#হৃদয়_গহীনে_তুমি_আছো।🦋
#লেখনীতে_ফাতিমা_তুয_যোহরা।
#পর্বঃ৯
বাড়িতে এসে লাইট অফ করে অন্ধকার রুমটাতে বসে আছে সাফিন। বারংবার রাফির সাথে সিরাতের ডুয়েট ডান্সটা চোখে ভেসে উঠতে থাকলে রাগে মাথা হে’ট হয়ে যাচ্ছে তাঁর। জুবায়ের দরজাটা ঠেলে ভিতরে এসে লাইট অন করে দিলে বিরক্তি নিয়ে তাঁর দিকে তাকালো সাফিন৷
জুবায়ের খানিকটা থ’ত’ম’ত খেয়ে গিয়ে ধীর কন্ঠে বললো।
—স্যারের মুড অফ মনে হচ্ছে।
সাফিন চুপ করে থাকতে জুবায়ের সাফিনের র’ক্তে ভেজা হাতটার দিকে ধীর চাহনিতে তাকিয়ে ড্রয়ার থেকে ফাস্টএইড বক্সটা বের করে চেয়ার টেনে সাফিনের পাশে বসে হাতটা নিজের কাছে আনলো।
সাফিন দাঁতে দাঁত চে’পে চোখ বন্ধ করে যন্ত্র’ণাটা স’য্য করে নিল।
অনেকটা কাঁচ ঢুকে গেছে হাতের ভিতর। জুবায়ের ভালোভাবে হাতটাকে ড্রেসিং করতে-করতে বললো।
— আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে স্যার মেয়েটার প্রতি একটু হলেও দূর্ব’ল হয়েছেন। না মানে, আমার ধারনা আরকি। যেভাবে রিয়াক্ট করে বিয়ে বাড়ি থেকে চলে এলেন কাউকে না জানিয়ে। সবাই এখন আমাকে ফোন করে-করে পা’গল বানিয়ে ফেলেছে।
সাফিন দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে জুবায়েরের দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
— জানিনা দূর্ব’ল কিনা৷ কিন্তু মেয়েটা আমার হৃদয়ের সাথে গেঁথে গেছে। ওর পাশে অন্য কোনো ছেলেকে দেখলে আমার মাথায় র’ক্ত উঠে যায় কেন যেন! রাগ হয় প্রচুর। আজকে মোটেও ভালো লাগেনি আমার ওকে অন্য কারো সাথে ডুয়েট ডান্স করতে দেখে। ছেলেটা ওকে ছুঁয়েছে এটা ভাবতেই ওকে খু’ন করতে ইচ্ছে করছে আমার। রুবাইয়াতের কাজিন বলে সিনক্রি’য়েট করিনি, নয়তো দেখিয়ে আসতাম ওর ম’জা।
জুবায়ের হেসে উঠলো। সাফিনের কাঁধে হাত রেখে বললো।
—স্যার মেয়েটার উপর পাক্কা প্রেমে পরেছেন। আপনি একবার আদেশ করুন শুধু আমি তুলে নিয়ে আসছি ম্যামকে।
সাফিন ধীর চাহনিতে জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে হাসলো। বললো।
—মেয়েটাকে আমি যদি কোনে ভাবে ভালোও বেসে থাকি তবুও ওকে আমি সেটা এত সহজেই বুঝতে দেব না। আমাকে চর মারা’র মূল্যতো ওকে দিতেই হবে।
জুবায়ের হা হয়ে সাফিনের দিকে তাকাতে তাঁর ফোন বেজে উঠলে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতে অপর প্রান্তের কথা শুনে নিমিষেই চেহারার রঙ উড়ে গেল জুবায়েরের। সাফিন জুবায়েরের দিকে ভ্রু জাগিয়ে তাকাতে জুবায়ের ভয়ের কন্ঠে বললো।
—স্যার স্টোর রুমের লোকটা নিজেকে নিজে গু’লি করেছে। হেলাল আমাদের পার্মানেন্ট ডক্টরকে এনেছে ওখানে। কিন্তু,
সাফিন দ্রুত বসা থেকে উঠে বসলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
—কিন্তু কি জুবায়ের? ড্যাম ইট৷ বন্দুক কোথায় পেল ও। আর হেলালই বা কি করছিল তখন? বেঁচে আছেতো নাকি? জুবায়ের মাথা নিচু করে ফেলল। ধীর কন্ঠে বললো।
— নো স্যার, হি ইজ ডে’ট। গু’লিটা ঠিক বুকের উপর লেগেছে, ডক্টর কিছুই করতে পারেননি।
বিরক্ত হলো সাফিন৷ বললো।
—দ্রুত চলো এখন। কে জানে ওদিকে এখন কি সিচুয়েশন কারি করে রেখোছো তোমরা আমার জন্য। লোকটাকে আমার প্রয়োজন ছিল। হেলাল ওর বয়ান রেখেছে কিনা আল্লাহই জানেন।
জুবায়ের মাথা নিচু করে ফেলল।বললো।
—সরি স্যার।
— তোমার সরি এখন আমার কোনো কাজে আসবে না জুবায়ের৷ চলো এখন।
—জ্বী স্যার।
.
—সাহেব ওকে মে’রে দিয়েছি। ভাগ্যিস আমি নিজে যাইনি মিশনে৷ ওকে মে’রে দিয়েছি এবার সবকিছু শান্ত হয়ে যাবে। ওই সাফিন আর আপনার টিকিটিও ধরতে পারবে না।
কালো রাঙা জ্যাকেট পরা লোকটা পিছুঘুরে দেয়ালের সাথে হাত ঠেকিয়ে হেসে উঠলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন।
— সাফিন আমার টিকিটিও যে ধরতে পারবে না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত৷সাফিনকে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যা’থা নেই আপাদত। কিন্তু আমার মাথাব্যা’থা শুধু এবং শুধু মাএই রাজবাড়ী নিয়ে। ওই রাজবাড়ি আমার চাই৷ ৫০০ কোটি টাকার মহল কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারব না আমি। মেয়েটাকে আজকের মধ্যে উড়িয়ে দেও। কিভাবে দিবে, কি করবে ওসব আমি জানতে চাইছি না। আমি চাই মেয়েটার লা’শ৷ আর সেটা আজকের মধ্যেই। এতদিনের চেষ্টা এক মূহুর্তে শেষ হয়ে যাবে ওই মেয়ের কারনে, সেটাতো আমি বেঁচে থাকতে কখনোই হতে দেব না।
—জ্বী স্যার, আজকের মধ্যেই মেয়েটার লা’শ আপনার পায়ের কাছে এনে রাখব।
লোকটা হেসে উঠলো। বললো।
—পায়ের কাছে আনতে হবে না। জাস্ট নদীতে ভাসিয়ে দেবে।
—আচ্ছা স্যার।
.
গগনের কোল ঘেঁষে আজ শ্রাবন সন্ধ্যায় পরিপূর্ণ। এলোমেলো হয়ে ভেসে যাওয়া কালো রাঙা মেঘদ্বয় থেকে গুড়ুম-গুড়ুম গর্জ’ন পাতের সহিত শহর জুড়ে ঝমঝম বৃষ্টিপাতে বর্ষিত হয়ে গেলে বিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে নিতে রুবাইয়াত তোহার হাত ধরে পথ আঁ’টকে দাঁড়িয়ে পরলো। বললো।
— মাএ বিয়ে হলো আমার তোরা এখনই চলে যাচ্ছিস। বৃষ্টি পরছে এমনিতেই। এই ঝড় বাদলের মধ্যে কোথাও যাওয়া হচ্ছে না আজ তোদের।
তোহা হাসলো। বললো।
—ওরে জান আমার, আমরা বাড়ি খালি রেখে এসেছি৷ ভিতরে কিছুই লক করিনি আজকে দরজা ছাড়া। আমি গ্রামের বাড়ি গেলে লক করে যেতাম পুরো বাড়ি৷ কিন্তু আজকে কিছুই লক করিনি ফিরব বলে। সন্ধ্যাও হয়ে গেল। আজ আর ব্যাংক থেকে টাকাও তুলতে পারলাম না৷ সিরাতকে নিয়ে বাজারে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যা ঝড় তুফান শুরু হয়েছে শহরে, এর মধ্যে আজ আর যাব না। এখন ডিরেক্ট সিএনজি নিয়ে বাসায় চলে যাব।
রুবাইয়াত মুখ ভার করে ফেলল। রাফি তাঁদের দিকে এগিয়ে আসলে রুবাইয়াত রাফির উদ্দেশ্যে বললো।
— ভাইয়া ওদের দুজনকে একটু ড্রপ করে দিয়ে আসো তো৷ এই ঝড় বাদলের মধ্যে সিএনজি পাবে কিনা সন্দেহ।
তোহা বাঁধ সেধে বললো।
—আরে লাগবে না। বেচারা ভাইয়া শুধু-শুধু আমাদের সাথে যাবেন। সিরাত তোহার হাত ধরে রুবাইয়াতের উদ্দেশ্যে বললো।
— আমরা যেতে পারব তুমি টেনশন কোরো না৷ আমার জান অনেক স্ট্রিট আছে৷ আর তোমাকেও তো এখন শশুরবাড়ি যেতে হবে নাকি? ভাইয়া ওয়েটিংএ আছে তোমার জন্য৷ গাড়িওতো এসে পরেছে। সাবধানে যেও কেমন। আমাদের নিয়ে ভেবো না।
রুবাইয়াত ল’জ্জা পেলে রাফি বলে উঠলো।
— তোর বর ডাকছে তোকে৷ তুই নাকি আজকে নিজ বাড়ি থেকে শশুরবাড়ি যাবি, না আছে চোখে কোনো পানি না আছে কোনো চিন্তা৷ আর বাকিরা তোর জন্য কেঁদে-কেঁ’টে একসাট অবস্থা করে ফেলেছে নিজেদের।
হেসে উঠলো রুবাইয়াত। চোখ মেরে বললো।
—উফ রে, এই কান্নাটাই যে আমার আসে না কেন জানি!
রুবাইয়াতের কথা শুনে রাফি সহ সিরাত আর তোহাও হেসে উঠলো। তোহা বললো।
—তুই পারিসও বটে। আচ্ছা আসলাম আমরা। ভালো থাকিস দোস্ত।
তোহা রুবাইয়াতকে জড়িয়ে ধরে মৃদু হেসে সিরাতের হাত ধরে বেড়িয়ে পরলো দুজনে।
“শহরজুড়ে বৃষ্টির রেশটা বাড়াবাড়ি রকমের ভাবে ছেঁয়ে পড়েছে যেন আজ।” প্রচন্ড উত্তাপে হিমেল হাওয়ায় শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেন কাঁ’পিয়ে দিয়ে ছাড়ছে।
মাথার উপরে ছাতা দিয়ে বর্ষনের রেশ খানিকটা কমালেও শরীরের কাঁ’পা>কাঁ’পি যেন
কোনো ভাবেই থামানো যাচ্ছে না।
হিমেল হাওয়ায় সিরাতের নীল রাঙা সিল্কি শাড়ির আঁচল উড়তে থাকলে অর্থেকটা ভিজে একাকার৷কিছুদূর এসে একটা সিএনজি দেখতে পেলে তোহা হা’ক দিয়ে ডাকাতে সিএনজিটা তাদের সামনে এসে থামলে শাড়ি সামলে উঠে পরলো দুজন। বাতাসের সো-সো শব্দে সিএনজি চলতে শুরু করলে তোহা সিরাতের একগালে হাত রেখে হাসতে থাকলে সিরাত তোহাকে জড়িয়ে ধরলো একহাতে। শীতল কন্ঠে বললো।
—হুট করে তোর কি হলো রে জান। কিছুকি হয়েছে? মুখটা কেমন বাংলার পাঁ’চ করে রেখেছিস!
তোহা মৃদু হেসে বাহিরে তাকালো। ধীর কন্ঠে সিরাতের উদ্দেশ্যে বললো।
—নাহ তেমন কিছু না।
সিরাতও হালকা হেসে উঠলো। বললো।
—সামনে থেকে জিলাপি নিয়ে নেব। আজকে রাতে খাওয়া যাবে দুজনে।
হাসলো তোহা।
.
স্টোর রুমে এসে লোকটার নিস্তে’জ চেহারাটা দেখে রাগে মা’থা ঠিক রাখতে পারলো না সাফিন। হেলালের দিকে বন্দুক তাক করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
—এ মা’রা গেল কিভাবে হুম? থাকো কোথায় তোমরা? আর এ বন্দুকই বা পেল কই?
হেলাল কয়েকটা ঢোক গি’লে সাফিনের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললো।
—স্যার লোকটা বোধহয় নিজেকেই নিজে গু’লি করেছে। কিন্তু আবার গু’লিও দেখছি না। তাছাড়া অন্য ভাবে দেখতে গেলে এই অন্ধকার স্টোর রুমে কেই বা আসবে বা জানবে এখানে কেউ আছে কিনা।
সাফিন সন্দেহের সহিত স্টোর রুমটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে লোকটার চেয়ারের পিছন বরাবার খোলা জানালাটা ঘেঁষে বৃষ্টির শিহরণ ঝড়ে পরতে দেখে বন্দুক হাতে সেদিকে কয়েক পা হেঁটে গিয়ে আবার ফিরে এসে লোকটার দে’হটার দিকে তাকিয়ে উল্টো করলে খানিকটা ভ্রু জাগিয়ে তাকিয়ে হেসে উঠলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
—একে গু’লি করা হয়েছে। বাই দ্য ওয়ে, লোকটা কে জানতে পেরেছো?
হেলাল চমকিত হলো। শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে ধীর কন্ঠে বললো।
—রশিদ স্যার। বাড়ি রাজশাহী। ফলের দোকান দেয়। স্ত্রী আর সন্তানরা ওখানেই থাকেন। তাছাড়া ওর বসের কথা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি এবং মেরে’ছিও প্রচুর। মুখ খোলেনি ও। আপনি চাইলে ওর পরিবারকে ধরে আনতে পারি।
সাফিন বাঁধ সেধে বললো।
—উহুম, আমার মনে হচ্ছে এর মধ্যেও কিছু চালাকি আছে। যাইহোক, কালকে নির্বাচনে যেন এইসব উট’কো ঝামে’লা না আসে সেদিকে খেয়াল রাখো হেলাল। মোহনকে বলো সবকিছু যেন ঠিক থাকে।আর লা’শটাকে বস্তা বেঁধে নদীতে ভাসিয়ে দেও। জুবায়ের,
—জ্বী স্যার।
—চলো বের হব আমরা।
—ওকেহ স্যার।
সাফিন বন্দুকটা পকেটে ঢোকাতে নিতে ফোনটা বেজে উঠলে ফোনের স্ক্রিনে আম্মা নামটা ভেসে উঠতে ফোনটা রিসিভ করতে ওপাশ থেকে উদ্বী’গ্ন কন্ঠ ভেসে আসলো।
—সাফিন তোর নানু অসুস্থ হয়ে পরেছে রে। বিয়ে বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই কেমন জেনো করছেন৷ দ্রুত বাড়িতে আস বাবা।
সাফিন রাগ এবং চিন্তায় মিশ্রিত কন্ঠে বললো।
—নিশ্চিই বিয়ে বাড়ির ওই হাবিজা’বি জিনিস খেয়েছে? নানু কেন ভুলে যান উনি সুগারের রোগী! মেজা’জ খারাপ করে৷ এখনই আসছি আমি৷ আব্বা কই আছেন ওখানে?
আমেনা বেগম ধীর কন্ঠে বললেন৷
—তোর বাপ আর চাচ্চুতো বাড়িতেই আসেন নাই। দুজনে কই গেছেন কে জানে৷ ফোনটাও আমার কাছে দিয়ে গেছেন। কালকে নির্বাচন সেই নিয়ে পরে আছে সে। মানুষ যে একটু ফোন করে খোঁজ খবর নিবে তাঁরও কোনো জো রাখে নাই৷
সাফিন গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলে জুবায়ের গাড়ি স্টার্ট দিল৷ সাফিন সেদিকে ধীর চাহনিতে তাকিয়ে আমেনা বেগমের উদ্দেশ্যে বললো।
—ডক্টরকে কল করেছো তো নাকি?
—হুম মোহন করেছে এসে পরবে এখনই। তুইও আস। আমার মাথা কাজ করছে না এখন।
—আচ্ছা টেনশন করো না বেশি আসতাছি আমি।
–হ দ্রুত আয়।
আমেনা বেগম ফোন কেঁ’টে দিতে সাফিন দুইহাতে মাথা চে’পে ধরে গাড়ির সঙ্গে সমস্ত শরীর এলিয়ে দিল। আজ বড্ড ক্লা’ন্ত লাগছে নিজেকে তাঁর।
.
বাড়ি থেকে দশ মিনিটের দূরত্বে থাকা জিলাপির দোকানটার সামনে তোহা সিএনজি থামাতে বললে সিরাত হাসলো৷ তোহা বললো।
—তুই বসবি নাকি নামবি। চল একসাথেই দুজন মিলে কিনে আনি।
—আচ্ছা জান। উম্মাহ, চল টেষ্টও করা যাবে।
ছাতাটা খুলে তোহা বেড়িয়ে পরে সিরাতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে সিরাতও নেমে পরলো। রিমিঝিমে শ্রাবন সন্ধ্যাময় পরিবেশে গরম-গরম জিলাপি খাওয়ার মজাই আলাদা।
—মামা জিলাপি দেন তো আধা কেজি।
দোকানদার তোহার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো।
—আচ্ছা আম্মা দিতাছি। খেয়েও যাও এখান থেকে ভালো লাগবে।
—আচ্ছা দেন দুই প্রিস।
.
কালো রাঙা গাড়িটা সিরাতদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গাড়ির কাঁচ সরিয়ে দূর থেকে বন্দুক তাক করতে পিছনের সিটে বসে থাকা কালো রাঙা জ্যাকেট পরিহিত মুখ ঢাকা লোকটা গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন।
— নীল শাড়ি পরে আছে মেয়েটা৷ স্যুট হিম।
সামনে থাকা লোকটা পিছনের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বললো।
—স্যার দুজনই নীল শাড়ি পরে আছে তো। কিভাবে বুঝব।
পিছনে থাকা লোকটা গলায় ঝোলানো দূর্বিনটা সিরাতদের দিকে তাক করে হেসে বললো।
—ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। এই ঝমঝমে গর্জ’ন মূখর পরিবেশে গু’লির শব্দ আশা করি কারো দৃষ্টিগোচর হবে না। দ্রুত কাজ সারো।
সামনে থাকা লোকটা মাথা ঝাকিয়ে বন্দুকটা সিরাতের দিকে তাক করে স্যুট করতে নিতে তোহা দোকানদারের থেকে জিলাপির প্রিসটা নিয়ে সিরাতের দিকে দিতে যেতে হুট করে গাড়িটার দিকে চোখ যেতে সিরাত বলে চিৎ’কার করে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজে সরে যাওয়ার আগেই গু’লিটা তোহার পেটের বাম পাশে লাগলে ঝমঝমে বৃষ্টির পানির সঙ্গে তোহার শরীরের র’ক্তের অশ্রুস্নিগ্ধ পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। পা ঢলে রাস্তায় পরে গেল তোহা। আকস্মিক ঘটনায় সিরাত পুরো তব্দা খেয়ে গেল। তোহার দিকে চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে ভয়ে কয়েকটা ঢোক গিলল সঙ্গে- সঙ্গে। ছাতা ফেলে দিয়ে রাস্তায় বসে পরে তোহার নিস্তে’জ হয়ে থাকা শরীরটা নিজের কোলে নিয়ে আঁকড়ে ধরলো তাঁকে। চোখ বেয়ে অজস্র কান্নার রাশি ছেঁয়ে গেলে গলা শুকিয়ে এলো তাঁর।
চারপাশে তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেও যখন কাউকে দেখতে পেলনা তখন ডু’করে কেঁদে উঠলো সিরাত। সিএনজির লোকসহ দোকানের ভিতরে থাকা সবাই বেড়িয়ে এসে তাঁদের দিকে তাকিয়ে। হুট করে ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে যাওয়ায় সবাই পুরো শ’ক খেয়ে গেছে। কেউ-কেউ রাস্তার অপর প্রান্তে দৌঁড়ে গিয়ে কাউকে দেখতে পায় কিনা সেদিকে ছুঁটলো। সিরাতের রু’হু নিস্তে’জ হয়ে গেছে যেন। শরীর বেয়ে বৃষ্টির রেশ চুল থেকে সমস্ত শরীরে ছুঁয়িয়ে দিচ্ছে যেন।
হৈচৈ লেগে গেল ওখানে। কালকে নির্বাচনের কারনে এমনিতেই পরিবেশটা গরম ছিল। এই ঘটনায় যেন লোকজন আরও অবাক হয়ে গেল।
—আপা এনাকে হাসপাতালে নিতে হবে জলদি। আপনে সিএনজিতে উঠে বসুন এভাবে কান্নাকাটি করে কিচ্ছু হবে না। আল্লাহ জানে কোন হা’রা’মি এমনটা করেছে। তারাতাড়ি উঠে বসুন এটা পুলিশ কেস হলেও ওই আপাকে এখন বাঁচানোটা জরুরি।
সিরাতের হুঁশ ফিরতে কান্নায় ভে’ঙে পরলো সে। মা-বাবার পরে এই তোহাই তাকে আগলে রেখেছে। আর আজ তোহারও এই অবস্থা হয়ে গেল। চোখের পানি বাঁধ মানছে না সিরাতের। তোহাকে বুকে জড়িয়ে নিজে একা ওঠাতে নিতে দোকানদার সহ সিএনজির লোকটা হাতে হাত লাগিয়ে সিএনজিতে উঠিয়ে দিলে লোকটা দ্রুত সিএনজি ছেড়ে দিল। দোকানদার সিএনজির দিকে ধীর চাহনিতে তাকিয়ে আশেপাশে থাকা লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন।
—কখন কি হয়ে যায় আল্লাহই ভালো জানেন। আল্লাহ যেন মেয়েটাকে রক্ষা করে।
.
বাড়িতে এসে সোজা নানুর রুমে চলে গেল সাফিন।
আজাদ সাহেব জোড়ে-জোড়ে শ্বাস টানছেন শুধু।
সাফিন ডক্টরের দিকে তাকাতে তিনি বললেন।
— মসলা জাতীয় খাবার খেয়ে ফেলেছেন বেশি। মেডিসিন দিয়ে দিয়েছি ঠিক হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ।
আমেনা বেগম শশুরের পায়ে তেল মালিশ করতে থাকলেন। সাফিন আজাদ সাহেবের পাশে টুল টেনে বসে মাথায় হাত রাখতে আদাজ সাহেব পিটপিট করে তাকালেন তাঁর দিকে। সাফিন রাগ নিয়ে বললো।
—কতবার বলেছি হাবিজা’বি খাবার খাবে না। কথা শুনো না কোনো! এবার ক’ষ্টটা তো সেই তুমিই পাচ্ছো নাকি?
আজাদ সাহেব হেসে উঠলেন। মৃদুস্বরে বললেন।
—কিচ্ছু হবে না আমার। তোর বিয়ে না দেখে আমি ম’রছি না আপাদত।
সাফিন বিরক্ত হলো। বললো।
—চুপ থাকো তুমি। রেস্ট নেও এখন।
আজাদ সাহেব সাফিনের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে শীতল কন্ঠে বললেন।
—বিয়েটা কর সাফিন। আমি আজ আছি কাল তে নাও থাকতে পারি। ম’রে গেলেও নাতিবউ না দেখার ক’ষ্টটা এই বুড়োটার বুকে রয়ে যাবে কিন্তু।
আজাদ সাহেব কেঁদে উঠলে সাফিন গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
—খুব শিঘ্রই বিয়ে করছি। তুমি রেস্ট নেও।
আজাদ সাহেব হেসে চোখ বুজলেন।
সাফিন রুম থেকে বেড়োতে নিতে জুবায়ের হন্তদন্ত হয়ে তাঁর কাছে আসলে সাফিন ভ্রু জাগিয়ে তাকালো তাঁর দিকে। বললো।
—কি হয়েছে হাঁ’পাচ্ছো কেন তুমি?
—সর্ব’নাশ হয়ে গেছে স্যার। মাএ খবর পেলাম বাসের ওই মেয়েটার গু’লি লেগেছে নাকি। মোহন ফোন করে জানালো আমাকে। ও বাজার থেকে শুনেছে নাকি।
সাফিনের মুখশ্রী হুট করেই কালো মেঘে ছেঁয়ে গেল।
দ্রুত দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে আমেনা বেগম পিছু ডাকলেও উওর না দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরলে জুবায়েরও সাফিনের পিছনে গাড়ি নিয়ে ছুটলো।
.
হাসপাতালের সাদা রাঙা ফ্লোরে হাঁটু ভাজ করে দুই হাত দিয়ে নিজের পা আঁকড়ে ধরে কাঁদছে সিরাত। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে তোহার এই অবস্থা হয়েছে এটা ভাবতেই আরও কান্না চলে আসছে তাঁর। ভেজা শরীরে ঠান্ডায় রীতিমতো কাঁ’পছে সে। সমস্ত শরীরে তোহার র’ক্তে ছেঁয়ে আছে তাঁর। আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে তোহাকে।
নার্স এসে সিরাতের দিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললো।
—এটাতো পুলিশ কেস।তবুও পেসেন্টকে বাঁচানো জরুরি বলে রি’ক্স নিয়েছে ডক্টর। আপনি পেসেন্টের কে হন এখানে সাইন করুন।
সিরাত ধীর পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে কাগজটা হাতে নিয়ে কাঁ’পতে থাকলো সে।
কিছু একটা ভেবে বোন লিখে সাইন করে দিলে নার্সটা কাগজটাতে এক পলক চোখ বু’লিয়ে বললেন।
—বোন হন। আচ্ছা ইমিডিয়েটলি কিছু পেমেন্ট করে আসুন। আসছি আমি।বেশি চিন্তা করিয়েন না। ইনশাআল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে আপনার বোন।
নার্সটা চলে যেতে কেঁদে উঠলো সিরাত৷ দীর্ঘশ্বা’স ছাড়া কিছুই আসছে না তাঁর। শহরের কোনো কিছুই তেমন চিনে না সে। একবার তোহার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে ফোনটা বের করতে তোহার বাড়িতে ফোন দিবে ভেবেও থেমে গেলে এবার ফোনটা নিজেই বেজে উঠলে জুলিয়া লেখা আছে তাই মুখ চে’পে রিসিভ করতে ওপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠের রেশ শোনা গেল।
—আপা আমি না পরীক্ষায় এ+ পেয়েছি। এবার কিন্তু আমাকে মোবাইল ঘড়ি কিনে দিতে হবেই হবে।
থ’মকে গেল সিরাত৷ চোখ বেয়ে অনবরত পানি ঝড়ে পরলে আর কথা বলতে পারলো না সে। ফোনটা কে’টে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকলে কারো হাতের স্পর্শ মাথার উপরে অনুভব করতে মাথা তুলে তাকিয়ে সাফিনকে দেখে কোনোকিছু না ভেবেই ঝা’পিয়ে পরলো তাঁর বুকে। বুকের ভিতর অজস্র যন্ত্র’ণায় ছেঁয়ে গেছে সিরাতের৷ ভারি হয়ে আশা কান্নাগুলো সাফিনের বুকে ঝড়িয়ে দিতে থাকলো সে। সাফিনের শার্ট ভিজে উঠলে সাফিন ধীর চাহনিতে সিরাতের দিকে তাকিয়ে সিরাতের কান্নাভেজা মুখশ্রী বুক থেকে তুলে দুইগালে তাঁর শীতল হাতের স্পর্শ ছোঁয়াতে সিরাত সাফিনের দিকে তাকালো।
চোখ লাল হয়ে আছে তাঁর। সাফিন সিরাতের কপালে চুমু খেয়ে আবারও বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত ছুঁয়িয়ে দিয়ে ধীর কন্ঠে বললো।
—সব ঠিক হয়ে যাবে জান।
সাফিনের কথাটা শান্তনা দেওয়া হলেও এই মূহুর্তে সাফিনকেই বটগাছের ছাঁয়া ভেবে আঁ’কড়ে রাখলো সিরাত।
.
ভোর হওয়ার মৃদু আলো এসে চোখেমুখে ছেয়ে যেতে ঘুম ভে’ঙে গেল সিরাতের। সাফিন তাঁকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে আছে তাঁর বুকে।
আজ আর রাগের মুডে নেই সিরাত। ধীর চাহনিতে হাসপালে পরখ করলে সাফিনের চোখ আপনা-আপনি খুলে গেল।
সিরাতের দিকে মৃদু হেসে মাথায় হাত রেখে বললো।
—চলো বাসায় চলো এখন তুমি। তোহা ঠিক আছে। খেয়ে আসবে কিছু তুমি। সারারাততো কিছু খাওয়া হয়নি তোমার।
সিরাত মৃদুস্বরে বললো।
—ওকে দেখতে চাই।
—উমম, আচ্ছা চলো।
হাসপাতালের বেডের উপর শুয়ে আছে তোহা। এখনও জ্ঞান ফিরেনি তাঁর। বাহির থেকে এক নজর দেখে কেঁদে উঠতে সাফিন রাগ নিয়ে বললো।
— তোমার ন্যা’কা কান্না থামাওতো সিরাত। এতে ও আরও অসুস্থ বোধ করবে। সিরাত সাফিনের দিকে তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
— আপনার বা’জে বকা থামান।
সাফিন হাসলো। বললো।
—এখন আমার সাথে বাড়ি যাবে তুমি। দেন ফ্রেশ হয়ে আসবে। ভেজা শরীরে সারারাত জ্বরে কেঁ’পেছো তুমি। এখনই না গেলে হাত পা বেঁধে নিয়ে যেতে বাধ্য হব আমি।
— পেমেন্ট দেওয়া হয়নি এখনও।
—ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না চলো এখন।
—মানে?
—মানে কিছু না চলো এখন তুমি।
সিরাত আর কথা বাড়াল না। সত্যিই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে তাঁর।
.
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামাতে সিরাত নেমে পরলে কয়েকজন লোক সিরাতের দিকে এগিয়ে এসে ধীর কন্ঠে বললো।
— এটা মিস তোহার বাড়ি না?
সিরাত খানিকটা অবাক হয়ে বললো।
—হ্যা আমি ওর বোন।
লোকটা খানিক ভ্রু জাগিয়ে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল সিরাতের হাতে। বললো।
—পাঁচ দিনের ভিতরে এডভান্স ১০ লাক টাকা জমা না দিলে আপনাদের নামে মামলা দেওয়া হবে। আপনার বোন ২৫ লাক টাকা লোন নিয়েছিলেন ব্রাক অপিস থেকে। গত কয়েকমাস ধরে তাঁর কোনো খবরই নেই। এমন হলে তো আর চলে না। তাই খবরটা দিয়ে গেলাম।
সিরাত অবাক হয়ে গিয়ে লেকগুলোর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলে সাফিন ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো তাঁর দিকে।
এক নজর কাগজটার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো।
— আমি তোমাকে ২৫ লাখ কেন পুরো ১ কোটি দেব সিরাত। শুধু শর্ত একটাই আমাকে বিয়ে করতে হবে…..
চলবে……