#ধারাবাহিক গল্প
#হৃদ মাঝারে রেখেছে তারে
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী
আমার শ্বশুর আসার আগেই সবাই উনাকে নিয়ে নানা কথা বলতে লাগলো। কেউ কেউ মায়া দেখিয়ে বললো,
——আহা, বেচারা বউ হারিয়ে এ বয়সে উনি একা কিভাবে থাকবেন?
কেউ কেউ আবার আগ বাড়িয়ে আমায় নানা পরামর্শ দিলেন। যেমন আমার শ্বশুরের কলিগ এর স্ত্রী জামিলা আন্টি আমায় বললেন,
——উনাকে একটা বিয়ে দিয়ে দাও। উনার তো মেয়ে নেই তাই বৌমা তোমাকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে।
উনার কথা শুনে আমার ফুফু শাশুড়ী বললেন,
——তেমন কোনো মেয়ের সন্ধান আপনার কাছে আছে?
——কত পাওয়া যাবে। অনেক আছে। আপনারা চাইলে আমি আমার পরিচিত জায়গায় খোঁজ করতে পারি।
আমার বড় জা শুনে বললো,
—–আমার শাশুড়ীর লাশটা দাফন হতে না হতেই আপনারা কিভাবে আমার শ্বশুরের বিয়ের কথা ভাবছেন আমার মাথায় আসে না। উনি আদৌ বিয়ে করতে চান কিনা সেটাতো আগে জানা দরকার।
আমার সেজ জা বললো,
——তুমি এতো রিঅ্যাক্ট কেন করছো আপু? প্রস্তাবটা তো মন্দ না। তাছাড়া আমরা সবাই জব করি। উনাকে সময় দেওয়ার মতো সময় আমাদের কারো হাতে নেই। এভাবে একা থাকতে থাকতে উনাকে ডিপ্রেশন পেয়ে বসবে।
——কিন্তু তারজন্য তো আমাদের একটু অপেক্ষাকরা উচিত।
আমি একটু অবাক হয়ে ভাবলাম, একজন মহিলা যখন বিধবা হয় তার সর্বাঙ্গে তৎক্ষনাত বৈধব্যে চিহ্ন বহন করার জন্য আমরা মেয়েরাই অগ্রনী ভুমিকা পালন করি। একবারের জন্য ভাবি না সদ্য স্বামীহারা নারীটির মনে কি চলছে। তার ভিতরে যে শোকের ঝড় বইছে তা যেন আমরা ভুলে যাই। অথচ একজন পুরুষের বউ মারা গেলে লাশ দাফনের সাথে তাকে বউ দেওয়ার জন্য আমরা মেয়েরাই এগিয়ে আসে। আমরা নারী হয়ে কিভাবে দ্বৈত সত্তার দুই রকম আচরণ করি।
যাইহোক শ্বশুর আব্বা এসে মেয়েমহলে দাঁড়িয়ে বললেন,
——লাশ তো দাফন হয়ে গেছে আপনারা এখন বাড়ি যেতে পারেন।
আমার ফুফু শাশুড়ী কাঁদো কাঁদো হয়ে শ্বশুরকে বললেন,
—–ভাইয়া তোমাকে এই শোকের সময়ে একা ফেলে আমি কিভাবে যাই?তাই দু,দিন তোমার কাছে থাকতে চাইছিলাম।
——তুমি থাকতে চাইলে থাকতে পারো। তবে আমায় নিয়ে এতো ভাবনার দরকার নেই। আমিও মানসিকভাবে একদম ঠিক আছি। আল্লাহ যে বান্দাকে ভালোবাসেন তাকে একটু তাড়াতাড়ি নিজের কাছে টেনে নেন। এতে আমার মন খারাপ করার কিছু নেই।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—–সালেহা তুমি আর আরমান এখন থেকে দোতলায় আমার বেডরুমে থাকবে। আর তিনতলায় তোমাদের বেডরুমটা আমার থাকার ব্যবস্থা করে দাও। আমি এখন থেকে তিনতলায় একাই থাকব। বড় বউ সেজ বউ তোমরা একতলা আর দোতলায় থাকার জায়গা করে নাও। আর হ্যা, সালেহা তোমার শাশুড়ীর ব্যবহার করা কোনো জিনিস যেমন বিছানার চাদর বালিশের কভার এমনকি ওর যত শাড়ি আছে সব মানুষকে বিলিয়ে দাও। শুধু আমার জন্য ওর ব্যবহার করা তছবিহ আর জায়নামাজ নিয়ে এসো। আর এখন থেকে আমার খাবার উপরে পাঠিয়ে দিবে।
তারপর আমার ছোটো দেবর সেজানকে ডেকে উনি বললেন,
——তুই চাইলে রোকাইয়াকে নিয়ে আমার পাশের রুমে থাকতে পারিস।
আমার শ্বশুরকে এতো স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে দেখে সত্যি খুব অবাক হয়ে গেলাম। উনার উপর দিয়ে যে এতোবড় ঝড় বয়ে গেল তার লেশমাত্র চিহ্ন উনার মাঝে নেই। উনার কথা শুনে এখানে সবাই পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগলো। এবং সবাই চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলো। শুধু ফুফু শাশুড়ী রয়ে গেলেন। আমার মা বাবাও চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন। বেয়াইদের মধ্যে আমার বাবা মা ঢাকায় থাকেন। বড় জায়ের বাপের বাড়ি চিটাগাং আর সেজ জায়ের বাপের বাড়ি চাঁদপুর।উনারা আসতে পারেননি। আসলে আমার শ্বশুর খুব বেশী দেরী করতে চাননি। দ্রুত লাশ দাফন করতে চেয়েছেন। আমার শাশুড়ীর নাকি সেরকম ইচ্ছা ছিলো।
আমিও খুব তাড়াতাড়ি শ্বশুরের ঘর খানা গুছিয়ে দিলাম। উনি ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে আমায় ডাকল। আমিও পড়িমড়ি করে তিনতলায় উনার ঘরের দিকে ছুটে গেলাম।
——-বাবা আমায় ডাকছেন?
——-এই ছবিটা এখানে কেন?
——না,মানে এটাতো আপনার আর মায়ের যুগল ছবি।
——তাতো আমি দেখতেই পারছি। আজ থেকে এই ছবিটা আলমারিতে তুলে রেখো।
আমি আরো অবাক হয়ে গেলাম। কত বিচিত্র মানুষের মন। বেঁচে থাকতে যাকে চোখে হারাতো মৃত্যুর পর তার কোনো চিহ্নই নিজের কাছে রাখতে চাইছে না। হয়ত এটাই প্রিয়তম স্ত্রীকে ভুলে থাকার উনার প্রয়াস। সেজানের মেয়েটা এই কয়দিনে আমার বেশ ভক্ত হয়ে গেছে। ওর ভক্ত হওয়ার কারণ হয়তো সাদাফ। দুজনের বয়স কাছাকাছি হওয়াতে সারাদিন ওরা খেলা করে সময় কাটায়। আমার বড় জায়ের মেয়েটা এদের থেকে বেশ বড়। ওর নাম রাইমা। রাইমা এ বছর ওয়ানে ভর্তি হয়েছে।সেজানের বউ কানাডায় চলে যাবার পর মেয়েটা আমার শাশুড়ী মায়ের কাছেই থাকতো। যাইহোক মেয়েটাকে আমার কাছে রেখে সেজানকে ডেকে বললাম,
——তুমি রোকাইয়াকে নিয়ে কোনো চিন্তা করো না। ও আমার কাছে ভালোই থাকবে। তুমি বরং বাবার কাছেই থাকো। উনার খেয়াল রেখো। তোমার বাকি ভাইয়েরা ভেঙ্গে পড়েছেন। আব্বাকে যদিও খুব শক্ত লাগছে তারপরও এসময় বাবাকে একা রাখা ঠিক না। হাজারো হোক এত বছরের সঙ্গী হারানোর বেদনা এতো তাড়াতাড়ি ভোলা সম্ভব নয়।
—–আমিও তাই ভাবছি। ভাবি এতোগুলো মানুষের খাবারের কি ব্যবস্থা হবে? আমি কি হোটেল থেকে খাবার কিনে আনবো?
——দেখি কি করা যায়?
আমার মা আমার আর সেজানের কথা শুনে আমায় ডেকে বললেন,
—–আজকে তোদের এখানে আমরা খাবার পাঠাবো। আমরা তাহলে এখন চলে যাই।
——তোমার তো কষ্ট হবে।
——অসুবিধা নাই। রুপা আর আমি দিব্যি রান্না করে পাঠাতে পারবো। তুই অত ভাবিস না।
বাবা তিনতলায় উঠে আমার শ্বশুরের সাথে দেখা করলেন। শ্বশুরও খুব স্বাভাবিকভাবে বাবার সাথে নীচে নেমে আসলেন। এমনভাবে কথা বলছেন যেন সবকিছু আগের মতই আছে। খুব স্বাভাবিকভঙ্গীতে আমার মাকে বললেন,
——যে মানুষটা আপনাদের আতিথেয়তা করতো সে তো এখন এই পৃথিবীতে নাই। তাই আপনারা আবার আসা বন্ধ করবেন না। ও নাইতো কি হয়েছে। আমার বৌমা মানে আপনার মেয়ে তো এবাড়িতে আছেন। মাঝে মাঝে আসবেন। আমাদের অনেক ভালো লাগবে।
আমার বাবা আমার শ্বশুরকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
—–আশরাফ বন্ধু আমার, আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করি উনি যেন তোমাকে এই শোক সামলে উঠার তওফিক দান করুন।
——আমায় নিয়ে তোমরা এতো ভেবো না। একমাস ধরে ও যে কষ্ট পেয়েছে এর থেকে আল্লাহপাক ওকে মুক্তি দিয়েছে আমি এতেই খুশী। আল্লাহপাক ওকে জান্নাতবাসী করুন এই দোয়া করি। যতদিন বেঁচে থাকবো এই দোয়া করে যাবো। তোমরাও ওর জন্য দোয়া করো।
যতক্ষণ সবাই বাড়িতে ছিলো শাশুড়ীর শোকটা ভুলে ছিলাম। তারপর পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মে আমার ভাসুর,দেবর জায়েরা সাথে রাইমাও চলে গেল এবং আমার ফুফুশাশুড়ীও চলে গেলেন বাড়ীটা যেন বিরানভুমিতে পরিনত হলো। আমারই খারাপ লাগলো তাহলে আমার শ্বশুরের বুকের ভিতরটা কেমন লাগছে তা সহজে অনুমেয়।
এই পৃথিবীতে সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আপন গতিতে সে চলতে থাকে। কারো শুন্যস্থানও খালি থাকে না। প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে একসময় শুন্যস্থানও পূরণ হয়ে যায়। আমার সেজ দেবর রায়ানের বউ কনসিভ করেছে। বিয়ের পাঁচবছর পর ওদের সন্তান হচ্ছে। শাশুড়ী মা বেঁচে থাকলে খুব খুশী হতেন।
দিন যায় মাস যায়। দেখতে দেখতে শাশুড়ী মা চলে যাওয়ার ছ,মাস পার হয়ে গেল। সবাই শোক অনেকটা সামলে নিয়েছে। কিন্তু আমার শ্বশুরকে নিয়ে আমরা সবাই চিন্তায় আছি। কারণ উনি যেন আপন ভুবনে পরবাসি হয়ে আছেন। যেন একদম স্বেচ্ছা নির্বাসন। এই ছয় মাসে উনি উপর থেকে একদম নিচে নামেননি। আমি আর আরমান মাঝে মাঝে উনাকে উপরে গিয়ে দেখে এসেছি। কিন্তু উনার আচরণে আমরা বেশীক্ষণ উনার কাছে থাকতে পারতাম না। একটা দুটো কথা বলার পর উনি আমাদের বলতেন,
—–তোমাদের কথা যদি শেষ হয়ে যায় তোমরা নিচে চলে যেতে পারো।
আমরাও নিচে নেমে আসতে বাধ্য হতাম। তবে উনাকে দেখে মনে হতো উনি যেন এই পৃথিবীতে নাই। উনার মন যেন অন্য কোথাও বিরাজ করছে। তবে এখনও জোৎস্না রাতে অনেক রাত অবধি ছাদে ঘুরে বেড়ান। উনাকে দেখাশোনার জন্য আমাদের কাজের খালা মিনারা বেগমের ছেলেকে আনা হয়েছে। কিন্তু উনার একাকীত্বের মুহুর্তগুলোতে উনি একা থাকতেই পছন্দ করেন। যারফলে ছাদে একা থাকার সময় ছেলেটাকে সঙ্গী করেন না।ছেলেটার বয়স সতেরো কি আঠারো হবে। তবে আমি সাদাফকে মাঝে মাঝে উপরে ওর দাদুর কাছে পাঠিয়ে দেই। এর মাঝে একদিন ফজরের নামাজের সময় শ্বশুর আব্বা আমায় ফোন দিয়ে বললেন,
——-সালেহা তুমি কি আজ বাসায় থাকতে পারবে?
——কেন আব্বা?
——-তোমার সাথে আমার কথা আছে।
——ঠিক আছে বাবা আমি অফিসে ফোন দিয়ে ছুটি নিয়ে নিবো।
—–ঠিক আছে আমি নিচে আসছি।
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। ছ,মাস পর আমার শ্বশুর প্রথম নিচে নেমে আমার সাথে কি জরুরী কথা বলবেন?
চলবে