হৃদমাঝারে পর্ব-১৯+২০

0
778

#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
পর্ব-১৯+২০

নতুন সকাল নতুনত্ব নিয়ে আসে। সকালের রোদের আলো চোখে মুখে পড়তেই ঘুম হালকা হয়ে যায় শুভ্রতার। উঠে বসতে গেলেই কাঁধের একপাশ ব্যাথায় টনটন করে উঠে। উঠতে গিয়েও আবার শুয়ে পড়লো। পাশেই মেঘ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। শুভ্রতা হাত দিয়ে মেঘের কপালে হাত দিলো,জ্বর চেক করার জন্য। নাহ জ্বর অনেকটা নেমে গেছে। শরীর স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। শুভ্রতা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। উঠে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হলো। মেঘের জন্য নাস্তা বানানো প্রয়োজন। ওয়াশরুমে থাকার মাঝেই কলিংবেলের আওয়াজ এলো। শুভ্রতা তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো। মেঘের দিকে এক পলক তাকালো,না ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে নি। শুভ্রতা নিঃশব্দে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলতেই মেঘের মা’কে চোখে পড়ে। শুভ্রতা অবাক হলো না,কারণ কালকেই সে সব জানিয়ে দিয়েছে। শুভ্রতা সালাম দিয়ে বলে,,’মা ভেতরে আসুন!’
‘আপা আসুন।’ মেঘের মায়ের কথায় শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আরো কে এসেছে নাকি? শুভ্রতা উঁকি দিয়ে দেখে। কিন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত মুখ দেখে চমকালো। কারণ,পাশেই তার মা দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতা অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত চোখে তাকালো।
‘ভেতরে আসুন।’ বলে সে সাইড দিলো। দু’জনেই রুমে প্রবেশ করে।
‘বউ’মা মেঘ কই? কেমন আছে? কিভাবে হলো এসব?’
‘হ্যাঁ রে। এখন কি অবস্থা ছেলেটার।’ শুভ্রতা দু’জনের দিকে একপলক চেয়ে বলে,,’উনি ঘুমাচ্ছেন এখন। রাতের জ্বর এসেছিলো। এখন ছেড়ে গিয়েছে। আপনারা জার্নি করে এসেছে, ফ্রেশ হন। আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি!’
‘হ্যাঁ ঠিক বলেছ। নোংরা কাপড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আপা আসুন!’ কথাটা বলে মেঘের মা শুভ্রতার মাকে নিয়ে পাশের রুমে যায়। শুভ্রতা নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে রয়। নিজের মায়ের চোখে আজ তীব্র অনুশোচনা দেখা যাচ্ছে। মা যেনো তার সাথে চোখ মেলাতেই পারছে না। শুভ্রতা নিঃশব্দে আবারও রুমের দিকে যায়। ফ্রেশ হওয়া দরকার।

‘শুভ্রা!’ মায়ের ডাকে শুভ্রতা একবার তার দিকে তাকিয়ে চায়ে দুধ দিতে দিতে বলে,,’হ্যাঁ বসো তুমি। নাস্তা দিচ্ছি।’
‘আমি এখানে খেতে আসি নি।’
‘আচ্ছা। উনাকে দেখেছো? বাসার সবাই ভালো আছে?’
‘তুই খবর নিস? না দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিস?’
‘কি যে বলো। যার থেকে মুক্তি চেয়েছো আবার তার থেকে খবর আশা করছ? ব্যাপারটা হাস্যকর লাগছে না?’
‘শুভ্রা আ..’ আর কিছু বলার আগেই মেঘের মা সেখানে উপস্থিত হয়ে বলে,,’কি মা মেয়ের গল্প হচ্ছে?’
‘ওই আরকি। আপা আসুন আমরা বসি।’ শুভ্রতার মা উনাকে নিয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে যায়। শুভ্রতা সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।

‘কিরে বাবা কেমন আছিস? শরীর কেমন?’ মাত্রই ঘুম থেকে উঠে হয়তো নিজের মা,শাশুড়িকে আশা করে নি মেঘ। তাই শুভ্রতার দিকে তাকালে শুভ্রতা ইশারায় চোখে আস্বস্ত করে। শুভ্রতা মেঘকে ধরে হেলান দিয়ে বসায়।
‘মা চিন্তা করো না,আমি ঠিক আছি। তুমি একা আসতে গেলে কেনো?’
‘একা কই আমি আর আপা একসাথে এসেছি।’

‘মা আপনিও বা এতো কষ্ট করে এসেছেন। আমি তো ঠিক আছি।’
‘আচ্ছা বাবা তুমি এতো কথা বলো না। রেস্ট নাও। আমরা তো আছি। আর ছেলের অসুস্থতায় মা না এসে থাকতে পারে?’
‘আপনারা খেয়েছে? নাস্তা দিয়েছো ওদের? (মেঘ শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে।)
‘হ্যাঁ আমার নাস্তা হয়ে গেছে। এক্ষুণি দেবো।’
‘আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। আমরা খেয়ে নিচ্ছি।’
‘হ্যাঁ আসুন।’ কথাটা বলে শুভ্রতা ওদের নিয়ে নাস্তার টেবিলে যায়।

‘আপনার তো ফ্রেশ হওয়া দরকার। একটু অপেক্ষা করুন।’ কথাটা বলে শুভ্রতা এক বালতি পানি,ব্রাশ,পেস্ট নিয়ে আসে। তারপর মেঘকে ফ্রেশ করিয়ে দেয়।
‘ওয়াশরুমে যাওয়া লাগবে।’ মেঘ মিনমিনিয়ে কথাটা বলে। মেঘের বলার স্টাইল দেখে শুভ্রতা ফিক করে হেসে দেয়।
‘এভাবে বলছে কেনো? আমি হেল্প করলে যেতে পারবেন?’
মেঘ মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়,শুভ্রতা সাবধানে নিজের উপর ভর দিয়ে মেঘকে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। তারপর আবার বের করে এনে খাটে বসিয়ে দেয়।
‘বউমা আমি মেঘকে খাইয়ে দি?’ মেঘের মায়ের কথায় শুভ্রতা মুচকি হেসে বলে,,’এভাবে বলছেন কেনো মা? খাইয়ে দিন। নিন (খাবারের প্লেটটা হাতে দিয়ে) খাইয়ে দিন।’ মেঘের মা শুভ্রতার হাত থেকে প্লেট টা নিয়ে যত্ম সহকারে ছেলেকে খাওয়াতে লাগে। মেঘও এতোদিন পরে নিজের মায়ের হাতে তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে।
‘ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? তুমিও তো নিশ্চয়ই খাও নি। এসো একসাথে খাইয়ে দেই।’ মেঘের মায়ের কথায় শুভ্রতা মেঘের দিকে তাকায়। মেঘও ইশারায় আসতে বললে,শুভ্রতা মেঘের পাশে বসে। মেঘের মা দু’জনকেই খাইয়ে দেয়।

‘শু..’ শুভ্রতার মা কিছু বলতে বলতে রুমে ডুকছিলো। কানে মোবাইল,হয়তো কারো সাথে কথা বলছে। উনার উপস্থিতিতে রুমের সবাই উনার দিকে তাকায়।
‘আপা আসেন না, আসলে মেঘকে খাইয়ে দিচ্ছি তাই শুভ্রাকেও খাইয়ে দিচ্ছি। আপনার মেয়ের উপর কিন্ত আমারও ভাগ আছে। হিংসে করবেন না!’ মেঘের মায়ের কথায় শুভ্রতার মা কিঞ্চিৎ হাসলো শুধু কিছু বললো না। শুভ্রতা নিজের মায়ের দিকে তাকালো। চোখটা কেমন ছলছল করছে। হয়তো এতোদিন মেয়েকে অবহেলা করার জন্য খারাপ লাগছে। শেষ কবে মেয়েকে ভালোবেসে খাইয়ে দিয়েছে সেটাও মনে নেই। শুভ্রতা আর ভাবতে চাইলো না। তার মা যখন তার কাছ থেকে মুক্তি চেয়েছে সে মুক্তিই দিবে, সারাজীবনে মাকে কিছুই দিতে পারে না,কষ্ট ছাড়া তাই সে তার মাকে মুক্তিই দেবে।
__________________
মেঘের পাশেই একধ্যানে কিছু ভেবে চলেছে শুভ্রতা। আজ মেঘ আর শুভ্রতার মা দুজন মিলে রান্না করবে বলে ঠিক করেছে। শুভ্রতা এতোক্ষণ ওখানে বসে ছিলো। একটু আগে উঠে মেঘের কাছে এসেছে।
‘কিছু ভাবছো শুভ্র?’ মেঘের কথায় ঘাড় কাত করে মেঘের দিকে তাকায় শুভ্রতা। মেঘ উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। শুভ্রতা মাথা নাড়িয়ে ‘কিছু না বুঝায়!’
‘আমি বলেছিলাম না,তুমি হা করলে আমি সব বুঝে ফেলি।’
‘এই জন্যই আমি এখন হা করি নি!’ শুভ্রতা ভেংচি কেটে বলে। শুভ্রতার উত্তরে মেঘ হাওয়া ছাড়া বেলুনের মতো চুপসে যায়। বেশ অহংকার করে বলেছিলো এখন শুভ্রতা ঠুস করে পাটিয়ে দিলো।
‘আচ্ছা হইছে। এবার বলো কি হয়েছে?’
‘এখনও খবর পাই নি,হবে কি করে? হলে আপনি দেখতেন নাহ?’
‘আমি ওই হওয়ার কথা বলি নি ইডিয়েট,আমি তোমার মুড অফের কারণ জানতে চাইছি।’
‘আমি ঠিকই আছি। আপনার কোনো সমস্যা হচ্ছে? সেটা বলুন আমায়।’
‘নাহ আমি ঠিকই আছি।’
‘আচ্ছা। আপনি তাহলে রেস্ট করুন আমি আসছি।’
কথাটা বলে শুভ্রতা আর কাল বিলম্ব না করে উঠে চলে যায়। শুভ্রতার হঠ্যাৎ উঠে যাওয়ায় মেঘ কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রয়।
______________
‘রুহিপু। সেদিনের অসমাপ্ত কথাটা আজ পূরণ কর।’
‘আহ শুভ্র। তুই আগে বল মেঘ ভাই কেমন আছে?’
‘আছ ভালো। এবার তুই আমাকে বল সবটা।’
‘আচ্ছা।’ শুভ্রতা একটু আগে রুহিকে ফোন দেয়, ওইদিনের কথাগুলো জানার জন্য।

‘আসলে শুভ্রা মেঘ তোকে প্রায় ছয়বছর আগে থেকেই চিনে।’ রুহির কথায় শুভ্রতা চমকে উঠে।
‘কি বলছিস কি?’
‘আগে পুরো কথাগুলো শুন,তারপর চমকাবি।’
‘আচ্ছা বল।’

‘মেঘ ভাইয়ের বাবা আর তোর বাবা পূর্ব পরিচিত ছিলো। একদিন মেঘ ভাইয়ের বাবাকে কোনো একটা বিপদ থেকে চাচ্চু বাঁচায়,আমি যতদূর জানি জমি সংক্রান্ত কিছু। তো ওখানের কোনো একটা দলিল দেওয়ার জন্য মেঘ ভাই প্রথম আমাদের বাসায় আসে। সেখানেই মেঘ ভাই প্রথম তোকে দেখে। তুই তখন হয়তো সেভেন/এইটের ছাত্রী। মেঘ ভাই কলেজের স্টুডেন্ট। তোর ওই খরগোশের কথা মনে আছে,যেটা গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যায়? ওই খরগোশের বাচ্চার সাথে তুই ছিলি। মেঘ ভাইয়ের ওখানে তোকে দেখে ভালো লেগে যায়। মেঘ ভাই তখন ঢাকায় পড়াশুনো করতো। নিছক ভালো লাগা ভেবে সে আর পাত্তা দেয় না। কিন্ত সেটা গাড়ো ভাবে ভালোবাসায় রুপ নেয় যখন সে তোকে আজ থেকে প্রায় চার বছর আগে গ্রামের মেলায় দেখে।
ভার্সিটি বন্ধ থাকায় গ্রামে এসেছিলো মেঘ ভাই। আমি,তুই,আরো কিছু বন্ধু মিলে মেলায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। মেঘ ভাই সেখানে তোকে আবার দেখেছিলো। পুরনো ভালো লাগা কাজ করা শুরু করে। দিন গড়াতে গড়াতে সেটা ভালোবাসায় রুপান্তর হয়ে যায়। মেঘ ভাইয়ের সাথে আমার ফেইসবুকে আলাপ হয়। সেখানে থ
ভাইয়া আমার থেকে তোর ব্যাপারে টুকটাক ইনফরমেশন নেয়। আমিও তাকে দেই। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম মেঘ ভাই সত্যি তোকে ভালোবাসে। কিন্ত এর মাঝেই তুই স্বপ্নের সাথে একটা রিলেশনে জড়িয়ে পড়িস। মেঘ ভাই তা জানতে পেরে প্রচন্ড কষ্ট পায়। উনি সিদ্ধান্ত নেন, তোর জীবন থেকে সরে যাবে। কিন্ত সে তো কোনোদিন তোর জীবনে ছিলোই না। এরপর যখন স্বপ্নের সাথে তোর রিলেশনের এই ঘটনা ঘটে,আমি মেঘ ভাইকে জানাই। সব জেনে উনি প্রস্তাব পাঠান চাচ্চুর কাছে। এরপরের টা তো তুই জানিসই। মনে আছে তোর গায়ে হলুদের দিন তোকে শাড়ি পড়িয়ে আবার খুলে ফেলেছিলাম। মেঘ ভাইকে আমি ছবি পাঠানোফ জন্যই পড়িয়েছিলাম। আমি প্রথম থেকে সবটা জানতাম। আমি চেয়েছিলাম তুই সত্যিকারের ভালোবাসা খুঁজে নিস,তাই এতোকিছু।’

চলবে…?

#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
(২০)

কেউ আমাদেরকে ভালোবাসে শুনলে অটোমেটিকলি আমাদের মনের ভেতর একটা আনন্দ কাজ করে। হোক আমরা বিপরীত মানুষটাকে ভালোবাসি অথবা না বাসি। শুভ্রতার মনে আজ খুশির জোয়ার চলছে। মেঘ তাকে এতোদিন ধরে,এতোটা ভালোবাসে সেটা কোনোদিনও বুঝতে পারে নি। শুভ্রতার খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করে। ওপাশ থেকে রুহি হ্যালো হ্যালো করছে তার কোনো খবর নেই। খট করে ফোনটা কেটে দিলো। মেঘ তাকে ভালোবাসে সে এটাতেই আটকে আছে। আজ সে তার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছে। কেনো মেঘ তার আগের বিয়ের কথায় ভ্রুক্ষেপ করে নি, কেনো সব জেনেও তাকে বিয়ে করলো। কিভাবে শুভ্রতার সব কিছু নিজের নখদর্পণে নিয়ে নিয়েছে। কিভাবে শুভ্রতার পছন্দ-অপছন্দ জানে। আর এই সব কিছুর উত্তর মেঘ তাকে ভালোবাসে। শুভ্রতা ছাদে দু’হাত মেলে আকাশের দিকে তাকালো। এইরকম আকাশের দিকে তাকিয়েই একদিন সে আল্লাহ কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলো। আজ আবার এই আকাশের নিচে দাঁড়িয়েই সে সবচেয়ে খুশি, আল্লাহ যা কেড়ে নিয়েছে তার থেকেও হাজারগুন উত্তর তাকে দান করেছে। শুভ্রতা দু’হাত মেলে নিজে নিজে ঘুরতে ঘুরতে বলে,,’উনি আমাকে ভালোবাসে। শুনেছো তোমরা মেঘ ফল ইন লাভ উইথ শুভ্রতা,উঁহু শুভ্র!’
হাতে থাকা ফোনটা আবারও ভাইব্রেট করতে শুভ্রতার উচ্ছাস থামে। ফোনের স্ক্রিনে ‘ঘোমড়ামুখো এইচবি’ নামটা ভেসে উঠতে শুভ্রতা ফিক করে হেসে দেয়। বেচারা হাটতে পারে না বলে বউকে ফোন দিয়ে ডাক দেয়। শুভ্রতা ফোন কানে ধরলে মেঘ ওপাশ থেকে বলে,,’হ্যালো শুভ্র। কই তুমি? কখন রুম থেকে বের হয়েছ। বের হয়ে কি হাওয়া হয়ে গেছো নাকি?’
‘বউরে এতো মিস করলে নিজেই ছাদে চলে আসেন। আপনার বউ ছাদে।’
‘হ্যাঁ আমি হাটতে পারলে ফোন করে ডাকা লাগতো না, নিজেই চলে আসতাম।’
‘আহা গো,জামাই আমার। কোলে করে ছাদে নিয়ে আসবো?’
শুভ্রতার টিটকারি কথায় মেঘ খানিকটা কর্কশ কন্ঠে বলে,,’নিতে পারলে নিয়া যাও। ওই তো কাঠির মতো শরীর। দেখা যাবে, কয়েকটা হাড় জয়েন্ট থেকে ছুটে মাংস ফেটে বেরিয়ে এসেছে।’
‘এ্যাহ আমার কাজ নাই তো, আপনার মতো বুইড়া দামড়ারে কোলে নিবো। ফোন রাখেন আমি আসছি।’ কথাটা বলে শুভ্রতা ফোন কেটে নিচে চলে যায়।
___________________
শিং মাছের সামনে পা গুটিয়ে বসে আছে শুভ্রতা। সামনেই মেঘ মুখ চেপে হাসছে। চেয়ারে বেশ আয়েশ করে বসে মোড়ার উপর দু’পা দিয়ে শুভ্রতার কান্ড দেখছে। পাশেই মেঘ আর শুভ্রতার মা দাঁড়িয়ে আছে। মেঘের শরীর খারাপের জন্য শুভ্রতার মা বলেছে শিং মাছ খাওয়াতে,তাই একটু আগে দারোয়ানকে দিয়ে শিং মাছ আনিয়েছে শুভ্রতা। শুভ্রতা শিং মাছ কাটতে জানে না বলে,শুভ্রতা আর মেঘের মা বলেছে কেটে দিবে। কিন্ত শুভ্রতা বেশ ভাব নিয়ে বলেছে,,’চেষ্টা করলে মানুষ কি না পারে, আর এটা তো শুধু শিং মাছ। আমি পারবো।’
এরপর শিং মাছগুলো পাতিলে ডালতেই শুভ্রতা লাফিয়ে উঠে। মাছ গুলো লাফিয়ে একবার এদিক আরেকবার ওদিক যায়। শুভ্রতা ধরতে গিয়ে বার বার হাত সরিয়ে নেয়। আর শুভ্রতার কান্ডে উপস্থিত সবাই মুখ টিপে হাসছে। শুভ্রতার সবার দিকে অসহায় ভাবে তাকায়।
‘আচ্ছা বউ’মা, তুমি বরং উঠো। বসে দেখো কিভাবে কাটতে হয়। তুমি পারবা না।’

‘কেনো মা? মানুষ চাইলে কিনা পারে? এটা তো শুধু শিং মাছ। শুভ্র উইল বি ম্যানেজ। তাই না?’
শুভ্রতার দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে বলে মেঘ। মেঘের কথায় শুভ্রতার মা এবার জোরেই হেসে দেয়। শুভ্রতা মেঘের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালে,মেঘ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে থাকে।
‘আচ্ছা হইছে,এবার উঠ তো। আমরা কেটে দেই।’ মায়ের কথায় শুভ্রতা উঠে দাঁড়িয়ে যায়। মেঘের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধুপ ধাপ পা ফেলে রুমে চলে যায়। শুভ্রতা যেতেই আরেক দপা হাসির রোল পড়ে।
_________________
‘শুভ্রা।’ সন্ধ্যে বেলায় চায়ের পানি বসিয়েছে শুভ্রতা। তখনই তার মা এসে পাশে দাঁড়ায়।
‘কিছু বলবে?’
‘আমাদের উপর রেগে আছিস তাই না?’
‘আমার রাগ,অভিমান কিছু থাকতে নেই। খারাপ সন্তানদের এসব থাকা পাপ।’
‘শুভ..’
‘প্লিজ মা। পুরণো কাসুন্দি ঘেটে লাভ নেই। আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমাকে ক্ষমা করো। ব্যাস আর কিছুর প্রয়োজন নেই।’ কথাটা বলে শুভ্রতা অন্যদিকে চলে যায়। শুভ্রতার যাওয়ার দিকে তার মা শুধু তাকিয়ে রয়। সে সময় যদি মেয়েটাকে ধাক্কা সামলানোর একটু সময় দিতো, একটু পাশে দাঁড়াত, তাহলে হয়তো মেয়েটা এতো কষ্ট পেতো না। মেয়েটা যা বরাবরই চাপা স্বভাবের। শুভ্রতার মা মনে মনে এটাই প্রার্থণা করে তার সন্তান যাতে ভালো থাকে।
_________________
বন্ধুদের সাথে আড্ডায় সব সময় ভালো সময় কাটে। মন খারাপ থাকলেও সেটা নিমিষেই দূর হয়ে যায়। ক্যাম্পাসের একপাশেই বসে আড্ডা দিচ্ছে শুভ্রতারা। আড্ডার বিষয় বস্ত মাহির ছ্যাঁকা খাওয়া। মাহি বেশ বড় আকারে ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে গিয়েছে। সে ফেইসবুকে একটা ছেলের সাথে কথা বলেছে। প্রোফাইলে বেশ ইয়াং দেখা গিয়েছে, কিন্ত দেখা করার পর জানা গেলো,উনার মাথায় ইয়া বড একটা টাক। মাহি সেই দুঃখে নাজেহাল।
‘আরে ভালোই তো,যখন তোর ভালোবাসা উতলাইয়া পড়ব,তুই ওই ব্যাডার টাকে ইয়া বড় একটা চুম্মা দিবি।’ নিশানের কথায় সবার মাঝে হাসির রোল পড়ে যায়। মাহি উঠে ধুম ধুম করে কিল বসিয়ে দেয়।
‘আবে রাখ তোর চুম্মা, আমাদের এখানে বিয়াইত্তা শুভ, তুই টিপস দে বেডি। বইসা বইসা মজা মারা লাগবো না।’
মাহির কথায় শুভ্রতা মুখ বাঁকিয়ে বলে,,’আমি কি টিপস দিমু? আমার জামাইর মাথায় হেব্বি চুল,তোর ওই ব্যাডা তো টাক। আমার কাছে টাকের কোনো টিপস নেই। তুই বরং নিশানের দেওয়া টিপস এপ্লাই কর!’
‘এই তো একটা ভালা কথা কইছস। এর লাইগা মাম্মা তোরে আমি বিশেষ ট্রিট দিমু।’
নিশানের কথায় শুভ্রতা নাক সিটকে বলে,,’ছিহ তোর ওই স্পেশান ট্রিট মানেই,করলা ভাজি। ইয়াক!’
নিশান কিছু বলবে তার আগেই শুভ্রতার ফোন বেজে উঠে। মেঘের ফোন দেখেই সবাই হইহই করে উঠে। শুভ্রতাকে ফোন কানে নিতেই নিশান বেশ ঢং করে বলে,,’আহ বেবি,এই সময় ডিস্টার্ব করে কে? দেখা করার সময় কেউ ডিস্টার্ব করলে ভাল লাগে না। ফোনটা বরং বাসায় রেখে আসবা।’
নিশানের কথায় শুভ্রতা চোখ বড় বড় করে তাকায়। পাশে সবাই মুখ টিপে হাসে। শুভ্রতা ধুম করে একটা কিল বসিয়ে বলে,,’হারামি পোলা,আমার ঘর ভাঙ্গার লাইগা উইঠা পড়ছস কেন? ওই মাহি এডার মুখ চাইপা ধর।’ শুভ্রতার কথায় মাহি নিশানের মুখ চেপে ধরে। শুভ্রতা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,,’জ্বি বলুন।’
‘তোমার সাথে কে?’
‘ওই নিশান মজা করেছে। আই সোয়ার আমি ক্যাম্পাসে।’
‘পেছন ফিরো।’ মেঘের কথা মতো শুভ্রতা পেছন ফিরে দেখে কয়েক হাত দূরে মেঘ দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতাকে অবাক হতে দেখে সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। শুভ্রতা উল্টো দিকে তাকিয়ে ছিলো বলে মেঘকে এতোক্ষণ দেখে নি, কিন্ত বাকি সবাই মেঘকে দেখেছে। মেঘকে দেখেই নিশান কথাগুলো বলেছে। মেঘ এগিয়ে এসে আড্ডার স্থলে দাঁড়াল।

‘আমাদের দুলাভাইয়ের বউয়ের জন্য কি টান,টানে টানে ভার্সিটিতে চলে এসেছে।’ মাহির কথায় সবাই হেসে উঠলেও শুভ্রতা খানিক লজ্জা ফেলো।
‘থাম তোরা। আসছি আমি।’
‘এখন চুল ওয়ালা জামাই পাইয়া,আমারে ভুইলা গেলা বেইব। এটা সহ্য হয় না।’ নিশান বুকের ডান পাশে হাত দিয়ে বলে।
‘ওইটা বা’পাশে হবে ভাই।’ মেঘের কথায় সবাই সমস্বরে হেসে উঠে। নিশান অসহায় চোখে সবার দিকে তাকায়।
‘এই জন্যই তোর জিএফ টিকে না। যা ফট।’ কথাটা বলে শুভ্রতা আড্ডা থেকে বিদায় নিয়ে মেঘের কাছে যায়।
‘আমার শরীর এখনও পুরো ভালো হয় নি। আপনি এখানে চলে এসেছেন? এই জন্যই আমি ভার্সিটিতে আসতে চাই নি। মা রাও দু’দিন আগে চলে গেছে। বাসায় আপনাকে একা ছাড়তে আমার মোটেও ইচ্ছে হয় নি। আপনি জোর করে পাঠিয়েছেন।’
‘আমি একদম ঠিক আছি। কাল থেকেই অফিস জয়েন করবো। ভাবলাম তার আগে বউকে একটু সময় দিয়ে যাই।’
‘এ্যাহ আসছেন আমার বউকে সময়দাটা বীরপুরুষ। ‘ শুভ্রতা ভেংচি কেটে কথাটা বলে।
শুভ্রতার কথায় মেঘ শুভ্রতার হাতে চিমটি কেটে বলে,,’ক্ষেপি মহিলা।’
‘ঘোমড়ামুখো ব্যাডা।’
দু’জনে মজা করতে করতে ভার্সিটি পেরিয়ে নিজেদের গন্তব্যের দিকে হাটা দিলো।

চলবে..?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে