#হৃদয়_গহীনে_তুমি_আছো।🦋
#লেখনীতে_ফাতিমা_তুয_যোহরা।
#পর্বঃ১৪
দীগন্তের কোল ঘেঁষে মেঘাচ্ছন্ন প্রহরটা আজ বারংবার বৃষ্টির আগমনের ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে যেন। গাড়ির কাঁচ ভেদ করে হীমেল হাওয়ার উ’ষ্ণতা যেন সমস্ত শরীরে কাঁ’পুনি ধরিয়ে দিচ্ছে সিরাতের। সাফিন ড্রাইভিং করতে-করতে আর চোখে সিরাতের থ’মথ’মে মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আবার ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিল৷
— বাড়িতে কে দেখবে এখন তোহাকে? না মানে, এতদিন তো হাসপাতালে ছিল প্রবলেম হয়নি। কিন্তু এখনতো বাড়িতে থাকছে তাইনা। এখন কে দেখবে ওকে?
সিরাতের চিন্তিত মুখদ্বয় দেখে সাফিন ধীর চাহনিতে সিরাতের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হেসে বললো।
—কেয়ারিং বউ আমার৷ এমন কেয়ার তো আমাকেও একটু আথটু দেখাতে পারো নাকি?
বিরক্ত হলো সিরাত। কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বললো।
— আপনার বা’জে বকা থামান তো। আগে কাজের কথা বলুন?
হাসলো সাফিন। ধীর কন্ঠে বললো।
— টেনশন নিও না জানস। আমি আছি তো নাকি?
—সেটাই তো টেনশনের কারন।
—কিছু বললে?
মৃদু হাসার চেষ্টা করলো সিরাত। ধীর কন্ঠে সাফিনের দিকে তাকিয়ে বললো।
—কই কিছু না তো? আপনি ড্রাইভিংএ ফোকাস করুন।
—হুম।
.
সিরাতদের বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা সাইড করে দাঁড়িয়ে যেতে সিরাত চটজলদি গাড়ি থেকে নেমে পরলে হাসলো সাফিন৷ গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
— ধীরেসুস্থে যাও সিরাত! মনে হচ্ছে এক যুগ পর বান্ধবীকে দেখতে এসেছো।
সাফিনের কথা কানের চারপাশেও না নিয়ে দরজায় কলিং বেল ক্লিক করতে না করতেই জুবায়ের দরজা খুলে দিতে অবাক হলো সিরাত। জুবায়েরের দিকে চ’মকে তাকালে জুবায়ের হেসে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাফিনের উদ্দেশ্যে বললো।
— স্যার তিনজন মেড ঠিক করে দিয়েছি আপাদত। ব্রাক অফিস থেকে কোলে করে নিয়ে এসেছি ম্যামকে। বিছানা থেকে উঠতে দেইনি একদম।
সাফিন হাসলো। বললো।
— গুড জব জুবায়ের৷
হাসেলো জুবায়ের। সিরাত সাফিনের কথাগুলো শুনে সাফিনের দিকে হা হয়ে তাকাতে সাফিন গাড়িটা লক করে সিরাতের দিকে এগিয়ে এসে খানিকটা ঝুঁ’কে সিরাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে শীতল কন্ঠে বলতে থাকলো।
— বউকে খুশি করার জন্য শাহনেওয়াজ সাফিন সবকিছু করতে পারে বুঝলে সিরাত। এখন চলো ভিতরে আমার বউয়ের ভালোবাসার অর্থেক ভাগিদারকে দেখে আসি।
—হিংসে হচ্ছে স্যার আপনার?
জুবায়েরের কথা শুনে হেসে উঠলো সাফিন৷ জুবায়েরকে চোখ মেরে ধীর চাহনিতে সিরাতের দিকে তাকিয়ে বললো।
—বলার বাহিরে। যেখানে শাহনেওয়াজ সাফিন কোনোদিন তাঁর কোনো জিনিসের চুল পরিমান ভাগও কাউকে দেয়নি, সেখানে বউয়ের ভালোবাসা ভাগ করতে হচ্ছে! হিংসে তো হবেই তাইনা।
সাফিনের কথার পাত্তা না দিয়ে সিরাত ভিতরে চলে গেলে জুবায়ের হেসে উঠলো। বললো।
—ম্যাম রেগে গেছেন মনে হচ্ছে।
সাফিন জুবায়েরের কাঁধে হাত রেখে হেসে বললো।
—রাগলে অবশ্য ম’ন্দ লাগে না তোমার ম্যামকে।
সাফিনের কথা শুনে হাসলো জুবায়ের।
.
না চাইতেও জোরপূর্বক তোহাকে বিছানায় শুয়িয়ে রাখাতে রাগে মুখ ভার করে শুয়ে রয়েছে তোহা।
সিরাত তোহার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাতে থাকা ব্যাগটা টি টেবিলের উপরে রেখে মরা টেনে বিছানার পাশে বসলে তোহা খুশিতে দ্রুত উঠতে নিতে চোখ রাঙাল সিরাত। রাগ নিয়ে বললো।
—শুয়ে থাক এখানে। বেশি পা’কনা’মি করতে হবে না তোর৷ তুই জানিস হাসপাতালে তোকে খুঁজতে-খুঁজতে পাগ’ল হয়ে গেছি আমি। ফারদার এমন কখনো যদি করিস না তাহলে হাত-পা ভে’ঙে বিছানায় শুয়িয়ে রাখব বলে রাখলো সিরাত।
হেসে উঠলো তোহা৷ বললো।
— ওরে আমার আম্মা। বিয়ে করে পুরো নানিদের মতো জ্ঞান দেওয়া শিখে গেছিস দেখছি। এগুলো আগে আমি তোকে বলতাম। আর আজ তুই উল্টো আমাকে বলছিস।
—দেখতে হবে না বউটা কার।
দরজার কাছে হেলান দিয়ে সাফিন বাঁকা হাসি হেসে কথাটা বললে হেসে উঠলো তোহা। সিরাত সাফিনের দিকে রাগ নিয়ে চোখ গরম করে তাকালে সাফিন সিরাতকে চোখ মেরে ভিতরে এসে চেয়ার টেনে পায়ের উপর পা রেখে বসে পরলে জুবায়েরের উদ্দেশ্যে বললো।
—জুবায়ের টিভিটা অন করোতো।
— জ্বী স্যার করছি।
টিভিটা অন করে দিতেই মেয়েলি কন্ঠের নিউজটা কানের কাছে এসে বা’রি খেয়ে গেল যেন সাফিনের।
— পুলিশ কাস্টারিতে থাকা কালীন সময়ে পুলিশের অগোচরে থানায় বসে খু’ন হয় মিস্টার মিরাজ চৌধুরী। ঘটনাক্রমে মৃ’ত্যুর আগে তাঁর রেখে যাওয়া বয়ান অনুযায়ী জানা গেছে, গত সাতদিন আগে মুশলধারা ঝড় বৃষ্টির মধ্যে সমুদ্রের বীচ থেকে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে ক্যামেরা দিয়ে পিক তোলার সময় তাঁর ক্যামেরাতে ভেসে ওঠে এক নি’র্ম’ম ঘটনা। চার-পাঁচ জন লোক মিলে একটা ভাড়ি বস্তা সমুদ্রের অতল ঢেউয়ের সাথে ভাসিয়ে দিতে দেখে মিরাজ চৌধুরী সাথে-সাথে পুলিশের সাথে কনট্যাক্ট করেন৷ তুমুল বৃষ্টির কারনে লোকগুলোর চেহারা স্পষ্ট ভাবে ক্যামেরায় ধরা পরেনি৷পুলিশ সেখানে গেলে ঝর বৃষ্টির মধ্যে তুফা’নের গতি কমলে অনেক খোঁজা-খুঁজির পর বস্তাটা পেলে সেখান থেকে বের হয় একটা গোটা লা’শ। যেটাকে কেঁ’টে টুকরো-টুকরো করা হয়েছে নি’র্ম’ম ভাবে। ঘটনাক্রমে বস্তার ভিতর থেকে তাঁর আইডেন্টি কার্ড পাওয়া গেলেও সমুদ্রের পানিতে ভেজার কারনে সেটা পুরো ন’ষ্ট হয়ে গেছে। শুধু আ’ব’ছা-আ’বছা ভাবে দেখে জানা গেছে লেকটার নাম দুলাল। পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে এই দুটো খু’নের আসা’মিকে খুঁজে বের করার। থানায় বসে মিরাজ চৌধুরী খু’ন হওয়ার কারনে যথাসম্ভব জবাবদিহি করতে হবে অন ডিউটি পুলিশ অফিসারদের। আজকের মতো এখানেই খবর শেষ। পরবর্তী খবর পেতে চোখ রাখুন মাইটিভি চ্যানেল ঢাকা।
জুবায়ের টিভিটা অফ করে দিলে সাফিন ভ্রু কি’ঞ্চিৎ ভাঁ’জ করে ফেলল। দুলাল নামটা কেমন শোনা-শোনা ঠেকছে তাঁর কাছে। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না এখন। একে বলে অতি টেনশনে মাথা কাজ না করা। সিরাত কয়েকটা ঢোক গি’লে তোহার হাতটা চে’পে ধরে ভয়ের কন্ঠে বললো।
— আমার এখন খুব ভয় হচ্ছে। শহরের অবস্থা ঠিক লাগছে না তেমন। আমাকে কে মা’রা’র চেষ্টা করছে সেটাও তো এখনও বুঝতে পারছি না। কারন আমার জানামতে শহরে কেউই আমাকে তেমন চিনে না। তাঁর উপর গ্রাম থেকে মামা-মামী যে এখানে আসবেন সেটাওতো সম্ভব নয়। কারন আমি চলে এসেছি যখন জায়গা- সম্পত্তি তো এখন তাঁদের দ’খলেই চলে গেছে তাইনা। আর তাঁরাই বা খামখা আমাকে মা’রার চে’ষ্টা কেন করতে যাবেন।
সিরাতের ভয়ার্ত কন্ঠ শুনে সাফিনের তিরিক্ষি চোখদ্বয় সিরাতের দিকে থ’মকে গেলে গম্ভির কন্ঠে বললো সাফিন।
—যতদিন এই শাহনেওয়াজ সাফিনের গাঁয়ে বিন্দুমাত্র র’ক্ত অবশিষ্ট আছে সিরাত? ততদিন তোমার গাঁয়ে কেউ আঁ’চও ফেলতে পারবে না। সে আমি তোমার কাছে থাকি বা না থাকি।জুবায়ের?
—জ্বী স্যার?
— চলো আমরা একটু বাহির থেকে ঘুরে আসি।
জুবায়ের গাড়ির চাবিটা বের করে হাতে নিয়ে বললো।
—ওকে স্যার চলুন।
সাফিন বাঁকা হাসি হেসে সিরাতের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বললো।
—দুই বান্ধবী থাকো তাহলে। যাওয়ার সময় এখান থেকে নিয়ে যাব তোমাকে।
সিরাত মৃদু চুপ হয়ে গেল। তোহার দিকে তাকাতে তোহা হাসলো। সাফিন চলে যেতে নিতে সিরাত বাঁ’ধ সেধে বললো।
—শুনুন?
সিরাতের মৃদুস্বরের রেশ কান ছুঁয়ে স্পর্শ করে গেলে থ’মকে গেল সাফিন। মাথা চুলকে পিছু ফিরে বাঁকা হাসি হেসে সিরাতকে রাগানোর জন্য বললো।
—উফ সিরাত, এবার নিশ্চয়ই বলবে যেও না জান।তোমাকে ছাড়া আমার ভালো লাগেনা। আহা।
সিরাত রাগ নিয়ে শ্বাস ছেড়ে বললো।
—সাবধানে যাবেন। আরকিছু না। বিদায় হ শ’য়’তা’ন এখান থেকে।
সাফিন হা হয়ে গেল সিরাতের কথা শুনে। গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
— এখন কিছু বলছি না সিরাত তোমাকে। পরে এর ম’জা ঠিকই বোঝাব তোমাকে।
— হেহ আইসে, আমিও দেখবনে কি দেখাবেন আমাকে। ব’জ্জা’ত লোক একটা। (মনে-মনে কথাগুলো বলে বিরক্তির নিশ্বাস ছাড়ল সিরাত।)
.
সারাদিনের ঝিম মেরে থাকা শান্ত আবহাওয়ার রেশ কাঁ’টিয়ে বিকেলের দিকে নামলো ঝুম বর্ষন। টিনের চালের উপর বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজের সহিত কালো রাঙা এলোমেলো মেঘদ্বয় থেকে ক্ষনে- ক্ষনে গর্জ’নপাত হয়ে ধরনীতে এসে বা’রি খেয়ে যাচ্ছে যেন।
বৃষ্টি ভেজা জানালাগুলো আঁ’টকে দিতে ব্যাস্ত হয়ে পরলো সিরাত।
তোহা বিছানা ছেড়ে উঠতে নিতে একজন মেড তাঁকে বাঁ’ধ সাধলে বিরক্ত হলো তোহা। বললো।
— আরে ধুর, এভাবে কতক্ষণ শুয়ে-বসে থাকা যায়! সিরাত? জান তুই কিছু বলবি তো নাকি?
হাসলো সিরাত। বললো।
—চুপচাপ ওখানে শুয়ে থাক তুই। আমি তোর পছন্দের খাবার রান্না করছি।
নিরা’শ হলো তোহা। অভিমানের স্বরে বললো।
— দোস্ত তুইও! যা কথাই বলব না কারো সাথে।
তোহার কন্ঠ শুনে হাসলো সিরাত৷ মাঝারি সাইজের ড্রাম থেকে খিচুড়ির চাল আর মুগডাল বের করতে-করতে বললো।
— জান শোন?
তোহা টি টেবিলের উপর থেকে কমলা নিয়ে ছা’ড়িয়ে খেতে-খেতে বললো।
—হুম বল। আমি আসি ওখানে?
—একদম না। ওখানে শুয়ে থাক একটু পরে বলছি। এখন কাজ করছি।
সিরাত বেসিংএ চাল>ডালগুলো ভালো ভাবে ধুতে থাকলে একজন মেড সিরাতের হাত থেকে কুকারটা নিতে যেয়ে বললেন।
—ম্যাম আমাকে দিন আমি করে দিচ্ছি।
হাসলো সিরাত৷ মেয়েটা তাঁর থেকে দু-এক বছের ছোট হবে হয়তো৷ সাদা রাঙা মেডের ড্রেস পরিহিত শ্যামা রাঙা চেহারায় ধোঁয়াসা চোখগুলো নিয়ে সিরাতের দিকে হেসে তাকিয়ে মেয়েটা। ঠোঁটের কোনে আপনা-আপনি হাসির রেখা ফুটে উঠলো সিরাতের। ধীর চাহনিতে তোহার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো।
—আমার জান আমার হাতের বানানো খিচুড়ি খুব পছন্দ করে। আজকে নাহয় আমি করি এরপর থেকে তো আপনারাই করবেন তাইনা।
মেয়েটা হেসে বললো।
—আচ্ছা তাহলে আমি ঘড়টাকে পরিষ্কার করে দিচ্ছি ম্যাম। মেয়েটা চলে যেতে নিতে সিরাত পিছু ডেকে বললো।
—নাম কি তোমার? সরি তুমি বলে ফেললাম আপনাকে।
মেয়েটা একগাল হাসলে চোখগুলোও যেন হেসে উঠলো মেয়েটার। এই প্রথম কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে এত ভালো লাগছে সিরাতের।
—তামান্না ম্যাম। আপনি আমাকে তুমি করেই বলুন। তাহলে একটা আলাদা আপন-আপন মনে হয় নিজেকে।
হাসলো সিরাত। চালগুলোতে পানি অবস্থায় রেখে আঁচলে হাত মুছে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটাকে। ধীর কন্ঠে বললো।
— তোমরা যে তিনজন আছো এখানে, এইসব ম্যাম-ট্যা’ম বলতে হবে না আমাদের।সোজা আপা বলে ডাকবে। মনে করবে আমরা পাঁচ বোন একসাথে থাকছি এখানে। তামান্না হাসলো। চোখে পানি এসে ভর করলো যেন৷ এতবছরের কাজের মধ্যে এই প্রথম কেউ এভাবে কথা বলছে তাঁদের সাথে।
—আরে বোকা মেয়ে। আবার কাঁদে! আর একবার কাঁদতে দেখলে কড়া বকুনি দেব আমি। ওদের দুজনের নাম কি?
— সেফা আর নাহিদা।
হাসলো সিরাত। চালগুলো ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ে রান্নাঘরে ছুটলো সে। পিছু ফিরে বলে গেল।
তামান্না ফ্রিজে উপরের বক্সে কাঁচা মরিচ আছে ওখান থেকে নিয়ে আসো তো তিন চারটা৷ আর সেফাকে বলো নিচের বক্স থেকে মাং’স বের করে ফিজিয়ে রাখতে।
—আচ্ছা আপা। সিরাত হেসে কাজে মন দিল।
তোহা মুখ বেঁ’কিয়ে বললো।
— হ তোরাই সব কাজ করে উদ্ধার করে দে আমাকে। আর আমি সারাদিন এখানে শুয়ে-বসে থাকি।
— আহা সোনা। তোমার ক’ষ্ট আমার চোখে সই’তেছে না জান।
— মার খাবি সিরাত। আমার কি এমন হয়েছে যে এত ধরে বেঁ’ধে রাখতে হবে আমাকে! হাসপাতাল থেকেতো দিব্য ব্রাক অফিস পর্যন্ত গেছিলাম। তখন তো কিছু হয়নি? তোহার কথা শুনে সিরাতের মাথায় ঘোরপাক খেয়ে গেল যেন। এই বিষয়ে কথা বলার জন্যই এতক্ষণ হাস’পা’স করছিল সে। খিচুড়ি চরিয়ে দিয়ে কোমরে আঁচল গুঁ’জে তোহার দিকে এগিয়ে আসলে নাহিদা রান্না ঘরে চলে গেল।
“বিছানার পাশে তোহার মাথার কাছে বসে তোহার মাথায় শীতল হাতের স্পর্শ ছুঁয়িয়ে দিয়ে ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
—একটা কথার ঠিকঠাক উত্তর দিবি জান।
তোহা মাথার নিচ থেকে বালিশ সরিয়ে পিঠের নিচে বালিশ রেখে আধসোয়া হয়ে উঠে বসলে সিরাত তাঁকে উঠাতে হাতে হাত লাগাল।
মৃদু হাসলো তোহা৷ বিচক্ষণ ম’স্তিষ্ক বারংবার করা নেড়ে বোঝাতে চাইছে যে,সিরাত এই মূহুর্তে ঠিক কি জিজ্ঞেস করতে পারে? তাই নিজেই সিরাতের জড়’তা কাঁ’টাতে ধীর কন্ঠে বলতে থাকলো।
—আমাদের গ্রামের বাড়িটা তো দেখেছিস তুই।
সিরাত তাঁর শুঁ’কনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে ধীর কন্ঠে বললো।
— হুম দেখেছি।
তোহা মৃদু হাসলো। দৃষ্টিদ্বয় নিচু করে কয়েকটা ঢোক গি’লে ধীর কন্ঠে বললো।
— কিছু কথা চাইলেও কাউকে বলা যায় না জানিস। আমি অনেক আগেই তোকে বলতে চেয়েছি এই কথাগুলো। কিন্তু বিবেক, বাবার সম্মান, মায়ের চোখের জল বাঁ’ধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিটাখন। আর আজকে সিচুয়েশনটাই এমন যে,আমি তোকে না বলেও থাকতে পারছি না।
তোহা কেঁদে উঠলে সিরাত থ’ম মেরে গেল। এ যেন বিনাবাক্যে দুশ্চিন্তার আভাস। তোহাকে আস্থা যুগিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো সিরাত। গগনের গর্জ’নের প্রতিটা মূহুর্তের সাথে যেন তাঁর হৃৎস্পন্দনের গতিও কেঁ’পে উঠতে থাকলো বারংবার।
— স্কুল জীবনটা খুব ভালোভাবেই কাঁ’টছিল আমাদের। আমার আব্বা ছোটখাটো একটা ব্যাবসা করতেন বিদেশে। আমরা থাকতাম বাড়িতে। মাঝেমধ্যে ভিডিও কলে কথা হতো আব্বার সাথে। কখনো এমন কোনো ব্যাবহার করেননি আব্বা যাতে আমরা কোনো রকম ক’ষ্ট পাই৷ দিনকাল খুব ভালোই চলছিল।কিন্তু হঠাৎ এক বৃষ্টির রাতে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কাউকে না জানিয়েই বাড়িতে চলে আসলেন আব্বা। নে’শাগ্র’স্ত অবস্থায় ছিলেন তিনি। সেদিন রাতে আব্বাকে দেখে একটু অন্যরকমই ঠেকছিল আমার কাছে। ভয় পাচ্ছিলাম রীতিমতো তাঁকে দেখে। আম্মা কাছে গিয়ে আব্বার সাথে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিতে আব্বা আম্মাকে নিয়ে দরজা আঁ’টকে বিনা কারনেই প্রচুর পরিমানে মা’রধো’র করলেন। আমি তখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি কলেজে এডমিশন নেব। আব্বার এ রকম আচারন দেখে আমি আর জুলিয়া ভয়ে কেঁদেছি শুধু। দরজা ধাক্কিয়েছি কিন্তু দরজা খুলেননি আব্বা। দরজার ওপাশ থেকে আম্মা আর আব্বার কথা কাঁ’টা>কাঁ’টি আর আম্মার অঝরে কান্না শুনতে থাকলাম আর নিজেও প্রচুর কেঁদেছিলাম সেদিন। সকালে আম্মা রুম থেকে বের হতে চেনা যাচ্ছিল না তাঁকে। ফর্সা চেহারায় শক্ত হাতের মা’র কেমন শিরায়-শিরায় দা’গ পরে র’ক্ত জ’মাট বেঁ’ধে গেছে। জিজ্ঞেস করেছি আম্মাকে প্রচুর। কিন্তু আম্মা টু শব্দও করেনি কি হয়েছে। শুধু বলেছে তোর আব্বার বিদেশের চাকরিটা আর নেই। আমার ছোট মস্তি’ষ্কে এতকিছু কেমন খাপছাড়া ভাবে যাচ্ছিল যেন। দিনকেদিন আব্বার আম্মার প্রতি অ’ত্যা’চার বেড়ে গেল। আমি মাঝে মধ্যে বাঁ’ধা হয়ে দাঁড়ালে আমিও কম মা’র খাইনি আব্বার হাতে। মাঝরাতে ম’দ্যপান করে বিদঘুঁ’টে গন্ধ নিয়ে বাড়িতে ফিরতেন আব্বা। বাড়িতে বাজার হত না। আম্মা সেলাই মেশিন চালিয়ে যেটুকুওবা ডালেচালে চালাতে চাইতেন সেটাও আব্বা কেরে নিয়ে যেতেন ওইসব হাবিজা’বি কেনার জন্য। সাথে তাঁর অ’শা’লীন মুখের ভাষা ছারতেন। কান্না পেত খুব। আম্মা নিজে না খেয়ে জুলিয়া আর আমাকে খাওয়াতেন। রাত শেষে আব্বার সামনে ভাত বেড়ে দিলে আব্বা লা’থি দিয়ে ফেলে দিতেন। এদিকে সবাই কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে আর আমি এখনও কলেজে যেতেই পারিনি। আম্মাকে আঁচলে মুখ লুকিয়ে কান্না করতে দেখেতাম শুধু। কি নিপুন তাঁর মৃদু কান্নার স্বর। শুধু ভাবতাম, সুখের সংসারটার কি হয়ে গেল।
“টানা দুই সপ্তাহ আব্বা বাড়িতে এলেন না। আম্মার মুখে বিন্দুমাএ হাসি খুঁজে পেলাম না আমি।” একদিন খবর এলো আব্বা কোন দোকানদারকে নাকি দা দিয়ে কু’পিয়েছেন ওইসব আজে-বা’জে জিনিস টাকা ছাড়া দেয়নি বলে। লোকটা সেখানেই মা’রা গেছেন। আম্মা পরিপূর্ণ রুপে ভে’ঙে পরেছিলেন আমাদের দু বোনের কথা ভেবে। আব্বাকে পুলিশে এসে ধরে বেঁ’ধে নিয়ে গেলেন। উপর মহল থেকে ফাঁ’সির রায় দিয়ে দিলেন। আব্বার ফাঁ’সির রায় হওয়ার পরপরই কাগজ এসে হাজির হলো বাড়িতে৷ আব্বা বিদেশে যাওয়ার সময় ২৫ লাখ টাকা লোন নিয়েছিলেন তাঁর এক বন্ধুর থেকে৷ বিদেশ থেকে ফিরে দিয়ে দিবেন বলেছিলেন৷ এখন আব্বার ফাঁ’সির খবর শুনেই টাকা নিতে হাজির হলেন। বাড়ি ভাং’চুর করলেন। নয় তাঁরা বাড়ি নিবেন নয়তো তাঁদের টাকা কালকে সকালের মধ্যে সুদ সমেত ফেরত দিতে হবে। কাঁন্নাগুলো যেন দ’লা পা’কিয়ে যাচ্ছিল আমার৷ লোকমুখে শুনতে পারলাম আব্বা আম্মাকে পালিয়ে এনে বিয়ে করেছে বলে আম্মার বাড়ি থেকে কোনো টাকা পয়শা দেয়নি আব্বাকে তাঁর জন্য আম্মাকে এত মা’র>ধো’র করত আব্বা। মা’নসি’ক শান্তির থেকেও পাড়াপ্রতিবেশি যেন তাঁদের মুখের বলা কথা দিয়ে মস্তি’ষ্কে চাঁ’পের সৃষ্টি করতে থাকলো। আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আম্মা শহরে আসলেন আমাদের দুবোনকে না জানিয়ে৷ আশ্চর্য জনক হলেও আম্মার পরিবারের কোনো বান্দা আমাদের দিকে ফিরেও তাকান নি পর্যন্ত। আম্মা তাঁর বান্ধবীর সহায়তায় ব্রাক অফিস থেকে ৩০ লাখ টাকা লোন নিলেন। পরেরদিন টাকা নিতে হাজির হয়ে গেলে আমি আর জুলিয়া পুরো থ মেরে গেছিলাম আম্মা ছাড়া। বাড়ির ভিতরে ঢুকে নোং’রা ভাষায় গা’লি দিতে-দিতে যেটুকু রয়ে গেছে ভা’ঙার সেগুলোও ভা’ঙতে থাকলে কেঁদে উঠলাম আমি আর জুলিয়া। অনেকক্ষণ পর গাড়ি এসে বাড়ির সামনে দাঁড় হতে আম্মাকে দেখে হৃদয়ে পানি পরলো যেন। কান্নারত অবস্থায় দৌঁড়ে গিয়ে আম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম। আম্মাও কাঁদছেন। কালো রাঙা বোরকার মুখোশটা খুলে ব্যাগ থেকে টাকা থলেটা বের করে দিলে লোকগুলো হা হয়ে গেছিলেন আম্মার দিকে তাকিয়ে। আমিও কম অবাক হইনি সেদিন৷ এতগুলো টাকা আম্মা কোথায় পেলেন?
লোকগুলো চলে গেলে পাড়াপ্রতিবেশি এসে জমা হলে রাগ নিয়ে বলেছিলাম আমি।
— এখানে কোনো সার্কাস হচ্ছে না যে এত মনোযোগ সহকারে দেখতে হবে! জান এখান থেকে সবাই।
—বাপ আ’কাম কইরা বেড়াইবে আর মাইয়া বড় গলায় কতা কইবে৷ গলা নামাইয়া কতা ক মাইয়া৷ খু’নির মাইয়ার আবার কি দে’মাক।
সেদিন তাদের কথায় আ’ঘাত পেয়েছিলাম প্রচুর৷ কিন্তু আম্মা কান্নারত চোখে বারংবার বাঁধ সাধলেন বলে বলতে পারিনি কিছুই। আম্মা তাঁর সেলাই মেশিনের কাজটা চালিয়ে গেলেন।
কলেজে ভর্তি করে দিল আমাকে। সে নিয়েও অনেক কথা শুনতে হয়েছে লোকের। আম্মা বলতেন কারো কথায় কিছু যায় আসে না। উওর দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু আমার মন কেমন মানতে চাইতো না। দুই একটা উওর দিয়েই দিতাম৷ আম্মা সময় করে আব্বাকে দেখতে যেতেন জেলখানায়। কাঁদতেন প্রচুর। আব্বা তাঁর করা ভু’ল বুঝতে পারলেও ততদিতে সময়, পরিস্থিতি সবকিছুই পাল্টে গেছে।
কলেজে দেখা হলো তোর সাথে। ভালো বন্ধত্ব হলো। তোর সম্পর্কে সবকিছুই বললি তুই৷ কিন্তু আমি বলতে পারলাম না। যদি তুইও আব্বার কথা জেনে গেলে মুখ ফিরিয়ে নিস আমার থেকে। ভয় হত খুব। আস্তে-আস্তে বড় হলাম। কলেজের গন্ডি পেড়োলাম। ভালো রেজাল্ট হওয়ায় চাকরিও পেয়ে গেলাম এক টিচারের সহায়তায়। আম্মাকে আর সেলাই মেশিন চালাতে দিলাম না। শহরে চলে আসলাম। খবর এলো আব্বার ফাঁ’সি হয়ে গেছে। আম্মা সেদিন প্রচুর পরিমানে কেঁদেছেন৷ আব্বার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী আম্মা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আব্বাকে ফাঁ’সি হতে দেখেছেন। আম্মার ধৈর্য শক্তির কথা আগেই জানতাম আমি। কিন্তু এতটা আশা করিনি। আর তারপর জানতে পারলাম আম্মার নেওয়া লোনের কথা। যেটা প্রতিমাসে আম্মাকে একটু-একটু করে শোধ করতে হত৷ আর মাস দুয়েক ধরে দিতে না পারায় সুদ সমেত ২৫ লাখ টাকা এসে হাজির হলো আমার মাথায়। বিগত কয়েকমাস ধরে আম্মা অসুস্থতায় ভু’গছেন। তাঁর চিকিৎসা। বোনের পড়াশোনা। বাড়িতে টাকা পাঠানো,নিজের খাওয়া-দাওয়া লোন সামলানো যেন টা’ফ হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার কাছে। ভাবছি শুধু, আম্মা কিভাবে এতদিক সামলাতেন। তোহা অনবরত কাঁদতে থাকলে সিরাতের চোখের পানিও যেন বাঁধ মানতে চাইছে না। তোহাকে জড়িয়ে ধরে কান্নারত কন্ঠে বললো।
— তুই ভাবলি কিভাবে আমি তোর অতীত যেনে তোকে ছেড়ে যাব?এই তোর বিশ্বাস আমার প্রতি!
—মা’ফ করে দে জান। তখন কিছুই মাথায় আসছিল না আমার। আমি নিজেই খুব ডিপ্রেশনে ছিলাম।
সিরাত তোহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলে খিচুড়ির মিষ্টি সুগন্ধ নাকে এসে পৌঁছাতে কান্নারত অবস্থায় মৃদু হেসে তোহাকে ছেড়ে দিয়ে আঁচল দিয়ে তোহার চোখ মুছে দিয়ে হেসে বললো।
—তোর খিচুড়ি হয়ে গেছে বলে। দাঁড়া একটু দেখে আসি ওদিকে নাহিদা একা-একা কি করছে।
হাসলো তোহা। আজ যেন নিজেকে হালকা ঠেকছে মনের কথাগুলো সব উ’গরে দিতে পেরে।
.
রান্না ঘরে এসে নাহিদা একগাল হেসে বললো।
— খিচুড়ি হয়ে গেছে আপা। আমি শুধু একটু মরিচ কেঁ’টে দিয়ে নেড়েচেড়ে দিয়েছি। গন্ধটা কিন্তু সেই।
হাসলো সিরাত। সেফা মাং’সের বাটিটা এনে দিলে হলুদ-মরিচ মশলা পরিমাপ মতো দিয়ে ক’সাতে থাকলো। হুট করে কারেন্ট চলে গেলে তামান্না জেনারেটর অন করে দিয়ে চিংড়ি মাছ বা’টতে বসে পরলো। জেনারেটর দেখে অবাক হলো সিরাত। মনে-মনে ভাবলো এ নিশ্চই সাফিনের কাজ৷ মৃদু হেসে মাং’সে আরেকটু পানি দিয়ে ক’সাতে-ক’সাতে বললো।
— চিংড়ির ভর্তা বানাবে নাকি?
—হ আপা। বৃষ্টির মধ্যে এসব ভর্তার স্বাদটাই আলাদা। হাসলো সিরাত৷ বললো।
— আলু সেদ্ধ দিয়ে দি তাহলে। ফ্রিজে বাদাম খো’টা আছে ওগুলোও বে’টে ফেলো।
হাসলো তামান্না। বললো।
—আইছ্যা আপা।
.
বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজটা যেন গাঢ় থেকে গাঢ়তম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে সাফিনের কোনো খবর নেই। বিকেল গড়িয়ে রাত হতে চললো। অস’স্থি হচ্ছে যেন সিরাতের। ক্ষনে- ক্ষনে প্রবল বেগে গর্জ’নপাত হওয়াটা যেন আরও ভয়ের কারন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মাং’সের করাইটা সেদ্ধ হওয়ার জন্য বেশি করে পানি দিয়ে ঢকটা দিয়ে ঢেকে দিয়ে ধীর পায়ে এসে রান্না ঘরের জানালাটা খুলে দিতে হীমেল হাওয়ায় বৃষ্টির রেশ চোখে মুখে এসে ছেঁয়ে পরলো যেন সিরাতের। তাঁর চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। জানালার গ্রিলে হাত রেখে বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে যাওয়া রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছারল সে।
— এখনও আসছেন না কেন সাফিন…..
চলবে……