হৃদ মাঝারে রেখেছে তারে পর্ব-০৬

0
419

#ধারাবাহিক গল্প
#হৃদ মাঝারে রেখেছে তারে
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী

সেজানের ডিভোর্সের ধাক্কাটা সামলাতে আমাদের পরিবারের কিছুটা দিন সময় লাগলো। যদিও আমরা জানতাম এ রকমই হওয়ার কথা ছিলো তারপরও মিছে আশা কুহুকিনীর মতো আমরাও তলানীতে একটু আশা ধরে রাখতে চাইলাম। আসলে রোকাইয়ার মুখের দিকে তাকালে খুব মায়া লাগে। মা থেকেও নেই আর বাবা যদিও টএখন ওকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু সেজানের তো একটা জীবন আছে। বিয়ে করে সেজানকে তো সংসারী হতে হবে। ওর জীবনটাও তো এভাবে চলতে পারে না। জীবনের পুরোটা সময় পড়ে আছে। সেজানের বিয়ে হলে ওর নতুন বউ ওর মেয়েকে কিভাবে নিবে সেটাও ভাবনার বিষয়। কপালগুনে অনেক সময় সৎ মা ভালো হয়। অবশ্য আমার মেয়েটার উপর অনেক মায়া পড়ে গেছে। সাদাফ আর রোকাইয়া আপন ভাইবোনের মতো বড় হচ্ছে। সেজানের আপত্তি না থাকলে রোকাইয়াকে আমার কাছে রেখে দিবো।

কিছুদিন পর এক ছুটির দিনে আমি ফজরের নামাজ পড়ে ছাদে উঠলাম। কিছু ফল আর ফুলের গাছ লাগিয়েছি। যদিও মিনারা খালার ছেলে শাহেদ গাছ গুলোর দেখাশোনা করে তারপরও আমার হাতে সময় থাকলে আমি গাছের যত্নে হাত লাগাই। সেদিন ছাদে উঠে গাছের গোড়ার আগাছাগুলো পরিস্কার করতে লাগলাম। এমন সময় আমার শ্বশুর কাশি দিয়ে ছাদে এসে আমায় বললেন,
——-কি করছো সালেহা?
——তেমন কিছু না বাবা? কিছু বলবেন?আপনি তো বেশ কিছুদিন নিচে নামেননি।
——তোমার হাতে সময় থাকলে একটু বস। গল্প করি।
আমি আর উনি ছাদের স্টিলের চেয়ারটায় বসলাম। ভোরের মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। বেশ ভালো লাগছে। আমার শ্বশুর বললেন,
——ভোরের হাওয়াটা খুব ভালো লাগছে তাই না। কথায় আছে ভোরের হাওয়া লক্ষ টাকার দাওয়া। জানো, দু,দিন আগে তোমার কাছে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি বুঝি এই যে তোমার শাশুড়ীকে আমি যে স্বপ্নে দেখি এবং সেই গল্পগুলো তোমার কাছে বলি এতে আমার ছেলেদের ধারণা হচ্ছে আমার মানসিক সমস্যা শুরু হয়েছে। ওরা মনে হয় আমার কথাগুলো বিশ্বাস করে না। তাই সন্কোচে আমি তোমার কাছে যাইনি।
——বাবা কে কি মনে করলো এতে আমাদের বাপ মেয়ের কিছু আসে যায় না। আমি আপনার সব কথা বিশ্বাস করি। আপনি নিঃসন্কোচে আমার কাছে সব কথা শেয়ার করবেন।
——-তোমার সাথে তোমার শাশুড়ীর মায়ের কিছু কিছু ব্যাপারে বেশ মিল আছে। ও খুব গাছ ভালোবাসতো। তোমার শাশুড়ী মা কিন্তু খুব ডানপিঠে ছিলেন। সাপ বিচ্ছু কিছুই ভয় পেতো না। কিন্তু তেলাপোকা দেখে ভয় পেতো। জানো, একবার আমি আমার শ্বশুর বাড়ি কুমিল্লার নবীনগর থানায় বেড়াতে যাই। বিয়ের পরের কথা। সময়টা ছিলো গরম কাল। আমি আর ও রাতে কেবল শুয়েছি। মাঝরাতে ফোঁস ফোঁস শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। মশারী টাঙ্গানো ছিলো। মশারীর ভেতর থেকে দেখতে পারছি আমার থেকে এক হাত দূরে ফণা তোলা সরীসৃপটার চোখ অন্ধকারে জ্বল জ্বল করছে। মনে হলো সাক্ষাত মৃত্যুদূত আমার সামনে। পাশে তোমার শাশুড়ী ঘুমাচ্ছিলো। আমি চিমটি কেটে ওর ঘুম ভাঙ্গালাম। ভয়ে তখন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কোনো রকমে বললাম সা—-প। ও সরীসৃপটার দিকে তাকিয়ে বললো,
——তুমি ওর দিকেই তাকিয়ে থাকো। বাকীটা আমি দেখছি।
ও আস্তে করে হারিকেনের আলোটা একটু বাড়িয়ে দিলো। তারপর ঘরের কোনায় রাখা ছিলো একটা ট্যাটা। ওটা দিয়ে সাপটার মাঝ বরাবর আঘাত করলো। আমি যতনা সাপটা দেখে ভয় পেয়েছি তার থেকে তোমার শাশুড়ীর কান্ড দেখে আরো বেশী ভয় পেয়েছি। সাপটা না মরা পর্যন্ত ট্যাটা টা ধরে রাখলো।

আমার শ্বশুরের মুখে এই কথা শুনে আমার শিরদ্বাড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমি ভাবলাম একটা মানুষ তার জীবন সঙ্গীনিকে কতটা ভালোবাসলে মৃত্যুকে পরোয়া করে না। বাকি ঘটনা জানার জন্য আমার শ্বশুরকে বললাম,
——বাবা সাপটাতো মাকে ছোবল দিতে পারতো?
——আমিও তোমার শাশুড়ীকে সে কথাই বলেছিলাম। ও কি বললো জানো,
——ওতো তোমাকে টার্গেট করেছে। ওকে আমি না মারলে ও তোমাকে ঠিক ছোবল দিতো। আমি বেঁচে থাকতে এটা হতে পারে না। মরতে হলে আমি আগে মরবো। আমি অবাক হয়ে সেদিন তোমার শাশুড়ীকে দেখলাম আর ভাবলাম ভালবাসার কাছে মানুষের কোনো ভয় ডর থাকে না।
কথাগুলো বলে উনি নিরব হয়ে গেলেন। আমার তখন শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে মনে হলো স্মৃতির উঠোনে উনি হারিয়ে গেছেন। আমি শাহেদকে আমাদের জন্য চা দিতে বললাম। তারপর আমার শ্বশুরকে বললাম,
——-এর পর কি হলো বাবা?
—–তারপর বাসার সবাইকে ডেকে এই ঘটনা বলা হলো। আমার শ্যালক এসে মরা সাপটাকে সরিয়ে ফেললো। এরপর আবার সবাই ঘুমানোর উদ্যোগ নিলাম। এমন সময় একটা তেলাপোকা উড়ে এসে ওর গায়ে পড়লো। ও দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
——তেলাপোকাটা মেরে ফেলো। আমার খুব ভয় করছে।
আমি এবারও অবাক হয়ে গেলাম। যে কিনা একটু আগে বিষাক্ত গোখরাে সাপটাকে এক কোপে মেরে ফেললো সে একটা তেলাপোকা দেখে ভয়ে আমার বুকে আশ্রয় নিলো।
এই ঘটনা বলে আমার শ্বশুর শিশুর মতো হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে উনার চোখ দুটো জলে ভরে গেলো।
মানুষটার জন্য আমার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। বাইরে থেকে বুঝা যায় না তার বুকের গভীরে কতটা ব্যথা লুকিয়ে আছে। আমি উনাকে স্বাভাবিক করার জন্য বললাম,
——বাবা, আপনি এখন মাকে স্বপ্নে দেখেন না?
উনি চোখের জল মুছে বললেন,
——-দেখিতো। সে কথা বলতেই তোমাকে বসতে বলেছি। দু,দিন আগের রাতে আবার তোমার শাশুড়ী মাকে স্বপ্নে দেখলাম। আমরা দুজন একটা ডিঙ্গি নৌকায় মেঘনা নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছি । আকাশে আষাঢ়ের ভরা পূর্ণিমা। চারিদিকটা মায়াবী জোৎস্নায় ভিজে রয়েছে। চাঁদিমার আলোয় ওকে অপূর্ব লাগছে। চাঁদের শুভ্র আলো আর ওর পরণের সাদা শাড়িতে ওকে অপ্সরীর মতো মনে হলো। বৈঠা হাতে আমি ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছি। আর ভাবছি মানুষ এতো সুন্দর হয় কিভাবে? ও আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। আমার চোখে মুখে এতটাই মুগ্ধতা ছিলো যে সুনামী হলেও মনে হয় আমি টের পেতাম না। হলোও তাই। অকস্মাৎ একটা ঢেউ এসে নৌকোটা উল্টে ফেলে দিলো। আমি পানির তলায় ডুবে যেতে লাগলাম। তখন তোমার শাশুড়ী আমাকে টেনে ধরে সাঁতরে নদীর তীরে উঠালো। আমার পেটে কিছুটা পানি ঢুকে গেছে। আমার অবাক লাগলো ও যখন বেঁচে ছিলো তখন ও এভাবে আমাকে আগলে রাখতো আবার দুনিয়া থেকে চলে যাবার পরও স্বপ্নেও দেখলাম ও আমাকে কিভাবে আগলে রাখে? আমার কাছে খুব অবাক লাগলো।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে