হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা পর্ব-১০

0
472

#হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা|১০|
#শার্লিন_হাসান

সকাল বেলা হাঁটতে বের হয়েছে সবাই। চিকন সরু রাস্তায় সবাই হাঁটছে। মিসবাহ ছুটাছুটি করছে রাস্তায়। আনায়া সবার শেষে হাঁটছে। নিবরাস কলে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে।

হাটাহাটি শেষ করে তারা নাস্তা করে নেয়। এই বাড়ীতে থাকা একজন কাজের বুয়া আরেকজন মধ্যবয়স্ক লোক যিনি বাড়ী দেখাশোনা করেন। তারাই খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। নিবরাসরা আগামী দুই তিন দিনের মধ্যে রাজশাহীর মোহনপুর ব্যাক করবে।

আনায়া মিসবাহর সাথে বাড়ীর ছাদে যায়। শেওলা পড়েছে অনেকটা। হয়ত কেউ আসে না সেজন্য! ছাঁদটা অনেক পুরোনো লাগলো! বেশীক্ষণ থাকলো না আনায়া মিসবাহ সহ চলে আসে।

*****

নিধির মামনিরা আপ্পায়নে ব্যস্ত! প্রায় বছর পর তারা চট্টগ্রাম এসেছে। নাজিয়া বাড়ীটা ঘুরে,ঘুরে দেখছে। জায়ানের নানু বাড়ী!

সকালে নাস্তা শেষ করে নিধি,শাহরিয়ার,জায়ান, নাজিয়া হাঁটতে বের হয়। অবশ্য কেউই তেমন রাস্তা ঘাট চেনে না।

তবুও হাঁটছে তারা। এক গ্রাম ছাড়িয়ে অন্য গ্রামে পা রেখেছে। চট্টগ্রাম এর মানুষের আঞ্চলিক ভাষা তেমন বুঝে না তারা।

আগামী কালকে তারা সবাই রাতে ঘুরতে বের হবে। অবশ্য গ্রামগুলো সাধারণের মাঝে তবুও ঘুরে দেখবে তারা। একেক জেলায় একেকরলম সবকিছু! একেক কালচার একেক নিয়ম অনেককিছুই তাদের অজ্ঞতার মাঝে পড়ে।

ঘুরাঘুরি শেষ করে বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা হয় তারা।
জায়ানের ছোট মামাতো ভাই তাঁদের নিয়ে দিঘির পাড়ে যায়। শান দিয়ে বাঁধাই করা সিঁড়ি তে নামে নাজিয়া,নিধি। জায়ান নামেনা তার ভয় করে যদি পা পিছলে পড়ে যায়। নাজিয়া নিধিকে বারণ করেছে নামতে। শেওলা পড়ে আছে কিছু,কিছু সিঁড়িতে।

নিধি কয়েক সিঁড়ি নামতে জুতা স্লিপ কেটে পড়তে যাবে নাজিয়ার হাত ধরে নেয়। তাতেও তাঁদের রক্ষা হয়নি দু’জন মিলে পানিতে পড়ে যায়। নাজিয়া সাতার জানে না।

জায়ান আর এক মূহুর্ত ও দাঁড়ায়নি গুটিগুটি পায়ে পানিতে নেমে পড়ে। নিধি সাতার কেটে সিঁড়িতে এসে বসে। জায়ান নাজিয়াকে নিয়ে আসে। শাহরিয়ার সায়ন্তিক সেখানে দাঁড়িয়ে রয়। তার ভয় করে যদি সেও পড়ে যায়।

নিধি বার কয়েক কেশে উঠে। সায়ন্তিকের দিকে নজর যেতে মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায়। চেঁচিয়ে বলে,

-ওইখানে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনার বউ পড়ে গেছে মরে যাচ্ছে দয়া মায়া লাগে না?

-আমার ভয় করছে যদি আমিও পড়ে যাই।

-যাহ্! এই শা*লা তো দেখি মেয়েদের থেকেও ভীতু।
মনে,মনে কয়েকটা গালি দেয় নিধি। জামাইকে শা*লা বানিয়ে দিয়েছে তারজন্য কয়েকবার তওবা পড়ে নেয়। এটা তার কমন গালি! বিশেষ করে ছেলেদের এটা বলে।

নাজিয়াকে ধরে উপরে নিয়ে আসে জায়ান। নিধি সেও আস্তে,আস্তে উঠে আসে। ততক্ষণে জায়ানের আম্মু সাথে জায়ানের নানুও আসে। কেউ নিধিকে বকছে তো কেউ জায়ানকে। জায়ান কী করেছে যে ওদের আগলে রাখতে পারলো না।

জায়ান বুঝাচ্ছে নিধি পিছলা খেয়েছে এতে কারোর দোষ নেই। আর পড়ে যাওয়ার পর সেই তো উঠিয়ে আনলো নাজিয়াকে। কে জানে সবার কথা শোনে নাজিয়া আবার তার সাথে না রাগ করে বসে।

বাড়ীতে এসে এক দফা বকা খেয়েছে নাজিয়া। সীতারা আহমেদ তাকে বকা দিয়েছে। যদিও জায়ান সামলে নেয়। তাতেও নাজিয়ার মন ভে’ঙে গেছে। সামান্য কয়েকটা ক’টু কথাই তার কিশোরী মনে এক্কাদোক্কা খেলছে। নিতে পারেনি কথাগুলো! যদিও এর থেকে বড়,বড় বিষয়গুলো হাসিমুখে সামলে নিয়েছে কিন্তু ছেট,ছোট ব্যপারগুলো নিয়ে হুটহাট মন খারাপ হয়ে গেছে। তার কী দোষ? আর মা জাতিরা অপমান করতে গেলে ছাড়ে না। একবারে মুখ না দেখানোর মতো অপমান।

জামা কাপড় চেন্জ করে লিভিং রুমে বসে নাজিয়া। হাতে তার আম্মুর ফোন! ফেবুতে একটু ঢু মারতে তার ছোট ভাই আসে ফোনের জন্য। ফোনে ভিডিও দেখবে সে। নাজিয়া দিতে নারাজ! তার মতে, ‘ছোট বাচ্চাদের ওতো ফোন দেখতে নেই।’ কিন্তু তার ভাই কান্না করছে। তারউপর সীতারা আহমেদ এসে নাজিয়াকে বকা দিয়েছে আবার। বেড়াতে এসে আবার কিসের ফোন?

উঠে চলে আসে নাজিয়া। জায়ান জাফিনের গাল টেনে দেয়। উঠে নাজিয়ার রুমের দিকে যায়।

সে দরজা বন্ধ করে রেখেছে। জায়ান বার কয়েক ডাক দেয়। নাজিয়া দরজা খুলে দেয়। তবে তার মন খারাপ সহজে জায়ান ধরে নেয়। নিজের ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে,

-আইডি লগ ইন করে নিও। আমি কিছু বলবো না ফোন ইউস করতে পারো।

-ধন্যবাদ! লাগবে না।

-আরে কাকীমা তো এমনই! তোমাকে বেশী শাসন করে। তবে আমার কাছে তুমি খোলা ডায়েরির মতো! আর ডায়েরিটা আমার আগলে রাখতে চাই।

-তুমি যতটা বলছো ততোটা নই আমি। নির্দিষ্ট সীমার মাঝে! আর আমার মনে পড়ছে না তুমি যতটা এলোমেলো ভাবে আমায় সাজাচ্ছো আমি ততটা এলোমেলো। আর শোনো আমায় নিয়ে তোমায় এতো ভাবতে হবে না। আমি নিজেকে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা করি।

-আয়াত পাখি বেশী পেকে গেছো।

-তোমার মতো বোকা কয়জন আছে? আচ্ছা তুমি কী এই জনমেও একটু চালাক হবা না?

-আমি যথেষ্ট চালাক। শুধু তোমার চোখে বোকা লাগতেই পারে।

-হ্যাঁ দেখাই যাচ্ছে চালাকের নমুনা। আমায় এতো দরদ দেখাতে হবে না। পারলে নিজের কাকীমার দোষ,ভুলগুলো চোখের সামনে তুলে ধরো। মানুষ মানেই ভুলত্রুটি দিয়ে গড়া! নিজেকে এতোটা সঠিক মনে করা ঠিক না বরং নিজের ভুলগুলো খুঁজে নিজেকে সুধরে নেওয়া।

-সময় হলে সব বুঝবে। এই নিয়ে মন খারাপ করো না।

-আমার আবার মন খারাপ!

তাচ্ছিল্য হাসি টানে ঠোঁটে। তখন জায়ান পকেট থেকে দু’টো চকলেট বের করে নাজিয়ার দিকে এগিয়ে দেয়।

-তুমি চকলেট লাভার। আই হোপ মন খারাপে চকলেট পেলে মন কিছুটা ভালো হবে তোমার।

নাজিয়া চকলেট দু’টো হাতে নিয়ে ধন্যবাদ দেয় জায়ানকে। জায়ান হেঁসে প্রস্থান করে। জায়ানের কেয়ারগুলো নাজিয়ার ভালো লাগে আবার ভাবায় ও! শুধু কী ভাই,বোন হিসাবে? নাকী জায়ান তাকে অন্যকিছু ভাবে। তার মনে হয়না বোন হিসাবে এতো কেয়ার করে। নাহলে নিধিও সমান কেয়ার পেতো। কিন্তু জায়ান তাকে একটু আলাদা রকমের কেয়ার করে।

*****

দুপুরে লান্স করে রুমে এসে শুয়ে পড়ে আনায়া। হুটহাট মন খারাপ তার। সব বিরক্ত লাগছে! হয়ত মুড সুয়িং ভাবতে আরো বেশী বিরক্ত হয় আনায়া। তার মুড সুয়িং মানে জ্বালিয়ে মারবে সাথের জনকে। এটা ভালো লাগবে না ওরা ভালো লাগবে! একে বিরক্ত লাগবে তাকে বিরক্ত লাগবে। ভালো কথাও যেনো বি’ষের মতো
লাগে।

নিবরাস রুমে আসে। আনায়াকে দেখে বলে,

-এই বাড়ীতে ভালো লাগছে তোমার?

-মোটেও না। আমার মন চাচ্ছে রাজশাহী চলে যাই। আমার শহর আমার কাছে বেস্ট।

-সে তো বটে।

সন্ধ্যায় তারা সবাই বের হয় ঘুরতে। মিসবাহ,তারিশা,রোহিত, পরাগ,নিবরাস,আনায়া। গাড়ী নিয়েই বের হয়। আনায়ার মন ভালো নেই তবুও সবার সাথে বের হয়েছে।

নিবরাসদের গাড়ীর পেছনে শামিম সরদারের গাড়ী আসছে। তাঁদের গাড়ীর থেকে অনেকটা দূরে শামিম তার গাড়ী থামায়।

একটা পার্কের কাছে এসেছে নিবরাসরা। সন্ধ্যায়ও মানুষের আনাগোনা আছে।

নিবরাস পরাগ কথা বলতে,বলতে পার্কে ঢুকছে। তারিশা রোহিতের সাথে তাদের পেছনে। আনায়া মিসবাহর সাথে আস্তেধীরে ঢুকছে। মিসবাহর কথায় আনায়া দোকান থেকে আইসক্রিম কিনতে গেছে। তার সাথে মিসবাহ ছিলো তবে সে পেছনে দাঁড়ানো। আনায়া আইসক্রিম দু’টো হাতে নিয়ে টাকা দেয় দোকানদার কে। পেছনে ঘুরতে দেখে মিসবাহ নেই। দোকানদার কে তড়িঘড়ি জিজ্ঞেস করে,

-মামা ওকে যেতে দেখেছেন?

বিনিময় দোকানদার হাসে। তার হাসিটা আনায়ার পছন্দ হয়নি। তখন দোকানদার বলে,

-মিসবাহকে জায়গা মতো পাঠিয়ে দিয়েছি মিসেস মির্জা। পারলে খুঁজে বের করো! এই ছোকড়াকে দিয়ে তোমার প্রাণপ্রিয় স্বামীকে জব্দ করবো আমরা। আমি কিন্তু দোকানদার নই!

আনায়া আইসক্রিম রেখে বেড়িয়ে আসে। পার্কে কত মানুষই তো। এতো মানুষের ভীড় থেকে কীভাবে কী? নিশ্চয়ই পার্কের ভেতরে প্রবেশ করবে না মিসবাহকে নিয়ে। আনায়া বেড়িয়ে পড়ে তড়িঘড়ি। বাইরে গাড়ী পার্কিংয়ের জায়গা সেখানে অনেক গাড়ী। তার কিছুটা সামনে গেলে ল্যাম্পপোস্ট তেমন দোকানপাট নেই।
অনেকদূরে দোকান সেখানেও বখাটে দের আড্ডা।

আনায়া ফোনের ফ্লাশ অন করে। তার বুক কাঁপছে। মিসবাহ তো উসিলা! তার নেতার যদি কিছু হয়ে যায়? মনের মাঝে অজানা ভয় গ্রাস করে। ল্যাম্পপোস্টের কাছে এসে আনায়া মিসবাহ বলে বার কয়েক ডাক দেয়।

আনায়ার ডাক কানে আসে শামিম সরদারের লোকদের। তারাও বাচ্চাটাকে খুঁজছে। দোকান থেকে বহুকষ্টে বাইরে আনলেও হাতে কামড় দিয়ে কোনদিকে জানি ছুটেছে বাচ্চাটা। দেখে পাঁজি মনে হয়েছে।

ফোনের ফ্লাশ লুকিয়ে ফেলে আনায়া। তার মনে হলো তার আশেপাশে লোক আছে। ভেবে আনায়া বড় গাছটার পেছনে লুকিয়ে পড়ে

শামিম সরদারকে কল লাগায় একজন। কল রিসিভ হতে বলে,

-স্যার ছোকড়াটা পালিয়ে গেছে। কী পাজি ছেলে! হাতে কামড় দিয়ে পালিয়ে গেছে মামুর মতোই হয়েছে।

-কু*ত্তার বা** তোদের দ্বারা কোন কাজই হবে না। আমার ছেলেটাকে চাই মানে চাই। যে করেই হোক! এতোদূরে আসলাম এতো সময়,তেল, টাকা সব খরচ করে। বাচ্চাটাকে আমার চাই মানে চাই।

-কিন্তু স্যার অন্ধকারে কোথায় খোজবো?

-আমার শ্বশুর বাড়ীতে খোঁজ হারামজাদা। আমি বলে দেবো কোথায় খুঁজবি? নিজের গো*বর ভর্তি মাথাটাকে কাজে লাগা।

শামিম সরদার কল কেটে দেয়। রেগে গাড়ী থেকে বেড়িয়ে আসে সে। গাড়ীতে কয়েকটা লাথি মারতেও ভুলেনি সে।

-শীঘ্রই জায়গা বদল করো। অন্য জায়গায় খোঁজো! নিশ্চয়ই ছেলেটা পার্কের ভেতরে আবার প্রবেশ করছে। আমার সাথে পার্কে চলো আবার।

আরিফের কথা মতো বাকীরা চলে যায় পার্কের উদ্দেশ্য। আনায়া ফ্লাশ অন করে আশেপাশে তাকায়। না কেউই নেই সব চলে গেছে। তখন আনায়ার হাতে টান পড়তে ভয়ে লাফ দিয়ে উঠে আনায়া। ফ্লাশ ধরতে দেখে মিসবাহ। আনায়া তাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে,

-কোথায় লুকিয়েছিলে সোনা?

-ওই যে গাড়ীটার পেছনে।

আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মিসবাহ। আনায়া খেয়াল করে অন্ধকার বললে ভুল হবে ল্যাম্পপোস্টের কিছুটা আলো বাড়ি খাচ্ছে তবে গাড়ীর পেছনটা নিশ্চয়ই গাছপালা দ্বারা আবৃত্ত জঙ্গল টাইপ হবে।

-চলো সোনা আমরা মামুকে কল দিয়ে জানিয়ে দেই?

-তাড়াতাড়ি কল দিয়ে বলো।

আনায়া নিবরাসকে কল দেয় তড়িঘড়ি। কল রিসিভ হতে নিবরাসের ব্যস্ত কন্ঠ শোনতে পায় আনায়া।

-কোথায় তুমি? মিসবাহ কোথায়? তুমি ঠিক আছো?

-ল্যাম্পপোস্টের এখানে আমরা। তাড়াতাড়ি আসুন! বাকী কথা পরে বলবো।

আনায়া কল কেটে দেয়। তখন একটা ছেলে লাইট জ্বালায় তাদের চোখেমুখে। আনায়া চোখ বন্ধ করে নেয়। ফোন হাতে ছেলেটা বলে,

-স্যার নেতার বউ,ভাগ্নে দুটোকে একসাথে পেয়েছি।

-তাড়াতাড়ি দুটোকে আমার কাছে নিয়ে আয়।

শামিম সরদার লাইন কেটে দেয়।
আনায়া মিসবাহর হাত ধরে ছুটে বেড়িয়ে পড়ে। লোকটা ফোন পকেটে ঢুকাতে,ঢুকাতে লেট হয়ে যায়।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে