#হৃদয়ে_তুমি
লেখনীতে:Waziha Zainab (নিহা)
তৃতীয় পর্ব
নিয়তি এক অদ্ভুত জিনিস_
কখন কার সাথে কিভাবে কি ঘটে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা।
বিয়ের দিন সকালে অনিতা আর নুযহাত আমার পাশে বসে আছে
নুযহাত বললো
“আপু তুই দুলাভাই কে দেখেছিস?
আমি বললাম
” না 😪
অনিতা এবার বলে উঠলো
“নিহা তুই বিশ্বাস করবি না
তোর বর কালো কুচকুচে
আমি পাত্তা না দিয়ে বললাম
” তাতে আমার কি
এবার নুযহাত বলে উঠলো
“জানিস আপু দুলাভাই এত্তো গুলা মোটা
আমি ভ্রু কুচকে বললাম
” কতো গুলা?
অনিতা অসহায় দৃষ্টিতে বললো
“শুনেছি দুলাভাইর ওজন নাকি ৯৫ কেজি।আর কালো কুচকুচে।মাথায় কোকরা চুল।মোটা পেট
এবার আমার হাত পা ছড়িয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে
আগে বাবা মায়ের চয়েজের উপর ভরসা ছিলো কিন্তু এখন নুযহাত আর অনিতার কথায় সেই ভরসাটুকুও হারালাম আমি
ম্যারেজ রেজস্ট্রি পেপারে সই করেই অজ্ঞান হয়ে গেলাম আমি_যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে একটা ঘরে আবিষ্কার করলাম।
বাসর ঘরে লম্বা একটা ঘোমটা টেনে বসে আছি আমি।অপেক্ষা করছি আমার বর বাবুর জন্য
একমাত্র উপরওয়ালাই জানেন বাবা মা কেমন ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছেন আমার_ বিছানার চারদিকটা বেলী আর গোলাপ ফুল দিয়ে ডেকোরেশন করানো
কিন্তু আমার চিন্তা অন্য জায়গায়
নুযহাত আর অনিতার কাছে তার রুপের বর্ণনা শুনে গা গুলিয়ে এলো আমার হয়তো নিজের বরকে দেখে আমি হার্ট অ্যাটাক করবো__
রাত ১ টা বাজে
কারো পায়ের শব্দে ধ্যান ভাঙলো আমার_
আমি নিজেকে স্থির রেখে আমার বরকে দেখে পুরোপুরি অজ্ঞান হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে তাকাতেই অজ্ঞান না হয়ে অবাক হয়েছি_
বিষ্ময় নিয়ে বললাম
” আপনি এখানে এতো রাতে কি করতে এসেছেন?
দেখুন একটু পরে আমার বর চলে আসবে সে যদি পরপুরুষের সাথে আমাকে দেখে নেয় তাহলে হয়তো আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে_আপনি এখান থেকে যান প্লিজ
আমার কথায় আয়ান ভাইয়া হালকা হেসে আমার মাথায় বারি মেরে বললেন
“তোর বরকে দেখেছিস?
আমি মাথা নারিয়ে উত্তর দিলাম
” না কিন্তু অনিতা বলেছে কালো কুচকুচে আর মস্ত বড় একটা পেট না পেট না ভুড়ি
আমার কথায় হাসিতে ফেটে পড়লেন আয়ান ভাইয়া আর বললেন
“ছবি দেখলি না ঠিক আছে বাট কাবিননামায় নাম টা তো একবার দেখতে পারতি
এমন অন্ধের মতো বিয়ে কেউ করে আজিব_তোর বিয়ে আমার সাথেই হয়েছে
আমি থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম
ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে উঠলেন
“এই জীবনে ভালো দিন পেতে হলে
খারাপ দিনের সাথে যুদ্ধ করতে হয়”
আমিও করেছি__
একদিন না একবছরও না
পুরো ৩ টা বছর যুদ্ধ করেছি
নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি আমি_
“শেষটা সুন্দর হওয়ার জন্য প্রচুর অপেক্ষার প্রয়োজন”
আমিও অপেক্ষা করে ছি
একদিন না একবছরও না
পুরো ৩ টা বছর অপেক্ষা করেছি
নিজের ভালোবাসার জন্য নিজের প্রেয়সীর জন্য__
এই টুকু বলেই ভাইয়া থামলেন
একটা সস্তির নিশ্বাস ফেলে আবার বলে উঠলেন
সেদিন চিঠিটা মামনির হাতে পড়ার পর মামনি আমাকে বলেছিলো ৩ বছর তোমার থেকে যেনো দূরে থাকি_ কারণ তুমি তখন ছোটো ছিলে_বাস্তবতা বোঝার মতো ক্ষমতা তোমার ছিলো না।তুমি ছিলে আবেগে ভরপুর এক কিশোরী।যাকে যে কেউ খুব সহজেই যত্ন করে গড়ে নির্মম ভাবে ভেঙে দিতে পারে।
তাই মামনির ভয় ছিলো যদি তার মেয়ে ভুল পথে চলে যায়।
আম্মু আব্বু তখনই মামনির সাথে কথা বলে রাখে।তখন মামনি আম্মুকে সর্ত দেয় তিন বছর যেনো আমি তোর থেকে দূরে থাকি কোনো কন্টাক্ট না রাখি। আমার তিন বছর পর ইচ্ছে ছিলো তোকে জানানোর কিন্তু সবাই ভেবেছে তোকে সারপ্রাইজ দেবে তাই কেউ কিছু বলে নি।
আমি বিষ্ময় নিয়ে বললাম
“মিথ্যে বলছেন কেনো
এইটা আপনাদের বাড়ী না
আর এটা তো আপনার ঘর ও না
ভাইয়া এবার হালকা হেসে আমার নাক টেনে দিয়ে বললেন
” হ্যা,,,এটা নতুন ফ্ল্যাট আমাদের
আমি এবার একটু অলসেমি দেখিয়ে বললাম
“আমি ঘুমাবো
গুড নাইট বাই
কালকে সকালে কথা হবে
আমার কথায় ভাইয়া চোখ গরম করে বললেন
” আজকে কিসের ঘুম হ্যা
আজকে বাসর রাত আমাদের
সো আজকে নো ঘুম
আমি এবার কিছু না বলে গিয়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম
ভাইয়া এবার আমাকে টেনে উঠিয়ে বললেন
“আরে কেমন মেয়ে তুই
এতো ভারী ভারী গহনা আর এই মস্ত বড় লেহেঙ্গা নিয়েই শুয়ে পড়লি চেঞ্জ করবি না?
আমি তো আজকে তোকে চেঞ্জ করিয়ে দেওয়ার পুরো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি”
ভাইয়ার কথায় ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললাম আমি
“লাইক সিরিয়াসলি
বিশ্বাস করেন ভাইয়া আপনার মতো লুচি পরোটা আমি আমার লাইফে দুটো দেখিনি
ভাইয়া আমার কথায় হেসে বললো
” লুচু হলে সেটা নিজের বউয়ের জন্য বাহিরের মানুষের জন্য তো আর নাহ
বাই দা ওয়ে এই সাজ তোকে অনেক দারুণ লাগছে”
আমি এবার ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম_হাতে একটা থ্রী পিছ নিয়ে।
জামা কাপড় চেঞ্জ করে ভারী গহনা সব খুলে একটু হালকা হয়ে একটা সস্তির নিশ্বাস পেললাম
“এতো বাধাঁর পরও মানুষটাকে যে নিজের করে পাবো এটা কখনো ভাবি নি”
আমি আর ভাইয়া ছাদের সাইডে ফুলগাছ গুলোর থেকে হালকা দূরে বসে আছি।দুজনের পা দু টো নিচের দিকে ঝুলানো_আমি ভাইয়ার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছি_কিছুক্ষণ পর ভাইয়া সরে গেলে আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম
“কি হলো সরে গেলেন কেনো?
ভাইয়া আমার কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে বললেন
” অনেক্ষণ রাজরাণীর মতো আপনার সেবা করেছি এবার আপনি আমার করুণ
আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম
“হুহ রাজরাণীর মতো কি? আমি তো রাজরাণী
ভাইয়া আমার কথায় হেসে উঠলেন উঠে বসে শক্ত করে আমার হাত দুটো ধরলেন
আমি বলে উঠলাম
” কখনো ছেড়ে যাবেন না তো?
হারিয়ে যাবেন না তো কখনো
ভাইয়া কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো
“” হারাতে দিলেই তো মানুষ হারায়
আর রাখতে জানলে একসাথে শেষ সূর্যাস্তও দেখা যায়””
পরদিন আমি ভোর ৫ টায় ঘুম থেকে উঠে অজু করে নামাজ পড়ে নিলাম_তারপর উনাকে ডাকতে গেলাম।তার মুখ দেখেই আমার পৃথিবী থমকে গেলো। উনাকে নিষ্পাপ লাগে ঘুমন্ত অবস্থায়।আমার হৃদস্পন্দন যেনো তখন একটাই কথা বলছিলো
“থমকে যাক সময়
থমকে যাক পৃথিবী
দাঁড়িয়ে যাক ঘড়ির কাটা
আমার এই সুখময় জীবন থাকুক আজীবন”
সব ভাবনা কে আপাতত সাইডে রেখে উনাকে ডাক দিলাম
“””উঠুন নামাজ পড়বেন না।নামাজের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে।তাড়াতাড়ি উঠুন।
উনি ঘুমন্ত অবস্থায় বললেন
“পরে
কিন্তু আমি হাল ছাড়লাম না আমি উনাকে টেনে বসিয়ে বললাম
” পরে লাগবে না উঠুন এখন তাড়াতাড়ি মসজিদে নামাজ পড়তে যান।
উনি বিরক্তি নিয়ে উঠে গেলেন ওয়াশরুমের দিকে।।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম।
রান্নাঘরে (উনার ভাবি নিশান ভাইয়ার বউ তিশা) সকালের নাস্তা তৈরি করছে সাথে ফুফি ও আছে।
আমাকে দেখে ভাবি মুচকি হেসে বললো_
“নিহা ভেতরে এসো।
আমিও মুচকি হেসে ভেতরে গেলাম
ফুফি বললো”
“এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছিস কেনো।আরেকটু পরে উঠলে তো পারতি
আমি ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করতে করতে বললাম
” ফুফি তুমি তো জানো এটা আমার অভ্যাস
আমার কথায় ফুফি মুচকি হেসে আমার গাল টেনে বললেন
“এখনো ফুফি ডাকবি?
আমি তোর এখন শাশুড়ী তাই আর ফুফি ডাকা চলবে না।
আম্মু ডাকবি।
আর এখন থেকে আমি হুকুম করবো আর তুই তা পালন করবি”
এই টুকু বলেই ভাবি আর ফুফি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।ফুফি এমনই সারাক্ষন তার মুখে হাসির আভা দেখা যায়।আমাদের কথার মাঝেই খাবার টেবিল থেকে ফুফা ফুফিকে উদ্দেশ্য করে বললো
” আজকে কি খাওয়া কপালে জুটবে।নাকি শাশুড়ী আর বউমাদের হাসি শুনেই পেট ভরাতে হবে।
ফুফার কথায় ফুফি ঝাঝালো গলায় বললো
“প্রতিদিন তো আমরা মেয়েরা রান্না করি।
কখনো তো বাপ আর ছেলেরা মিলে রান্না করতেও তো পারো”
ফুফির কথায় উত্তরে বাহিরে থেকে উনি পাঞ্জবির হাতা ফোল্ড করতে করতে বললো
“ওকে ডান
তাহলে একটা গেইম খেলি চলো
আজকে ডিনার আমরা বাবা ছেলেরা তৈরি করবো আর তোমরা শাশুড়ী বউমা মিলেই তৈরি করবা
আর গেইমের নাম হবে
বাবা ছেলে VS শাশুড়ী বউমা
ভাইয়ার কথায় ফুফি বললো
” না কোনো দরকার নেই
তোরা বাপ ছেলে রান্না করলে আজকে না খেয়ে থাকতে হবে”
এবার ফুফা বললো
“দেখেছিস তোর মা ভয় পাচ্ছে
যদি আমাদের কাছে হেরে যায়
ফুফি এবার রেগে বললো
” আমরা হারবো কেনো হারবে তো তোমরা
(আমি ফুফি আর ফুফার ঝগড়া করা দেখে মুচকি মুচকি হাসছি।
এই বয়সেই এতো ঝগড়া আল্লাহ মালুম এরা বিয়ের পর পর তখন নিশ্চই কোপাকুপি করতো)
ফুফি আর ফুফার কথা মতো বাবা ছেলে VS শাশুড়ী বউমা গেইমের আয়োজন করা হলো।
আর রান্নার ভালো খারাপ নির্ণয় করার জন্য পাশের বাড়ীর আন্টি কে ডিনারের জন্য দাওয়াত দেয়া হলো।
এক পাশে আমি ফুফি ভাবি রান্না করা নিয়ে ব্যাস্ত আর,,,, অন্য পাশে ফুফা ভাইয়া আর উনি ব্যাস্ত।উনাদের ব্যাস্ততা টা ঠিক রান্না করা নিয়ে না । উনাদের ব্যাস্ততা আমাদের বিরক্ত করা নিয়ে।
রান্না শেষে ফুফি রান্না টা কেমন হয়েছে চেক করলো সব ঠিকঠাক হয়েছে।তখন আমি আর ফুফি ছিলাম রান্নাঘরে
ফুফা ফুফিকে ডাক দিলো তাই ফুফি রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে ফুফার কাছে গেলেন।
আমি রান্নাঘরে পায়চারি করছিলাম তখন উনিও আমাকে ডাকলেন
“নিহা একটু এদিকে এসো তো”
আমি ধীরে পায়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম
“কি হয়েছে
উনি আমাকে বললেন
” ঘরে টেবিলের ড্রয়ারে আমার একটা ঘড়ি আছে নিয়ে আসো তো
আমি ভ্রু কুচকে বললাম
“এতো রাতে ঘড়ি দিয়ে কি করবেন
উনি আমার কথায় বিরক্ত প্রকাশ করে বললেন
” গিলে খাবো
যাও নিয়ে আসো
আমি আর কথা না বাড়িয়ে ঘরের গিয়ে ঘড়ি খুজতে লাগললাম কিন্তু পেলাম না
একটু পর বেরিয়ে এলাম
উনি বললেন
“ঘড়ি কোথায়
আমি বললাম
“খুজে পাই নি
উনি একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন “গুড
আমি ভ্রু কুচকে বললাম
” গুড মানে?
উনি আরেকটু হেসে বললেন এতো কিছু তোমার বুঝতে হবে না।
পুরো টেবিল নানা রকম সুস্বাদু খাবার দিয়ে সাজানো।
আমি ফুফি আর ভাবী তৈরি করেছি “ভাত,,পোলাও,,রুই মাছ,,আলুর ভর্তা আর চিংড়ি মাছ।আন্টিকে ফোন করে জানতে পারলাম যে এগুলো তার প্রিয় খাবার।
আর অন্যদিকে উনারা তৈরি করেছে,,,চিকেন বিরিয়ানি,,,পুডিং_ ভেজিটেবল বার্গার,,,রোল
গেইমের শর্ত অনুযায়ী আন্টি ও তার ছোট্টো দুই মেয়ে চলে এসেছে।
রাত ৯ টা আন্টি তার মেয়ে ২ টো নিয়ে খাবার টেবিলে বসেছেন।তার পাশে ফুফি,,,আর ফুফির পাশে ফুফা
নিশান ভাইয়া আর উনি অন্য পাশে বসেছেন,,,নিশান ভাইয়া আর উনার মুখে এক রহস্য ময় হাসি ঝুলানো
আমি আর ভাবি মিলে খাবার সার্ভ করছি
প্রথমে উনাদের খাবার গুলো সার্ভ করলাম
আন্টি উনাদের রান্নার বেশ প্রসংশা করলেন
তারপর আমাদের খাবার গুলো সার্ভ করলাম
খাবার মুখে দিতেন আন্টির মুখ মলিন হয়ে গেলো আর মুখ থেকে সব খাবার পেলে দিলেন
ভাবি ভ্রু কুচকে বললেন
” খাবার টেস্টি হয় নি আন্টি
তখন আন্টি টা বললেন
“ভাতের মধ্যে এতো লবন দেয় কেউ
আর মাছের মাঝে এতো ঝাল কেনো?
ফুফি একটু মুখে দিয়ে আবার সেটা মুখ থেকে বের করে পেললেন
আর রাগী গলায় বললেন
” এএই বাপ ছেলে কিছু করেছে নিশ্চই তখন চেক করেছি সব ঠিকঠাক ছিলো
চলবে_