হৃদ মাঝারে রেখেছে তারে পর্ব-০৪

0
566

#ধারাবাহিক গল্প
#হৃদ মাঝারে রেখেছে তারে
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

আরমান ঘুম জড়ানো চোখে আমায় বললো
——এতো ভোরে তোমায় কে ফোন দিয়েছে?
——বাবা,
——হঠাৎ, আব্বুর শরীর ভালো আছে তো?
——গলা শুনে সেরকম মনে হলো না। কিন্তু বাবা আমাকে আজ অফিস থেকে ছুটি নিতে বলেছে।আমিও ছুটি নিবো ভাবছি। আসলে মা মারা যাবার পর বাবা এই প্রথম আমার সাথে কথা বলতে চাইছেন তাই মনে হলো বিষয়টা নিশ্চয় জরুরী। তুমি কি কিছু আঁচ করতে পারছো, বাবা আমার সাথে কি বিষয়ে কথা বলতে চান?
——হয়ত অনেকদিন পর মনে হয়েছে আমাদের সবার সাথে তার একটু সময় কাটানো উচিত।
——আমার কিন্তু সে রকম মনে হচ্ছে না।
——তোমার কি মনে হচ্ছে?
——খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই যেমন বাবা হয়ত আর একলা থাকতে পারছেন না।
আরমান শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে আমায় বললো,
——যা বলেছো এর থেকে আর বেশী কিছু বলোনা। এমন কিছু বলো না যেন নিজের সাথে নিজে ছোটো হয়ে যাও।
——এখানে ছোটো হওয়ার কি দেখলে। এটা তো বাবার বৈধ অধিকার। এছাড়া জমিলা ফুফু বলেছে বাবা চাইলে—–
——আমি তোমাকে একটু আগে কি বললাম? খাঁটি বাংলা ভাষায় বলেছি। হিব্রু ভাষায় তো বলিনি যে বুঝতে অসুবিধা হবে।
——তুমি এতো রিঅ্যাক্ট করছো কেন?
——করছি কারণ আমি আমার বাবা মায়ের সম্পর্কের ব্যাপারে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। তুমি আমায় বলতে, আমি নাকি আমার বাবার মতো রোমান্টিক না। কেন নিজেকে একটু সরিয়ে রাখতাম জানো? কারণ বাবা মাকে দেখেছি। এতো ভালোবাসায় যেমন সুখ আছে তেমনি বিপরীত পাশে এক আকাশ কষ্ট জমা আছে। কারণ সবাইকে একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এতো ভালোবাসায় অভ্যস্ত হওয়ার পরে একজন যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় তখন বেঁচে থাকা মানুষটির জন্য সারভাইভ করা কষ্ট হয়ে যায়। ঐ মানুষটি তখন মৃত্যুর জন্য প্রহরগুনে। যারা নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে তাদের কথা আলাদা। আর যারা তার ভালোবাসার মানুষের জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে পারে না তাদের জীবনটা দুর্বিসহ হয়ে উঠে। পৃথিবীতে সবাইকে যে একই রকমভাবে বাঁচতে হবে তার তো কোনো মানে নেই। প্রতিটি মানুষের জীবনবোধ আলাদা। বাবাকে নিয়ে আমি খুব চিন্তায় ছিলাম। ভাবছিলাম সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাবো। যাক বাবা আজ নিজেই যখন তার স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে বের হয়ে আসছেন বিষয়টা আমার কাছে ভালো লাগছে। তুমি কিন্তু বাবাকে এমন কিছু বলো না, উনি যেন আহত না হোন। খুব ভেবে চিন্তে কথা বলবে। মায়ের ব্যাপারে বাবা খুব সেনসেটিভ।
কথাগুলো বলে আরমান ওজু করতে ওয়াশরুমে গেল। আমি কিচেনে হাঁড়িপাতিল ধোয়ার শব্দ শুনতে পারছি। কিচেনে গিয়ে সাদাফ আর রোকাইয়ার জন্য চাওমিন বানিয়ে নিলাম। মিনারা খালা চা বানিয়ে ওর ছেলেকে দিয়ে বাবার চা উপরে পাঠিয়ে দিলো। আমাদের জন্য টেবিলে চা দিয়ে আমায় বললো,
——খালা আজকে নাস্তা কি হইবো? রুটি না পরোটা।
——আজ নাস্তা আমি বানাবো। আপনি পোলাওয়ের চাল ধুয়ে রেডী করেন। মুগডালটা হালকা ভেজে ধুয়ে ফেলুন। পেঁয়াজ কেটে পাশাপাশি অন্যান্য মশলা রেডী করেন। আমি চা খেয়ে আসছি।
—–আপনি অফিসে যাইবেন না?
——আজ ছুটি নিয়েছি।
ভূনা খিচুড়ী আর ডিমভাজি করে টেবিলে দিলাম। সাথে রসুনের আচার। সেজান আরমান নাস্তা করে অফিসে গেল। আমি টেবিলে আমার আর বাবার জন্য খিচুড়ী বেড়ে নিয়ে মিনারা খালাকে তার ছেলেকে নিয়ে নাস্তা করতে বললাম। বাবার জন্য আমি টেবিলে বসে অপেক্ষা করছি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে আটটা বাজে। বাবা ঠিক সকাল ন,টায় ব্রেকফাস্ট করেন। আমার শাশুড়ী মা মারা যাওয়ার পরেও তার এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। দুপুর দু,টায় লাঞ্চ করেন আবার রাত ন,টার মধ্যে ডিনার সারেন। আমি ডাইনিং রুম থেকে দেখতে পারছি বাবা সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসছেন। সাদা আদ্দির কাপড়ের পাঞ্জাবী পরেছেন। সাথে পাজামা পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো সাদা চাপ দাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে। দেখে মনে হলো তার পুরো অবয়বে এক ধরণের দ্যূতি ছড়িয়ে পড়ছে। সত্তোরোর্ধ একটা পুরুষ মানুষকে এখনও এতো সুন্দর হ্যান্ডসাম লাগে আমি আমার শ্বশুরকে না দেখলে জানতেই পারতাম না। আমি বাবাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে বললাম,
——বাবা আগে নাস্তাটা করে নিন।
——-হুম, আমারতো সময়মতো না খেলে চলে না। আজ ব্রেকফাস্টের মেনু কি?
——আপনার পছন্দের ভূনা খিচুড়ী।
আমরা দুজনে নাস্তা করে নিলাম। তারপর আমার শ্বশুর রিল্যাক্স হয়ে বসে আমায় বললো,
——জানো সালেহা আজ না তোমার শাশুড়ীর সাথে আমার দেখা হয়েছে।
আমার তো চমকে উঠার পালা। একটা মৃত মানুষের সাথে কিভাবে দেখা হতে পারে আমার মাথায় কিছু কাজ করছে না। উনার অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে উনি যেন কিছুক্ষণ আগে উনার সাথে দেখা করে এসেছেন। পুরো শরীরে এক ধরণের সুখানুভূতি ছড়িয়ে আছে। ভালো করে তাকে অবজার্ভ করতে লাগলাম। সে মানসিকভাবে আসলেই ঠিক আছে তো?
আমার শ্বশুর চোখ বন্ধ করে আবার বলা শুরু করলেন।
——জানো বৌমা, তোমার শাশুড়ী না আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়েছে। সেই বিয়ের সময়কার মতোন। ছিপছিপে গড়ন, লম্বাচুল। একটা সাদা শাড়ি পরে ছিলো। মনে হলো সদ্য গোসল করে এসেছে। চুলের আগা দিয়ে তখনও টপটপ করে পানি পড়ছে। চোখে সুরমা দেওয়া। আমার নাকে ছ,মাস পর ওর পরিচিত সুবাসটা লাগলো। আমি প্রতিদিন ওর জন্য অপেক্ষা করেছি। কবে ওর সাথে আমার দেখা হবে। জানো তো অপেক্ষার প্রহর অনেক দীর্ঘ হয়। এই ছ,মাস আমার কাছে ছয় যুগের মতো লেগেছে। আমি তোমার শাশুড়ী মাকে দেখে বললাম,
——তোমার এতোদিনে সময় হলো আমার কাছে আসার।
ও কি বললো জানো,
—–কি বললো বাবা?
——ও আমায় বললো নতুন জায়গায় এসেছি ঘরটা গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগে। তুমি তো জানো আমি একটু গুছিয়ে থাকতে পছন্দ করি।
জানো সালেহা আমি ওর ঘরটা দেখতে চাইলাম। ও আমাকে দূর থেকে দেখালো। দেখে মনে হলো ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। আমি ওর ঘরে যেতে চাইলাম।
ও আমায় বললো,
—–যখন তোমার সময় হবে তখন তোমায় নিয়ে যাবো। এর থেকে একটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাবো। তোমার খুব ভালো লাগবে।
ও আমার হাত ধরে একটি শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলো। পুকুরে অনেক পদ্ম ফুটে রয়েছে।সুন্দর সুন্দর হাস সাঁতার কাটছে। পানিটা এতো স্বচ্ছ ছিলো যে নীচে রঙিন মাছগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।পুকুরটার চতুর পাশে নানা ধরণের গাছ লাগানো রয়েছে। আসলেই জায়গাটা খুব সুন্দর ছিলো। আমরা পাশাপাশি বসলাম। ওর হাতের আঙ্গুলগুলো ছুঁয়ে দিলাম। খুব সুন্দর। নখটা খুব সুন্দর করে কাটা। এমন সময় একটা মেয়ে এসে বললো,
আপনাদের দুগ্লাস শরবত দিবো? তোমার শাশুড়ী বললো,
——এক গ্লাস নিয়ে এসো।
তারপর মেয়েটা একটা সুন্দর কাঁচের গ্লাসে আমাদের জন্য শরবত দিয়ে গেল। আমরা দুজনে দুটো স্ট্র দিয়ে একগ্লাসে শরবত খেলাম। আমি অবাক হয়ে তোমার শাশুড়ী মাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—–তোমার এখনও মনে আছে আমরা যে এক গ্লাসে শরবত খেতাম। এক কাপে দুজন চা খেতাম।
ও কি বললো জানো,
——মনে থাকবে না আবার। আমি যদি এসব ভুলে যাই তাহলে নিজেকেই তো ভুলে যাবো।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো। ও বললো,
—–আমায় তো এখন উঠতে হবে।
আমি ওকে অনুরোধ করে বললাম,
—–আর একটু থাকো না আমার পাশে।
—–আজ না আবার অন্য আর একদিন আসবো। তবে তোমায় কথা দিতে হবে তুমি আমার জন্য মন খারাপ করবে না। সবসময় হাসিখুশি থাকবে। ছেলে বৌমা নাতি নাতনীদের সাথে সুন্দর সময় কাটাবে। তুমি তো জানো বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়। এ কথা বলে ও চলে গেল।
আমি ওর গমন পথের দিকে চেয়ে রইলাম। মৃত্যু নামক দেয়াল দিয়ে আমাদের আলাদা করা হয়েছে। আমরা এখন দুই জগতের বাসিন্দা। এখন মিলনের জন্য শুধু অপেক্ষার প্রহর গোনা।
সালেহা আজকের রাতটা যেন খুব দ্রুত পার হয়ে গেল। তবে আমিও ভাবছি আমি এখন থেকে তোমাদের সাথে হাসিখুশীতে থাকবো। আমার শ্বশুরের শেষের কথাগুলো শুনে আমার বুকের ভিতরটা মোঁচড় দিয়ে উঠলো। আবার ভাবলাম মানসিক সমস্যা শুরু হলো কিনা। তাই কৌতূহল দমন করতে না পেরে বললাম,
—–বাবা, মায়ের সাথে আপনার কোথায় দেখা হয়েছে?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে