হৃদয় গহীনে তুমি আছো পর্ব-১০

0
498

#হৃদয়_গহীনে_তুমি_আছো।🦋
#লেখনীতে_ফাতিমা_তুয_যোহরা।
#পর্বঃ১০

গগনের বুকে আজ একরাশ বিষন্ন মেঘে আচ্ছন্ন। বিকেলের হিমশীতল হাওয়ায় সিরাতের কানের পিছনে গুঁ’জে থাকা এলোমেলো হওয়া চুলগুলো ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। মনটা কেমন আঁধারে তলিয়ে রয়েছে তাঁর। বুক চি’রে একরাশ দীর্ঘশ্বাস ছারলে চোখের কোনে এসে জমা হলো জমে থাকা নোনাজল।
— সাইনটা করো সিরাত।
সাফিনের শীতল কন্ঠের রেশ কানের কাছে এসে বা’রি খেয়ে গেলে সাদারাঙা কাগজটার দিকে ধীর চাহনিতে তাকাল সিরাত। এতক্ষণে জমে থাকা নোনাজলগুলো চোখ বেয়ে অনবরত ঝরে পরতে থাকলো সিরাতের৷ তোহার জন্য এটা তাকে করতেই হবে। তোহা নিজের জীবনের পরোয়া না করে তাঁকে বাঁচিয়েছে। হয়তো এই ঋন সিরাত কখনো ভু’লতে পারবে না। বোধহয় এই স্যা’করিফাই’জডটাও কম পরে যাবে তাঁরজন্য।
কাজি অপিসের কাঠের চেয়ারটাতে যেন হাত-পা অবশ হয়ে গাঁ’ট হয়ে বসে আছে সিরাত।
সামনে বসে থাকা কালো সাদা রাঙা কোর্ট পরা লোকটা কলমটা সিরাতের দিকে বাড়িয়ে দিলে সাফিন সেটা নিয়ে সিরাতের হাতে ধরিয়ে দিলে সাফিনের দিকে ধীর চাহনিতে তাকিয়ে আবার কাগজের দিকে তাকালো সিরাত৷ যেখানে বড়-বড় অক্ষরে শাহনেওয়াজ সাফিন লেখা রয়েছে।
চোখ খিঁ’চে নিজেকে শ’ক্ত করে শীতল হাতে সাফিনের নামের পরে সিদ্রাতুল সিরাত লিখে দিলে বাঁকা হাসি হাসলো সাফিন। কাগজটা হাতে নিয়ে এক নজর চোখ বু’লিয়ে পাশে থাকা জুবায়েরের উদ্দেশ্য বললো।
— জুবায়ের আমি বিয়ে করে নিয়েছি। নানুকে জানাও আর বলো রাজবাড়ী আমার নামে লিখে দিতে।
জুবায়ের একগাল হেসে বললো।
— কংগ্রাচুলেশনস স্যার। ম্যাম আপনাকেও। এক্ষুনি জানাচ্ছি আমি স্যার। সাফিন হাসলো।
সিরাত দীর্ঘক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে নিজেকে শান্ত করে ধীর চাহনিতে সাফিনের দিকে তাকালো। বললো।
— আমার টাকাটা।
মৃদু হাসলো সাফিন সিরাতের দিকে ধীর চাহনিতে তাকিয়ে সিরাতের চেয়ারটা নিজের দিকে ঘুড়িয়ে আনতে বিরক্ত হলো সিরাত। পিটপিট করে সাফিনের দিকে তাকাতে সাফিন বাঁকা হেসে শীতল হাতে সিরাতের দুই গালে হাত ছুঁয়িয়ে দিয়ে সিরাতের কপালে গাঢ় চুমু খেল। গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
— তুমি এখন মিসেস শাহনেওয়াজ বুঝলে সিরাত। সে তুমি এক বছরের জন্য হও বা সারাজীবনের জন্য। তাই ব্রাক অফিসের মতো চিপ জায়গায় তোমাকে আমি যেতে দেব ভাবলে কিভাবে তুমি! জুবায়ের।
—জ্বী স্যার?
— বাড়িতে পরে জানিয়ো। আমি নিজে সবাইকে জানাব। তুমি আপাদত গাড়িতে যে লাগেজটা দেখেছো ওতে ২৫ লাখ টাকা আছে, ওটা ব্রাক অফিসে দিয়ে আসো।
—জ্বী স্যার৷
—সিরাত কাগজটা দেওতো।
শুঁকনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে ব্যাগ থেকে কাগজটা সাফিনের দিকে বাড়িয়ে দিতে সাফিন কাগজটা নিয়ে এক নজর পরখ করে জুবায়েরের দিকে বাড়িয়ে দিল। বললো।
— ওখান থেকে সোজা নির্বাচনে যাবে। মোহন আর হেলাল কি সামলেছে কে জানে। আমিতো থাকতে পারলাম না এবার তবে সব গুছিয়ে তো এসেছি। ড্যাড নিশ্চয়ই রেগে আছেন আমার উপর। জুবায়ের কাগজটা নিয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বেড়িয়ে পরলো।
সাফিন রেজিষ্ট্রেরি পেপারটা ফাইলে ভরে সামনের লোকটার সাথে কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করে সিরাতের দিকে ধীর চাহনিতে তাকিয়ে বললো।
—চলো সিরাত।
ক্লান্ত মিয়িয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে সাফিনের দিকে পিটপিট করে তাকালে সাফিন মৃদু হেসে সিরাতকে পাঁ’জাকোলা করে নিল। সিরাত অবাক হলো ঠিকই কিন্তু মুখ খুলে কিছু বলতে পারলো না। ক্লান্তিতে সমস্ত শরীর যেন থ’ম মেরে গেছে তাঁর। সাফিনের বুকের সাথে লে’প্টে গিয়ে চোখ বুজতে সাফিন সিরাতের মা’য়াময় চেহারার দিকে এক নজর তাকিয়ে দরজা ঠেলে বেড়িয়ে পরলো।
.
গাড়ির দরজাটা খুলে সিরাতকে বসিয়ে দিলে সিরাত নিস্তে’জ হয়ে পরে রইলো সিটের সঙ্গে।
সাফিন ধীর চাহনিতে সেদিকে তাকালো। বুকটা কেমন মু’চরে উঠলো তাঁর।
— তোমাকে এভাবে মানাচ্ছে না সোনা! তোমার চঞ্চলতা না দেখা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না আমি।
(মনে-মনে কথাটা বলে সিরাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে পরলো সাফিন।)
“গগনের লালছে হয়ে যাওয়া দৃশ্যটা যেন সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বাভাস জানিয়ে দিতে ব্যাস্ত হয়ে পরেছে।” সো-সো শব্দ করে বাতাস বয়ে গেলে সিরাতের সমস্ত শরীরে যেন কাঁ’পুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। গাড়ির কাঁচ ভেদ করে লালচে রাঙা আকাশে পাখিদের নিজেদের নীরে ফিরে যাওয়ার ব্যাকুলতা দেখতে থাকলো সে।
ড্রাইভিং করার পাশাপাশি আর চোখে সিরাতের শুঁকনো চেহারাটা দেখে সাফিন বললো।
—শা’ক’চু’ন্নি হাসপাতালে যাবা নাকি তোহার কাছে?
সিরাত ধীর চাহনিতে সাফিনের দিকে তাকালো। মৃদুস্বরে বললো।
— হুম৷ আচ্ছা আমি আপনার সাথে চলে গেলে তোহাকে কে দেখবে? ওতো একা হয়ে যাবে তাইনা?
— ওরে আমার বউ, তোমাকে এত ভাবতে হবে না। আমি সব ব্যাবস্থা করে এসেছি। তোহার জ্ঞান ফিরেছে নাকি কিছুক্ষণ আগে। তুমি চাইলে নিয়ে যেতে পারি নয়তো সোজা শশুরবাড়ি চলো।
সিরাতকে রাগানোর জন্য সাফিন কথাগুলো বললেও আজ আর সিরাত রাগলো না। সিটের সঙ্গে মাথা এলিয়ে দিয়ে শুধু বললো।
— হাসপাতালে চলুন।
সাফিন মৃদু হাসলো। গাড়িটা সামনে গিয়ে বা দিকে ঘুড়িয়ে ফেলতে ফোনটা বেজে উঠলে কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে অন করতে জুবায়ের উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠলো।
— স্যার বড় সাহেব নির্বাচনে জিতে গেছেন। আজকে পুরো শহর কাঁ’পিয়ে ফেলা হবে আনন্দে।
হেসে উঠলো সাফিন। গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
— এটা হবে জানাই ছিল। যাইহোক পার্টি-সার্টির ব্যাবস্থা করো তাহলে। কালকে আশ্রমের বাচ্চাদের জামা-কাপড় দিতে ভুলোনা যেন। আমি ব্যাস্ত আছি তোমার ম্যামকে নিয়ে।
জুবায়ের হাসলো।
ফোন কাটার আগেই পর-পর আমেনা বেগম আজাদ সাহেব মোস্তফা সাহেবের ফোনকল আসাতে ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিল সাফিন৷ একসাথে বাড়িতে গিয়ে সব কথা হবে ভেবে।
.
হাসপাতালের সামনে এসে গাড়িটা থামাতে ধীর পায়ে নেমে পরলো সিরাত। সাফিন গাড়িটা লক করে বের হয়ে সিরাতের পাশে এসে দাঁড়াতে না চাইতেও শরীরের দূর্বলতার কারনে সিরাত সাফিনের হাত ধরাতে সাফিন হেসে সিরাতকে উল্টো ভাবে পাঁ’জা কোলা করে নিল। সিরাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো।
—আমার ঝগ’ড়ুটে বউটা এভাবে বরের সাথে ঝগ’ড়া না করে শান্ত হয়ে গেল কিভাবে হুম!
সিরাত সাফিনের দিকে এবার রাগ নিয়ে তাকালে হেসে উঠলো সাফিন। বললো।
— উফ সিরাত। মাই জান তোমাকে এমন নিরামিষ ঠিক মানাচ্ছে না বেব্বি। ট্রাস্ট মি তোমাকে ঝগ’ড়াতেই যায় এভাবে নয়।
— এ থামবেন কিনা বলেন? সেই সকাল থেকে আপনার প্যা’ন>প্যা’নানি শুনেছি। শান্ত আছি ভালো লাগছে না তাইনা? শ’য়’তা’ন বে’ডা।
সাফিন জোরে হেসে উঠলো। সিরাতের নাকটা টেনে দিয়ে বললো।
— এইতো আমার ঝগ’ড়ুটে বউটা হাজির। এবার ঠিক আছে চলো যাওয়া যাক।
সিরাত রাগে ফুঁ’সতে থাকলে সাফিন মিটমিট করে হাসতে থাকলো।
.
হাসপাতালের বেডে তোহার পাশে টুল টেনে বসে শীতল হাতে তোহার মাথায় হাত ছোঁয়াতে চোখ খুললো তোহা। সিরাত একবার ভাবলো লোনের ব্যাপারটা নিয়ে জিজ্ঞেস করবে কিনা তোহাকে। কিন্তু বিবেক বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে চুপ হয়ে গেল সে। মৃদু হেসে সিরাতের দিকে তাকাল তোহা। কেঁদে উঠলো সিরাত। কান্নারত কন্ঠে বললো।
— আই এম সরি দোস্ত। আমার জন্য আজ তোর এই অবস্থা। মাফ করে দিস দোস্ত আমাকে।
তোহা সেলাইন লাগানো হাতটা ক’ষ্ট করে জাগিয়ে সিরাতের হাতের উপর রাখলে তোহার হাতটা জলদি নিজের হাতের মুঠোয় করে নিল সিরাত৷ তোহা রাগ নিয়ে ধীর কন্ঠে বললো।
— একটা কানে খাবি সিরাত। তোকে এত কে ভাবতে বলেছে হ্যা। নিজের কি হাল করেছিস রে তুই। চোখের নিচে কালি পরে গেছে তোর। এই তুই খেয়েছিসতো নাকি?
—তোমার বান্ধবীকে জোর করে খায়িয়েছি আমি৷ মেয়ে কথা শুনে না। তোমার জন্য অস্থি’র সে।
দরজার কাছে হেলান দিয়ে থাকা সাফিনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু জাগিয়ে ফেলল তোহা। সেদিন শপিংমলের টিভির স্ক্রিনে নিউজটা চোখে ভাসতে চোখ বড়-বড় করে সিরাতের দিকে তাকালো তোহা।
সাফিন ধীর পায়ে ভিতরে এগিয়ে এসে তোহার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো।
— তোমার বান্ধবীর হাসবেন্ড। শাহনেওয়াজ সাফিন। কথাটা বলে তোহার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে সেলাইন লাগানো দেখে হাতটা সরিয়ে নিল।
—উপস সরি, তুমি এখন ঠিক আছো তো নাকি?
সিরাত সাফিনের দিকে রাগ নিয়ে তাকিয়েও আবার চু’পসে গেল। তোহা একবার সিরাত তো একবার সাফিনের দিকে তাকাতে নার্স খাবারের ট্রেটা নিয়ে এসে সাফিনের দিকে তাকিয়ে চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে হেসে বললো।
—স্যার আপনি নিজে এসেছেন, আপনার পেসেন্টের কোনো অজন্ত হতে দিব না ইনশাআল্লাহ। মনে হচ্ছে পেসেন্ট আপনার কাছের কেউ হবেন।
সিরাত সাফিনের দিকে ধীর চাহনিতে তাকাতে সাফিন হেসে হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে টাইম দেখে বললো।
—আমার বউয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড তো তারজন্য।
বাই দ্য ওয়ে, কতদিন থাকতে হবে ওনাকে এখানে?
নার্সটা তোহাকে জাগাতে নিতে সিরাতও হাতে হাত লাগিয়ে উঠে বসালো তোহাকে।
— এটাতো আমি বলতে পারছি না স্যার। এটা ডক্টর বলতে পারবেন। আমি ডেকে আনছি তাকে এক্ষুনি। তিনি হয়তো জানেন না আপনি আসছেন, নয়তো চলে আসতেন এতক্ষণে নিজেই।
সাফিন মৃদু হেসে বললো।
—না থাক আপনি ওনাকে দেখুন আমি দেখছি।
সিরাত তোহাকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরলো। সাফিন কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেলে তোহা চটজলদি সিরাতের দুইহাত পাকরাও করে ফেলল। বললো।
— তুই বিয়ে করেছিস সিরাত! লাইক সিরিয়াসলি? আমাকে জানাসও পর্যন্ত নি।
সিরাত কয়েকটা ঢোক গি’লে মৃদু হেসে তোহার কপালে চুমু খেয়ে বললো।
— বাদ দে না দোস্ত এসব। বিয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে? আমি সারাক্ষণ তোর কাছে তোর পাশে আছি, আর সবসময় থাকব৷ এবার নে তো লক্ষী মেয়ের মতো ফলের রসটা খেয়ে নে।
গ্লাসটা এগিয়ে দিতে তোহা এক ঢোক খেয়ে নার্সের দিকে তাকালে তিনি বললেন।
— ড্রেসিং করতে হবে ওনাকে এখন। প্লিজ আপনি যদি একটু বাহিরে যেতেন ম্যাম৷
সিরাত গ্লাসটা তোহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে রাগ নিয়ে বললো।
— পুরোটা খাবি।
—আরে ও কেন যাবে। ও থাকুক এখানে।
সিরাত মৃদু হেসে বললো।
— এখানেই আছি তুই বোস চুপচাপ এখানে।
.
— স্যার এটা যেহেতু আপনার পেসেন্ট তো আর কিসের কথা। আপনি আপনার ইচ্ছেতে নিয়ে যেতে পারেন।
চেয়ারের উপর পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে সাফিন। ধীর চাহনিতে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বললো।
— ভালো হবে কিসে সেটা জানতে চাইছি?
—মিনিমাম এক সপ্তাহ থাকুক এখানে। আপনার ইচ্ছে আরকি।
হাসলো সাফিন। গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
— আচ্ছা তাহলে পাঁচজন বিশ্বস্ত নার্স ঠিক করে রাখুন। আমি আবার এসে দেখে যাব মেয়েটাকে।
—আচ্ছা স্যার।
সাফিন চলে যেতে ডক্টর যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। চেয়ারে বসে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলেন।
.
—চলো সিরাত। তোহার কিছু হবে না আর। টেনশনের কারন নেই আর। কালকে এসে দেখে যাবে আবার এখন চলো শশুরবাড়ি।
বাহির থেকে এক নজর তোহার মুখটার দিকে ধীর চাহনিতে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললো।
—আসছি দোস্ত।
তোহা ছলছল চাহনিতে সিরাতের দিকে তাকাতে দী’র্ঘশ্বাস ছারল সিরাত।
“শাহনেওয়াজ ভিলার সামনে গাড়ি এসে থামতে দ্রুত গার্ডরা দরজা খুলে দিলে ফুল দিয়ে সজ্জিত সাদা রাঙা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে চোখ বড়-বড় করে ফেলল সিরাত। ”
সাফিন দরজার সামনে গাড়ি থামাতে ভিতর থেকে আমেনা বেগমসহ আরও কিছু মহিলারা ফুল আর ডালা নিয়ে ছুটে আসলে ভ্রু জাগিয়ে ফেলল সাফিন। আজাদ সাহেব এবার আর লাঠি নয় বন্দুক হাতে নিয়ে বের হলেন। সাফিন গাড়ি থেকে নেমে পরলে সিরাত অসস্থি নিয়ে গাড়িতে বসে থাকলে সাফিন সেদিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বললো।
— তোমাকে কি এখন কোলে করে নামাতে হবে সিরাত?
সিরাত রাগ নিয়ে তাকানোর আগেই আজাদ সাহেব সাফিনের বুক বরাবর বন্দুক তাক করে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন।
— শালা শ’য়’তান৷ বিয়া করছো আর বাড়িতে কাউকে জানাস নি? ফোন বন্ধ করে রাখছো’ত। যেমন তোর বাপ তেমন তুই। আমার কত শখ ছিল নাতিবউ আনার সময় ধূমধাম করে পুরো শহর নাচিয়ে ঘোড়ায় করে আনব। সেই রকম খাওয়া-দাওয়া হবে। খাসি,গরুর গোস্ত, আহা কি স্বাদ। সবকিছুতে দিলিতো মাটি করে। তুই একবার বলতে পারতি আমাকে। সাফিন হেসে উঠলো। বললো।
— আহা সোনা, তোমার খালি খাই-খাই। অসুস্থ ছিলা ভুলে গেলা নানু৷
—অসুস্থ হবে তোর বাপ এই আজাদ না।
সাফিন হেসে উঠতে আমেনা বেগম সাফিনের কানটা টেনে ধরে বললেন।
— আম্মার প্রতি এই তোর ভালোবাসা? আম্মার কাছে নাকি সব শেয়ার করিস তুই। এই তাঁর নমুনা কই দেখি আমার মেয়ে কই।
—আহ আম্মা ছাড়ো আমাকে। তোমার ছেলে যে বিয়ে করেছে এটা কি অনেক নয় নাকি?
— তোকে পরে দেখাচ্ছি। আগে আমার মেয়েকে দেখে নেই। আমেনা বেগম গাড়ির দরজাটা খুলে সিরাতের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে সিরাতের গালে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বলে উঠলেন।
— মাশাআল্লাহ। মেয়ে আমার হুরপরী।
আজাদ সাহেব বন্দুকটা জুবায়েরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাড়ির সামনে এসে সিরাতকে দেখে চোখে মুখে খুশিতে সাফিনের উপর আর রাগ দেখাতে পারলেন না। সিরাত চোখ বড়-বড় করে শশুরবাড়ির সবাইকে দেখে নিল। ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নেমে দাদাশ্বশুর আর শাশুড়ীকে পা ছুঁয়ে সালাম করতে যেতে আমেনা বেগম সিরাতের দুইহাত ধরে উঠিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন।
— ওই মাইয়া মায়ের পা ছুঁচ্ছিস কেন হুম। আমি কিন্তু শাশুড়ী-টাশুড়ী না কোনো তোর। তোর মা আমি। তা তোর মা আবার রাগ-টাগ করলেও আমাকেও নিজের মা ভাবতে হবে বলে রাখলাম। কথাটা বলে নিজ হাত থেকে সর্নের মোটা বালাদুটো পরিয়ে দিলেন সিরাতকে।
আমেনা বেগমের মমতাময়ী স্পর্শে সিরাতের চোখে পানি এসে ভর করলো।
আমেনা বেগম ভ্রু জাগিয়ে ফেললেন বললেন।
—উহুম, কান্নাকাটি কিসের আবার!
সিরাত শুকনো হাসি হেসে মাথা নিচু করে বলল।
—আমার মা-বাবা কেউ নেই।
আমেনা বেগম খানিক চুপ থেকে সিরাতকে জড়িয়ে ধরে বললেন।
— আমরা বুঝায় ভেসে আসছি তোর কাছে! এইসব কথা যেন আর না শুনি মেয়ে কখনো।
সিরাতের কথাটা সাফিনের কানে পৌঁছাতে ধীর চাহনিতে তাঁর দিকে তাকালো শুধু।
এতক্ষণে মোস্তফা সাহেব আর সরোয়ার সাহেব বের হলেন বাড়ি থেকে। মোস্তফা সাহেব সাফিনের বুকের উপর হালকা কি’লের মতো দিয়ে বললেন।
—বাপ কা বেটা।
সাফিন হেসে উঠলে সরোয়ার সাহেব সাফিনকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন।
— ইসরে খাওয়া-দাওয়াটা হলো না।
মোস্তফা সাহেবের গলায় থাকা নির্বাচনের মোটা-মোটা ফুলের মালা থেকে একটা সিরাতের গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন।
— খাওয়া-দাওয়া হলো না মানে! কালকে সকালের মধ্যে পুরো শহরে কাঁপিয়ে দেওয়া হবে। শাহনেওয়াজ সাফিনের বিয়ে বলে কথা। এ রকম একঘেয়ে ভাবে হয়ে গেলেই হলো নাকি?মোস্তফা সাহেব সিরাতের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বললেন।
— এই নাহলে আমার ছেলের পছন্দ। যা সাফিন তোর উপর যে রাগ জমেছিল না আজকে নির্বাচনে বসে। এখন তা আর নাই, মা’ফ করে দিলাম বাঁ’ছা আমার।
সিরাত শশুরের দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে মৃদু হেসে পা ছুঁতে যেতে নিতে রাগ নিয়ে বললেন।
—হোপ, এইমাএ তোর আম্মা কি বললো ভুলে গেলি। হাসলো সিরাত। বললো।
—আচ্ছা ভুল হয়ে গেছে আমার।
—আরে ধুর তোমরা আমার বউকে আর কতক্ষণ এখানে দাঁড় করাই রাখবা। ভিতরে কি ঢুকতে দেবে না নাকি?
হুট করে সাফিনের এমনধারা কথা শুনে সবাই হেসে উঠলে সিরাত চোখ গরম করে তাকাতে চোখ মারলো সাফিন তাঁকে।
আজাদ সাহেব বললেন।
— তোর বউ কি রে আবার? আজকে দিনে বউকে ভুলে যা কাল আসিস। আসসালামু আলাইকুম।
হেসে উঠলো সাফিন। চোখ মেরে বললো।
— আমার বউকে আমি এক মিনিটও ছারছি না হুম।
সিরাত পুরো ল’জ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে সাফিনের কথাবার্তা শুনে।
— এই লোকের কি কোনো ল’জ্জা নেই নাকি! মানে মুখে যা আসবে বলে দিলেই হলো। এ রকম বেশ’রম লোক একটা দেখিনি আমি। (মনে-মনে কথাটা বলে রাগে ফুঁ’সতে থাকলো সিরাত।)
.
—তোমাকে দিয়ে যদি একটা কাজ হয়। আমি ভাবছি আমি টাকা দিয়ে কতগুলো গরু-ছাগল পালছি এতদিন ধরে। একটা গু’লি পর্যন্ত ঠিকঠাক ভাবে করতে পারো না তুমি। কাকে রেখে কাকে গু’লি করেছো হ্যা। এ রকম আহা’ম্মকের মতো কাজ করার জন্য মাসে-মাসে আমার থেকে গুনে-গুনে টাকা নেও।
সামনে দাঁড়ানো লোকটা মুখটা কাঁ’চু>মা’চু করে মাথা নিচু করে ধীর কন্ঠে বললো।
—সরি সাহেব। আপনি তো দেখেছেন আমি চেষ্টা করেছি।
—চুপ থাকো তুমি। তোমার চেষ্টা দিয়ে আমার এখন কিচ্ছু হবে না। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন দলিলে সাইন করার আগে ওই বুড়োকে মা’রবে নয়তো সাফিনকে চিরতরে উপরে পাঠিয়ে দেবে। নয়তো তোমাকেই আমি উপরে পাঠিয়ে দেব।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা ভয়ে ঢোক গিললে পিছু ফিরে থাকা অন্ধকারের লোকটার দিকে ধীর চাহনিতে তাকাতে নিজের প্যান্ট ভে’জা অনুভব করে ভয়ে কেঁ’পে উঠলেন সে।
.
পুরো বাড়িটাতে ঝাড়বাতির জ্বলে নেভে আলো চোখেমুখে এসে ছেঁয়ে পরছে যেন সিরাতের। রাত এখন আটটা নাগাত। আমেনা বেগম সিরাতকে পুরো বাড়ি ঘুড়িয়ে দেখিয়েছেন। নিজের হাতে খায়িয়ে দিয়ে তাঁকে লালরাঙা শাড়ি পরিয়ে দিয়ে গহনা পরাতে যেতে সিরাত ধীর চাহনিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললেন।
—আজকে এসব থাকনা আম্মা। মাথাব্যাথা করছে প্রচুর।
আমেনা বেগম হাসলেন সিরাতকে জড়িয়ে ধরে বললেন।
—কি বললি আবার বল?
ভরকে গেল সিরাত। কিছু ভু’ল বলে ফেলেনি তো আবার?
—না মানে মাথা ব্যা’থা করছে সেটাই আরকি।
— আরে ওটানা তার আগে কি বলেছিস।
— আম্মা।
হাসলেন আমেনা বেগম। বললেন।
—আবার বলতো একবার।
সিরাত আমেনা বেগমের দিকে শীতল চাহনিতে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো।
—আম্মা।
আমেনা বেগম সিরাতের হাত ধরে বললেন।
— আচ্ছা চল তাহলে তোকে তোর বরের রুমে দিয়ে আসি। কালকে তোদেরকে নিয়ে পার্টির ব্যাবস্থা করবে তোর আব্বা।
কথাগুলো বলতে-বলতে একধাপ-একধাপ করে সিঁড়ির দিকে এগোতে থাকলে সিরাতের হার্টবিট যেন ক্রমশ বাড়তে থাকলো। গলা শুকিয়ে আসতে চাইছে যেন তাঁর।
কয়েক কদম পর পা থ’মকে দাঁড়াতে আমেনা বেগম হেসে ধীর কন্ঠে বললেন।
— যা ভিতরে যা৷ আর শোন, আমার ছেলেটা কিন্তু সামনে থেকে কঠোর দেখালেও ভিতর থেকে অনেক নরম৷ ওকে কিভাবে শাসনে রাখবি কালকে এই নিয়ে গবেষণা করবনে দুই মা মেয়ে মিলে। যা এখন ভিতরে যা।
আমেনা বেগম চলে গেলে হেসে উঠলো সিরাত।
ভয়ে-ভয়ে দরজাটা ঠেলে ভিতরে পা দিতে অন্ধকার রুমটাতে চোখ বো’লাতে থাকলে হুট করে গিটারের টং-টাং আওয়াজের সাথে গান ভেসে আসলো বারান্দার দিক থেকে।

~ চাহে কুছনা কেহনা
ভালে চুপতো রেহনা
মুঝে হে পাতা
তেরে পেয়ার কা
খামোস চেহরা
আখোপে পেহরা
বুন্দ হে গাওয়া
মেরে পেয়ার কা।
মেরি ছুপি নাজার
তেরি হার আদা
মুঝে কেহরাহিরে এ রাস্তা……

বাড়ান্দার দোলনায় বসে সাফিনের গানের কন্ঠ শুনে বাড়ান্দার দরজায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়াল সিরাত। আকাশের মেঘের কনাগুলো এলোমেলো ভাবে ভেসে যাওয়ার শহিত হীমেল হাওয়ায় পরিবেশে কাঁ’পুনি ধরিয়ে দিতে সিরাত হাতের সাথে হাত ঘ’ষতে থাকলে সাফিন ধীর চাহনিতে ঝাড়বাতির নিভু-নিভু আলোয় সিরাতকে দেখে তাঁর ব্রাউন্ড রাঙা চুলে ঝাড়ি দিয়ে গিটারটা দোলনার উপর রেখে ধীর পায়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে নিতে সিরাত ভয়ে কয়েকটা ঢোক গি’লে পিছিয়ে যেতে নিতে দরজার পাশে থাকা ফুলের টপটা ভে’ঙে গুড়িয়ে গেলে সাফিন হেসে সিরাতকে পাঁ’জা কোলা করে নিল। সিরাত ভয়ে সাফিনের বুকে এলোপাথাড়ি কি’ল ঘু’ষি দিতে থাকলে সাফিন সিরাতকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে দুইহাত চে’পে ধরতে সিরাতের নিশ্বাস ঘন হয়ে আসলো যেন ভয়ে। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে ঝাড়বাতির মৃদু আলোয় সিরাতের গোলাপি রাঙা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থেকে তাঁর কপালে চুমু খেয়ে সাফিন ধীর কন্ঠে বললো।
— তো এখন গু’লি করে মে’রে দেই তোমাকে বেব্বি। চর মেরেছিলে না আমাকে।
ভয়ে চোখ মুখ খিঁ’চে বন্ধ করে রাখলো সিরাত…

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে