হৃদয়ে তুমি পর্ব-০৭

0
958

#হৃদয়ে_তুমি
লেখনীতে:Waziha Zainab (নিহা)
সপ্তম পর্ব

এই মুহূর্তে আমার হুয়ায়ুন আহমেদের লেখা দুটো লাইন মনে পড়ছে
“প্রিয় মানুষের কাছে কখনো যেতে নেই তাতে আকর্ষণ কমে যায়”

সারা বাড়ি খুশির আমেজে ভরপুর।ফুফা ফুফি ও খুশিতে আত্মহারা।খুশি তো থাকারই কথা। ইতিমধ্যে আয়ান ভাইয়া পুরো এলাকা মিষ্টি বিতরণ করে দিয়েছে।চারদিকে এতো খুশির মাঝে আমার অস্থিরতা গতি বেগে বেড়ে যাচ্ছে_

সন্ধ্যায় ছাদে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে সূর্যের হারিয়ে যাওয়াটা দেখছি।পশ্চিম আকাশে চারদিকে ছড়িয়ে আছি সূর্যের লাল রক্তিম আভা।সূর্যের মতোই আমার জীবন থেকে সব আনন্দ হারিয়ে গেছে।জানিনা আর কখনো কি এই আনন্দ ফিরে পাবো আবার।এসব ভাবতেই চোখ দিয়ে পানি চলে এলো।আমি দু হাত দিয়ে চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিলাম যে আমার অগোচরে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখে তার জন্য বৃথা চোখের পানি না ফেলাই উত্তম

রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় চা বসিয়ে দিলাম সবার জন্য এর মাঝেই ফুফি আমাকে রান্নাঘরে দেখে বকাবকি শুরু করে দিয়েছে। ভাবিও সেইম কাজ করেছে। তারা আমাকে কোনো কাজই করতে দিচ্ছে না।

সবাই বিশ্বাসের কথা বলে,,,, আর যে আমাকে একআকাশ পরিমাণ ভালোবেসেছে তাকে আমি,,,,আমাকেই ঠকাতে দেখেছি। বিশ্বাস সবাইকে করা যায় কিন্তু সবাই বিশ্বাসের মুল্য দিতে পারে না। বাস্তবতা এমনই যাকে বিশ্বাস করবে সেই পেছন থেকে এসে চুরি মারবে। বিশ্বাস শব্দে বিশ ও আছে আবার শ্বাস ও আছে এবার ঠিক ভুল বেছে নেওয়া টা আমাদের দ্বায়িত্ব। বিশ্বাস তৈরি করতে পুরো জীবন লেগে যায় আর নষ্ট হয়ে যায় এক মুহুর্তে।

আলমারি গোছানোর সময় শাড়ির ভাজে চোখে পড়লো উনার আর ওই মেয়েটার বিয়ের ছবি। ছবিটা দেখেই বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা লম্বা নিশ্বাস এর মাঝেই উনি পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।উনার আভাস পেয়েই আমি টেবিল থেকে দিয়াশলাইয়ের একটা কাঠি দিয়ে ছবিতে থাকা মেয়েটার মুখের অংশ টা পুড়িয়ে দিলাম আমার হাত থেকে ছবি টা নিচে পড়ে গেলো।আমাকে এখন আবার এক অজানা ভয় গ্রাস করছে আমি আপাতত উনাকে এই বিষয়ে কিছু জানাতে চাই না।ডিভোর্সের পরে শুধু উনাকে একটা কথা জিজ্ঞাস করতে চাই কেনো করলেন উনি এমন।কেনো আমার সাজানো গোছানো জীবন টাকে অগোছালো করে দিলো।

উনি ছবিটা দেখলেন।উনি তোলার আগেই তাড়াতাড়ি করে আমি তুলে হাত পেছনে নিয়ে শাড়ি দিয়ে ডেকে পেললাম। উনি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বললেন
“কি লুকাচ্ছো তুমি
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিনা উনি আবার বললেন
” হাতে কি দেখি
আমি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললাম
“ককই ককিছু না তো”
কিন্তু উনি নাছোড়বান্দা আমার হাতে কি আছে দেখবেই দেখবে
আমি এবার উনাকে ধাক্কা মেরে বের হওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু কোনো লাভ হলো না উনি আমার এক হাত ধরে ফেললেন
হাত টা মুছড়িয়ে অন্য হাত থেকে ছবিটা নিয়ে নিলেন। মুহুর্তেই উনার মুখে নেমে এলো অন্ধকারের কালো ছায়া।

আমি উনার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি।উনার কোনো কথাই আমার মাথায় ডুকছে না উনি নিজের শরীরের সর্বো শক্তি দিয়ে চিল্লাচ্ছেন।
“আমি জানতে চাই এটার মানে কি” কোথায় পেলে তুমি এই ছবি।আর কে এই মেয়ে আন্স মি ড্যাম ইট
আমি উত্তর দিলাম না উনি আমাকে ঝাকুনি মেরে বললেন
“এভাবে তুমি বলবে না ওকে তাই তো”তোমার মুখ থেকে কিভাবে কথা বের করতে হয় আমি খুব ভালো করেই জানি”আমি তোমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। তাই এবার আমার ক্ষতি হলে তো তুমি অবশ্যই সবটা বলবে।

এতোটুকু বলেই উনি কিচ্ছুক্ষণ খোজাখুজি করে রান্নাঘর থেকে একটা ফল কাটার চুরি নিয়ে এলেন
“আমাকে আবারো জিজ্ঞাসা করলেন বলো এই ছবির মানে কি” আমার সাথে এই ছবি আর আমি বরের পোশাকে কেনো আর এই ছবি তুমি কোথায় পেয়েছো।আন্স মি”
এবার আমি শক্ত গলায় জবাব দিলাম
“এই ছবির মানে কি সেটা আমি না আপনি বলুন? বলুন কেনো আমার জীবনটাকে? কি ক্ষতি করেছিলাম আমি আপনার?নিজে থেকেই তো আমার জীবনে এসেছিলেন? এই মেয়েকেই যখন এতো ভালোবাসেন তো আমাকে বিয়ে কেনো করেছেন বলুন? কেনো বলুন?
উনি অবাক চোখে আমার কথায় বললেন
” মানে?
আমি আবারো জোরে বললাম
“মানে টা আমার নয় আপনার বলা উচিত? আমার জীবন্টাকে কেনো নরক বানিয়ে দিয়েছেন? বলুন কেনো করলেন? এবার ওই মেয়ে যখন আপনাকে নিজের হাসবেন্ড হিসাবে দাবি করবে তখন আমার সন্তান ও তো পিতৃপরিচয় হীন হবে_
উনি আর জবাব দিলো না সরু চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ছবিটা নিয়ে কোথাও একটা চলে গেলেন।

ভালোবাসার প্রতিদানে সবাই ভালোবাসে না। কাউকে ভীষণ ভালোবাসলে তার থেকে অবহেলা ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না।দিন শেষে সেই আমার আমিটাকে নিজে একাই সামলাতে হয়।দুনিয়ায় এমন কিছু মানুষ আছে যারা আমাদের নিজের কাছে আটকে ও রাখবে না আবার ছেড়েও দেবে না তারা শুধু তাদের প্রয়োজনে আমাদের ব্যবহার করবে।প্রয়োজন শেষ হলে আঘাত করবে কষ্ট দেবে_অবহেলা করবে বারবার ছেড়ে যাওয়ার বাহানাও খুজবে।
আয়ান ভাইয়াও ঠিক এমন। আমাকে ধরে ও রাখছে না আবার ছেড়েও দিচ্ছে না।নিজের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করছে। আকাশে মিটি মিটি তারা জ্বলছে আমি একা ছাদে দাড়িয়ে তারাগুলোকে দেখছি তারা যেনো মিটিমিটি হাসছে। আগে একটা সময় ছিলো যখন আমি এই রুম থেকে ওই রুমে যেতেও ভয় পেতাম কিন্তু এখন আর ভয় করে না অন্ধকার রাতে খোলা চুলে ছাদের দাঁড়িয়ে আছি।হঠাৎ কেউ পেছন থেকে আলতো হাতে আমার চুল গুলো সুন্দর করে খোপা করে দিলেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন
” এতো রাতে একা খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছো কেনো_এতো কেয়ারলেস হলে চলবে।বেবীর ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

এবার আমি একটা হাসি দিয়ে বললাম
” যা ক্ষতি হবার তো হয়ে গেছে আবার নতুন করে কি কিছু হওয়ার বাকী আছে?
বলেই ধীরে পায়ে নিচে নেমে এলাম।

পরের দিন বিকালে হঠাৎ করে আয়ান ভাইয়া হুরমুরিয়ে ঘরে ডুকলো। আমাকে বললো “তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও একটা জায়গায় যেতে হবে
আমি বিষ্ময় নিয়ে বললাম
” কোথায়?
উনি ব্যাস্ততা দেখিয়ে বল্লো
“তোমার সব প্রশ্নের জবাব আজকে পেয়ে যাবে
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেডি হয়ে নিচে নেমে এলাম

আধাঘন্টা যাবৎ রিক্সা চলছে কিন্তু কোথায় যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি না উনাকে জিজ্ঞাসা করলে উনি শুধু এতোটুকুই বলেছেন আমিও আর কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না নিরবে শুধু চোখের পানি ফেলছি,,,,আমাদের রিক্সা টা গিয়ে থামলো তুষার স্টুডিও নামক একটা দোকানের সামনে। উনি নেমে রিক্সার ভাড়া দিয়ে আমাকেও খুব সাবধানে নামিয়ে আমি সহ দোকানের ভেতরে গেলাম।দোকানে একটা ছেলে ছিলো।ছেলেটার বয়স বারো কিংবা তেরো এর মাঝামাঝি হবে।ছেলেটা দেখতেও বেশ হ্যান্ডসাম।

উনি পকেট থেকে থেকে উনার আর সেই মেয়েটার বিয়ের ছবিটা বের করে ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বললো
“দেখো তো এই ছবিটা কবে চাপানো হয়েছিলো এবং এই ছবির কোনো কপি আছে কি না
ছেলেটা কিছুক্ষন ছবিটাকে উল্টে পাল্টে দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উনার দিকে ফিরে বললেন
“আমি তো জানিনা এই ছবির বিষয়ে তবে মামা জানে উনি বলতে পারবে
এবার উনি বললেন
“তোমার মামা কোথায়
এবার ছেলেটা আবার বললেন
” একটা কাজে গেছে
এবার উনি হতাশ দৃষ্টিতে বললেন
“উনার আসতে কতো সময় লাগবে?
ছেলেটা কিছু সময় ভেবে বললেন
” পনেরো মিনিট বা তার বেশী”
এবার উনি আচ্ছা বললেন ছেলেটা আমাদের ভেতরে গিয়ে বসতে বললো__

প্রায় আধা ঘন্টা পর লোকটা দোকানে এলো। লোকটার বয়স চল্লিশের উর্ধে।
উনি লোকটাকে ছবিটা দেখিয়ে জানতে চাইলেন
“ভাইয়া এই ছবিটা কবে চাপানো হয়েছে বলতে পারবেন?
লোকটা কিছুক্ষণ ছবিটাকে নেড়েচেড়ে উনাকে বললেন
” দেখুন আমাদের একটা নিয়ম আছে_এক কাস্টমারের কথা অন্য কাস্টমারকে বলা আমাদের উচিত না
উনি এবার করুন চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন
“এই ছবির কোনো কপি দিতে পারবেন?দেখুন আপনি যদি আমাদের এই ছবির আসল কপিটা না দেন তাহলে আমরা থানায় গিয়ে আপনাদের দোকানের নামে মামলা করবো আপনারা ভুয়া ছবি চাপান।
এবার লোকটা খানিকটা ভয় পেয়ে গেলো।আমি পাশে বসে সব কিছু খেয়াল করছি। কিন্তু কি হচ্ছে কিছুই আমার মাথায় ডুকছে না সব যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।এসব কি উনার নতুন কোনো ফন্দি আমি ভাবতে পারছি না আর মাথা ধরছে

উনার কথায় লোকটা ছবিটা বের করে দিলো যা দেখে উনার মেজাজ চরম পর্যায়ে খারাপ হয়ে গেলো।উনার সাথে ওই মেয়েটার ছবি।উনি অবাক হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললেন
” রাত্রির আর আমার ছবি
উনি লোকটাকে আবারো উদ্দেশ্য করে বললেন
” দেখুন ভালোয় ভালোয় বলছি আসল ছবিটা দিন।এটা আমি হতেই পারি না এটা এডিট করা ছবি।
লোকটা এবার বললেন
“এইটাই আসল ছবি।যান তো ভাই আর ঝামেলা কইরেন না
এবার উনি রেগে লোকটার কলার চেপে ধরলেন ভয় পেয়ে লোকটা আসল ছবিটা বের করে দিলেন।

ছবিটা দেখে আমার চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা।মিহির ভাইয়া আর ওই মেয়েটার বিয়ের ছবি আর আমাকে যেটা দেখা নো হয়েছিলো সেটা ভুয়া ছিলো। উনি একহাতে ছবিটা নিয়ে অন্য হাতে আমার ডানহাত শক্ত করে ধরে আমাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন

আমি এখন উনার চোখে চোখ রাখার সাহস পাচ্ছি না।উনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আর আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি উনি রাগী গলায় বললেন
” ছবিটা কোথায় পেয়েছো
আমি কাচুমাচু হয়ে বললাম
“আমি যখন আমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম তখন আমার শাড়ীর ভাজে পেয়েছিলাম
এবার উনি অবাক দৃষ্টিতে বললেন
” তোমার শাড়ীর ভাজে এই ছবি এলো কি করে আর কে ইবা এসব করছে ভাববার বিষয়
এবার আমি শক্ত গলায় উত্তর দিলাম
“এটা না হয় মিথ্যা মানলাম কিন্তু আপনার আর ওই মেয়ের অশ্লীল ছবীটাও কি মিথ্যে
এবার উনি বিষ্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
“অশ্লীল ছবি মানে”
আমি এবার নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেঞ্জার থেকে সেই ছবি বের করে উনাকে দেখিয়ে বললাম
“আপনার তো চরিত্র ও ঠিক নেই আবার এতো রাগ নিয়ে কার সাথে কথা বলেন,
এবার উনি আমার গলা টিপে ধরে বললেন
তুই কোন সাহসে আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলিস? তুই দেখেছিস কোনো মেয়ের সাথে এমন অবস্থায় আমাকে? আগের টা এডিট করা ছিলো এটাও নিশ্চই এডিট করা।
এবার আমি উনাকে এক ধাক্কা দিয়ে বললাম
“এটা এডিট করা কিন্তু আমার চোখ তো আর এডিট করা নয়
বলুন আপনি সেদিন গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা বলে পরে রাস্তার পাশে ওই মেয়ের সাথে আইস্ক্রিম হাতে গল্প করতে করতে হাটছিলেন না?
বলুন তিন বছর আগে ওই মেয়ের সাথে আপনাকে কিস করতে আমি পার্কে দেখেছিলাম কি না?
এবার উনি অবাক হয়ে বললেন
” রাত্রি আমার স্কুল ফ্রেন্ড ওর সাথে অনেক ভালো সম্পর্ক আর অনেকদিন পর দেখা হয়েছিলো তাই ও অনুরোধ করলো আইস্ক্রিম খাবে সেই অনুযায়ী।
আর মানুষের চোখের দেখার মাঝেও ভুল থাকে তাই তুইও ভুল দেখেছিস।সেদিন বসে ওর সাথে ফুচকা খাচ্ছিলাম ও হঠাৎ বললো ওর চোখে কিছু একটা পড়েছে আমি সেটাই দেখছিলাম
ছিহ।ভালোবাসায় এতোটুকু বিশ্বাসও রাখতে পারলি না তুই
কে না কে তোকে কিসব দেখিয়েছে আর তুই আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিস।

চলবে___

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে