হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
০৪.
হাসপাতালের করিডোরে অপেক্ষার প্রহর গুনছে হিমি আর তার বন্ধুরা। সবার মাথায় আগুন জ্বলছে। একটা ছেলের কথা ভেবে বান্ধবী মরতে বসেছে এতে সোহিনীর উপরও রাগ লাগছে তাদের। সোহিনী অজস্র রোগীর মাঝে একটা বেডে শুয়ে আছে। হাতে রক্তের নল, অন্যহাতে ব্যান্ডেজ। এখনো অজ্ঞান সে। দরজার বাইরে বেঞ্চে বসে আছে দোহা। চোখের জ্বল শুকিয়েছে সেই কখন। এখনো ফুঁপাচ্ছে সে। ইমন দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ, হিমি, সূর্য পুরোদমে পায়চারি করছে। পা যেনো থামছেই না তাদের। এই মুহুর্তে ছেলেটাকে হাতে পেলে যাচ্ছে তাই করতে পারে তারা। বয়ফ্রেন্ডের নাম্বার খুঁজতে গিয়ে ডায়েরি ভর্তি সোহিনীর হৃদয়বিদারক গল্প পড়েছে হিমি। মেয়েটা কালো বলে এভাবে অপমান করবে? তাও আবার যে কি না দেড় বছর ধরে তাকে ভালোবেসে পাগল! বিশ্বাস হয় না হিমির। ছেলেটা নিশ্চয় আগে থেকে ছক কষে রেখেছিলো। প্রেমের নাটক করেছিলো, বাস্তবে কখনোই ভালোবাসে নি তাকে। ভাবনার মাঝেই করিডোরে ঢোকে ডাক্তার তাহির। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে হিমিদের দিকে তাকায় সে। আবারও সেই কোঁকড়ানো চুলের মায়াবিনী! তাহির তাড়াতাড়ি চোখ ফেরায়। আবারও তাকায়। মেয়েটার দিকে তাকালে কেমন ঘোর লেগে যায় যেনো! কারো ধাক্কায় সম্বিৎ ফিরে তার। গলা কেশে এগোয় সামনের দিকে। ধীর কন্ঠে বলে,
“এক্সকিউজমি?”
হিমি ভ্রু কুঁচকায়। এই ডাক্তারের এখানে কি কাজ? এখানেও চিকিৎসা টিকিৎসা করে না কি লোকটা? হতে পারে। তাহির আবারও ডেকে উঠে। হিমি বিরক্তি নিয়ে বলে,
“কি চাই?”
“কিছুক্ষন আগে কেউ একজন কল করেছিলো আমাকে।”
তাহিরের কথার মাঝেই বলে উঠে ইমন,
“তো? আপনারে কে কল দিছে না দিছে সেইটা জেনে আমাদের কি কাম?”
তাহির মৃদু গলায় বলে,
“আসলে, কে কল করেছিলেন বলতে পারছি না তাই জিজ্ঞেস করছি আপনাদের মধ্যে কেউ কল করেছিলেন কি না!”
এবার গর্জে উঠলো সূর্য,
“আজিব মানুষ! আপনারে চিনিই না তাইলে কল কেমনে করমু? আর কেনোই বা করমু ভাই? এই তোরা চিনোস লোকটারে?”
মেঘ একপলক দেখে চোখ ফিরিয়ে বেডে শুয়ে থাকা সোহিনীর দিকে তাকালো। ইমন কিছু না বলে আগের মতো দেয়ালে ঠেস দিলো। দোহা উঠে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কিছু বলতে নিলে ধমকে উঠলো সূর্য,
“ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাইন্দা তুই স্বর্গে যাইবি? বেদ্দপ! বন্ধ কর মরা কান্না। এই কেবিনের সব রোগী তোর কান্না শুইনাই মইরা যাইবো। দোস্ত, চিনোস এরে?”
শেষের কথাটা হিমির উদ্দেশ্যে ছিলো। হিমি মাথা নাড়লো। সূর্য তটস্থ হলো এবার। হিমি বললো,
“ভুলে গেলি? সেদিনের ডাক্তার। ওই যে মফিজ না কি যেনো নাম লোকটার? হাসপাতালে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন উনিই নার্সকে বকাঝকা করছিলেন।”
তাহিরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
“কিন্তু আপনার নাম্বার তো আমি আনি নি। তাহলে কল করার প্রশ্নই উঠে না। অন্যকেউ হয়তো কল করেছিলো।”
তাহির মাথা নেড়ে চলে যেতে নিলে ওয়ার্ড বয়ের সামনা সামনি হয়। কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“একটা সুইসাইড কেইস। বন্ধুরা নিয়ে এসেছে মেয়েটাকে। তাদের মধ্যে একজনের নাম মেই বি হিমি! এই রুমেই?”
তাহিরের কথা শেষ হতে দেরি মেঘের তার কলার ধরতে দেরি হয় নি। এক হেঁচকা টানে তাহিরকে নিজের সামনে দাঁড় করালো মেঘ। দু হাতে টি শার্টের গলার দিক টেনে ধরে রক্তলাল চোখে তাকিয়েই বলে উঠলো,
“শালা, ****! তোর সাহস কি করে হলো ওরে ধোকা দেয়ার? কালো? ও কালো? আগে মনে ছিলো না? সোহিনী তোর কাছে গিয়েছিলো ভালোবাসার দাবি নিয়ে? তুই আসছিলি? কেনো? কেনো আসছিলি তখন? বিয়ে করবি না না! দেখি কেমনে বিয়ে না করে থাকিস! একবার, একবার খালি ওরে উঠতে দে এই হাসপাতালেই তোদের বিয়ে দেবো। বাপ মা না মানলে নাই। আর যদি ত্যারাব্যারা করিস তাইলে তুই শেষ!”
হিমিরা মেঘের হাত টেনে ধরে আছে। সূর্য পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে টানছে মেঘকে। অথচ তার হাত তাহিরের টি শার্ট থেকে সড়ছে না। তাহির কিছু বলতেও পারছে না। গলায় কথাগুলো আটকে গেছে। আমতা আমতা করে শুধু এতটুকুই বললো,
“আপনি যার কথা বলছেন আমি সে নই মিস্টার।”
হিমিও জোড় গলায় বললো,
“মেঘ? এই লোকটা সেই লোক নয়। ছার!”
মেঘের হাত হালকা হলো। ঘাড় ঘুরিয়ে হিমির দিকে তাকালো। হিমি চোখের ইশারায় তাকে শান্ত হতে বলায় তাহিরকে ছেড়ে দিলো সে। হিমি তাড়াহুড়া করে বললো,
“আমি ওই ছেলেটাকে দেখেছি।”
মেঘ গোল গোল চোখ করে তাকালো। বললো,
“কবে? কখন?”
“অনেক আগে একবার দেখা হয়েছিলো আমাদের। সোহিনী আর তার বয়ফ্রেন্ড রিকশায় কোথাও যাচ্ছিলো। তখনই দেখি।”
সূর্য সন্দিহান হয়ে বললো,
“তুই শিওর যাকে দেখেছিলি সে এই লোক নয়!”
“হ্যাঁ। ইনি তো ডাক্তার। আর সোহিনী বলেছিলো ওর বফ ছোট খাট একটা চাকরি করে। সো!”
ইমন শান্ত গলায় বললো,
“তবে ইনি কেনো এসে বললেন কলের কথা? এনাকে কে কল দিলো? আর এসব জানলেন কি করে?”
তাহির টিশার্ট টেনে টুনে ঠিক করে বললো,
“আপনাদের কল রং ডিরেকশনে চলে গেছিলো। আমাকে আপনাদের কাঙ্খিত কেউ ভেবে ধমকে আসতে বলেছিলেন।”
“আর আপনি চলে এলেন?”
দোহার প্রশ্নে ঠোঁট চওড়া করলো তাহির। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
“এমন ভাবে বলা হয়েছিলো ভেবেছিলাম ভয়ানক কিছু হয়েছে। আসল ঘটনা জানতে আর মিসআন্ডার্স্টেন্ডিং দূর করতেই তাই ছুটে এসেছি। পাশাপাশি একজন ডক্টর। কোনো সাহায্য লাগলে আই ক্যান হ্যল্প!”
সবাই মাথা দুলিয়ে যার যার জায়গায় চলে গেলো। অলসভঙ্গীতে বেডের দিকে তাকিয়ে আছে কয়েকজোড়া চোখ। দোহা হঠাৎই বলে উঠলো,
“হিমি? বদমাইশ টাকে জানাবি না সোহিনীর খবর?”
হিমি তাচ্ছিল্য হাসলো। বললো,
“নিজেই তো বলছিস বদমাইশ। বদমাইশকে এসব জানিয়ে কি লাভ? বিশ্বাসঘাতক কোথাকারের! সোহিনী সুস্থ হোক তারপর ভাববো কি করা যায়।”
তাহির হিমির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনাদের ফ্রেন্ড, সোহিনী কোথায় এখন?”
হিমি হাতের ইশারায় দেখালো। কয়েক সেকেন্ড পর বললো,
“ভীষন ইমোশনাল। দেড় বছরের সম্পর্কে ইতি টানা সহজ নয় ওর কাছে। তারউপর যাকে ভালোবাসে সে অন্যকাউকে বিয়ে করছে। শুধু করছেই না বাজে ভাবে অপমান করেছে মেয়েটাকে। সব সহ্য করা যায় ডাক্তার, অপমান, আর প্রিয়জনের অবহেলা সহ্য করা যায় না। প্রিয়জনের কথার তীর বুকে গিয়ে বিধলে তা শুধুই রক্তক্ষরণ বাড়ায়। সোহিনী ভেতরের রক্তক্ষরণ থামাতে গিয়ে বাইরে রক্তক্ষরণ করলো। হাতের রগ কেটে দিয়েছে। কি সাহস দেখেছেন? ভাগ্য খারাপ থাকলে যা হয়! আমরা বাঁচিয়ে নিলাম।”
এতক্ষনের কথায় তাহির কষ্ট অনুভূত করলেও শেষের কথায় চমকালো। চমকে ওঠা কন্ঠেই বললো,
“বাঁচিয়ে নিলেন বলে ভাগ্য খারাপ?”
“অবশ্যই! ও তো মরতে চাইছিলো। পারলো না। এটা কি ভালো হলো? যেহেতু ভালো হলো না তাই ভাগ্য খারাপ বলাটাই শ্রেয়।”
তাহির হিমির বলা কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করলো। এর মধ্যেই হিমি ধরফরিয়ে উঠে দৌড় লাগালো সোহিনীর বেডের দিকে। বন্ধুরা সবাই হিমির কাজের পেছনে কারন ঠাহর করতে পারলো না। তবুও তার পিছু নিলো। তাহির কৌতুহল হয়ে ধীর পায়ে এগুলো। সোহিনীর জ্ঞান ফিরেছে। সবে চোখ মেলে তাকিয়েছিলো। হিমি ওতো দূর থেকেও স্পষ্ট দেখে নিলো তার নড়াচড়া। দৌড়ে এসেই ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো বাম গালে। সোহিনী সহ বাকিরাও ভড়কালো।
“বেঁচে আছিস।”
হিমির থাপ্পড় খেয়ে সোহিনী এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো। হয়তো বুঝে উঠতে পারছে না সে কোথায়! তবে এবার বুঝলো। হিমির কথায় ঢোক গিললো সে। কাঁদো কাঁদো গলায় হিমি নামটা উচ্চারণ করতে গেলে অন্যগালেও চড় পরে তার। এবারের চড়টা মেরেছে মেঘ। বেচারি ফুঁপিয়ে উঠলো। দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরলো কানের পাশ দিয়ে। দোহা এগিয়ে এসে উঠে বসতে সাহায্য করলো সোহিনীকে।
“আফসোস হচ্ছে দোস্ত? মরতে পারলি না বলে আফসোস হচ্ছ?”
হিমির দাঁতে দাঁত চেপে কথা বলায় ভয় পেলো সোহিনী। ঢোক গিলে বললো,
“পানি খাবো।”
সূর্য দাঁত কেলিয়ে স্টুলে বসে বললো,
“পানি? না, ঐটা খাওয়া যাবে না। তোরে বরং এক গ্লাস বিষ দেই। খা। খেয়ে চটপট মরে যা। তোরে মাটি দিয়া আমরাও ঘুমামু।”
সোহিনী অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো সূর্যের দিকে। ইমন সূর্যের কাধে হাত রেখে বললো,
“কি যে বলিস মামা! বিষ খেয়ে মরায় অনেক প্যারা। এক কাজ করা যায় বুঝলি, ওরে ঝুলাই দেই! মাথার উপরে দেখ কি সুন্দর ফ্যান ঘুরতাছে! ওইটাতে ঝুলাই রাখা যাবে। আরামসে বাঁচার চেষ্টা করতে করতে মরে যাবি।”
কথাটা বলেই ভ্রু নাচালো সে। মেঘ হাত টানটান করে বললো,
“এর থেকেও ভালো উপায় আছে। আমি ওর গলা টিপে ধরে মেরে ফেলি। কাতরাতে কাতরাতে মরবো। কি বলিস সোহু। মরবি আমার হাতে?”
সোহিনী দোহার গায়ের সাথে লেগে পরে একদম। মেঘ সোহিনীর দিকে ঝুঁকে বলে,
“ওহ তুমি বন্ধু দোহার হাতে মরতে চাও! দোহা, বালিশ চেপে ধর ওর মুখে। হিমি হাত পা আটকাতো। সবাই মিলে আল্লাহর নাম নিয়া শয়তান মারি চলো। কি রে ভয় পাস কেন? মরবি না? কবরে অনেক শান্তি পাবি দোস্ত। অন্ধকার মাটির ঘর, আহা আরাম! কি রে শুরু কর তোরা!”
সোহিনী কাঁদতে লাগলো। ধীরে ধীরে গলার আওয়াজ বাড়তে লাগলো তার। বন্ধুরা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। শান্ত চোখে সোহিনীকে দেখছে। তাকে থামাচ্ছে না। হিমি লম্বা শ্বাস টেনে নিলো। সোহিনীকে কাঁদতে দেখে কিছুটা শান্তি পেলো এবার। তারা জানে সোহিনী আবেগী হয়েই কান্ডটা ঘটিয়েছে। তাকে বুঝানো প্রয়োজন ছিলো মৃত্যু এতো সোজা নয়। এতো শান্তির নয়। চাইলেই সব পাওয়া যায় না আর না পাওয়ার জন্য হন্নে যাওয়া উচিত। তাকে বুঝাতে গিয়েও এতো কথা বলতে হয়েছে তাদের। মেয়েটা কাঁদছে। হাউমাউ করে নয় তবে কাঁদছে। চোখের পানির সাথে সাথে বুকের ভেতরের পাথরটা নামছে একটু একটু করে। একজন ডাক্তার হিসেবে তাহিরের উচিত তাকে আটকানো। এভাবে কান্নাকাটি করলে সে আরো অসুস্থ হয়ে পরবে। কিন্তু তাহির তা করছে না। কক্ষে থাকা বাকি রোগীরা খুব বিরক্ত হচ্ছেন এতে। একজন নার্স এগিয়ে এসেছে। সোহিনীকে শান্ত হতে বলে পাল্স, প্র্যাশার চেইক করলো সে। বন্ধুরা সান্তনা দিলো না সোহিনীকে। কিছু সময়ের ব্যবধানে নিজ থেকেই শান্ত হলো সোহিনী। দোহা পানির বোতল এগিয়ে দিলো। দু ঢোক পানি খেয়ে বোতলের ছিপি বন্ধ করে দোহার হাত ধরেই বালিশে মাথা রাখলো সোহিনী। তাহির কিছুক্ষনের জন্য আৎকে উঠেছিলো। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ওঠা এক ব্যক্তিকে এভাবে কেউ বলতে পারে তা তার ধারনার বাইরে ছিলো। তাও একসাথে এতোজন! মেরে ফেলার কথা এতো সহজে কি করে বলে ফেললো এই ছেলে মেয়েগুলো? তাহির ভেবে পায় না। বেশি ভাবেও না। হাসপাতালের দেয়াল ঘড়িতে দুটো বেজেছে। ঘড়িটা কি নষ্ট? হতে পারে। জেনে কাজ নেই। তাহিরের এখন বাড়ি ফেরা উচিত। যা জানার ছিলো জানা হয়ে গেছে, যা জানানোর ছিলো জানানোও হয়েছে। শুধু শুধু এখানে থাকার কোনো মানে হয় না। তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দেয়া উচিত।
চলবে,,,,,,,,,,
হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
০৫.
একছুটে হিমির জন্য বরাদ্যকৃত ঘরে এসে ঢোকে অথৈ। হিমি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। অথৈয়ের এমন হঠাৎ আগমনে চমকে উঠলো সে। অথৈ হাঁপাচ্ছে। চোখে মুখে ক্লান্তি, অসহায়ত্ব। বেনি করা চুলের অনেকাংশ খোলে গেছে। হাত গালে গলায় লেগে থাকা চুল সরালো সে। নীল রঙা আয়রণ করা জামার ভাজ ভেঙে কুঁচকে গেছে। হিমি কিছু বললো না। খুব ভালোভাবে নিরক্ষন করলো অথৈকে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে খাটের কোনায় এসে বসলো অথৈ। হিমি তাকে অনুসরন করে কাছে এসে দাঁড়ালো।
“আমি বিয়ে করবো না হিমি আপু।”
হিমি গোল গোল চোখে তাকালো। অথৈ তাড়াহুড়া করে বললো,
“কাউকে বলো না প্লীজ। আমি শুধু তোমাকেই বলছি।”
হিমির চটজলদি প্রশ্ন,
“আমায় কেনো বলছিস?”
“তুমি ছাড়া আর কে আছে বলো? এ বাড়িতে একমাত্র তুমিই যে আমাকে বুঝো। প্লীজ।”
হিমি হাই তুলে হাত টানটান করে বসে বললো,
“পাম দেয়া বন্ধ কর। বিয়েতে আপত্তি কি সেটা বল!”
অথৈ জবাব দেয় না। মাথা নুইয়ে হিমির প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে। হিমি বিরক্তি নিয়ে আবারও প্রশ্ন করে। অথৈ উত্তর না দিয়ে অসহায় কন্ঠে বলতে থাকে,
“প্লীজ বাঁচিয়ে দাও আমায়। আমি এই বিয়ে করবো না।”
হিমি কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে। বলে,
“বাঁচিয়ে দাও মানে? বিয়েটা কি কোনো মৃত্যু খাদ না কি? যে তুই মরে যাবি!”
“তুমি বুঝছো না আপু। আমি এই বিয়ে করবো না।”
“এই বিয়ে?” (এক ভ্রু উচিয়ে)
অথৈ ঢোক গিলে। হিমি রাগি গলায় বলে,
“এই বিয়েতে কি সমস্যা তোর? বার বার এই বিয়ে এই বিয়ে করছিস কেনো?”
অথৈ আমতা আমতা করে বললো,
“আমি ওতসত জানি না। তুমি হয় বিয়েটা আটকাও নয় ভেঙে দাও।”
হিমি সন্দিহান গলায় বললো,
“তুই অন্যকাউকে ভালোবাসিস? না কি ছেলে পছন্দ হয় নি?”
অথৈ ঝট করে বলে দিলো,
“আরে ধুর! ছেলেটাকেই তো দেখি নি। বিয়ে কি করে করি? তোমাকে যা বলছি করো না! ভেস্তে দাও বিয়েটা। আর কাউকে বলো না যেনো আমি এসব করতে বলেছি!”
হিমি ব্যাপারটা বুঝে যায় এবার। ঠোঁট টিপে হেসে বলে,
“বিয়ে ভাঙতে হলে মামানিকে বল। আমি এসবে নেই। পরে দেখা গেলো এ বাড়ি থেকে লাত্থি মেরে বের করে দেয়া হলো আমায়। একটা বাড়ি তো কমে যাবে বল!”
অথৈ জানে হিমির কথায় দম আছে। কিন্তু সে কি করবে? এই লোকটাকে বিয়ে করে যদি জীবনটা তছনছ হয়ে যায় তার! তখন? হিমি একমনে বললো,
“পাত্র কলেজের টিচার। মানুষ হিসেবে ভালো। নম্র, ভদ্র, বড়দের সম্মান করে। আগে কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো না। স্কুল থেকে ভার্সিটি লাইফ অব্দি কোনো খারাপ রেকর্ডও নেই। টিচার হিসেবেও ভালো তবে স্টুডেন্টদের ক্ষেত্রে স্ট্রীক্ট! তাও খুব বেশি না কিছুটা। পারিবারিক ছেলে। সবদিক দিয়ে ভালো বুঝলি!”
অথৈয়ের দিকে ঝুঁকে বললো,
“দেখতেও ভালো একদম তোর ওই বরুণ ধাওয়ানের মতো!”
অথৈ চোখ তুলে তাকায়। বিস্ময় নিয়ে বলে,
“তুমি এতোকিছু কি করে জানলে?”
হিমি সটান খাটে শুয়ে পরে। মাথার নিচে দু হাত রেখে জোড়ালো গলায় বলে,
“বোনের বিয়ে আর আমি ছেলের ঠিকুজি গোষ্ঠী জানবো না? তা হয় না কি? সব খবর আছে আমার কাছে।”
অথৈ মনে মনে হিমির কথাগুলো থেকে চিত্র বানাতে থাকে। হবু বরের চিত্র। যাকে সে দেখে নি। একুশ শতকের মেয়ে হয়েও মাকে বলতে পারছে না, ‘মা! আমি ওনাকে দেখবো। ছবি আছে? ওনার সাথে ব্যক্তিগত কথা বলতে চাই। বিয়ের আগেই’। তবুও আক্ষেপ নেই তার। হিমি যখন বলেছে ছেলে দেখতে শুনতে ভালো তবে ভালো। খারাপ হওয়ার চান্সই নেই। অথৈকে অন্যমনস্ক দেখে হিমি প্রশ্ন করে,
“বিয়ে করবি না তো?”
অথৈ চমকে উঠে। কি বলবে ভেবে পায় না সে। একটু আগেই তো বিয়ে করতে চাইছিলো না এখন কি করে বলে সে বিয়ে করবে? কি করে বলবে, সে ছেলেটাকে রাগি, কর্কশ কন্ঠের ব্যক্তি মনে করে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলো? অথৈর চেহারা দেখে হিমি দুষ্টু হাসলো। কন্ঠ যথাসম্ভব রাগি করার চেষ্টা করে বললো,
“যা গিয়ে ঘুমা। কাল মামানির সাথে কথা বলবো আমি।”
অথৈ কেঁপে উঠে। প্রত্যুত্তর না করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। হিমি বড় গলায় বলে,
“লাইট অফ করে যা।”
অথৈ ফিরে আসে। লাইট বন্ধ করে চলে যেতে নিয়ে হুট করেই বলে উঠে,
“আমি বিয়ে করবো।”
হিমি হাসলো। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো খাটে শোয়া হিমির চোখে মুখে পরে। হিমি উঠে বসে। বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে ডায়াল করে দোহার নাম্বারে। দু বারের মাথায় ফোন রিসিভ করে দোহা। হিমি জানতে চায় সোহিনী কেমন আছে। দোহা জানায় ভালো আছে। এখনো দূর্বল তবে অনেকটাই ভালো। কিছুটা নয় বরং অনেকটাই শান্ত হয়েছে সে। হিমি ফোন কেটে বালিশে মাথা রাখে। গতকাল দুপুরেই সোহিনীকে বাসায় ফিরিয়ে এনেছে হিমিরা। দেখভালের জন্য দোহা থাকছে তার সাথে। হিমি চোখ বোজে। সবাইই সুখী। হিমিও সুখী। তবে বাইরে থেকে। ভেতরটা তো খালি। সুখের অস্তিত্ব নেই সেথায়। সেই ছোট্টবেলা থেকে এবাড়ি ওবাড়ি করছে সে। নিজের বলতে কিচ্ছু নেই, কেউ নেই। বাবাও না।
________________
চোখে আলো লাগতেই ঘুম ছুটে যায় হিমির। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে। হাই তুলে ঘড়ির কাটায় চোখ বুলায়। দরজার বাইরে থেকে কেউ ডাকছে তাকে। হিমি ধীর গলায় বলে,
“ভেতরে আয় মিশু!”
মিশ্মি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে। হিমি উঠে দাঁড়ায়। মিশ্মি তাড়া দিয়ে বলে,
“ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসো। খাবার ঠান্ডা হচ্ছে।”
“খাবো না আমি।”
মিশ্মি শান্ত গলায় কারন জিজ্ঞাসা করলে হিমি বলে,
“ওবাড়িতে যেতে হবে। তাড়া আছে।”
“খেয়ে যাও। টেবিলে সব রাখা।”
মিশ্মির কথার জবাবে কিছু বলে না হিমি। আলমারি খোলে জিন্স আর শার্ট হাতে তুলে। ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলে,
“আমাকে এই ভোর বেলা দেখলে কারো দিনটাই মাটি হয়ে যেতে পারে। বেরুতে হবে আমায়। তুই যা।”
মিশ্মি দাঁড়িয়ে রয়। হিমির কথায় একটুকুও অবাক হয় না সে। এসব তো নিত্যদিনের রুটিন। হিমি যখন তখন যাওয়া আসা করে, কখনো এখানে কখনো ওখানে। কখনো বন্ধুদের সাথে বাইরেই খাওয়া দাওয়া করে সে। কোনোদিনও পানি না খেয়েও দিন কাটায়। হিমির চাল চলন ছেলেদের মতো। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে যেমন রোজ ছুটতে থাকে টিউশন, ভার্সিটি, বন্ধুমহলে ঠিক তেমনি হিমিও ছুটে। শুধু পড়াশোনা করে না সে। দুবছর আগেই স্বইচ্ছায় পড়াশোনা থামিয়ে দিয়েছে। মিশ্মি লম্বা শ্বাস টেনে কাথা বালিশ গুছিয়ে রেখে বেরিয়ে যেতে নিলে ঘরে ঢোকে অথৈ। চোখে মুখে উপচে পরা খুশি তার। মিশ্মি ভ্রু কুঁচকে বলে,
“এতো সকাল উঠে পরলি?”
“হিমি আপু কই?”
মিশ্মি ওড়না ডান কাধে তুলে নিয়ে বলে,
“ফ্রেশ হতে গেছে। ওবাড়িতে যেতে হবে না কি। এখন খাবে না বলছে।”
অথৈর মুখটা ছোট হয়ে যায়। মিশ্মি আদুরে গলায় বলে,
“কি হয়েছে?”
“আমার কিছু জানার ছিলো তো। এখন চলে গেলে জানবো কখন?”
“কি জানার ছিলো?”
মিশ্মি অবাক হয়া গলায় বলে। অথৈ লাজুক হেসে বলে,
“তুই বুঝবি না। আসি আমি।”
মিশ্মি ভ্রু কুঁচকে অথৈয়ের যাওয়ার দিকে তাকালো। গর থেকে বেরুতে নিলে রিংটোনের আওয়াজ পেয়ে পেছন ঘুরে সে। বেড সাইড টেবিলে রাখা হিমির মুঠোফোন তুমুল ধ্বনি তুলে বাজছে। মিশ্মি ওয়াশরুমের দরজায় টোকা দিলে ভেতর থেকে হিমি বলে উঠে,
“ফোনটা তোলে বলে দে আমি একটু পরই আসছি। বড়মা হবে হয়তো!”
হিমির কথা মতো ফোন ওঠায় মিশ্মি। ওপাশের কন্ঠ শোনে চমকে উঠে সে। স্মিত গলায় বলে,
“কে বলছেন?”
“আমি ডাক্তার তাহির! চেনেন নি?”
মিশ্মি জবাব দিলো না। তাহির নিজ থেকেই বললো,
“আসলে সোহিনীর খবর নিতে কল করেছিলাম। উনি ভালো আছেন এখন? কাল হাসপাতালে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি আপনারা ডিসচার্জ করে নিয়ে গেছেন। অনেক খোঁজে কল লিস্টে আপনার নাম্বার পেলাম। হিমি? শুনছেন? হ্যালো!”
চলবে,,,,,,,,,