হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৫২.
‘মা? হিমি এই কাজটা করতে চান। অনেকদিন যাবত করছেনও। আমার মনে হয় ওনাকে চাকরিটা করতে দেয়া উচিত।’
তসবি পড়া থামালেন মায়মুনা। ছেলের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডানদিকে দাঁড়ানো হিমিকে আড়চোখে দেখলেন।
সকালেই এ বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে হিমির সাথে। অফিস থেকে ফোন আসায় শাশুড়ির থেকে পারমিশন নিতে এসেছিলো হিমি। যদিও এর আগে কখনোই কারো থেকে পারমিশন নিতে হয় নি তাকে তবে বাপের বাড়ি থেকে আসার আগে বড়মা বলছ দিয়েছে যে কাজই করবে শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে তবেই করবে। হিমি তাই জিজ্ঞেস করতে এসেছিলো যাবে কি না। মায়মুনা স্তম্ভিত গলায় জানতে চেয়েছিলেন কি কাজ করে সে। সরল মনে হিমি জবাব দিয়েছে ম্যানেজমেন্টের কাজ। সাথে সাথেই গর্জে উঠেছেন মায়মুনা। বাড়ির বউ বাইরে গিয়ে কাজ করবে না। কিছুতেই না। হিমি উচ্চবাচ্য করে নি। কথা তো সেখানেই শেষ। তবে এখন আবার ছেলে বউয়ের ওকালতি করতে এসেছে কেনো? ভেবে পান না মায়মুনা।
ছেলেকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে কাঠ কাঠ গলায় বললেন,
‘বাড়ির বউয়ের চাকরি করার প্রয়োজনীয়তা দেখছি না। তাও আবার ক্যাটেরিং, ডেকোরেটিংএর কাজ!’
মায়মুনার কথায় আশাহত হলো তাহির। শুকনো হেসে বললো,
‘কোনো কাজই তো ছোট নয়। ওনার যা ভালো লেগেছে তাই করছেন। তাতে আমাদের বাঁধা দেয়া উচিত নয়।’
‘অবশ্যই উচিত। বাড়ির বউ যখন তখন অন্যের বিয়ে, জন্মদিন এসব অনুষ্ঠানের সাজসজ্জা করতে চলে যাবে তা তো আর হয় না। তোমার বউ যদি পড়াশোনা করে ভালো কোনো চাকরি করতো আমি আটকাতাম না। কিন্তু ইন্টার ফেইল মেয়ের আবার কাজ কিসের? নতুন বিয়ে হয়েছে। কোথায় ঘরে থাকবে, ঘরের কাজ শিখবে তা না। সামান্য চা বানাতেও শিখে নি। কফিও বানাতে চিনে না। সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়াবে কেনো?’
তাহির হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে হিমির দিকে তাকালো। হিমির গাল দুটো বেলুনের মতো ফুলে আছে। ফর্সা নাকটা লাল টকটকে হয়ে আছে। চোখে বোধ হয় বর্ষণ শুরু হবে। মায়মুনা জামান আবারও তসবি পড়ায় মনোযোগ দিলেন। তাহির বিনাবাক্যে উঠে গেলো। হিমি কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ধপাধপ পা ফেলে উপরে গেলো। মায়মুনা জামান তসবি পড়া অবস্থায় পেছন ফিরে চোখ বড় বড় করে তাকালেন। এতো জুড়ে হাঁটাচলা করে কেনো এই মেয়ে? ও কি বুঝে না এখন আর সে ছোট নয়। নিজের বাড়িতে নয়। শ্বশুরবাড়িতে আছে। শাশুড়ির সামনের তেজ দেখায় কোন সাহসে? কেউ ওকে শেখায় নি কি করে গুরুজনদের সম্মান করতে হয়?
___________________
হাসপাতালের কাজ শেষে বেডরুমে ঢোকে খাটের মাঝখানে হিমিকে পা গুটিয়ে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো তাহির। দেয়াল ঘড়িতে বারোটা বেজে সাত মিনিট। তাহির দরজা আটকে হিমির মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। হিমির দৃষ্টি শূণ্যে স্থির। হিমিকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষন করেও কিছু ঠাহর করতে পারলো না তাহির। জিজ্ঞাসু গলায় বললো,
‘হিমি?’
হিমি নিশ্চুপ। তাহির আবারও ডাকলো তাকে। এবার চোখ ঘুরিয়ে তাহিরকে দেখলো সে। তাহির কিছু বলতে নিতেই হিমি বলে উঠলো,
‘আপনার ঘুম পাচ্ছে? ঘুমান। আমি সরে যাচ্ছি।’
কথাটা বলেই ঝট করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো হিমি। তাহির ভড়কে গেলো। হিমির কন্ঠ শোনে মনে হচ্ছে ভীষন রেগে আছে সে। কিন্তু কার উপর রেগেছে? তাহিরের উপর? না কি তাহিরের মায়ের উপর? বিষয়টা বুঝা যাচ্ছে না ঠিক। তাহির ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে টাউজারের পকেটে হাত গুজে বললো,
‘আমার ঘুম পায় নি। আপনি চাইলে আগের মতোই খাটের মাঝখানে বসে থাকতে পারেন।’
হিমি অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো। রাগে কটমট করতে করতে খাটের কোনায় বসে পরলো। কিছুক্ষন নিরব থেকে হুট করেই বলে উঠলো,
‘আপনার মা এমন কেনো?’
‘কেমন?’
‘নিজের ছাড়া অন্যের কথা, অনুভুতি কিছুই বুঝার চেষ্টা করেন না। কে কি চাইলো, কার কি ইচ্ছে, কার কি পছন্দ এসবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই কেনো ওনার?’
‘মা এমনই হিমি। কেনো এমন সেটা জানি না। তবে ছোটবেলা থেকেই ওনাকে এমন ব্যবহার করতে দেখে আসছি।’
‘আপনি ঠিকই বলেছিলেন বাচ্চা ডাক্তার। আমার এখন আপনার বাবার জন্যই মায়া হচ্ছে।’
তাহির হাসলো। এগিয়ে গিয়ে হিমির পাশে বসলো। শান্ত গলায় বললো,
‘মা আপনাকে কিছু বলেছেন?’
‘যেদিন থেকে এবাড়িতে এসেছি খালি তো উনিই বলে যাচ্ছেন।’
‘মায়ের কথার জবাব দিতে না পারায় ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে পরছেন?’
‘হতে পারে। তবে আপনার মায়ের মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। এই যে আমাকে একের পর এক আদেশ, নিষেধ, অপমান করছেন তাতে আমার খারাপ লাগছে, রাগ হচ্ছে এসব উনি বুঝতে পারার পরও থামছেন না।’
তাহির শুকনো হাসলো। হিমির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আমি মাকে রাজি করাবো। কিছুদিন সময় দিন আমায়। কাজ ছাড়তে হবে না আপনাকে। শুধু কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে নিন। মা রাজি হয়ে গেলেই আবার জয়েন করবেন।’
হিমি মাথা নেড়ে বললো,
‘আমি কাজ ছেড়ে দিতে হবে বলে রেগে নেই বাচ্চা ডাক্তার।’
কপালে চিন্তার ভাজ পরলো তাহিরের। চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলছে।
‘কাজ করাটা আমার জন্য ইম্পোর্টেন্ট নয়। তখন ছিলো। নিজের জন্য কিছু করার ইচ্ছে ছিলো বলে নয় বরং নিজেকে ব্যস্ত রাখার তাগিদে। এখন সে ইচ্ছাটা নেই। কাজটা বোরিং লাগে আমার কাছে।’
‘তাহলে?’
‘দু বাড়িতেই গাড়ি ছিলো। যে যখন যেখানে যেতে চাইতো নিজেদের গাড়িতে বসে যেতে পারতো। পারতাম না শুধু আমি। দাদু নিহান আর আমার মধ্যে ভয়াবহ পার্থক্য তৈরি করেছিলেন। ফলে নিহান বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গেলেও গাড়ি চড়ে যেতো আর আমি কোচিংএ যাওয়ার সময় অটোয় করে যেতাম। কেউ দাদুকে আটকায় নি। বুঝায় নি সঠিক বেঠিকের পার্থক্য। ও বাড়িতে আবার মামানির আদেশ! হিমিকে গাড়িতে বসতে দেয়া হবে না। পড়ালেখা নেই যাচ্ছে তাই করে বেড়াবে, দরকারের সময় গাড়ি পাওয়া যাবে না। হিমি যা করার একা একা করবে। একা একা চলাফেরা করবে। মামু তাই জেদ করেই আমায় বাইক কিনে দেয়। ড্রাইভিং শেখায়। বাইক পাওয়ার পর থেকে কখনোই আর হিংসে করি নি কাউকে। আগে একটু একটু করতাম। তবে বাইক পেয়ে নিজেকে সবচেয়ে বেশি লাকি মনে হতে লাগলো। যখন তখন যেকোনো জায়গায় সাই করে বেড়িয়ে গেছি। সারাক্ষন বাইকে করেই ঘুরেছি। বিয়ে হয়েছে বলে কি বাইক চালানো যাবে না? আপনার মায়ের জন্য আমি আমার এতোদিনের কম্ফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে এসে কুর্তি পরছি। কাজ ছেড়ে দিচ্ছি। সারাদিন ঘরে থাকছি। আপনার মা আমার কথা ভেবে শুধু একটা পারমিশন দিতে পারবেন না? বাইক চালানোর পারমিশন? আমি তো আর এখন ওনাকে না বলে ছাদেও যাই না। প্রমিজ করছি বাইরেও ঘুরবো না বেশি। শুধু মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাবো। বাইকে চড়ে হাওয়া খেতে যাবো। আমি এই কাপড় পরেই যাবো। তবু আপনার মা মানছেন না। এ বাড়িতে বাইক আনা এলাউড না বলছেন।’
তাহির দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হিমির চোখে আকুতি। তাহির এক হাত বাড়িয়ে হিমির হাতের উপর রাখলো। অপরাধী গলায় বললো,
‘আমি মাকে বুঝানোর চেষ্টা করতে পারি হিমি। তবে আশ্বস্ত করতে পারছি না যে মা মেনে নিবেন। আমার মা ভীষন জেদী। যা উনি চান তাই করতে হয়। যা বলেন তা কখনো পরিবর্তন হয় না। ওনার অমতে কিছুই করাও সম্ভব নয় এ বাড়িতে। চাকরি করা আর বাইক চালানো দুটো আলাদা বিষয়। চাকরি করলে আপনি আর্ন করতে পারবেন বলেই হয়তো মাকে মানানো সহজ হতো। কিন্তু বাইক চালানো!’
হিমি ঠোঁট উল্টে মুখ ঘুরালো। তাহির চেয়েও কিছু করতে পারলো না। দু এক মিনিট ঘরময় নিরবতা ছেয়ে ছিলো। তারপরই হিমি তাহিরকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিয়ে নিজের জায়গায় শুয়ে পরে বললো,
‘ঘুমাবো আমি। যান আপনিও ঘুমান।’
দুচোখ বুজে আছে হিমি। তাহির বুঝতে পারছে হিমির ঘুম পায় নি। শুধু আর কথা বাড়াতে চায় না বলেই ঘুমানোর অভিনয় করছে সে। তাহির কিছু বললো না তবুও। ডিম লাইট জ্বালিয়ে চোখের চশমা খোলে রাখলো বেড সাইড টেবিলে। বালিশে মাথা রাখতেই খসখসে গলায় বলে উঠলো হিমি,
‘কাল কিন্তু আমি আমার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাবো।’
চলবে,,,,,,
হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৫৩.
ক্যাফেটেরিয়ায় একটা টেবিল জুড়ে পাঁচজন বসে। বহুদিন পর আবারও আড্ডা, হৈ চৈ, হাসি ঠাট্টা হবে। সূর্য এখনই টেবিলের উপর দুহাতের দু তিনটে আঙুল দিয়ে তুরি বাজিয়ে চলেছে। সেই সাথে ফিসফিস কন্ঠে বেসুরো গান গাইছে। তার গান শুনেই বন্ধুরা হাসিতে লুটিয়ে পরছে। এর মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হলো হিমি। সবার দৃষ্টি তার দিকে। কোথায় সেই আগের হিমি? এ যে পুরো পাল্টে গেছে। গায়ে নেভি ব্লু কালারের লম্বা রাউন্ড ড্রেস। কানে বড় ঝুমকা। হাতে চুড়ির সংখ্যা বেড়েছে। কোঁকড়ানো চুলগুলো খোলাই আছে। গলায় চেইন। ঠোঁটটা অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই গোলাপি ঠেকছে। ডান হাতের মুঠোয় সাদা রঙের পার্স। হাটাচলায়ও কিছু পরিবর্তন লক্ষ্যনীয় তার। ক্যাফের দরজা থেকে টেবিল পর্যন্ত আসতেই দুবার পায়ে মোচড় খেয়েছে।
-দোস্ত। আই ক্যান্ট বিলিভ। তুই, দ্যা গ্রেইট হিমি, বিয়ার পর এক্কেরে টিপিকাল বউ হইয়া গেছোচ! হাতের বেল্ট, ঘড়ির বদলে চুড়ি! গায়ে আবার মাইয়াগো কুর্তি। কানের দুল দেইখা মনে হইতাছে এহনি তোর কান লইয়া ঠাস কইরা ছিড়া যাইবো। ঠোঁটে কি দিছোত মামা? তুই কি ময়দা দিছোত?
হিমি চেয়ারে বসতে না বসতেই কথাটা বলে উঠে সূর্য। বিরক্তি নিয়ে তাকায় হিমি। টেবিলে পার্স রেখে চোখ ঝাঁপটিয়ে বলে,
-আমার চা?
ইমন হাত উচিয়ে ওয়েটারকে চা আনতে বলে। ততক্ষনে হিমি ড্রেসের ওড়না দিয়ে নিজেকে বাতাস করছে। সূর্য তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো তার দিকে। তারপর অত্যন্ত রাগি গলায় বললো,
-ওই হারামী। আমার কথার জবাব দেস না ক্যান?
-তোর কথা সম্পূর্ণ আজাইরা। শুধু শুধু এগুলোর উত্তর দিয়ে সময় নষ্ট করবো কেনো?
হেসে উঠলো দোহা, ইমন, মেঘ, সোহিনী। সূর্য বাঁকা হেসে বললো,
-মামা? তোর গলার আওয়াজও দেহি অন্যরকম লাগে। ঘটনা কি? কোনো সার্জারী করাইছিস?
-ধুর ছাই। এতো ফালতু কথা বলিস কেনো? বিয়ে হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই আমি বদলে যাবো। নতুন পরিবেশ, নতুন পরিবার সবার সাথেই খাপ খাইয়ে চলতে হবে। বড়মা বলে দিয়েছে এখন থেকে আর শার্ট প্যান্ট পরা যাবে না। বাধ্য হয়ে এইসব পরছি। এদিকে বাচ্চা ডাক্তারের মা যখন যা পারছেন এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন। প্রথমে যাও কুর্তি টুর্তি পরেছি কিন্তু এখন না কি বাইরে বেরুলে এসব ড্রেস, কামিজ পরে যেতে হবে। তার সাথে ম্যাচিং জুয়েলারি। কোনো মানে হয়?
-হয় হয়। মানে হয়। এই যে বললি না, বিয়ের পর স্বাভাবিক ভাবেই বদলে যেতে হয়। পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে চলতে হয়। তোকেও তো তাই করতে হবে হিমি।
মেঘের কথায় ফুঁসে উঠলো হিমি,
-আমি তো মানা করছি না। চেষ্টা করছি। কিন্তু ভদ্র মহিলার তাতেও আপত্তি। সম্পূর্ণ আমিটাতেই আপত্তি।
ওয়েটার চা এনে হিমির সামনে রাখলো। ইমন টেবিলে দু হাত রেখে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
-আপত্তি কিসের? এখন তো তুই ওনার কথামতো বাড়ির বউয়ের মতোই বিহেভ করছিস।
-ছাই করছি। রান্না শিখতে বলছে। আমার চুল নিয়েও ভয়াবহ সমস্যা ওনার। চুল কোঁকড়ানো কেনো? সোজা নয় কেনো? তেল দেই না কেনো? হাজারটা কথা। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের জবটাও ছেড়েছি ওনার কথায়। তারপরও থেমে নেই। বাইক চালানোয়ও আপত্তি।
-বাইক সাথে আনিস নাই? কেমনে আইলি তাইলে?
সূর্যের প্রশ্নের বিপরীতে মুখ ফুলালো হিমি। হতাশ গলায় বললো,
-গাড়িতে করে। দমবন্ধকর লাগছিলো।
দোহা হিমির হাতের উপর হাত রেখে বললো,
-মানিয়ে নিতে হবে তো। সব সময় কি আর নিজের মন মতো থাকা যায়?
-অবশ্যই যায়। চেষ্টা করলেই তা সম্ভব। তবে আপনজনদের মন রক্ষা করতে হলে তাদের কথাও একটু আধটু ভাবতে হবে। কিছুটা তাদের মতো কিছুটা নিজের মতো চললেই হলো।
হিমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
-কিন্তু সোহু উনি আমায় সম্পূর্ণ বদলাতে বলছেন। হিমি থেকে ওনার ছেলের বউ হতে বলছেন। এতসব আমি পারি না।
ইমন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললো,
-পারা উচিতও নয়। প্রত্যেকের আলাদা কুয়ালিটি থাকে। অন্যরকম পছন্দ অপছন্দ থাকে। অভ্যাস, ইচ্ছা অনিচ্ছা, ভালো লাগা মন্দ লাগা থাকে। সবকিছুই তো আর বদলে দেয়া সম্ভব নয়। হ্যা পরিস্থিতি যেমন হবে তেমন ভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু তা বলে নিজের অস্তিত্ব মিটিয়ে নতুন একটা মানুষ হয়ে যাওয়া কিছুতেই উচিত নয়। আর যদি হতেই হয় তবে সেটা নিজের জন্য হবে। অন্যকারো জন্য নয়।
দোহা মৃদু হেসে বললো,
-তোর সামনে বিয়ে না?
ইমন মাথা দুলালো। দোহা ছোট্ট নিঃশ্বাস টেনে রয়ে সয়ে বললো,
-বিয়ের পর সুপ্তি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে থাকতে পারবে? ও নিজেকে তোর জন্য তোর পরিবারের জন্য বদলাবে না?
-অফ কোর্স নট।
-ভুল বললি ইমন। সুপ্তি বদলাবে। আর ওর বদলে যাওয়ার প্রধান কারন হবে তার শ্বশুরবাড়ি।
ইমন ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মেঘ দু হাত আড়াআড়ি ভাবে টেবিলে রেখে তার উপর চিবুক রেখে বললো,
-কি করে?
-যেভাবে আমি বদলেছি। আগের আমি তোদের কাছে বোকা হাবা ছিলাম। সূর্য তো কথায় কথায় বেক্কল, গাধী বলতো। এখন আমি বোকা থাকলেও সেন্সিবল বিহেইভ করতে হয়। বাড়ির বউ বোকা হাবা থাকে না কি? বাড়িতেও শাড়ি পরে থাকতে হয়। যে আমি একসময় শাড়িতেও হোঁচট খেতাম সেই আমি চব্বিশ ঘন্টা শাড়িতেই থাকি। মা বলতেন বিয়ের পর উনি ভুলে গেছেন ওনার পছন্দের খাবার কি ছিলো। ইউ নো হুয়াট গাইজ? বিয়ের পর থেকে আজ অব্দি আমার পছন্দের খাবার ও বাড়িতে রান্না হয় নি। আমি সিনেমা দেখতে ভালোবাসি। এদিকে আমিন এসব পছন্দ করে না। টেলিভিশনে শাশুড়ির সিরিয়াল চলে, শ্বশুরের নিউজ চলে, ননদের পছন্দের শো চলে। চলে না সিনেমা। আমিন আর তার পুরো পরিবার শিক্ষিত হয়েও চায় না আমি আর পড়াশোনা করি। অনার্স শেষ হলেই পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বলেছেন মা। আমিনও তাই চাইছে।
শেষের কথাটায় আঁতকে উঠলো বন্ধুরা। সোহিনী বিস্মিত গলায় বললো,
-তুই পড়াশোনা ছেড়ে দিবি?
-হু। আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখে গেছি। আর মানিয়ে নিতে নিতে কখন যে একবারেই বদলে গেছি খেয়ালই করি নি। মাত্র কয়েক মাস বিয়ের। এখনি মনে হচ্ছে কতো যুগ কেটে গেছে আমি হাসি না, দুষ্টুমি করি না। লাফালাফি করি না। আমিনের এসব বাচ্চামো পছন্দ নয়। আমি ভেবেছিলাম ও ভীষন হাস্যরসিক। কিন্তু না। ও খুব গম্ভীর। সবাই সেটা বুঝে না। জানিস তো, ওবাড়িতে আমার আর কথা বলা হয় না। সবাই কেমন চুপচাপ। গুমোট ধরা। আমিও চুপ করেই থাকি। তোদের ছাড়া আর কারো সামনে কথা বলতেও ইচ্ছে করে না। আমি বদলে গেছি। ভবিষ্যতে আরো বদলাবো। একটা কথাই খালি ভাবছি। পুরোদমে সংসারী হয়ে গেলে আর তোদের সাথে দেখা হবে না, না?
………………………………
-আন্টি? মামু ফোন করেছিলেন। মিশ্মি, আমার মামাতো বোন, ওর বিয়ে। আমাদের বিয়ের দাওয়াত দিয়েছেন। চাইছেন আমি আর বাচ্চা ডাক্তার যেনো কদিন আগেই যাই।
মায়মুনা জামান হাদিসের বই পড়ছিলেন। চশমার উপর দিয়েই তাকালেন হিমির দিকে। বই বন্ধ করে সোজা হয়ে বসলেন। পা দুটো তখনও খাটে বিছিয়ে রাখা। শীতল গলায় বললেন,
-তোমার জ্যাঠু না বললেন তোমার চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে?
-হ্যা। আসলে, মামাতো বোনের বিয়ে চাচাতো ভাইয়ের সাথেই হচ্ছে।
ক্ষীণ গলায় বলে উঠেন মায়মুনা,
-কবে বিয়ে? আর দাওয়াত তোমার হাতে পাঠাচ্ছে কেনো? নিজে এসে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দিয়ে যেতে পারছে না?
হিমি আমতা আমতা করে বলে,
-না মানে বলবেন তো। ওনারাই আসবেন। এখন শুধু আমাদের যেতে বলছেন। মানে আমাকে আর বাচ্চা ডাক্তারকে।
মায়মুনা জামান কপাল কুঁচকালেন। বললেন,
-বাচ্চা ডাক্তার! আবার? তোমাকে না বলেছি আমার ছেলেকে বাচ্চা ডাক্তার বলে না ডাকতে! তারপরও ডাকছো?
জিব কাটলো হিমি,
-সরি আন্টি।
-আন্টি? আমি তোমার আন্টি? আমার ছেলে বাচ্চা ডাক্তার? কি সমস্যা তোমার মেয়ে?
কথা বলতে বলতেই খাট থেকে নামলেন মায়মুনা। হিমির দিকে এগুতেই পিছিয়ে গেলো সে। জড়সড় হয়ে বললো,
-সরি সরি। শাশুড়ি মা।
মায়মুনা কয়েক মুহুর্ত স্থির দৃষ্টিতে দেখলেন হিমিকে। তারপর বললেন,
-আর আমার ছেলে?
-আপনার ছেলে তো আপনারই ছেলে।
-সেটা নয়। আমার ছেলে তোমার কে হয়?
হিমি চোখ নামিয়ে অস্থিরতা প্রকাশ করছে। মায়মুনা জেদ ধরা গলায় বললেন,
-কে হয়?
-আমার স্বামী।
-তাহলে অদ্ভুত নামে ডাকো কেনো?
-অদ্ভুত না তো। উনি ডাক্তার। তাও আবার চাইল্ড স্পেশালিস্ট। তাই বাচ্চা ডাক্তার বলে ডাকি।
-আজ থেকে ডাকবে না।
-ডাকবো না?
-না। ডাকতে হলে নাম ধরে ডাকবে।
হিমি মিন মিন করে বললো,
-ডাক্তার সাহেব বলে ডাকতে পারি?
মায়মুনা ঝট করে জবাব দিলেন,
-না। তুমি ওর পেশেন্ট? না পেশেন্টের আত্মীয় যে ডাক্তার সাহেব বলে ডাকবে? তাহিরের সাথে তোমার সম্পর্ক স্বামী স্ত্রীর। তাহির বলে ডাকতে না পারলে ওগো, হেগো, এই যে, শুনছেন এসব বলবে। আর তাও না পারলে বাচ্চার নাম ঠিক করে এর বাবা ওর বাবা বলে ডাকো।
হিমি বিষম খেলো। মায়মুনা চোখ মুখ কুঁচকালেন। বললেন,
-কাঁশছো কেনো? বিয়ে যখন হয়েছে বাচ্চা তো হবে। আগে থেকে বাচ্চাদের নাম ঠিক করে রাখো। স্বামীকে ডাকতেও অসুবিধা হবে না আর মনেও থাকবে ও তোমার স্বামী।
-বাচ্চাদের?
-হ্যা বাচ্চাদের। এখন যাও। কাল চা বানানো শিখিয়েছিলাম। মনে আছে?
হিমি মনে মনে কিছু একটা ভেবে বললো,
-হুম।
-এখন আমার জন্য এক কাপ চা বানাও। নিজের জন্য বানাবে না। তাহির, হৃদি এদেরকেও দেবে না। আমি চাই না এই অল্প বয়সে চা খাওয়ার অভ্যাস করে শরীর স্বাস্থ্য নষ্ট করো।
হিমি বলতে চাইলো, ‘আমি চা খাই। অনেক আগে থেকেই খাই। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন এই অভ্যাস পাল্টানো যাবে না। গেলেও আমি পাল্টাবো না।’ কিন্তু বললো না। সব কথা বলতে নেই। বললে হয়তো বকা খাবে। নয়তো রাগ করবেন শাশুড়ি। হিমি তাই মনের কথাটা মনেই চেপে রেখে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো। মাথায় অতিরিক্ত তেল দেয়ায় চুলগুলো আঠালো হয়ে আছে। চপচপে লাগছে। বিরক্ত লাগছে তার। কিন্তু এবারও কিছু বলতে পারছে না। সাবধানে ধীরে স্থিরে চা বানিয়ে মায়মুনার ঘরে ঢুকলো হিমি। মায়মুনা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হিমির থেকে জানতে চাইলেন কি করে বানিয়েছে চা। কি কি উপকরণ দিয়েছে। হিমিও যথাযথ জবাব দিয়ে গেছে। চা ভালো হয়েছে বুঝতে পেরেই চায়ে চুমুক বসালেন মায়মুনা। সাথে সাথে মুখ বাঁকালেন। বললেন,
-চিনি দিয়েছো কেনো? আমি চিনি খাই না। জানো না?
-সরি শাশুড়ি মা। আবার বানাবো?
-আর দরকার নেই। ঘরে যাও। গোছগাছ করো। কাল বিকেলে যেও তোমার মামার বাড়ি। উনি ফোন করেছিলেন একটু আগে। তাহিরকে বলে দিও হাসপাতালের ডিউটি শেষে জেনো ওবাড়ি যায়।
চলবে,,,,,,,,,,
হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৫৪.
বিকেলের শিথিল পরিবেশে উৎসবের উত্তেজনা, উদ্বেগ বেড়ে দ্বিগুন। গেস্ট রুম আর আউট হাউজ দুটোই আত্মীয় পরিজনে পরিপূর্ণ। নিচতলার বড় কক্ষে গানের আসর বসেছে। কয়েকজন উচ্চস্বরে গান গাইছে। তাদের মাঝখানে স্থির হয়ে বসে আছে মিশ্মি। চেহারায় হতাশা না কি লজ্জা ঠিক ধরা যাচ্ছে না। গায়ের রঙ আগের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল হয়েছে। সেই সাথে জড়তা ঘিরে ধরেছে তাকে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। ক্ষনে ক্ষনেই সবার হাসি ঠাট্টায় অসার হয়ে আসছে শরীর।
অথৈ হিমি আর তাহিরকে নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকতে গেলো। সেও এসেছে দুদিন হলো। ইয়াসির হলুদের দিন সকালে আসবে। এতে অবশ্য কোনো রাগ নেই অথৈর। সে দিব্যি লম্পঝম্প করছে। খুশি যেনো ধরছেই না তার। মিশ্মির বিয়ে। সেই ছোটবেলার খেলার সাথি পিচ্চি বোনটার বিয়ে। ভাবতেই ভীষন অবাক অবাক লাগছে তার। শিহরণ বয়ে যাচ্ছে শরীরে। অযথাই হাসছে। খুশি হচ্ছে। তার এই খুশিতেই যেনো মিশ্মির হৃদয়ের ক্ষত দ্বিগুন হচ্ছে। আফসোস সেই ক্ষত কারো নজরে পরে না।
-হিমিপু? আসবো?
দরজার বাইরে অথৈর গলা পেয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো হিমি। ক্লান্ত গলায় বললো,
-আয়।
অথৈ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। হিমিকে কাঁথা জড়িয়ে থাকতে দেখে কৌতুহলী গলায় বললো,
-তুমি এসময় কাঁথা গায়ে দিয়ে কেনো? ঘুমাচ্ছিলে?
হিমি মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। চোখ টানটান করে বললো,
-মাথা ব্যাথা করছিলো। তাই একটু শুয়েছিলাম। কিছু বলবি?
-চা নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিলাম। এসো।
-ইচ্ছে করছে না অথৈ।
-ইচ্ছে করছে না বললে তো হবে না। বিয়ে বাড়িতে এসে এভাবে গুম ধরে বসে থাকলে চলে? চা খেলেই মাথা ব্যথা সেড়ে যাবে। আচ্ছা, বাইরে না যেতে চাইলে এখানে এনে দেই?
হিমি কিছু একটা ভেবে বললো,
-মামু ফিরেছে?
-এখন ফিরবে।
-আসছি তাহলে।
অথৈ মাথা দুলিয়ে ঠোঁট চওড়া করলো। যেতে গিয়েও পেছন ফিরে আশপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,
-দুলাভাই কোথায়?
হিমি হাই তুলতে তুলতে নিচে নামলো। কাপড় ঠিক করতে করতে বললো,
-ফোন এসেছিলো একটু আগে। নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলেন না তাই বোধ হয় বাইরে গেছেন। দেখছি আমি।
__________________
বসার ঘরে হলুদ আর বিয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিলো। এমন সময় সদর দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢোকলেন হানিফ শরীফ। হিমি মামুকে দেখেই ঝট করে দাঁড়িয়ে গেলো। উচ্ছল গলায় বললো,
-মামু?
হানিফ শরীফ কারো সাথে কথা বলছিলেন। কথায় এতোই মগ্ন ছিলেন যে বসার ঘরের কারো দিকেই নজর যায় নি। হিমির গলা কানে আসতেই চমকে সেদিকে তাকালেন তিনি। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ঠোঁটে ফুটলো হাসি। হাসি হাসি মুখে বললেন,
-হিমি মা! কেমন আছিস?
হিমি দ্রুত পা ফেলে হানিফ শরীফের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো। কাঁধ ঝাঁকিয়ে হেসে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। তিনিও একহাতে জড়িয়ে নিলেন ভাগ্নীকে। সিঙ্গেল সিটেড সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম জানালো তাহির। হানিফ শরীফ এবার তাহিরের দিকে তাকালেন। সালামের জবাব দিতে দিতে হিমিকে জড়িয়ে রেখেই কয়েক কদম এগুলেন। বললেন,
-কেমন আছো বাবা? তোমার মা কেমন আছেন?
-জি আলহামদুলিল্লাহ।
-তোমরা এসেছো দেখে আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে বলে বুঝাতো পারবো না।
কথাগুলো বলতে বলতে ঘাড় কাত করে হিমির দিকে দেখলেন তিনি। হিমি সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হানিফ শরীফ বললেন,
-এ কি কান্ড করেছো জামাই? আমাদের মেয়ে যে পুরো চেঞ্জ। মাশা আল্লাহ। সেই ছোটবেলায় ফ্রক, স্কার্ট পরে ঘুরতো। তারপর আজ এতোবছর পর এমন ভাবে দেখছি। হা হা, এই মিরাকল কি করে হলো?
তাহির কিছু বললো না। মৃদু হেসে চুপ করে রইলো। হিমি মুখ বাঁকালো,
-এখনো তো কিছুই দেখো নি। মিশুর বিয়েতে দেখো।
-মিশুর বিয়েতে! মিশুর বিয়েতে কি দেখবো?
-সেটা তো সারপ্রাইজ। এখন বলা যাবে না। শুধু বলতে পারি মিশুর বিয়েতে আমার দেয়া সারপ্রাইজ দেখে তোমাদের মাথা ঘুরে যাবে।
হানিফ শরীফ নিঃশব্দে হাসলেন। হিমির মাথায় আলতো করে ডান হাত বুলিয়ে বললেন,
-আচ্ছা।
…………………………
আমিনা বেগম একাই সব দিক সামলাচ্ছেন। রাদিবা বিয়ের কোনো কাজে হাত দেবেন না বলে অনেক আগেই জানিয়েছিলেন। সবার ধারনা ছিলো কথার কথা বলেছেন। বিয়ের সময় হলে এমনিতেই নিজ থেকে সব করবেন। যতোই হোক ছেলের বিয়ে। কিন্তু রাদিবা কথার কথা বলেন নি বরং প্রতিজ্ঞা করে বসে আছেন। বাড়ি ভর্তি মেহমান রেখে তিনি নিজের ঘরে বসে আছেন। কখনো যাও বা ঘরের বাইরে পা রাখছেন তাও নিজ দরকারে। হয় রান্নাঘরে চা জ্বাল দিচ্ছেন নয়তো শ্বশুরকে ঔষধ পত্র দিচ্ছেন। বিয়ে বাড়ির কাজের চাপে আমিনা শ্বশুরের দেখভাল করতে পারছেন না। শ্বশুরের দেখাভালের পুরো দায়িত্ব প্রথমবারের মতো রাদিবার ঘাড়ে। এতে রাদিবা কিছুটা গর্ব অনুভব করছেন।
-ছোট বউমা? বলি কি, ভুলে যাও। রাগ, অভিমান সব ছেড়ে দাও। ছেলে তো তোমারই। ওর মনে কষ্ট দিও না। মাকে কষ্ট দিয়ে কোনো সন্তান ভালো থাকে না। তোমার অভিশাপ লেগে যাতে পারে।
রাদিবা ঔষধের শিশি থেকে বড়ি বের করতে গিয়ে থেমে গেলেন। কিছুক্ষন স্তব্ধ থেকে বললেন,
-আমি কাউকে অভিশাপ দিচ্ছি না বাবা।
-তুমি দিচ্ছো না কিন্তু তোমার এই অভিমান, রাগ, কষ্ট সব যে তোমার ছেলের উপর দিয়ে যাবে না তা কি করে বলতে পারো? নিহানের বৈবাহিক জীবনে প্রভাব ফেলবে এসব। এমনটা করো না। এখানে কারো কোনো দোষ নেই বউমা। যদি থেকেও থাকে তবে সেটা আমার। তুমি আমার উপর রাগ করো। তবুও এভাবে সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখো না।
রাদিবা বড়ি দুটো বের করে মতিউর রহমানের হাতে দিলেন। কাঁচের গ্লাসে পানি ঢেলে পরিপূর্ণ করে বললেন,
-আমি এসবে হাত না লাগালেও কিছু আটকাবে না। আপা আছেন। বড় ভাই, মুহিব ভাই, আপনার ছোট ছেলে সবাই আছেন। ওনারা সব সামলাতে পারবেন। আমি রাগ করিনি।
কথা শেষ করে পানি এগিয়ে দিলেন মতিউর রহমানের দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে পানির গ্লাস উঠিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালেন মতিউর রহমান। দু ঢোক পানি খেয়ে রাদিবার হাতে দিলেন গ্লাস। ঘন ঘন শ্বাস টেনে বললেন,
-সামলাতে তো যে কেউ পারবে। সেটা কথা নয়। কথা হচ্ছে বিয়েটা তোমার ছেলের। বিয়ে একবারই হয়। প্রত্যেক মানুষের যেমন নিজের বিয়ে নিয়ে ভাবনা চিন্তা থাকে তেমনি প্রত্যেক বাবা মায়ের নিজ সন্তানের বিয়ে নিয়ে আকাঙ্খা থাকে। আমি জানি তোমারও আছে। কেনো এসব বলি দিচ্ছো? পরে আফসোস হবে।
রাদিবা মুখ ঘুরালেন। মশারি টানানোয় ব্যস্ত হয়ে চোখের পানি আড়াল করলেন। মতিউর রহমান ভুল বলেন নি। রাদিবার ছেলের বিয়ে নিয়ে আকাঙ্খা ছিলো। ইচ্ছে ছিলো। একমাত্র সন্তান। তার বিয়ে কি যেমন তেমন হলে চলে? ধুমধাম হবে বিয়েতে। দূর দূরান্ত থেকে আত্মীয় আসবে। এক মাস ব্যাপী কেনাকাটা, প্ল্যানিং চলবে। বউ হবে রাদিবার নিজের পছন্দের। বিয়ের যাবতীয় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, আয়োজন সব রাদিবা করবেন। নাচ, গান, হৈ হুল্লোর হবে। ছেলের বউকে দেখে তাক লেগে যাবে সবাই। গর্ব হবে রাদিবার। ছেলে বউ ঘরে আসবে। বরণ উনিই করবেন। সবকিছুই উনি করবেন। কোথায় গেলো সেসব পরিকল্পনা, স্বপ্ন, আকাঙ্খা? কোথায় সেই খুশি রাদিবার? নেই। কিচ্ছুটি নেই। ভাবতে ভাবতেই নিজেকে শক্ত করলেন রাদিবা। তিনি যে রেগে আছেন এবং বিয়েতে কোনো প্রকার মত দেন নি তাই বোঝানোর চেষ্টা করছেন। সমস্যা হলো মতিউর রহমান ছাড়া আর কেউ ওনার এই রাগ ধরতে পারছে না। রাগকে জেদ ভেবে বসে আছেন সবাই। মতিউর রহমান যেভাবে তাকে বিয়ের কাজে হাত লাগাতে বলছেন আর কেউ বলছে না। ভাবসাব এমন, ‘করলে করো না করলে নাই। আমরা আছি। তোমার এখানে কোনো রাগ, জেদ খাটবে না। সংসারে তোমার স্থান নগন্য!’
……………………………
রাত নটা। বসার ঘরে মোজাম্মেল সাহেব লিস্ট করছেন। ডেকোরেটোরের লোকগুলো ভীষন পাঁজি। ঠিকমতো সাজাচ্ছে না। প্লাস্টিকের গোলাপ না এনে অন্য আরেক ফুল নিয়ে এসেছে। এবং কাউকে কিছু না জানিয়ে নিজেদের মতো করেই সাজাচ্ছে। আশ্চর্য, বিয়েটা কি ওদের? মোজাম্মেল সাহেব আবারও সব ফুল ছুটিয়িছেন ওদের দ্বারা। সেই সাথে আরো হরেক রকম ফুল, ডেকোরেশনের সামগ্রী আনাচ্ছেন। ওনার মতে পুরো বাড়ি লাল রঙের ফুল দিয়ে সাজানো উচিত। লাল গোলাপের সাথে সাদা গোলাপ। লাল সাদার কম্বিনেশন বরাবরই ভালো লাগে ওনার। কিন্তু বাধ সাধছেন আমিনা। ওনার মতে লাল সাদা গোলাপ শুধু নিহানের শোবার ঘর সাজানোর কাজে ব্যবহার হবে। তাও প্লাস্টিকের না। আসল, সতেজ ফুল। বাকি কোনো ঘর সাজানোর দরকার নেই। বাড়ির বাইরেটা সুন্দর করে লাইটিং করলেই হলো। হলুদ, বিয়ে, রিসেপশন তিনটাই ক্লাবে হবে। সুতরাং শুধু শুধু ফুল দিয়ে ঘর ভরে লাভ নেই। তারউপর প্লাস্টিকের ফুল। না সুগন্ধ আর না প্রয়োজন। অযথাই আবর্জনা। এ নিয়ে বার কয়েক কথা কাটাকাটি হওয়ার পর হার মেনেছেন আমিনা। রাগে গজগজ করতে করতে বসার ঘর ত্যাগ করেছেন। মুহিব রহমান ক্যাটারিং সামলাচ্ছেন। যদিও হলুদের অনুষ্ঠানে কি কি খাবার থাকবে সেটার লিস্ট মোজাম্মেল সাহেবই করেছেন। নেহাল রহমান অফিস থেকে ফিরে আর কাপড় পাল্টান নি। হাত মুখ ধুয়ে চা নিয়ে বসেছেন। সবার কাজ দেখছেন। পাশের ঘর থেকে হাসাহাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নিহানের মামাতো ভাই বোনেরা নিহানকে নিয়েই পাশের ঘরটায় জটলা পাকিয়েছে। নাচ প্র্যাক্টিস করছে। হলুদ সন্ধ্যায় তাদের খাস পারফর্মেন্স আছে। গোপন তথ্যে জানা গেছে কনে পক্ষ ভয়াবহ কোনো প্ল্যান করছে। নিহানের ধারনা তারা ডান্স পারফর্ম করেই বাজিমাত করতে চাইছে। মিশ্মির কাজিনদের মধ্যে দুজন আবার অসাধারন নাচে। তাদের টেক্কা দিতেই বরপক্ষের এতো আয়োজন।
দু বাড়িতেই হুলুস্থুল চলছে। কাল গায়ে হলুদ। পরদিন বিয়ে। একদিকে নিহান তার ভালোবাসা পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা। অপরদিকে মিশ্মি তার ভালোবাসা হারিয়ে পাগল প্রায়। কোনো আনন্দ, উচ্ছাস স্পর্শ করছে না তাকে। সব যেনো ফ্যাকাসে।
চলবে,,,,,,,,,