#হৃদয়_গহীনে_তুমি_আছো।🦋
#লেখনীতে_ফাতিমা_তুয_যোহরা।
#পর্বঃ ১
—কেমন আছো সিরাত?
ওপাশ থেকে গাম্ভীর্যপূর্ন শীতল কন্ঠের রেশ কানের কাছ ঘেঁষে বা’ড়ি খেয়ে খেলে থমকে গেল সিরাত। এত বছর পর নিজের প্রাক্তনের ফোনকল আশা করেনি সে। ঠিক প্রাক্তন নয়, কিন্তু আলাদা।
দাঁড়ানো থেকে পাশে থাকা বিছানায় পা ঢ’লে বসে পরলো সে।
সিরাতের ঘন হয়ে আসা নিশ্বাসের শিহরনময় আবেশে অপর প্রান্তের মানবটি খানিকটা বিভ্রা’ন্ত বোধ করলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু গলা খাঁ’কারি দিয়ে শীতল কন্ঠে বললো।
— আজকে সন্ধ্যা সারে সাতটায় তোমাদের বাড়ির সামনে যাব তোমাকে নিতে। রেডি থেকো।
সিরাতের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরাতে অপর প্রান্তের মানবটি স্থীর কন্ঠে বলে উঠলো।
—টেনশনের কোনো কারন নেই। টাকা পেয়ে যাবে। সো সুন্দর ভাবে আমার বউয়ের মতো রেডি থেকো।
হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে রা’গের কন্ঠে বলে উঠলো সিরাত।
—শুনুন আমি আপনার টাকার ধার ধারিনা। তাই ভদ্রভাবে কথা বলুন। আর শুনুন আমি কোথাও যাচ্ছি না ওকে। আমার কাজ ছিল এক বছর আপনার বউ হয়ে থাকা সেটা শেষ। আপনার নানুও আর নেই আমাদের সম্পর্কও আর নেই। আল্লাহ হাফেজ।
—বেশি বকছো। তুলে নিয়ে আসব বলে রাখলাম।
—আপনার রাজনীতি আপনি অন্য কাউকে দেখান আমাকে না।
—শাহনেওয়াজ সাফিন কখনো কথার খেলাপ করে না । সেটা তুমি খুব ভালো ভাবেই জানো সিরাত। তাই রেডি থেকো। বলেই ফোনটা কেটে দিতে রাগে নাক লাল হয়ে উঠলো সিরাতের৷ আর কিছু না পেয়ে হাতে থাকা ফোনটাকে ছুঁড়ে মারাতে চটজলদি তোহা ফোনটা ক্যাঁ’চ ধরে নিল। চোখ মুখের ভাবভঙ্গি অসহায় করে দরজা লক করে ভিতরে ঢুকলো সে। ফেসটা কাঁদো-কাঁদো করে বললো।
— ভাগ্যিস ধরে ফেলেছি। তুই এই নিয়ে কয়টা ফোন ভে’ঙেছিস তাঁর হিসাব নেই সিরাত। এটাও ভে’ঙে ফেললে তুই ফ’কির হয়ে যাবি বলে রাখলাম আমি। তা বল কাঁদছিস কেন? আবার কি হলো তোর?
সিরাত বিছানার উপর উল্টো হয়ে শুয়ে পরে ধীর কন্ঠে বললো।
— রাখতো তোর ফ’কিরের কথা। নিজের শান্তি বড় শান্তি৷ ফোন ভা’ঙলে এবার আর কিনতামও না৷ যত ন’ষ্টের গো’রা ওই ফোন।
তোহা মুখ গো’মরা করে ফেলল।
—ধুরো, এসব কথা রাখতো এখন।এই উঠ আজকে সন্ধ্যায় সাওদার এনগেজমেন্ট পার্টি আছে। জাস্ট চিল বস৷ তারাতাড়ি উঠ।
সিরাত চটজলদি উঠে পরলো। বিছানা থেকে ওড়নাটা হাতে নিয়ে গলায় জড়িয়ে হাসি-হাসি মুখ করে মনে-মনে বললো। এই সুযোগ সাফিনের সাথে না যাওয়ার। তাঁর আগেই তোহার সাথে চলে যাবে ও। উফ ভাবতেই খুশি লাগছে মনটা সিরাতের।
—আচ্ছা যাবনে। আজকে তাহলে রান্না করতে হবে না।
তোহা হাতে থাকা ব্যাগটা টেবিলে রেখে মৃদু হেসে ফ্রিজ থেকে আপেল বের করে খেতে লাগল। বললো।
— জান শোন আমার প্রমোশনটা না ঠিক হয়ে গেছে। যেটার জন্য সকাল-সকাল বের হয়েছিলাম। কি যে ভালো লাগছে কিভাবে বোঝাব তোকে। একবার প্রমোশনটা হয়ে গেলে একটা ফ্লাট কিনে নিব দুজনের জন্য। ভালো হবে না বল?
সিরাত মৃদু হেসে বললো।
—তোহা শোন।
সিরাতের চোখ-মুখ থমথ’মে হয়ে গেলে তোহা খাওয়া রেখে সিরাতের সামনে মরা টেনে বসে পরলো। শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
—কি হয়েছে বলতো তোর? আমি এতক্ষণ সিরিয়াসলি নেইনি। দোস্ত বলনা!
সিরাত কয়েকটা ঢোক গিলে মাথা নিচু করে ফেলল৷ ধীর কন্ঠে বললো।
—সাফিন ফোন করেছিল।
তোহা নিশ্চুপ হয়ে যেতে সিরাতের চোখ বেয়ে পানি ঝরে পরলো। কান্নারত কন্ঠে বললো।
— উনি বলছেন আজকে সন্ধ্যায় নাকি নিতে আসবে আমাকে। না গেলে তুলে নিয়ে যাবে। টাকা দেখাচ্ছে আবারও।
তোহা খানিকটা চুপ থেকে হাসলো। বললো।
—ধুল পা’গলি। বাদ দে তো ওসব! তখন আমরা পরিস্থিতির স্বী’কার ছিলাম। আমারও কিছু করার ছিল না।আর উনি ভয় দেখালেই তুই ভয় পেয়ে যাবি নাকি! আমি আছিতো নাকি? উনি আসার আগেই আমরা সাওদার এনগেজমেন্ট পার্টিতে চলে যাব। চিল বস জাস্ট চিল।
সিরাতও খানিকা হাসার চেষ্টা করলো। বললো।
— আমিও সেটাই ভাবছি।
.
আকাশ ছেঁয়ে আজ ভরা বর্ষনে শিহরিত পরিবেশ৷ থমথ’থে স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় কালো রাঙা শাড়ী পরে তৈরি হয়ে গেল সিরাত। তোহাও সেম কালারের শাড়ী পরে স্টাইল দিয়ে পিক তুলছে একের পর এক। সিরাত হাইহিলটা পরে নিলে ছাতা হাতে বেড়িয়ে পরলো তাঁরা।
সিরাত তোহা অন্ত প্রান৷ ওদের দুজকে সবাই হরিহর আ’ত্মা বলেই জানে। তোহা হলো সিরাতের বেস্ট ফ্রেন্ড। সেই কলেজ লাইফ থেকে ওদের বন্ধুত্ব। সিরাতের নিজের বলতে ওর মামা-মামি ছিল৷ কিন্তু তাঁরা সিরাতকে জোর করে টাকার লো’ভে পরে বয়স্ক লোকের সাথে বিয়ে দিতে চাইলে সিরাত বিয়ের রাতে পালিয়ে এসেছিল তোহার কাছে ঢাকাতে। আর এখন ও তোহার সাথেই তোহার বাড়িতে থাকে। তোহাও একা থাকে এখানে৷ এই ঢাকার শহরে তোহা চাকরির সূএে এসেছিল। আর সিরাতকেও চাকরি পেতে সাহায্য করেছিল। বলতে গেলে সিরাতের জীবনে তখন তোহাই ছিল একমাএ অবলম্বন।
.
রিমঝিমে বৃষ্টির শিহরণময় আবেশে ঢাকার শহরে এত-এত জ্যা’ম থাকা সর্তেও আজ কেমন শুনসান নিরবতা পালন করতে ব্যাস্ত হয়ে পরেছে সে।
সিরাতের হাতটা শক্ত হাতে ধরে রোড ক্রশ করতে নিতে দুটো কালো রাঙা গাড়ি এসে তাঁদের সামনে এসে দাঁড়াল। সন্ধ্যা হওয়ার আবছা আলোয় গাড়ির ভিতরে থাকা সুদর্শন চেহারার মানবটিকে চোখ এরাল না সিরাতের। চোখেমুখে একরাশ বি’ষন্নতা এসে ঝেঁ’কে বসেছে যেন তাঁকে। হয়তো কোন এক সময় এই সুদর্শন মানটিকে তাঁর হৃদয়ের গহীনে অজান্তেই জায়গা করে দিয়েছিল সে। এত ঠান্ডার মাঝেও ঘামছে সে। তোহা বিরক্তি নিয়ে তাকাতে সাফিন গাড়ির কাঁচটা নামিয়ে দরজা খুলে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো।
—সিরাত উঠে বসো তারাতাড়ি। এক মিনিটও ওয়েট করতে চাইছি না আমি।
তোহা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বললো।
—সিরাত কারো সাথে যাবে না আপনি আপনার মতো যেখানে খুশি যান।
সাফিন ভ্রু জাগিয়ে এক পলক তোহার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো৷ বললো।
— তোহা সিরাত এখনও আমার স্ত্রী আমি ওকে ছেড়ে দিয়েছি ঠিকই কিন্তু ডিভোর্স দেইনি। তাই আমি ওকে আমার সাথে নিতেই পারি। তুমি চাইলে তুমিও আমাদের সাথে যেতে পারো।
সিরাত তোহার হাত ধরে ধীর কন্ঠে বললো।
— আর যদি না যাই, তখন কি হবে?
সাফিন মাথায় জড়ানো কালো রাঙা হুডিটা খুলে গাড়ী থেকে বেড়িয়ে পরলো। বৃষ্টির রেশে সাফিনের গোছানো চুলগুলোর ওপর তাঁর উষ্ণ’তা ছুয়িয়ে দিচ্ছে যেন। সিরাত শীতল দৃষ্টিতে সাফিনের দিকে তাকাতে সাফিন মৃদু হেসে সিরাতকে পাঁ’জাকোলা করে নিল। সিরাত সাফিনের বুকে এলোপাথাড়ি কি’ল ঘু’ষি দিতে থাকলে তোহা রাগ নিয়ে কতক্ষণ চিৎ’কার চেচা’মেচি করলে সাফিন কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে তাঁর পিছনে থাকা গাড়িটার উদ্দেশ্যে আদেশের স্বরে বললো।
— জুবায়ের মেয়েটাকে গাড়িতে তুলে নিও। যেখানে যাবে সেখানে নামিয়ে দিয়ে আসো।
জুবায়ের বাঁধ সেধে বললো।
—কিন্তু স্যার আপনাকে প্রটেক্ট না করে মেয়টাকে নিয়ে গেলে বড় সাহেব জানলে রেগে জাবেন তো?
—যেটা বলছি সেটা করো। ইট’স মাই অর্ডার।
—ওকে স্যার।
পিছনে থাকা গাড়িটা সামনে আসার সাথে-সাথে সাফিন সিরাতকে নিয়ে চলে গেল।
—ম্যাম উঠে বসুন।
তোহা রাগান্বিত কন্ঠে রোখ রাঙিয়ে বলে উঠলো।
—যাব না। আপনি যান এখান থেকে।
জুবায়ের সাফিনের ফোনে ফোন লাগিয়ে ব্লুটুথ অন করে বললো।
—স্যার ম্যাম যাবেননা বলছেন।
— তুমি তাহলে কি করছো তাঁকে ঠিক জায়গা মতো দিয়ে আসবে। আর বলবে তাঁর বন্ধুকে ঠিক টাইমে পৌঁছে দিয়ে আসব।
—যাবেননা বলছে তো?
—কোলে নিয়ে নেও।
—ওকেহ।
জুবায়ের গাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই তোহা চটজলদি বলে উঠলো।
—না থাক। উঠছি আপনি বসুন।
—গুড গার্ল।
সিরাত গাড়িতে বসে বের হওয়ার জন্য ছ’ট’ফ’ট করতে থাকলে সাফিন হেসে উঠলো।
সাফিনের হাসির কন্ঠ শুনে যেন সিরাত আরও রেগে যাচ্ছে। মনে-মনে একশো একটা গা’লি দিতে থাকলো সাফিনকে। মুখ ফ’স’কে বের হয়ে গেলেও ভালো হতো। কিন্তু রাগ ভয় দুটোই কাজ করছে এখন নিজের ভিতর।
— এখন আবার কি চাই আপনার আমার কাছে! আপনি না বলেছিলেন নানু আর নেই তো সিরাত তোমার এই বাড়িতে আর প্রয়োজন নেই তুমি তোমার মতো থাকতে পারো। তাহলে আবার এত বছর পর কোন নাটক শুরু করতে চলেছেন?
সাফিন বিরক্ত হলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
—চুপ থাকো সিরাত! কথা কম বলো। ড্রাইভিং করছি দেখতে পাচ্ছো না নাকি?
সিরাত রাগে ফু’স’তে-ফু’স’তে বললো।
—না চুপ থাকতে পারব না আমি। কি করবেন আপনি? যা ইচ্ছে করুন গিয়ে। ভয় পাই নাকি আপনাকে আমি?
সাফিন গাড়িটা থামিয়ে দিয়ে গাড়ির পেছন থেকে ফাস্টএইড বক্সটা হাতে নিতে সিরাত চোখ বড়-বড় করে তাকালো। একটু জোড়েই বলে উঠলো।
— ছুঁ’ড়ি খুঁজছেন নাকি? আইমিন মা’র্ডার করতে চাইছেন আমাকে। পুলিশ,পুলিশ, হেল্প মি প্লিইইজ এই লোক আমাকে মে’রে ফেলবে,প্লিজ হেল্প…
সাফিন রাগ নিয়ে টেপ আর ছুঁ’ড়ি বের করে সিরাতের কাছে এগোতে সিরাতের গাড়ির সাথে পিঠ ঠেকিয়ে গেল যখন। তখন সিরাত তাঁর চোখদ্বয় ভয়ে বন্ধ করে ফেলল। এই লোক নিশ্চিত আমাকে মা’রা’র জন্যই নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সাথে। (মনে-মনে)
সাফিন সিরাতের মুখের সাথে টেপটা এঁ’টে দিয়ে কেঁ’চি না থাকায় ছুঁ’ড়ি দিয়ে বাকি টেপটা কেঁটে দিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসলো।
সাফিন সরে গেছে অনুভব করতে পেরে সিরাত পিটপিট করে তাকালো।
—এবার ঠিক আছে। হাত পাও কি বাঁ’ধ’তে হবে? না তুমি চাইলে আমি সেটাও করে দিচ্ছি। বলেই হাসলো সাফিন। সিরাত সাফিনের কথা শুনে চোখ রাঙিয়ে সাফিনের দিকে তাকালো। যেন চোখ দিয়েই গি’লে খেয়ে নেবে সাফিনকে।
সাফিন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে শীতল কন্ঠে বলতে লাগল।
— যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানে গিয়ে মোটোই লা’ফা>লা’ফি, চিৎ’কার, চেচা’মে’চি করবে না বলে রাখলাম। সেখানে গিয়ে লক্ষী মেয়ের মতো আমার পিছনে-পিছনে হাঁটবে।
সিরাত সাফিনের দিকে মুখ ভে’ঙিয়ে বললো।
—বয়েই গেছে আমার। শ’য়তা’নকা হা’ড্ডি। (মনে-মনে)
—মনে-মনে যা খুশি বলতে পারো সিরাত। কিন্তু প্রকাশ্যে বললে কিন্তু বি’পদ।
সাফিনের কথা শুনে সিরাত বললো।
—পা’গল নাকি সিরাত! যে প্রকাশ্যে বলতে যাবে? মনে -মনে কথাটা বলেই হাসিতে গ’ড়া>গ’ড়ি খেল সে।
.
ঝুম বৃষ্টির ভিতরেও সুন্দর করে ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো গোছানো রিসোর্টটা দেখে সিরাতের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। সাফিন গাড়ি থেকে নামার আগেই ভিতর থেকে ওয়েটাররা দৌঁড়ে ছাতা হাতে এগিয়ে আসলে সাফিন সিরাতের দিকে ধীর চাহনিতে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বললো।
—টেপটা কি খুলে দেব? নাহ থাক তোমার ট্যাপ রেকর্ড আবার শুরু করে দিবে তাহলে। নামো এখন। সিরাত দাঁ’তে দাঁ’ত চেঁ’পে রাগে ফু’স’তে থাকলো। সাফিন হেসে বললো।
—শাহনেওয়াজ সাফিন কখনো তাঁর কথার খেলাপ করে না বুঝলে সিরাত। চলো ভিতরে চলো। তোমার জন্য সারপ্রাইজড অপেক্ষা করছে ভিতরে….
চলবে……