Friday, August 15, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 110



সংঘাতের মেঘ পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0

#সংঘাতের_মেঘ
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ৪(অন্তিম পর্ব)

ঘড়িতে রাত দেড়টা…
রায়হান সর্তকতার সাথে বারান্দা টপকে রুমে প্রবেশ করলো। বারান্দার দরজা খোলা থাকায় রায়হানের বেশ সুবিধা হলো।

মেহেরজান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রায়হান একটা মলিন মুচকি হাসি দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো মেহেরজানের মুখের সামনে।

মনে করতে লাগল আজ সন্ধ্যার কথা। তার সাথে মেহেরজানের বাবার কথপোকথন।

তার রিকুয়েস্ট করার কথা। সে পারেনি সেই অনূরোধকৃত পিতাকে ফিরিয়ে দিতে। তাকে যে প্রমিস করতে হয়েছে যে সে সরে যাবে মেহেরজানের জীবন থেকে। তার হয়তো নিজের ভালোবাসাকে নিজের করে পাওয়া হলোনা এ জীবনে। রায়হান জীবনে সব কিছুই পেয়েছে। হয়তো নিজের ভালোবাসা ছাড়া। মেয়েটা বুঝতেই চাইলো না তার ভালোবাসা।

চোখের কাণিশে জমা হওয়া পানিতে আলতো করে মুছে মুচকি হাসি দিয়ে বলল
“মেহের যা হেরে গিয়ে জিতিয়ে দিলাম তোকে। ভালো থাক তুই।”

মেহেরজানের গালে হাত বুলিয়ে ওর কপালে একটা গভীর চুমু খেল। মেহেরজান ঘুমের মাঝেই কেঁপে উঠলো।

রায়হান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো, মেহেরজানের মুখের উপর একবার শেষবারের মতো তাকিয়ে নিলো। যেনো সেই মুখের প্রতিটি রেখা মনের গভীরে খোদাই করে নিতে চাইলো। সে জানে, আর কখনো এই মেয়েটির মুখে সে তাকাতে পারবে না। সিসি ক্যামেরাটা খুলে নিলো।

বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে, মনে হলো যেন মনের ভেতর বিশাল এক শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু প্রতিজ্ঞা ছিলো, প্রতিশ্রুতি ছিলো মেহেরজানের বাবার কাছে। সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে।

বারান্দা টপকে, রায়হান অন্ধকার রাতের মধ্যে মিশে গেলো। কিন্তু তার হৃদয় জানে, সে চিরকাল মেহেরজানের ভালোবাসার জন্য অপেক্ষায় থাকবে, যদিও তা কখনোই তার হবে না।

——————-

সকালের তীব্র রোদের ঝলকানিতে ঘুম ভেঙে গেল। তখনি তার রুমে ছুটে এলো আরিয়ানা। আরিয়ার ঠোঁটে হাসি দেখে মেহেরজান ভ্রুকুচকে তাকালো সেদিকে। আরিয়ানা লাফিয়ে বেডে উঠে বলল
“আপু রায়হান ভাই বিয়েতে না করে দিছে।”

মেহেরজান নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা। মেহেরজান আরিয়ানার কথা শুনে স্থির হয়ে বসে পড়লো। তার মন যেন থেমে গেছে, মাথার ভেতরে চিন্তার ঝড় বইছে। রায়হান না করে দিয়েছে? এমনটা কিভাবে সম্ভব? কাল রাতেও তো সে…

তারপর ধীরে ধীরে, মনে পড়তে লাগল সেই অদ্ভুত স্বপ্নের মতো মুহূর্তগুলো। রায়হানের উপস্থিতি, তার গালে মৃদু স্পর্শ, কপালের সেই গভীর চুম্বন। সে ঘুমের ঘোরে অনুভব করেছিল, কিন্তু বাস্তব ভেবেছিল কি না, তা নিয়ে তখন খুব একটা ভাবেনি।

“কিন্তু কেন?” মেহেরজান শেষমেশ অস্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস করলো।

আরিয়ানা হেসে বলল
“কেন জানিনা। শুধু বলেছে যে, তার সিদ্ধান্ত পাকা, বিয়ে সে করবে না। মাও অবাক, সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে সে।”

মেহেরজান যেন শূন্যে ঝুলছে। রায়হানের এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কি কারণ থাকতে পারে? কেন সে এমন করলো? ভালোবাসার কোনো ইঙ্গিত না দিয়ে, এক রাতের মাঝেই কেন সে তাকে ছেড়ে চলে গেল?

মেহেরজানের বাবা তব্দা মেরে বসে আছে। সকালেই রায়হানের বাবা ফোন করে আফসোস নিয়ে বলেছেন ছেলে নাকি তার বেঁকে বসেছে সে কিছুতেই বিয়ে করবেনা। তার কথা যে রায়হান রাখবে ভাবেনি সে।

মেহেরজান বেশ খুশি হয়েছে। নিজেকে মুক্ত মুক্ত মনে হচ্ছে তার কাছে।

———————

দেখতে দেখতে কেটে গেছে তিনটা বছর। পরিবর্তন এসেছে সবকিছুর মাঝেই। পরিবেশ, পরিস্থিতি,মানুষিকতা এমনকি জীবনের ও। দুবছর হলো মেহেরজানের বিয়ে হয়েছে। তবে তা কাব্যের সঙ্গে। যে একজন দায়িত্বশীল পুরুষ তার একান্ত নারীর জন্য। পারিবারিকভাবে বিয়েটা হলেও দুজনের মধ্যে ভালোবাসার কোনো অভাব নেই। একে অপরকে পাগলের ন্যায় ভালোবাসে। কাব্য নিজের ব্যস্ততা পাশে রেখেই নিজের প্রিয়তমার জন্য সময় বের করে। যেমন আজকে তারা দুইজন মিলে ঘুরতে এসেছে শাপলাবিলে। কাব্য নীল রঙের পাঞ্জাবী পড়ে নৌকা চালছে। আর মেহেরজান নীল শাড়ী পড়ে শাপলা দেখছে আর মুহূর্তটাকে উপভোগ করছে।

বেশকিছু সময় সেভাবেই অতিবাহিত করে তারা নৌকা ছেড়ে বিলের কিনারার বসলো। মেহেরজানের লম্বা চুলগুলো উড়ছে মৃদু বাতাসের তালেতালে। কাব্য সেদিকে কিছুসময় মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধীর কন্ঠে বলল
“ভালোবাসি প্রিয়তমা।”

মেহেরজান মুচকি হেসে কাব্যের হাতে হাত রেখে ওর কাধে মাথা এলিয়ে দিলো।

কাব্য খানিকবাদে বলল
“আইসক্রিম খাবে?”

মেহেরজান হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ালো। কাব্য উঠে দাঁড়ালো আইসক্রিম আনার জন্য।

আইসক্রিমের দোকানে যেতেই একটা এগিয়ে এলো কাব্যের কাছে। পড়নে তার কালো পাঞ্জাবী। হাতে দামি ঘড়ি। চোখে সানগ্লাস। ফর্সা লম্বা সুঠাম দেহের পুরুষটিকে একপলক দেখে কাব্য ভ্রু কুচকে বলল
“আমি কি আপনাকে চিনি!”

লোকটি হাসলো। তারপর ধীর কন্ঠে বলল
“আপনি আপনার স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসেন তাইনা!”

কাব্য চোখ তুলে দূরে বসে থাকা মেহেরজানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠলো
“হুম অনেক। কিন্তু আপনি কে বললেন না তো।”

লোকটি আবার ও হাসলো। তার হাসিতে কি যে ছিলো। সে আবার ও বলে উঠলো
“আগলে রাইখেন নিজের ভালোবাসাকে। সবার কপালে ভালোবাসা থাকেনা।”

কাব্য অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলো
“রায়হান”

লোকটি কাব্যকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সানগ্লাস ঠিক করে রওনা হলো। কাব্য পলকহীন তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে।

মুহূর্তেই তুমুল বর্ষণ শুরু হলো। ধ্যান ভাঙলো কাব্যের। লোকটি চোখের আড়াল হয়ে গেছে অনেক আগেই। মেহেরজান তার কাছে দাঁড়িয়ে বলল
“চলুন না বৃষ্টিতে ভিজি।”

কাব্য রাজি হলো মেহেরজানের কথায়। দুইজন ভিজতে লাগলো।

অন্যদিকে কালো গাড়ির কাঁচ ভেদ করে রায়হান সবটা দেখে তপ্তশ্বাস ফেলল। আর মনে মনে বলতে লাগল

“ভালোবাসা সবার কপালে থাকে না। ভালো থাকুক আমার না পাওয়া ভালোবাসা তার ভালোবাসার কাছে।”

#সমাপ্ত

সংঘাতের মেঘ পর্ব-০৩

0

#সংঘাতের_মেঘ
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ৩

রাফি রায়হানের এমন রূপ দেখে খানিকটা ভয় পেলেও ইশারায় মেহেরজানকে দেখিয়ে দিলো। রায়হান তাকিয়ে দেখলো মেহেরজান আর একটা ছেলে পাশাপাশি বসে আছে। রায়হান হনহনিয়ে সেদিকে গেল।

মেহেরজান হুট করেই রায়হানকে দেখে চমকে গেল। মেহেরজান একবার ওর বন্ধু নিরবের দিকে তাকিয়ে আবার ও রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল
“রায়হান ভাই আপনি এখানে কি করছেন!”

রায়হান অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো নিরবের দিকে। গম্ভীর কন্ঠে মেহেরজানকে বলল
“মেহেরজান এই মুহূর্তে বাড়ি যাও।”

মেহেরজান কিছু আরো বলতে নিবে তার আগেই রায়হান হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো
“এই ছেলে এখনো এখানে কি করছো! মেহেরজান শুধু রায়হান তালুকদারের। তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও।”

নীরব রায়হানের এমন হুঙ্কারে ভয় পেয়ে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে যায়।

নীরবকে যেতে দেখে মেহেরজান রায়হানকে কিছু বলতে নিবে তার আগেই রায়হান একটা থাপ্পড় বসিয়া দিলো মেহেরজানের গালে।

আর চেঁচিয়ে বলতে লাগলো
“আমার সঙ্গে ফাতরামি করতে আসবিনা একদম। ভালোবাসি বলে পাড় পেয়ে যাবি এটা ভাবিস না। ভুলে যাস না আমি কে!”

মেহেরজান অবাক হয়ে গেল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো বেশ কিছু মানুষ তাঁদের দেখছে। অপমানে মেহেরজানের চোখ ভরে এলো। মেহেরজান ছুটে চলে গেল। রায়হান চোখ বুজে পরপর কয়েকটা তপ্ত শ্বাস ফেললো। রাগ যেন এখনো কমেনি তার। মেহেরজান শুধু তার। সে কেন অন্য ছেলের সঙ্গে থাকবে।

————————

টানা চারটা ক্লাস নিয়ে বেশ ক্লান্ত কাব্য । আরো একটা ক্লাস করানোর পর আবার কোচিং করাতে হবে। কিন্তু তার শরীর আর চলছে না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ার এ বসে ফোন স্ক্রল করতে লাগলো সে। তখনি তার ডাক পড়লো। হেডস্যার ডেকেছে তাকে। ফোনটা পকেটে রেখে কাব্য রওনা হলো হেডস্যারের রুমের দিকে।

হেডস্যারের রুমের সামনে গিয়ে কাব্য ভিতরে যাওয়ার পারমিশন চাইলো। হেডস্যার মাথা উঠিয়ে কাব্যকে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে কাব্যকে ভিতরে এসে বসতে বলল। কাব্যও মুচকি হাসি দিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বলল
“স্যার কিছু জরুরি কথা কি!”

স্যার একটু গম্ভীর কণ্ঠেই বললেন
“জরুরি বটেই। আমার মেয়েটা এই নিয়ে দুবার ম্যাথে ফেল করেছে। এমন করলে কেমন করে হয় বলো তো। আমি একটা স্কুলের হেডস্যার আর আমার মেয়ে নাকি ফেল করে প্রতিবার।”

কাব্য হেডস্যারের কথায় সম্মতি দিয়ে বলল
“আসলেই বিষয়টি বেশ জরুরি। একটা টিচার রেখে দেন তাহলে।”

হেডস্যার হেসে বললেন
“তুমি থাকতে আমার ম্যাথ টিচার খোঁজা লাগে। আমার মেয়েটাকে কোনোমতে পাশটা করিয়ে দেও কাব্য।”

কাব্য খানিকটা ইতস্তত হয়ে বলল
“কিন্তু স্যার!”

“কোনো কিন্তু না কাব্য তুমিই পারবে আমি জানি।”

কাব্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
“আচ্ছা স্যার। তবে আমি যেভাবেই পড়া আদায় করি আপনি তা জানেন। এই নিয়ে কিন্তু আমি কিছু শুনবোনা স্যার।”

“আমি জানি তো। মারো ওকে আমার কোনো সমস্যা নেই।”

“আচ্ছা স্যার আমি কাল থেকে আপনার মেয়েকে পড়াতে যাবো ইনশাআল্লাহ।”

কাব্যর কথায় হাসি ফুটে উঠলো হেডস্যারের ঠোঁটে। কাব্য আরো কিছু কথা বলতে লাগলো।

——————-

মেহেরজান ছুটতে ছুটতে পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো। তার হৃদয় ভারী হয়ে আছে, মাথার ভেতর রায়হানের থাপ্পড় আর অপমানের দৃশ্যগুলো বারবার ফিরে আসছে। পার্কের লোকেরা তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, আর সেই লজ্জা তাকে আরও পুড়িয়ে দিচ্ছিল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল, কিন্তু সে দ্রুত বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।

বাড়িতে ঢুকতেই তার মা চমকে উঠলেন। মেহেরজানের চোখমুখের অবস্থা দেখে তিনি সবকিছু বুঝতে পারলেন। মেহেরজানের মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মেহেরজান আগে থেকেই জানত কী হতে যাচ্ছে। তার মা তাকে আগে থেকেই সাবধান করেছিলেন—রায়হানের সামনে কিছু বলা যাবে না, কারণ তাদের পরিবার রায়হানের পরিবারের কাছে ঋণী।

মেহেরজান কোনো কথা না বলে সোজা মায়ের ঘরে ঢুকে গেল। তার মা চিন্তিত মুখে বললেন
“মেহেরজান, কী হয়েছে? এইভাবে কেন আসলে?”

মেহেরজান ঠোঁট চেপে ধরে বলল
“আম্মু, তুমি জানো আমি এই বিয়ে করতে চাই না। আজ রায়হান আমাকে থাপ্পড় মেরেছে, সবার সামনে। সে আমাকে কোনো সম্মান দেয় না, আর আমি ওকে ভালোবাসি না।”

তার মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে ধীরে বললেন
“মা, আমি জানি রায়হান রাগী, কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। আমরা ঋণী, রায়হানের বাবা তোমার বাবাকে যখন সাহায্য করেছিলেন, তখন আমাদের হাতে বিকল্প ছিল না। এখন তারা আমাদের এই ঋণ শোধ করতে বলছে। তুমি যদি রায়হানকে বিয়ে না করো, আমরা সবাই বিপদে পড়ব।”

মেহেরজান হতাশায় বলল
“আম্মু, তোমরা ঋণ শোধ করতে পারো, কিন্তু আমি কেন নিজের জীবন বিসর্জন দেব? কেন আমাকে এই বোঝা নিতে হবে?”

তার মা চোখ মুছতে মুছতে বললেন
“তোমার বাবার কথাও ভাবতে হবে মা। আমরা সব হারিয়ে ফেলব। রায়হানকে চটিয়ে দেওয়া যাবে না।”

মেহেরজান বুঝতে পারল, এই মুহূর্তে তার মা-বাবা তার পাশে নেই। তারা কেবল ঋণ শোধের কথা ভাবছে, আর সে যেন নিজের ইচ্ছের কোনো মূল্যই পায় না।

মেহেরজানের নিজেকে অসহায় লাগছে। তার সাথেই কেন এমন হলো। জীবনটা তো এমন না হলেও পারতো। তার কপালে কি রায়হানের মতোই মানুষ আছে। মেহেরজানের কিছু ভালো লাগছে না। সে তো বেশি কিছু চায়নি একটা ভালো মানুষকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসাবে চেয়েছে। হয়তো তার কপালে নেই। কিন্তু তার বাবা মা কিভাবে পারলো তাকে এভাবে বলি দিতে। মনের মধ্যে একরাশ অভিমান এসে জমা হলো বাবা মার জন্য।

মেহেরজান একমনে ভাবতে থাকে, কিভাবে তার বাবা-মা তাকে এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সে যে কখনোই রায়হানের মতো একজন রাগী, অহংকারী মানুষকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসাবে ভাবতে পারেনি। অথচ, ঋণের বোঝা আর পারিবারিক সম্মান রক্ষার জন্য তাকে এই বলি দেওয়া হচ্ছে। মেহেরজানের মনের মধ্যে এক অসম্ভব তিক্ততা ছড়িয়ে পড়ে।

মেহেরজান গভীর শ্বাস নিয়ে নিজের কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। তার মাথায় অনেক চিন্তা ঘুরছিল, কিন্তু সে একটাই সিদ্ধান্তে আসলো—এই বিয়েতে তার সম্মতি নেই। কিছু একটা করে তাকে এই বিয়ে থেকে মুক্তি পেতেই হবে। নিরবকে মানানোর চেষ্টা করতে গিয়েছিলো সে। যেন নিরব রায়হানকে গিয়ে বলে যে সে আর নিরব একে অপরকে ভালোবাসে। কিন্তু কাজের কাজ হওয়ার আগেই তো সবটা ঘেটে দিলো রায়হান।

মেহেরজান কয়েকটা দার্ঘশ্বাস ফেলে এগোলো ওয়াশরুমের দিকে। একটা লম্বা শাওয়ার নিতে। মনটাকে শান্ত করা বেশ প্রয়োজন তার।

——————-

অন্যদিকে রায়হান বেশ কিছুসময় তব্দা মেরে বসে রইলো পার্কেই। পরমুহূর্তেই তার মনে পড়লো রাগের বশে সে কি করছে। মেহেরজানের গায়ে হাত তুলেছে সে। রায়হান নিজের মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। পার্কের নিস্তব্ধতা যেন তার ভেতরের অশান্তিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। মেহেরজানের গায়ে হাত তোলা—এটা তো সে কখনোই ভাবেনি করবে! কিন্তু রাগের বশে, পরিস্থিতির চাপে, তার ভেতরের অস্থিরতা এমন একটা কাজ করিয়ে ফেলেছে, যা সে চাইলেও আর ফিরিয়ে নিতে পারবে না।

রায়হানের মনে হলো, মেহেরজানকে সে যতই নিজের বলে দাবি করুক, ভালোবাসার নামে তাকে আটকে রাখুক, এই পথ সঠিক নয়। নিজের কাজের পরিণতি নিয়ে ভাবতে গিয়ে রায়হানের চোখের সামনে ভেসে উঠলো মেহেরজানের অপমানিত মুখ। সে কি মেহেরজানকে সত্যিই ভালোবাসে, নাকি নিজের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে তাকে পেতে চায়?

রায়হান যেন নিজের ভেতরের দ্বন্দ্বে পুড়তে লাগল। মেহেরজান যদি সত্যিই নিরবকে ভালোবাসে, তবে কি সে তার ভালোবাসাকে বাঁধা দিতে পারে? কিন্তু আবার, রায়হান মেহেরজানকে নিজের করে পেতে চায়। এই দোটানার মধ্যে পড়ে তার ভেতরের রাগ, হতাশা, এবং দুর্বলতা একসঙ্গে তাকে গ্রাস করতে থাকে।

রায়হান উঠে দাঁড়ালো। তার মন বলছে, এবার কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু কীভাবে, তা সে জানে না।

নিজের উপরি নিজের রাগ হলো রায়হানের। পরপর ঘুষি বসিয়ে দিতে লাগল পাশের গাছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। রাফি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তখনি সেখানে হাসান আসলো। রায়হানকে আটকিয়ে বলল
“কি করছিস রায়হান! রক্ত বের হচ্ছে তো। পাগল হয়ে গেছিস। কি হয়েছে বল আমায়!”

রায়হান লাল চোখ নিয়ে হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল
“আমি কি খুব খারাপ হাসান!”

হাসান ভ্রুযুগল কুচকে রায়হানের দিকে তাকালো। হাসান কিছু বলতে নিবে তার আগেই রায়হান উঠে দাঁড়ালো। হাসানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টালমাটাল পায়ে সেখান থেকে চলে গেল রায়হান।

হাসান রায়হানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক দৃষ্টিতে।

#চলবে

(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। রেসপন্স করবেন।)

সংঘাতের মেঘ পর্ব-০২

0

#সংঘাতের_মেঘ
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ২

মেহেরজান এর যাওয়া পরেই রায়হান রুম থেকে বের হয়। আরিয়ানা রায়হানের সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল
“রায়হান ভাই আপু কি রাজি হয়নি!”

রায়হান ঠোঁটের নিচের দাড়ি চুলকে হালকা হেসে বলল
“আরে শালিকা তোমার বোন রাজি হোক আর না হোক। আমিই তোমার দুলাভাই হবো।”

বলেই রায়হান হেসে সেখান থেকে চলে গেল। আরিয়ানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসার রুমের দিকে অগ্ৰসর হলো।

বসার রুমে সবাই উৎসুক হয়ে বসে ছিলো। মেহেরজান চুপ করে বসে আছে। কিছুই বলছেনা সে। রায়হান আসতেই মেহেরজানের বাবা বলল
“কি হয়েছে বাবা তোমরা রাজি!”

রায়হান সোফায় বসতে বসতে বলল
“রাজি না হওয়ার কোনো করণ তো নেই আংকেল।”

রায়হানের কথার পর সবাই যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মেহেরজানের মা একটু মুচকি হেসে বললেন
“তাহলে তো এবার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় এসে গেল।”

মেহেরজান তখনও নীরব ছিল, তার চোখেমুখে এক অদ্ভুত ভাব। যেন সে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু কোনো এক কারণে আটকে যাচ্ছে। আরিয়ানা মেহেরজানের পাশে গিয়ে তার হাত ধরে চাপ দিল।

মেহেরজান অসহায় দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকাল। আরিয়ানার আর বুঝতে বাকি রাখল না, কী গভীর দ্বিধায় রয়েছে তার বোন। মেহেরজান বাবার ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না, আর রায়হানের স্বভাব সে ভালো করেই জানে।

আরিয়ানা মেহেরজানের হাত ধরে আস্তে করে ফিসফিস করে বলল
“তুই যদি রাজি না থাকিস, তাহলে এখনই বলে দে। আমি আছি তোর পাশে।”

মেহেরজান চোখে পানি চলে এলো, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নিচু করে রইল। এদিকে, রায়হান আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বসে আছেন, যেন সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণে। মেহেরজানের মা-বাবাও কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে ছিলেন মেয়ের দিকে, যেন তারা কিছু অনুমান করছেন।

একটু পর মেহেরজানের বাবা চাপা স্বরে বললেন,
“মেহের, তুমি কি কিছু বলতে চাও?”

মেহেরজান একটু ইতস্তত করে, কিন্তু কোনো কথা বলতে পারল না। মুহূর্তটি যেন ভারী হয়ে উঠল।

মেহেরজানের মা মুচকি হেসে বললেন
“মেয়ে মানুষ তো লজ্জা পাচ্ছে হয় তো।”

সবাই বিষয়টা বুজতে পারলো। রায়হান একদৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে মেহেরজানের দিকে।

মেহেরজানের বাবা একটু গম্ভীর হয়ে বললেন
“মেহের, যদি তুই কিছু বলতে চাস, এখনই বল। তোর কোনো আপত্তি নেই তো?”

মেহেরজান এবার চোখ তুলে তাকাল, কিন্তু কথাগুলো তার ঠোঁটে আটকে গেল। এক মুহূর্তের জন্য সে নিজেকে নিঃস্ব মনে করল। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারল না, কিন্তু তার অন্তরবিদীর্ণ কষ্ট আর অস্বস্তি তার বোনের কাছ থেকে লুকানো রইল না।

আরিয়ানা এবার আর চুপ থাকতে পারল না। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল
“আপু ঠিক আরামদায়ক বোধ করছে না, বাবা। আমি মনে করি, ওকে একটু সময় দেওয়া উচিত।”

সবাই তখন চুপ হয়ে গেল।

তখনি মেহেরজানের দাদি রাবেয়া বেগম বললেন
“তোমরা বুঝোনা নিরবতা সম্মতির লক্ষণ। বিয়ের কথা আগাও তো বাপু।”

মেহেরজান একটা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো। সে বুজতে পেরেছে এখন এখানে কিছু বলে লাভ নাই। মেহেরজান মনে মনে বলতে লাগল
“অন্য কোনো প্লান করতে হবে তাকে। বাবাকে বললেও লাভ নাই। বন্ধুর ছেলে বলে কথা। জীবনেও না করবেনা। আর এক হয়েছে দাদি রায়হান ভাই বলতে অস্থির। পিরিত দেখে বাঁচিনা। এই লুচু বেডারে তো আমি জীবনেও বিয়ে করবো না। নো নেভার।”

বলেই মুখ বাঁকালো মেহেরজান। যা রায়হানের চোখ এড়ালোনা। রায়হান বাঁকা হাসলো। তার সেই হাসিতে মেহেরজানের অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল। সে জানে, এই বিয়েটা তাকে নিয়ে কেউ গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে না। তার মতামতকে একেবারে উপেক্ষা করা হচ্ছে।

রায়হান যখন সেই আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বসে, সবাই বিয়ের প্রস্তুতির কথা বলতে শুরু করল। মেহেরজানের মা বললেন
“আগামী মাসেই দিন দেখে কাজ শুরু করো। মেহেরের তো সব ঠিকঠাকই আছে। বড় কোনো আয়োজন করতেও হবে না।”

মেহেরজানের বাবা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন, রায়হানের বাবা সম্মতি দিয়ে বললেন
“হুম আবার কিছুদিন পর রায়হানের নির্বাচনের কাজ শুরু হবে। তাই ভাবছি নির্বাচনের আগেই বিয়েটা দিয়ে দেই ওদের।”

সবাই কথা বলতে ব্যস্ত আর রায়হান তখনও তার দম্ভিত হাসি মুখে ধরে রেখেছে। কিন্তু মেহেরজানের মন ততক্ষণে ভিন্ন কোনো পথে চলে গেছে। তার ভাবনায় ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরছে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ।

————————

বেডের মাঝে গালে হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় মত্ত মেহেরজান। হুট করে একটা আইডিয়া মাথা আসতেই চোখমুখ চিকচিক করে উঠলো তার। খুশিতে সে গান গেয়ে উঠলো
“চাঁন্দের বাতির কসম দিয়ে ভালোবাসিলি।
এখন আমারে চাঁন্দেও চিনে না আমারে সূর্যও চিনেনা।”

অন্যদিকে মেহেরজানের এমন গান দেখে হুট করেই হেসে দিলো রায়হান। ভালো যে মেহেরজানদের বাসায় গিয়ে ওর রুমে ছোট সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে এসেছিল বুদ্ধি করে। তা না হলে মেহেরজানের এমন সুরেলা কন্ঠের অদ্ভুত গান শুনতেই পেত না। হুট করেই রায়হানের মুখের হাসি চলে গেল। আচ্ছা মেহেরজান এত খুশি কেন? রায়হান আবার ও মনোযোগ দিয়ে তাকালো ল্যাপটপের দিকে।

মেহেরজান কাকে যেন কল করছে। মেহেরজান নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক রেখে বলে উঠলো
“হ্যালো, তুই ঠিক জায়গায় আছিস তো? সব রেডি তো?”

মেহেরজানের কন্ঠে আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট ছিল। ওপাশ থেকে কেউ যেন তাকে নিশ্চিন্ত করল। মেহেরজানের মুখে এক ধরনের সপ্রতিভ হাসি ফুটে উঠল।

“ঠিক আছে, আমি কাল সকালেই সব কিছু ঠিক করে আসবো।”

বলে ফোনটা রেখে সে একরকম নিশ্চিন্তভাবে বেডে শুয়ে পড়ল।

রায়হান এবার আরও চিন্তিত হয়ে পড়ল। তার মন ভরে গেল অস্বস্তিতে। মেহেরজান কিছু একটা পরিকল্পনা করছে, আর সেটা নিশ্চয়ই তার বিয়ে নিয়ে।

নিজের দম্ভকে একপাশে সরিয়ে, রায়হান এবার সত্যিকারের চিন্তায় পড়ল।
“এই মেয়েটা কী করছে?”

———————

সকাল সকাল মেহেরজান উঠে রেডি হয়ে নিলো কলেজ যাওয়ার জন্য। একদম রেডি হয়ে খাবার টেবিলে যেতেই ওর মা নীলা বেগম বললেন
“কিরে আজ যে কলেজ যাবি কিছু বলিসনি তো।”

মেহেরজান খাবার প্লেট নিতে নিতে বলল
“আম্মু আজ একটা ক্লাস আছে। ওটা মিস করা যাবেনা।”

নীলা বেগম ধীর গলায় বললেন
“ওও”

আরিয়ানার একটু সন্দেহ হলো। কালই রাতেই তো মেহেরজান মুখ ঝুলিয়ে রেখেছিলো। আর সকালেই তার মন খুশি খুশি হয়ে গেল। ডাল মে কুছ কালা হে। নিজের মনেই এসব ভাবলো আরিয়ানা। সবার সামনে আর কিছু বলল। চুপচাপ খেলো শুধু।

মেহেরজান খাওয়া শেষে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলো কলেজের উদ্দেশ্যে।

অন্যদিকে রায়হানের ঠিকমতো ঘুম হয়নি মেহেরজানের হুট করে এমন আচরণ পরিবর্তনের কারণ ভেবে। কেবলি তার চোখটা লেগে এসেছিলো তখনি বিকট আওয়াজে তার ফোনটা বেজে উঠলো। রায়হান একরাশ বিরক্তি নিয়ে কলটা রিসিভ করে কানে ধরলো। কল রিসিভ হতেই অপর পাশ থেকে রায়হানের বডিগার্ড রাফি হড়হড়িয়ে বলতে লাগল
“ভাই ভাবি অন্য একটা ছেলের লগে পার্কে ঘুরতে আইছে।”

কথাটা কানে যেতেই লাফিয়ে সোয়া থেকে উঠে বসলো রায়হান। চিল্লিয়ে বলে উঠলো
“কি বলছিস তুই! তুই থাক ওখানে আমি আসছি।”

রাফিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো রায়হান। তাড়াতাড়ি করে কোনমতে ফ্রেশ হয়ে, গাড়ির চাবিটা নিয়ে,পড়নের টিশার্ট ঝাড়া দিয়ে ছুটলো সে। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। চোখ বেয়ে যেন রক্ত ঝড়ছে তার। ফর্সা মুখের রক্তাক্ত আভা যেন ক্রোমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে।

রায়হানকে এমন অবস্থায় ওর মা দেখে রায়হানকে ডাকতে নিবে কিন্তু তার আগেই রায়হান সেখান থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেল।

রায়হানের মা আমেনা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজ মনেই বললেন
“ছেলেটার অতিরিক্ত রাগটা বরাবরই আমাকে চিন্তায় ফেলছে। কি যে হবে ছেলেটার। আল্লাহ তুমি আমার ছেলেটাকে রাগ কন্টোল করার ক্ষমতা দেও।”

রায়হান দ্রুত ড্রাইভ করে পার্কে পৌঁছালো। রায়হানকে আসতে দেখে রাফি এগিয়ে গেল ওর কাছে।

#চলবে

(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

সংঘাতের মেঘ পর্ব-০১

0

#সংঘাতের_মেঘ
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ১

“আমি আপনাকে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবো না রায়হান ভাই। আপনার অনেকগুলো বান্ধবী।”

মেহেরজানের কথা শুনে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ রায়হান তালুকদারের কপাল কুঁচকে গেল। সে বিরক্তি নিয়ে বলল
“মেহের কি বলতে চাচ্ছিস তুই!”

মেহেরজান রায়হানের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে
“আপনি কি কানে কম শোনেন রায়হান ভাই। আমি তো বললাম যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। তাছাড়া আমার উনি আছে।”

রায়হান তালুকদার হতভম্ব হয়ে মেহেরজানের দিকে তাকিয়ে রইল। মুহূর্তের জন্য তার মুখে কথা ফোটেনি। খানিক পরে, সংযত হয়ে বলল
“উনি? উনি কে মেহের? এতদিন তো শুনিনি তোর কারো কথা!”

মেহেরজান একটু মুচকি হাসল আর বলল
“শুনবেনই বা কেন? সবকিছু কি আপনাকে বলতে হবে?”

রায়হানের ভ্রু কুঁচকে গেল আরও। সে কিছুক্ষণ মেহেরজানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বলল
“মেহের, তুই ভুলে যাস না আমি কে এই রায়হান তালুকদার যা চায় তাই পায়। আর যা পায় না তা কেড়ে নেয়। সো রেডি থাকো বেবি মিসেস তালুকদার হওয়ার জন্য।”

মেহেরজান আবার চোটে উঠে বলল
“আপনি কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি করছেন রায়হান ভাই। বেশি করলে কিন্তু আমি বিয়ের দিন পালাবো। এই মেহেরজান ও কিন্তু কম যায় না।”

বলেই মুখ বাঁকালো মেহেরজান।

রায়হান তালুকদার মেহেরজানের চ্যালেঞ্জ শুনে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর তার ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। মৃদু হেসে বলল
“পালাবি? তুই পালিয়ে কোথায় যাবি মেহের? তুই জানিস না রায়হান তালুকদারের হাত কতদূর পৌঁছায়। আমি তোকে ধরে আনতে পারবো না, এমন জায়গা এই দেশে নেই।”

মেহেরজান এবার সত্যিই বিরক্ত হলো। চোখে স্পষ্ট চ্যালেঞ্জের দৃষ্টি নিয়ে বলল
“আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করবেন না রায়হান ভাই। আমি আপনার মতো মানুষকে চিনি। কিন্তু মনে রাখবেন, আমি কোনো খেলনা নই। বিয়ে আমার ইচ্ছেতে হবে, আর যদি আপনি জোর করেন, তবে সে বিয়ে আপনার কল্পনাতেই থেকে যাবে।”

রায়হানের মুখে এবার একটু গম্ভীর ভাব এল। তার মনের ভেতরে হতাশা আর রাগ মিশ্রিত কিছু অনুভূতি জাগতে লাগল। কিন্তু সে নিজেকে সংযত করে, মৃদু হাসি ধরে রেখে বলল
“তুই যা বলছিস, তাতে তোর সাহসের অভাব নেই, সেটা মানতেই হবে। তবে তুই আমাকে চ্যালেঞ্জ করলে কী হতে পারে, সেটা ভেবে দেখিস।”

মেহেরজান এক পা এগিয়ে এসে চোখের দৃষ্টিকে সরাসরি রায়হানের চোখে রেখে বলল
“আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নেবো, রায়হান ভাই। আর যদি আপনি জোরাজুরি করতে থাকেন, তবে আপনাকে বুঝতে হবে যে এই মেহেরজান আপনার চেয়ে বেশি শক্তিশালী।”

রায়হান কণ্ঠস্বরে এক ঝলক রাগ ফুটিয়ে বলল,
“দেখা যাক, কে কাকে হারায়!”

মেহেরজান রায়হানের কথা শুনে গভীর শ্বাস নিয়ে শান্তস্বরে বলল
“রায়হান ভাই, আমি হার-জিতের খেলায় নেই। আপনি যদি আমাকে ভালোবাসতেন, তাহলে আমার ইচ্ছাকে সম্মান করতেন। কিন্তু আপনি শুধু জেতার জন্য খেলছেন।”

রায়হান তিক্ত হেসে উত্তর দিল
“তুই বুঝিস না, মেহের। এটাই তো আসল জীবন—হার-জিতের খেলা। আর আমি এই খেলায় সবসময় জয়ী হই।”

মেহেরজান নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
“আপনার সেই খেলা আপনার জন্য সুখকর হতে পারে, কিন্তু আমার জীবনের নিয়ন্ত্রণ আপনি পাবেন না। আমি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবো। আপনি যা-ই ভাবেন না কেন, আমি পালিয়ে যাবো, প্রয়োজনে এমন জায়গায় যাবো যেখানে আপনার ক্ষমতা পৌঁছাবে না।”

রায়হানের চোখে ক্ষণিকের জন্য অনিশ্চয়তা দেখা দিল, কিন্তু সে তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন গলায় বলল
“তুই পালাতে চাইলেও, আমি তোকে খুঁজে বের করবো। রায়হান তালুকদার কোনো খেলায় হার মানে না।”

মেহেরজান এক পা পিছিয়ে গেল, গভীরভাবে তাকিয়ে বলল
“তাহলে দেখা যাক, কার ইচ্ছাশক্তি শক্তিশালী।”

এই বলে মেহেরজান রায়হানের চোখের দৃষ্টির সামনে থেকে চলে গেল, আর রায়হান তালুকদার সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল মেহেরজানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।

—————

মেহেরজানকে রুম থেকে বের হতে দেখে ওর ছোট বোন আরিয়ানা ভ্রু নাঁচিয়ে বলল
“কিরে আপুই রায়হান ভাই কি বলল!”

মেহেরজান নাক ফুলিয়ে বলল
“তুই তোর রায়হান ভাইয়ের কাছে থেকেই শোন গিয়ে।”

বলেই আরিয়ানার পাশ কাটিয়ে চলে গেল মেহেরজান। আরিয়ানা হতভম্ব হয়ে রইলো। কি হলো এটা।

মেহেরজান রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আরিয়ানা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর সে এক পা দুই পা করে মেহেরজানের পিছু নিল।

“আপু, কিছু তো বল!” আরিয়ানা ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল।

মেহেরজান কোনো উত্তর দিল না। নিজের ভাবনায় ডুবে রইল। রায়হানের সাথে কথা বলার সময় তার যে শক্ত অবস্থান ছিল, তা একবারে গলে গেছে মনে হচ্ছে। তবে মুখে দৃঢ়তার আভাস নিয়ে সে বলল
“আরিয়ানা, সব কিছু নিয়ে এত জিজ্ঞেস করিস না। তুই যা বুঝতে চাইছিস, তার থেকেও অনেক বেশি জটিল ব্যাপার এটা।”

আরিয়ানা মুচকি হেসে বলল
“আপু, আমি কিন্তু তোর সব বুঝি। তোর আর রায়হান ভাইয়ের মধ্যে যা কিছুই হোক না কেন, তুই ঠিকঠাক সামলে নিতে পারবি। তুই তো মেহেরজান!”

মেহেরজান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
“হ্যাঁ, মেহেরজান তো আমি… কিন্তু সবাইকে সন্তুষ্ট রাখা কি এত সহজ?”

বলেই সে আরিয়ানার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে হেঁটে চলে গেল।

#চলবে কি?

জীবনের ডাকবাক্স পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0

#জীবনের_ডাকবাক্স
[ শেষ পর্ব]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

নিঝুম খাবার নিয়ে রিহানের রুমে যায়। নিঝুম রুমে গিয়ে দেখে রিহান ঘুমিয়ে আছে। নিঝুম রিহানকে ডেকে তুলে। রিহানকে নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দিতে থাকে। খাবার খাওয়ানোর সময় নিঝুমের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। আর সেটা চোখ এড়ায়নি রিহানের।

— নিঝুম তুমি কান্না করছ কেন?

— আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও রিহান। আমার জন্য আজ তোমার এই অবস্থা হইছে। প্লিজ ক্ষমা করে দাও।

— আরে কান্না করোনা। আমি ঠিক আছি। গাড়িটা তোমার। তুমি কাকে তুলবে কাকে তুলবেনা তোমার ব্যাপার।

–এভাবে বলোনা, তখন তুমি যদি।

এই কথা বলে থেমে যায় নিঝুম।

— যদি কি?

— কিছুনা খাবার খাও।

তারপর রিহান আর কোনো কথা বলল না। নিঝুম রিহানকে খাবার খাইয়ে দিয়ে ঔষধ খাইয়ে তারপর সে তার রুমে চলে গেলো। এভাবেই কেটে গেলো বেশ কিছুদিন। দুজনের মধ্যে আবার সব আগের মতো হয়ে গিয়েছে। একদিন রাতে হঠাৎ করে বাসার ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়। এটা দেখে রিহান বেশ অবাক হলো। এভাবে হুটহাট করে তো কারেন্ট যায়না। তাহলে কি কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে? এটা ভেবে রিহান নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে ড্রইংরুমের দিকে চলে যায়। ড্রইংরুমে প্রবেশ করতেই আচমকা আবার বিদ্যুৎ চলে আসে। আচমকা সব আলো এক সাথে জ্বলে উঠে। তখনই আসিফের কানে একটা শব্দ ভেসে আসে।

— হ্যাপি বার্থডে টু ইউ রিহান।

সবাই এক সাথে আসিফকে উইশ করে। আসিফ অনেক বেশি খুশি হয়। এভাবে আসিফের সুন্দর মুহুর্ত গুলো তার ফ্ল্যাশব্যাকে সামনে চলে আসে।
আর কেউ একজন আসিফের কানের কাছে এসে বলছে, আমাদের মুক্তি দাও রিহান। আমরা আর পারছিনা এভাবে থাকতে। প্লিজ আমাদের মুক্ত করো। তখনই আসিফের ঘুম ভেঙে যায়। আসিফ চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে সে তো নিজের রুমে আছে। তাহলে কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখেছে সে? কিন্তু এগুলো স্বপ্ন হলেও বাস্তব মনে হচ্ছিলো তার। তার বার বার মনে পড়ছিল কেউ তার কানের কাছে এসে বলছি তাদের মুক্ত করতে। আসিফ শোয়া থেকে উঠে বসে ভাবতে থাকে। ইতিমধ্যে নিলয়ের ঘুম ভেঙে যায়। সে আসিফকে বসে থাকতে দেখে বলল,

— কিরে এতো রাতে না ঘুমিয়ে তুই বসে আছিস কেন?

আসিফ নিলয়কে সব ঘটনা খুলে বলল।

— আরে ঘুমিয়ে পড় এগুলো হয়তো স্বপ্ন ছিলো।

— স্বপ্ন নয় নিলয়, এগুলো বাস্তব। আমার অনেক কাজ বাকি।

আসিফের কথা শুনে নিলয় তো হতবাক হয়ে গেলো। সে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আসিফের দিকে।

— কীসের অনেক কাজ?

— নিঝুম আর তার মা। এখনও বন্ধি রয়েছে সেই বাড়িতে। আমাদের আর দেরি করলে হবে না। ওরা অনেক কষ্ট পাচ্ছে।

— মানে? তুইও কি পাগল হয়ে গেলি? ওরা কষ্ট পাচ্ছে মানে কি?

— ওদের লাশ এখনও দাফন করা হয়নি। ওদের লাশ দাফন করতে হবে।

— তোর কোনো কথাই বুঝতে পারছেনা আমি।

— তোকে বুঝতে হবে না। তুই আমাকে একটু সাহায্য করলেই হবে। তুই এখন আমার সাথে ঐ বাড়িতে চল।

— কিহ! এতো রাতে ঐ বাড়িতে যাওয়া কি ঠিক হবে? আর তুই যে বলছিস লাশের কথা। ত্রিশ বছর আগের লাশ তুই এখন কোথায় পাবি?

— আমি জানি লাশ কোথায় আছে। চল আমাদের এখনই বের হতে হবে।

আসিফের কথা বলার ধরনে কেমন একটা অদ্ভুত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। এই আসিফকে আগের আসিফ মনে হচ্ছেনা। কিন্তু নিলয় আসিফকে একা ছাড়বেনা। কারণ আসিফ তার এক মাত্র বন্ধু। দু’জনে দুইটা লাইট নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় একটা কাকপক্ষীও নেই। শুনশান পরিবেশ। তারা দু’জন হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু কারোর মুখে কোনো শব্দ নেই। নিলয়ের মাঝে অদ্ভুত এক ভয় কাজ করছে। কিন্তু আসিফের মুখে ভয়ের কোনো চাপ দেখা যাচ্ছেনা। আসিফ আগে আগে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জন সেই বাসার সামনে চলে গেলো। আসিফ একবার নিলয়ের দিকে তাকাল। আসিফ লক্ষ্য করল নিলয় খুব ভয়ে আছে। আসিফ নিলয়ের কাধে হাত রেখে বলল,

— আমি আছি তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার উপরে বিশ্বাস রাখ।

এবার দু’জন সাহস করে ভিতরে চলে গেলো। বাড়ির ভিতরের পরিবেশ খুব ভয়ংকর। তারউপর মাঝ রাত। আসিফ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। তারপর সে একটা তালাবদ্ধ রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। যে রুমে এর আগে তারা একবার ও যায়নি। এই রুম আগে থেকেই তালাবদ্ধ। কারণ এই রুমে থাকতেন রিহান। তাই এই রুমে কেউ আসেনি। পুলিশ ও এই রুম তল্লাশি করেনি। কেন করেনি কারণ এই রুমে রিহানের সব স্মৃতি রয়েছে।

— নিলয় এই রুমের ভিতরে আছে সব কিছু। এই তালাটা তোকে ভেঙে দিতে হবে।

— আমি কেন?

— তোকে যেটা বলেছি তুই সেটা কর।

নিলয় এবার তালা ভেঙে দেয়। দু’জন ভিতরে প্রবেশ করে। নিলয় হা হয়ে তাকিয়ে আছে আসিফের দিকে। আসিফকে যেনো আজ সে চিন্তেই পারছেনা। ওর মাঝে কোনো ভয় কাজ করছেনা। আসিফ তার রুমে থাকা ফ্রিজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

— আসিফ আমার খুব ভয় করছে। আমার মনে হয় এখান থেকে আমাদের চলে যাওয়া উচিৎ।

— আমার আর একটু কাজ বাকি।

এই কথা বলে আসিফ জোরে টান মেরে ফ্রীজ খুলে ফেলে। তখনই একটা পঁচা গন্ধ আসে নিলয়ের নাকে। নিলয় সাথে সাথে নাক বন্ধ করে ফেলে। কিন্তু এই তীব্র গন্ধ আসিফের নাকে লাগছেনা। নিলয় আর আসিফ খেয়াল করে ফ্রীজের মধ্যে কিছু হাড়গোড়। এগুলো হাত দিয়ে আসিফ একটা বেগের ভিতরে ভরতে শুরু করে। এতো দিনে মা মেয়ের শরীরের সব গোস্তো নষ্ট হয়ে হাড় গুলো রয়ে গিয়েছে। এগুলো দেখে নিলয়ের দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। নিলয় বমি করতে শুরু করে। সব বেগের ভিতরে নিয়ে আসিফ নিলয়ের সামনে এসে বলল।

— আমার সাথে চল।

— এই গুলো নিয়ে কোথায় যাবি তুই?

— গোরস্থানে।

— কিহ! আমি যেতে পারবোনা।

— ঠিক আছে তুই থাক আমি একাই যাচ্ছি।

আসিফ এই কথা বলে চলে যেতে থাকে। নিলয় কোনো উপায় না পেয়ে সেও আসিফের পিছু করতে থাকে। যদিও নিলয় প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে। নিলয় একটা জিনিস বুঝতে পারছেনা ভীতু ছেলেটার এতো সাহাস হঠাৎ করে কীভাবে হয়ে গেলো? নিলয় যে আসিফকে কোনো প্রশ্ন করবে সেই সাহস ও পাচ্ছেনা নিলয়। এবার আসিফ একটা গর্ত করে। আর সেখানেই দাফন করে দেয় মা মেয়ের লাশ। তখনই খুব জোরে একটা বাতাস শুরু হয়ে যায়। নিলয়ের ভয়ে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো স্তব্ধ হয়ে যায় এই যায়গা টা। আসিফ তাকিয়ে আছে কবরের দিকে। নিলয় আসিফের কাধে হাত রাখে। তখনই আসিফ পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে নিলয় দাঁড়িয়ে আছে।

— নিলয় আমরা এখানে কীভাবে এলাম? আর গোরস্থানে কি করছি আমরা?

আসিফের এই কথা শুনে নিলয় যেনো আকাশ থেকে পড়লো। তাহলে কি এতক্ষণ আসিফের শরীরে অন্য কেউ ছিলো?

নিলয় আসিফকে বলল — তোকে আমি বাসায় গিয়ে সব বলব আগে এখান থেকে বের হতে হবে।

এবার দু’জন তাড়াতাড়ি করে নিজের বাসায় চলে যায়। বাসায় গিয়ে হাঁপাতে থাকে দু’জন। কিছুক্ষণ পরে আসিফ বলল,

— আমরা ওখানে গেলাম কেন? আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম।

— তুই এখন থেকে মুক্ত।

— মানে?

নিলয় এবার প্রথম থেকে সব বলতে শুরু করল। সব কথা শুনে আসিফ যেনো হতবাক হয়ে যায়। নিলয় বুঝতে পারে আসিফের শরীরে তখন রিহান ছিলো। তারপর থেকে আসিফের সব কিছুই পরিবর্তন হয়ে যায়। এরপর থেকে তারা তাদের নতুন জীবন শুরু করে।

সমাপ্ত।

জীবনের ডাকবাক্স পর্ব-১০

0

#জীবনের_ডাকবাক্স
[ দশম পর্ব]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

সাদা শাড়ী পড়া কাওকে দেখতে পেয়ে আসিফ ভয় পেয়ে পিছনে সরে আসতেই সে ফ্লোরের মধ্যে বসে পড়ে। ভয়ে আসিফের শরীর দিয়ে ঘাম বের হতে শুরু করে। আসিফ দেখতে পায় সাদা শাড়ী পড়া লোকটা নিঝুম। নিঝুমের মুখে সেই পরিচিত হাসিটা লেগেই আছে। এবার নিঝুম আসিফের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। পিছনে যেতে যেতে একটা সময় আসিফের পিট দেওয়ালে ঠেকে যায়। নিঝুম আসিফের খুব কাছে চলে যায়।

— তুমি এতো ভয় কেন পাচ্ছ রিহান? আমি তো তোমার নিঝুম। আমাকে দেখো। আমি তোমার ভালোবাসা।

— আপনি আমাকে বার বার রিহান কেন বলছেন আমি আসিফ। আমি রিহান নই।

নিঝুম এবার আসিফের কাছে গিয়ে আসিফের কপালে হাত রাখতেই আসিফ তার কিছু ফ্ল্যাশব্যাক দেখতে পায়। ফ্ল্যাশব্যাক গুলো ছিল নিঝুমের সাথে কাটানোর মুহুর্ত গুলো। সে দেখতে পায় নিঝুমের সাথে ঘুরাঘুরির মুহুর্ত গুলো। কতো সুন্দর ভাবেই কেটেছে সময়।

ফ্ল্যাশব্যাক
_______________

রিহানের আজ কলেজের প্রথম দিন তাই সে রেডি হচ্ছে। তখন নিঝুম ও রেডি হচ্ছে। কারণ নিঝুম ও আজ কলেজে যাবে। দু’জন একি কলেজে আর সেম ইয়ারে পড়ছে। রিহান রেডি হয়ে নিঝুমের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। তখনই রিহানের কাছে আসে রহিম মেয়া।

— রিহান তোমরা কি এখনও রেডি হওনি? কলেজে তো যেতে হবে। আজ প্রথম দিন তাই একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার তোমাদের।

— আরে চাচা আমি তো রেডি হয়ে বসে আছি। কিন্তু নিঝুম ওর কোনো খোঁজ নেই।

তখনই তাদের কথার মাঝে চলে আসেন জাহানারা বেগম।

— কি নিয়ে কথা হচ্ছে তোমাদের মধ্যে?

রিহান বলল — কাকে নিয়ে আবার? আপনার মেয়েকে আমি কখন বলছি রেডি হতে সে এখনও রেডি হয়ে আসেনি। মনে হচ্ছে সে আজ কলেজে পাত্র দেখতে যাবে।

রিহানের কথা শুনে সবাই হেসে উঠে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিঝুম সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করে। নিঝুমকে দেখে রিহান হা করে তাকিয়ে থাকে। নিঝুম এমনিতেই সুন্দরী। আজ আরো বেশি সুন্দর লাগছে। নিঝুম কখন যে রিহানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রিহান খেয়ালি করেনি।

— এই-যে মিস্টার চলুন।

রিহানের কানে নিঝুমের বলা শব্দ টা পৌছায়নি। নিঝুম এবার একটু জোরেই বলল।

— যাবে নাকি আমি একাই চলে যাবো?

— ওহ হ্যাঁ চলো।

এবার দু’জনেই বেরিয়ে পড়ে কলেজে যাওয়ার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জন কলেজে পৌছে যায়। তারপর ক্লাসে। তাদের সাথে কয়েকজনের পরিচয় হয়। হঠাৎ একটা মেয়ে আসে রিহানের কাছে।

— হাই আমি নীলা।

— আমি রিহান।

— আমরা কি ফ্রেন্ট হতে পারি?

— হুম অবশ্যই।

দু’জনকে কথা বলতে দেখে নিঝুম নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছেনা। নিঝুম নিজের যায়গা থেকে উঠে বিহানে কাছে এসে বলল,

— রিহাম উঠো কথা আছে তোমার সাথে।

— ওকে।

দু’জন উঠে বাহিরে চলে যায়।

— কি হইছে তোমার? হঠাৎ ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে আসলে কেন? কিছুক্ষণের মধ্যেই তো ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।

— ওহ ক্লাস মিস হবে নাকি ঐ মেয়েটার সাথে কথা বলতে পারছো না বলে সমস্যা হচ্ছে?

— কি বলছ এসব? তোমার কি শরীর টরীর খারাপ করছে নাকি?

— না।

— তাহলে এগুলো কি বলছ?

— কিছুনা আমি ক্লাসে যাই।

এই কথা বলে নিঝুম চলে গেলো। রিহান অবাক হয় তাকিয়ে আছে। এখানে নিঝুম তাকে ডেকে এনে কিছু না বলেই চলে গেলো? এই মেয়ের কোনো কিছুর ঠিকঠাক লাগছেনা। রিহান ও এবার ক্লাসে চলে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাস শুরু হয়ে গেলো। প্রথম দিনে তেমন একটা ক্লাস হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে আসে। দু’জন গাড়ির সামনে আসে। রিহান লক্ষ্য করে নিঝুম কোনো একটা কারণে সে এখনও রেগে আছে। কিন্তু রাগের কারণ এখনও অজানা রিহানের। এবার দু’জন গাড়ির সামনে যায়। নিঝুম গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে। এটা দেখে রিহান অবাক হলো। তারপর রিহান যখনই গাড়িতে উঠতে যাবে তখনই নিঝুম বলল,

— গাড়িতে উঠবেনা একদম। আজকে তুমি পায়ে হেঁটে বাসায় যাবে।

— কি বলো? আমি বুঝলাম না তুমি কেন এমন করছ আমার সাথে?

— তুমি কখনও বুঝবেনা।

এই কথা বলে নিঝুম গাড়ি নিয়ে চলে যায়। রিহান কিছুই বুঝলোনা। রিহান এবার নিজের পকেটে হাত দিয়ে দেখে মানিব্যাগ টাও নেই। মানিব্যাগ ও হয়তোনিঝুমি নিয়ে গিয়েছে। এই মেয়ের মাথায় কখন কি চলে বলা মুসকিল। হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর তো কোনো উপায় ও নেই। অন্য একটা গাড়িতে যে উঠবে সেই টাকাও সাথে নেই। কি আর করার পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এইদিকে আকাশের অবস্থা ভালো না। মনে হচ্ছে ঝুম বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টিতে আবার রিহানের শরীর খারাপ হয়ে যায়। তাই তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়। রিহান ভিজতে ভিজতে চলে যায় বাসার দিকে। অনেক সময় পরে সে বাসার সামনে গিয়ে দরজায় নক কর‍তেই জাহানারা বেগম এসে দরজা খুলে দেয়।

— রিহান তুমি বৃষ্টিতে ভিজলে কেন?

— কি আর করব? আপনার মেয়ে আমাকে রেখেই চলে আসছে।

— তোমাদের কি ঝামেলা হইছে নাকি?

— আমিও জানিনা। সকাল থেকেই দেখছি মেডাম রেগে আছে।

— আচ্ছা আমি দেখছি তুমি গিয়ে তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে নাও।

রিহান চলে গেলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। তারপর সবার সাথে দুপুরের খাবার খেতে বসে। নিঝুম ও এসেছে। কিন্তু সে চুপচাপ খাবার খাচ্ছে কারোর সাথে কোনো কথা বলছেনা। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রিহান নিজের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। কিন্তু রিহান এখনও রুম থেকে বের হয়নি। তাই রহিম মেয়া রিহানের রুমে যায় রিহানকে দেখার জন্য। উনি রিহানের রুমে গিয়ে দেখে রিহান এখনও ঘুমিয়ে আছে। রহিম মেয়া রিহানের শরীর স্পর্শ করতেই দেখে রিহানের পুরো শরীর আগুনের মতো হয়ে আছে। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে রিহানের শরীর। রহিম মেয়া তাড়াতাড়ি করে সবাইকে ডেকে নিয়ে আসে। সাথে নিঝুম ও আসে। জাহানারা বেগম তাড়াতাড়ি করে ডাক্তার নিয়ে আসতে বলে। রহিন মেয়া চলে যায় ডাক্তার আনতে।

জাহানারা বেগম রাগি কণ্ঠে নিঝুমকে বলল,

— আজ তোর জন্য ছেলেটার এই অবস্থা হইছে। তুই ওরে একা রেখে না আসলে হয়তো ছেলেটা এতো অসুস্থ হতোনা।

নিঝুম কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রহিম মেয়া ডাক্তার নিয়ে আসে। ডাক্তার রিহাকে দেখে বলল।

— শরীরের তো অনেক জ্বর। এতো জ্বর কীভাবে আসছে?

রহিম মেয়া বলল — আসলে বৃষ্টিতে ভিজে কলেজ থেকে এসেছে। এর পর থেকেই জ্বর।

— আচ্ছা ঠিক আছে আমি ঔষধ লিখে দিয়েছি। ঠিক ভাবে খাওয়াবেন। আর আজকে রাতে একটু খেয়াল রাখবেন। আর একটু পর পর জলপট্টি দেওয়ার চেষ্টা করবেন।

এই কথা বলে ডাক্তার চলে গেলো। জাহানারা বেগম আবার বলল — নে এবার খুশি হইছিস না? ছেলেটা অসুস্থ হলো।

নিঝুম এবার কান্না করছে। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সে সবার আড়ালে নিজের চোখের পানি মুছে ফেলে। দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেলো। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে জাহানারা বেগম যখন যখন রিহানের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে তখনই নিঝুম তার আম্মুকে বলে,

— আমাকে দাও আমি রিহানকে খাইয়ে দেবো। আর তোমরা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো আজ আমি রিহানের দেখাশোনা করব।

জাহানারা বেগম কোনো কথা না বলেই নিঝুমের হাতে খাবারের প্লেট ধরিয়ে দেয়। উনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন নিঝুম নিজের কাজের জন্য অনুতপ্ত। তাই তিনিও কোনো কথা বলেন নাই। নিঝুম খাবারের প্লেট হাতি নিয়ে বিহানের রুমের দিকে অগ্রসর হয়।

চলবে?

জীবনের ডাকবাক্স পর্ব-০৯

0

#জীবনের_ডাকবাক্স
[ নবম পর্ব]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

কান্নার শব্দ শুনে আসিফের চোখ একটা যায়গায় আঁটকে যায়। সে দেখতে পায় একটা মেয়ে কান্না করছে। মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছেনা। আসিফ মেয়েটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তখনই পিছন থেকে কেউ তার হাত চেপে ধরে।

— আসিফ তুই কোথায় যাচ্ছিস?

— ওখানে একটা মেয়ে কান্না করছে। মেয়েটার হয়তো কোনো সাহায্যের প্রয়োজন।

— আসিফ ওখানে তো কাওকে দেখতে পাচ্ছিনা। আর কীসের কান্নার শব্দের কথা বলছিস তুই?

— তুই কি আসলেই দেখতে পাচ্ছিস না কিছু?

— না।

নিলয়ের কথা শুনে এবার আসিস সেই দিকে আমার তাকায়। অদ্ভুত ভাবে মেয়েটা সেখান থেকে গায়েব হয়ে যায়। আসিফ বুঝতে পারে এটা একটা আত্মা ছিলো। এবার দু’জন নিজের বাসায় চলে যায়। বাসায় গিয়ে ভাবতে থাকে কি করা যায়! আসিফ তার আগের স্মৃতি গুলো মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু আসিফের কোনো কিছুই মনে পড়ছেনা।

নিলয় আসিফকে বলল — আসিফ আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে।

— কি প্ল্যান?

— তোর তো টিউশনির সময় হয়ে এসেছে। তুই ওখানে চলে যা। আর তাদের সাথে কথা বল তুই। দেখ কোনো কিছু বের করতে পারিস কিনা।

— আমার খুব ভয় করছে।

— দেখ ওরা তোর কোনো ক্ষতি করবেনা। আমি যতটা বুঝতে পারছি।

— ঠিক আছে।

— আমিও আসবো নাকি তোর সাথে?

— না।

— মনে করে অবশ্যই সব কিছু জিজ্ঞেস করবি। প্রয়োজনে আমাকে কল করিস।

— ঠিক আছে।

এই কথা বলে আসিফ বের হয়ে পড়ে। সকালে সে বাড়ির সামনে সে পুরনো বাড়ি দেখেছে সেই বাড়ি আবার নতুনের মতো হয়ে গিয়েছে। আসিফ বুঝতে পারে তারা তাহলে ফিরে এসেছে। আজ যেভাবেই হোক এর রহস্য বের করবে। এসব ভাবতে ভাবতে আসিফ বাসার ভিতরে গিয়ে সোফায় বসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিঝুম আর নিঝুমের আম্মু আসিফের সামনে আসে। আসিফ তাদের সাথে নরমাল আচরণ করতে শুরু করে। সে ভুলেই গিয়েছে এখানে আসার আসল কারণ। সে নিঝুমকে পড়াতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। সেই আগের দিন গুলোর মতো। আসিফ লক্ষ্য করে নিঝুম অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে আসিফের দিকে। নিঝুমের মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে সে যেনো কোনো এক অজানা কারণে হারিয়ে যায় নিঝুমের মাঝে। হঠাৎ করে নিঝুম আসিফকে বলল,

— স্যার আমার সাথে একটু আসুন। আম্মু বলছে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

— আচ্ছা ঠিক আছে।

এই কথা বলে আসিফ নিঝুমের পিছনে যেতে থাকে। অদ্ভুত ভাবে নিঝুম রুমে না সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে যাচ্ছে। আসিফ ও নিঝুমের পিছনে যেতে থাকে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই। এবার কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ছাদের উপরে চলে আসে। আসিফ ছাদের উপরে এসে দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে জাহানারা বেগম। আসিফ নিঝুমের আম্মুকে দেখে বলল — আন্টি আমাকে এখানে কেন নিয়ে আসলেন?

— তোমাকে কিছু কথা বলার আছে আমার। আমি চাই তুমি আমার কথা গুলো মন দিয়ে শুনবে।

— আমাকে কি বলবেন?

— আসলে,,

এই কথা বলতেই আচমকা হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যায় নিঝুম আর জাহানারা বেগম। আসিফ অবাক হ’য়ে গেলো। সে আসেপাশে তাকাই সে হতবাক হয়ে গেলো। এতক্ষণে যে নিজের মধ্যে ফিরে এসেছে। সে ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। ভূতুড়ে একটা পরিবেশ। চারপাশ নিস্তব্ধতা। হঠাৎ করে কেউ আসিফের ঘাড়ে হাত রাখতেই আসিফ ভয়ে একটা চিৎকার দিয়ে উঠে।

— আসিফ আমি নিলয়।

নিলয়ের কণ্ঠ শুনে আসিফের ভয় কিছুটা কেটে যায়।

— তুই ছাদের উপরে কেন আসলি?

— আমি জানিনা। আমি তো গিয়েছিলাম নিঝুমের রুমে। আমি ছাদের উপরে এলাম কখন? আর তুই এখানে?

— আমি তোকে ফোন দিচ্ছিলাম তোকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু দেখলাম ফোন অফ। তাই আমি আর দেরি না করে চলে এলাম। মনের মধ্যে কেমন একটা ভয় কাজ করছিলো। তারপর এখনে এসে দেখি তুই ছাদে। আচ্ছা জিজ্ঞেস করছিস?

— না, এই বাড়িতে কিছু একটা তো আছে। এই বাড়িতে আমি আসলেই অদ্ভুত ভাবে সব ভুলে যায়। আর নিঝুমকে দেখলেও আমি কেমন যেনো একটা হয়ে যাই।

— এটা হয়তো তাদের মায়া। আচ্ছা তোকে নিঝুম রুমে কেন নিয়ে আসে?

— নিঝুমের আম্মু আমাকে কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। হয়তো তারা তোর উপস্থিতি টের পেয়েছে।

— হুম। এই বাড়িটা একবার ভালো ভাবে চেক করলে কেমন হয়?

— ভালো কিন্তু পুরো বাড়ি তো ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখানে তো কিছুই দেখা যায়না। আর সব থেকে বড় কথা এই বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি ও নেই।

— আমাদের কাছে ফোন আসছেনা? ফোনের প্লাস অন কর।

এবার দু’জন ফোনের প্লাস অন করে সব গুলো রুমের ভিতরে যায়। কিন্তু সেখানে সব কিছুর পুরনো। আর ধুলোময়লা। হঠাৎ করে তাদের মনে হলো কেউ তাদের দেখছে। দু’জন ভয় পেয়ে যায়। ভয়ে তাদের শরীর কাঁপতে শুরু করে। হটাৎ তাদের কানে কারোর হাঁটার শব্দ আসে। বুঝতে পারে তাদের আশেপাশে হয়তো কেউ আছে। তারা সেটা দেখার জন্য রুম থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু বাহিরে কেই নেই। দু’জনে খুব বেশি ভয় পেয়ে যায়। এই বাড়িতে থাকার শক্তি তারা হারিয়ে ফেলছে।

— আসিফ এই যায়গা টা আমার কাছে ভালো লাগছে না। আমাদের বাসার দিকে যাওয়া উচিৎ। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।

— হ্যাঁ। আমার কাল সকালে একবার এখানে আসবো।

— সেটাই ভালো হবে মনে হচ্ছে।

এই কথা ভেবেই তারা সেই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা নিজেদের বাসায় পৌছে যায়। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমাতে আসে দু’জন। হঠাৎ আসিফের ফোন বেজে উঠে। অপরিচিত নাম্বার দেখে আসিফ ফোন রিসিভ করে। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে একটা মেয়ের কণ্ঠ।

— কে আপনি?

— ভুলে গেলেন এতো তাড়াতাড়ি?

— দেখুন আমি আপনাকে আসলেই চিনতে পারছিনা। নিজের পরিচয় না দিলে ফোন রেখে দিন।

— এতো রেগে যাচ্ছেন কেন? আপনাকে দেখে তো শান্ত মনে হয়। আর এতো সুইট একটা ছেলেকে রেগে গেলে ভালো দেখায়না।

— ফাজলামো না করে পরিচয় দেন। নাহলে ফোন রাখছি বায়।

— আরে এই-যে মিস্টার, আমি প্রিয়া বলছি।

— ওহ, আপনি?

— হ্যাঁ। কি করছেন?

প্রিয়ার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে আসিফ কল কেটে দেয়। মেয়েটা খুব বেশি কথা বলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে আসিফ। হঠাৎ করে আসিফের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে যেতেই আসিফ চোখ খুলে নিজেকে অন্ধকার একটা রুমের মধ্যে আবিষ্কার করে। রুম পুরো ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোনো কিছুই ভালো ভাবে দেখতে পারছেনা। বিছানার পাশে হাত দিয়ে সে নিলয়কে খুঁজতে থাকে। কিন্তু নিলয় তার পাশে নেই। আসিফ ভাবতে থাকে, এই নিলয় আবার কোথায় চলে গেলো? আসিফ বিছানা থেকে উঠে লাইট অন করতে গিয়ে বুঝতে পারে সে তার নিজের বাসায় নেই। তখনই সে ভয়ে আঁতকে উঠল। সে বুঝতে পারছেনা সে কোথায় আছে! আর এখানে সে কীভাবে এলো? হঠাৎ সে সাদা কিছু একটা দেখতে পায়। অন্ধকারের মধ্যে সেদিকে পা বাড়ায় আসিফ। ভয়ে তার শরীর ঘামতে শুরু করে। তবুও সে বুকে সাহস রেখে এগিয়ে যেতে থাকে সামনের দিকে। সে যতটা সামনে যায় সেই সাদা জিনিস টা পিছনে সরতে থাকে। রুম থেকে বের হতেই সে কিছুটা আলো দেখতে পায়। এবার সে এতক্ষণ যেটাকে সাদার কাপড় ভেবেছে সেটা আসলে একটা মানুষ। মানুষ নাকি অন্য কিছু সেটা আসিফ এখনও শিউর হতে পারেনি।

— কে ওখানে?

এই কথা বলে আসিফ এগিয়ে যেতে থাকে। আর সাদা কাপড় পড়া মানুষটা সামনের দিকে চলে যায়। কিছুদূর যেতেই সে দাঁড়িয়ে যায়। আসিফ এবার তার সামনে চলে যায়। এটা কে দেখার জন্য আসিফ মুখের দিকে তাকাতেই ভয়ে সে পিছনে সরে আসে। আর মাটির মধ্যে পড়ে যায়।

চলবে?

জীবনের ডাকবাক্স পর্ব-০৮

0

#জীবনের_ডাকবাক্স
[ অষ্টম পর্ব]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

হঠাৎ কিছু একটার শব্দ শুনে দু’জন দু’জনকে ছেড়ে দিয়ে আলাদা হয়ে যায়। তখনই তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাই আমি। তারা দু’জন আমাকে এখানে দেখে অনেক বেশি লজ্জা পায়। আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,

— এতো রাতে ছাদের উপরে থাকা ঠিক হবে না। তোমরা রুমে যাও। আর হ্যাঁ আমি কিন্তু কিছু দেখিনি।

এই কথা বলতেই নিঝুম দৌড়ে চলে যায়। আমি রিহানের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে আমরা যে যার রুমে চলে আসি। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে সবাই। বিয়ের সময় বেশি না থাকায় পরের দিন আমরা কেনাকাটা করতে যাই। বিয়ের কেনাকাটা শেষ করে আমরা বাসায় ফিরে আসছি। গাড়িতে বিয়ের জিনিস পত্র বেশি থাকার কারণে আমি আর জাহানারা বেগম অন্য একটা গাড়িতে উঠি। আর রিহান আর নিঝুম আমাদের সামনের গাড়িতে করে যাচ্ছে। গাড়ি ড্রাইভিং করছে রিহান। আর রিহানের পাশে বসে আছে নিঝুম। দু’জনেই খুব খুশি। হঠাৎ সামনে একটা দ্রুত গতিতে একটা ট্রাক তাদের দিকে ছুটে আসছে। গাড়িটার গতি অনেক বেশি ছিলো। ট্রাকটা এসে সজোরে রিহানের গাড়িতে এসে ধাক্কা দেয়। সাথে সাথে গাড়িটা রাস্তার এক পাশে এসে পড়ে। গাড়ির ভিতরে নিঝুম আর আর রিহান তখনও রয়েছে। তাদের এমন এক্সিডেন্ট দেখে সাথে সাথে আমি গাড়ি থামিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আর সেই ট্রাক চলে যায়। দু’জনের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। নিঝুমের থেকে বেশি আঘাত পেয়েছে রিহান। রিহানের পুরো শরীর লাল হয়ে গিয়েছে। আর নিঝুম অজ্ঞান হয়ে আছে। রিহানও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। আমরা আর দেরি না করে দুজনকে কাছের একটা হাসপাতালে নিয়ে যাই। ডাক্তার দু’জনকে অপারেশন রুমে নিয়ে যায়। ডাক্তার জানাত নিঝুম ঠিক আছে কিন্তু রিহান আর নেই। মানে রিহান মারা গিয়েছে। এই খবর টা শুনে আমি যেনো পাগলের মতো হয়ে গেছি। যে ছেলেটা আমার চোখের সামনে বড় হয়েছে সে আজ লাশ হয়ে গিয়েছে! এটা যেনো আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা। জাহানারা বেগম তো কান্না করেই যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিঝুমের চিৎকার শুনে আমরা নিঝুমের কাছে চলে যায়।

— মা রিহান কোথায় রিহান ঠিক আছে তো?

জাহানারা বেগম কান্ন করছে। তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা। নিঝুম আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল — চাচা আমার রিহান কোথায় আমি একটা বার আমার রিহানকে দেখতে চাই।

— মারে রিহান আর আমাদের মাঝে নেই।

আমার কথা শুনে নিঝুম একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। একটু পরে নিঝুমের জ্ঞান ফিরে আসতেই নিঝুম পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করে। রিহানকে হারিয়ে সে যেনো উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। এর আগে বাবাকে হারিয়েছে। এবার নিজের ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে সে পুরো উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে আমরা রিহানের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরি যায়। যেই বাড়িতে বিয়ের আয়োজন হওয়ার কথা সেই বাড়ি টা মৃত হয়ে গিয়েছে। রিহানের লাশ জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না করে নিঝুম। সবাই কান্না করছে। জাহানারা বেগম নিজের মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই কান্না করছে। কিছুক্ষণ পরে জামাল সাহেবের কবরের পাশে রিহানকে দাফন করা হলো। রিহানের শোকে সবাই পাথর হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ একদিন আমি বাজার থেকে এসে দেখি পুরো বাড়িতে কেউ নেই। বাড়িটা পুরো খালি। নিঝুমরা কোথাও গেলে তো অবশ্যই আমাকে জানিয়ে জেতেন। আমি এবার তাদের রুমে চলে গেলাল। সেখানে গিয়ে দেখি তারা নেই। কিন্তু রুমের অবস্থা খুব খারাপ। বাড়ির অনেক যায়গায় রক্তের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমি দৌড়ে নিঝুমের রুমে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি অবস্থা আরো খারাপ। পুরো রুমে রক্ত। কিন্তু রুমে কোনো মানুষ নেই। আমি তখনও কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ওনাদের সাথে খারাপ কিছু হয়ে যায়নি তো? তখন আমার চোখ পড়ে একটা যায়গায়। আমি তাকিয়ে দেখি নিঝুমের জামাটা পড়ে আছে। আর সেটায় প্রচুর রক্ত। আমি সাথে সাথে থানায় ফোন দেই। পুলিশ এসে সব কিছুই দেখেন। কিন্তু কোথাও নিঝুম আর জাহানারা বেগমের লাশ পাওয়া যায়না।

অতীত শেষ করে বাস্তবে ফিরে আসে। সবার চোখে পানি টলমল করছে।

আসিফ বলল — পুলিশ কি খুনিদের ধরতে পারেনি?

— না কিছুদিন পরেই পুলিশ তাদের মামলা বন্ধ করে দেয়। কোনো প্রমাণ আর লাশের সন্ধান না পাওয়ার জন্য। আজো তাদের সেই লাশ পাওয়া যায়নি। আমার মনে হয় তাদের আত্মা মুক্তি পাওয়ার জন্য তোমার সামনে তারা এসেছে। আর তাদের খুনিদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

সব কিছুই আসিফের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সে কি করবে বুঝতে পারছেনা। এগুলো কি আসলেই বাস্তব নাকি কোনো গল্প? এটাই আসিফ মানতে পারছেনা। হঠাৎ করে নিলয়ের ফোন বেজে উঠে। নিলয় কথা বলা শেষ করে আসিফকে বলল,

— আসিফ আমাদের এখন হাসপাতালে যেতে হবে। রিয়া ও যাবে প্রিয়াকে দেখার জন্য।

— আচ্ছা ঠিক আছে চল তাহলে।

সবার থেকে বিদায় নিয়ে আসিফ আর নিলয় বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা রিয়ার সাথে দেখা করতে যায়। তারপর তিন জন এক হয়ে চলে যায় হাসপাতালে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা একটা হাসপাতালের সামনে গিয়ে নামে। তারপর সবাই মিলে হাসপাতালের ভিতরে চলে যায়। প্রিয়ার কেবিন নাম্বার জিজ্ঞেস করে সবাই প্রিয়ার কেবিনের দিকে চলে যায়। সবাই কেবিনের সামনে গিয়ে দেখে প্রিয়া তার মায়ের সাথে কথা বলছে। প্রিয়ার মাথায় ব্যান্ডেজ করা। হয়তো এক্সিডেন্টের সময় মাথায় আঘাত পেয়েছে। প্রিয়া সবাইকে দেখে অনেক খুশি হয়। সব থেকে বেশি খুশি হয় সে আসিফকে দেখে। সে হয়তো ভাবতেও পারেনি আসিফ তাকে দেখতে আসবে। প্রিয়ার আম্মু বাহিরে চলে যায়। আর সবাই প্রিয়ার কাছে গিয়ে বসে। তখনই নিলয় বলল,

— তোমার এক্সিডেন্ট হলো কীভাবে?

এবার প্রিয়া বলতে শুরু করলো,

— আমি তোমাদের সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং করছিলাম। দেরি হবে ভেবে ড্রাইভার নিয়ে আসিনি আজ। আমি একাই বের হইছি গাড়ি নিয়ে। আমি দেখলাম রাস্তা পুরো খালি। আমি গাড়ি ড্রাইভিং করছি আচমকা আমি গাড়ির সামনে একটা মেয়েকে দেখে আর গাড়ি কন্ট্রোল করতে পারিনি। সাথে সাথে গাড়িটা রাস্তার পাশে থাকা একটা কাজের সাথে ধাক্কা খায়। আমি সিট ব্যালট পড়ে থাকার কারণে বেশি একটা আঘাত পাইনি। কিন্তু মাথায় বাড়ি খাওয়ার কারণে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। জ্ঞান ফিরে আসতেই আমি নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করি। অজ্ঞান হওয়ার পরের কোনো কিছু আমার মনে নেই।

নিলয় আর আসিফ এবার দু’জন দু’জনের দিকে তাকায়। দু’জনেই বুঝতে পারে প্রিয়ার এক্সিডেন্টের আসল রহস্য।

প্রিয়া আসিফকে বলল — আপনি এসেছেন আমি অনেক খুশি হয়েছি। আমিতো ভাবতেই পারিনি আপনি আসবেন। ধন্যবাদ আপনাকে।

— ধন্যবাদ দেওয়ার মতো কিছু হয়নি। আপনি এখন ঠিক আছেন তো?

— হ্যাঁ। অনেকটাই সুস্থ লাগছে এখন, শুধু মাঝেমাঝে মাথা একটু ব্যাথা করে।

— চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ পরে প্রিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে তিন জন বেরিয়ে পড়ে হাসপাতাল থেকে। রিয়াকে তার বাসায় দিয়ে নিলয় আর আসিফ নিজের বাসার দিকে চলে যেতে থাকে। তখন নিলয় বলল,

— আসিফ তুই কি কিছু বুঝতে পারছিস?

— কীসের কথা বলছিস?

— প্রিয়ার হঠাৎ এক্সিডেন্ট, আর সে এক্সিডেন্টের আগে একটা মেয়েকে তার গাড়ির সামনে আসে! ওটা নিঝুমের আত্মা নয়তো?

— যদি নিঝুমের আত্মা হয়ে থাকে তাহলে সে প্রিয়ার কেন ক্ষতি করতে চাইবে?

— তাও ঠিক। বাই দ্যা ওয়ে! প্রিয়া তোর সাথে কথা বলেছে কারণ কি তাহলে সেটা?

— তোর কি মাথা ঠিক আছে? এমন হলে সে তো তোর আর রিয়ার ও ক্ষতি করতে চাইত।

দু’জনের মাঝে আবার নিরবতা শুরু হলো। হঠাৎ একটা কান্নার শব্দ ভেসে আসে আসিফের কানে। এই শব্দটা তার পরিচিত। এর আগেও এই শব্দ সে শুনেছে। এবার আসিফের চোখ আচমকা একটা যায়গায় আঁটকে যায়।

চলবে?

জীবনের ডাকবাক্স পর্ব-০৭

0

#জীবনের_ডাকবাক্স
[ সপ্তম পর্ব]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

আচমকা চিৎকারের শব্দ শুনে সবাই তাড়াতাড়ি করে চলে আসেন। সবাই এসে দেখেন আমি ফ্লোরের উপরে বসে আছি। আর এক সাইডে পড়ে আছে আমার ফোন। আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে আছি। যেনো আমি কিছুক্ষণের জন্য কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলছি। নিঝুমের আম্মু মিসেস জাহানারা বেগম আমার কাছে এসে বলল,

— রহিম ভাই আপনার কি হইছে? এভাবে চিৎকার করছেন কেন? আর আপনি এমন করছেন কেন? কি হইছে আপনার?

আমি কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছিলাম না। কী ভাবে সবাইকে বলব জামাল সাহেব আর নেই আমাদের মাঝে। আমি বুঝতে পারছিনা আমার কি করা উচিৎ।

রিহান আমার কাছে এসে বলল — চাচা কি হইছে আপনার? আপনার বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে?

— না বাবা।

— তাহলে কি হইছে?

— আপনারা সবাই আমার সাথে চলুন নিজের চোখে দেখবেন।

এই কথা বলে আমি রিহান,নিঝুম আর জাহানারা বেগমকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাকে একটা হাসপাতালে এড্রেস দিয়েছে তারা। সেখানেই নাকি জামাল সাহেবের লাশ রাখা হয়েছে। আর জামাল সাহেবের মৃত্যু একটা গাড়ি এক্সিডেন্টে হয়। যদিও আমি তখনও কাওকে কিছুই বলিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা হাসপাতালের সামনে এসে পড়লাম।

— চাচা আমরা হাসপাতালে কেন এলাম?

— বাবা আগে ভিতরে আসো।

এবার সবাই মিলে ভিতরে গেলাম। আমি সবাইকে দাড়াতে বলে আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেলাম। ডাক্তারের সাথে কথা বলে শেষ করে আবার তাদের কাছে ফিরে আসি। কেউ এখন অব্দি আন্দাজ করতে পারেনি,তাদের জন্য কি অপেক্ষা করে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সামনে একটা মৃত লাশ নিয়ে আসে। লাশের মুখ সাদা কাপড় দিয়ে ডেকে রাখা। লাশটি আমাদের সামনে এনে রাখায় সবাই কিছুটা অবাক হয়। রিহান আমাকে বলল,

— চাচা এই লাশ আমাদের সামনে কেন নিয়ে আশা হলো? এটা কার লাশ?

আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। কান্নার জন্য আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা। রিহান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সে লাশের মুখ থেকে কাপড় সরাতেই চমকে উঠে। সাথে সাথে রিহান পিছনে সরে আসে। আর জামাল সাহেবের মুখের কাপড় সরে যাওয়াতে এবার সবাই মুখ দেখতে পায়। জাহানারা বেগম নিজের স্বামীর লাশ দেখে সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যায়। আর নিঝুম বাবার লাশ জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে। আমি গিয়ে নিঝুমকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করি। আর রিহান জাহানারা বেগমের জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছেনা। এবার একটা এম্বুল্যান্স নিয়ে জামাল সাহেবের লাশ আর সবাইকে নিয়ে বাসায় চলে যাওয়া হয়। জাহানারা বেগম তখনও অজ্ঞান ছিলো। লাশ বাড়িতে নিয়ে আশার পরে অনেক মানুষের আগমন ঘটে। জাহানারা বেগম নিজের জ্ঞান ফিরে পায়। নিঝুম অঝোরে কান্না করছে। রিহান নিঝুমকে শান্তনা দেয়। দেখতে দেখতে কিছু সময় পার হয়ে যায়। জামাল সাহেবের লাশ দাফন করে আমরা বাড়িতে আসি। তারপর কেটে গেলো দুই দিন। সবাই খুব নিরব হয়ে গিয়েছে। কেউ কারোর সাথে ঠিক করে কথা বলেনা। কেউ টাইম মতো খাবার খায়না। রিহান তবুও জোর করে সবাইকে খাবার খাইয়ে দেয়। আসলে রিহান এই পরিবারের সবাইকে নিজের পরিবার মনে করে। জামাল সাহেব রিহানকে অনেক ভালোবাসেন। সব সময় নিজের সন্তানের মতোই দেখেছেন।

কিছুদিন পরে আমরা সবাই খাবার খেতে বসি। তখনই জাহানারা বেগম রিহানকে বলল,

— রিহান। এখন থেকে আমাদের সব ব্যবসার দ্বায়িত্ব তোমার। আগে সব কিছুর দেখা শোনা তোমার আংকেল করেছে। আমি চাই ওনার পরিবর্তে তুমি সব কিছুর দেখবাল করো।

— আন্টি আমি কি পারবো এতো বড় দ্বায়িত্ব নিতে?

— তুমি ঠিক পারবে। তোমার উপরে আমাদের সেই আস্থা আছে।

— আমি যতো টুকুন পারি চেষ্টা করব। আর আমার জন্য দোয়া করবেন। আর একটা কথা।

— কি কথা?

— আমাকে সাহায্য করার জন্য চাচাকে আমার সাথে থাকতে হবে।

জাহানারা বেগম একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,

— তাহলে তো আরো ভালো। কাল থেকে তোমরা দুজনে ব্যবসার দ্বায়িত্ব নাও।

বুঝতেই পারছেন পরিবার টা ঠিক কেমন? এতো ভালো একটা পরিবারের সাথে কি কি হচ্ছে!

পরের দিন থেকে রিহান সব কিছুর দেখা শোনা করতে শুরু করে। রিহান বুদ্ধিমান একটা ছেলে। সে খুব সহজেই সব বুঝে নেই। আর খুব ভালোই ব্যবসায় মনোযোগী হয়। ব্যবসার জন্য রিহান পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেয়। যদিও জাহানারা বেগম এতে রাজি ছিলেননা। এদিকে নিঝুমের পরিক্ষা ও শেষ হয়ে যায়। রাতে সবাই এক সাথে খেতে বসেন।তখন হঠাৎ করে জাহানারা বেগম সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

— তোমাদের সবার সাথে আমার একটা কথা ছিলো। আসলে কথাটা ঠিক আমার নই। আমার হাসবেন্ড এর।

— কি কথা আন্টি?

— রিহান তোমার আংকেল আমাকে প্রাই সময় বলতো। তুমি আর নিঝুম যখন পড়াশোনা শেষ করবে তখন তোমাদের চার হাত এক করে দিবে।

এই কথা শুনে রিহান সহ উপস্থিত সবাই অবাক হয়। যদিও আগে থেকেই নিঝুম রিহানকে পছন্দ করতো কিন্তু কখনো সেটা মুখ খুলে বলেনি। কথাটা শুনে নিঝুম মুচকি একটা হাসি দেয়। তখন রিহান বলল,

— আন্টি এটা আপনি কি বলছেন? আমার মতো একটা এতিম ছেলেকে রাস্তা থেকে তুলে এনে সন্তানের যায়গায় বসিয়েছেন। আমার আর কিছু চাইনা। নিঝুমের সাথে আমার যায়না আন্টি। আমি একটা এতিম ছেলে।

জাহানারা বেগম রাগি কণ্ঠে বলল — আর যদি কখনও তোমার মুখে এই কথা শুনি তাহলে তোমার খবর আছে। তুমি কীসের এতিম? আমরা কি মরে গেছি নাকি? নাকি আমাদের তুমি আপন মনে করোনা?

— আন্টি এটা কি বলছেন? আপনারা যদি আমাকে আপনাদের বাসায় যায়গা না দিতেন তাহলে তো আজ আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। আমি ভালো করে মা-বাবার ভালোবাসা পাইনি। আদর পাইনি। আপনাদের থেকে পেয়েছি।

— তাহলে তুমি কি আমাদের এই আবদার রাখবেনা? তোমার আংকেলের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করবেনা? বাবা আমি জানিনা আমি আর কতো দিন বেঁচে থাকবো। আমি মৃত্যুর আগে তোমাদের চার হাত এক করে দিয়ে মরতে চাই।

— আন্টি প্লিজ এভাবে বলবেন না।

— আমি বিয়ের ডেট ঠিক করে রেখেছি আগামী শুক্রবার তোমাদের বিয়ে। আর বিয়ের সব আয়োজন করবে রহিম ভাই।

লজ্জা পেয়ে নিঝুম খাবার টেবিল থেকে উঠে চলে যায়। তারপর যে যার রুমে চলে যায়। হঠাৎ করে নিঝুম রিহানের রুমে আসে।

— নিঝুম এতো রাতে তুমি আমার রুমে কেন আসলে? কেউ দেখলে কি বলবে?

— কে কি বলবে? আমি আমার হবু হাসবেন্ডের রুমে তো আসতেই পারি।

— না পারো না। কারণ আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি। সো নিজের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

— রিহান ছাদের উপরে চলো প্লিজ। আজ আকাশে অনেক সুন্দর চাঁদ উঠেছে।

— এতো রাতে ছাদে? যদি আমাদের ভূতে আক্রমণ করে তখন কি হবে?

— তুমি এতো ভীতু কেন হ্যাঁ? ছেলেদের এতো ভয় পেতে হয়না। তুমি যাবে নাকি আমি একাই যাবো?

বাধ্য হয়ে রিহান নিঝুমের সাথে ছাদের উপরে চলে যায়। দু’জনে গিয়ে ছাদের এক পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আজ আকাশের চাঁদ অনেক বেশি সুন্দর লাগছে দু’জনের কাছে। হয়তো আগে কখনও এমন ভাবে চাঁদ উপভোগ করেনি তারা। দু’জন নিরবতা পালন করছে। নিরবতা ভেঙে নিঝুম বলল,

— রিহান তুমি কি কখনো আমার মনের ভাষা বুঝতে পারোনি? আমি সেই ছোট বেলা থেকে তোমাকে পছন্দ করি সেটা কি তুমি কখনও অনুভব করতে পারো নি?

রিহান একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,

— পেরেছি। তাও না বোঝার বান করে থেকেছি। আমি কখনও চাইনা আমার জন্য তোমার পরিবারের মানুষ গুলো কষ্ট ফাক। যে মানুষ গুলো একটা এতিম ছেলেকে নিজের সন্তানের মতো করে বড় করছে তাদের আমি আঘাত কীভাবে দেই?

— তাহলে তুমি আগে থেকেই সব জানতে?

— হ্যাঁ।

— যাও তোমার সাথে কথা নেই।

এই কথা বলে নিঝুম যখন চলে যেতে চাইল তখনই রিহান নিঝুমের হাত ধরে টেনে তার বুকের কাছে নিয়ে আসে।

— কোথায় যাবে তুমি?

— তুমি তো আমাকে ভালোবাসোনা। এখানে থেকে কি করব?

— ইশ! আমি আমার পাগলিটাকে ভালো না বাসলে কে বাসবে?

— সত্যিই?

— হ্যাঁ। ভালোবাসি তোমাকে। অনেক বেশি ভালোবাসি।

রিহানের কথা শুনে নিঝুম খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রিহানকে। রিহান ও নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ করে কিছু একটা শব্দ শুনে দু’জন দু’জনকে ছেড়ে দেয়।

চলবে?

জীবনের ডাকবাক্স পর্ব-০৬

0

#জীবনের_ডাকবাক্স
[ ষষ্ঠ পর্ব]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

বয়স্ক লোকটি আসিফের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করে। লোকটা কেমন যেনো হয়ে গেলো। তার চোখ গুলো ছানাবড়া হয়ে গেছে। আসিফ আর নিলয় হতবাক হয়ে আছে। এই লোকের হঠাৎ করে কি হয়ে গেলো?

তখনই লোকটা আসিফের দিকে তাকিয়ে বলল,

— রিহান তুমি বেঁচে আছো?

এই কথা শুনে নিলয় আর আসিফ দু’জন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। আসিফ তো বুঝতেই পারছেনা এই লোক তাকে রিহান কেন বলছে?

তখন নিলয় লোকটাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। নিলয় এবার তাকে বলল,

— ওর নাম রিহান নই। ওর নাম আসিফ। আপনি ভুল করছেন।

— না, এতো বড় ভুল আমার হয়না। এটা রিহান। রিহানকে আমি ছোট বেলা থেকে বড় করছি। রিহান বাবা তুই এতো দিন কোথায় ছিলি?

লোকটা বিছানা থেকে উঠে আসিফকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে শুরু করে। কেউ কিছুই বুঝতে পারছেনা। নিলয় লোকটাকে বোঝাতেই পারছেনা যে এটা রিহান না এটা আসিফ। তখনই সেই ভদ্রলোক রুমের ভিতরে আসে। উনি রুমের ভিতরে এসে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তার বাবাকে খাটের উপরে বসিয়ে দেয়। তখন উনি তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল।

— বাবা ও যদি রিহান হতো তাহলে ও কি এখনও এই বয়সে থাকতো? রিহানের বয়স তো এতো দিনে চল্লিশ পার হতো। তোমার ভুল হচ্ছে কোথাও। হয়তো তুমি চোখে ভুল দেখছ।

— আমি ভুল দেখছিনা। দাঁড়া আমি এক্ষুনি প্রমাণ দিচ্ছি তোদের।

এই কথা বলে লোকটা একটা ব্যাগ বের করে। সেখান থেকে একটা ছবি বের করে তার ছেলের হাতে দেয়। লোকটা ছবির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। ছবিতে যে ছেলেটা হুবহু আসিফের মতো দেখতে। এই ছবির ছেলেটার থেকে কিছুতেই আসিফ কে আলাদা করা যাচ্ছেনা। দুইটা মানুষ একই চেহারার কীভাবে হতে পারে? এবার লোকটার হাত থেকে নিলয় ছবিটি নিয়ে দেখে এখানে চারজন মানুষ আছে। একটা বয়স্ক মহিলা সাথে একটা মেয়ে আর এই বয়স্কলোক আর আসিফ। এই ছবি দেখে নিলয় ও হতবাক হয়ে যায়। নিলয় এবার আসিফের দিকে ছবিটি এগিয়ে দেয়। ছবির দিকে তাকাতেই আসিফের পায়ের তোলার মাটি সরে যায়। ছবি মধ্যে যে দু’জন আছে এরা আর কেউ না, এরা হচ্ছে নিঝুম আর তার মা। আসিফ তো কিছুই বুঝতে পারছেনা।

আসিফ এবার বলল — এই দু’জনকে তো আমি ছিনি। আর এই মেয়ের নাম তো নিঝুম, ওনাদের বাসায় আমি টিউশনি করি।

আসিফের কথা শুনে ভদ্রলোকটা অবাক হয়ে বলল,

— কি বলছ তুমি এসব? ওনারা তো আজ থেকে ৩০ বছর আগে মারা গিয়েছে।

লোকটার কথা শুনে আসিফ যেনো আকাশ থেকে পড়লো। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় সবাই। আসিফ কিছুই বুঝতে পারছেনা। আসিফ এবার বুঝতে পারে সে কেনো একাই সব সময় নিঝুমকে দেখতে পেতো। এবার সবাই এক যায়গায় গিয়ে বসে। ভদ্রলোকটা এবার আসিফকে বলল।

— আসিফ ছবিতে যে ছেলেটা আছে ওটা তুমিই ছিলে। হয়তো ওটা তোমার আগের জন্ম ছিল। তুমি একটু চেষ্টা করো কোনো কিছু মনে করতে পারো কিনা।

— দেখুন আপনারা বলতে চাইছেন আমার পুনর্জন্ম হইছে? পুনর্জন্ম বলতে কিছু হয়না।

নিলয় আসিফকে বলল — আসিফ তুই একটু কিছু মনে করার চেষ্টা কর।

— তুইও কি পাগল হইলি?

— একটা জিনিস কেন বুঝতে পারছিস না! ছবিতে তোর ছবি, আর ওনারা মা-মেয়ে তোর সামনে আসে। এর মধ্যে তো কারণ অবশ্যই আছে। আর একটা জিনিস মনে আছে? তোর সেই এক্সিডেন্ট এর কথা? আমার তো মনে হয় নিঝুমের আত্মা তোকে সেদিন বাঁচিয়েছে।

নিলয়ের কথা শুনে আসিফ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। সে অতীতের স্মৃতি গুলো মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো কিছুই সে মনে করতে পারছেনা।

এবার বয়স্ক লোকটি আসিফের কাছে এসে বলল,

— রিহান, বলতে গেলে তুমি আমার কাছেই বড় হয়েছো আগের জন্মে।

নিলয় বলল — আচ্ছা আপনি আমাদের সব ঘটনা খুলে বলুন। এই পরিবারের সাথে কি কি হয়েছে। আপনি যেটুকু জানেন সেই টুকুই বলুন।

অতীত
______________

আমি অনেক বছর থেকেই জামাল সাহেবের বাসায় কাজ করি। (জামাল সাহেব নিঝুমের বাবা) আমি একদিন বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে আমার চোখে পড়ে একটা সাত থেকে আট বছরের বাচ্চা কান্না করছে। আমি তাড়াতাড়ি করে ছেলেটার কাছে চলে গেলাম।

— কে তুমি বাবা? আর এখানে দাঁড়িয়ে এভাবে কান্না কেনো করছ তুমি?

ছেলেটা কান্না করেই যাচ্ছে।

— তোমার মা-বাবা কোথায়?

— আমার মা-বাবা কেউ নেই। দু’জনেই মারা গিয়েছে।

— ওহ। তোমার বাসা কোথায়? আর তুমি এখানে কার সাথে এসেছ?

— আমি এখানে একাই এসেছি। আসলে আমি বাড়ি থেকে চলে আসছি। আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমাকে কিছু খেতে দেন।

ছেলেটার মুখ দেখে আমার খুব মায়া হয়। আমি ছেলেটাকে নিয়ে একটা দোকানে গেলাম। তারপর তাকে কিছু খাবার কিনে দিয়ে খেতে দেয়। ছেলেটা খাবার হাতে পেয়েই খেতে শুরু করে। ছেলেটার এমন অবস্থা দেখে মনে হলো অনেক দিন ধরেই কিছু খায়নি। আমি ছেলেটাকে নিয়ে আমার বাসায় চলে গেলাম। আমার পরিবার থাকতো গ্রামে। আমি একাই শহরে ছিলাম। আর জামাল সাহেবের বাড়িতেই আমি একটা রুমে থাকতাম। ছেলেটাকে গোসল করিয়ে দিয়ে ভালো একটা জামা পড়িয়ে দেই। তারপর আমি তাকে নিয়ে বসলাম।

— তোমার নাম কি বাবা?

— আমার নাম রিহান।

— তুমি বাসা থেকে কেন চলে আসলে? তোমার বাসার লোকেরা তোমার জন্য চিন্তা করবেনা?

— যারা আছে তারা কখনও আমার জন্য চিন্তা করবেনা। বাবা মা মারা যাওয়ার পরে আমি আমার চাচার বাসায় থাকতে শুরু করি। ওনারা কেউ আমাকে পছন্দ করেনা। ঠিক ভাবে খাবার খেতে দেয়না। আমাকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেই। ইতি আপু আমাকে খুব মারে।

— ইতি কে?

— আমার চাচাতো বোন। আপুকে আপু বলে ডাকলেও আমাকে মারে। আপুর সব কাজ আমি করে দেই। তাও আপু আমাকে দেখতে পারেনা। সেদিন চাচা আমাকে খুব মেরেছে।

এই কথা বলে ছেলেটা তার পিট আমাকে দেখায়। ছেলেটার পিঠের উপরে মারের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। কতটা খারাপ হলে একটা বাচ্চাকে এভাবে আঘাত করতে পারে মানুষ? ছেলেটার এমন অবস্থা দেখে আমি নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কিছুক্ষণ পরে আমি রিহানকে নিয়ে জামাল সাহেবের বাসায় নিয়ে গেলাম। বাসার ভিতরে যেতেই দেখি সবাই খাওয়া দাওয়া শুরু করছে। আমাকে দেখে জামাল সাহেব বলল,

— আরে রহিম। আসো আসো খাবার খেতে বসো। এক সাথে খাই।

এই কথা বলে শেষ করার আগেই জামাল সাহেবের চোখ পড়ে রিহানের দিকে।

— আরে এই ছেলেটা কে?

জামাল সাহেবের কাছে আমি ছেলেটার ব্যাপারে সব কিছু খুলে বলি। জামাল সাহেব ও তার পরিবারের সবাই খুব ভালো ছিলেন। ছেলেটার কথা শুনে জামাল সাহেব নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসে রিহানকে তার সাথে খাওয়ার জন্য বসায়। আমিও তাদের সাথে বসি। নিঝুম ও খুব ভালো আর শান্ত মেজাজের মেয়ে ছিলো। নিঝুমের বয়স তখন চার অথবা পাঁচ এমন হবে। রিহান আর নিঝুম এক সাথেই খেলাধুলা করতো। যতই দিন যায় ততই দুজন বড় হতে থাকে। জামাল সাহেব আর তার স্ত্রী রিয়ানকে নিজের ছেলের মতো করেই ভালো বাসতেন। খুব ভালো ভাবেই সময় যাচ্ছিলো। রিহান আর নিঝুম এখন কলেজে পড়ছে। জামাল সাহেব ছিলেন অনেক বড় ব্যবসায়ী। যার কারণে ওনার অনেক শত্রু হয়ে যায়। একদিন আমি বাসার কাজ করছিলাম। হঠাৎ একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে। আমি ফোন রিসিভ করতেই এমন কথা শুনি যেটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারলাম না। আমার হাত থেকে ফোন পড়ে যায়। আমি একটা চিৎকার দিয়ে ফ্লোরের উপর বসে পড়ি।

চলবে?