#হৃদয়াক্ষী
#পর্ব_০৪
#সারিফা_তাহরিম
কিছু বলার আগেই পেছন থেকে কেউ তাকে ঝাপটে ধরতেই সে চমকে উঠলো। হাত থেকে মোবাইল ছুটে বিছানায় পড়ে গেছে। পূর্ণতা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল অবন্তী তাকে জড়িয়ে ধরেছে। আর মৌনতা পেছনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। অবন্তী বলল,
‘কী ভাবিজি? রুমে এসে আমার ভাইয়ের সাথে প্রেম করা হচ্ছে বুঝি?’
পূর্ণতা অবন্তীর দিকে ফিরে অপ্রস্তুত হেসে বলল,
‘আরে না এমনি কল দিয়েছিল তোমার ভাইয়া।’
‘থাক আর কৈফিয়ত দিতে হবে না। তুমি ভাইয়ার সাথে কথা বলা শুরু করো। আমার ভাই বেচারা তোমার সাথে কথা বলতে না পেরে ছটফট করছে।’
অবন্তী ফোনটা নিয়ে লাউড স্পিকারে দিয়ে পূর্ণতার মুখের সামনে ধরল। তার চোখে মুখে চঞ্চলতা ভীড় করছে। ওপাশ থেকে অরিত্র ‘হ্যালো হ্যালো’ বলছে। পূর্ণতা কাঁপা স্বরে হ্যালো বলতেই অরিত্র ঠান্ডা গলায় বলল,
‘প্রেয়সী, তুমি কি রেগে আছো এখনো? রাগটা কি একটু কমানো যায় না? তোমার রাগের উত্তাপে যে এই শীতল মানবটা বাষ্প হয়ে যাচ্ছে। একটুও কি মায়া হচ্ছে না আমার জন্য?’
অরিত্রের কথা শুনে অবন্তী আর মৌনতা শিস বাজালো। কিন্তু সেই আওয়াজ ফোনের ওপাশে যাওয়ার আগেই পূর্ণতা তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে কেটে দিল। অবন্তী আর মৌনতা দুজনেই খুব হাসছে। এই মুহূর্তে পূর্ণতা লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে যেতে লাগল। ইশ! এই লোকটা কেমন নির্লজ্জ! এই বিচ্ছু দুটো শুনে ফেলেছে কথাগুলো। এবার সারাদিন ক্ষেপাবে পূর্ণতাকে। অবন্তী পূর্ণতাকে বলল,
‘ইশ! ভাবি আমার রাগ করেছে। আর ভাইয়া সেই রাগে একেবারে বাষ্প হয়ে যাচ্ছে! প্রেম তাহলে এতদূর গড়িয়েছে! একদিন আসেনি বলে আমার ভাইটার সাথে রাগ করেছে ভাবি। তাহলে এই ছয়মাস কাটাবে কিভাবে? তুমি তো আমার ভাইকে রীতিমতো চোখে হারাচ্ছো। তোমাদের প্রেম জমে ক্ষীর হয়ে গেছে আর আমরা ঠিক মতো কিছু জানি না। এটা তো ভারি অন্যায়। কী বলো মৌনতা?’
মৌনতা সায় দিয়ে বলল,
‘একদম ঠিক। শতভাগ ঠিক। আপু তুই যে গভীর জলের মাছ, তা তো আগে জানতাম না। বিয়ে হতে না হতেই কত ভালোবাসা! আমার জিজুও কত রোমান্টিক! ইশ! আপু জানিস, আমার না ভীষণ আফসোস হচ্ছে। তুই তো আমার একটামাত্র বোন। আমার একটা রোমান্টিক দুলাভাই। কিন্তু তার কোনো রোমান্টিক ভাই নেই। আজ যদি তোর একটা রোমান্টিক দেবর থাকতো তাহলে আমি সাতপাঁচ না ভেবে তার গলায় ঝুলে পড়তাম। কিন্তু আমার কপালটাই খারাপ।’
কথাটি বলেই মুখ ফুলিয়ে বসল মৌনতা। অবন্তী তার পাশে বসে একই সুর ধরে বলল,
‘সেই দুঃখ তো আমারও হয় মৌনতা। আমার একটামাত্র ভাই। কিন্তু তার কোনো শ্যালক নেই। কত কত গল্পে পড়েছি ভাইয়ের শ্যালকের সাথে টুকটাক ঝগড়া হয়, কথা-কাটাকাটি হয়, তারপর ধীরে ধীরে প্রেম হয় অবশেষে বিয়ে। আমার ছোট থেকে আসা ছিল ভাবির ভাইয়ের সাথে প্রেম করব। কিন্তু আফসোস! আমার ভাবির তো কোনো ভাই ই নেই। প্রেম না হোক, অন্তত একবার শয়নে স্বপ্নে তাকে ভেবে ভেবে আমার দিন পার করার জন্য হলেও ভাবির একটা ভাইয়ের দরকার ছিল।’
মৌনতা একটু কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
‘ অবন্তী আপু, আমাদের না এত আফসোস থাকতো না যদি তুমি ছেলে হতে। তখন তুমি ভাবির রোমান্টিক ভাইয়ের পরিবর্তে রোমান্টিক বোন খুঁজতে। আর সেই রোমান্টিক বোন আমি। আর আমার দুলাভাইয়ের রোমান্টিক ভাই তুমি হতে। সবকিছু খাপে খাপ মিলে যেত। কিন্তু আফসোস, তুমি মেয়ে। এবার আমরা রোমান্টিক, হ্যান্ডু হাসবেন্ড কোথায় পাব?’
অবন্তী আর মৌনতা গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। প্রথম দিকএর কথায় পূর্ণতা লজ্জা পেলেও, তাদের পরের কথোপকথন শুনে বিস্মিত হলো। দুজন গালে হাত দিয়ে দেবদাস স্টাইলে গভীর বিষন্নতায় ডুব দিতেই শব্দ করে হেসে উঠলো পূর্ণতা।
______
চারপাশে নিস্তব্ধতা হাতছানি দিচ্ছে। এসির শীতল হাওয়া গ্রীষ্মের গরম ছাপিয়ে ঠান্ডা পরশ বুলাচ্ছে ঘরময়। ঘড়িতে রাত আটটা বেজে সতেরো মিনিট। অরিত্র কিছু ফাইল সামনে নিয়ে বসে আছে। অফিসে কয়েকজন স্টাফ, পিয়ন ও গার্ড ছাড়া আর কেউ নেই। আজ কাজের চাপ তেমন ছিল না। তাই প্রায় সবাই চলে গেছে। অরিত্রও ভেবেছিল সেও বাসায় চলে যাবে। তারপর পূর্ণতাদের বাসায় যাবে। কিন্তু পূর্ণতা বারণ করার পরে বাসায় জানালো আজ তার মিটিং আছে তাই পূর্ণতাদের বাসায় যেতে পারবে না। এই সময়টায় সে ফ্রি ছিল। চাইলে বাবা মা চলে যাওয়ার পরে বাসায় চলে আসতে পারত সে। কিন্তু সে ভাবল এই সময়টুকু কাজে লাগিয়ে অফিসের কাজ আরও কিছুটা কমিয়ে রাখা যেতে পারে। তাই আর বাসায় গেল না।
অরিত্র সময় দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এখন বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তাদের বাসা বেশ কিছু দূরে রফিক মামার টঙ দোকানে যাবে। এই জায়গাটা তার প্রাণের বন্ধুদের আড্ডাস্থল। আগে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে সবাই মিলে একবার হলেও চা খেয়ে যেত। অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও আড্ডা দিত। মাঝেমধ্যে আড্ডা দিতে দিতে কখন যে রাত হয়ে যেত কেউ টেরই পেত না। কিন্তু এখন সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পেড়েছে, প্রত্যেকের চাকরি ব্যবসা আর পরিবার নিয়ে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। আগের মতো তেমন আড্ডা দেওয়া হয় না। কিন্তু বন্ধুদের টান এখনো কেউ ছাড়তে পারেনি।
অরিত্র অফিস থেকে বেরিয়ে এসে রিকশা নিল। এই মুহূর্তে তার মাথায় অন্যকিছু ঘুরছে। তখন পূর্ণতা কিছু না বলে কল কেটে দিল কেন? অরিত্রের কথায় কি তার রাগ বাড়ছে? অরিত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এত কিসের রাগ পূর্ণতার? শুধুমাত্র তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে হয়েছে বলে? কিন্তু এই বিয়েকে সম্পূর্ণরূপে ইচ্ছের বিরুদ্ধেও বলা চলে না৷ কারণ তাকে তার বাবা মা বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করিয়েছি। বারবার বলতে বলতে রাজি করিয়েছেন। পূর্ণতা শেষ পর্যন্ত রাজি হওয়াতেই তো বিয়েটা হয়েছে। অরিত্রের জানামতে পূর্ণতার বাবা মা তাকে মারধর বা বকাঝকা করেও বিয়ে দেয়নি। তাহলে? আর পূর্ণতার বাবা মা জোর করলেও তাদের সাথে রাগ করার কথা। কিন্তু অরিত্র গতকাল দেখল সে তার বাবা মায়ের প্রতি কোনো রাগ সম্বলিত আচরণ করেনি। তাহলে অরিত্রের সাথে কেন রাগ দেখাচ্ছে? তার দোষটা কী?
আবারও একটা চাপাশ্বাস ফেলল অরিত্র। পরক্ষণে ভাবল, সে হয়তো বেশি বেশি ভেবে ফেলছে। হুট করে বিয়ে হওয়াতে মানসিকভাবে চাপে আছে হয়তো। তার উপর সামনে পরীক্ষা। আর যাই হোক, মেয়েটা পড়াশোনার ক্ষেত্রে বেশ মনোযোগী। এজন্যই হয়তো বেশি চাপ মনে করছে। আর তাছাড়া অরিত্রও হয়তো প্রেমময় সম্পর্ক শুরু করার ক্ষেত্রে খুব বেশিই উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। এত দ্রুত সবকিছু করাটা ঠিক হবে না। এভাবে জোরপূর্বক রাগ কমানোর কথা বললে বিরক্তিতে রাগটা বাড়তে থাকবে। তাই পূর্ণতাকে একটু সময় দিতে হবে। একজন প্রেমিক হওয়ার আগে একজন বন্ধু হতে হবে। তাহলেই ধীরে ধীরে সবঠিক হবে। নিজের ভাবনায় একটা উপায় বের করতেই প্রশান্তির হাসি হাসলো অরিত্র।
______
কড়া রোদের তেজে চারপাশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। মাঠের ধুলোবালি উড়ছে ক্রমাগত। পূর্ণতা, মিফতা আর দিনা বসে আছে ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়াতে। এক তপ্ত গুমোট ভাব বিরাজ করছে। পূর্ণতা গম্ভীর মুখে বসে আছে। পূর্ণতার দুই বেস্ট ফ্রেন্ড মিফতা আর দিনা তার মুখোমুখি বসে আছে। মিফতা নিরবে পূর্ণতার ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছে। দুজনের নিরবতায় চঞ্চলতাপূর্ণ শ্যামকন্যা দিনা বিরক্ত হয়ে উঠলো। বিরক্তিসূচক ‘চ’ এর মতো ধ্বনি উচ্চারণ করে বলল,
‘কিরে ভাই, তোরা এরকম বোবার মতো বসে আছিস কেন? কেউ কি মুখে সুপার গ্লু চিপকায় দিসে? মুখ দিয়ে কথা বাইর হয়না তোদের?’
পূর্ণতা দিনার কথা কানে না নিয়ে স্প্রাইটের বোতলে চুমুক দিয়ে বাহিরে চোখ রাখলো। মিফতাও তেমন পাত্তা দিল বলে মনে হলো না। সেও বার্গার চিবুতে চিবুতে পূর্ণতাকে পরখ করছে। এই মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতী। শান্তভাবে অনেক কিছু সামলে নেওয়ার মতো ক্ষমতা আর ধৈর্য আছে তার। আর তার ডাগর ডাগর দুই চোখে যেন দুনিয়ার সকল সৌন্দর্য নিহিত। দিনা তার কথার কোনো উত্তর না পেয়ে বলল,
‘কিরে ফকিন্নি তোরা দুইটা কি পঁচা ইন্দুরের রক্ত খাচ্ছিস যে মুখ থেকে কথা বাইর হইতেসে না?’
দিনার এমন কথায় দুজনের মুখ থেকেই স্প্রাইট ছিটকে বেরিয়ে এলো। দুজনেরই বমি হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। বারবার মুখ চেপে ধরছে। দিনা কিছুটা ভড়কে গেল তাদের এমন অবস্থা দেখে। দুজনের পিঠে হাত বুলিয়ে পানি এগিয়ে দিল। দুজনে পানি খেয়ে স্বাভাবিক হতেই দিনা পানসে মুখে বলল,
‘তোরা ঠিক আছিস?’
মিফতা রাগান্বিত হয়ে বলল,
‘তোর মুখে এসব জঘন্য কথা ছাড়া ভালো কথা আসে না! আমার তো এখনো বমি পাচ্ছে।’
পূর্ণতা বলল,
‘ আমার এখন তোকে পঁচা ইন্দুরের রক্ত খাওয়াইতে ইচ্ছা করতেসে দিনা।’
দিনা কাচুমাচু করে বলল,
‘সরি। তোরা বোবা হয়ে ছিলি তাই ওরকম বলেছিলাম।’
মিফতা দিনার কথায় পাত্তা না দিয়ে পূর্ণতাকে জিজ্ঞেস করল,
‘ অবশেষে তাহলে বিয়েটা হয়েই গেল। কিন্তু এরকম মনমরা হয়ে আছিস কেন? এমনটা তো না যে তুই কাউকে ভালোবাসিস তাই এই বিয়ে মেনে নিতে পারছিস না। তাহলে মুখে এমন মেঘের ছায়া কেন? কোনো ঝামেলা হয়েছে? অরিত্র ভাইয়া কিছু বলেছে?’
পূর্ণতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘নারে, ওরকম কিছু না। ব্যাপারটা হচ্ছে মা বাবা আমাকে অবিশ্বাস করছে। তাঁরা ভাবছেন আমার সাথে কারও রিলেশন ছিল তাই আমি প্রথমে বিয়েটা করতে চাইছিলাম না প্রথমে। আর সেই ছেলেটা নাকি আগদ্ এর দিন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সেইদিন থেকেই বাবা মা আমার সাথে কথা বলছেন না। অবিশ্বাস করছেন। একটাবারের জন্য ব্যাপারটা সত্য নাকি মিথ্যা তা বিবেচনা করে দেখলেন না। আর তার উপর কোন ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল আমি জানি না।’
‘কী বলিস এসব! আর কী কী হয়েছে খুলে বল।’
পূর্ণতা মিফতা আর দিনাকে সবকিছু খুলে বলল। কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখে পানি চলে এলো। বাবা মায়ের ব্যবহার মেনে নিতে পারছে না পূর্ণতা। এখনও তাঁরা পূর্ণতাকে এড়িয়ে চলেন। আর নাজিবা হাসান প্রায় সময় তাকে কথা শোনায়৷ দিনা চিন্তিত মুখে বলল,
‘ আঙ্কেল আন্টি এমন কেন করছে? একটু বোঝার চেষ্টা করলেই তো হয়। আচ্ছা আমরা নাহয় আন্টি আঙ্কেলকে বুঝিয়ে বলব?’
মিফতা তড়িৎ গতিতে বলল,
‘আরে না না। এতে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। আমার মনে হয় পূর্ণতা, তুই আঙ্কেল আন্টির সাথে খোলাখুলিভাবে কথা বল। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা না করলে সমাধান হবে না। তোর প্রতি বাজে সন্দেহ রয়েই যাবে।’
‘হু, তা ই করতে হবে। কিন্তু কিভাবে করব বল? বাবা মা তো আমাকে সহ্যই করতে পারছেন না।’
দিনা বিরক্তি মুখে বলল,
‘ আমি না বুঝতে পারছি না। কে এই ছেলে?’
তখন পেছন থেকে কেউ একজন বলল,
‘আমি।’
চলবে…