হৃদ মাঝারে রেখেছে তারে পর্ব-০৫

0
466

#ধারাবাহিক গল্প

পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী

—–তুমি এ কেমন প্রশ্ন করলে বৌমা? তোমার কি মনে হয় আমি সিজোফ্রেনিক পেশেন্ট। তোমার শাশুড়ীর সাথে আমি সত্যিই বাস্তবে এ ভাবে সময় কাটিয়েছি?
আমি লজ্জিতভাবে উনাকে বললাম,
——না, বাবা না, আমি এটা বলতে চাইনি। মানে আমার একটা ছোট্ট ভুল হয়ে গেছে। আমি জানি স্বপ্নে মায়ের সাথে আপনার দেখা হয়েছে। আসলে আমি জানতে চাইছিলাম স্বপ্নটা কখন দেখেছেন।

একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমাকে তো আরমান আগেই সাবধান করেছিলো। বাবা এই বিষয়ে অনেক সেনসেটিভ। এখন যদি উনি কিছু মনে করেন কিংবা আবার বন্দী জীবন যাপন করেন তাহলে তো মুশকিল হয়ে যাবে। উনি মানসিকভাবে সুস্থ আছেন কিনা এটা জানার জন্যই আসলে আমি প্রশ্নটা করেছিলাম।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে ভালোভাবে আমাকে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর আবার বলা শুরু করলেন।
—–গতরাতে আমি তাহাজ্জুদ পড়ে তোমার শাশুড়ীর জন্য আল্পাহপাকের কাছে প্রার্থনা করেছি। আমি আসলে ওকে এতোদিন না দেখে থাকতে পারছিলাম না। তাই নিজের কষ্টের কথাগুলো আমার পরম করুনাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে পেশ করলাম। আর ওর জন্য প্রাণভরে দোয়া করলাম। আমি দোয়া করতে গিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। যখন আমার প্রার্থনা শেষ হলো আমি দেখলাম দুচোখ দিয়ে এতটাই অশ্রু ঝরেছে কখন যে আমার পাঞ্জাবীর গলাটা ভিজে গেছে আমি টের পাইনি। তবে নিজেকে অনেক হালকা লাগলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত তিনটা বাজে। ভাবলাম ফজরের আযানের কিছুটা দেরী আছে বিছানায় একটু গড়িয়ে নেই। রাজ্যের ঘুম নেমে এলো আমার দুচোখে। ঘুমটা খুব একটা গাঢ় ছিলো না। তোমার শাশুড়ী চলে যাওয়ার পর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। তখন চারিদিকে ফজরের আযান হচ্ছে। অনেক দিন পর ওকে দেখে আমার এতোটাই ভালো লাগলো ওকে হারানোর বেদনা এক লহমায় দূর হয়ে গেল। আমি আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করেছি মাঝে মাঝে ওকে যদি আমি স্বপ্নেও দেখতে পাই তাহলেও আমি খুশী। এর বেশীকিছু আর চাওয়ার নেই।
যাক আমার শ্বশুর স্বাভাবিকভাবে কথা বলা শুরু করাতে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এরপর
উনাকে নিরব থাকতে দেখে বললাম,
——বাবা, মা তো আপনাকে ভীষণ ভালোবাসতো।
——সে কথা আর বলতে। ও মনে হয় আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না বলে আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো। জানো ও সব সময় আমায় বলতো ও আগে চলে যাবে। আমি ভাবতাম ও আবেগী হয়ে এ কথাটা বলে। কেননা বয়সে তো আমি ওর থেকে দশ বছরের বড়। সে হিসাবে আমার আগে চলে যাবার কথা। কিন্তু ও দিব্যি আমাকে একা করে চলে গেল। ওর রান্না করা সব খাবার আমার কাছে অমৃতের মতো লাগতো। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করতাম, ” তোমার খাবারে এতো স্বাদ কেন”?
ও কি বলতো জানো,
ও বলতো,”রান্না করার সময় খাবারের সাথে আমার প্রতি ওর ভালোবাসাটা নাকি মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। সে জন্য নাকি অমৃতের মতো লাগে”।
ও যখন এই কথাগুলো বলতো তখন ওর চোখে মুখে অদ্ভূত মুগ্ধতা বিরাজ করতো। আমারও এমনটা হতো। ওকে যতই দেখতাম ততই আরো বেশি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে মন চাইত। ওর সব কিছুই আমার ভীষণ ভালো লাগতো। হয়ত আমায় ছেড়ে চলে যাবে বলে ওকে দেখার তৃপ্তি মিটতো না। ও যখন হাসতো আমার মনে হতো আমার পুরো পৃথিবী হাসছে।

সেদিনের পর থেকে আমার শ্বশুর যেদিন রাতে শাশুড়ী মাকে স্বপ্নে দেখতো সেদিনেই উনি আমার কাছে চলে আসতেন। আমি উনার মুখ দেখেই বলতাম,
——-বাবা আজ কি মাকে স্বপ্নে দেখেছেন?
উনি উৎফুল্ল হয়ে আমায় বলতো,
——-তুমি কিভাবে বুঝলে?
——-আপনার চেহারা দেখে বুঝেছি। আপনার চোখ মুখ খুব ঝলমল করছে। এক ধরণের দ্যূতি ছড়িয়ে আছে।
উনি খুব খুশী হয়ে যেতেন। আমার তখন মনে হতো আমার শাশুড়ী মা খুব ভাগ্যবতী রমনী। অনেক ভাগ্যে এরকম স্বামী কপালে মেলে। বেঁচে থেকে স্বামীর অফুরান ভালোবাসা পেয়েছে। মৃত্যুর পরে স্বামী উনার জন্য আল্লাহপাকের কাছে দু,হাত তুলে প্রার্থনা করছে। এর থেকে বড় প্রাপ্তি জীবনে আর কি হতে পারে। অথচ আমি আমার বাবা মায়ের দাম্পত্য জীবন দেখেছি। যেমন সবারটা হয় উনাদের টাও তেমন ছিলো। এমনকি আমার নিজের বিবাহিত জীবনও অন্যান্য কাপলদের মতো। সেদিক থেকে আমার শ্বশুর শাশুড়ী অনেক ভাগ্যবান। দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসতো। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উনাদের ভালোবাসা একটুও কমেনি। বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও শাশুড়ী মারা যাবার পর শ্বশুরকে নিয়ে আমরা সবাই খুব টেনশনে ছিলাম। কিন্তু উনি এখন অনেকটা সামলে উঠেছেন। আসলে সময় মানুষকে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলতে শিখিয়ে দেয়। যার ফলে প্রিয়জন ছাড়া মানুষ একসময় বাঁচতে শিখে যায়।
কিন্তু আমার শ্বশুরের মাঝে মাঝে আমার শাশুড়ী মাকে স্বপ্নে দেখা এবং উনার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো আমার সাথে আবার শেয়ার করা এই বিষয়গুলো নিয়ে আমার বড় ভাসুর খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। প্রথম প্রথম বিষয়টা সবাই স্বাভাবিকভাবে নিলেও এখন আমি বাদে সবাই ভাবছেন আমার শ্বশুরের হয়তো মানসিক সমস্যা শুরু হয়েছে। এবং উনাদের ধারণা আমার শ্বশুর শাশুড়ী মাকে নিয়ে যে কথাগুলো বলেন সবগুলোই আমার শ্বশুরের বানানো কথা। উনারা সবাই আমার শ্বশুরকে
সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে চাইছেন। কিন্তু আমার কাছে তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। আসলে উনি উনার স্ত্রীকে যে প্রচন্ড ভালোবাসেন এটা হয়তো তারই বহিঃপ্রকাশ।
এভাবে কালের ঘড়িতে পাঁচবছর সময় পার হয়ে যায়। মাঝে মাঝে আমার বাসায় ভাসুর দেবরদের দাওয়াত দেই। সবাই একসাথে অনেক আনন্দ করি। বাবাও আমাদের সাথে অংশ নেন। সাদাফ এখন ক্লাস টু তে পড়ে। রোকাইয়া ক্লাস ওয়ানে পড়ে। বড় ভাইয়ার মেয়ে রাইমা সিক্সে পড়ে। রায়ানের মেয়েটার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। ও নার্সারীতে কেবল ভর্তি হয়েছে। বাবা এই নাতি নাতনী গুলোর সাথে খুব কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করেন। বিশেষ করে বাবা রোকাইয়াকে ভীষণ পছন্দ করে। ওর চেহারায় আমার শাশুড়ী মায়ের আদল আছে। এর মাঝে হঠাৎ রুহী দেশে ফিরে আসে। সেজানের কাছ থেকে পরিপূর্ণ ডিভোর্স চায় এবং রোকাইয়াকে নিয়ে যেতে চায়। রোকাইয়ার বয়স সাত বছর সেই তুলনায় ও অনেক ম্যাচিউর। ও বাবা আর দাদুকে ফেলে মায়ের সাথে কানাডায় যেতে চায় না। এদিকে আমার শ্বশুর ডিভোর্সের কথা শুনে খুব মন খারাপ করে। উনি বুঝতেই পারেন না মানুষ কেন সংসার ভেঙ্গে চলে যায়। আসলে আমরা সবাই চাইছি রুহী আর সেজানের বিষয়ে একটা ফয়সালা হোক। এভাবে তো চলতে পারে না। রুহী তো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে সেজানের সাথে ডিভোর্স হয়ে গেলে ও বিয়ে করে ফেলবে। অলরেডী ওর একজনের সাথে রিলেশন আছে। সেজানেরও বিয়ে করা উচিত। কারো জন্য জীবনকে থামিয়ে রাখা উচিত নয়। সেজানও এই সম্পর্ক থেকে এখন বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমরা ভেবেছিলাম একসময় রুহী হয়তো ফিরে আসবে। ওর সন্তান আছে এ বাড়িতে। সেজানের টানে না হলেও অন্তত ওর সন্তানের টানে একসময় এ বাড়িতে ও ফিরে আসবে। কিন্তু আমাদের সব ধারণা পাল্টে দিয়ে রুহী সেজানের কাছ থেকে ডিভোর্স নিয়ে চলে যায়। রোকাইয়া সবার চোখের মনি হয়ে এ বাড়িতে থেকে যায়।
এই পৃথিবীতে কত ধরনের মানুষ বাস করে। কেউবা আজীবন তার প্রেমকে বুক দিয়ে আগলে রাখে। আবার কেউ ভুল মানুষকে ভালোবেসে যন্ত্রনার অনলে পুড়তে থাকে। অথচ তার ভালোবাসাটা ভুল ছিলো না। মানুষটা ভুল ছিলো।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে