গল্পটা_নিশ্চুপ_বালিকা’র(০৯)
রচনায়- অনামিকা ইসলাম ‘অন্তরা’
পরদিন রাত্রে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শুভ্র ডাক দেয় নীলিমা’কে। ‘কই হলো?’ শান্ত গলায় নীলিমা’র জবাব, জ্বী! আসছি… একদম প্রস্তুত হয়ে নীলিমা শুভ্র’র সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ‘চলুন…’ শার্টের হাতা ঠিক করছিল শুভ্র। কন্ঠ শুনে মাথা তুলে তাকায়। স্তব্ধ হয়ে যায় শুভ্র। সাদা রঙের জামা পরিহিত এক শুভ্র পরি ওর সামনে দাঁড়িয়ে। ‘কি হলো! চলুন…’ ঘোর কাটে নীলিমা’র ডাকে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ! চলো।’ হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির নিকটে পৌঁছে যায় দু’জন। দরজা খুলে সামনের সিটে গিয়ে বসে শুভ্র। তার ঠিক পেছনের দরজা খুলে পেছনের সিটে বসে নীলিমা। গাড়িতে উঠার মিনিট পাঁচেক অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে না শুভ্র। প্রশ্ন করে নীলিমা- ‘কি হলো? কোন সমস্যা?’ — আমাকে কি তোমার ড্রাইভার মনে হয়?! — এটা কি ধরনের কথা? ড্রাইভার কেন মনে হবে? — আমার তো তাই মনে হচ্ছে। — কেন?! — সামনে আসো! না হয় বাসা’য় ফিরে যাও… কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সামনে শুভ্র’র পাশে গিয়ে বসে নীলিমা। — তারপর! নিশ্চুপ বালিকা’র ফিউচার প্ল্যান কি? — স্বামী সংসার আর বাচ্চাকাচ্চা প্রতিপালন করা। — কিহ? — কিছু না!(জিহ্বা’য় কামড় দিয়ে লজ্জা’য় নিচের দিকে দৃষ্টি নিয়ে যায় নীলিমা। ছি! কি বলতে কি বলে ফেললাম!!!) — তোমাদের বাড়ি জানি কোথায়? — নরসিংদী! — মেম-এর অসংখ্য ইচ্ছের মধ্যে একটা ইচ্ছে তোমাদের নরসিংদী’টা ঘুরে দেখা। ইচ্ছে’টা কি পূরণ করা যায় না? — জ্বী, নিয়ে যাবো! — এই নিয়ে যাবো করতে করতে তো গত একটা বছর পাড় করে দিয়েছো! আচ্ছা, তোমাদের নরসিংদী’র মানুষ কি মেহমানদের ভয় পায় নাকি?(দুষ্টুমির ছলে) — না, না! ভয় কেন পাবো?!(গম্ভীর কন্ঠে) — মন খারাপ করলে নাকি আবার?! — নাহ! — না করলেই ভালো! — (নিশ্চুপ) — আচ্ছা, নামো তো! সেই কখন থেকে একা একা’ই বকবক করছি। খিদে পেয়েছে বড্ড! — এখানে? — হ্যাঁ, এখানে। — আশেপাশে তো কোথাও দোকানপাট আছে বলে মনে হয় না! — আছে… — কোথায়? — আগে নামো… — হু… গাড়ি থেকে নেমে, পায়ে হেঁটে, কিছুটা পথ সামনে এগিয়ে যায় দু’জনে। কিছুদুর এগুতেই নীলিমা দেখতে পায় সামনে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়িওয়ালা। ‘ওয়াও! ঐ যে ঝালমুড়ি কাকা। আমি ঝালমুড়ি খাবো! আনন্দে লাফিয়ে উঠে নীলিমা।’ সেটা দেখে হেসে দেয় শুভ্র। শুভ্র’র হালকা হাসিতে থেমে যায় নীলিমা। লাফানো বন্ধ করে লজ্জায় চুপসে যায়। ততক্ষণে কাঙ্খিত ভ্যান গাড়ি’টির সামনে চলে এসেছে ওরা। দুর থেকে শুভ্র’র ডাক, চাচা! ১০টাকা’র ঝালমুড়ি দেন। হালকা ঝাল দিয়ে। ঝালমুড়িওয়ালা’র তাৎক্ষণিক জবাব, জ্বী, বাবা! দিতাছি… পাশেই বন্ধ হয়ে যাওয়া টং দোকানের সামনের বেঞ্চটাতে শুভ্র গিয়ে বসে। নীলিমা দাঁড়িয়ে আছে ঝালমুড়িওয়ালা থেকে বেশ ক্ষাণিকটা দুরে। ‘এই যে মা মুড়ি! এই লন কার্ড…’ ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে শুভ্র’র দিকে এগিয়ে যায় নীলিমা। ঝালমুড়ি এগিয়ে দেয় শুভ্র’র দিকে। নেন! খান…. ‘আমি ঝালমুড়ি খাই না! তুমি খাও! আর দাঁড়িয়ে কেন? বসো…’ চুপচাপ শুভ্র’র পাশে বসে পড়ে নীলিমা। খাওয়া শুরু করে। ঘোরের মধ্যে ডুবে যায় শুভ্র। এই তো সেদিন! লাঞ্চে নিয়ে গিয়েছিল নীলিমা’কে। টেবিলে বসলে স্বভাবত’ই বিদেশী নানা সুস্বাদু খাবার অর্ডার করা হয়। আর সেগুলো দেখে খাবারে হাত না দিয়ে এদিকওদিক তাকাতে থাকে নীলিমা। শুভ্র খাবার শুরু করার কথা বললে একবার খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে জানায় খিদে নেই। অথচ লাঞ্চ করার উদ্দেশ্যে’ই ওরা বাহিরে এসেছিল। পরে শুভ্র না খেয়েই খাবারের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়। আসার পথে রাস্তায় ঝালমুড়িওয়ালাকে দেখে গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে যায়। ঝালমুড়ি হাতে নিতেই দৃষ্টি যায় পাশের দোকানের চিপসের দিকে। বাচ্চাদের ন্যায় দ্রুত সেদিকে ছুটে যায় নীলিমা। গাড়ি থেকে বের হয় শুভ্র। ঝালমুড়িওয়ালার পাওনা মিটিয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়ায় নীলিমা’র। দোকানদারকে নীলিমা চিপস দিতে বলে। দোকানদারের প্রশ্ন, কয়টা দেবো? ১টা বলতে যাচ্ছিল নীলিমা, তার আগেই শুভ্র’র জবাব, সবগুলো…. চমকে উঠে পিছনে তাকায় নীলিমা। দোকানদারেরও বিস্ময়ের দৃষ্টি শুভ্র’র দিকে। — সবগুলো মানে?(দোকানদার) — সবগুলো মানে সব!(শুভ্র) — মানে? — মানে বুঝতে পারেননি? দোকানে যা চিপস আছে সব দিবেন… — কিন্তু… — কোন কিন্তু নেই। আমি আপনাকে টাকা দেবো আর আপনি আমায় চিপস দিবেন! — সেটা না! ভাবছি এত চিপস নিবেন কিভাবে? — গাড়ি এনেছি আমি। — সিরিয়াসলি নিবেন? — আমি আপনার সাথে মজা করবো কিসের খাতিরে? — আচ্ছা, দাঁড়ান! রাসেল, এদিকে আয় একটু…(দোকানদার) — জ্বী, চাচা…(কর্মচারী) — চিপসগুলো রেখে আয় ওই গাড়িতে। — আচ্ছা… যাইতাছি… চোখের পলকে কর্মচারী ছেলেটা চিপসগুলো নিয়ে রেখে আসে গাড়ি’তে। গাড়ি’র দিকে একবার তাকিয়ে শুভ্র ফিরে তাকায় দোকানদারের দিকে। ‘ আচ্ছা! সবমিলিয়ে প্রাইজ কত?’ — কিছুক্ষণ আগেই মাল ডেলিভারি দিয়ে গেছে। তারপর হাতে গুনা ২টা চিপস’ই বিক্রি হইছে। — পূর্বে চিপস সংখ্যা কত ছিল? — ১০০… — এই নিন! (১০০০ টাকা’র নোট এগিয়ে দিয়ে দিয়ে।) — (নীলিমা নিশ্চুপ) — কি হলো? দাঁড়িয়ে কেন? চলো!(শুভ্র) — আপনার ২০টাকা!(দোকানদার) — লাগবে না ভাই। গাড়িতে উঠে বসে শুভ্র। নিঃশব্দে নীলিমা’ও পাশে গিয়ে বসে। চোখাচোখি ছাড়া পুরো রাস্তা’য় একটাও কথা হয়নি দু’জনের মাঝে। তবে নীলিমা বেশ কয়েকবার গাড়ির পিছনে উঁকি দিয়ে চিপস দেখেছে। ‘ ওহ, মাগো! ঝাল….’ ঘোর কাটে শুভ্র’র। ডানে তাকায়। নীলিমা তখন মুড়ি ফেলে দিয়ে ঐ কাগজ দিয়ে মুখে বাতাস করছে। রাগান্বিত দৃষ্টিতে শুভ্র তাকায় ঝালমুড়িওয়ালা’র দিকে। ‘আপনাকে না আমি বলে দিয়েছি হালকা ঝাল দিতে?’ চটজলদি দোকানদারের জবাব, মা, তো মুড়িতে ঝাল বেশী’ই খায়। মানে ও আপনার থেকে আগে আরো ঝালমুড়ি খেয়েছে? কিছুটা স্বাভাবিক গলায় শুভ্র’র প্রশ্ন। প্রতিউত্তরে দোকানদার জানায়, হ্যাঁ! ও তো রোজ’ই আমার এখান থেকে ঝালমুড়ি খায়। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় শুভ্র। গাড়ি’র কাছে যায় এবং ভেতর থেকে পানির বোতল এনে দেয়। এগিয়ে দেয় নীলিমা’র দিকে। নিচুস্বরে নীলিমা’র জবাব, বোতল দিয়ে পানি খেতে পারি না আমি… শুভ্র এবার উঁচু স্বরে ডাক দেয় দোকানদারকে, চাচা! গ্লাস আছে…? ‘হ্যাঁ, আছে….’ দোকানদার একটা গ্লাস এগিয়ে দিয়ে যায় শুভ্র’র দিকে। শুভ্র সেটা লাবণ্য’র দিকে এগিয়ে দেয়। ‘ধরো…’ লাবণ্য গ্লাসটা ধরে রাখলে শুভ্র বোতলের মুখটা খুলে কিছু পানি গ্লাসে ঢেলে দেয়। পানি খেয়ে বোকা’র মতো শুভ্র’র দিকে ফিরে তাকায় নীলিমা। গম্ভীর কন্ঠে শুভ্র’র জবাব, গ্লাসটা দিয়ে গাড়িতে আসো… শুভ্র গাড়ি’তে গিয়ে বসলে তার পিছু পিছু নীলিমা’ও গাড়িতে গিয়ে বসে। দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে সিটে মাথা রেখে শুয়ে আছে শুভ্র। ভীত স্বরে নীলিমা’র প্রশ্ন, আপনার কি খারাপ লাগছে? — হ্যাঁ, কবিতা শুনাও একটা! — মানে?(বিস্ময়ে হতবাক) — বাংলা বুঝো না? কবিতা শুনাও কবিতা.. — আমি তো কবিতা পারি না। — পারতে হবে। — সত্যি মাথায় কিচ্ছু আসছে না! তবে… — তবে? — ফেসবুকে আমার একটা ফ্রেন্ড আছেন। ওনি খুব ভালো কবিতা লিখেন! বেশ কিছুদিন আগে চাঁদপুরের কোন একটা পত্রিকায় ওনার একটা কবিতা পড়েছিলাম। আজ আমি সে কবিতা’র প্রেমে ভেঙে চূড়ে পড়েছি! একদম মুখস্ত হয়ে গেছে আমার কবিতা’টা! — তো আমাকেও একটু সুযোগ করে দাও প্রেমে পড়া’র… সম্মুখ পানে তাকিয়ে গাড়িতে বসেই নীলিমা আবৃতি করতে শুরু করেঃ- চল না আজ কিছুটা পথ , দু’জন একসাথে হাঁটি ! ছিল যতো গোপন কথা সব বলে দেবো, কল্পনা’র ক্যানভাসে কিছু ছবি এঁকে নিবো, চল না হই ফেলে আসা সেই জুটি !! তোর নীল শার্ট , চোখে সানগ্লাস, চুল কিছু অগোছালো! হালকা হাসিতে, সিগারেট হাতে, হবে কথা এলোমেলো!! পাওয়া না পাওয়ার গল্প হবে না, থাকবে না অনুতাপ! যাব তোর সাথে, ফেলে আসা তটে, যেখানে প্রথম আলাপ!! শরীর স্বাস্থ্য কেমন আছে তোর , খবর নেবো না কিছু ! হয়ে এক মন , রবো কিছুক্ষণ, স্বপ্নেরা নেবে পিছু !! তোর চেনা রঙ, লুটিয়ে আঁচল, আলতা পাটি ছুঁয়ে! বুকে তোলপাড়, হবো নদী পার, ফেলে আসা সুখ নিয়ে !! প্রাণপাখি’র মুখে কবিতা আবৃতি শুনে সোজা হয়ে বসে শুভ্র। নীলিমা যখন কবিতা আবৃতি’তে মগ্ন শুভ্র তখন মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় নীলিমা’র মুখপানে তাকিয়ে। আবৃতি শেষে হালকা হাসিতে নীলিমা ফিরে তাকায় শুভ্র’র দিকে। খোলা শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে ক্ষাণিকটা রসিকতার ছলে শুভ্র’র মন্তব্যঃ- ভাবছি সিগারেট’টা ধরবো, আর নীল শার্ট সে যোগাড় হয়ে যাবে…!!! অতঃপর দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ে…..