলে—
” আমার ঠ্যাকা পরেছে ফালতু মেয়েকে নিয়ে কথা বলতে….”!!!!

অত্যাধিক মাত্রায় রেগে যায় নুসরাত।
বাঁধনের পথ আগলে দাঁড়ায় সে।
” ঐ ব্যাটা?!!! আমার স্ট্যাটাসে হুটহাট মন্তব্য করে চলে যাচ্ছিস কোথায়? মন্তব্যের রিপ্লাই নিয়ে যাবি না?????”???

চলবে……

কৃষ্ণকলি পর্ব- ০৮

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ০৮
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

বহুকাল পর অচেনা কারো কন্ঠে সেই চিরচেনা নাম. . . . . . .
বাঁধন চমকে গেল।
থমকে গিয়ে পিছু ফিরে তাকালো বাঁধন।
“কি বললেন?”
অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করল নুসরাতকে।অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার সময় এসেছে সত্যিটা বলার। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মুখ খুলে নুসরাত।
“মানে বুঝতে পারেননি?আপনার…….. (……)…..?
কথার মধ্যিখানে থেমে যায় নুসরাত। বাঁধন বার বার জিজ্ঞেস করছে, কি হলো? বলুন….
কিন্তু নুসরাত যেন কোনো কথায় বলতে পারছে না। কারন- কথার মাঝখানে ফুলস্টপ’টা টেনে দিলাম আমি মায়া। ঐ মুহূর্তে আমি সামনে গিয়ে না দাঁড়ালে নুসরাতের হয়ত মনেই থাকত না আমার সাথে করার প্রতিজ্ঞার কথা।

সেদিন বাঁধনের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য ছুটে যাচ্ছিল নুসরাত। কিন্তু আমার কসমের কাছে হার মেনে যায় সে। থমকে যায় পথিমধ্যে। বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে ওকে সেদিন বলেছিলাম কখনো যদি আমার ব্যাপারে বাঁধনের সাথে কোনো কথা বলে তাহলে সেদিন বড়’ই অনর্থ ঘটে যাবে। ওকে বলেছিলাম, বাঁধন যাতে কখনো ওর গত হয়ে যাওয়া ভালোবাসার কথা জানতে না পারে………
আমি এসব ভাবতে ভাবতে বাঁধন নুসরাতকে হাজারটা প্রশ্ন করে ফেলেছে। নুসরাত বোকার মত চুপসে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে বাঁধনের প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়ার ক্ষমতা নুসরাতের নেই। আর একটা কিছু বলে যে বিষয়টা ধামাচাপা দিবে সেটাও মাথায় আসছে না।
এদিকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে বাঁধন।
“গত রাত্রে ফেসবুকের একটা পেইজে মায়ার বাঁধন নামে একটা গল্প পড়ছিলাম আমরা। মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্পটা পড়ে’ই নুসরাত আপনাকে মায়ার বাঁধন বলে সম্বোধন করল জনাব।”
পিছন থেকে কথাটা বলে উঠলাম আমি।
“ওহ্, তাই বলেন…”
বলেই বাসার দিকে পা বাড়ালো বাঁধন।

উফফ্, বাঁচালে খোদা!
আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কথাটা বলল নুসরাত।
আজ ভয়ংকর কিছু ঘটে যেত……
অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে বাসার ভিতরে চলে গেলাম আমি।

দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন কেটে যায়। একটু একটু করে যে বাঁধনকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, সেই বাঁধনের জন্য’ই বুকের ভেতরে অল্প অল্প করে ভালোবাসার জন্ম হতে লাগল। ধীরে ধীরে বাঁধনের মায়ায় গভীর ভাবে জড়িয়ে যেতে লাগলাম। ওর কথা বলা, ওর খাওয়া, ওর চলা সব…..
সবকিছুর প্রেমে পরে যায় নতুন করে। সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ___
বাঁধন ও তার পরিবার প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ’টা ওদের গ্রামের বাড়িতেই উৎযাপন করেন। আর সে জন্য যথারীতি এবারো ওরা পহেলা বৈশাখের আগের দিন বিকেলে রওয়ানা দেয় গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওদের পরিবারের সঙ্গে এবার আমরা দু’বান্ধবিও ছিলাম।
রাত্রি ৮টা…..
আমরা বাঁধনের গ্রামের স্টেশনে গিয়ে পৌঁছলাম। স্টেশনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল স্বয়ং বাঁধনের দাদা। বাঁধনের কাছাকাছি পৌঁছেই বাঁধনের মা সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল। সুইটি দাদাভাই, দাদাভাই করে জড়িয়ে ধরে দাদাকে। সুইটির কপালে চুমু খেয়ে বাঁধনের দাদা আমার দিকে এগিয়ে আসেন।
” এই তাহলে আমার আরেকটা গিন্নি”
কথাটা বলে বাঁধনের বাবা আমার গাল টেনে দিলেন। নুসরাতের সাথেও পরিচিত হলেন।
বাঁধন যখন আনমনে ফোন টিপাটিপিতে ব্যস্ত ঠিক তখন’ই ওর তলপেটে ব্যাথা অনুভূত হয়। ওহ্, বলে সামনে তাকাতেই দেখে ওর দাদা এখনো ঘুষি দিয়ে হাত ওভাবেই রেখেছে। দাদা তুমি…..???
কথাটা বলে’ই বাসার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে বাঁধন। পিছন দিয়ে বাকি সবাই যাচ্ছে।

বাড়িটা খুব পুরনো,
তবে ছিমছামও গুছানো।
চারদিকে শ্যাওলা পরা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়িটির ভিতরের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে সুন্দর বাগান। বাগানটিতে নানারকম জানা অজানা ফুল ফুটে রয়েছে। ফুলের গন্ধে চারদিক মুখরিত।
বাগানটির ঠিক পাশেই রয়েছে বিশাল বড় দীঘি। যা বাড়ির সৌন্দর্যকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। দীঘিটিতে উঠা-নামার জন্য সিড়িও রয়েছে। ঐ সিড়ি বেয়েই মহিলারা দীঘির জলে গোসল করত। বাগানের ক্ষাণিকদুরে আরেকটি জিনিস লক্ষ করলাম।
ছোট্ট করে একটা ছাউনির মত কি যেন একটা। সুইটির থেকে জানতে পারলাম এটা আসলে চা’য়ের জন্য নির্মিত।
গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলে কিংবা সন্ধ্যাবেলায় বাঁধনের দাদা সবাইকে নিয়ে এখানে বসেই চা আড্ডা দেয়।
বাঁধনের মায়ের থেকে জানতে পারলাম বাঁধনের দাদা পরদাদারা ছিলেন পুরনো ধনী। সমস্ত গ্রামের মধ্যে ওনারাই ছিলেন অধিকতর সম্পত্তির মালিক। আর সে হিসেবে ওনার এই এলাকায় রয়েছে যথেষ্ট দাপট। আর গ্রামের লোকের এ পরিবারের লোকদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা এবং সম্মান করে। কোনো সমস্যা হলে এখানেই সবাই ছুটে আসে……

গ্রামে লোডশেডিং খুব কমন একটা ব্যাপার।
সেদিনও লোডশেডিং হয়েছিল।
বাঁধনের দাদা কাজের ছেলেকে চা বানাতে বলে সবাইকে বললেন হাতে একটা করে চেয়ার নিতে। আমরা সবাই হাতে একটা করে চেয়ার নিয়ে বাঁধনের দাদাকে অনুসরন করে হাজির হলাম দীঘির পাড়ে। দীঘি থেকে ক্ষাণিকটা দুরেই আমাদের অবস্থান। সেখানে সবাই যে যার মত চেয়ার পেতে বসে পরলাম।
প্রকৃতির শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ,
মৃদু বাতাস,
দুরের পাখিদের বাসা ফেরার আয়োজন।
মাঝে মাঝে দু’য়েকটা পাখির কিচিরমিচির শব্দ।
সবমিলিয়ে ভালো’ই লাগছে……..

ইস!
এই সময় বাঁধন যদি কাছে থাকত,
ওর হাতটা ধরে যদি বসে থাকতে পারতাম
কিংবা ওর কাধে মাথা রেখে!
তাহলে মন্দ লাগত না।
আচ্ছা….
ওর কি আমার কথা একটুও মনে নেই?
ও কি আমাকে একটুও আর ভালোবাসে না?
আমার কথা কি ওর একটুও মনে হয় না?
মনে হয় না সেই স্বপ্নগুলোর কথা,
যা একসময় আমরা দু’জন দেখতাম?
বাঁধনকে নিয়ে যখন ভাবনার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন’ই আমার ভাবনাচ্ছেদ ঘটে।
” কি বড় গিন্নী? আমাকে রেখে’ই হারিয়ে গেলা কল্পনাতে?”
ছি! দাদাভাই….
কি যে বলো না…..বলেই লজ্জায় মুখ লুকালাম আমি।
-তো গাচ্ছেন না কেন গান???
বাঁধনের কথা শুনে ওর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকালাম। কিসের গান?!!!
আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম ওদেরকে।
দাদাভাই আমার সখি এখন ওর কল্পরাজ্যের রাজকুমারকে নিয়ে ভাবনার অতলে ডুবে আছে, ওর মন কি আর এখানে আছে???
নুসরাত কথাটা বলতেই ফিক করে হেসে দিল সবাই। আমি মুখ ভার করে বসে আছি।
তো যায় হোক!
হাসি পরে হবে। আগে রবীঠাকুরের কাব্যের নায়িকা কৃষ্ণকলি ম্যামের কন্ঠে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে নেই, কি বলো সবাই???
ইতিমধ্যে বাঁধনের মা এবং ওনার দুই জা ও তাদের ছেলেমেয়েরা এসে যোগ দিল।
সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমার কন্ঠে গান শুনার প্রতিক্ষায়। অন্যদিন হলে ঠিক বাঁধনের মুখের উপর বলে দিতাম এখন কোনো গান শুনাবো না তোমায়, গান যা শুনানোর ফুলশয্যার রাতেই শুনাবো। দুজন মিলে একসাথে আমাদের প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনব……
আজ তো তা বলতে পারব না।
কারন- ওর সাথে আমার মত কালো মেয়ের মিল তো কখনোই হবার নয়।
” কি হলো শুনান….!!!”
বাঁধনের কথা শুনে সম্ভিত ফিরল। ওর দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি দিয়ে গান শুরু করলাম-

আমি এলেম, তারই দ্বারে….
আমি এলেম।
ডাক দিলেম অন্ধকারে,
হা রে……….
আমি এলেম, তারই দ্বারে……..
আমি এলেম।
আগল ধরে দিলেম নাড়া………
প্রহর গেল, পাইনি সাড়া;
দেখতে পেলেম না’যে তারে,
হা রে………..
আমি এলেম, তারই দ্বারে…….
আমি এলেম।
তবে যাবার আগে এখান থেকে,
এই লিখনখানি__
যাব রেখে………
তবে যাবার আগে এখান থেকে….!
দেখা তোমার পাইবা না পাই…..
দেখতে এলেম__
যেনগো তাই ফিরে যায় সুদূরের পাড়ে……
হা রে……
আমি এলেম, দ্বার’ই দ্বারে…..
আমি এলেম।
তবে যাবার আগে এখান থেকে,
এই লিখনখানি_
যাব রেখে…..
তবে যাবার আগে এখান থেকে….!
দেখা তোমার পাইবা না পাই…….
দেখডে এলেম___
যেনগো তাই ফিরে যায় সুদূরের পাড়ে……
হা রে……
আমি এলেম, তারই দ্বারে…….
আমি এলেম।
ডাক দিলেম অন্ধকারে…….
হা রে…….
আমি এলেম, আমি এলেম……!!!

চলবে……

কৃষ্ণকলি পর্ব- ০৭

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ০৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মাঝরাত্রে রিংটনের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় বাঁধনের মায়ের। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে ফোন রিসিভ করে চমকে উঠেন ওনি। অজানা বিপদের আশংকায় ভিতরটা মুচড় দিয়ে ওঠে ওনার।
“গেইটের সামনে মানে….?”
কাঁপা স্বরে ওনি জিজ্ঞেস করেন।

হ্যাঁ, ঠিক’ই শুনেছেন আপনারা!
এই মুহূর্তে আমি বাঁধনের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সাথে আছে বান্ধবী নুসরাত। হাজার অনুনয়-বিণয় করেও ওকে ওর কথা থেকে টলাতে পারিনি। গেইটের সামনে এসে ফোন করলাম বাঁধনের মাকে।
” আন্টি! গেইট’টা খুলেন। আমি গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে কথাটা বাঁধনের মাকে বললাম। এত রাত্রে এ ধরনের কথা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। ঘাবড়ে যান ওনি। তাড়াতাড়ি বাঁধনকে ডেকে তুলে গেইটের সামনে গেলেন ওনি। গেইটের বাইরে থেকেই লক্ষ্য করলাম মা-ছেলে দু’জনের চোখে মুখেই আতঙ্কের ছাঁপ। নুসরাতের কথায় এত রাত্রে এভাবে ছুটে আসা মোটেও উচিৎ হয়নি আমার। মনে মনে নুসরাতকে হাজারটা গালি দিলাম। তারপর মাথা নিচু করে গেইট অতিক্রম করে বাসার ভেতর ঢুকলাম।

এই মুহূর্তে আমাদের অবস্থান ড্রয়িংরুমে। সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছি আমি। আর আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে কয়েক জোড়া চোখ। যে চোখগুলোতে রয়েছে হাজারো প্রশ্ন, হাজারো কথা। মিনিট দুয়েক নিরবতার পর মুখ খুলেন বাঁধনের মা।
“এত রাত্রে তুই চলে আসছিস? কি হয়েছে তোর? তুই ঠিক আছিস তো? তোর কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

একনিশ্বাসে করা একগাদা নাগরিক প্রশ্ন।

“আসলে আন্টি ও খুব বাজে স্বপ্ন দেখেছে। আর সেটা দেখেই চিৎকার দিয়ে উঠল ঘুম থেকে। তারপর থেকে অদ্ভুত সব পাগলামী করতে থাকে। আমি বাসায় যাব, বাসায় যাব, আন্টির কাছে যাব। তাই বাধ্য হয়ে নিয়ে আসতে হলো।”
বাঁধনের মাকে দ্বিত্বীয় বার প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ না দিয়ে কথাগুলো বলে নুসরাত। বাঁধনের মা দৌঁড়ে আমার কাছে আসলেন। জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। নুসরাতের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালাম। কারন- আমার পক্ষে ঐসকল প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল না। আবার মিথ্যেটাও বলতে পারতাম না। কারন- ওনার মাঝে আমি আমার মাকে খুঁজে পায়!!!

চলে গেল আরো কয়েক মাস….
এর’ই মাঝে আমার সাথে সাথে নুসরাতও পরিচিত হয়ে গেল এ বাসার প্রত্যেকটি সদস্যের কাছে। এখন আর আমাকে নুসরাতের বাসায় যেতে হয় না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে, কখনো বা পেলে নুসরাত’ই ছুটে আসে তার পরাণের বান্ধবীকে দেখার জন্য। সেদিনও নুসরাত এ বাসায় এসেছিল।
” কিরে মা?তুই এত শুকাচ্ছিস কেন? তুই কি খাস না নাকি?”
রাত্রে খাবার টেবিলে সবাই যখন খাবার নিয়ে ব্যস্ত তখন আচমকা’ই প্রশ্নটি করে বাঁধনের মা নুসরাতকে।
“হসপিটালে সারাক্ষণ রোগী নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তারউপর বাসায় গিয়ে রান্না, গোসল, খাওয়া। ঘুমানোর আর সময় হয়ে উঠে না আন্টি।”
মাথা উচু করে গম্ভীর হয়ে কথাগুলো বলে নুসরাত।

রান্নার জন্য বুয়া রেখে নাও। আর গ্রামের বাড়িতে কেউ নেই? মানে আপনজন!!!ওখান থেকে একজনকে নিয়ে আসো। যে কিনা অলস সময়ে তোমাকে সঙ্গ দিতে পারবে।
“আমার আবার আপনজন!
ঐ যে সামনে যে মেয়েটি বসে আছে না?!!! যাকে আপনি আপনার মেয়ের স্থান দিয়ে এ বাসায় স্থান দিয়েছেন তার কপাল আর কপাল একই। আমরা একসাথে একই স্কুল+কলেজে পড়েছি। আমরা পাশাপাশি গ্রামের মেয়ে ছিলাম। আমাদের দুজনের মা’ই মারা গেছেন সেই ছোট্ট কালে। দু’জনের বাবা’ই পরবর্তীতে বিয়ে করেছেন। ওর সৎ মা অবশ্য মারা গেছেন কিন্তু আমার সৎ মা??? বেঁচে ছিলেন। ২য় মা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা আরেকটা বিয়ে করেন। প্রথমজন যাও একটু মারার পাশাপাশি আদর করত, পড়াশুনার ব্যাপারে সাপোর্ট করত। কিন্তু এখন যেজন আছেন ওনি? ওনার কথার আঘাতে প্রতিনিয়ত আমায় জর্জরিত হতে হয়।খুব বাজে বাজে কথা বলে আমাকে নিয়ে আমার বাবার সাথে। যা একজন মেয়ে হিসেবে আমার জন্য ভিষণ লজ্জাকর ছিল। বহু সংগ্রাম করে মেডিকেল কোর্সটা কমপ্লিট করলাম। তারপর সেই যে বাড়ি ছাড়লাম আর যায়নি। কিসের জন্য যাব বলেন? ওখানে গেলে যে আমি মানসিক শান্তির পরিবর্তে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায় আরো।
একটা শুকনো হাসি দিয়ে কথাগুলো বলে চুপ করল নুসরাত।

বাঁধনসহ ওর মা, বোন আর বুয়ার চোখে জল চিকচিক করছে নুসরাতের কথা শুনে। খাবার টেবিলে এই মুহূর্তে থমথমে ভাব বিরাজ করছে। কিছুটা সময় নিরবতা, তারপর আচমকা বাঁধনের মা বলে উঠল__
” কে বলছে তোর কেউ নেই? তোর জন্য আমি আছি, এ পরিবারের সবাই আছে। আজ থেকে তুই এ বাসায় থাকবে। আর এখান থেকেই হসপিটালে যাবি। বাঁধন রোজ তোকে দিয়ে আসবে। আর বাঁধন?!!!
তুই কালকে একবার নুসরাতকে নিয়ে ওর বাসায় যাবি। ওখান থেকে ওর সব জিনিসপত্র নিয়ে আসবি। কি মনে থাকবে তো?!!!”

– আচ্ছা….. (বাঁধন)

নুসরাতের সাথে আমার চোখ দুটোও জলে ছলছল করে উঠল।

পরদিন সকাল বেলা_
” এই, উঠবি নাকি পানি ঢালব???”(মা)
– উফ্, মা! আরেকটু ঘুমাই না।(বাঁধন)
– ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছিস কয়টা বাজে? বেলা ১১টা বাজে। নুসরাতের জিনিসপত্র গিয়ে কখন আনবি?(মা)

ধরমরিয়ে শুয়া থেকে উঠে বসে বাঁধন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বলে ১১টা? মা, তুমি আগে ডাক দিবা না? বাঁধন দৌঁড়ে ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে গাড়িতে করে নুসরাতকে নিয়ে পৌঁছে গেল কাঙ্খিত স্থানে। নুসরাত ওর যাবতীয় জিনিসপত্র গুছাতে গুছাতেই কাটিয়ে দেয় ৩ঘন্টা। দুপুর ০২টা নাগাদ ওখানকার সমস্ত ঝামেলা শেষ হলো। আধঘন্টার মধ্যে বাসায় পৌঁছল ওরা। গাড়ি থেকে নেমে বাঁধন একটা একটা করে জিনিস দাঁড়োয়ান চাচার হাতে এগিয়ে দিতে লাগল আর দাড়োয়ান সেগুলো বাসার ভিতর নিয়ে রেখে আসতে লাগল। সবশেষে ড্রাইভারকে গাড়ি ভেতরে নিতে বলে বাঁধন যেই না গেইটের ভিতরের দিকে পা বাড়ালো ওমনি পেছন থেকে ডেকে উঠে নুসরাত।
এই যে মায়ার বাঁধন শুনোন?!!!

থমকে যায় বাঁধন।
দীর্ঘ অনেকগুলো বছর পর সেই প্রিয় নাম!
চমকে উঠে পেছনে তাকালো বাঁধন…..

চলবে…….

কৃষ্ণকলি পর্ব- ০৬

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ০৬
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

“কেমন আছে এখন মায়ার বাঁধন?”

বেশ ভালো!
ছোট্ট করে বলে থেমে গেলাম আমি। কিছু সময় নিরবতা তারপর জনাব শফিক সাহেবের প্রশ্ন- কতজনের নানা হলাম?
শফিক সাহেবের এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তাইতো চনকে উঠে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, মানে?
মানে হলো আমার মায়া বন্ধুর কোল আলো করে এ পর্যন্ত কয়জন এলো? আমি কতজন ছেলে মেয়ের নানা হতে পেরেছি?

বন্ধু শফিকের কথা শুনে কন্ঠ’টা স্তব্ধ হয়ে আসে। উত্তর দিতে গিয়েও দিতে পারিনি। কেন জানি মনে হচ্ছিল কথারা সব বুকের ভেতর প্রকান্ড এক পাথর রুপ ধারন করেছে। প্রচন্ড এক যন্ত্রণায় ভেতরটা ছটফট করে উঠল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি।
পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষটিকে এত সহজে হারিয়ে ফেলার বেদনায় জমে থাকা নীল কষ্টের তুষারগুলো গলে গলে পড়তে শুরু করল অশ্রু হয়ে।
এই মুহূর্তে বাঁধনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া পেছনের স্মৃতিগুলোই আমাকে পীড়া দিচ্ছে। বাঁধনের স্মৃতিগুলো বার বার হৃদয়ের ক্যানভাসে ভেসে উঠছে। হুশ হয় বন্ধু শফিকের কথায়।
এই মেয়ে! কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে তোর?

চোখের অশ্রু মুছে হাসিমুখে উত্তর দিলাম, কই? কিছু না তো!!!

ভুলে গেলি? আজকে রাত পোহালে শুক্রবার। আজকের দিনেও তুই মিথ্যে বলবি?

উফ্! বন্ধু শফিকের কথায় মনে পরল আজকের দিনটা একটা সময় আমার আর বাঁধনের জন্য কতটা স্পেশাল দিন ছিল। ২০১০ সালের এই দিনে দু”জন দু’জনকে ভালোবাসার কথাটা বলছিলাম।
ইস! কতই না সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো….
কখনো যদি বাঁধনের সাথে ঝগড়া হতো, আর সেটা যদি হতো শুক্রবার দিন, তাহলে বাঁধনের মুখ থেকে এই একটা কথায় শুনতাম-
” মায়া! আজ না শুক্রবার?!!! আজকের দিনেও তুমি ঝগড়া করবে? রাগ করে থাকবে?”

বাঁধনের এই একটি কথায় থেমে যেত সব ঝগড়া, উড়ে যেত সব রাগ।
বাঁধনকে বলতাম- এই দেখো! চুপ করলাম।
আর ঝগড়া করব না। এবার হলো তো???
আর রাগ? সেটা কি আদৌ গেছে?(বাঁধন)
– হ্যাঁ, গেছে। আমি আর রেগে নেই।
আমার কথা শুনে বাঁধন গম্ভীর গলায় প্রমান চাইত। আমি যে রেগে নেই তার প্রমাণ হিসেবে একটা হাসি দিতে বলত। জোর করে হলেও হাসি দিতাম এভাবে-
” হি হি হি হি হি হি হি হি হি হি হি হি”
হাসি হাসি মুখে বাঁধন বলত, এইতো আমার পেত্নী হাসছে।
প্রেমিকরা ওদের প্রেমিকাদের হাসির বর্ণনা কত সুন্দর, কত নিঁখুত ভাবে গল্প-উপন্যাসে তুলে ধরেন। আর বাঁধন?!!!
আমার হাসিকে পেত্নীমার্কা হাসির সাথে তুলনা করত।
রাগান্ধিত স্বরে বলতাম- আমি পেত্নী, নাহ?
সিরিয়াস ভঙ্গিতে বাঁধন বলত- হ্যাঁ, তুমি পেত্নী।

আচ্ছা, আচ্ছা। রাখি।
রাগ দেখিয়ে ফোনটা কেটে দিতে যাব, তখনই ও বলে উঠত-
শুনো! তুমি শুধু আমার পেত্নী। আর কারো না। এ পেত্নীটা শুধুই আমার।
বাঁধনের এই একটা কথায় আমার সমস্ত রাগ দুরে সরে যেত। ভিতরের আনন্দটা চেপে বলতাম- শয়তান!
বাঁধনও আমার সাথে সাথে লম্বা করে বলত- শয়তান!
তারপর আবার সেই হাসি।
পেত্নী মার্কা হাসি।

Oh, hlw mem!
কিছু’তো বলুন। সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি। শফিক সাহেবের কথায় সম্ভিত ফিরে। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেদিন বাঁধনের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পর থেকে ওনার বাসায় আশ্রয় নেওয়া পর্যন্ত সবটা খুলে বললাম। আমার কথা শুনে জনাব শফিক সাহেব চুপসে গেলেন। শুধু চুপসে নয়, কিছুক্ষণের জন্য ওনি হয়তো নির্বাকও হয়ে গেছেন। যার কারনে ওনি কোনো কথা বলতেছেন না। টানা ৫,৬মিনিট নিরবতা চলল। ওনার কথা বলার কোনো আভাস’ই পাচ্ছি না।

নিরবতা ভেঙ্গে মুখ খুললাম আমি। বন্ধু শুনতে পাচ্ছেন?
হ্যাঁলো, হ্যাঁলো বলতে বলতে পিছনে ঘুরে তাকালাম। নুসরাত অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে এভাবে দেখে চমকে উঠলাম আমি।

ফোন’টা কান থেকে নামিয়ে, তু তু তু তু….ইই……????

হ্যাঁ, আমি। মায়ার বাঁধনের বর্তমান অবস্থান জানার জন্য’ই ঘুম থেকে জেগে উঠা। আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে নুসরাতের জবাব।

ই ইয়ে মানে আসলে নুসরাত আমি তোকে…..

সম্পূর্ণ কথাটা বলতে পারিনি। তার আগেই আমার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে রাগান্বিত ভঙ্গিতে জোর গলায় বলতে থাকে নুসরাত, তুই কিভাবে এমনটা করলি?
কিভাবে তুই আমার থেকে এত বড় সত্যি’টা লুকাইলি? আমি কি কখনো’ই কোনো ভালো বন্ধু ছিলাম না???

নুসরাত কথা’টা তো শুন।
চুপ!
একদম চুপ। তুই কোনো কথা বলবি না।রাগান্বিত স্বরে নুসরাতের জবাব। আমি আর কোনো কথা বাড়ালাম না। চুপ করে আছি। নুসরাত ১ঘন্টার আলাপকে সাড়ে ৩ঘন্টা বানালে প্যাঁচাল পেরে। প্যাঁচাল শেষে যখন হাফিয়ে উঠে আমার দিকে তাকালো। আমি তখন সোফায় বসে ঝিমুচ্ছি। নুসরাত আমার কাছে দৌঁড়ে গিয়ে আমার দু’বাহু ঝাকিয়ে বলে-
এই ঘুমোবে না একদম!
তুই এখন এই মুহূর্তে আমার সাথে চলবি।

আধো ঘুম আধো জাগরিত অবস্থায় আমি নুসরাতকে বললাম-
” কোথায় যাব?”
নুসরাত আমার কানের কাছে এসে জোরে জোরে বলতেছে-
” কোথায় আবার? বাঁধনের বাসায়। আমায় তুই বাঁধনের বাসায় নিয়ে চলবি। ঐ হারামজাদাকে আমি দেখতে চাই। দেখতে চাই কেমন বেকুব যে গার্লফ্রেন্ডের কন্ঠ শুনেও গার্লফ্রেন্ডকে চিনে না।”

কি?!!!
চমকে উঠে চোখ মেলে তাকালাম।
এই মুহূর্তে আমার চোখ থেকে নিদ্রাদেবী প্রস্থান করেছে।

কি, কি করিস না;
আমি বাঁধনের বাসায় যেতে চাচ্ছি। ওর সাথে আমার কথা আছে। নিয়ে চল আমায় সেখানে……

চলবে……….

কৃষ্ণকলি পর্ব:- ০৫

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব:- ০৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

এফএমে লাখো মানুষের শ্রোতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলা’টা তো খুব ভাগ্যের ব্যাপার। তাহলে আংকেলকে সবাই কেন এমন করত? আমি আজ’ই আন্টির কাছে যাব। আন্টির কাছের কাছে গিয়ে আংকেলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে বলব। কারন- আংকেল অবশ্যই একবার হলেও ফোন দিয়েছিল আন্টিকে।

-খবরদার!
যা বলছো এখানেই। এই কথা’টা যাতে মায়ের সামনে না বলা হয়।
তাহলে কিন্তু…… (……)……???
আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত চোখে কথাটা বলল বাঁধন। কেন? ওনি কি এফএমকে ভালোবাসেন না? প্রশ্ন করলাম বাঁধনকে।
তাচ্ছিল্যের স্বরে বাঁধনের জবাব,
” ভালোবাসা?!!!
হা, হা। ঘৃণা করে মা। শুধু ঘৃণা না, ভয়ংকর ঘৃণা। এই নামটাই ওনি সহ্য করতে পারেন না আমার মা। এফএমের “ফ”টাও সহ্য করতে পারেন না।

বাঁধনের কথা শুনে আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। বলতে পারলাম না, বাঁধন!
আমিও তো এফএমে প্রোগ্রাম করতাম একসময়। প্রতি বৃহস্পতি’বার দিন আমায় সেখানে যেতে হতো প্রোগ্রাম করার জন্য। অবশ্য মধ্যিখানে অনেকটা দুরে সরে গিয়েছিলাম রেডিও থেকে। কিন্তু আজ এতবছর পর লাখো শ্রোতার ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে যখন সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আবার প্রোগ্রাম’টা শুরু করব, তখন…..(……)…..???
যাক!
এখন কথা না বলাটাই শ্রেয়।
আর তাই আমিও কোনো কথা বললাম না।
চুপ করে বাঁধন গাড়ি চালালো।
বাকি রাস্তা একটা কথাও হলো না আর।

সেদিন বান্ধবী ডাঃ নুসরাত কল দিয়ে বলল, ও ঢাকায় ট্রান্সফার হয়ে এসেছে। আমাকে দেখতে ওর ভিষণ ইচ্ছে হচ্ছে। আমি যেন ওর বাসায় যায়। কলিজার টুকরা বান্ধবীর ইচ্ছে বলে কথা। ফেলতে পারিনি। বাঁধনের মায়ের থেকে অনুমতি নিয়ে ছুঁটে চললাম নুসরাতের বাসার উদ্দেশ্যে। ১ঘন্টার মধ্যে’ই নুসরাতের ওখানে গিয়ে পৌঁছলাম। ওকে দেখে বুঝতে পারলাম এতক্ষণ ধরে আমার’ই অপেক্ষায় গেইটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখে সেকি খুশি! ওর কাছে যাওয়ার সাথে সাথে জড়িয়ে ধরল আমায়। অনেক দিনের দুঃখ কষ্ট জমে পাহাড়ের মত হয়ে গিয়েছিল আমার ভিতর। সেই দুঃখ-কষ্টের একটু একটু ওকে বলতে লাগলাম। ঘন্টা দু’য়ের মধ্যে’ই মনে হলো আমার ভিতর যে বরফগলা পাহাড় ছিল,
সেটি একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে।
সন্ধ্যায় হালকা নাস্তা করা শেষে দু’বান্ধবীর মধ্যে কিছু কথা হয়। কথোপকথনগুলো এমন ছিল__

নুসরাত:- তারপর?
তোর প্রোগ্রামের কি খবর? এখনো
করিস প্রোগ্রাম’টা?
আমি:- না। তবে কথা দিয়েছিলাম শুরু করব। কিন্তু আমি মনে হয় ওদের কাছে দেওয়া কথাটা রাখতে পারব না। শুরু করতে
পারব না প্রোগ্রাম’টা?
নুসরাত:- কেন? কেন???
আমি:- বাড়িওয়ালাী এফএম নামটা সহ্য
করতে পারে না, ঘৃণা করে।
নুসরাত:- মানে?!!! মানে কি মায়া???

নুসরাতের সাথে বাঁধনের বলা কথাগুলো’ই পুনারবৃত্তি করলাম। আমার কথা শুনে নুসরাত চিন্তিত মনে বাহির পানে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ওর চোখে মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। লাফ দিয়ে আমার কাছে এসে বলল, আইডিয়া!
– কি idea?
তোর তো প্রতি বৃহস্পতিবার রাত্রে প্রোগ্রাম, তাই না?
– হুম।
আর সেই বৃহস্পতিবার দিন কলেজ থেকে এসে আন্টিকে আমার বাসায় থাকার কথা বলে তুই যদি আমার এখানে চলে আসিস, তারপর রাত্রে আমি তোকে রেডিও অফিসে দিয়ে আসি। তাহলে কেমন হয় ব্যাপার’টা?
– Yes.

খুশিতে নুসরাতকে জড়িয়ে ধরলাম।
কিন্তু পরক্ষণে মুখটা নিকষ কালো অন্ধকারের ন্যায় হয়ে যায়। নুসরাতের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বারান্দায় চলে গেলাম। বারান্দায় গিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। নুসরাত পিছন থেকে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে। নুসরাতের দিকে একবার তাকিয়ে চোখটা ফিরিয়ে নিলাম। আমার দৃষ্টি তখন বারান্দার রেলিংয়ের ভিতর দিয়ে দুর অজানায় চলে গেছে। বান্ধবী নুসরাত চুপটি করে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট পাঁচেক পর মুখ খুলে নুসরাত।
তোকে খুব ভালোবাসেন ভদ্রমহিলা, তাইনা?

নুসরাতের দিকে না তাকিয়েই বললাম-
হ্যাঁ। বড্ড বেশীই ভালোবাসেন ওনি আমাকে। এরকম ভালোবাসা আমি আমার জীবনে পূর্বে একজনের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। তিনি ছিলেন- আমার মা। মা মারা যাওয়ার এই যে এত বছর পর আমি একটু তৃপ্তির হাসি দিতে পারি, সে ঐ মহিলার জন্য। যিনি আমার মা সমতুল্য। ওনি এমন একজন মানুষ যার মাঝে আমি মায়ের ছায়া খুঁজে পায়। খুঁজে পায় মায়ের সেই স্নেহমাখা ভালোবাসা, আদর-সোহাগ এবং শাসন। ওনার সাথে আমার পরিচয় তিনদিনের। অথচ দ্যাখ….
ওনি যেন আমার শিরায়-উপশিরায় মিশে আছেন।

– তো! কি করবি?(নুসরাত)

আমি করব না প্রোগ্রাম। আমি চাই না ঐ প্রোগ্রাম করতে যেটা করতে গিয়ে মায়ের সাথে দিনের পর দিন মিথ্যা কথা বলতে হবে। মাকে ঠকানো হবে। আমি আমার মায়ের সাথে এরকমটা করতে পারব না। ওনার স্নেহের মূল্য আমি এভাবে দিতে চাই না। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে গেলাম।

নুসরাত আমার কাছে এসে বলল, তুই তাহলে রেডিওর জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে চাচ্ছিস, এই তো?!!!

হ্যাঁ, ঠিক তাই।
আমি এ জগত থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছি। তুই প্লিজ আমায় জোর করিস না।
নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে কথাটা বলছিলাম।

তোর যা ভালো মনে হয়।
নুসরাত রুমে চলে গেল। নুসরাতের পিছু পিছু আমিও রুমে গেলাম।

রাতের রান্নাটা দু’বান্ধবি মিলে করলাম।
অনেক দিন পর দু’বান্ধবী একসাথে খাবার খেলাম।
বুঝলি মায়া! একেই বলে সত্যিকারের বন্ধুত্ব। এই যে দুজন দুজনকে ছেড়ে এতটা দিন এতটা দুরে ছিলাম, অথচ সম্পর্কে একটুও ফাটল ধরে নি। সেই আগের মতই হাসি, আনন্দ, খুনসুটিতে ভরপুর আমাদের সম্পর্ক। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে কথাটা বলল নুসরাত।
মনের টান’টাই আসল নুসরাত। আর দূরত্ব কখনো কোনো সম্পর্কের অন্তরায় হতে পারে না, যদি সেখানে একে অপরের প্রতি টান, ভালোবাসা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা থাকে। তা যে কোনো সম্পর্ক’ই হোক না কেন। নুসরাতের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে জবাব দিলাম।

একদম ঠিক কথা বলছেন ম্যাম। এখানে মনের টান’টাই মূখ্য। (নুসরাত)

ডাক্তার সাহেবা! রাত’তো অনেক হয়েছে। তাই দয়া করে ঘুমান। কালকে সকালে তো আপনাকে আবার হসপিটালে যেতে হবে, তাই না? (আমি)

Okey, good night…..(Nusrat)
Good night….(Myself)

ঘন্টা দেড়েক হয়ে গেছে শুয়ে আছি। নুসরাত মনে হয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে। বিছানা থেকে উঠে বসলাম। বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে ধীর পায়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। ফেসবুক লগইন করলাম। দীর্ঘ ৬বছর পর চিরচেনা সেই “মায়া” আইডিতে ঢুকলাম। শত শত মেসেজ। মেসেজ পাঠিয়েছে মায়ার পাগল ভক্তরা। হ্যাঁ, ওরা আমার সেই পাঠক যারা একটা সময় আমার লেখা গল্প,কবিতা না পেলে পাগল হয়ে যেত। মেসেজের পর মেসেজ দিত। কখনো গল্প, কবিতা দিতে দেরি হলে আমার প্রতি ওদের অভিযোগের অন্ত ছিল না। আজ এই যে এতদিন এফবিতে ঢুকলাম মনে হচ্ছে ওরা এতটা দিন আমার নামের পাশে সবুজ বাতিটা জ্বলার অপেক্ষায়’ই ছিল। আজ যখন সবুজ বাতিটা জ্বলে উঠল তখন ওরা ঝাপিয়ে পরে ইনবক্সের উপর। শত শত পাঠকের শত শত মেসেজ। তন্মধ্যে একটা মেসেজের মধ্যে চোখটা আটকে গেল। যেখানে লেখা ছিল-
Very bad, Maya.
Very bad.
সখাকে পেয়ে বন্ধুকেই ভুলে গেলে?!!!
সবার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে উত্তর দিলাম ঐ মেসেজকৃত আইডিতে। যে আইডির লোকটি সাথে ফেসবুকে প্রথম পরিচয় আমার। লোকটি প্রবাসী। নাম “শফিক”।
বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। চোখে সানগ্লাস। পরনের ধূসর কালো গেঞ্জিটা ধূসর বর্ণের চাদরে আবৃত। মুখের মিষ্টি হাসিটা যেন সবসময় লেগে থাকে।
লোকটার ছবি দেখলে কেমন যেন এক ভালো লাগা কাজ করে। বাঁধনের চেহারার সাথে লোকটার চেহারার অদ্ভুত মিল রয়েছে।
বাঁধনের সাথে পরিচয়ের শুরু থেকে শেষ অবধি এই লোকটার জানা।
ওনার সাথে শেষ কথা হয় সেদিন, যেদিন বাঁধন শেষ বার আমার এলাকায় গিয়েছিল। বাঁধনের সাথে দেখা করার আগ মুহূর্ত শফিক সাহেবকে ফোন দিলাম আমি। বুকটা তখন ধুরু ধূরু করে কাঁপছে। সেদিন বন্ধু শফিকের কাছে কাঁপা গলায় দোয়া চেয়েছিলাম। বলেছিলাম-
“দোয়া করবেন বন্ধু। দেখা করতে চাচ্ছি।”
সেদিন সেই কথাগুলোই ছিল বন্ধু শফিকের সাথে আমার শেষ কথা।
তারপর আর কথা হয়নি ওনার সাথে। ফেসবুক আইডি, সিম কোনোটাই আর ইউজ করা হয়নি বাঁধনের কাছে প্রত্যাখিত হওয়ার পর থেকে।

মেসেঞ্জারটা ওপেন করার সাথে সাথে বন্ধু শফিকের কল। কোনো দ্বিধা না করে কলটা রিসিভ করে ফেললাম।
ওপাশ থেকে এক মধ্য বয়স্ক লোকের কন্ঠে ভেসে উঠে__
” কেমন আছে এখন মায়ার বাঁধন?”

চলবে……

কৃষ্ণকলি পর্ব- ০৪

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ০৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

জি, আপনার বোধ হয় আর কোনো কষ্ট করতে হবে না। সুইটি এখন থেকে আমার সাথে’ই যেতে পারবে। বাঁধনের দিকে তাকিয়ে কথা’টা বলছিলাম আমি।
– সেই জন্য’ই তো বললাম ভালো’ই হলো।
মৃদু হেসে বাঁধনের জবাব।
“আচ্ছা, আসি আন্টি। আসসালামু আলাইকুম।”
বাঁধনের মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। একমিনিট দাঁড়ান, আমিও অফিসে যাব। কথাটা বলে আমায় থামালো বাঁধন। বাঁধন ওর মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।
বাঁধনের পাশের সিটে চুপচাপ বসে আছি এই আমি। গাড়ি চলছে। কিন্তু গাড়ি মুখে’ই কোনো কথা নেই। দুজনে’ই নিরব।
-তারপর???
কলেজ থেকে ফিরবেন কখন? নিরবতা ভেঙে বাঁধনের প্রশ্ন।
– ফিরব কখন সেটা তো জানি না। তবে ৩টা ২০পর্যন্ত কলেজ টাইম। সামনের দিকে তাকিয়ে বাঁধনের প্রশ্নের জবাব দিলাম আমি। বাঁধন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-
” তাহলে তো মনে হয় আমার সাথে ফিরতে পারবেন। আমিও অফিস থেকে চলে আসব ৪টার দিকে। ততক্ষণে আপনার নিশ্চয় অফিশিয়াল কাজ সব শেষ হয়ে যাবে???
-হুম, শেষ হয়ে যাবে। প্রতিউত্তরে আমার জবাব।

তারপর বাকি রাস্তা আর কোনো কথায় হয়নি। বাঁধন আমাকে কোনো প্রশ্ন করেনি আর আমিও কোনো কথা বলার সুযোগ পায়নি।

গাড়ি থেকে নামার সময়_
” এই! সাবধানে, সাবধানে!!!
গাড়ি আসছে….”
বাঁধনের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট হাসি দিয়ে বললাম-
আসি তাহলে….
বাঁধন আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
” অপেক্ষা করব ৪টার সময় এখানে।”

বাঁধনের থেকে বিদায় নিয়ে কলেজ গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম।
আমার প্রথম ক্লাস ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের ফিজিক্স সকাল ১০টায়, দ্বিতীয় ক্লাস ২য় বর্ষের ছাত্রীদের ফিজিক্স দুপুর ১২টা ৪০মিনিটে। ১টা ২০মিনিটে আমার ক্লাস শেষ। তারপর আমার পুরো অবসর। অফিসিয়াল কাজ সেরেও ২টা কিংবা আড়াইটার ভিতর কলেজ থেকে বের হওয়া যাবে, আর ছাত্রীদের প্রাইভেট কিংবা কোচিং করালে তাহলে সেটা অন্য কথা। সেদিন ক্লাস+অফিসিয়াললি কাজ সেরেও দেখলাম ঘড়িতে মাত্র ২টা বেজে ২০মিনিট।

অন্য কোনো কাজ না থাকায় বের হয়ে গেলাম কলেজ থেকে। কলেজ গেইটে গিয়ে অটোতে উঠব কি না সেই দ্বিধাদ্বন্ধে পরে গেলাম। বাঁধন তো বলেছিল ৪টায় বাসায় ফিরবে, ততক্ষণ কি আমি অপেক্ষা করব?
মাত্র তো আড়াইটা বাজে।
না, থাক।
আমি বরং বাসায় চলে যায়।
এই বলে বাসায় চলে যাচ্ছিলাম।পিছন থেকে একটা গাড়ি এসে আমার সামনে থামল। গাড়ির কাছাকাছি যেতে’ই দেখলাম বাঁধন বসে।।
আপনি? এ সময়?
আপনার না ৪টার আসার কথা? অবাক হয়ে বাঁধনকে প্রশ্ন করলাম।
~ আমারও তো একই প্রশ্ন মিস কৃষ্ণকলি!
আপনি এ সময় এখানে???

বাঁধনের প্রশ্নোত্তরে বললাম,
আমার দুইটা ক্লাস। সেটা ১টা ২০পর্যন্ত’ই। অফিসিয়াল কাজও তেমন ছিল না। তাই টিফিন করে সোজা চলে আসলাম।

আমার অফিসে এখন লাঞ্চটাইম চলে। অসুস্থ্যতার অজুহাত দেখিয়ে বস মামার থেকে ছুটি নিয়ে চলে আসলাম। হেসে হেসে বাঁধনের জবাব।
– বস মামা? সেটা আবার কেমন ডাক? আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম বাঁধনকে।

বস মামা মানে বস আমার মামা হয়। আপন মামা। বাবার অনুপস্থিতিতে ঐ মামায় বাবার কোম্পানির দেখাশুনার দায়িত্বে আছেন।
– আংকেল? আংকেল কোথায়??? বাঁধনের দিকে তাকিয়ে বাঁধনকে প্রশ্নটা করলাম।

বাঁধন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল__
বাবা?!!!
বাবা হারিয়ে গেছে।
আমাদের রেখে দুর অজানায় পালিয়ে গেছে।
বাঁধনের কথা শুনে হচ্ছিল আমার ভিতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, ভেঙে চূরমার হয়ে যাচ্ছে। কোনো কথা না বলে বাঁধনের পাশের সিটে গিয়ে বসলাম, ছোট্ট করে বললাম “স্যরি”।
বাঁধন মনে হয় আমার এই স্যরি’টা আশা করে নি। তাই তো আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল-
” Sorry?!!! But Why?”
আমি জানতাম না আংকেল নেই। জানলে এভাবে আপনাকে কষ্ট’টা মনে করিয়ে দিতাম না। আমি আবারও বলছি স্যরি…..
আর আল্লাহ ওনাকে শান্তিতে রাখুক সেই দোয়ায় করি। ভেজা গলায় কথাগুলো বললাম।
এদিকে বাঁধনের অবাক হওয়ার মাত্রা’টা যেন বেড়ে’ই চলছে উত্তরোত্তর। বাঁধন অবাক হওয়ার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেল। আর তাই তো আমার দিকে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করল-
” নেই মানে? What do you mean?”
চোখের জলটুকু মুছলাম। করুণ চোখে বাঁধনের দিকে তাকালাম। তারপর_
” আমি সত্যি’ই দুঃখিত। আমি জানতাম না আংকেল আর এ পৃথিবীতে নেই। আর যখন জানতে পারলাম তখন মনে হলো আংকেলের মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিয়ে আমি আপনাকে অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। এই জন্য I am sorry….”
আচমকা বাঁধন stopped, stopped বলে চেঁচিয়ে উঠল। আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। কিন্তু এভাবে চেঁচানোর মানে’টা বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর বলল, আমার বাবা হারিয়ে গেছে দুর অজানায়,তার মানে এই নয় আমার বাবা আর বেঁচে নেই। আমার বাবা বেঁচে আছে। ওনাকে বেঁচে থাকতে’ই হবে। আমাদের ভালোবাসার টানে ওনাকে একদিন ফিরে আসতেই হবে। তা পৃথিবীর যে প্রান্তে’ই হোক না কেন। এটুকু বলে বাঁধন চুপ হয়ে গেল। আমিও কোনো কথা বাড়ালাম না। তাই আমিও চুপ করে আছি। কিন্তু কৌতূহলী মনকে কিছুতেই শান্তনা দিতে পারছি না। পারছিলাম না একটা হিসেব মিলাতে। হিসেবটা মিলানোর জন্য আমার বাঁধনের হেল্প দরকার। কিন্তু এই মুহূর্তে ওকে এ সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস না করাই ভালো। আর তাই চুপ করে আছি।

মিনিট দশেক এভাবে একই স্থানে গাড়ির ভেতর ২জন চুপ করে বসে ছিলাম। নিরবতা ভাঙে বাঁধন। সামনের দিকে তাকিয়েই বলতে থাকে_
” বাবা ছিলেন ভিষন ছটফটে এবং দুরন্ত স্বভাবের। সারাক্ষণ কাঁধে গিটার নিয়ে ঘুরে বেড়ানো’ই ছিল ওনার স্বভাব। দুরন্ত এবং চঞ্চল বাবা ছিলেন স্বাধীনচেতা আর মুক্তমননের অধিকারী। কোনো ধরাবাধা নিয়ম ওনি পছন্দ করতেন না। আর তাইতো লেখাপড়া শেষ করে দাদার ব্যবসায়ে যোগ না দিয়ে একটা এফএমে আর.জে হিসেবে জয়েন করলেন। সেই রেডিওর পোগ্রামের মাধ্যমে’ই আমার বাবা অসংখ্য দুঃখী মানুষের দুঃখ দুর করে দিয়েছেন। অল্প কয়েক বছরের ব্যবধানে আমার বাবা হয়ে গেলেন সকলের প্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব। দিনে কাঁধে গিটার নিয়ে বন্ধুদের সাথে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ানো আর রাত্রে রেডিওতে মানুষের লাইফ সাপোর্ট দেওয়া। এটুকুই ছিল বাবার কাজ। বাবার জীবন যেন এটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু না!!!
বাবার জীবন এটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
বাবার জীবনে আরো একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। সেটা ছিল ‘সংসার’। কিন্তু বাবার হাবভাব দেখে মনে হতো সংসারের প্রতি যেন ওনার কোনো দায়িত্ব’ই নেই। বাবা মাকে একদম’ই সময় দিত না। দিত না বললে ভুল হবে, আসলে বাবার সময় হতো না। মা সব দেখেও চুপ করে ছিল। ভাবত পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সুইটি জন্ম নেওয়ার পরেও যখন বাবার চালচলনে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না, তখন আমার মা মুখ খুলে। বাবাকে এই নিয়ে কথা বলে। দাদাও বাবাকে বকাঝকা করত। মায়ের বকবকানি, দাদার বকাঝকা আমার বাবার ব্যক্তিত্বে বোধ হয় আঘাত হানে। তাই তো একদিন ভোরে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাবা বাসা থেকে চলে যায়। বাবা চলে যান বলে গেছেন। কিন্তু কোথায় চলে গেছে সেটা বলে যান’নি। আমার মা আজও বিশ্বাস করে বাবা আসবে। ওনাকে আসতে’ই হবে।

চলবে…..

কৃষ্ণকলি পর্ব- ০৩

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ০৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কাঙ্খিত গন্তব্যে। আমার স্বপ্নের সুখের নীড়ে।
যে নীড়কে নিয়ে একটা সময় রাতভর স্বপ্ন দেখতাম;
স্বপ্ন দেখতাম আমার থাকবে একটা সাজানো ছোট্ট সংসার।
যেখানে মা সমতুল্য শাশুড়ি , বন্ধু ভাবাপণ্ন শ্বশুর আর বোনের মত একটা ছোট্ট ননদ থাকবে। ওদেরকে নিয়ে হৈহুল্লুর করে কেটে যাবে আমার দিন, আমার রাত।
আমার স্বপ্নগুলো আজ যেন স্বপ্ন হয়ে’ই রয়ে গেল। পূরণ আর হলো না….

মিষ্টি মা!
আমাদের বাড়িটা কি পছন্দ হয়েছে?
~মিষ্টি???(আমি)
হুম, মিষ্টি। এত মিষ্টি দেখতে যে তাকে মিষ্টি বলব না তো কি বলব, হুহ্?
আজ থেকে তোর নাম মিষ্টি। তুই আমার মিষ্টি মা। আগে পরে কি নাম ছিল সেসব ভুলে যা। মনে করবি,
তুই সদা বর্তমানে ছিলি, আছিস, থাকবি।
কি!!!
মনে থাকবে আমার কথা?
– হুম।

সুইটি একটু এদিকে আয়’তো!
বাঁধনের মায়ের ডাকে বাঁধনের ছোট বোন সুইটি ছুঁটে আসল। মিষ্টি করে সালাম দিয়ে আমাকে ওর রুমে নিয়ে গেল।
ফ্রেস হয়ে রেস্ট নেবার জন্য বলল। ফ্রেশ হয়ে এসে ব্যাগ থেকে কাপড়-চোপড় বের করছিলাম, এর’ই মাঝে মিস সুইটি ওর রুমের প্রতিটি কোণায়-কানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আসবাবপত্রের বর্ণনা দিতে লাগল। এমনভাবে সব কিছুর বিশ্লেষণ করছে মনে হচ্ছে ও যেন কোনো দোকানের মালিক। আর আমি সেখানকার একমাত্র ক্রেতা।
যায় হোক!
আধঘন্টা এভাবে অনর্থক পেঁচাল পারল।
তারপর মনে হয় হাফিয়ে গিয়েছিল।
আপু তুমি বসে রেস্ট নাও, আমি আসছি বলে চলে গেল সুইটি
উফ!!!
পারেও বটে।
কিছু সময়ের ব্যবধানে’ই বুঝে গেলাম মেয়েটা ভিষণ ছটফটে আর চঞ্চল। সারাক্ষণ ছুটোছুটো করাটাই যার স্বভাব। সুইটি যাওয়ার পর বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিয়েছিলাম, ঠিক তখন’ই রুমে বাঁধনের আগমন। একবাটি নুডলস হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে। অনুমতি নিয়ে’ই তবে রুমে প্রবেশ করে।
নুডলস খান বলে আমার দিকে নুডলসের বাটি”টা বাড়িয়ে দেই বাঁধন।
আমি নুডলস খাই.. না এটুকু শুধু বলছিলাম, তখন’ই ও বলে উঠে-
নিজ হাতে বানিয়েছি।
গ্রহণ করলে ভালো লাগত।
এবার আর ফিরিয়ে দিতে পারিনি। বাঁধনের হাত থেকে নুডলসের বাটিটা নিয়ে ডকডক করে গিলতে লাগলাম, যদিও নুডলস আমার ভিষণ অপছন্দের খাবারের তালিকায় পরে।
জীবনের প্রথম অপছন্দের কোনো খাবার খেলাম।
নাহ, পূর্বের ন্যায় কোনো বমি কিংবা অস্বস্তি লাগে নি। কেন যেন মনে হচ্ছে,
অপছন্দের কোনো খাবার নয়, আমি যেন কোনো অমৃত খাচ্ছি।
এমন অনুভূতির কারণ’টা কি সত্যি’ই ওর রান্নার জন্য নাকি প্রিয় কারো হাতের খাবারের জন্য সেটা জানা নেই আমার….
খাওয়া শেষ করতে’ই জিজ্ঞেস করে বাঁধন, কেমন হলো জানাবেন না???
বাঁধনের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম।
ওর প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করলাম-
” আপনি রান্না পারেন আগে কখনো বলেন নি তো?!!!”

বাঁধন আমার দিকে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসো দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। মনে মনে নিজের বোকামির জন্য নিজেকে’ই গালি দিচ্ছিলাম। প্রশ্ন করে বাঁধন__
” আগে বলব মানে?”
– স্যরি, মজা করলাম। তবে যায় হোক!
আপনার নুডলস রান্না’টা কিন্তু বেশ হয়েছে।
আমার দিকে তাকিয়ে একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলে_
” শুনে ধন্য হলাম…..”

বাঁধন রুমে চলে যায়।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়া শেষে অনেক কথা-বার্তা হলো সবার সাথে।
এতে এটুকু বুঝলাম যে_
” আমার ধারণা’টা মনে হয় একটু ভুল। বাঁধন শান্ত নয়, এখনো আগের মত’ই অশান্ত ভাবটা ওর মধ্যে আছে।”

মাঝরাত্রে খুব ভেঙ্গে যায়।
স্মৃতি’রা এসে মনের জানালায় কড়া নাড়ে। ভিতরে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।
অস্থিরতা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে নামাজকে’ই উত্তম মনে হলো।
ওযু করে বসে গেলাম নামাজের বিছানায়।
আদায় করে নিলাম তাহাজ্জদ।
নামাজ শেষে কুরআন নিয়ে বসে পরলাম।
কুরআন পাঠে এতটাই মগ্ন ছিলাম যে মনে’ই ছিল না এখন রাত্রী গভীর।
এদিকে গভীর রজনীতে তেলাওয়াতের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় বাঁধনের মায়ের। বিছানা থেকে নেমে ঘড়ির দিকে তাকান ওনি। রাত্রী তখন ৩টা।
এত রাত্রে কুরআন তেলাওয়াত???
বাঁধনের মা নামাজ কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালো। রুমে দরজা আটকানো। কিন্তু এ রুম থেকে’ই তেলাওয়াতের আওয়াজ’টা আসছে সেটা ওনি বুঝতে পারলেন। জানালার পর্দা আংশিক ফাঁক করে রুমের ভিতর তাকালেন ওনি।
ওনার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল।
– এত সুন্দর সুরেলা কন্ঠে তেলাওয়াত তাহলে এই মেয়ে’ই করছে। মিষ্টি হেসে রুমে চলে গেলেন বাঁধনের মা….

পরদিন সকালবেলা ব্রেকফাস্ট করে আন্টিকে(বাঁধনের মা) বলতে গেলাম যে, বাইরে যাচ্ছি। গিয়ে দেখলাম ওনি আধ শুয়া হয়ে হাদিসের বই পড়ছেন। আমাকে দেখে সোজা হয়ে বসলেন ওনি। জিজ্ঞেস করলেন-
কোথাও যাবি মা?
– জি, আন্টি। কলেজে যাচ্ছি।
~ কলেজে? কেন কোনো দরকার মা???(আন্টি)

আন্টি কলেজে আমার চাকুরী হয়েছে…..
– আলহামদুলিল্লাহ! শুনে খুশি হলাম। তা কোন কলেজে চাকুরী হয়েছে তোমার মা?
~ গার্লস স্কুলের সাথে যে কলেজ’টা আছে সে কলেজ’টাই আন্টি।
– কিহ? তুমি মহিলা কলেজের কথা বলছ?
আশ্চর্য হয়ে বাঁধনের মা প্রশ্ন করে আমায়। ওনার প্রশ্নের জবাবে ছোট্ট করে বললাম__
জি আন্টি….

বাঁধনের মা মিষ্টি হেসে বলল__
সেখানে তো সুইটিও পড়ে মা….

ভালো’ই তো হলো।
ও তাহলে এখন থেকে আমার সাথে’ই যেতে পারবে।
‘ হুম, একহিসেবে ভালো’ই হয়েছে আমার মাথার বোজা কমল, ভিষণ থেকে বলে উঠল বাঁধন………’

চলবে…….

কৃষ্ণকলি পর্ব- ০২

0

কৃষ্ণকলি পর্ব- ০২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

বাঁধন চলে গেলে সেদিনের মত বাসায় ফিরে গেলাম। সারা রাত বাঁধনকে ভেবে ছটফট যন্ত্রণায় কাটল। ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে ঐ স্থানে গিয়ে দাঁড়ালাম যেখানে বাঁধন উন্মাদের মত হাঁটছিল গতকাল। সকাল থেকে দুপুর বাসা খুঁজার অজুহাতে ঘুরঘুর করেছি সে স্থান ও তার আশেপাশে। কিন্তু বাঁধনের দেখা আর মেলেনি।
একদিন, দু’দিন করে চলে যায় এক সপ্তাহ। বান্ধবী অর্পিতাকেও যে বিশাল বড় ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি সেটা ও মুখে না বললেও কাজে ঠিক টের পেতাম। বেশকিছুদিন আগে একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরীর জন্য এপ্লাই করেছিলাম। রিটেনে ভালো’ই করেছিলাম। আল্লাহ, আল্লাহ করে যদি ভাইবাতে ভালো করতে পারি তাহলে চাকুরীটা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ!
আর সে জন্য’ই অর্পিতার এখানে উঠেছিলাম। কিন্তু অর্পিতা বোধ হয় এই কয়দিনে’ই হাফিয়ে উঠেছে। আর তাই সেদিন ভাইবা দিয়ে এসে অর্পিতাকে বললাম,
আর একটা দিন অর্পি!
একটা দিন পর আমি বাসা পাই বা না পাই এখান থেকে চলে যাব। অর্পিতা করুণ স্বরে বলেছিল,
মায়া! আমি তোকে এভাবে যেতে দিতাম না। কিন্তু কিন্তু কি করব বল? আমার এত অল্প ইনকামে পরিবার চালিয়ে নিজেও চলা খুব কষ্টকর হয়ে যায়!!!
অর্পিতাকে আমার খরচ বাবদ কিছু টাকা দিয়ে পরদিন সকালে ওর বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম। সেদিন সারাদিন হন্যে হয়ে খুঁজেও কোথাও ভালো বাসার সন্ধান করতে পারিনি। ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে বাসস্টপের ছোট্ট বেঞ্চে বসে যখন জীবন অংকের হিসাব মিলাচ্ছিলাম তখন’ই পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠে,
” শুনছেন___”

পিছনে ফিরে তাকালাম। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এ যে স্বয়ং বাঁধন দাঁড়িয়ে। চোখের জল লুকিয়ে বললাম, আপনি?!!!
কেমন আছেন?
এই তো আলহামদুলিল্লাহ! আপনি এখানে এভাবে!!!
— বাসা খু্ঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম আজকে যেভাবে’ই হোক একটা বাসা ঠিক পেয়ে যাব, তাই বান্ধবীর বাসা থেকে একেবারে চলে আসছিলাম। কিন্তু____
পেলেন না’তো বাসা???

আমার নিরবতা দেখে বাঁধন বুঝে নিল বাসা খুঁজে পাওয়া যায় নি।
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছিল দেখে বাঁধন বলল, চলেন। বাঁধনের দিকে তাকিয়ে চোখ’টা ফিরিয়ে নিলাম।

আমার পক্ষে আর ও বাসায় যাওয়া সম্ভব নয়।

কি করবেন তাহলে? এভাবে এখানে অসহায়ের মত বসে থাকবেন?(বাঁধন)
— থাকব।(আমি)
মিস ম্যাম! চারপাশ’টা দেখেছেন? সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আর আপনি দিনের শহর দেখেছেন, এখনো অবধি হয়ত রাতের শহর দেখেননি। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলে ফেললেন। সন্ধ্যা পর থেকে’ই এখানে বখাটেদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। আমি কি বুঝাতে চেয়েছি আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন!(বাঁধন)

বাঁধনের কথা শুনেও আমার কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না দেখে বাঁধন বোধ হয় মনে মনে অবাক হয়েছিল। অবাক হওয়ার’ই কথা। আমি নির্বিকারচিত্তে সামনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছি,
আমি জানি বাঁধন! তুমি এই মুহূর্তে ঠিক ভাবছ? তুমি ভাবছ আমার কোনো ভয়-ডর নেই নাকি!
ভয় আমার ঠিক’ই আছে বাঁধন। কিন্তু তুমি পাশে থাকায় সেটা এখনো অবধি ভালো ভাবে ঝেকে বসতে পারেনি।

আমার দৃঢ়চিত্তে বসে থাকা দেখে বাঁধন আমায় কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল ঠিক তখনি ওর ফোন’টা বেজে উঠে। বাঁধন ওর ফোন রিসিভ করে।
এই তো মা রাস্তায়। ওকে, ওকে আসছি।
ফোন’টা রেখে বাঁধন আমার দিকে তাকালো।
কৃষ্ণকলি!!!
আমায় এখন যেতে হবে। বোন কোচিংয়ে। সেখান থেকে ওকে আনতে হবে। আপনি বরং আপনার বান্ধবীর বাসায় ফিরে যান।

বাঁধন মায়াকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে’ই ফোন কানে আসছি, আসছি বলে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। মায়া দু’টানায় পরে যায়। কি করবে বুঝতে পারছিল না। বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াতে’ই ওর ফোন’টা বেজে উঠে।
ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকল মায়া। তারপরে’ই মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে ওর। অবশেষে মায়ার চাকুরী’টা হয়ে গেছে। আর হাসি’টা সেই বিজয়ের’ই হাসি।

খুশিতে আত্মহারা হয়ে যখন আমি দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম তখন মনে হলো ওপাশ থেকে এক দোকানদার ডাক দিয়েছে আমায়। আশেপাশে কেউ ছিল না দেখে নিশ্চিত হলাম ওনি বোধ হয় আমায়’ই ডাক দিয়েছেন। আর তাই আমি টং দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দোকানদার আমায় বেঞ্চে বসতে বলে আমার দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিলেন। আমি চা খাই না বলে চুপচাপ বেঞ্চে বসে পরলাম। চায়ের কাপ পাশে রেখে দোকানদার আমার পাশে এসে বসলেন। তারপর বলতে লাগলেন__
” তুই বোধ হয় এই এলাকায় নতুন! তোর বোধ হয় এই এলাকা সম্পর্কে কোনো ধারনায় নেই। তাই এভাবে নির্ভয়ে এখানে হাঁটতে পারতেছিস।”

– দোকানদারের কথা শুনে এবার সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছি।

_ তোর বাড়ি কোথায়রে মা?
দোকানদারের আবেগী গলার কথা শুনে মনটা গলে গেল। সবটা খুলে বললাম ওনাকে। দোকানদার আমায় নির্ভয় দিয়ে বললেন, “তুই একদম চিন্তা করিস না মা। একদম কাঁদবি না। তুই শুধু এখানে ৫টা মিনিট বস। আমি তোকে বাসা খুঁজে দিব।”

কোনো কথা না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলাম আমি। কিছুক্ষণ পর দোকানদার কাকে যেন বলল__
” আরে ভাবিসাব যে!
আসসালামু আলাইকুম।”
না তাকিয়েও বুঝে গেলাম কোনো মহিলা আসছে বোধ হয় সওদা করতে। মহিলাটি আমার পাশে এসে বসল বুঝতে পারলাম।
আমার চোখ দিয়ে তখনও অঝরে অশ্রু গড়িয়ে পরছিল বিপদের কথা ভেবে। আতংকে কলিজা শুকিয়ে আসছিল। মহিলাটি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাচ্ছিল, তারপর কি মনে করে যেন ফিরে আসল।
মহিলাটি আমার পাশে এসে পুনরায় বসল।
আমায় মাথায় হাত রেখে বলল__
” কোন মায়ের নাড়িছেঁড়া ধনরে তুই এখানে এভাবে অনাথের মত বসে কাঁদছিস। বাসা কোথায় তোর মা?”

বহুদিন পর নারী কন্ঠে ‘মা’ ডাক শুনে চোখ দুটো জলে ছলছল করে উঠল। অশ্রুভেঁজা নয়নে সামনের দিকে তাকালাম। এক অতিকায় সুন্দরী মধ্যবয়স্কা নারী আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে চশমা, গায়ে চাদর। আমি ভদ্রমহিলার দিকে ঢ্যাব ঢ্যাব করে তাকিয়ে আছি। কিছু বলতে যাব তখন’ই দেখি বাঁধন। বাইকে করে একটা মেয়েকে নিয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে। বাঁধনকে দেখে আমার মুখে শুকনো হাসি ফুটে উঠল…….

দোকানের সামনে এসে বাঁধন বাইক রাখে। বাইকের পিছনে বসা মেয়েটি আচমকা ভদ্রমহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে।
নালিশ করে বাঁধনের নামে। মহিলা ব্যস্তভাব নিয়ে বললেন,
পাজিটার বিচার বাসায় গিয়ে করব।
আগে দেখি তো আমার আরেক মা কেন কাঁদছে? কথা বলতে বলতে ভদ্রমহিলা আমার দিকে এগিয়ে আসেন।
গম্ভীর ভাব নিয়ে প্রশ্ন করলেন,
বললে না তো মা তুই এখানে এভাবে বসে কাঁদছিস কেন???

আ…..মি…..
মুখ খুলতে যাওয়ার আগেই দোকানদার আমার মুখ থেকে কথা নেয়। ওনি বলা শুরু করেন,
” ভাবিসাব! এ আমার এক মা!
গ্রাম থেকে এসেছে চাকরীর খুঁজে।
চাকুরী ঠিক পেয়ে গেলেও কোনো বাসার সন্ধান পাইনি ও। আমি’ই ওকে এখানে বসিয়ে রেখেছি। ভেবেছিলাম দোকানপাট বন্ধ করে আপনার কাছে নিয়ে যাব ওকে। কিন্তু তার আগে’ই আপনি এসে গেছেন। এখন আপনি যদি আমার এই মা’টার জন্য কিছু করেন তাহলে বড় উপকার হতো। আপনি তো ভাড়াও দেন বাসা। যদি ওকে একটা রুম দিতেন.. ..?!!!”

দোকানি থেমে গেল এটুকু বলে।

মহিলাটি মিষ্টি হেসে বলল__
এভাবে বলবেন না ভাইজান! আপনার মা তো আমারও মা। আর ও ভাড়া কেন থাকবে? কোনো মেয়ে কি তার মা’কে নিজ বাসায় ভাড়া রাখবে???
ও আজ থেকে আমার এখানে’ই থাকবে। আমরা যা খায় তাই ও খাবে।
কি পারবি মা?
যাবি এই মায়ের সাথে???

কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি। অজস্র জলরাশি চোখ থেকে গড়িয়ে পরছিল।
নাহ, এ জল বেদনার নয়!
এ জল আনন্দের।
এ আনন্দের জল। বহুদিন পর অচেনা কারো মাঝে মায়ের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। তাই চোখ থেকে অজান্তেই সুখের দু’ফোঁটা আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পরছে……

কি হলো মা? যাবি না এ মায়ের সাথে?
মহিলাটির কথা শুনে চোখের অশ্রু মুছে নিলাম। মৃদু হাসি দিয়ে বললাম__
” যাব আন্টি….”

হুম, এবার তাহলে চল। রাত’তো অনেক হয়েছে। (ভদ্র মহিলা)
দোকানদারের থেকে বিদায় নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম।
এই হতচ্ছারা! এখানে দাঁড়িয়ে ফোন টিপবি নাকি বাসায় যাবি???(মহিলা)
ওহ, মা! লাগছে বলে পিছনে ফিরে তাকালো বাঁধন। আমায় দেখে চোখ বড় বড় করে বলল, আপনি???(বাঁধন)
জি, ও আজ থেকে আমাদের সাথে আমাদের বাসায় থাকবে। কেন? তুই চিনিস নাকি ওকে???(মহিলা)

না’তো…
আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলল বাঁধন। পিছন থেকে ওকে অনুসরন করে অচেনা মা-মেয়ের সাথে এক অচেনা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম আমি।

চলবে……..

কৃষ্ণকলি পর্ব:- ০১

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব:- ০১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

ছয় বছর পর বাঁধনের সাথে দেখা। ভাবতেই পারিনি, ওর সঙ্গে এভাবে দেখা হবে।
এই ছয় বছরে অনেক বদলে গেছে বাঁধন। সেই চঞ্চল বাঁধন আর এখনকার শান্ত, সভ্য বাঁধনের মধ্যে অনেক তফাত।
আমি এই বিরতিতে বাঁধনকে প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন পড়ন্ত বেলায় ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর জীবনের হিসাব কেমন যেন পাল্টে গেল।
মাথা নিচু করে রাস্তায় হাটছিলাম। হঠাৎ উপরের দিকে তাকাতেই বাঁধনকে দেখলাম।
আশ্চর্য হয়ে গেলাম! কোনো দ্বিধা না করে বলে ফেললাম, কেমন আছেন?
ভালো। ছোট করে বলেই থেমে গেল বাঁধন। আমার মুখে তখন আর কোনো ভাষা ছিল না। কিছু সময় নিরবতা, তারপর আচমকা বাঁধনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসল, আপনি? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারিনি!!
স্মিতহাস্যে বললাম, কৃষ্ণকলি। “কৃষ্ণকলি”
আমার নাম।

অতীতে ফিরে গেলাম আমি। ২০১০সালে বাঁধনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় আমার। পরিচয়টা ফেসবুকে’ই। তারপর ঘনিষ্ঠতা, ঘনিষ্ঠতা থেকে আন্তরিকতা। মনের অজান্তে’ই ওকে নিয়ে ভালোবাসার বীজ বপন করে ফেলেছিলাম। খুব বেশী ভালোবেসেছিলাম ওকে। এতটাই ভালো যা লিখে বুঝানোর মত নয়। সেও যে আমাকে ভালোবাসে নি, তাও কিন্তু নয়। বাঁধনও আমায় ভালোবাসত, কিন্তু কখনো বুঝতে দিত না। বুঝতে না দিলেও আমি ওর মনের না বলা কথাগুলো ঠিক বুঝে নিয়েছিলাম। রিলেশনের দু’বছরের মাথায় বাঁধন আমার কাছে একটা জিনিস চাই। আমার ছবি চাই। আমার কাছে বাঁধনের প্রথম আবদার, পূরণ করা’ই যেত। কিন্তু করিনি। বাঁধনকে ছবি দিতে অস্বীকার করলাম। প্রচন্ড অভিমানে বাঁধন আমার সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দেয়। তারপর অতিবাহিত হয়ে যায় দীর্ঘ একটা বছর।
সেদিন হসপিটালের বিছানায় আধাশোয়া অবস্থায় তন্ময় হয়ে মান্না দের গান শুনছিলাম। বাঁধনকে হারিয়ে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেছিলাম আমি। অসুস্থ হয়ে পুরো একবছর মনোরোগ বিভাগে থাকতে হয়েছিল আমাকে। কয়েকদিন ধরে শরীরের অবস্থাও বেশী ভালো যাচ্ছিল না। বান্ধবীর জোরাজুরিতে একরকম বাধ্য হয়ে’ই তাই দু’দিন ধরে হসপিটালে আছি। গান শুনার ফাকে একসময় পাশের কেবিনের এক রোগীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। হঠাৎ’ই ফোন’টা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতে’ই মনে হলো চোখে কিরকম সরষে ফুল দেখছি। ফোন’টা চোখের কাছ থেকে আরো কাছে নিয়ে আসলাম।
চমকে উঠলাম। এ যে বাঁধন!
এতবছর পর কি মনে করে? কানে নিয়ে কথাটা বলতে’ই ও জবাব দেয়, তোমাকে দেখব। দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। তোমাদের এলাকার পরিত্যক্ত সেই জমিদারী আমলের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানকার কথা তুমি প্রায়’ই বলতে। ৩০ মিনিটের ভেতর তুমি এখানে আসো, আমি তোমায় সামনাসামনি দেখতে চাই।

ফোনটা কান থেকে নামিয়ে ফেললাম। বান্ধবী ডাঃ নুসরাতকে বলেই ছুটে চললাম এলাকার দিকে। মিনিট দশেকের ভেতর পৌঁছে গেলাম কাঙ্খিত স্থানে। সি.এন.জি থেকে নামতেই দেখলাম একটা অচেনা যুবক গিটার হাতে দাঁড়িয়ে আছে অন্যমনস্ক হয়ে। বাঁধনকে চিনে নিতে আমার ভুল হয়নি, বুঝতে অসুবিধে হয়নি এই আমার বাঁধন! এক’পা দু’পা করে এগিয়েও পিছু হটলাম।
সেদিন বাঁধনের সামনে যেতে পারিনি। বাঁধন ছিল আমার কল্পরাজ্যের রাজকুমারের চেয়েও অনেক অনেক সুন্দর। এত সুন্দর-সুদর্শন যুবকের পাশে আমি যে বড্ড বেমানান। কারণ- আমি কালো। শুধু কালো নয়, অনেক বেশী’ই কালো। মনে ভয় ছিল এমন কালো চেহেরা নিয়ে ওর সামনে গেলে যদি ও ফিরিয়ে দেয়? যদি হারিয়ে যায় ভালোবাসার এই তীব্রতা’টুকু? তার চেয়ে ভালো ওর কাছে অপ্রকাশিত’ই থাকা। বাঁধন ফিরে গিয়েছিল সেদিন। এরপর হাজার চেষ্টা করেও ওর সাথে কথা বলতে পারিনি। পারিনি কোনো প্রকার যোগাযোগ করতে। আর করব’ই বা কিভাবে?
ও যে যোগাযোগের সব মাধ্যম’ই ছিন্ন করে দিয়েছিল। বন্ধ করে দিয়েছিল ফোন নাম্বার। ফেসবুকে ব্লক করে দিয়েছিল। অন্য আইডি খুলে নক করেছিলাম। যার কারনে আইডি’টাই ডিএক্টিবেট করে দেয়। এভাবেই আমার সব স্বপ্নের ইতি ঘটল। সাজানো স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণায় আবারো ছটফট করে উঠলাম।
~ কি হলো? বললেন না যে কে আপনি?
বাঁধনের কথায় ভাবনাচ্ছেদ হলো। ফিরে এলাম সুদূর অতীত থেকে আজকের এই নির্মম বর্তমানে। বাঁধনের দিকে তাকি বললাম, কৃষ্ণকলি।
বাঁধন বিরক্তিভাব নিয়ে বলল, কৃষ্ণকলি!
সে’তো গল্প-উপন্যাসে’ই মানায়। আপনি তো কোনো গল্প নন, তাই না? আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি কোনো গল্প বা উপন্যাসের কথা বলছি না। আর এটাও বলছি না আমি গল্পের নায়িকা।
আমার কথা শুনে বাঁধন বলল,
তবে আমি নিশ্চিত আপনি রবীন্দ্রনাথের সেই কৃষ্ণকলি….
বাঁধনের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ ছিলাম।
বাঁধন নিরবতা ভেঙে বলল_
“তবে যায় হোক।
আমি মনে হয় ভুল কিছু বলিনি। আপনি’ই সেই কৃষ্ণকলি, যার রূপের বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ ওনার কবিতায় চমৎকার ও সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।”
বাঁধনের কথার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ওর তুড়ির আওয়াজে দিশা হয়। সামনের দিকে তাকালাম।
– এ এলাকায় নতুন?
বাঁধনের দিকে তাকিয়ে বললাম, জি!
আজ’ই এসেছি এখানে।
– ওহ! কোথায় উঠেছেন?
জবাব দিলাম, আপাতত বান্ধবীর বাসায় আছি। বাসা খুঁজে পেলে’ই ওখান থেকে চলে যাব। আপনি?
আপনিও এখানকার…..(……)…..???
আমার কথা শুনে মৃদ্যু হেসে বাঁধন বলল, নাহ! আমি ভাড়াটে নয়। এ এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা আমি। ঐ যে সামনে যে বাসাটি দেখছেন সেটাই আমাদের বাসা। কোনো প্রয়োজন হলে জানাবেন। যথাসাধ্য চেষ্টা করব সাহায্য করার। এখন আসি।
আল্লাহ হাফেজ।

বাঁধন চলে যাচ্ছে।
একটু একটু করে দুরে চলে যাচ্ছে।
আমি নির্বাক দৃষ্টিতে ওর সেই চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি….

চলবে…..