গল্পটা_নিশ্চুপ_বালিকা’র(০৭)
রচনায়- অনামিকা ইসলাম ‘অন্তরা’
ঘড়িতে সময় রাত্রি ১১টা বেজে ৩৭মিনিট। খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে সেই সাড়ে ১০টার দিকে। জায়গাটা নতুন। হয়তো এ কারণেই ভালো লাগছিল না নীলিমা’র। কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ ছটফট করে বেরিয়ে পড়ে তাই ছাদের উদ্দেশ্য।
ছাদে উঠে থমকে দাঁড়ায় নীলিমা। ছাদের একপাশে দুরের ল্যাম্পপোস্টের আলোর দিকে তাকিয়ে চুপচাপ শুভ্র দাঁড়িয়ে।
চলে যাচ্ছিল নীলিমা। পিছু ডাকে শুভ্র। পূর্বের ন্যায় একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পিছু না ফিরেই প্রশ্ন করে, চলে যাচ্ছেন?!
আমতাআমতা স্বরে নীলিমা’র জবাব, জ্বী। না। মানে। আপনি। আসলে..(…)..?
ফিরে তাকায় শুভ্র। ধীর পায়ে দুর থেকে কাছে চলে আসে নীলিমা’র।
— কেন? কোথাও কি এমন লেখা আছে
নাকি যেখানে আমি থাকবো সেখানে
আপনি থাকতে পারবেন না?
— না মানে আসলে…
— হ্যা, বলুন…!
— আমি কি ছাদে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে পারি?
— আবারো! আচ্ছা এটা কি ধরনের প্রশ্ন
বলুন তো?!
— না মানে আপনার যদি কোন আপত্তি
থাকে। তাই আর কি….
— (নিশ্চুপ)
— মনে হচ্ছে আপনার আপত্তি আছে…
— হ্যাঁ, আপত্তি আছে আমার। ঘোর
আপত্তি। আপনি যান! দয়া করে আপনি
রুমে যান! ছাদে আপনার জায়গা নেই
কোন। কেননা এই ছাদের পুরো’টাই
এখন আমার দখলে।
পূর্বের দাঁড়ানো স্থানে ফিরে যায় শুভ্র। তাকে অনুসরন করে ভীরু পায়ে তার ঠিক পাশেই এসে দাঁড়ায় নীলিমা। নিরবতা। কিছুক্ষণ ঘোর নিরবতা বিরাজ করে দু’জনের মাঝে।
কিছু একটা বলতে গিয়েও বার বার থেমে যাচ্ছে নীলিমা। আসলে এই মুহূর্তে সে কি বলবে আর ঠিক কি বা বলা উচিৎ সেটাই বুঝতে পারছে না সে।
নীলিমা’র অগোচরে আড়চোখে নীলিমা’কে একবার দেখে নিয়ে আবারো মূর্তির ন্যায় দুরের রাস্তায় জ্বলে থাকা ল্যাম্পপোস্টের দিকে তাকিয়ে শুভ্র।
শুভ্র’র সে দৃষ্টি অনুসরন করে নীলিমা’ও তাকায় ল্যাম্পপোস্টের দিকে।
অকস্মাৎ শুভ্র’র কিছু বুঝে উঠা’র আগেই আবৃতি করতে শুরু করে-
তোমার শহরে লাখো মানুষের
আনাগোনা।
প্রতিদিন শত শত মানুষ
তোমার শহরে যাচ্ছে;
কেউ বেড়াতে, কেউবা কাজের তাগিদে।
খবরের কাগজেও প্রায়’ই দেখি সেই শহরের নাম,
যে জনবহুল শহরে তোমার হাত ধরে একদিন আমি হেঁটেছিলাম।
সহস্র ভীড় উপেক্ষা করে-
অজস্র মিনারে, সৌধে, রাজপথ, অলিগলি, বিলাসবহুল রেস্তোরায়, রমনার বটমূলে ঘুরে আমায় নিয়ে সেদিন’টি তুমি কাটিয়েছিলে;
অনর্গল কথা বলে,
হেসে হাসিয়ে পথ হেটেছিলে।
দীর্ঘ আঙ্গুল উঁচিয়ে বিভিন্ন দর্শনীয়ের সাথে আমায় পরিচয় করাচ্ছিলে।
আর আমি?!!!
সেসব দেখার ছলে তোমাকেই দেখছিলাম।
পায়ের আঙ্গুল ঘেষে ইয়া বড় বড় সব গাড়িঘোড়া,
দুর্দান্ত গোধূলী ছিল আমাদের উষ্ণ কাঁধ ঘেষে।
গাড়িচাপা পড়ব ভেবে হ্যাচকা টানে
সামলাচ্ছিলে ভ্যাবাচ্যাকা এই আমাকে।
অলস আমি, কিছুদূর হেঁটেই ক্লান্ত।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে, ঘরে ফিরতে চাই।
সেদিন আসবার কালে পরম আদরে
কাছে টেনে এই আমার চোখে চোখ রেখে অপলক তাকিয়ে ছিলে,
নাকে, মুখে, গালে, কপালে ভালোবাসার এক উষ্ণ পরশ এঁকে দিয়েছিলে।
জানতাম সইবেনা;
কোনকালে এত সুখ সয় নি আমার।
যে শহর তোমার পথের ভাগ দিয়েছিল এই আগন্তুককে,
সে-ই পথ ভাগ করে দিল তোমার আমার।
কত অবলীলায় আজ তুমি
সেই পথে হাঁটো অন্য ছায়ার সঙ্গে,
অন্য আঙুল ধরে!
কত অনায়াসে হেসে উড়িয়ে দিয়েছ স্মৃতির ফানুস!
পথক্লান্ত আমি কখন ঘোরের মধ্যে ফিরেছি এখানে,
নিজেই জানি না।
তবু আজও……
তোমার শহরের নাম
অথবা কোন জনসমুদ্রে ঢাকা রাস্তার ছবি আমাকে থামায়;
সেদিনের সেই পড়ন্ত বিকেলে ফেলে আসা
আমাদের একমাত্র জীবন্ত অধ্যায় আমাকে আজো কাঁদায়।
সেই কখন থেকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় নীলিমা’র দিকে তাকিয়ে শুভ্র। সেদিকে দৃষ্টি নেই নীলিমা’র। নীলিমা’র দৃষ্টি দুর বহুদুরে।আবৃতি শেষেও মিনিট দুয়েক চুপচাপ পূর্বের ন্যায় একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল নীলিমা। তারপর শুভ্র’র দিকে না তাকিয়েই একটা সময় রুমে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। পিছু ডেকে বলে উঠে শুভ্র-
‘কত যে ছবি জমা থাকে মনে কেই বা তার খবর রাখে…’
ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পূর্ব স্থানে গিয়ে দাঁড়ায় নীলিমা। পাশাপাশি একই ভঙ্গিতে গম্ভীর দৃষ্টিতে দুরের ল্যাম্পপোস্টের দিকে তাকিয়ে শুভ্র’ও। আর সেদিকে তাকিয়েই শুরু হয় দুজনের কাব্য কথন। শুরু’টা শুভ্র’ই করে…
— বালিকা তোমার মনের মাঝে
কেন আজি শ্রাবণ ব্যথা
সরিয়ে তারে শুনাও আজি
বসন্তের’ই ফাগুন কথা।
— যে গেছে সে কি আসবে ফিরে,
চোখের জলে স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু না…
— জল ভরা মেঘে
যদিও শ্রাবন অবিরত,
তবুও বসন্ত বয়ে চলে চুপিসারে
ফল্গুধারার মত……
— তুমি চলে গেলে,
বসন্তের ছোঁয়া মুছে গেছে
জীবন থেকে।
বাইরে আকাশে
আজও শিমুল পলাশ রঙ সাজায়,
মন মরুতে চর জেগেছে
শ্রাবন রাতে ভিঁজিয়ে যায়।
তোমাকে ছুঁয়ে থাকা স্বপ্নগুলো
আজও আমায় গুমরে কাঁদায়,
এখন জেনেছি আমি
সে আর আসে না ফিরে
যে চলে যায়।
— বসন্ত চিরকাল আসে
আজও এসেছে।
মনের জানালা খুলে দ্যাখো
তার ছোঁয়া পাবে।
আমাদের সৌভাগ্য
বসন্ত আমাদের দরজায় আসে,
আমাদের তার দরজায় যেতে হয় না।
— আমার দরজায় আর আসে না …
— আশাহত হতে নেই।
একটু পরে কি হবে,
তুমি আমি কেউ জানিনা!
আশায় তো জীবন, তাই না?
‘হ্যাঁ, সে আশাতে’ই তো বেঁচে থাকা।’
একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নীলিমা।
পাশ থেকে শুভ্র’র জবাব, তারপর! রাত্রি তো অনেক হলো। রুমে যাবেন না?
শান্ত গলায় নীলিমা’র জবাব, হ্যাঁ! চলুন…
দ্রুতপায়ে ছাদ ছেড়ে রুমের দিকে পা বাড়ায় নীলিমা। তাকে অনুসরন করে শুভ্রও যাচ্ছে নিজ রুমে….
#